দেড় মাস আগে আইলা যখন চইলা গেলো আমাদের রাজ্যপাট তছনচ করে দিয়ে, আলিপুরি ফতোয়া জারি হলো – “বর্ষা আইলা রে”। কিন্তু কোথায় কি? ছাতা খুলতেই হলো রাস্তায় নামতে গিয়ে, কিন্তু বৃষ্টির জন্য নয়। আলী সাহেব নামখানা খাসা দিয়ে গেছেন, “ধুপছায়া”। আমি শুধু একটু অন্য অর্থে লাগাতে চাইলুম। আলিপুরি ফতোয়া মানতে দেখা গেলো মৌসুমি বায়ুর ঘন্টা, কচু, কলা। লালদীঘির পাড়ে খোদ লালবাড়ির ফতোয়াও তো আজকাল দেখি বিবাদী বাগ মিনিবাস স্ট্যান্ড পেরোয় না। আলিপুর তো কোন ছার। মুখ ঘোরালুম দক্ষিনে, কিন্তু কালিঘাটের মানতও কাজ করল না (যা মন চায়, তাই মানে করুন, ওটা আপনার ওপরে ছাড়লুম)। মৌসুমি বায়ু আপন মনে নিকোবর না কোনচুলোয় যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। খোদার খামোখা একটা পুঁচকে রাজ্যের লোকজনের ফতোয়া মানতে তার বয়ে গেছে। আর আমরা তাবৎ বঙ্গবাসী ভাজা ভাজা হতে থাকলুম। দিন গেল, সপ্তাহ গেল। তাবৎ টিভি চ্যানেল এবং খবরের কাগজের আবহাওয়ার সবরকম ভবিষ্যৎবানীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঠাঠা রোদ্দুর বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে লাগল। যেন ও লীগের প্রথম বড় ম্যাচে আমাদের দু – গোলে হারিয়েছে। এই করে করে সবাই যখন আশা ছেড়ে দিয়েছে একেবারে, সেই সময় তিনি এলেন। প্রথমে অল্প হাওয়া। পরে হাল্কা মেঘ। শেষ রাত্রে টিপির টিপির ইলশে গুঁড়ি। “পড়েছে”, “পড়েছে”। কিন্তু ওই। আবার দু দিন গেল। আবার একটু। এই করে করে শেষটায় খরা ঘোষণা হয় হয়, এমন সময় হুড়মুড়িয়ে বর্ষা এসে ঢুকলো। ভারি ভালো লাগলো। পাড়ার বাজার ওয়ালা, বাসের কন্ডাকটর, সেমি কন্ডাক্টর (ওই যে যিনি দরজা গোড়ায় ঝোলেন, আর হাঁকডাকের ঠেলায় হৃদ্কম্প তোলেন), অটো চালক, চায়ের দোকান, আমাদের অফিসের ফিন্যান্স আর অ্যাডমিনের লোকজন, বস, বসের বস (তাঁর ওপরের জন চেন্নাইতে, কাজেই বঙ্গের বর্ষা তাঁর নাগাল পায়নি) সবারই মেজাজ অনেকটা মোলায়েম হয়ে পড়লো। লোকে এই সময় একটু ভাবুক হয়ে পড়ে। বছরের এই সময়টায় বাঙালিরা কবিতাও লেখে বেশি, খোঁজ নিয়ে দেখবেন। আমিও বাঙালি। ভাবুক তো হতে হয় আমাকেও। তাই ভাবলুম। আর ভাবতে গিয়ে যা মনে এলো, সেইটে নিচে ঝট পট লিখে দিলুম। এইটা ছাড়া আর ভেবেছি ইলিশ মাছ নিয়ে, সে গপ্পো আর একদিন হবে খন।
৯৯ সালের কথা।তখন আমি চাকরি সূত্রে নাগপুরে। ঠিক নাগপুরেও না। সেখান থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে একটা কয়লা খনিতে থাকি। সে বছর ওই সব অঞ্চলে বর্ষা হচ্ছিল জব্বর। থাকতুম এক্কেবারে জঙ্গলের মধ্যে (টুকরো স্মৃতি ২ আর ৩ দেখতে পারেন)। বর্ষায় জঙ্গলের সবুজ যে কি অপরূপ হতে পারে, না দেখলে ধারনা করা যায় না। যাই হোক, এর মধ্যে একদিন কাজের সূত্রে অন্য আর একটা খনিতে যাবার হুকুম হলো। সে খনি কাছাকাছি তো নয়ই, এমন কি মহারাষ্ট্রেও নয়। যেতে হবে মধ্যপ্রদেশ। ছিন্দোয়ারা থেকে ভিমভেঠকা (আসলে ভিমের বৈঠক বা বৈঠকখানা, এখানে এলে প্রাগৈতিহাসীক