বিরিয়ানি নিয়ে যত লেখা
হয়েছে, তত বোধহয় আর কোনো খাবার নিয়ে হয়নি। তার হাজারো ঘরানা, হাজারো পদ্ধতি, আর
হাজারো কিসিমের উপকরন। তবে বিরিয়ানির স্বাদ, সবসময় তাতে ঢালা ঘিয়ের ওপর নির্ভর
করেনা। কার সঙ্গে কি দেওয়া হলো, আর কতটা , কিভাবে মিশ খেলো, স্বাদ নির্ভর করে সেই
অনুপাতের ওপর। যদিও বিরিয়ানি মানেই আমার কাছে মট্ন্ বিরিয়ানি, কিন্তু এই গরমে
মট্ন্ বেশী খাওয়া যাচ্ছে না।
অনেক ভেবেচিন্তে সব দিক বাঁচিয়ে একটা পাকপ্রনালী বের করেছি, যেটা হালকা, খুব তাড়াতাড়ি রান্না হয়, আর সব মিলিয়ে বলা যায় – “চালিয়ে নেবার মত”। তবে কিনা, হাজার হোক, এটা বিরিয়ানি। কিছু কসরত তো থাকবেই। আমি খালি সেটা কিছুটা সহজ করে দিয়েছি। একটা অনুরোধ। বিরিয়ানি খাবেন সালাড আর রায়তার সঙ্গে। দয়া করে ঝোল জাতীয় কিছু মেখে, বিরিয়ানির সর্বনাশ করবেন না।
অনেক ভেবেচিন্তে সব দিক বাঁচিয়ে একটা পাকপ্রনালী বের করেছি, যেটা হালকা, খুব তাড়াতাড়ি রান্না হয়, আর সব মিলিয়ে বলা যায় – “চালিয়ে নেবার মত”। তবে কিনা, হাজার হোক, এটা বিরিয়ানি। কিছু কসরত তো থাকবেই। আমি খালি সেটা কিছুটা সহজ করে দিয়েছি। একটা অনুরোধ। বিরিয়ানি খাবেন সালাড আর রায়তার সঙ্গে। দয়া করে ঝোল জাতীয় কিছু মেখে, বিরিয়ানির সর্বনাশ করবেন না।
৫ জনের মত বিরিয়ানি করতে
নিচের জিনিষ পত্র লাগবে। পাকপ্রনালীর সবচেয়ে বড় অংশ এটাই।
কেনাকাটা
১ – চাল নেবেন ৫০০ গ্রাম।
পয়সা নেহাত বেশী না হলে, প্যাকেটে করা সুদৃশ্য বাসমতি কিনবেন না। মুদির দোকানে বা
যে চালওয়ালার কাছে চাল কেনেন, তার কাছে বলবেন, ভালো বিরিয়ানির চাল পেয়ে যাবেন ১১০-১৩০
টাকার মধ্যে। ওই একই চালই প্যাকেটে ভরলে প্রায় ১৯০ – ২০০ টাকা কিলো হয়।
২ – মুরগি নেবেন ৭৫০ গ্রাম।
কিন্তু বুকের দিকের মাংস চলবে না। পা আর পিঠের দিকের মাংস।আর দোকানে বলবেন
“ফ্রেস-মাংস”। এটার মানে হলো গলা, বাড়তি চর্বি, মেটে এসব বাদ। বড় বড় টুকরো হবে, না
হলে তৈরি হবার পর মাংস ভেঙ্গে যেতে পারে। ৭ টুকরোর বেশী হলে হবে না। বিরিয়ানির
মাংসের একটা বড় রহস্য হলো, মাংসের টুকরোর ওজন হতে হবে ১১০ গ্রাম। আপনি ৮০ থেকে ১২০
গ্রামের মধ্যে রাখলেই হবে।
৩- ঘি। একটু ভালো ঘি কিনবেন
এক শিশি। ২০০ গ্রাম কিনবেন, সবটা লাগবে না।
৪ – মশলা লাগবে ছোটো ও বড়
এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, জায়ফল, জয়ীত্রি, শা-জিরে, শা-মরিচ, ধনে, জিরে, কাশ্মীরি
