[রচনাকাল
২০০৯]
গঙ্গাতীরবর্তি
উত্তরাপথের সূর্য্যাস্ত নাকি মালব দেশের সন্ধ্যার সঙ্গে তুলনীয়। দিনান্তে এই
সময়টুকুতে যেন মনের সমস্ত বিষাদ আসিয়া বলপুর্বক দিবাভাগকে অস্তমিত করিয়া দিতে চায়।
জনাকীর্ণ পাটুলিপুত্রের পাষান নির্মীত ঘাটে বসিয়া করলগ্নকপোলে ভাবিতেছিলাম আমার
মনের এই যে বিকার, ইহা কি শুধুমাত্র প্রদোষকালজনিত বিষাদ? তাহা হইলে মাসাধিক কাল এরূপ অস্থির হইতেছি কেন? এই সুবিশাল মগধ সাম্রাজ্যের অধিশ্বর স্বয়ং বিক্রমাদিত্যের (দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য) খাস স্থাপত্যবিভাগের একজন মধ্যম-বাস্তুকারের কি ইহা শোভা পায়?
কর্মে মন নাই।
মুখ্যস্থপতি প্রথমে লক্ষ্য করিয়া সদুপদেশ দিয়াছিলেন। পক্ষকাল পরে ডাকিয়া তিরস্কার
করিয়াছেন। এবং গতকাল হুমকি দিয়াছেন, বৎসরান্তে যখন আমার কার্য্যকারিতার মুল্যায়ন হইবে, তখন আমার এমত অমনোযোগীতা, অতি অবশ্যই আমার বাৎসরিক
ফলাফলে প্রভাব ফেলিবে। গত কয়েক বৎসরের ফলাফল আমাকে মধ্যম হইতে গরিষ্ঠ বাস্তুকারের
পদোন্নতীর সমীপে আনিয়াছে। এমতাবস্থায় ক্ষণিকের অসতর্ক পদক্ষেপে আমাকে সরাইয়া অন্য
কেহ আগাইয়া আসিতে পারে। মুখ্যস্থপতি ইহাই বলিয়াছেন। কিন্তু ইহা আমার মানসিক
অস্থিরতা কে সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করিতে অক্ষম। ইহা শুধু ফলাফল। কারন খুঁজিতে কালের
উজান বাহিয়া আরো কিছুদুর পিছাইতে হইবে।
পূর্বরাগ
আমি কবি নহি। সাহিত্যচর্চা আমার শখ নহে। যদিচ পুর্বরাগ দেখিয়া মনে এইরূপ ধারনা
হওয়া সম্ভব, যে একখানি প্রেমাখ্যান
শুরু হইতেছে। দুই বৎসরাধিক পূর্বে আমরা শিবির ফেলিয়াছিলাম পাটুলিপুত্রের দুইশত
ক্রোশ উত্তর-পূর্বে ঘন জঙ্গলাকীর্ণ এক পাহাড়ি এলাকায়। আরো কিছু উত্তরে হিমালয়ের
শুরু এবং সে অঞ্চল দুধর্ষ পাহাড়ি উপজাতির বাসভূমি। উহাদের ক্ষুদ্র চক্ষু, উচ্চ হনু, বিরল শশ্রু মুখোমন্ডল
দেখিলেই আর্যাবর্তের অধিবাসী হইতে পৃথক করা যায়। মগধ সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্ত
ইহাদের কবল হইতে সুরক্ষিত করা একান্তই প্রয়োজন। সম্রাট সীমান্ত জুড়িয়া সেনা গুল্ম
বসাইতে চাহেন। আর সেনা গুল্ম নির্মানে বাস্তুকারের প্রয়োজন। এই কারনেই আমাদের এই
অঞ্চলে পদার্পন। এত দুরের পথ, তদুপরি পথে দস্যু-তস্করের ভয় ও রহিয়াছে। তবু অধিকাংশ বাস্তুকারই ঘরদোর ছাড়িয়া
এমন কর্মে আসিতে চাহেন তাহার পশ্চাতে দুইখানি কারন রহিয়াছে। প্রথমত এইসব দুর্গম
অঞ্চলে আসিলে নিয়মিত মাসোহারার উপরে কিঞ্চিত অতিরিক্ত ভাতা পাওয়া যায়। তদুপরি কোন
বরিষ্ঠ আধিকারিক এসব অঞ্চলে কদাচ পদার্পন করেন না বলিয়া, কার্য্যসিদ্ধির অন্তে, উপরমহলের চোখে পড়িবার
সম্ভাবনাও বাড়িয়া যায়।
কতিপয়
দিবস অতিক্রান্ত হইয়াছে। জরীপের নিমিত্ত জঙ্গলে ঘুরিতে হইতেছে। আমি নিতান্তই
নাগরিক। কখনো এরূপ উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে দিন কাটাই নাই। একদিন বেলা দ্বীপ্রহরে
একখানি ঘন গুল্মের পশ্চাতে সহসা লক্ষ্য করিলাম একখানি হরিদ্রাভ ঝলক। মেরুদন্ডে
হিমশ্রোত বহিয়া গেল, উদরের তলদেশে একটি অস্বস্তিকর চাপ অনুভব করিতে লাগিলাম। তবে কি উহা শার্দুল? এতদঞ্চলে উহাদের আধিক্য
রহিয়াছে শুনিয়াছিলাম। মস্তিস্ক শূন্য হইয়া গেল। পদদ্বয়ে ভর করিয়া বায়ূবেগে
ছূটিলাম। দিকবিদিক লক্ষ্য করি নাই। দৌড়ঝাঁপের অভ্যাস একেবারেই নাই। দ্রূত
পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িলাম। তদুপরি পথ হারাইয়াছি। পথিমধ্যে কখনো বৃক্ষশাখা, কখনো উপলখন্ডের সহিত
সংঘর্ষে নিজেকে সম্পুর্ন অক্ষত রাখিতে পারি নাই। এমনই এক সময় অনুভব করিলাম পৃষ্টে
অন্যান্য উপকরনের সহিত একখানি ক্ষুদ্র মৃৎ নির্মিত জলের সুরাহী ছিল, সেখানি ভগ্ন হইয়াছে।
অনভ্যাসের শারীরিক পরিশ্রমের ফলে যৎপরোনাস্তি তৃষ্ণার উদ্রেক হইতেছিলো। এক্ষনে
জলাভাবে সেই তৃষ্ণায় যেন ঘৃতাহুতি পড়িল। অভাবে অভাব-বোধ বৃদ্ধি পায়। একখানি বৃহৎ
বৃক্ষ সন্মুখে দেখিয়া উহার নিকট অগ্রসর হইলাম। কিঞ্চিত বিশ্রামের প্রয়োজন।
বৃক্ষতলে উপবেশন করিয়া ক্লান্তি দূর করিবার প্রচেষ্টা, সীমাহীন তৃষ্ণার তাড়নায়
বিলক্ষন বিঘ্নীত হইতেছিল। উপরন্তু অনভ্যস্ত পরিশ্রমের উপান্তে, শরীর চাহিতেছিল কিছু
খাদ্য। সহসা সন্মুখে “ছপ” শব্দে বৃক্ষশাখা হইতে
কিছু পতিত হইল। চাহিয়া দেখিয়া সহসা ঠাহর হইলনা, কিন্তু হস্তে ধরিয়া বোধ হইল ইহা বন্য তিন্তিড়ী। অত্যধিক অম্ল স্বাদের জন্য
ইহার বিলক্ষন খ্যাতি রহিয়াছে। ইহা ভক্ষন করিয়া পিত্তরক্ষা সম্ভব নহে। তদুপরি
জলাভাব।
ক্লান্তি
এবং হতাশায় কিঞ্চিত তন্দ্রা আসিয়াছিল, বলিয়া লক্ষ্য করিনাই, সন্মুখে কখন যেন একখানি মনুষ্য অবয়বের আবির্ভাব ঘটিয়াছে। মুখ তুলিয়া তাকাইলাম, সহসা প্রত্যয় হইল না।
সন্মুখে এক যুবতী, আর্য্যজাতী বলিয়াই মনে হইল। বয়স আন্দাজ বিশ বৎসর হইবে। পানপত্রের ন্যায়
মুখোমন্ডলের আকৃতি, নির্ভয় দুখানি চক্ষু, পরনে একখানি ফ্যাকাসে গেরুয়া কাপড়। কবরী এবং গ্রীবায় বন্য পুস্পের মালা ব্যতীত
অন্য কোন প্রসাধন দৃষ্টিগোচর হইলনা। বড় ভাল লাগিল।
অনুরাগকিয়ৎকাল
পরের ঘটনা। অশ্বপৃষ্ঠে পাটুলিপুত্র ফিরিতেছি। পশ্চাতে একখানি গো-শকটে রহিয়াছেন
মেধা। গত চার মাসের প্রেম বিফলে যায়নাই। ঘন জঙ্গলে পথ হারাইয়াছিলাম। ঋষিকন্যা মেধা
আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যান আপন পিতার আশ্রমে। নিশীযাপন করিয়া চলিয়া আসি, মেধা আমাকে কিয়দ্দুর
আগাইয়া দিয়া শিবিরের পথ দেখাইয়া দেন। তাঁর দ্রষ্ট পথ ধরিয়া নিরাপদে শিবিরে ফিরিয়া
আসিতে সমর্থ হই, কিন্তু অনুভব করি, ভগ্ন জলের সুরাহির
অতিরিক্ত কিছু হারাইয়া আসিয়াছি। বিশেষতঃ মধ্যাহ্নভোজনের সময় পাচকের স্থুল রোমশ
হস্ত দেখিয়া মানসপটে গতকল্যের দেখা দুখানি সুললিত বাহুর কথা, বাহুর উপরে সুললিত
স্কন্ধে আলুলায়িত ঘন কালো কুঞ্চিত কেশরাশি এবং সর্বোপরি দুইখানি চক্ষুর কথা বার
বার মনে পড়িতেছিল। এই জঙ্গলী পরিবেশে মেধার উপস্থিতি যেন আমার মরুভুমিসম বন্য
প্রবাসে একখানি ঘন সবুজ মরুদ্যান রূপে দেখা দিলো। অতঃপর নানাবিধ ছলাকলা, ন্যাকামো এবং হবু
শ্বসুরের ভজনা শুরু করিলাম। কন্যাটি কথা বলেন বড়ই কম। হয় ঘর কন্যার কার্য্য, নতুবা পুঁথী লইয়া ব্যস্ত
থাকেন। মধ্যে মধ্যে তাঁহার নিকট কতিপয় শবর জাতীয় মানুষের আনাগোনা দেখি। উহারা
বোধহয় আমাকে কিঞ্চিত সন্দেহের চক্ষুতে দেখে। মেধার সহিত উহারা কি যেন জল্পনা করিতে
আসে। মেধার মাতা নাই। গত হইয়াছেন। আর পিতা সর্বক্ষন পুঁথী ও আয়ুর্বেদ লইয়া ব্যস্ত।
ইহাদের আশ্রমিক জীবনে বৈচিত্র বড় কম। তবু তাহারই মধ্যে আমার হবু শ্বসুর মহাশয়, প্রত্যহ আমার কিছু
কাল্পনিক ব্যাধির চিকিৎসা করিতেন। এবং তাঁর তৈরি পাঁচন এবং অনুপানের দাপটে, কখনো সে ব্যাধি রাত্রি