গূহাচিত্র দেখতে পেতে পারেন, আলতামিরা যাবার দরকার নেই) যাবার রাস্তায় পারাসিয়ার কাছে পেঞ্চ নামে একটা খনি আছে, যেতে হবে সেখানে। নাগপুর থেকে সক্কাল সক্কাল বাস ধরতে পারলে বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাওয়া যায়। এর আগেও একবার গেছি ও রাস্তায়। তবে সেবারে সঙ্গে ছিলো গাড়ী, আর এবারে যেতে হবে নিজেকে। খনির অফিসে জিজ্ঞেস করে জানা গেল শনিবার ভোর বেলায় কিছু লোকজন একটা জিপ গাড়ী নিয়ে নাগপুর যাবে। তারা আবার ওই রাস্তাতেই যাবে। ছুটি তে বাড়ি ফিরবে। শুনে ভরষা হলো। একেবারে একলা যাওয়াটা একটু কেমন যেন লাগছিলো।
শনিবার ভোরবেলা যাত্রা শুরু হলো। একটা জিপগাড়িতে ঠাসাঠাসি করে বসেছি অনেকে। যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে একজন কে আগে থাকতেই চিনতুম। অল্প আলাপ ছিল। নকুল কাওয়ারে। সবাই কাওয়ারে বলেই ডাকতো। লোকটি বেশ রসিক, তবে কিঞ্চিত রগচটা। রাত থাকতেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। ভোরবেলাতেও তার বিরাম নেই। ছাতা সত্ত্বেও আধভেজা হয়ে জিপে উঠলুম। রাস্তাটি ভারি সুন্দর। ঝকঝকে মসৃন। কোথাও এতটুকু খানাখন্দ নেই। শুনেছিলাম বিশ্বব্যাঙ্কের খয়রাতির টাকায় তৈরি। এমন রাস্তা ধরে নাগপুর আসতে সময় লাগতো এক ঘণ্টার কিছু বেশি। যাইহোক, গাড়িতে বেশি কথাবার্তা বলছিলোনা কেউ। রাত্রের ঘুমের রেশটুকু রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করার এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হতে পারে কি? নাহয় হলোই একটা জিপে ১২ জন সওয়ার আর থাকলোই অসংখ্য বাক্স-প্যাঁটরা-তোরঙ্গ-পুঁটুলি কোল আর ঘাড়ের ওপর গোঁজ হয়ে।
নাগপুরে নেমে তাড়াতাড়ি করে গেলুম বাসের টিকিট কাটতে। কাওয়ারে বলল, আমি যেন ওর মালপত্রগুলো একটু দেখি, ও টিকিট কেটে আনছে।এদিকে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। নাগপুরের এই বাসস্ট্যান্ডটা বেশ বড়ো, আর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। সাধারনত বৃষ্টি পড়লে বাসস্ট্যান্ড বা রেলের স্টেশনগুলোর অবস্থা আমাদের দেশে খুব খারাপ হয়। কিন্তু এখানে দেখলুম সেরকম কিছু হয়নি। হয়ত কাকভোর বলেই। মধ্যপ্রদেশ রাজ্য পরিবহন নিগমের সাদা রঙের বাসে উঠে বসা গেল। জানলার ধারে সিট পেয়েছি। পাশে বসলেন কাওয়ারে। আর তার পাশে কাওয়ারের স্ত্রি। আর উল্টোদিকের আসনে কাওয়ারের ছেলে সচিন আর মেয়ে সোনালি। বছর ১০ – ১২ বয়স দুজনের। ভোরের ধাক্কাটা কেটে যাবার পরেই, গোটা রাস্তা দুজনে বিদর্ভের ঝোলে চোবানো মারাঠিতে কলকল করতে করতে গেছে। কাওয়ারে এই ভোর বেলা কোথা থেকে যেন বেশ বড় এক কাঁদি কলা নিয়ে এসেছে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। কাঁদি। এক ডজন বা এক ছড়া কলা নয়। পুরো গোটা একটা কাঁদি। নাগপুরে কলা সস্তা। মনে আছে ওই সময়ে ৩ টাকায় এক ডজন কিনেছি। আর দারুন পুরুষ্টু লম্বা লম্বা কলা। সবুজ নয়, হলদে রঙ। খুব ভালো জাতের। কিন্তু তাই বলে এক কাঁদি?
বাস ছাড়লো। কাওয়ারে একটা করে কলা ছিঁড়ে পরিবারের সবার হাতে ধরালো। আমাকেও দিলো একটা। শেষ করতেই আবার একটা দিলো। সকালবেলা একদম খালি পেট, নিয়েও নিলুম। কিন্তু আবার গেরো, এটা শেষ করতেই সামনে হাজির তৃতীয় কলা। সেরেছে, ষোলোকলা পূর্ন না করে কি ছাড়বেনা লোকটা? একটু কিন্তু কিন্তু করে এটাও নিলুম। খোসা ফেলার ব্যাপারে দেখলুম কাওয়ারে নির্বিকার। বাসের জানলা গলিয়ে টুপ টাপ ফেলে যাচ্ছে রাস্তায়। তিন খানা কলার খোসা ধরে বসে থাকা যায়না। আমিও কাওয়ারের পদাঙ্ক অনুসরন করলুম। সঙ্গে সঙ্গে সামনে হাজির চতুর্থ কলা। এবারে কিছু একটা বলতেই হয়।
- থাক্, আর না।
- আরে নাও নাও, লজ্জা পাবার কিছু নেই।
- তিনটে তো খেলাম।
- তাতে কি?
- কত খাবো আর?
- চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখো। নাগপুরে কলা সস্তা এখানে সবাই এরকম কলা খায়। দেখছোনা, সবাই কিনেছে?
বাস্তবিকই তাই। এক কাঁদি না হলেও দেখলুম সবার হাতেই কলার ছড়া। আর কেমন যেন আনমনে লোকজন টুপ্টাপ করে কলা খেয়ে চলেছে। কাওয়ারের পাশ থেকে মৃদুকন্ঠে মন্তব্য এলো –
- এর পরে বাস থামবে সেই সাওসর এ। দেরি আছে। কিছু খেয়ে নিলে তো ভালোই।
পেছনের সিটে বসেছেন এক দশাসই ফৌজি অফিসার। হাসতে হাসতে উপদেশ দিলেন
- হাতের বস্তু ঠেলবেন না। কে জানে, ভগবান কখন আবার দয়া করবেন।
ফৌজি অফিসারের পাশে বসেছিলেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। সাদা পাজামা কুর্তা (একেবারে দুধ সাদা নয়, কাচার পরে মনে হয়, একটু বেশী নীল দেওয়া হয়েছিলো), মাথায় গান্ধী টুপি। গালে বেশ একটা গালপাট্টা গোঁফ। গলার আওয়াজ শুনে মনে হল, ইনি বোধহয় ওস্তাদী গান টান করেন। বেশ গুরুগম্ভীর আর ওজনদার গলা –
- এ আর কি কলা দেখছেন? উমরেড় রোড ধরে যান, দেখবেন কলার খেত শুরু হয়েছে। বিশ কিলোমিটার দু দিকে শুধু কলার খেত। সেই কলা খেলে বুঝবেন কি স্বাদ।
কাওয়ারে বলল,
- সে কলা পাবো কোথা থেকে? শুনেছি সেগুলো সব বিদেশে চালান যায়।
- না না, এখানের বাজারেও আসে। আমার নিজেরই খেত আছে।
কথায় কথায় নাগপুরের চৌহদ্দি পেরিয়ে বাস হাইওয়ে ধরেছে। ৬৯ নম্বর জাতীয় সড়ক। এই সড়ক ধরে সাওসর পর্যন্ত গিয়ে বাস মহারাষ্ট্র থেকে মধ্যপ্রদেশের ভেতর ঢুকবে। বেলা প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ সাওসর এলো। সবাই নামলো বাস থেকে। সামনেই চা এর দোকান। বসা হলো সবাই মিলে। বৃষ্টি কিছুটা ধরেছে। কাওয়ারে বলল এই আবহাওয়ায় এক কাপ “কড়ক” চা এর তুলনা হয় না। সঙ্গে সঙ্গে ফৌজি উত্তর
- সে যদি বলেন তো চা হতে হবে পাঞ্জাবের। সে চায়ে যেমন ঘন দুধ-মালাই, তেমনি কড়া লিকার। এক কাপ খেয়েছেন তো হাত পা ছুঁড়তে ইচ্ছে করবে।
- সে চায়ে কি আদা দিয়ে তারা এরকম ঝাঁঝ আনতে পারে?