লঙ্কা, গোলমরিচ, তেজপাতা, হলুদ আর কেশর। কেশর বা জাফরান পৃথিবীর সবচেয়ে দামী মশলা।
আপনি চাইলে স্বচ্ছন্দে বাদ দিতে পারেন।বিরাট তফাত হবে না। কেশর কিনলে, আধ কাপ দুধের
ব্যবস্থা রাখবেন।
৫ – কেওড়া জল, গোলাপ জল আর
বিরিয়ানি তে দেবার গোলাপী আতর কিনবেন। এগুলো এতই কম পরিমানে লাগে, একবার কিনলে
৮-১০ বার রান্না করতে পারবেন। হয়তো তার চেয়েও বেশি। আর হাতের কাছে রাখবেন একটু
সাদা তেল। যে কোনো। সূর্য্যমুখি হলেই ভালো। সঙ্গে একটু আটা।
৬ – ১০০ গ্রাম টক দই, গোটা
পাঁচ মাঝারি পেঁয়াজ, ২ খানা মাঝারি রসুন আর ২ ইঞ্চি আদা কিনবেন। সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা
কিছু, একটা ছোটো টমেটো। হায়দরাবাদী বিরিয়ানি তে ধনেপাতা ও পুদীনা পাতা দেওয়া হয়।
আপনার ইচ্ছে হলে দিতে পারেন। আমি দিই না। আলু খেতে চাইলে গোটা পাঁচেক মাঝারি আলু।
প্রস্তুতি – ১
প্রাথমিক প্রস্তুতি হলো
মাংসটা মেখে রাখা। আপনাকে একটু আগে থেকে পরিকল্পনা করতে হবে। ধরুন আপনি ভেবেছেন
রবিবার দুপুরে জমিয়ে বিরিয়ানিটা খাবেন। তাহলে ব্যাপারটা শুরু করুন আগের দিন
সন্ধ্যে বেলা। আমি বলছিনা এরকম না করলে হয়না, কিন্তু এটা করলে সত্যিই একটা তফাত
পাবেন।
প্রথমে মাংসটা কিনে আনুন,
আর ভালো করে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিন।
এবারে একটা মিক্সিতে দিন –
আধখানা পেঁয়াজ (ছোটো হলে একটা), গোটা টমেটো, একটা গোটা মাঝারি রসুন (খোসা ছাড়িয়ে
নিন), এক ইঞ্চি আদা (কুচিয়ে দেবেন) দু থেকে তিন খানা কাঁচা লঙ্কা (বীজ ছাড়িয়ে
নেবেন), দুই চা চামচ করে শা-মরিচ, শা-জিরে, ধনে, জিরে, জয়িত্রির ৩ টে পাপড়ি। এক খানা বড় এলাচের দানা। ৬ খানা ছোটো এলাচ, দশ খানা
লবঙ্গ আর ধরুন আধ ইঞ্চি দারচিনি (এটা ভেঙ্গে দেবেন)। আর দেবেন খুব খুব
খুব সামান্য জায়ফল। নখ দিয়ে খুঁটলে যেটুকু ওঠে, সেই টুকুই। মনে রাখবেন বেশী হয়ে গেলেই কিন্তু তেতো হয়ে
যাবে। সামান্য জল দেবেন। খুব
সামান্য। এবারে গোটা জিনিষটা মিক্সিতে বেটে নিন ভালো করে।
দই ফেটিয়ে নিন। এবারে
মুরগিটা একটা কাচ বা প্লাস্টিকের পাত্রে রেখে তাতে ওই মিক্সির মিশ্রন আর দই টা
দিন। এবারে দিন এক চামচ হলুদ গুঁড়ো, তিন থেকে চার চামচ কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো, তিন
চামচ ঘি। আর আন্দাজ মতো নুন। দই দিন। খুব ভালো করে হাত দিয়ে অন্ততঃ ৩-৪ মিনিট ধরে
মাখুন। মাখা শেষ হলে ভালো করে ঢাকা চাপা দিন। হাওয়া চলাচল না করলেই ভালো। গোটা
