(১)
-
তুই আন্দাজ করতে পারিস পুকু, পারিস না? কিছু তো আন্দাজ করেছিস বটেই...
-
দাদা, এসব ব্যাপারে আমার বিদ্যে তোমার ধারেকাছেও যায়না। আমি কারবারী মানুষ......
-
দেখ, আমি এই মাঝরাতে আমেরিকা থেকে তোকে এমনি ফোন করিনি, নিশ্চই কারন আছে যথেষ্ট
-
জানি তুমিও ব্যস্ত মানুষ
-
ব্যস্ত কে নয়? কিন্তু সেটা কথা নয়। দেখ পুকু, আমার গত এক বছরের গবেষনা বলছে ও জিনিস
অমূল্য, আর সেই গবেষনা শেষ করতেই ওটা আমার লাগবে।
-
সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে নিশ্চই অমূল্য, কিন্তু দাদা, এটা আমাদের বাড়ির ...
-
বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকি বলে বাড়ির কোনো জিনিসের ওপর আমার অধিকার
নেই বলছিস?
-
দাদা, এমন কথা আমি কখনো বলেছি তোমায়?
-
আমি আসছি, সামনের সপ্তাহেই। ওটা নিয়ে ফিরবো। আপত্তি করিসনা পুকু, ও জিনিসের মূল্য আমার
চেয়ে ভাল কেউ বুঝবে না।
-
কিন্তু ... কিন্তু
-
আর কোনো কিন্তু নয়। গুডনাইট।
(২)
-
অরনী সেনের সঙ্গে কথা বলছি?
-
বলছেন
-
আমার নাম ডক্টর প্রভাস পোদ্দার, আমি কি আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি? একটা
সমস্যায় পড়েই আপনার নম্বর পেলাম এক...
-
আপনি কি আসতে পারবেন আমার অফিসে? না হলে আমিও যেতে পারি
-
সমস্যাটা আমার বাড়ি সংক্রান্ত, কাজেই আমার বাড়িতে আসাটা বোধহয় ঠিক হবে না। তা ছাড়া
আমার ধারনা আমার গতিবিধির ওপরেও কেউ নজর রাখছে, কাজেই আমি একজন প্রাইভেট
ইনভেস্টিগেটরের অফিসে ঢুকছি, এটাও ঠিক কাম্য নয়। অন্য কোথাও বসা যায় কি?
-
আপনি ফ্লুরিজ চেনেন?
-
পার্ক স্ট্রিট তো? খুব চিনি
-
এখন বাজে সাড়ে আটটা, আমার পৌঁছতে ধরুন মিনিট পয়ঁতাল্লিস। চাইলে ওখানে বসে
ব্রেকফাস্ট আর আপনার সঙ্গে কথা দুটোই হতে পারে।
-
সাউন্ড’স গুড মিস্টার সেন। আমি ঠিক সাড়ে নটায় আসছি পনের মিনিট গ্রেস টাইম রইল
-
ঠিক আছে। ফ্লুরিজে ঢুকে আমাকে একটা ফোন করে নেবেন। বাইরে থেকে করবেন না, তাহলে
লোকে বুঝে যাবে আপনি অ্যাপো করে এসেছেন
-
অ্যাপো? মানে? আমি ঠিক...
-
অ্যাপোয়েন্টমেন্ট
-
ও হো। অনেক বছর বাইরে থেকে, নতুন বাংলা গুলো একটু ...
-
হে হে, ন্যাচরালি। হতেই পারে
-
তাহলে সাড়ে নটায় দেখা হচ্ছে মিস্টার সেন। আর হ্যাঁ এই কথা গুলো আপনার আর আমার
মধ্যে থাকাই ভাল। এটা মনে রাখবেন।
-
এটা আমার প্রোফেশন ডক্টর পোদ্দার। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
-
থ্যাংক্যু
-
ও হ্যাঁ আর একটা কথা ডক্টর পোদ্দার, আমার সঙ্গে আর একজন থাকবেন, মানে আমার
স্যাটেলাইট
-
স্যাটেলাইট?
-
সহকারী, আমাকে সাহায্য করেন আর কি
-
গপ্পের গোয়েন্দার মত লাগছে মিস্টার সেন। তা তিনি ভরষার লোক তো?
-
চোখ বন্ধ করে
-
ঠিক আছে, আসুন আপনারা দুজনে, সামনা সামনি কথা হবে তাহলে। এখন রাখি?
(৩)
-
জুতোটা পায়ে বড় অস্বস্তি করছে স্যার
-
কেন কি হলো?
-
বড্ড বড়
-
ছোটো তো আর নয় নিবারনদা, একটু ম্যানেজ করে নাও। পার্ক স্ট্রিটের এই সব জায়গায়
তোমার ওই চপ্পল পরে এলে যদি ঢুকতে না দেয়?
-
তাহলে আসা কেন স্যার? অন্য জায়গায় গেলেও তো চলত
-
ভদ্রলোক বেশ রঈস আদমী মনে হলো নিবারনদা। ডাক্তার মানুষ। উল্টোপালটা জায়গায় ডেকে
শেষে ...
-
টাক মাথা, কানের দু পাশে অল্প কাঁচা পাকা চুল, হাইট আপনারই মত, খুব ফর্সা
-
কিসের কথা বলছ নিবারন দা?
-
আপনার মক্কেল স্যার, বোধহয় এদেশে নতুন আমদানি?দরজার ঠিক বাইরে ট্যাকসি থেকে নামলেন
-
কি করে বুঝলে?
-
আন্দাজ স্যার, এত ফিট ফাট হয়ে কেউ ব্রেকফাস্টে আসেনা শনিবারের সকালে। অন্যদের
দেখুন। ইনি কাজের জন্যেই এসেছেন।
-
আর নতুন আমদানী?
-
ভদ্রলোক নিজে ডানদিকে সরে গিয়ে ওই মহিলাকে বেরোতে দিলেন। আমরা অভ্যেসবশে বাঁ দিকে সরি।
-
দাঁড়াও দাঁড়াও ফোন, উনি ফোন করছেন...... হ্যালো...... ডক্টর পোদ্দার... এই যে, না
না, আপনার বাঁ দিকে... এই যে হাত তুলে...
(৪)
-
আপনার ছোট ভাইয়ের ব্যাবসা ? পৈত্রিক? ওই পোদ্দার অ্যান্ড সন্স?
-
আমাদের ছ পুরুষের ব্যাবসা মিস্টার সেন। তবে হ্যা, পুকু, মানে আমার ভাই প্রকাশ, সে
নিজের চেষ্টায় আমাদের ওই বৌবাজারের পুরোনো দোকান থেকে আজ ব্যাবসাকে এই জায়গায় এনে
দাঁড় করিয়েছে।
-
আরে পোদ্দার অ্যান্ড সন্স জুয়েলার্স তো এখন হাউসহোল্ড নাম মশাই, বঙ্গ জীবনের অঙ্গ।
-
এটা পুকুরই ক্রেডিট। আমার এসব নিয়ে কোনো কালেই উৎসাহ ছিলোনা। আমি আর্টের লাইনের
লোক। নামের আগে ডক্টর দেখে ভাববেন না আমি ডাক্তার, ওটা পিএইচডি।
-
কিছু যদি মনে না করেন ডক্টর পোদ্দার, আপনার প্রোফেশনটা একটু ...
-
না না, এতে মনে করার কি আছে মিস্টার সেন, আমি সারা জীবন প্রোফেসরি করেছি ছবি আঁকা
শেখাতাম, আর শখের আর্ট ক্রিটিক। বিভিন্ন কাগজে ছবি বিষয়ক কলাম লিখতাম, অবশ্য
বেশীরভাগই আমেরিকান, কিছু ব্রিটিশ ও আছে।
-
এখন ? অবসর?
-
ওহ নো নো। নো রিটায়ারমেন্ট । আমি প্রোফেসরি করিনা বটে, তবে আর্টের লাইন
ছাড়িনি, এখনো কলাম লিখি এবং ছবি আঁকি। তা ছাড়া আমার নিজের একটা ছোট গ্যালারি আছে
নিউ ইয়র্ক শহরে। যদিও আমি সেখানে থাকিনা।
-
আপনার পরিবার?
-
আয়াম সিঙ্গল । বিয়েটা টেকেনি। ওদেশের মেয়ে, আমার কালো চামড়া সইতে
পারলনা বেশীদিন। একটি ছেলে আছে, সে ল-ইয়ার। যোগাযোগ বলতে ওই নিউ ইয়ার, বার্থ ডে,
থ্যাংকস গিভিং এই সব দিনে একটা করে ফোন।
-
এবার বলুন , আপনার সমস্যাটা কি
-
একটু ডিটেলে বলি আপনাকে একটু আগে থেকে
-
বলুন
-
দেখুন, আজকের এই যে আমাদের এত বড় ব্যাবসা, চিরকাল এটা এত বড় ছিলোনা।
-
হ্যাঁ আপনার ভাইয়ের চেষ্টায়...
-
নট রিয়্যালি, তারও অনেক আগে। ধরুন আজ থেকে দেড়শো বছর আগে, আমাদের অবস্থা তেমন ভাল
ছিল না, খুবই সাধারন, বলতে পারেন নিম্নবিত্ত
-
আপনার কত পুরুষ আগে হবে সেটা?
- আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা এবং তাঁর বাবার আমল। এই ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার নাম হলো ঈশ্বর গনেশ চন্দ্র পোদ্দার।
- আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা এবং তাঁর বাবার আমল। এই ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার নাম হলো ঈশ্বর গনেশ চন্দ্র পোদ্দার।
-
গনেশ চন্দ্র পোদ্দার? নামটা যেন ... ও, আচ্ছা, এবার মনে পড়েছে মাঝে মাঝে আপনাদের
বিজ্ঞাপনে থাকে বটে, প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে।
-
তা হতে পারে, ও দেশে বিজ্ঞাপন গুলো আমি তেমন দেখতে পাইনা। তবে হ্যাঁ, আমাদের এই
প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ওনাকেই ধরা হয়, যদিও ওনার আগেও আমাদের স্বর্নকারের
ব্যবসাই ছিল। তবে খুব ছোট। মূলধন ছিলোনা। মহাজনের থেকে টাকা ধার নিয়ে সোনা কিনে
তাই দিয়ে কাজ। মজুরির টাকায় মহাজনের সুদ মিটিয়ে সামান্য যা পড়ে থাকে তাই দিয়েই
সংসার চলত।
-
এই গনেশ চন্দ্র পোদ্দার কি ব্যবসার ভোল পালটে দেন?
-
ঠিক সেরকম নয়। উনি অল্প বয়সে ছিলেন বাউন্ডুলে, এবং সংসারের প্রতি কোন টান ছিলো না।
-
পড়াশোনা?
-
সে আমলে যেমন হয় আর কি। তেমন বলার মত কিছু না। স্কুলের গন্ডি পেরতে পারেন নি খুব
সম্ভবতঃ। আমাদের বাড়িতে সে সময় পড়াশোনার তেমন চল ছিলোনা, ওই কারবারের প্রয়োজনে
যতটুকু হয় আর কি। আজও যে খুব একটা আছে এমন নয়, ওই আমিই বলতে পারেন ...
-
আপনার ভাই?
-
সে তো টেনে টুনে বিএসসি। তার পরে ব্যবসায় ঢুকে গেল। গনেশ চন্দ্র পোদ্দার সতের বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালান। মানে নিখোঁজ হয়ে যান।
-
খোঁজাখুঁজি হয়নি?
-
হয়েছিল, কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। বাপের অনেক কষ্টে জমানো কিছু টাকাও হাপিস হয়ে
যায়।
-
তার পর? নিজে থেকেই বাড়ি ফিরে এসেছিলেন?
-
নাঃ তা আসেন নি। তবে বছর পাঁচেক পর, আমাদের ও পাড়ারই এক ভদ্রলোক, তাঁর আবার ছিল
কাপড়ের ব্যবসা, আর সেই সূত্রে বোম্বাই যাতায়াত ছিল, হঠাৎ গনেশ চন্দ্র পোদ্দার কে
আবিস্কার করেন প্রায় ভিখিরির দশায়। তিনিই বুঝিয়ে শুঝিয়ে ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন।
-
আর পালাননি তো?
-
নাঃ তার পর বাড়িতেই ছিলেন। ছেলেকে বাড়িতে রাখার জন্যে বাপ সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেন।
আর সেই সঙ্গে ছেলেকে ব্যবসার কাজেও লাগান
-
উনি অতদিন বোম্বাইতে কি করছিলেন সেটা উনি বলেননি?
-
এই ব্যাপারে গনেশ চন্দ্র ছিলেন একেবারে চুপ। কাউকে একটি কথাও কখনো বলেননি। বোম্বাই
থেকে ফেরার সময় ওনার সঙ্গে ছিল এক খানা শতচ্ছিন্ন ক্যাম্বিসের ঝোলা, আর তার ভেতরে
গুটি কতক অত্যন্ত সাধারন জিনিস। সে ও আমাদের শোনা কথা। তবে হ্যাঁ একখানা জিনিস
ওনার সঙ্গে ছিল, যেটা এখনো আমাদের বাড়িতেই আছে।
-
সেটা কি?
-
একটা ছবি । একটা পোর্ট্রেট। হাতে আঁকা গনেশ চন্দ্র পোদ্দারের
প্রতিকৃতি। আর সেই ছবি নিয়েই কিছু সমস্যায় পড়ে আপনার কাছে আমার আসা।
-
খুলে বলুন কি সমস্যা।
-
দেখুন, প্রথমে ছবিটার একটা বর্ননা দিই। তেল রঙে আঁকা, এক ফুট বাই দেড় ফূট মাপের ছোট্ট
ক্যানভাস। খুব সাধারন সরু কালো কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো। অবশ্য ফ্রেমটা ছবি বাড়িতে
আসার পরে করানো হয়েছে কিনা সেটা আমি নিশ্চিত নই।
-
ছবিটা কার আঁকা?
-
সেইটাই একটা রহস্য । কার আঁকা সেটা ওই ছবির কোথাও লেখা নেই। আমার নিজের
ছবি নিয়ে বরাবরের আগ্রহ ছিল বলে, আমি বহু বার বহু ভাবে ছবিটায় খুঁজে বের করতে
চেষ্টা করেছি, ছবিটা কার আঁকা, কিন্তু কোথাও কিছু পাইনি।
-
একটু আশ্চর্য্যের নয় কি এটা? সে সময় তেল রঙের ছবিতে শিল্পী খুব স্পষ্ট করেই নাম
লিখতেন বলে জানি।
-
সব ক্ষেত্রে নয় । আমার আন্দাজ ছবিটা আঁকা হয়েছিল উনবিংশ শতকের শেষের
দিকে। তবে সত্যিকারের আশ্চর্য্যের যদি কিছু থাকে, তাহলে সেটা ছবিটার ঘরানা। আপনি পোস্ট
ইম্প্রেশনিস্টদের ব্যাপারে কিছু জানেন?
-
আজ্ঞে, মানে, এটা নিয়ে... ঠিক
-
সেটাই স্বাভাবিক। নিতান্ত ছবির জগতের লোক না হলে, ওই আমলের এবং ঘরানার ছবি নিয়ে খুব
বেশী লোকের জানার কথা নয়। শুধু এইটুকু বলে রাখি, উনবিংশ শতকের শেষ দিকে, ইয়োরোপে, প্রধানতঃ
ফ্রান্সে এই ঘরানার চিত্রকরেররা একটা নতুন বিপ্লবই এনে ফেলেন বলা যায়। এনারা
প্রচলিত ধ্যান ধারনা ভেঙ্গে ফেলে...
-
বুঝেছি, একটা শিল্প আন্দোলনের জন্ম দেন এনারা। তা সেই শিল্প আন্দোলনের সঙ্গে এই
ছবির সম্পর্কটা কি?
-
মিস্টার সেন, এই ছবির মধ্যে পোস্ট ইম্প্রেশনিস্টদের ছবির প্রায় সব বৈশিষ্ট
বিদ্যমান। অথচ বোম্বাই তো দুরস্থান, পোস্ট ইম্প্রেসনিজম ফ্রান্সের বাইরে ইয়োরোপের
অন্যান্য দেশে পৌঁছয় মোটামুটি বিংশ শতকের প্রথম দিকে।
-
হুঁ, কিঞ্চিত গোলমেলে। অন্ততঃ সময়ের দিক থেকে। অবশ্য এক যদি না গনেশ চন্দ্র সে
বয়সে ফ্রান্সে পাড়ি দিয়ে ছবি না আঁকিয়ে আনেন।
-
অসম্ভব মনে হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি , এটাই হয়ত একমাত্র সম্ভাবনা।
-
আপনি কি এই ছবিটা সম্পর্কে জানতেই...
-
না না, মিস্টার সেন। ছবির সম্পর্কে জানতে আমাকে কারোর কাছে যেতে হবে না। সেটা
ছবিটা হাতে পেলে আমি নিজেই বের করে ফেলতে পারবো হয়ত। কিন্তু ছবিটা হাতে পাওয়া
নিয়েই সমস্যা।
-
আপনার ভাই কি ছবিটা দিতে রাজি নন?