অতিক্রান্ত হইবার পুর্বেই বিদায় লইত।
মেধাকে
যে টুকু পাইতাম, তাহাকে নাগরিক জীবনের
গল্প শুনাইতাম, পাটুলিপুত্রের গল্প।
কখনো বারানসী বা প্রয়াগের গল্পও করিতাম। কর্মসূত্রে এসব দেশ আমার পরিচিত। মেধা চুপ
করিয়া শুনিত। কয়েকবার অতিরঞ্জনের চেষ্টা করিয়াছি, সফল হই নাই। মেধার পান্ডিত্য অথবা জীবনবোধ প্রতিবারেই ধরিয়া ফেলিয়াছে। বিস্ময়
জাগিত, জঙ্গলী পরিবেশে বড় হওয়া
এক যুবতী নাগরিক জীবন সম্পর্কে এতখানি ওয়াকিবহাল হয় কি রূপে! তবে মেধা সম্পর্কে
আমার মোহ ছিলো সম্পুর্ণ একতরফা। তাহার দিক হইতে কখনো কোনোরূপ ইঙ্গিত পাইনাই।
কিন্তু আমাকে হতবাক করিয়া কিছুদিন পূর্বে মেধা নগর দর্শন এবং এবং নগরবাসী হইবার
স্বপক্ষে মত প্রকাশ করিল। অকস্মাৎ সৌভাগ্যে বুদ্ধি হারাই নাই মোটেই। ঋষির নিকট
গিয়া মেধার পাণিপ্রার্থনা করিয়াছি। ঋষি আমাকে জটাজূট ভেদ করিয়া তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে
দেখিয়াছেন। হয়ত নেহাতই মনের ভুল, তবুও মনে হইয়াছিল, তাঁর শশ্রু-গুম্ফের দুর্লঙ্ঘ বাধা উপেক্ষা করিয়া, কিঞ্চিত হাস্যের কিরন
দ্রষ্ট হইল।
বিহারে
বিবাহের
পর কিয়ৎকাল গিয়াছে। প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়াছে। কিন্তু মনে হইতেছে আরো কিছু হয়ত
চোখের সন্মুখে ভাসিয়া উঠিতেছে। পাটুলিপুত্রের নাগরিকগন নাট্যরসিক। নগরে প্রায়সই
নাট্যাভিনয় অনুষ্টিত হয়। আমার বাসগৃহ হইতে নাট্যশালা পদব্রজে বড়জোর দুই দন্ডের পথ।
সায়ংকালে মেধা ও আমি গৃহ হইতে নিস্ক্রান্ত হইয়া নাট্যশালায় যাইতেছি, অকস্মাৎ মেধা জেদ ধরিয়া
বসিলেন, শকটিকা ব্যতিত তিনি
যাইতে পারিবেন না। সায়ংকালে পাটুলিপুত্রের শকটচালকগন কিঞ্চিত মেজাজে থাকেন।
পছন্দের দিশা ব্যতিত যাইতে চাহেন না। আমি কিয়দ্দুর অগ্রসর হইয়া এক শকট চালক কে
কোনক্রমে রাজী করাইলাম। দস্যুটা এই মাত্র দূরত্বের জন্য অর্ধ কার্ষাপন দাবী করিল।
উপায়ন্তর না দেখিয়া রাজি হইলাম। কিন্তু মনের ভিতরে উহার ঊর্ধতন চতুর্দশ পুরুষ
উদ্ধার করিয়া ছাড়িলাম, যদিও কন্ঠ নিশ্চুপ রহিল। বাক্যালাপ হইতে অনুভব করিলাম, শকট চালক সমতট নিবাসী।
উহাদের গালিগালাজ ভূবন বিখ্যাত।
তদবধি
দেখিতেছি, মেধা পদব্রজে কোথাও
যাইতে চাহেন না। শকটিকা, নতুবা দোলা তাঁহার জন্য ডাকিতেই হইবে, অন্যথা তিনি গৃহেই অধিষ্ঠান শ্রেয় মনে করেন। একবার বলিয়া ফেলিয়াছিলাম, পিতৃগৃহে তাঁর পদব্রজের
অভ্যাস ছিল, আজ তিনি তা ভুলিতে
বসিয়াছেন। কি কুক্ষনেই যে বলিয়াছিলাম, মুহুর্তে অধর স্ফুরিত হইল, চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হইল, পরনের কাপড়ের আঁচল ওষ্ঠে উঠিয়া আসিল, এবং কন্ঠ হইতে সুতীক্ষ্ণ স্বরে অনুযোগ নির্গত হইল - “তবে কি মধুচন্দ্রীমা শেষ?” ইহার প্রত্যুত্তরে
নিরবতাই শ্রেয় বলিয়া মনে করিয়া ছিলাম। ইহাতেই না থামিয়া, মেধা বলিয়া চলিলেন, তিনি পিতৃগৃহে
প্রত্যাবর্তন করিবেন। সমূহ বিপদের সম্ভাবনা দেখিয়া তদ্দন্ডেই একখানি বিলাস বহুল
শকট ডাকিয়া আনিয়া গভীর রাত্রি পর্যন্ত গঙ্গাতীরবর্তি বীথি ধরিয়া ভ্রমন করিয়াছিলাম।
ইহা বাবদ, আমার মাসোহারার একখানি
বৃহৎ অংশ খরচ হইয়া গিয়াছিল। ভুলেও আর কোনদিন মুখ খুলিনাই। শুধু মাঝে মাঝে মনে হয়, এই কি সেই মেধা? যাহাকে বন্য গুল্মের নাম
না জানা পুস্পের ন্যায় আপন করিতে চাহিয়াছিলাম!