-
বললেন ভুবনরাও দিঊয়েকর। নামটা জেনেছি ততক্ষনে। ফৌজি হার মানতে নারাজ।
- পাঞ্জাবী চায়ে আদা দেয় না বলছেন? আর আদা দিলেই ভালো চা হলো? এই যে, এনাকে জিজ্ঞেস করুন না, এনাদের চায়ে দুধ,চিনি সবই কম কম, লিকার ও পাতলা। তবু সেই দার্জিলিং চাই হলো পৃথিবীর সেরা।
-
বলে আমার দিকে আঙ্গুল দেখালেন। মনে হলো সেনাবাহিনীর কাজের সূত্রে বহু জায়গা ঘুরেছেন মেজর এনায়েতুল্লা খান, আর সেই সূত্রে অভিজ্ঞতার ঝুলিটির আকার বেশ বড়। তাঁর নামটাও জেনেছি ততক্ষনে বুকে লেখা ধাতব ফলক থেকে।
- চা হলো, দিন ক্ষন আর আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করা পানীয়। ভেজা ভেজা দিনে এক রকম, শীতের সকালে আবার অন্য রকম। বিকেলে আবার আর এক রকম, কাজের ফাঁকে বা সন্ধ্যের আড্ডায় আবার আলাদা চা।
সবাই কে খুশী করতে চাই আমি। কথার সূত্র ধরে নিজের মত ব্যাখ্যা করলেন ভুবনরাও,
- দেখুন দেখুন, একদম ঠিক। যেমন দেশ, তেমনি চা। এখানে পাঞ্জাবের চা চলবে কেন? মেজর সাব কি পাঞ্জাবী? মনে তো হয় না।
- না না, আমি মধ্যপ্রদেশের লোক। আসল মেঁ হম্ ভোপাল সে হ্যাঁয়। এখন ছিন্দোয়াড়ার দিকে চলে এসেছি।
গরম গরম পকোড়া আর আলু গুণ্ডা নেওয়া হলো। আলু গুন্ডা আমাদের চেনা আলুর চপের মাসতুতো ভাই। শুধু একেবারে নিটোল গোল বলের মতো দেখতে, আর ভেতরের পুরে, রশুনের কিঞ্চিত আধিক্য। লঙ্কার কথা আর আলাদা করে বললুম না। ভারতবর্ষের যত অঞ্চলের রান্না খেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে, লঙ্কার ব্যবহারে বিদর্ভকে টেক্কা দিতে পারে, এমন অঞ্চল বোধহয় আর নেই। পকোড়া আর আলু গুন্ডার সঙ্গে চাটনি হিসেবে এলো টক দই, ওপরে লাল লঙ্কার গুঁড়ো ছড়ানো। একটা পকোড়ায় বেশ করে মাখিয়ে মুখে দিলুম, আর সটান দাঁড়িয়ে পড়লুম। না, ঝাল নয়, সেটাও ছিলো, তবে সহ্যসীমার বাইরে নয়। কিন্তু না বেরোনো আক্কেলদাঁত পর্যন্ত টকে গেলো, এমন টক দই। বাপরে বাপ। তার পরে আর কিছু মুখে তুলতে পারলুম না। এমন দাঁত সিরসির করতে লাগল। যদিও অভ্যস্ত তবুও বাকিদের দেখলুম অতি সাবধানে সামান্য একটু করে দইয়ের টাকনা দিয়ে খাচ্ছেন। তাও মাঝে মাঝে। শেষে বাস ছাড়ার পর কাওয়ারের পাশের সিট থেকে আরো খান দুয়েক কলা পাওয়া যেতে, সে যাত্রা কিছুটা সামলালুম।