-
প্রথমে রাজি না হলেও, পরের দিকে সে নিমরাজি হয়। কিন্তু আজ তিন দিন হলো ছবিটা বাড়ি
থেকে বেপাত্তা ...
(৫)
-
কোথায় হাওয়া হয়ে গেলে নিবারন দা, অফিসে ঢুকেই দেখি তুমি নেই
-
এই যে স্যার, নিমাইয়ের দোকানে একটা চা আর ডিম টোস্ট বলে এলাম। ওখানে তো কিছুই খেতে
পারলাম না
-
কেন যে খেলে না সে তুমিই জানো
-
হিঁদুর ছেলে স্যার, এই বয়সে গরু শুয়োর খেয়ে জাত-ধম্ম খুইয়ে ...
-
গরু পেলে কোথায় নিবারনদা? আর শুয়োর শুয়োর কোরোনা তো, বেকন, হ্যাম, সসেজ। তাও ত
চিকেন সসেজও ছিল।
-
না বাবা, কোথা দিয়ে কি হয়ে যায়। আমার নিমাইয়ের দোকানের ডিম টোস্টই ভাল।
-
তাই খাও। এবার বল দেখি, কি বুঝলে?
-
প্রভাস বাবু ছবিটা চান, আর প্রকাশ
বাবু দেবেন না।
-
ব্যাস এই? আর কিছু না?
-
মোদ্দা কথা তো এইটেই বুঝলুম স্যার
-
আর বাকি কথা? ছবি চুরির ব্যাপারটা?
-
গন্ডগোল লাগছে স্যার
-
গন্ডগোল? চুরিটা নিয়ে?
-
না স্যার, এইখানেই তো খটকা। প্রভাসবাবুও বলছেন ছবিটা বেপাত্তা, খুঁজে পাওয়া
যাচ্ছেনা। কিন্তু চুরিটা কেউ তো বলছেন না।
-
সেটা ঠিকই, তবে কিনা আমার মনে হলো প্রকাশ বাবু হয়ত চুরির ভাঁওতা দিয়ে ...
-
সেটা বলার জন্যে যতটা তথ্যপ্রমান লাগে সেটা কিন্তু আমাদের সামনে নেই স্যার
-
তা ঠিক, তা ঠিক, তবে মনে হলো কিনা...
-
ওখানেই খটকা লাগছে স্যার।
-
খটকা?
-
ভেবে দেখুন স্যার, এরকম একটা ঘটনা ঘটলে যেখানে সন্দেহ আপনা থেকেই প্রকাশ বাবুর
দিকেই যায়, সেখানে উনি এইভাবে ছবি হাপিস করবেন কেন?
-
প্রকাশ বাবুর বয়ান, অবশ্য আমাদের সামনে নয়, যেটা ওনার দাদাকে বলেছেন, আর দাদা
বললেন আমাদের, সেটা হলো – ঘরদোর পরিস্কার করা হচ্ছিল, সেই সময় ছবি আসবাব সব কিছুই
এদিক ওদিক করা হয়েছে, আর সেই সবের জন্যেই ছবিটা হয়ত কোথাও ঢুকে গেছে। খুঁজলেই
বেরোবে। এটা কি বিশ্বাস হয়?
-
বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্নই নেই স্যার। আমাদের হাতে কোন পক্ষেরই উপযুক্ত
তথ্যপ্রমান নেই। খুব ভাল হতো, একবার ও বাড়িতে যেতে পারলে।
-
কিন্তু... আমরা ও বাড়িতে ঢুকবো কি ভাবে?
-
একবার স্যার প্রভাস বাবু কে বললে হতো না কথাটা?
-
উনি কি...
-
দেখুন, এই প্রভাসবাবু যতই বিদ্যেধারী হোন আর যাই হোন, ভেতরে ভেতরে কিছু সংস্কার তো
কাজ করছেই স্যার। ভাবুন না, ওনাদের বংশানুক্রমে সকলের ধারনা, ওই ছবি নাকি ওনাদের
পরিবারে সৌভাগ্য বহন করে এনেছে। প্রভাসবাবুও আমাদের সেই কথাই বললেন। ওনার কাজকর্মে
মন্দা চলছে, ধারদেনা হয়ে গেছে বাজারে। ওই ছবি উনি পেলে ওনার ভাগ্য ফিরে যাবে।
-
আর প্রকাশবাবুরও নিশ্চই সেরকমই ধারনা, তাই
ছবিটা উনি হাতছাড়া করতে চাইছেন না।
-
প্রকাশবাবু বা বাড়ির অন্যলোকেদের এই সংস্কার যে আছে সেটা কিন্তু প্রভাসবাবুর মুখেই
শোনা
-
সে তো আমাদের এখনো পর্যন্ত যাবতীয় তথ্যই প্রভাসবাবুর থেকে পাওয়া
-
ওই জন্যেই তো ও বাড়িতে একবার যাওয়াটা খুব দরকার স্যার। না গেলে, পুরো ব্যাপারটা
ঠিক আন্দাজ...
(৬)
-
তুমি গোয়েন্দা লাগিয়েছো দাদা?
-
গোয়েন্দা কোথায় দেখলি পুকু? এনারা প্রোফেশনাল লোক, হারানো জিনিসপত্র খুঁজতে
সাহায্য করবেন, এই টুকুই
-
দেখো দাদা, এই কলকাতা শহরে কে যে কি ধরনের প্রোফেশনাল সে নিয়ে আমার মোটামুটি একটা
ধারনা আছে। ব্যাঙের ছাতার মত ডিটেকটিভ এজেন্সি ছড়িয়ে আজকাল। তাদেরই কাউকে ধরেছ
নির্ঘাত।
-
ঠিক সেরকম নয়, এঁদের রেফারেন্সটা আমি পেয়েছিলাম সুনীলের থেকে, সুনীলেরই ভায়রাভাইয়ের
কেমন যেন...
-
সুনীলদা আবার এর মধ্যে জড়ালেন কবে থেকে দাদা? এটা আমাদের বাড়ির ব্যাপার।
-
আহা সুনীল আমার ছোটবেলার ক্লাসফ্রেন্ড, আর একমাত্র ওর সঙ্গেই তো নিয়মিত যোগাযোগটা
আছে।
-
ঠিক আছে, তুমি যখন সব কিছু ঠিক করেই ফেলেছ, তখন আর আমার কিছু বলার নেই।
-
দেখ পুকু, আমি জানি তুই খুশী নোস, কিন্তু আমার হাতে তো সময় খুবই কম সামনের শনিবার
আমি ফিরছি। কাজের হাতে মাত্র দুটো দিন। বৃহস্পতি আর শুক্র। যা করার এই দু দিনেই।
-
ছবিটা কি দু দিনে আমরা খুঁজে পেতামনা দাদা?
-
এটার গ্যারান্টি কি তুই দিতে পারিস? যদি দিস, আমি স্রেফ একটা ফোন করে অরনি সেন আর
ওর স্যাটেলাইটকে আসতে বারন করে দেবো।
-
স্যাটেলাইট? হা হা হা হা কোথা থেকে আমদানী করলে এদের দাদা তুমি? পারো ও বটে। আসুন
ওনারা কাল। আমিও দেখি সত্যিকারের গোয়েন্দা আর স্যাটেলাইট কেমন দেখতে হয়। আর হ্যাঁ,
এগারোটার পর আমাকে বেরোতেই হবে। আমাদের তিনজনেরই কাল কাজের দিন। ওনারা যদি একটু
সকাল সকাল এসে ...
-
ওরা ৯ টার মধ্যেই আসবে বলেছে।
(৭)
-
কি বুঝলে নিবারনদা?
-
সবচেয়ে আগে যেটা বুঝলাম স্যার, সেটা হলো, ছবি যদি ঘর পরিস্কারের সময় হারিয়ে থাকে,
তাহলে দু দিনের ভেতর পাওয়ার একটা আশা আছে। কিন্তু ওই বিশাল পুরোনো বাড়িতে কেউ যদি
ও ছবি লুকিয়ে রাখতে চায়, তাহলে পুরো ফোর্স এনেও হদিস পাওয়া খুব কঠিন।
-
কি বলছ নিবারনদা? আমাদের প্রথম কেসে এই রকম নিরুৎসাহ করে দিলে?
-
স্যার, সমস্যাটা হারানো ছবি খুঁজে পাওয়া বটে, কিন্তু একটু যদি তলিয়ে ভাবেন, তাহলে
দেখবেন সমস্যার মূল হচ্ছে কারন, বা উদ্দ্যেশ্য। মানে ছবি কি সত্যি হারিয়েছে? নাকি
কেউ সরিয়েছে, এইটাই ত পরিস্কার নয়।
-
আজ যাদের সঙ্গে কথা হলো, তাদের থেকে কি বুঝলে?
-
কথা তো তেমন একটা হলো না স্যার, তবে প্রকাশবাবু, ওনার স্ত্রী নিলিমা আর মেয়ে , এই
তিনজনের বয়ান মোটামুটি সমান। এনারা কাজের মানুষ, এক নিলিমাদেবী ছাড়া বাকি দুজন
কাজের সূত্রে সকালে বেরিয়ে যান আর বাড়ি ফেরেন রাতে। প্রকাশবাবু বোধহয় গয়নার
ব্যাপারে এখনো কাজকর্ম কিছু করেন ব্যাবসার কাজ ছাড়াও, কেননা আঙুলে কালচে ছোপ। নিলিমা
পোদ্দার বাড়িতেই থাকেন বটে বেশীরভাগ সময়, তবে নিজের অফিসে। ঘরের কাজের অভ্যেস কম। আর
ঘর ঝাড়পোঁছের ব্যাপারটা উনিই তদারক করছিলেন।
-
ছবিটা যে নেই, এটা কেউই লক্ষ্য করেননি বলছিলেন। এটা কি একটু আশ্চর্্য্য নয়?
-
খটকা একটা আছেই স্যার। তবে এটাও ভেবে দেখুন, যে ঘরগুলোয় ঝাড়পোঁছ হয়েছে প্রভাসবাবু
আসার জন্যে, সেখানেই ছবিটা ছিলো। অথচ ঘর ঝাড়পোঁছ করে তৈরি হবার পর, সে ছবি যে নেই
এটা কারোর চোখে পড়ল না কেন?
-
হয়ত এনারা নিয়মিত ও ঘরে যেতেন না, তাই নজর পড়েনি।
-
হতে পারে স্যার। বয়ান অনুযায়ী ও ঘরে আগে প্রভাসবাবু ও প্রকাশবাবুর স্বর্গত বাবা মা
থাকতেন। তাই ছবিটা ও ঘরে বহু বছর রাখা ছিল। এমন একটা জিনিস, দেওয়ালে নেই, সেটা কেউ
দেখলো না? দেওয়ালের গায়ে ছাপ নেই কারন এই ঝাড়পোঁছের সময় ঘর রঙ করাও হয়েছে। দেওয়াল
গুলো তাই আনকোরা।
-
আমি কিছুই ভেবে পাচ্ছিনা।
-
কারন আমরা এখনো ভাবতে শুরুই করিনি স্যার। আমরা শুধু হাতে আসা তথ্যগুলো সাজাতে
চেষ্টা করছি। এখনো অনেক ফাঁকফোকর রয়ে গেছে।
-
কাজের লোকেদের সঙ্গে তো তুমিই কথা বললে, আমি সে সময় ছিলাম না ওখানে। ওদের থেকে
কিছু পেলে?
-
কিছু তথ্য পেয়েছি স্যার যেগুলো বেশ ভাল। যেমন ধরুন, আমার ধারনা ছিল, প্রভাসবাবুর
ঘর বন্ধ থাকতো বলে কেউই তাতে ঢুকতো না। কিন্তু মোটা কাজের যিনি লোক, নাম মালতী,
উনি তো অন্য কথা বললেন। ছুটির দিনে, বিশেষ করে রবিবার মাঝে মধ্যেই ওই ঘর খোলা হতো,
এবং প্রকাশবাবু সেখানে ঢুকতেন।
-
কতজন কাজের লোক ওনাদের?
-
এই তো, মোটা কাজের লোক, মালতী, মানে দোতলার ঘর ঝাঁট দেওয়া পোঁছা আর বাসন মাজা, বয়স
ধরুন প্রায় পঞ্চাশ, ও বাড়িতে গত বছর কুড়ি কাজ করছে। এ ছাড়া রান্নার লোক মিনতিদি,
তেনার ও বয়স হয়েছে, ষাঠের কোঠায় বয়স। এ ছাড়া একজন আছে, তার নাম ফুলমতি, সে বাঙালী
নয় যদিও কিন্তু বাংলা কথায় টান নেই কোন। এর বয়স তিরিশের আসেপাশে। এর কাজ নিচের
তলার অফিসঘর ও বসার ঘর ঝাঁট দেওয়া পোঁছা আর কাপড়জামা কাচা, যদিও কাচার কাজ হয় মেশীনে।
এ ছাড়া দু জন দারোয়ান আছে, একজন সকালে আসে, আর একজন রাতে। এরা ভেতরে ঢোকেনা।
-
প্রকাশবাবুর ওই ঘরে যাতায়াতের কথাটা কে বলল?
-
আজ্ঞে মালতী। সে ই বাড়িতে সবচেয়ে বেশী সময় কাটায়।
-
আর কিছু তথ্য যা কাজে আসতে পারে?
-
আজ্ঞে স্যার আমি সব কিছু এই খাতায় লিখে রেখেছি। সকলের বয়ান।
-
ছবিটা শেষ কে দেখেছে?
-
ঘরদোর ঝাড়পোঁছের জন্যে প্রথমে তো বাড়ির কাজের লোকেরাই হাত লাগিয়ে জিনিস পত্র
সরিয়েছে, কারন ঘর রঙ হয়েছে। রঙ করার সমত রঙ এর মিস্ত্রিরা কাজ করেছে, কিন্তু
সেখানে দারোয়ান পাহারায় ছিল। সে কথা সে হলফ কেটে বলছে, যে সারা দিন চেয়ার পেতে ওই
ঘরের সামনেই সে বসে থাকত। কড়া হুকুম ছিল।
-
তাহলে? নিবারনদা? মাথায় কিছু এলো?
-
ঘর রঙ কেন হবে স্যার?
-
আরে পুরোনো বাড়ি, অনেক দিন বন্ধ ঘর, দেওয়াল হয়ত ময়লা হয়ে গিয়ে থাকবে। তাই রঙ করতে
হয়েছে।
-
কিন্তু... কিন্তু...
-
কিন্তু কি নিবারনদা ?
-
নাঃ কিছু না স্যার, এবার বেরোই, প্রায় ন টা বাজতে চলল। আজ আবার বাড়িতে রান্না করবে
না বলে রেখেছে, তড়কা রুটি নিয়ে ঢুকতে হবে।
-
ঠিক আছে, তুমি বেরিয়ে পড়ো… কিছু বলবে?
-
কাল সকালে, যদি আপনি একবার ওই সুনীল্পবাবুর সঙ্গে কথা বলতেন...
-
সুনীলবাবু মানে? প্রভাসবাবুর বন্ধু?
-
আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। আমি গেলে পাত্তা দেবে না, বরং আপনি যান, কি জিজ্ঞেস করবেন, আমি
নাহয় আপনাকে লিখে দেবো
-
ঠিক আছে, আমাকে লিখেই দিও নিবারন দা। কিছু গন্ডগোল লাগছে?
-
সুনীলবাবু প্রভাসবাবুর ছোটবেলার বন্ধু, অন্ততঃ সেদিন যা শুনলাম। ওই বাড়িতেও
যাতায়াত ছিল, তাই ওনার থেকেও হয়ত কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে...
-
বেশ , তাই যাবো
-
নাঃ স্যার, আপনি যাবেন না। আমাকে পাত্তা না দিলেও আমিই যাই
-
তুমি যাবে?
-
আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। আপনি শুধু প্রভাসবাবুর সঙ্গে কথা বলে নিন, উনি যদি একটু আগে
থেকে জানিয়ে রাখেন।
(৮)
-
আমাদের অফিস তো... মানে... আজ একটু দেরি হবে
-
আমি অপেক্ষা করতে পারি
-
আপ... মানে তুমি, প্রকাশবাবুর মেয়ে না? তোমার নাম তো শ্রমনা
-
ঠিক ধরেছেন, আপনার নাম তো অরনি সেন...
-
ঠিক ঠিক তুমি বসো তাহলে, নিবারনদার আসতে আরো হয়ত আধ ঘন্টা, এলেই অফিস খুলবো,
চাবিটা ভুল করে...
-
দেখুন, আপনার সঙ্গেই কথা বলা যেতে পারে, যেটা বলতে এসেছি
-
যেটা বাড়িতে সকলের সামনে বলা যায় না?
-
ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয় অরনি দা... বাই দ্য ওয়ে, আপনাকে অরনি দা বলতে পারি তো?
-
নিশ্চই নিশ্চই, তুমি যে আজকালকার সবার মত শুধু অরনি না বলে অরনি দা বললে, এটা আমার
খুব ভাল লেগেছে। বলো তুমি কি বলতে চাও
-
সেরকম কিছু না অরনি দা। আমি শুধু এটাই বলতে চাই, যে আপনারা যা ভাবছেন, তা হয়ত ঠিক
নয়, আমার বাবা কিন্তু ছবিটা সরায়নি।
-
কি করে বুঝলে যে আমরা তোমার বাবাকেই সন্দেহ করছি?
-
সেটাই কি স্বাভাবিক নয় ? বলুন তো? ওই ছবি আমাদের পারিবারিক ব্যবসায় সৌভাগ্য নিয়ে
এসেছে। এ ছবি কেউ হাতছাড়া করতে চাইবে না। সবাই ভাবছে আমার বাবা হয়ত ছবিটা জ্যেঠুকে
দিতে চায়না তাই লুকিয়ে রেখেছে...
-
সবাই যেটা ভাবে আমরাও সেটা ভাবি এরকম না ও হতে পারে
-
আমি আপনাকে অনুরোধ করছি অরনি দা, আপনারা একটি বার আমাদের বাড়িতে আসুন, একবার আসুন
ভাল করে খুঁজে দেখুন, আমার মনে হয় ছবিটা নিশ্চই কোথাও পড়ে আছে। ঠিক খুঁজে পাওয়া
যাবে।
-
এত নিশ্চিত হয়ে এ কথা কি করে বলছ শ্রমনা?
-
কারন আমি আমার বাবা কে চিনি। উনি চোর নন, মিথ্যেকথা বলার লোক নন, উনি ... উনি...
-
কি হলো?
-
কিছু না, কিন্তু আমি তো এত বছর ধরে মানুষটাকে চিনি। আমি জানি আমার বাবা চোর নন।
-
তুমি কি করো শ্রমনা?
-
আমি? আমি চাকরি করি। ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে। সারা দিনটা আমার ওখানেই কাটে।
-
ছবিটা নিয়ে তোমার কোন কথা ... বলার মত
-
দেখুন ছোট থেকে দেখে আসছি ছবিটা। কাজেই সেই ভাবে হয়ত খুব মন দিয়ে দেখিনি। তবে
হ্যাঁ ছবিটা সম্পর্কে একটা ধারনা তো আছেই। পোর্ট্রেট হিসেবে বেশ অন্য রকম মানে
আগেবার মানুষদের যেমন ছবি আঁকা হতো তার চেয়ে অনেক আলাদা। আর তা ছাড়া ছবিটা গনেশ
চন্দ্রের খুব কম বয়সের।
-
আপনার ছবি নিয়ে আগ্রহ আছে?
-
না, মানে ঠিক তেমন নেই। তবে ওই কাজের খাতিরে যতটুকু খোঁজ রাখতে হয় আর কি।
-
সেই সুত্রেই কিছু চোখে পড়েনি কখনো?
-
না... মানে সেরকম কিছু তো চোখে পড়েনি।
-
বেশ। তুমি বোসো তাহলে... চা খাবে?
-
আমি বরং এখন আসি অরনিদা, কেননা আমি সোজা অফিসে যাবো, আপনাকে তো সবই বললাম। সত্যি
আমার বাবা কিন্তু...
-
ঠিক আছে, তোমার কথা আমি মাথায় ...
(৯)
-
নমস্কার সুনীলবাবু, আপনি আমাদের কথা নিশ্চই শুনেছিলেন আগেই প্রভাসবাবুর কাছে
-
হ্যাঁ হ্যাঁ আমার সঙ্গে প্রভাসের কথা হয়েছে। কিন্তু... আমি কি ভাবে আপনাদের ...
সেটা ঠিক...
-
আমাদের মানে আপাতত আমিই, কেননা আমার স্যার অন্য
জায়গায় ব্যাস্ত। তাই আমি ভাবলাম যদি একবার আপনার সঙ্গে কথা বলা যায়।
-
বলুন।
-
কিছু তথ্য সুনীলবাবু, আর কিছু সাধারন প্রশ্ন
-
আমি কি উত্তর দিতে বাধ্য এই জেরার?
-
আপনি খামোখা ভুল বুঝছেন সুনীলবাবু, এরকম একেবারেই নয়, জেরা কখনোই নয়। আপনি পন্ডিত
মানুষ, অন্ততঃ আপনার এই বসার ঘরের বইয়ের আলমারি ভর্তি বই সেরকমই বলছে, আর ...
-
আর?
-
আর আপনি পোদ্দার পরিবারের একজন শুভাকাঙ্খী, ও বাড়িতে সকলেই আপনাকে শ্রদ্ধা করে,
কাজেই আপনার একটা...
-
ঠিক আছে, বুঝেছি। বলুন কি জানতে চান।
-
আপনি ছবিটা দেখেছেন?
-
হ্যাঁ অনেক বার দেখেছি
-
কিছু বর্ননা দিতে পারেন?
-
কেন, আপনি অন্যদের কাছে সে বর্ননা পাননি?
-
নিশ্চই পেয়েছি, তবে আপনি যদি কিছু আলাদা করে ...
-
তারা কি বলেছে তা তো জানিনা, আর ও ছবির মধ্যে আলাদা করে দেখার মত কিছু ছিল বলেও
মনে হয়নি। আসলে আমি ছবি টবি এসব একেবারেই বুঝিনা।
-
আপনি তাহলে... মানে আপনি কি ...
-
আমি কি করি বা করতাম? পেশাগত ভাবে? আমি অ্যাকাউন্টেট ছিলাম চাকরি জীবনে।
-
কোথায়?
-
ওঃ সে জায়গা সবাই চেনে। ঐ তো আমাদের মিউজিয়ামে। তবে আমার কারবার শুধুই টাকা পয়সা
ব্যালেন্স সিট নিয়ে।
-
বুঝেছি
-
আর কিছু?
-
ইয়ে... মানে ... আপনার কাউকে সন্দেহ ...
-
দেখুন, আমার মনে হয় এবারে জেরাটা ভদ্রতার সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে।
-
না, মানে, ঠিক আছে।
-
নমস্কার। আপনি আসুন এবার তাহলে।
(১০)
-
আচ্ছা অভদ্র লোক নিবারনদা। কিছুই তো বলল না, তার ওপরে তোমাকে প্রায় বেরই করে দিল
বাড়ি থেকে।
-
ওটা স্যার গায়ে মাখবেন না। এ লাইনে এসব অভদ্র লোকেদের সংখ্যাই বেশি। কদিন যাক দেখবেন
অভ্যেস হয়ে গেছে।
-
কিস্যু পাওয়া গেল না লোকটার থেকে, শুধু এটা ছাড়া যে মিউজিয়ামে অ্যাকাউন্ট্যান্ট
ছিল? এখন রিটায়ার্ড। তোমার আসতেও এত দেরি হলো, আমি তো বাইরের রকে বসেই আছি।
-
কিছু না স্যার ওদিকে একটা কাজ সেরে এলাম, পুরোনো জায়গায়
-
থানায়? এদিকে এখানে আবার শ্রমনা এসেছিল।
-
শ্রমনা মানে? প্রকাশবাবুর মেয়ে? তার পর? ফোন করেননি কেন?
-
যা বলার সে আমাকে বলে গেছে
-
কি বলল?
-
তেমন কিছু না, এটাই বলে গেল বার বার করে যে ওর বাবা চুরি করেন নি।
-
তার স্বপক্ষে কোন প্রমান?
-
কিছুই না
-
আর কিছু?
-
বলল আপনারা আসুন , খুঁজে দেখুন, ঠিক পেয়ে যাবেন।
-
কিন্তু কেন?
-
মানে? কেন বলল খুঁজে দেখতে? কারন আমরা ছবিটা খুঁজছি। তাই বলল খুঁজে দেখতে।
-
স্যার...... একটা ......
-
বলো নিবারনদা, খটকা লাগছে কোথাও?
-
আমরা তো ছবিটাই খুঁজছি স্যার। মেয়েটা ঠিকই বলেছে।
-
শ্রমনা কোথায় চাকরি করে স্যার? ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে না?
-
হ্যাঁ , ও তো এখান থেকে সোজা মিউজিয়ামেই গেল।
-
হুঁ, এই দিকটা মাথায় আসেনি আগে ...
-
ধুস, কি বলছ আমি কিছুই বুঝছি না নিবারন দা।
-
স্যার, প্রভাস বাবুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করুন, আজ সন্ধ্যেবেলা, বাড়িতে ওনারা কখন
সবাই থাকবেন। কেননা প্রভাস বাবুর ঘর ভাল করে খুঁজে দেখতে হবে। আমরা যাবো খুঁজে দেখতে।
আর ...
-
আর?
-
প্রভাস বাবুকে বলুন, আমরা যে ওনার ঘর তল্লাসি করব আজ, সেটা যেন উনি সবাইকে বলে রাখেন।
মানে বাড়ির লোক।
-
কি ভাবছো বলো তো?
-
সব বলব স্যার। আর আপনি প্রভাস বাবুকে বলুন, উনি যেন বিকেলে একবার বেরিয়ে ছবি প্যাক
করে ওনার দেশে নিয়ে যাবার জন্যে একটা ভাল ব্যাগ কিনে আনতে।
-
ছবি কোথায় তুমি কি জানো নিবারনদা?
-
ছবি কোথায় জানিনা, তবে আশা করছি আজ রাতের মধ্যে ছবিটা প্রভাসবাবু পেয়ে যাবেন।
-
এত নিশ্চিত হয়ে কি করে বলছ নিবারনদা?
-
আমি খুব বেশী হলে ২০% নিশ্চিত স্যার
-
এর ওপর ভরসা করে তুমি আমাকে বলছ ওনাদের ফোন করতে?
-
কি আর হবে স্যার? খুব বেশী হলে ছবিটা পাওয়া যাবে না, এই তো? সে তো আমরা চুপচাপ বসে
থাকলে এমনিতেই পাওয়া যাবে না স্যার।
-
অভয় দিচ্ছ?
-
দিচ্ছি স্যার, আপনি ফোন্ করুন। আমি একটু বেরোই। আজ কয়েকটা ব্যাপারে একটু নজর রাখার
আছে। আর হ্যাঁ, একটা ছেলেকে লাগাচ্ছি নজর রাখতে। হয়ত কিছু টাকা...
-
হয়ে যাবে নিবারন দা। আমেরিকান ক্লায়েন্ট, সাকসেস এলে মোটা পয়সাই দেবে আশা করি।
(১১)
-
আপনাকে যে কি বলে ...
-
না না, এ কি বলছেন প্রভাস বাবু, আমাদের তো কাজই এই
-
আপনার স্যাটেলাইট কে দেখছিনা... তিনি আসেন নি?
-
এখনো তো আসেনি, মাঝে মাঝে দেরি করে। টুকটাক কাজ ও থাকে।
-
আমি ভাবতে পারিনি, ছবিটা শেষে কিনা বেরোবে আমার খাটের গদির তলা থেকে। আপনি যে কি
ভাবে এটা করলেন, কান্ট বিলিভ ... এইটা রাখুন, আপনাদের পারিশ্রমিক।
-
ইয়ে , মানে ...
-
কম ? আরো কিছু কি...
-
একদম না প্রভাস বাবু। যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক আপনি দিয়েছেন। আর সেই সঙ্গে আমরা পেলাম
অভিজ্ঞতা
-
কিন্তু কি করে বুঝলেন বলুন তো, যে ছবিটা ঘরেই কোথাও আছে? আমি তো ...
-
দেখুন প্রভাসবাবু, আমরা অনেক গুলো সম্ভাবনার কথাই ভেবেছিলাম। কিন্তু মেথড অফ
এলিমিনেশন ইউজ করে...
-
ট্রুলি ইম্প্রেশড। কাল রাতে ছবিটা পেয়ে উত্তেজনায় ঘুম হয়নি আমার। আজ তো দুপুরেই
ফ্লাইট। আমি ট্যাক্সি নিয়েই এসেছি এখানে। আপনার সঙ্গে দেখা করেই সোজা এয়ারপোর্ট
যাব।
-
হ্যাভ আ সেফ জার্নি প্রভাসবাবু।
-
ওঃ আর একটা কথা ... এইটা রাখুন
-
এটা কি প্রভাস বাবু
-
আ নোট অফ অ্যাপ্রিশিয়েশন অ্যান্ড রেকমেন্ডেশন। আপনি যে দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করেছেন
, সেটা নিয়ে দু কলম লিখে আপনাকে রেকমেন্ড করেছি। এ ধরনের জিনিস আমেরিকায় খুব চলে।
-
অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রভাস বাবু।
-
আমি তাহলে আসি মিস্টার সেন। আবার দেখা হবে কখনো দেশে এলে। আপনার স্যাটেলাইটের সঙ্গে
তো দেখা হলো না। ওনাকে বলবেন আমার শুভেচ্ছা আর গ্র্যাটিচিউড...
-
নিশ্চই নিশ্চই। বিলক্ষন।
(১২)
-
কোথায় থাকো নিবারনদা ? প্রভাস বাবু এসেছিলেন, অনেক ধন্যবাদ দিলেন, তোমাকেও খুঁজছিলেন।
-
শুধু ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলেন স্যার?
-
যাঃ কি যে বলো না তুমি ! এই দেখো, খামের ভেতর ক্যাশ পঞ্চাশ হাজার দিয়ে গেছেন।
-
ওরেব্বাবা স্যার, এ তো অনেক টাকা। এত টাকা ... একটু ...
-
শাঁসালো মক্কেল নিবারনদা ... আমেরিকান... এদের হাতে টংকা ঝরে
-
আমরা ছবি খুঁজে দেবার পারিশ্রমিক পেলাম, তাই তো স্যার?
-
আবার হেঁয়ালি... কাল থেকে তুমি বড্ড হেঁয়ালি করছ নিবারনদা, একটু ঝেড়ে কাশো দিকি...
-
গরু শুয়োর ছাড়া পার্ক স্ট্রিটে একটা ভাল খাবার জায়গা বলুন না স্যার, বৌ আর মেয়ে কে
নিয়ে খেতে আসবো।
-
কথা ঘোরাচ্ছো নিবারনদা।
-
বলুন না। কখনো আসিনি ওদের নিয়ে।
-
বার-বি-কিউ যেতে পারো। ওদের ওখানে পর্ক থাকলেও খুব লিমিটেড, আর বলে দিও যে পর্ক খাবেনা,
সেই মত ওরাই সাজেস্ট করে দেবে। এবার প্লিজ ঝেড়ে কাশো নিবারনদা।
-
সব বলব স্যার। আপনি শুধু আর একটা কাজ করবেন। প্রকাশবাবুর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট
নেবেন।
-
প্রকাশ বাবু? সে কি? কেন? ওনাদের আবার টানাটানি কেন?
-
খটকা স্যার, ছবির ব্যাপারে খটকা আছে।
-
এখনো? ছবি তো একটু পরেই দমদম থেকে উড়বে।
-
তাও আছে স্যার। আপনি প্রকাশবাবু কে বলবেন না ছবির ব্যাপারে দরকার। বলবেন অন্য একটা
কেসে গয়না সংক্রান্ত কিছু ব্যাপারে একটু সাহায্য দরকার। উনি এ ব্যাপারে অথরিটি,
কাজেই...
-
পাত্তা দেবে? ব্যাস্ত মানুষ...
-
আপনাকে পাত্তা দেবে স্যার, আপনার হাইট, চেহারা, সব কিছুই সাধারন বাঙালির চেয়ে
অনেকটা আলাদা, আপনাকে সহযেই চোখে পড়ে, আর লোকে পাত্তাও...
-
আবার ???
-
ফোন স্যার... প্রকাশবাবুকে...
(১৩)
-
জানতাম গয়নার ব্যাপার, অন্য কেস, এগুলো সত্যি নয়। তবুও জাস্ট আউট অফ কিউরিওসিটি...
-
দেখুন প্রকাশবাবু, আমিই বলি, আমার নাম ...
-
নিবারন পোল্ল্যে, গোয়েন্দা অরনি সেনের স্যাটেলাইট।
-
আজ্ঞে ঠিকই... আপনি মনে রেখেছেন আমার মত ...
-
সিধে কাজের কথায় আসুন নিবারন বাবু, আমার অফিসে্র চেম্বারে আমার সঙ্গে দেখা করার
জন্যে অনেক লোক...
-
ছবিটাকে পুরোনো সাজাতে কার কার সাহায্য নিয়েছিলেন প্রকাশবাবু?
-
মানে? ক্কি ক্কি ক্কি বলতে চান ? দিস ইজ ইনসালটিং... আপনি জানেন... আপনাকে ...
-
শান্ত হোন প্রকাশবাবু, আমি কিছুই করবো না, কাউকে কিছু বলবও না। এমনকি আপনি যে কাজ
করেছেন, তার ওপরে আমার এবং আমার স্যারের নৈতিক সমর্থনও আছে। কিন্তু আপনার মুখ থেকেই
পুরোটা শুনতে চাই।
-
কিসের নৈতিক সমর্থনের কথা বলছেন নিবারন বাবু?
-
পুরোনো দুর্মূল্য শিল্পকর্মকে বিদেশে পাচারের হাত থেকে রক্ষা করা।
-
আপনি জানেন সেটা?
-
জানতাম না প্রকাশবাবু, তবে এখন জেনেছি।
-
দেখুন ছবিটা দাদা নিয়ে যাক, এটা কেউ চায়নি।
-
কেউ বলতে?
-
আমি, আমার পরিবারের বাকিরা ...
-
আপনারা কি ছবিটার সম্পর্কে আগেই জানতেন?