আহারে
আমার
প্রপিতামহ পূর্বদেশ হইতে আসিয়া পাটুলিপুত্র নিবাসী হইয়াছিলেন। তদবধি পরিবার
পাটুলিপুত্রেই অবস্থান করিলেও, গৌড়িয় আচার – বিচার – সংস্কার একেবারে কাটাইতে পারেনাই। বিশেষত আহারের দিক হইতে বিচার করিলে গৌড়িয়
প্রভাব সহজেই চোখে পড়িয়া যায়। মৎস এবং নানা প্রকারের আমিষ ভিন্ন খাদ্য মুখে রুচিত
না। আমাদের পরিবার বাস করিত গঙ্গার অপর পারে। কার্যের সুবিধার্থে আমি বাস করিতাম
নগরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে। আমার সেবার্থে পিতৃদেব এক ভৃত্য ও তাহার স্ত্রী কে আমার
নিকট পাঠাইয়াছিলেন। ভৃত্য আমার গৃহের সকল কার্য্য করিত, এবং উহার স্ত্রী আমার
পাচিকা রূপে বহাল হইয়াছিল। যখন কার্য্যপোলক্ষ্যে উত্তরে গিয়াছিলাম, তখন ইহাদের দুই জনকেই
পিতার নিকট প্রেরন করিয়াছিলাম। কিন্তু বিবাহের পর, পুনরায় মাতা উহাদের প্রেরন করিতে উদ্যোগি হইলে, মেধা মৃদু আপত্তি প্রকাশ করিয়াছিলেন, এবং গৃহের সকল কার্য্য আপন হস্তে করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন। নবপরিণীতা
বধুর এইরূপ মনোভাব প্রকাশের ফলে মেধা প্রথম দিবসেই অনেক খানি সম্ভ্রম আদায় করিতে
পারিয়াছিলেন ইহা বলাই বাহুল্য। ফলে পাটিলিপুত্রে ফিরিলাম ভৃত্য ও পাচিকা
ব্যাতিরেকে।
কিন্তু
অবস্থা পূর্ববৎ না থাকিলেও এতখানি বদলাইয়া যাইবে তাহা ভাবি নাই। মেধা অতিশয়
স্বাস্থ সচেতন। এবং তাঁহার খাদ্যাভ্যাস একেবারেই পৃথক। আমিষ আহারে তাঁহার একেবারেই
রূচি নাই। উপরন্তু রাত্রের আহার তিনি কেবল গোটাকতক ফল-মূল সমারোহে সমাধা করেন।
সর্বক্ষন দুশ্চিন্তা, তিনি হয়ত স্থুল হইয়া পড়িতেছেন। আমি অন্তত তার কোন লক্ষন দেখিনাই। বিবাহের পর
রাত্রে রন্ধনের পাঠ উঠিয়া গিয়াছে। দিবা ভাগেও অবস্থা তথৈবচ। ঘৃতের সহিত তন্ডুল
নতুবা দুগ্ধ ও কদলী। ইদানিং ইহাদের নাম শুনিলেই আমার ক্ষুধা অন্তর্হিত হয়। কেবল
চোখের সম্মুখে ভাসিয়া ওঠে সরিষার তৈলে ভর্জিত মৎস খন্ড, কিম্বা শূল্য পক্ক অজ
নতুবা কুক্কুট মাংসের সুবাস নাসিকায় খেলিয়া বেড়ায়। কিয়দ্দিবস পূর্বে এক সহকর্মির
গৃহে নিমন্ত্রন রক্ষা করিতে গিয়াছিলাম। তিনি বহুকাল পরে পাটুলিপুত্রে ফিরিয়াছিলেন।
সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে বিপাশা ও চন্দ্রভাগা নদীর মধ্যবর্তি অঞ্চলে
তিনি কোন এক সামরিক নির্মানকার্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন। হাসিতে হাসিতে সেই কাহিনীই
তিনি শুনাইতেছিলেন। অকস্মাৎ ভৃত্য একখানি বৃহৎ বারকোশ আনিয়া সম্মুখে রাখিল।
প্রথমটা বুঝিতে পারিনাই, পরে মনে হইল, বারকোশের উপরে অপূর্ব সুবাস নির্গত করিতেছে যাহা, তাহা বোধহয় আস্ত কুক্কুট, কোন কৌশলে ইহাকে
শূল্যপক্ক্য করা হইয়াছে। মুখে পুরিতেই মনে হইল, উহা যেন গলিয়া যাইতেছে। এরূপ সুপক্ক অথচ মুখোরোচক পদ এর পূর্বে খাইয়াছি বলিয়া
মনে পড়িলনা। বন্ধুবরকে ইহা বলিতে তিনি রহস্য ভাঙ্গিলেন। পঞ্চনদ অঞ্চলে এই খাদ্যের
প্রচলন খুব বেশি। তিনি ওই দেশে থাকাকালিন ইহার প্রেমে মশগুল হইয়া পড়েন, এবং আসিবার সময়, একখানি তদ্দেশীয় পাচক
সঙ্গে আনিয়াছেন। শুধু পাচকেই হয়নাই, ইহার জন্য এক প্রকার বিশেষ চুল্লির ও প্রয়োজন। বন্ধুবর সেটিও সঙ্গে আনিয়াছেন।
ভাবিয়াছিলাম
আস্ত কুক্কুট উদরস্ত করিব, কিন্তু মেধা বাধ সাধিলেন। অন্তপুর অকস্মাৎ মেধার বার্তা সমেত এক ভৃত্যের আগমন
হইল। বার্তায় সাবধান বানী, আমি যেন অতিরিক্ত আমিষ আহার না করি, আমার স্বাস্থ্য লইয়া তিনি বড়ই চিন্তায় পড়িয়া যান। ইহার পর সম্মুখের লোকজনের