জিনিষটা ফ্রীজে চালান করুন। কিন্তু ডিপ ফ্রীজে রাখবেন না। এমনি রাখুন।
প্রস্তুতি – ২
এটা পরের দিন সকালের
প্রস্তুতি। সকালে উঠে চাল টা আগে জলে ভিজিয়ে দিন। সকাল ৮ টা নাগাদ।
যদি খাবার সময় হয় বেলা ১
টা, তাহলে বাকি কাজ বেলা ১১টা নাগাদ শুরু করতে পারেন। প্রথমে আলু গুলো খোসা ছাড়িয়ে
নিন। আর একটা পেঁয়াজ খুব সরু সরু করে কেটে নিন। এটার একটা কায়দা আছে। পেঁয়াজের
বোঁটার দিক ধরে আড়াআড়ি কাটুন। এতে করে তেলে ছাড়ার পর খুব তাড়াতাড়ি আলাদা জয়ে যাবে।
অন্য আর একটা পেঁয়াজ একটু বড় করে টুকরো করে আলাদা করে রাখুন। ৪ কোয়া রসুন অল্প
থেঁতো করে নিন। কিন্তু বাটবেন না।
চালটা জল ঝরিয়ে নিন, কিন্তু
একদম শুকনো করবেন না। চালে অল্প দারচিনি, লবঙ্গ আর ছোটো এলাচ গুঁড়ো করে মাখিয়ে
দিন।
রান্না
একটা প্যান হলে ভালো হয়। না
পেলে কড়া। আলু গুলো সাদা তেলে একটু ভেজে নিন গোটা অবস্থায়। আলু গুলো তুলে নিন।
তারপর তেলে পেঁয়াজ গুলো ছাড়ুন। ভালো করে লাল আর মুচমুচে করে ভাজুন পেঁয়াজ, আর তুলে
আলাদা করে রাখুন।
গরম তেলে এক চামচ ঘি দিন। তারপর
দিন আধ চামচ চিনি। সে চিনি কয়েক সেকেন্ড পরেই বাদামী হতে থাকবে। এবারে তেলে ২ খানা
তেজপাতা দিন। তার পরে দিন থেঁতো করা রসুন গুলো। তার পরেই আলাদা করে কেটে রাখা
পেঁয়াজ। পেঁয়াজ গুলো মিনিট দুয়েক ভাজুন। নাড়তে থাকবেন, না হলে পুড়ে যাবে। এবারে
ফ্রীজ থেকে বের করে আগের দিন মেখে রাখা মুরগি সোজা যোগ করুন তেলে।নাড়তে থাকুন
মিনিট পাঁচ সাত। এবারে একটা ঢাকা চাপা দিন। আঁচ একেবারে কমিয়ে দিন। আধ ঘন্টা
রান্না হতে দিন। বাড়তি জল দিতে হবে না।
আধকাপ দুধ কিছুটা গরম করে,
তাতে কেশর দিন। আর সেটা ঢাকা দিয়ে রেখে দিন। কেশরের রঙ বেরোতে থাকবে।
দু খানা বড় এলাচ, জয়িত্রির
২-৩ টে পাপড়ি, ৮-১০ খানা লবঙ্গ, ৭-৮ খানা ছোটো এলাচ, আধ ইঞ্চি দারচিনি একটু হাল্কা
করে শীলনোড়া বা হামানদিস্তায় ভেঙ্গে নিন। বাটবেন না কিন্তু।
একটা বড় ডেকচি বা চ্যাপটা
তলা ওয়ালা হাঁড়ি তে বেশ অনেকটা জল চড়িয়ে ফেলুন। এতটাই দেবেন, যেন ভাতের ফ্যান
গালতে পারেন। আমি সাধারনতঃ চ্যাপটা হাঁড়ি ব্যবহার করতাম। তবে রাইস কুকার ব্যবহার
করে দুর্দান্ত ফল পেলাম। আর যখন সাদা মাটা শর্টকার্ট মারছেন, তখন রাইস কুকার
দিব্যি চলবে। এই জলে, ওই ভাঙ্গা মশলা গুলো দিয়ে দিন। এর সঙ্গে দিন ৪ চামচ গোলাপ
জল, ৩ চামচ কেওড়ার জল, আর ২ ফোঁটা গোলাপী আতর। এর পরে দিন ৪ টে তেজ পাতা। আর