বৃষ্টি এইবার ঝেঁপে এলো। সাওসর ছোট্ট শহর। বাস এবারে উত্তরের রাস্তা ধরলো। মহারাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে কিছু দূর এগোতেই দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করল। দু দিকের ধু ধু করা খেত খামার উধাও। সামনে পাহাড় দেখা দিলো সঙ্গে বেশ ঘন জঙ্গল। পাহাড়ি রাস্তায় বাস এঁকে বেঁকে চলছে। এটা আর হাইওয়ে নয়, তাই অনেক সরু রাস্তা, আর খানা-খন্দ ও রয়েছে বেশ। রাস্তায় গাড়ি একেবারেই কম। মহারাষ্ট্রের মধ্যে তবু রাস্তার ধারে ছোটো ছোটো অনেক গ্রাম দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু মধ্যপ্রদেশ পড়তেই লোকালয় উধাও। শুনলুম সামনেই কান্হান্ নদী, সেটা পেরলে কয়েক কিলোমিটারের ভেতরে পড়বে রামটেক। এবার মনে পড়ল, আগেরবার যাবার সময় এই রামটেকেই আমরা যাত্রা বিরতী নিয়েছিলুম। পাহাড়ের গায়ে আস্তে আস্তে বাসটা একটা বাঁক নিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল। একেবারে ঘন জঙ্গল চতুর্দিকে। এখানে দাঁড়ানোর কারন টা বুঝতে চেষ্টা করলুম। কাওয়ারে ঘুমোচ্ছিলো। বাস থামতে জেগে উঠে চোখ কচলাতে লাগলো। আমরা বসেছিলাম বাসের মাঝামাঝি। সামনের দিকের কয়েক জন কে তড়বড় করে বাস থেকে নামতে দেখলুম। মেজর খান ও দেখলাম ঊঠলেন। আমিও ঊঠলুম। দেখেই আসা যাক কি হলো। টায়ার ফাটেনি নিশ্চই। তাহলে তো আওয়াজ পেতুম।
বাস থেকে নামতেই ড্রাইভার সাহেব বাসের ইঞ্জিন বন্ধ করলেন। একটা অদ্ভুত জিনিষ খেয়াল করলুম, চারপাশটা কত নির্জন। কোনো শব্দ নেই। এত নির্জনতায় নিজেদের গলার আওয়াজটাই কেমন অচেনা লাগছিল। বাস থামিয়েছে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের দু জন গার্ড। প্রথমটা খাকি উর্দী দেখে মনে হয়েছিল পুলিস। কিন্তু পরে দেখা গেল এরা ফরেস্ট গার্ড। সামনে একটা সেতু, তলা দিয়ে কান্হান্ নদী বইছে। আর সেই নদী নিয়েই গন্ডগোল। নদী নাকি ফুলেছে। খেয়েছে, এ কি হাঁটু না লুচি? যে ফুলবে? গতবার যাবার সময় দেখেছিলুম ব্রীজের অনেক তলা দিয়ে বালির ওপর সরু চিক্চিকে রুপোলী রেখা। কয়েক পা সামনে গিয়ে যা দেখলুম, নিজের চক্ষেই বিশ্বাস করতে পারছিলুম না। কোথায় সেই বালির ওপরে সরু জলের রেখা? নদী বইছে ভীম বেগে। জল উঠে এসেছে ব্রীজের ওপর। ঘোলা জল আর ফেনা, তাতে ভেসে আসছে রাজ্যের গাছপালা, ডাল, কাঠকুটো ইত্যাদি। শুনলুম সারা রাত বৃষ্টি হওয়াতে নদীর এই হাল। বাস যাবেনা জল না নামলে। হয়ে গেল। শেষে এইখানে আটকে থাকতে হবে? ওদিকে যে জরুরি কাজে যাচ্ছি তার কি হবে? সঙ্গে বেশকিছু টাকাও রয়েছে, এক সহকর্মী কে দেবার জন্য। দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করলুম, কি কি করা যায়। সে সময়টা এখনকার মতো মোবাইল ফোনের যুগ নয়। কাজেই খবর দেওয়ার উপায় ও নেই কোন। কাওয়ারে বলল, বৃষ্টি থেমে গেলে কয়েক ঘণ্টায় জল নেমে যাবে। গত প্রায় ঘণ্টা খানেক বৃষ্টি হয়নি। একটু আশাতেই থাকলুম, হয়ত জল আস্তে আস্তে নামতে শুরু করবে কিছুক্ষনের মধ্যেই। একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নদীর জলোচ্ছাস দেখতে লাগলুম। এরকম জিনিষ আগে দেখিনি কখনো।