-
না না, আগে কেউ কখনো ছবিটা নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। আমরাও জেনেছি সম্প্রতি...
-
কে জানতে পারল প্রথম? কি ভাবে?
-
দেখুন আমার মেয়ে তো এই সব নিয়েই পড়াশোনা করেছে। এবং ওর কাজও ছবি নিয়েই। সে ই প্রথম
ছবিটা নিয়ে চর্চা শুরু করে। এবং তাতে সময়ও লাগে অনেক।
-
ছবিটা আসলে কি প্রকাশবাবু?
-
গনেশ চন্দ্রের পোর্ট্রেট। কিন্তু শিল্পীর পরিচয় শুনলেই ছবিটার দাম বহুগুনে বেড়ে
যায়।
-
একটু যদি বলেন... শুধু কৌতূহল থেকেই জিজ্ঞেস করছি
-
আপনি যদি এত দূর জেনে থাকেন নিবারন বাবু, তাহলে আমার মনে হয়, বাকিটুকু জানার অধিকারও
আপনার আছে।
-
বলুন
-
দাদাও ছবিটার সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। আমরা যা জেনেছি, হয়ত পুরোটাই। কেননা ও আর্টের
লাইনের লোক। গনেশ চন্দ্র বাড়ি থেকে পালান সেটা তো আপনারা জানেন। কিন্তু কোথায় গিয়েছিলেন,
সে ব্যাপারে আমরা কেউই পরবর্তীকালে কিছু জানতে পারিনি। এতকাল বাদে, ছবিটা খুঁটিয়ে
পরীখা করে আমার মেয়ে...
-
শুধুই মেয়ে? না আরো কেউ ছিল প্রভাসবাবু?
-
আমার মেয়ে খুব শার্প, খুব ব্রাইট...
-
আমাদের অফিসে গিয়ে স্যারকে বোঝানো, যে ছবিটা বাড়িতেই আছে, খুঁজলেই বেরিয়ে যাবে,
ওটা কি ওরই ...
-
কিছুটা ওরই, বাকিটা ...
-
সুনীলবাবু?
-
আপনি আন্দাজ করলেন কি করে?
-
সুনীলবাবু আমাকে বলেছিলেন উনি মিউজিয়ামে অ্যাকাউন্টস বিভাগে কাজ করতেন। উনি জানতেন
না, আমিও কলকাতা পুলিশে দীর্ঘকাল চাকরি করে অতি সম্প্রতি অবসর নিয়েছি, আর কিছু
কনত্যাক্ট আমার ও আছে। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, সুনীলবাবু কখনোই অ্যাকাউন্ট্যান্ট
ছিলেন না। ওনার কাজ ছিল পুরোনো ছবির রেস্টোরেশন। আপনার মেয়েও এখন ওই কাজটিই করেন। উপরন্তু
সুনীল্বাবু ছবির ব্যাপারে একজন অথিরিটি।
-
পাকা হাতের কাজ আপনার নিবারন বাবু। ঠিকই ধরেছেন। গনেশ চন্দ্রের ছিল চিত্রকর হবার
বাসনা। আর সেই শখ পূরন করতেই উনি পাড়ি জমান ফ্রান্সে। আর আর এই ছবির যে ফ্রান্সে বসে আঁকা আর সেটাও আঠেরোশো
আশীর দশকের প্রথম দিকে, এটা সুনীল বাবুই প্রথম ধরতে পারেন ছবিটা রেস্টোর করার সময়।
অনেক পুরোনো ছবি, তাই মনে হয়েছিল রেস্টোর করানো দরকার।
-
তার পর?
-
আমার মনে হয়, দাদাকে সুনীলবাবু হয়ত ছবিটা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেশ করে থাকবেন। কেননা
উনি দাদার ক্লাসফ্রেন্ড। দাদা হয়ত আগে ছবিটা নিয়ে ভাবেনি কখনো, কিন্তু এখন সূত্র
পেয়ে দাদা দুইয়ে দুইয়ে চার করতে বেশী সময় নেয়নি। আর গত দেড় বছর ধরেই আমার কাছে ছবিটা
ইনিয়ে বিনিয়ে চেয়ে আসছিল।
-
আপনি দিতে রাজি হন নি।
-
না, তবে সেটা আমাদের পরিবারে চলে আসা সংস্কারের কারনে কিন্তু নয় মিস্টার পোল্ল্যে।
কেননা আমার ওসব সংস্কার নেই। এটা একটা অত্যন্ত দামী পুরোনো শিল্পকর্ম। এর স্থান
হতে পারে মিউজিয়ামে বা সরকারি কোন প্রদর্শনশালায়। আমেরিকান ডলারে কিনে কোন বিলিওনিয়ারের
বৈঠকখানায় থাকার কথা নয় এ ছবির।
-
সুনীল বাবু সেদিন সন্ধ্যেবেলায় আপনাদের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। কিছুই বলেননি, শুধু
একবার রসিকতা করে প্রভাসবাবুকে বলছিলেন এই খট্টাঙ্গ পূরান কথন শেষ হবে। তখনো ছবিটা
আমরা পাইনি।
-
আমরা ভয় পাচ্ছিলাম, আপনারা যদি না পান, তাহলে কি হবে।
-
ওনার কথা শুনেই আমি খাটের তল্লাসি নিই, এবং আমার মনের খটকাটা ঘোরতর সন্দেহতে
বদলায়, যে আপনারা চাইছেন যে ছবিটা আমরা খুঁজে পাই ওখানেই।
-
আসল ছবি ওই জন্যেই বাড়িতে রাখিনি। ওটা এখানে আমার অফিসে।এই আমার ডেস্কের ভেতরে
চাবি বন্ধ অবস্থায় রাখা। এ ছবির দাম এখন কোটি কোটি টাকা।
-
একবার দেখা যেতে পারে ছবিটা?
-
নিশ্চই মিস্টার পোল্ল্যে, দাঁড়ান আমি বের করছি। রেস্টোর করতে গিয়ে পুরোন ময়লা আর সস্তার
কাঠের ফ্রেমের আড়াল থেকে শিল্পীর নাম বেরিয়ে আসে। পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রকরদের
ভেতর সবচেয়ে নামকরা পেইন্টার ভিনসেন্ট ভ্যান গোর আঁকা গনেশ চন্দ্রের পোর্ট্রেট। তখনো
অবশ্য তিনি দক্ষিন ফ্রান্সে গিয়ে তাঁর সেরা ছবি গুলো আঁকেননি। পোস্ট ইম্প্রেশনিজম
সবে টলোমলো পায়ে হাঁটার চেষ্টা করছে, তবুও...
-
অপূর্ব...
(১৪)
-
তোমাকে ছাড়া আমার কি হবে নিবারনদা?
-
ছাড়বেন কেন স্যার?
-
পাঁচ মিনিটে তুমি নিবারন বাবু থেকে মিস্টার পোল্ল্যে হয়ে গেলে এটা লক্ষ্য করেছ? এর
পর কি আর...
-
আপনার মত গোয়েন্দা পাচ্ছি কোথায় স্যার? আর গোয়েন্দা না থাকলে শুধু স্যাটেলাইট...
-
আবার সেই এক কথা তোমার... ছাড়ো তো ওসব, আমাকে একটা জিনিস বলো, তুমি ধরলে কি করে
গোটা ব্যাপারটা
-
তেমন কিছু না স্যার। সন্দেহ শুরু হয় সুনীলবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওনার সম্পর্কে খোঁজ
নিতে গিয়ে। যেহেতু উনি কিছু বললেন না, তাই খটকা লাগছিল, যে ভদ্রলোক কি কিছু চেপে
যেতে চাইছেন? খোঁজ নিয়ে জানলুম উনি মোটেই অ্যাকাউন্ট্যান্ট নন। তার পরে যখন শুনলাম
শ্রমনা এসে বার বার করে বলেছে ওর বাবা দোষী নন, আর ওদের বাড়িতে খুঁজে দেখতে তখন
সন্দেহ পাকা হলো। তার মানে ওরা চায় আমরা ছবি খুঁজে পাই।
-
তার পর?
-
আপনাকে দিয়ে ফোন করালাম, যে আমরা যাচ্ছি। যদি সন্দেহ সত্যি হয়, তাহলে ওরা ছবিটা এমন
জায়গায় রাখবে যেখান থেকে পাওয়া খুব সহজ। নিশ্চিত হতে প্রভাসবাবুকে বাড়ি থেকে
বেরোতেও বললাম, যাতে ঘর খালি থাকে। আর...