প্রতি এক খানি দন্তবিকশিত হাসি বিতরন করিয়া হাত গুটাইয়া লইলাম। মানসপটে অশ্লীল
শব্দ ঘোরাফেরা করিতেছিল। কিন্তু গৃহে প্রত্যাবর্তন কালে বা তাহার ও পরে, ঘুনাক্ষরেও প্রকাশ
করিনাই। না জানি আরো কি বিপদ ঊপস্থিত হয়। কিন্তু গৃহে আরো বিপত্তি অপেক্ষা
করিয়াছিল। মেধা বলিলেন আমিষভোজী মানুষের গাত্র হইতে একপ্রকার দুর্গন্ধ নির্গত হয়, যাহা তিনি এক শয্যায় শুইয়া
সহ্য করিতে পারিবেন না। আমাকে স্নান করিতে হইবে। সময়টা শীত কাল, উপরন্তু ইঁদারার জল।
পরবর্তি এক পক্ষকাল জ্বরে শয্যাশায়ী রহিলাম। বৈদ্যরাজ আসিয়া ঔষধ ও পথ্য বাবদ মোটা
রকম চোট দিয়া গেলেন। মানসিক অবস্থার চিকিৎসার কথা আর ভাবিনাই।
অভিসারে
অভিসার
কথাটির সর্বাধিক ব্যবহার, কালিদাস নাকি বাৎসায়ন, কে করিয়াছেন সে নিয়ে বিতর্ক চলিতে পারে, কিন্তু ইঁহারা দুই জনেই আমাকে বিষম বিপদে ফেলিয়াছেন। কালিদাস এবং বাৎসায়নের
সম্পূর্ণ রচনা মেধা পাঠ করিয়াছেন, এবং সেই অভুতপূর্ব ঘুর্নাবর্ত হইতে নিস্ক্রান্ত হইতে পারেন নাই। প্রেম এবং
রমনের প্রতিটি পদক্ষেপে এই দুই লেখকের অনুসরন করিতে চান, আর আমি পড়িয়া যাই
সমস্যায়। প্রেম নিবেদন, যদিচ শেষ কয় মাসে কখনো করিয়া থাকি, তার প্রত্যুত্তরে মেধা সর্বদাই কালিদাসের উপমা আনিয়া হাজির করিয়াছেন। আমার
সমস্যা হইল, আমি সামান্য মজুর খাটানো
বাস্তুকার। এমত উচ্চস্তরের সাহিত্যের সহিত আমার পরিচয় নামমাত্র। আমি উহার উত্তরে
কথা খুঁজিয়া পাই না। প্রত্যুত্তর না পাওয়ায় মেধা প্রেমে মজা পান না। আমি নেহাতই
সাধারন নাগরিকের ন্যায় আপন প্রেম নিবেদন করিতে গিয়া বার বার “হাঁদা”,”ক্যাবলা”,”মুখ্যু” ইত্যাদি বিশেষনে ভুষিত
হইয়াছি। পাটুলিপুত্রে আমার মিত্রকূলের সহিত মেধার পরিচয় করাইয়া দিয়াছিলাম বিবাহের
অব্যবহিত পরই। তাঁহাদের মধ্যে এক মিত্রের সহিত মেধার ধাতে মিলিত, কারন এই মিত্র অর্থাৎ
রাঘব বর্মার ও সাহিত্য লইয়া চর্চা করিবার অভ্যাস ছিল। রাঘব কে আমি বিশেষ পছন্দ
করিতাম এমন নহে, কিন্তু যে মিত্রবর্গের
সহিত আমি মিশিতাম, রাঘবও সেখানে আসিত, অতএব উহাকে বাদ দিতে হইলে সমগ্র কূলটিকেই ত্যাগ করিতে হইত। কিন্তু যখন দেখিতাম
সকলের সম্মুখে কোন এক দুর্বোদ্ধ সাহিত্যিক রসিকতায় রাঘব এবং মেধা এক ই সঙ্গে
হাসিয়া উঠিয়াছে, তখন ই আমার মনে হইত
দাসীপুত্রটাকে সকলের সম্মুখে পাদূকা খুলিয়া প্রহার করি। মসীজীবি শয়তানটা আমার সহিত
আঁটিয়া উঠিবেনা। কিন্তু প্রতিবারেই আত্মসংবরন করিয়াছি। বাকি কথা বলিতে সংকোচ হয়।
বাৎসায়নের রচিত অসংখ্য মুদ্রা ও ভঙ্গীর অনুকরন করিতে গিয়া কখনো সপ্তাহকাল পৃষ্ঠ
নতুবা কোমরের যন্ত্রনায় কাতর রহিয়াছি, কখনো বা কোন অঙ্গ মচকাইয়া লাঠি হস্তে কার্য্যে হাজিরা দিয়াছি। তদুপরি শুনিতে
হইয়াছে, আমি কোনক্রমেই রতীকুশল
নই। অথচ আমার নিজস্ব বিশ্বাস, সুস্থ স্বাভাবিক ক্রিয়ায় আমার উৎসাহ ও নৈপুন্য, দুই রহিয়াছে। মেধা কিয়ৎকাল আমাকে বাৎসায়ন রচিত “কামসূত্র” পাঠ করাইয়াছেন, কিন্তু উহার পর, যাহা করিতে হইয়াছে, উহা প্রায়সই এত
বেদনাদায়ক, যে পরবর্তীকালে পুঁথিটি
দেখিবামাত্র আমার কাম অন্তর্হিত হইয়া যায়, এবং ভীতির উদ্রেক হয়। হায় ঋষি বাৎসায়ন, কি রচনার কি পরিণতি।
রাঘব
ব্যাতীত আরো কয়েকটি নটবর মিত্র রহিয়াছে, যাহারা মেধার ছলাকলার বিশেষ ভক্ত। উহাদের লইয়া সমস্যা দিন দিন বাড়িতেছে। অনুভব
করি, মেধার উপস্থিতি কেবল