বেলা গড়িয়ে দুপুর হলো। খাবার দাবারের কোনো আশা নেই এখানে। অগত্যা চুপ চাপ বসে থাকা আর অপেক্ষা করা। মেজর সাহেব গল্প শোনাচ্ছিলেন অনেক। উপস্থিত আসছেন তিনি জম্মু থেকে। আসার পথে দিল্লি থেকে কেনাকাটা ক রেছেন। প্রায় আট মাস পরে ফিরছেন। নেহাত যৌথ পরিবার, তাই ছেলে মেয়েদের নিয়ে যান না। এখানে ওরা ভালো থাকে। বললেন
- প্রত্যেক বার বাড়িতে ফিরি আর দেখি ছেলে মেয়ে গুলোকে যেমনটা দেখে গিয়েছিলাম, তার চেয়ে কিছুটা পালটে গেছে। বড় হয়েছে, লম্বা হয়েছে। আর আমার বঊটা বুড়ি হয়েছে। আমাকেও নিশ্চই দেখে ওদের মনে হয় যে আমিও বুড়ো হচ্ছি।
- বুড়ো ভাব লেই বুড়ো। আমার তো পঞ্চান্ন হলো। এখনো খেতের কাজকর্ম নিজে করি। ব্যবসা নিজেই সামলাই। মেয়ের বিয়ে দেওয়া বাকি। নাতি নাতনীর মুখ দেখে তবে বুড়ো হব।
বললেন ভুবনরাও। বলেই হা হা করে হাসি। কাওয়ারে যোগ দিলো এবারে –
- আমি তো ভাবি আর কতদিন ওই খাদানে ডিঊটি দিতে হবে? কবে যে অবসর নিয়ে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচবো ?
আকাশ আবার ঘোর করে এলো। আমরা বাধ্য হয়ে বাসের মধ্যে আশ্রয় নিলুম। যা কিছু খাবারদাবার ছিলো, বাচ্চাদের খাওয়াতে লাগলো সকলে। কাওয়ারের কলার কাঁদি দেখলুম শেষ। এক জায়গায় বিরক্তিকর নিরুপায় অপেক্ষা। একটা সময়ে নেহাত নিরীহ আশপাশের লোকজন কে দেখেও অর্থহীন মাথা গরম হতে থাকে। মেজর খান দেখলুম ড্রাইভারের সঙ্গে আলোচনা করছেন যদি কোনো গতিকে বাসটাকে ব্রীজের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। বাসের আরো কয়েক জন দেখলুম মেজর খান কে সমর্থন ও করছেন। ড্রাইভার ও নিমরাজি। এদিকে বেচারা ফরেস্ট গার্ড দুজন কিছুতেই রাজি নয় এই অবস্থায় ব্রীজ পেরোতে দিতে। মেজাজ টা খিঁচড়ে গেলো। এই জঙ্গলের মধ্যে উপায়হীন ভাবে আটকে থাকা। খাবার দাবার মাথায় থাকুক, একটু জল পর্যন্ত নেই। ভাবলুম দেখি কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা। ফরেস্ট গার্ডদের জিজ্ঞেস করতে বলল, এখান থেকে তিন কিলোমিটার পেছনে গেলে একটা দু মাথার মোড় পড়বে। সেখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের জীপ আসে একটা বিকেল চারটে নাগাদ। সেই জিপে করে আর কিছু না হোক এই জঙ্গল থেকে বেরোনো যাবে। ভাবলুম যা থাকে কপালে, দেখি জিপ পাওয়া যায় কিনা। কাওয়ারে, মেজর আর ভুবনরাও এর কাছে বিদায় নিলুম। জোর কদমে হাঁটা লাগালুম। চল্লিশ মিনিটে আমাকে তিন কিলোমিটার রাস্তা পার হতে হবে, এদিকে বৃষ্টির বিরাম নেই। বাঁকের কাছে এসে বাসের দিকে তাকালুম। কাওয়ারের ছেলে আর মেয়ে জানলা দিয়ে হাত নাড়ছিলো। আমিও নাড়লুম। তারপর সামনে ফিরে চলা শুরু হলো।
বৃষ্টি আর ঘামে ভিজে দু মাথার মোড়ে পৌঁছলুম। দেখলুম একটা গুমটি দোকান। সেটার সামনে একজন তালা বন্ধ করছেন। জিজ্ঞেস করলুম, এখানে জীপ পাওয়া যাবে কিনা। বললুম বাস আটকে গেছে, আমি নিরুপায়। লোকটি আশ্বাস দিলো। বললো ও নাকি রোজই জীপেই ফেরে। জীপটা নাকি সাওসর অবধিই যাবে। বলতে বলতেই জীপ এলো। ড্রাইভারের পাশে একজন অফিসার গোছের কেউ বসে। তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলুম আমার অবস্থাটা। ভালো করে শুনলেন না। ইশারা করলেন পেছনে উঠে পড়তে। শুধু বলে দিলেন, সাওসর পৌঁছনোর পর আমার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে। আমি তাতেই রাজি। ঘন্টা দেড়েক পরে সাওসর বাসস্ট্যান্ডের সামনে আমাকে জীপ টা নামিয়ে দিলো। আগে এক বোতল জল কিনে খেলুম। সঙ্গে এক প্যাকেট বিস্কুট। হঠাৎ দেখি স্ট্যান্ড থেকে একটা বাস বেরোচ্ছে। সামনে লেখা নাগপুর। অভাবিত এই সৌভাগ্যে লাফিয়ে উঠলুম। চলন্ত বাসেই লাফিয়ে উঠলুম। বসার জায়গাও পেলুম একেবারে পেছনের সিটে। বাইরে তখন অন্ধকার নামছে। নাগপুর থেকে আমাকে যেতে হবে আরো ষাট কিলোমিটার।
সেই রাত্রে ঘরে পৌঁছলুম যখন, তখন ঘড়িতে বাজে পৌনে এগারোটা। খাবার দাবারের আশা ছিলোনা। কোনোক্রমে হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় গেলুম। পরের দিন ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো সাড়ে পাঁচটায়। আধঘণ্টায় তৈরি হয়ে বেরোলুম। আজ আমাকে পেঞ্চ পৌঁছতেই হবে। হাইওয়ে তে একটা দুরপাল্লার বাস কোনোগতিকে দাঁড় করিয়ে নাগপুর পৌঁছলুম। বাস টার্মিনাসে ঢোকার মুখেই একটা খবরের কাগজ কিনলুম। বাসে যেতে যেতে পড়বো বলে। ভাঁজ করে ব্যাগে রাখতে গিয়ে চোখ আটকে গেল প্রথম পাতায়। শিরোনামের খবর বলছে গতকাল সন্ধের সময় কান্হান্ নদী পেরোতে গিয়ে মধ্যপ্রদেশ রাজ্য পরিবহন নিগমের একটি বাস জলে ভেসে যায়। যাত্রিদের একজনকেও জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা যায়নি। বাসটি নাগপুর থেকে পারাসিয়া যাচ্ছিল।
- সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়