-
আর দু জনের ওপরে নজর রাখলাম স্যার। এক প্রকাশবাবু আর দুই শ্রমনা। শ্রমনার ওপর নজর
রাখতে আমার পরিচিত একটি ছেলেকে লাগালাম। ওকে কিছু দিয়ে দেবেন স্যার কাল আসতে বলেছি।
আর প্রকাশবাবুর ওপরে নজর রাখলাম আমি। দেখলাম সন্দেহ মিলে গেল। বাপ বেটি দুজনেই
মিউজিয়াম আর জুয়েলার্সের অফিস থেকে বিকেলের একটু আগে একই সময়ে বেরিয়ে বাড়ি ফিরলো।
-
এবার কিছুটা আন্দাজ পাচ্ছি।
-
আর ছবি খুঁজতে শুরু করে খুব আনাড়ির মত আধ ঘনটা এদিক ওদিক করলাম। ছবিটা দেওয়ালে যেখানে
আগে টাঙানো ছিল, তার ছাপ মুছে দিতে ঘরে রঙ হয়েছে। যাতে পরে ছাপ দেখে কারোর মনে না
পড়ে যে ছবিটা নেই। কাজেই এটা ওনারা বলতে পেরেছিলেন যে ছবিটা নেই সেটা চট করে কেউ
লক্ষ্য করেনি। সুনীল বাবু টিটকিরি মারার ঢং এ জিজ্ঞেস করলেন এই খট্টাঙ্গ পূরান কখন
শেষ হবে। খট্টাঙ্গ পূরান ঠাট্টার বিষয় স্যার। গোপালভাঁড় পড়েছেন তো? কিন্তু আমি
সূত্র পেয়ে গেলাম। মিনিট পনের এদিক সেদিক দেখে খাট খুলিয়ে দেখলাম, ছবি কাঠের পাটাতনের
ওপর। ধুলোয় ধুলো।
-
এই ছবি কি নকল? প্রভাসবাবু এত বড় বোদ্ধা হয়েও বুঝলেন না?
-
উনি খুঁটিয়ে দেখলেন কই স্যার? ছবি পেয়েই আত্মহারা হলেন। ছবিটা অবশ্য নিখুঁত ভাবে
আঁকা, আর শ্রমনা, সুনীলবাবুর হাতে পড়ে সে ছবি পুরোনো রূপ ও পেয়েছে। ওনারা পুরোনো ছবিকে
রেস্টোর করেন। এবার নতুন ছবিকে পুরোনো করে দেখালেন। কিন্তু ফ্রেমের পেছন দিকে এক
জায়গায় খুব হালকা করে এক ছিটে হলদে রং লাগা ছিল। সেটা হয়ত দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে
সকলের। প্রভাসবাবু ভাল করে দেখলেই ধরে ফেলবেন ছবিটা নকল।
-
তবুও প্রভাসবাবুর মত ওস্তাদ বোদ্ধাকে অন্ততঃ কিছুক্ষনের জন্যে হলেও বোকা বানানো, খুবই
কঠিন... এমন সুন্দর করে ছবিটা আঁকলো কে নিবারনদা? এরকম হাত কার ?
-
এখনো বোঝেন নি স্যার? প্রভাসবাবু শিল্পী হলেন, আর প্রকাশ বাবু ব্যাবসাদার। বাপের ব্যাবসা
সামলাতে গিয়ে তাঁর আর শিল্পী হওয়া হয়নি জীবনে। দাদাকেই লোকে শিল্পী বলে চিনল। দাদা
ব্যবসাদার ভাইকে একটু হেয় নজরেও দেখেন। কিন্তু ভেতরের আর্টিস্ট তো মরে না। তাই
অন্ততঃ একবার সুযোগ পেয়ে, দাদাকে ঘোল খাওয়ালেন প্রকাশবাবু।
-
মানে?
-
নকল ছবি প্রকাশ বাবুর আঁকা স্যার। উনি খুব বড় আর্টিস্ট, না হলে এই দরের কাজ কেউ
পারেনা। প্রথম দিনেই দেখেছিলাম ওনার হাতে কালচে ছোপ। ভেবেছিলাম গয়নার কাজও হয়ত
করেন। ওগুলো যে তেল রঙের ছোপ তা বুঝিনি।
-
পোদ্দারের প্রতিকৃতি তার মানে দু খানা। একটা গনেশ চন্দ্র পোদ্দারের, আর একটা, অন্য
অর্থে দেখলে প্রকাশ চন্দ্র পোদ্দারের।
-
মোক্ষম বলেছেন স্যার।
দারুন। এর বেশি হয়তো কিছুই বলার থাকতে পারে না। আরো রঙ লাগুক নিবারণ পোল্ল্যের চরিত্রে।
উত্তরমুছুনকিছুটা পরীক্ষামূলক লেখা। একটু ভারসাম্যের অভাব ও রয়েছে।
মুছুনOshadharon!!!
উত্তরমুছুনম্যাজিক কে আমি এই গল্পের অনেক আগে রাখব । তবুও ভাল লেগেছে জেনে আমার ও ভাল লাগল। এই লেখাটা বহু দিন ধরে আটকে ছিল। অবশেষে দিনের আলো দেখলো।
মুছুনপড়লুম।
উত্তরমুছুনযারা গোয়েন্দা গল্প লেখেন, যেমন মানিকবাবু, ডয়েল দা, শরদিন্দু বাবু, মায় অদ্রীশ বর্ধন - এদেরকে আমি সবসময়ই একটা আলাদা সারিতে বসাতাম, কারণ আমার মনে হত যে, যে গল্পগুলো পড়ে আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করে, সেগুলো যারা লিখছেন, তাদের মস্তিষ্ক কি বস্তু দিয়ে তৈরি!!
যদিও তুমি আগে নিবারণ পোল্ল্যে কে নিয়ে লিখেছো, কিন্তু আজকেরটা সেগুলোকে ছাপিয়ে গেলো গল্পের আঙ্গিকে আর জট পাকানো আর ছাড়ানোর দক্ষতায়!
বেশ কয়েকজন বুদ্ধিমান/বুদ্ধিমতী চরিত্র, তাদের সংযমী সংলাপের মাধ্যমে রহস্যটা বুনে তুলেছিল নিখুঁতভাবে। আর "লগবগে"-রুপী নিবারণ পোল্ল্যে সেটাকে ছাড়ালেন নিখুঁতভাবে।
আর গল্পে স্যাটেলাইটের এথিকাল/আনএথিকাল বাউন্ডারির বিচারক্ষমতা এটার মধুরতা বাড়িয়ে দিল অনেকটাই, অন্তত আমার কাছে।
আজ থেকে তুমিও মানিকবাবুদের সারিতে বসে গেলে।
এই প্রথম হয়ত একটা লেখা ব্লগে দিলাম, যেটা আমার নিজেরই মনঃপুত নয়। তবুও দিলাম পাঠকের চোখে কেমন লাগে দেখতে।
মুছুনলেখার আঙ্গিক বদলেছি। সাধারনতঃ চুটকি অনুগল্পের আঙ্গিকে লেখা এটা। বর্ননা একেবারেই বাদ। শুধু সংলাপের ওপরেই দাঁড় করাতে চেয়েছিলাম। বলতে পারো কিছুটা পরীক্ষা নিরিক্ষার পর্যায়ের লেখা। তাই রহস্য একেবারেই সোজা সাপটা রেখেছি, না হলে শুধু মাত্র সংলাপ দিয়ে পুরোটা বাগে আনা যেত না। আর সংলাপ ও ছোটো রাখতে হয়েছে, না হলে গপ্প ঝিমিয়ে যেত।
তাও শেষে যা দাঁড়িয়েছে, সেটায় কিঞ্চিত ভারসাম্যের অভাব রয়ে গেলেও, চলনসই।।তাই ভাবলাম তুলেই দিই।
আর এর পরের নিবারন পোল্ল্যের গল্প গুলো আকারে অনেক ছোট হবে। ছোট্ট গল্পের তুলনা নেই।
Khub bhalo laglo dada. opekhkhay roilam Nibaran Polley mosai er poroborti adhyay er jonno...
উত্তরমুছুননিশ্চই । এর পরে একটু অন্য কিছু দু একটা লেখা বাকি আছে। সে গুলো শেষ করেই এদিকে আবার হাত দেবো।
মুছুনচোখের সামনে যেন একটা সিনেমা দেখতে পেলাম... শুধু সংলাপ দিয়ে গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা খুব ভালো লাগলো..আরো অনেক এরম গল্পের আশায় রইলাম
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ। চেষ্টা ঠিক এটাই ছিল যে শুধু সংলাপ দিয়েই গল্পটা তৈরি করে নেবো। বর্ননা একেবারেই বাদ দেবো।
মুছুনভালো লাগল তবে চেনা সোমনাথের অভাব বোধ করলাম। হয়তো আমার পড়া বা বোঝার ভুল।
উত্তরমুছুনতবে নিবারণ পোল্ল্যে কে আবারও আশা করব পরের লেখায়।