মাত্র আমার ক্ষুদ্র জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নাই। তাহা দ্রুতগতিতে পাটুলিপুত্রের
বৃহত্তর নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করিতেছে। এমত অবস্থায় বড় অসহায় লাগে। মনে হয়, আমি যেন এক নিমিত্ত
মাত্র। এমত অবস্থা বোধকরি আমার স্থলে অন্য কেহ থাকিলেও হইত। মহাকবি এবং মহাঋষি
সম্ভবতঃ এমত অবস্থা কল্পনা করেন নাই। তাঁহাদের লেখা কেবল মাত্র প্রেমিক-প্রেমিকাকে
লইয়া। কিন্তু এস্থলে, প্রত্যাখ্যাত পতি কে লইয়া কাব্য রচনা করিতে কেহ উৎসাহ পান না। দিনে দিনে মেধার
প্রভাব যতই বাড়িতেছে, ততই আমি হতাশ হইয়া পড়িতেছি। ইদানিং আমার অবস্থা কিয়ৎপরিমানে গৃহের আসবাবপত্রের
ন্যায় হইয়া পড়িয়াছে। অবস্থান রহিয়াছে, কারন তাহা অভ্যাস, কিন্তু মননে স্থান প্রায় নাই বলিলেই চলে।
দ্বিধা ও দ্বন্দ
মেধার
সহিত পাটুলিপুত্রের নাগরিক সমাজের যোগসূত্র সুদৃঢ় হইয়াছে। তিনি নগরের অন্যতম
ব্যস্ত নাগরিকা। অবশ্য নাগরিকা বলিতে কেহ যেন প্রচলিত অর্থে না ধরিয়া লন। আমি কেবল
অধিবাসী অর্থে ব্যবহার করিতে চাহিয়াছিলাম। তিনি নাগরিকগনকে লইয়া দল পাকাইয়াছেন, ইহা বুঝিতে অসুবিধা হয়
না। পূরুষ ব্যাতিত মেধার সহিত, অনুরাধা, মমতা, অপর্না নাম্নি নাগরিক
সমাজের স্বনাম ধন্য মহিলারাও যোগ দিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার উদ্দেশ্য লইয়া বহুকাল
কিঞ্চিত ধন্ধে রহিয়াছিলাম। কেননা উহাদের সাহিত্য বাসরই হউক, অথবা আলোচনা চক্র, নিজগৃহে কখনো মেধাকে
আয়োজন করিতে দেখিনাই। দেখিয়াছি আয়োজকগন শকট প্রেরন করেন, মেধা চলিয়া যান। প্রথম
প্রথম আমাকেও আসিতে বলিতেন, এখন বোধ হয়, সে নেহাতই ভদ্রতার
খাতিরে। মেধার সহচরগনের কানাঘুষায় শুনিতে পাইলাম, পাটুলিপুত্রের আনাচে কানাচে প্রবল অসন্তোষ জমা হইয়াছে। কিসের অসন্তোষ, কেন জমা হইল, ইত্যাদি বুঝিলাম না। তবে
শুনিলাম সম্রাটের কিছু কিছু কার্য্যকলাপ নাকি উহাদের মনে ধরিতেছে না। আমার ক্ষুদ্র
বুদ্ধিতে ইহার পরিমাপ করার চেষ্টা বাতুলতা, তাই বৃথা কালক্ষেপ করিনা।
কার্য্যপলক্ষ্যে
আমাকে পক্ষকালের নিমিত্ত শোনপুর যাইতে হইয়াছিল। এই স্থল পাটুলিপুত্রের উত্তরে
অশ্বপৃষ্ঠে অর্ধদিবসের পথ। পথিমধ্যে খেয়ায় গঙ্গা পার হইতে হয়। সম্রাটের আদেশে এই
স্থলে একখানি স্থায়ী পান্থাবাস নির্মিত হইবে। প্রতি বৎসর এই স্থলে এক বৃহৎ পশু
ক্রয়-বিক্রয়ের মেলা বসে। স্থায়ী পান্থাবাস এবং শুল্ক আদায়ের রাজকর্মচারীদিগের আবাস
নির্মিত হইলে কর বাবদ আয় বহুগুন বাড়িয়া যাইবার সম্ভাবনা। শুধু তাহাই নহে, শোনপুর এর নিকটে এক
গুচ্ছ নদ – নদী একত্রে মিলিত হইয়াছে। উত্তরের পথে পাটুলিপুত্র পৌঁছিবার পথ হিসাবে এই স্থল
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। তাই ইহার যথেষ্ট পরিমান সামরিক গুরুত্বও রহিয়াছে। হয়ত এইস্থলে
এইরূপ নির্মানকার্য্যের পশ্চাতে সেই ভাবনাও হয়ত থাকিবে। পান্থাবাসকে বিনা আয়াসেই
স্কন্ধাবারে পরিনত করা যাইতে পারে। এমত নির্মানকার্য্যের নিমিত্ত প্রাথমিক ভাবে
স্থান চিহ্নিত করিয়া রাজকীয় ফরমান জারি করা হইয়াছে। আমার ভূমিকা, প্রাথমিক ভাবে জমি জরিপ
করিয়া নির্মানকার্য্য যত শীঘ্র সম্ভব আরম্ভ করা। পক্ষকাল পরে পাটূলিপুত্রে
প্রত্যাবর্তন করিলাম। আপাতত এক মাসের কিছু অধিক গৃহে থাকিতে পারিব। কিন্তু তাহার
পর ফিরিতে হইবে শোনপুরে।
গৃহে
ফিরিয়া দুগ্ধ ও কদলীর সহিত তন্ডুল লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছি। আহারে মন নাই। কেবলই মনে
পড়িতেছে অস্থায়ি শিবিরের পাচকের হস্তের স্থূল রোটিকা কিম্বা পুরোডাশ এবং শূল্যপক্ক
অজ মাংসের স্বাদ। মেধা সহসা জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি শোনপুরে কোন কার্য্যপোলক্ষ্যে গিয়াছিলাম। আমি বিস্মিত হইলাম। কেননা, ইতিপূর্বে কখনো তিনি
আমার কার্য্য লইয়া ঔৎসুক্য প্রকাশ করেন নাই। যাহা হউক, আমি বিস্তারিত ভাবে মেধা
কে পরিকল্পনা বুঝাইলাম। মেধা মন দিয়া শুনিলেন। শেষে প্রশ্ন করিলেন, যাহারা ওই স্থলের
অধিবাসী, তাহারা কোথায় যাইবে।
বলিলাম, রাজকীয় ফরমান অনুযায়ি
উহারা এক বৎসরের গ্রাসাচ্ছাদনের নিমিত্ত রাজকোষ হইতে দুইশত কার্ষাপণ পাইবে। এবং
শোন নদীর কিনারে, তাহাদের গ্রামগুলির পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও রাজকীয় স্থাপত্য বিভাগের পরিকল্পনায়
রহিয়াছে। উপরন্তু, এমত বিশাল নির্মানকার্য্যে স্থানীয় অধিবাসীগন শ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত হইয়া কিছু
উপরি রোজগার ও করিতে পারেন, কেননা নির্মানকার্য্য শেষ হইতে প্রায় পাঁচ বৎসরের অধিক সময় লাগিবে। মেধা সহসা
ক্রোধ সংবরন করিতে পারিলেন না। তাঁর যুক্তিতে, সম্রাটের কোন অধিকার নাই, চাষিদের এইরূপে বাস্তুহারা করার। ইহার পর প্রায় অর্ধদিবস ধরিয়া মেধা আমাকে
বুঝাইয়া চলিলেন যে ইহা কি প্রকার অনৈতিক কার্য্য, এবং রাজা ইহার ফলে রাজধর্ম হইতে পতিত হইয়াছেন। মেধা এবং তাঁহার নাগরিক সমাজ
ইহার বিরুদ্ধে প্রজাকূল কে সচেতন করিবেন, এবং দরকার পড়িলে রাজাধীরাজ কে উচ্ছেদ করিবেন। যেমনটা চানক্য করিয়াছিলেন। আমি
হতবাক হইয়া রহিলাম। মেধা আমাকে এই কর্মে ব্যাপৃত হইতে বারংবার নিষেধ করিলেন, এবং বলিলেন, আমি এতদ্সত্বেও
কার্য্যে যোগ দেওয়া মনস্থ করিলে তাহার ফলাফল ভাল হইবে না।
তদবধি
মন অশান্ত হইয়াছে। মাসাধীক কাল কাটিয়াছে। ইতিমধ্যে আমার শোনপুরে ফিরিয়া যাইবার সময়
প্রায় আসিয়া গেল। কিন্তু যাহা লিখিয়া আখ্যান শুরু করিয়াছিলাম, পুনরায় সেই স্থলে ফিরিয়া
আসি। কিয়দ্দিবস হইল মেধা একদল নাগরিকের সহিত উত্তরে যাত্রা করিয়াছেন। যাইবার
পুর্বে অনুমতি বা স্রেফ বলিয়া যাইবার সৌজন্যটুকু ও দেখান নি। শুনিতে পাইয়াছি, উহারা শোনপুরের পথে
গিয়াছে। কানাঘুষায় শুনিতে পাই, স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দকে লইয়া তাহারা নির্মানকার্য্যে বিস্তর বাধা দিতেছে, এবং যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি
সাধন করিতেছে। রাজপ্রহরীদিগের মোকাবিলা করিতে জঙ্গল হইতে শবররা আসিয়াছে। আর্য্য
জাতির প্রতি স্বাভাবিক ভাবেই উহাদের জাতক্রোধ রহিয়াছে। উহাদের অস্ত্র ও শিক্ষা
যোগাইতেছে উত্তরের পাহাড়ি উপজাতিরা। কেননা শোনপুরের পশু মেলা বৃদ্ধি পাইলে, উহাদের ছোট খাটো পশু
বিক্রয়ের কেন্দ্রগুলি মার খাইবে, কারন, এক্ষনে মগধ তাহার পাওনা
শুল্ক আদায় করিয়া ছাড়িবে। উপরন্তু সাম্রায্য হিসাবে মগধের উপর উহাদের বিষ নজর
বহুকালের। মেধার সহিত এই দুই জাতির নৈকট্য সম্পর্কে পুর্ব হইতেই অবহিত থাকায় মনের
উপর চাপ আরো বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ফলস্বরূপ কর্মে মন নাই, এবং মুখ্যস্থপতির হুমকি
শুনিতে হইয়াছে। ইহার শেষ কোথায় ভাবিয়া পাইলাম না। আমার সংসার, কর্ম, দেশ আজ সব কিছু ছারখার
হইতে বসিয়াছে, অথচ আমার করিবার কিছুই
নাই। সম্রাট কি দেখিতে পাইতেছেন না?