কিছুটা নুন। ঢাকা দিয়ে জল টগবগ করে ফুটতে দিন।
জল ফুটে গেলে চাল ছাড়ুন
জলে। একটু অপেক্ষা করতে হবে। জল ফের ফুটে উঠলে ক্রমাগত দেখতে থাকুন, চাল আধসেদ্ধ
হলো কিনা। খুব তাড়াতাড়ি রান্না হয় এই চাল। ৫০-৬০% রান্না হয়ে গেলে ফ্যান গেলে নিয়ে
ভাত একটা বড় থালায় ছড়িয়ে দিন। ফ্যান টা ফেলবেন না। ওটা কাজে লাগবে।
ওদিকে মুরগি সেদ্ধ হয়ে
এসেছে। প্রায় গা মাখা মাখা। এবারে মুরগি গুলো তুলে নিয়ে আলাদা রাখুন, আর বাকি
গ্রেভিটা প্রায় শুকনো করে ফেলুন। তেল বের হয়ে আসবে লাল রঙের।
আটা মেখে নিন কিছুটা। এটা
দিয়ে হাঁড়ির ঢাকনা সিল করা হবে।
এবারে হাঁড়ির একদম তলায় দিন
দু চামচ ঘি। তাতে মেশান দু চামচ প্রায় শুকনো মুরগির গ্রেভি। তাতে ৪-৫ টা লবঙ্গ,
৪-৫ টা ছোটোএলাচ আর সমপরিমান দারচিনি দিন। এবারে তার ওপরে রাখুন আলু গুলো। এবারে
অর্ধেক চাল দিয়ে দিন। চালের ওপর টা হাতে করে সমান করে দিন। তার ওপরে আগে থেকে ভেজে
রাখা কুড়মুড়ে পেঁয়াজ গুলো দিন। তার পরে এক এক করে মুরগি গুলো সাজান। মুরগির যে
টুকু সামান্য গ্রেভি পড়ে আছে (৪-৫ চামচের বেশি হবার কথা না) সেটা মুরগি গুলোর ওপর
দিয়ে দিন। এবারে তার ওপরে বাকি চাল দিন যাতে মুরগির টুকরো গুলো পুরো ঢেকে যায়। এবারে
কেশর ভেজানো দুধ টা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দিন সমান ভাবে। তার পর, আধ কাপের কিছু বেশি
(৭৫% ভর্তি), ভাতের ফ্যান আস্তে আস্তে গোটা চালের ওপর ছড়িয়ে দিন।
মাখা আটা দিয়ে হাঁড়ির কানায়
একটা রিং তৈরি করুন। তার ওপরে হাঁড়ির ঢাকা এঁটে বসান। এবারে ওপরে একটা ভারি কিছু,
যেমন বাটনা বাটার শিল , চাপা দিন। গোটা ব্যাপার টা আঁচে বসান। প্রথম পাঁচ মিনিট
স্বাভাবিক আঁচে। তার পর আঁচ একেবারে কমিয়ে দিন। আর কমিয়ে দেবার ১৫ মিনিট পর, আঁচ
একেবারেই বন্ধ করে দিন। ঢাকা খুলবেন না যেন। ওই ভাবে বসিয়ে রাখুন আরো আধ ঘন্টা।
খোলার পর বিরিয়ানি
পরিবেশনের সময় ওপর থেকে তুলে পরিবেশন করবেন না। বিরিয়ানি তুলতে হয় এক দিক থেকে আর
ক্রস সেকশন যেমন হয়, ওপর থেকে নিচে পর্য্যন্ত পুরোটা। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ঘেঁটে
যেন না যায়। এ বিরিয়ানি কিন্তু বিশাল সাংঘাতিক কিছু নয়। তবে কিনা, সহজে বাড়িতে
করার জন্যে দিব্যি চলে যায়।
রান্না এবং খাবার পর মতামত
জানলে বাধিত হব।
কোন মন্তব্য নেই :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন