আজ্ঞে
সেই ইংরেজের ফেরেব্বাজির ফেরে যদি নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের কলকাতায় আগমন, আর তার পর কলকাতার
বিরিয়ানিতে আলুর কিস্যা লিখতে বসি, তাহলে আপনি এ লেখা মোটেও পড়বেন না। কেননা সামাজিক
মাধ্যমের কল্যানে ইউটিউব বা অন্যান্য জায়গায় এই নিয়ে হাজার হাজার ভিডিও আছে, এবং আপনি
সে গুলো দেখে দেখে গোটা ব্যাপারটা নিশ্চিতভাবে মুখস্তই করে ফেলেছেন। কাজেই, ও নিয়ে
আমি আর একটি কথাও বলছিনা। বলব অন্য কথা। এই আমাদের বিরিয়ানির কথা, যাকে, বাইরের লোকে
কলকাতা বিরিয়ানি নামে চিনতে শিখেছেন , এবং যা দেখতে একদম এই নিচের ছবির মত।
বিরিয়ানি
খেতে ইচ্ছে হলে, সবচেয়ে সোজা এবং ভরসাযোগ্য উপায় হচ্ছে, যে রেস্তোরাঁর বিরিয়ানি আপনার
পছন্দ, সিধে সেখানে চলে গিয়ে বিরিয়ানির ফরমায়েশ পেশ করা। এই উপায় কখনো আপনাকে নিরাশ
করবে না। এর পরে আসে, বাড়িতে বসে আরাম করে বিরিয়ানি খাওয়ার ব্যাপার। সেখানে আবার আজকাল
অনেক উপায়। মোবাইল ফোনে জোমাটো কি সুইগি তে আপনি ইচ্ছে পেশ করলেন, আধঘন্টায় বিরিয়ানি
হাজির। সে ও বড় আরামের। কিন্তু এসব কিছুর পরেও হয়ত দুকথা বলার থাকে, থেকেই যায়। যেমন
ধরুন, প্রখ্যাত পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরিকে কাঠমান্ডুতে এক সাংবাদিক প্রশ্ন
করেছিলেন, মশায় এত কিছু থাকতে আপনি ওই দুরূহ দুর্গম এভারেস্টে চড়তে চান কেন? ম্যালোরি
ছোট্ট করে উত্তর দিয়েছিলেন – “ওটা ওখানে আছে বলে” (because it is there) । বিরিয়ানির
সমঝদার, খুশখানেওয়ালা জনগনের ভেতরেও দু একজন সৃষ্টিছাড়া খাবার বাইরেও বিরিয়ানির অস্তিত্ব
নিয়ে মাথা ঘামাতে চান। এই লেখা তেনাদের জন্যেই। প্রথমেই বলে রাখি, এর আগে একটি লেখায়
আমি আওয়াধি বিরিয়ানির বিস্তারিত কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করেছি। সে বিরিয়ানির ঐতিহ্য তার
মেকদারিতে। সুগন্ধে চারপাশ নাক, মাথা মুখ ছেয়ে ফেলতে ফেলতে পদার্পন করছেন নবাব, অথচ
চোখে একটি মশলাও দেখা যাচ্ছেনা। আমাদের এই কলকাতা বিরিয়ানিও খানিক সেরকমই। তবে কিনা
আলু ছাড়াও আরো দু একটি ছোটোখাটো ব্যাপার আছে, যা আমাদের বিরিয়ানিকে তার আওয়াধি ঐতিহ্যের
থেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে। এগুলো ভাষায় প্রকাশ করা ভারি কঠিন। কিন্তু পাশাপাশি দু
রকম বিরিয়ানি রেখে খেলে, তফাতটা স্পষ্ট হবে।
বেশী
ধানাইপানাই না করে এবার সোজা চলে আসি আসল কথায়। ছোট্ট করে আবারও বলি, যাঁরা নিজের হাতে
কলকাতা বিরিয়ানি রান্না করতে চান, এ লেখা তাঁদের জন্যে। নিচের পাকপ্রনালী অনুযায়ী বিরিয়ানি
রান্না করলে সে বিরিয়ানি কেমন হবে? আমাদের চেনা বিরিয়ানির ঝরঝরে চেহারা, অথচ মুখে দিলে
একটুও শুকনো লাগবে না, ভুরুভুরে মশলা ও আতরের চেনা গন্ধ, কিন্তু কোথাও এতটুকু মশলা
চোখে দেখা যাবে না। মাংসর টুকরো মুখে দিলে মিলিয়ে যাবার মত নরম, এবং অত্যন্ত ভিজেভিজে,
আলুর ভেতর পর্যন্ত বিরিয়ানির সুবাস ভুরভুর করছে। অথচ খাবার পরে আইঢাই নেই, নেই আফশোষ
যে বিরিয়ানি খতম, কারন আপনি খাবার পরেও হাঁড়িতে আরো অনেকটা থাকবে। হাঁড়ির কথাই যখন
উঠলো, তখন বলি, হাঁড়ি বা ডেকচি যাই হোক না কেন, খেয়াল রাখবেন সেটি যেন চ্যাপ্টা গোছের
হয়। আমি যে সমস্ত হাঁড়িতে বিরিয়ানি করি, তা ওই রকম চ্যাপ্টা। নিচে একটা ছবি দিলাম।
আপনার
মনে হতে পারে, চাটুজ্যে ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে বড্ড বেশী মাথা ঘামাচ্ছে, কি এসে যায়
অন্য কিছুতে করে বিরিয়ানি করলে? মশলা আর সেদ্ধ ঠিক ঠাক হলেই তো হলো। আজ্ঞে আমার বিণীত
নিবেদন, বিরিয়ানি রান্না, আমাদের অন্য আর পাঁচটা সাধারন রান্নার মত নয়। এ হলো দমের
রান্না। মানে, মশলাদার বাস্প বা স্টিম এসে সমস্ত উপকরনের ওপর নিজের হাতের পরশ বুলিয়ে
আদর করে রান্না করে। যত চ্যাপ্টা বাসনে রান্না করবেন, বাস্প তত বেশী খেলা করার জায়গা
পাবে, আর মশলার মিশ্রন ও গন্ধ ততই ভাল করে তৈরি হবে। ওই বাস্পের খেলা করার জায়গা দেবার
জন্যে, যে হাঁড়ি বা ডেকচিতেই আপনি বিরিয়ানি করুন না কেন, তার অর্ধেকের বেশী কখনো যেন
ভর্তি না হয়। তাহলে বিরিয়ানির স্বাদ গন্ধ জমবে না। যাই হোক, এবার আসি উপকরণের কথায়।
আমি মোটামুটি জনা আট কি দশজন মানুষের বিরিয়ানি তৈরির একটা হিসেব দিচ্ছি। আমার বিশ্বাস
বিরিয়ানি তৈরির একটা ন্যুনতম পরিমান আছে। তার কমে তৈরি করলে সেটা কিছুতেই ঠিক সেই উচ্চতায়
পৌঁছয়না। তবে এ নিয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারে।
উপকরণ
রেওয়াজি
পাঁঠার মাংস – দেড় কেজি। দয়া করে এখানে রুগীভোগ্য কচি পাঁঠা এনে বিরিয়ানির স্বাদ নষ্ট
করবেন না। রেওয়াজি মাংস কলকাতা হাওড়ায় বেশ কিছু দোকানে পাওয়া যায়। যদি আপনার মনে এতটুকু
সন্দেহ থাকে, যে ঠিক কোথা থেকে কতটা রেওয়াজ (চর্বি, যা গলে যায়না) সমেত মাংস কিনবেন,
তাহলে আমি আপনাকে একটি দোকানের ঠিকানা দিতে পারি। নিউমার্কেটের নাহুম যদি চেনেন, তাহলে
নাহুম টপকে সোজা বাজারের পেছনের দিকে যাবেন। পেরোবেন বিখ্যাত মাংসের বাজার। মশলার গলি।
সেগুলোও টপকে গিয়ে পড়বেন বাইরের পিচের রাস্তায়। তার ওপাশে মাছের বাজার। রাস্তায় বাঁহাতি
মিটার তিরিশেক গেলেই পাবেন একটা চৌমাথা, ডান দিকে তাকালেই ছোট্ট একটি মসজিদ, আর তার
ঠিক উলটো দিকে এ ওয়ান মিট শপ (A1 Meat Shop) । স্রেফ বলবেন দেড় কিলো বিরিয়ানি কাট।
আপনি মাংস কেনার ব্যাপারে নিতান্ত আনাড়ি হলেও ঠকবার একেবারেই ভয় নেই। আমি রান আর চাপের
মাংস ৭০:৩০ অনুপাতে মিশিয়ে কিনি।
ভাল
বাসমতি চাল ১ কিলো। বিরিয়ানি আপনার রোজকার খাবার নয়। বছরে হয়ত একবার কি দুবার করবেন।
কাজেই চাল একটু ভালো দেখেই কিনবেন।
ঘি
আড়াইশো গ্রাম। পুরোটা লাগবে কিনা সেটা আপনার ওপর। নাও লাগতে পারে।
সাদা
তেল দেড় কাপ।
পেঁয়াজ
– ৪০০ গ্রাম। একেবারে ঝিরি ঝিরি করে কেটে নেবেন। এই পেঁয়াজ সাদা তেলে লাল লাল করে ভেজে
নেবেন। তার পর একটা থালায় ছড়িয়ে রাখবেন। একটু পরেই পেঁয়াজ গুলো কুড়কুড়ে হয়ে যাবে। খেয়াল
রাখবেন ভাজা যেন বেশী না হয়ে যায়, কালচে না হয়ে যায়। তাহলে তিতকুটে ভাব আসবে, আর গন্ধও
ঠিক ঠাক হবেনা।
আলু
গোটা দশেক কি ডজন খানেক। মানে আপনি যেমন চান আর কি।
আদা
রশুন বাটা – ছ সাত চা চামচ। সেটাকে দু গ্লাস জলে গুলে একটা সাদা পরিস্কার কাপড়ে ছেঁকে
নেবেন। শুধু এই রস টুকুই লাগবে।
বিরিয়ানি
মশলা – পাঁচ চা চামচ। এই বিরিয়ানি মশলা কি করে করবেন, সেটা আমি নিচে টিকায় লিখে দেবো।
সাধারন
গরম মশলা গুঁড়ো এক চা চামচ। দোকানে পাওয়া যায় এরকম যে কোনো গরম মশলার গুঁড়ো চলবে।
কেশর
বা জাফরান – আধ গ্রামের তিন ভাগের দু ভাগ। যাহারপরনাই দামী বস্তু এবং নকলে বাজার ছেয়ে
আছে। এভারেস্ট কোম্পানির জাফরান ব্যাবহার করি আমি। আধ গ্রামের দাম পড়ে ১৩০ টাকা, যা
দিয়ে দেড় বার এই পরিমান বিরিয়ানি আরামসে হয়ে যায়। আপনি সেই হিসেব করে দেবেন ।
লাল
লংকার গুঁড়ো – দুই চা চামচ।
গোটা
গরম মশলা – দারচিনি, লবঙ্গ, ছোটো এলাচ (ছোটো এলাচ গোটা দশেক কি বারো, লবঙ্গ গোটা দশেক
কি বারো তেরোটা, আর দারচিনি সম পরিমান)।
তেজ
পাতা – খান চারেক।
ফ্রেশ
ক্রিম ২৫০ গ্রাম। আমি আমূলের ক্রিম ব্যবহার করি। অনেকেই ফুল ক্রিম দুধ ব্যবহার করতে
বলেন, তার সঙ্গে ঘি বা মাখন মিশিয়ে। আমি পছন্দ করি ক্রিম ব্যবহার করা।
খোয়া
ক্ষীর – ১০০ গ্রাম। মিষ্টির দোকানে পাওয়া যায়। বিরিয়ানি যেদিন করবেন, তার বেশী আগে
কিনবেন না।
আলুবখরা
– গোটা দশেক। যা ওজন হয়। বস্তুটি বেজায় আক্রা। দিলে বিরিয়ানি ১০০ তে ১০০। না দিলে ১০০
তে ৯৫। তবে আপনি হয়ত আমারই মত ওই ৫ এর ফারাক চাইবেন না। কেননা ওইযে বললাম, বিরিয়ানি
তো আপনি রোজ রোজ করছেন না।
টক
দই ২০০ গ্রাম। ভালো করে ফেটিয়ে নেবেন।
পাতি
লেবুর রস – ২ খানা ছোটো পাতি লেবুর রস।
মিঠে
আতর ১০ থেকে ১২ ফোঁটা– দোকানে মোগলাই আতর, বিরিয়ানির আতর, বিরিয়ানি সেন্ট, গুলাবি আতর
অনেক নামেই বিক্রি হয়। যদি একটু পরিশ্রম করেন, নিউ মার্কেটে মশলার বাজার থেকে একটু
বড় শিশি কিনতে পারেন। সে বস্তুটি বড্ড ভালো।
কেতকির
নির্যাস এক চা চামচ– কেওড়ার জল বলে বিক্রি হয়।
চিনি
তিন চা চামচ।
নুন
– এর পরিমান আমি প্রনালীর সঙ্গে বলব।
খাবারে
দেবার কমলা রঙ – এটা আপনার ওপর। ব্যবহার করতেও পারেন, নাও পারেন। আমি করলেও সামান্য
পরিমানে করি, আর ভরসাযোগ্য দোকান থেকেই কিনি। কেননা নকল রঙ কিনলে বিষক্রিয়া হতে পারে
(ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে)। সেক্ষেত্রে স্বচ্ছন্দে এইটি বাদ দিতে পারেন। স্বাদে গন্ধে
কোন ফারাক হবে না, এইটি চাটুজ্যের গ্যারান্টি।
প্রস্তুতি
চাল
ভিজিয়ে রাখুন জলে। দেড় কাপ সাদা তেলে দু চামচ ঘি দিন। তার পর এই মিশ্রনে পেঁয়াজ লাল
লাল কুড়মুড়ে করে ভেজে তুলুন আর একটা বড় থালায় ছড়িয়ে রাখুন। লক্ষ্য রাখবেন পেঁয়াজ যেন
বেশী ভাজা না হয়ে যায়। তাহলে গন্ধ ও স্বাদ তিতকুটে হয়ে যাবে। আমার দেওয়া ছবিতে দেখলেই
বুঝবেন ঠিক কতটা ভাজতে হবে। অল্প আঁচে ভাজবেন। না হলে ওপর ওপর কালচে হয়ে যাবে, আর ভেতরে
পেঁয়াজ কাঁচা থেকে যাবে। পেঁয়াজ ভাজার পর তেলটি
যত্ন করে রেখে দিন। এইটি কাজে লাগবে পরে। কোথাও কিচ্ছু ম্যারিনেড করার দরকার নেই। এসব
যাঁরা বলেন বা করেন, তাঁরা ওগুলো নিজেরা জুড়েছেন প্রনালীতে। যদি খাঁটি বাহারি কলকাত্তাই
বিরিয়ানি খেতে হয়, ওসব রাস্তায় একদম যাবেন না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে, লোকজন ম্যানেজ
করে কখনো সিরাজ আরসালান বা বিখ্যাত বিরিয়ানি করেন এরকম কোনো রেস্তোরাঁর অন্দরমহলে ঢুকে
দেখে আসতে পারেন।
প্রনালী
আলু
সেদ্ধ – হাঁড়িতে আলু গুলো রাখুন, তার পর জল দিন। কতটা জল দেবেন? নিচের ছবিতে দেখুন,
আলু গুলো কেমন আধডোবা হয়ে আছে। ওই অতটা জল। মোটামুটি ধরে রাখুন লিটার খানেক জল। সেই
জলে দেবেন দুই চা চামচ নুন, এক চিমটি খাবারে দেবার কমলা রঙ, দু চামচ লাল লংকার গুঁড়ো,
দুই চা চামচ ঘি (আমি তরল ঘি বলছিনা, চামচের ওপর চুড়ো হয়ে থাকা ঘি এর হিসেব ধরে বলছি),
আর এক চামচ বিরিয়ানি মশলা। এবার অল্প আঁচে আলু সেদ্ধ হতে দিন। লক্ষ্য করুন, আলু ভাজার
কোনো ব্যাপারই নেই। গোটা বিরিয়ানি তৈরির প্রনালীতে আর কোথাও কোনো ভাজা, কষা এসবের গল্পই
নেই।
আলু সেদ্ধ করবেন অল্প আঁচে, আর হাঁড়ির ওপরে ঢাকা
দিয়ে। কেননা গোটা প্রনালীটাই অত্যন্ত ধীর লয়ে হবে। তবেইনা একেবারে ভেতর পর্যন্ত ঢুকে
যাবে মশলা। ম্যারিনেড করলে কাঁচা মশলা ভেতরে ঢোকে, কিন্তু এই পদ্ধতিতে রান্না মশলা
একেবারে ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। এইটাই কলকাতা বিরিয়ানির অন্যতম সেরা গোপন পদ্ধতী,
আর এখানেই সে অন্য বিরিয়ানিদের মেরে বেরিয়ে যায়। ামি জ্যোতি আলু ব্যবহার করি, কেননা
চন্দ্রমুখী বড় তাড়াতাড়ি গলে যায়, আর বিরিয়ানি ভাগ করার সময় ঘেঁটে যায়। আলু মোটামুটি
৯০% সেদ্ধ করবেন। বাকিটা দমে বসানোর সময় সেদ্ধ হয়ে যাবে। আলু সেদ্ধ হয়ে গেলে জল ঝরিয়ে
আলাদা করে রাখুন। আলু সেদ্ধর জল ফেলবেন না। এটা মাংস রান্নার সময় লাগবে। আর এবার আমাদের
মাংস রান্না করার পালা।
মাংস
রান্না করার সময়, প্রথমে হাঁড়িতে সেই পেঁয়াজ ভাজার যে তেল আলাদা করে রেখে দিয়েছিলেন,
সেইটি দিন। এর পর সেই তেলে গোটা গরম মশলার (দারচিনি, লবঙ্গ, ছোটোএলাচ) ঠিক অর্ধেক পরিমান
দিন সঙ্গে দিন গোটা দুই তেজপাতা। বাকি গোটা মশলা রেখে দিন, পরে কাজে লাগবে। মশলা ভাজা
হতে শুরু করলে এতে দইয়ের অর্ধেক দিয়ে দিন। এক দু বার নেড়ে নিয়ে এতে আদা রশুনের নির্যাস
(সেই দু গ্লাস ছেঁকে নেওয়া রস) দিন আর আলু সেদ্ধর সেই মশলাদার জল দিন। এবার এতে ভাজা
পেঁয়াজের তিন ভাগের দু ভাগ দিয়ে দিন। আর সেই সঙ্গে আরো এক চামচ বিরিয়ানি মশলা দিন,
আধ চামচ গরম মশলা দিন।
এবার
মাংস দিন আর সেদ্ধ হতে দিন। মনে রাখবেন, কলকাতার বিরিয়ানিতে যে মাংস ব্যবহার হয়, তার
এক একটি খন্ডের আকার মোটামুটি ১০০-১৩০ গ্রাম। কাজেই এই মাংস সেদ্ধ হতে সময় লাগবে। খালি
নুন একটু পরীক্ষা করে নেবেন। নিতান্ত কম হলে একটু নুন দিতে পারেন। মোটামুটি ধরে রাখুন
মাংস সেদ্ধ হতে ঘন্টা দেড়েক লাগবে। আপনি এতক্ষন সময় খরচ না করে প্রেসার কুকারে সেদ্ধ
করতেই পারেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বিরিয়ানির সেই স্বাদ পাবেন না। নরম ঢিমে আঁচে অল্প
অল্প করে মশলায় রান্না হতে থাকা মাংসের সেদ্ধ থাকা স্বাদই আলাদা। সে স্বাদ কিছুতেই
প্রেসার কুকারে আসবে না। হাঁড়ি বা ডেকচির ওপরে ঢাকা চাপা দিয়ে একদম অল্প আঁচে সেদ্ধ
করবেন।
মাংস
একেবারে গলে যাবার আগে , মানে মোটামুটি ৯০-৯৫% সেদ্ধ হয়ে গেলেই জল ঝরিয়ে আলাদা করে
তুলে নেবেন। আর বাকি যে নির্যাস পড়ে রইল, তাকে একটা ছাঁকনি বা পরিস্কার কাপড়ে ছেঁকে
নেবেন। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলেই দেখবেন তেল ওপরে ভেসে উঠেছে। এই তেল বা ঘি আস্তে আস্তে
একটা ছোট হাতায় করে আলাদা করে একটা অন্য বাটিতে নিয়ে নিন, আর বাকি ঝোল আলাদা করে রেখে
দিন।
এবার
একটা অন্য ডেকচিতে জল ফুটতে দিন। এক কিলো চালের জন্যে মোটামুটি দুই কি আড়াই লিটার জল
ফুটতে দিন, আর তাতে দেড় চা চামচ নুন দিন। সঙ্গে বাকি যা গোটা মশলা ছিলো, সে গুলো দিয়ে
দিন। জল গরম হতে থাকুক, আমরা ততক্ষনে বিরিয়ানি দমে বসানোর অন্য কাজ গুলো সেরে ফেলি।
প্রথমেই
এক কাপ গরম জলে জাফরান আর এক চিমটি কমলা রঙ মিশিয়ে ভিজতে দিন। ক্রিম, বাকি দই, চিনি,
দু চামচ ঘি, কেওড়া জল ১ চামচ আর মিঠে আতর ৮-১০ ফোঁটা খুব ভাল করে মিশিয়ে নিন। তার পর
যে হাঁড়িতে বিরিয়ানি করবেন, তাতে মাংসের টুকরো আর আলু গুলো দিন। আলু বখরা গুলো দিন।
এবারে মাংসের ছেঁকে নেওয়া ঝোল আর ক্রিমের মিশ্রন যোগ করুন। এর ওপরে অর্ধের পাতি লেবুর
রস দিন। দেখবেন, আলু ও মাংস গুলো ৭০-৮০% ডুবে যাবে। এইটিই হলো ঠিক ঠাক পরিমান। এবার
দু চামচ বিরিয়ানি মশলা আর আধ চামচ গরম মশলা দিন।এর পর এর ওপরে খোয়া ক্ষীর হাতে করে
গুঁড়ো গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দেবেন। খুব অল্প খোয়া রেখে দেবেন। পরে ব্যবহার হবে। বাকি পেঁয়াজ
ভাজার ৮০% ছড়িয়ে দেবেন। ২০% পরে ব্যবহার হবে।
ইতিমধ্যে
জল ফুটে গিয়ে থাকবে। ফুটে উঠলে গোটা মশলা গুলো জল থেকে ছেঁকে নিয়ে ফেলে দিন। এর পর
বাকি অর্ধেক পাতি লেবুর রস দিন। এর পর জলে চাল ছাড়ুন। অল্প অল্প নাড়তে থাকুন। বাসমতি
চাল খুব তাড়াতাড়ি রান্না হয়। চাল ছাড়ার পর আবার ফুট ধরলেই চাল পরীক্ষা করুন। মোটামুটি
৫০% মানে আধ সেদ্ধ হলেই চাল ছেঁকে নিয়ে বিরিয়ানির হাঁড়িতে দিতে থাকুন। অনেকেই বলবেন
৭০%,৭৫%,৮০% সেদ্ধ হবে চাল। একদম এই সবে যাবেন না। সিধে হিসেব। ৫০% সেদ্ধ। তার বেশী
না। চাল একটা সাঞ্চা বা ছাঁকনি হাতায় করে তুলে তুলে হাঁড়িতে চালান করবেন, আর খেয়াল
রাখবেন, একদম পুরোপুরি জল যেন না ঝরে যায়। অল্প জল যাওয়া ভালো। সেটা বাকি চাল সেদ্ধ
হতে সাহায্য করবে যেমন, তেমনই চালের গন্ধও ধরে রাখবে।
চাল
বিছোনো হয়ে গেলে এবারে জাফরান ভিজোনো জল ভালো করে ছড়িয়ে দিন চালের ওপর। তার পরে পেঁয়াজ
ভাজা ও খোয়া ক্ষিরের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিন। এর পর চার পাঁচ ফোঁটা মিঠে আতর ছড়িয়ে দিন। এক
চামচ বিরিয়ানি মশলা ছড়িয়ে দিন। আর একদম শেষে সেই মাংসর ঝোলের ওপর থেকে ছেঁকে নেওয়া
তেল ছড়িয়ে দিন ভালো করে। বিশেষ করে ধার গুলোতে।
এর
পর ঢাকনা আঁটার পালা। কেউ আটা মেখে তাই দিয়ে রিং তৈরি করে তার ওপরে ঢাকনা আঁটেন। কেউ
কাপড় পাকিয়ে তার ওপরে ঢাকনা রেখে আঁটেন। আমি ইদানিং অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে মুড়ে তার
ওপরে এক খানা কাপড় চাপিয়ে তার ওপরে ঢাকনা রাখছি ওপরে পাথরের শিল চাপিয়ে। বেশ ভালোই
হচ্ছে ব্যাপারটা। মোটের ওপর এটা আপনার যেমন সুবিধেম তেমন করবেন।
চড়া
আঁচে ৫ মিনিট রাখুন। আঁচ কমিয়ে আরো ২০ মিনিট রাখুন। আঁচ বন্ধ করে আরো ১৫ মিনিট রাখুন।
তার পর ঢাকা খুলুন সাবধানে।
এরকম
একটা দৃশ্য অপেক্ষা করে থাকবে আপনার জন্যে। বিরিয়ানি ভাগ করার নিয়ম হলো, এক পাশ থেকে
চাল গুলোকে তুলে তুলে খুঁড়ে ভেতরে জেতে থাকুন, যতক্ষন না মাংস ও আলুর নাগাল পাচ্ছেন।
এবার আলু ও মাংস সমেত তলার গ্রেভিওলা ভাত একটু ওপরে তুলে আনুন, আর জাফরানি রঙের ভার,
সাদা ভাত আর ভেতরের গ্রেভির ভাত মাংস ও আলুর সঙ্গে মিশিয়ে মিশিয়ে পরিবেশন করুন।
প্রথমে
বলেছিলাম বিরিয়ানি মশলার রেসিপি একেবারে শেষে দেবো। এখানে সেটাই দিচ্ছি। প্রথমেই এসব
লিখলে বিরিয়ানির উৎসাহ একটু কমে যেতে পারে। যদি ইচ্ছে হয় এ মশলা বাড়িতেই করে নেবেন।
আর যদি ইচ্ছে না হয়, তাহলে নিউ মার্কেটে মশলার দোকান গুলো থেকে আরাম সে তৈরি করা বিরিয়ানি
মশলা কিনে আনতে পারেন। ঠকবেন না। আর খাটুনি বেঁচে যাবে। তবু যদি নিজে তৈরি করতে চান,
তাহলে -
বিরিয়ানি
মশলা
লবঙ্গ
– ১০ গ্রাম
ছোটোএলাচ
– ২০ গ্রাম
দারচিনি
– ১৫ গ্রাম
বড়এলাচ
– ১০ গ্রাম
জায়ফল
– ছোটো আকারের দু খানা
জয়িত্রি
– ১৫ গ্রাম
শা-জিরে
– ১০ গ্রাম
শা-মরিচ
– ১০ গ্রাম
গোলমরিচ
– ১০ গ্রাম
গোলাপের
শুকনো পাপড়ি – ১৫ গ্রাম
জায়ফল
খোলা ভেঙ্গে বের করে নিন। এর পর বাকি মশলা (গোলাপের পাপড়ি ছাড়া) শুকনো খোলায়, হালকা,
খুব হালকা করে সেঁকে নিন। খেয়াল রাখবেন ভাজা না হয়ে যায়। খুব হালকা সেঁকতে হবে। একদম
অল্প আঁচে দু মিনিট নাড়াচাড়া করবেন। দু মিনিট পর গোলাপের পাপড়ি দিন। আরো এক মিনিট নাড়াচাড়া
করুন। তার পর নামিয়ে একটা থালায় ছড়িয়ে রেখে ঠান্ডা হতে দিন। ঠান্ডা হয়ে গেলে মিক্সিতে
গুঁড়ো করে নিন। ব্যাস হয়ে গেল আপনার বিরিয়ানি মশলা।
একদম
শেষে, এতটা ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্যে একটা বড় ধন্যবাদ জানাই আপনাকে। আর যদি এর পরে এত
ঝামেলা পুইয়ে রান্না করেন, তাহলে দয়া করে নিচে আমাকে লিখে জানাবেন কেমন দাঁড়ালো আপনার
বিরিয়ানি। খুশ-আমদিদ।
উরেব্বাবা, এ তো খাঁটি শিল্প! আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, এই জিনিস চেষ্টা করা আমার সাধ্যের বাইরে, তবে অসম্ভব না। আজ থেকে তিনমাস আগে হলেও হয়ত অসম্ভব বলতাম, কিন্তু রান্নার যে শিল্প, তার স্বাদ পেয়েছি, সুতরাং ভবিষ্যতে এটা নামাবো একদিন, এটা বলতে পারি।
উত্তরমুছুনখেয়েছি এই জিনিস তোমার হাতেই, সুতরাং বানাবার উৎসাহটা জোরদার হল। 😀
তুমি খেয়েছো তো বটেই। তবে সেইটি ছিলো আওয়াধি।।কলকাতার চেয়ে সামান্য আলাদা। আর এই রেসিপিটি খাশ কলকাত্তাই। যার স্বাদের তুলনা আর কোথাও নেই। এইটি করে ফেলতে পারো।।ব্যাঙ্গালোরে সবই পাবে। মিঠে আতর নিয়ে চিন্তা নেই। ওর একটা উপায় আছে। বলে দেবো।
মুছুনলেখাটা পড়তে পড়তে গন্ধটা নাকে পেলাম। দারুন।
উত্তরমুছুনখুশ-আমদিদ
মুছুন