উপসংহার
উপাখ্যান
পুর্ব অধ্যায়ে সমাপ্ত হইলেই ভাল হইত। কিন্তু মন হইল, এই উপাখ্যানের একখানি ক্ষুদ্র অথচ রোমাঞ্চকর উপসঙ্ঘার রহিয়াছে, যাহা এস্থলে লিপিবদ্ধ
করিয়া রাখিলে, ভবিষতের মানুষ তাহা হইতে
শিক্ষালাভ করিতে পারিবে। স্থানীয় অমাত্য, বিদ্রোহী নাগরিক, স্থানীয় কৃষক ও শবর দিগের সহিত আলোচনা করিয়া বিরোধ মিটাইয়া ফেলিতে চাহেন।
বিদ্রোহীরা রাজি হন নাই। তাঁহাদের একমাত্র দাবী, এই প্রকল্প বাতিল করিতে হইবে। স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দের মাঝে বিদ্রোহীদের পক্ষ
হইতে এরূপ বার্তা প্রচার করা হইয়াছিল, যে, এই পশুমেলা উপলক্ষে দেশ
বিদেশের ব্যবসায়ীগনের আগমন ঘটিবে, পারস্য, তূরান হইতে ম্লেচ্ছ
অশ্বব্যবসায়ীগন আসিবে অধিক সংখ্যায়, ফলে, স্থানীয় সনাতন ধর্মাচরন
রসাতলে যাইবে। এরূপ যুক্তিহীন আরো বহু উপায়ে লোক ক্ষেপানো হইয়াছিল। ক্রমশঃ অবস্থা
স্থানীয় অমাত্যের আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া গেল। এমতাবস্থায় স্বয়ং সম্রাট আসরে
নামিলেন। প্রথমে বিদ্রোহীদের নিকট সন্ধি আলোচনার প্রস্তাব পাঠাইলেন। ইহাই তাঁহার
চাল, সেকথা মূঢ় বিদ্রোহী
নেতৃবৃন্দ, যাহার মধ্যে মেধা ও
রহিয়াছেন, তাহারা বুঝিলনা, ও প্রত্যাখ্যান করিল।
ইহা, পূর্বানুমানের ভিত্তিতে
সম্রাট স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে সন্ধির কথা প্রচার করিয়া দিয়াছিলেন। এমতাবস্থায়
পিছোবার পথ নাই। সম্রাট সসৈন্যে অবতীর্ন হইলেন। একদিকে তাঁহার হস্তিবাহিনি
শবরদিগের দফা-রফা করিল, অন্য দিকে ভোজপূর অঞ্চলের কোতোয়ালগন, তেল চুকচুকে বংশ দন্ড দ্বারা স্থানীয় অনিচ্ছুকদিগকে (শেষ পর্য্যন্ত যাহারা
অবশিষ্ট ছিল, কারন অধিকতর, রনে ভঙ্গ দিয়াছিল, অথবা দুইশত কার্ষাপণ এবং
শোন নদীর তীরে জমি লইতে রাজি ছিল) উত্তম মধ্যম দিয় ভাগাইল। বাকি রহিল কেবল মেধা ও
তাহার নাগরিক বন্ধু বান্ধব। সম্রাটের আদেশানুসারে তাহারা রাজকীয় হস্তী ও অশ্বশালার
পর্বতপ্রমান পূরীষ পরিষ্করনের কার্য্যে নিযুক্ত হইল। শোনপুরে, যখন মেলা বসিবে, আদেসানুশারে, তাহারা সেই স্থলের
পশুদের পূরীষ ও পরিষ্করনের জন্য ব্যবহৃত হইবে। মেধার সহিত আর আমার দেখা হয় নাই।
তবে শুনিয়াছি তাহার শাস্তির পঞ্চম বৎসরে তাহাকে হস্তিশালার এক চোল দেশীয় মাহুতের
পছন্দ হওয়াতে বিবাহ করিয়াছে। ইহাও শুনিতে পাইয়াছিলাম, বিবাহ নাকি রাক্ষস মতে
হইয়াছে, কারন মেধার সম্মতি ছিলনা।
পরিশেষে
জানাই, পঞ্চনদের সেই শূল্যপক্ক
কুক্কুটের প্রেমে মশগূল হইয়া আমি সেই পূর্বকথিত মিত্রের বাটিতে যাতায়াত বাড়াইয়া
দিয়াছিলাম। কিয়দ্দিবস পরে, বন্ধু পাচকটিকে ডাকিয়া আনিয়া আলাপ করইয়া দিয়াছিলেন। পাচক নহে, পাচিকা। চারি চক্ষুর
মিলন হইয়াছিল। আর দেরি করি নাই। কয়েক মাসের পর বিবাহ করিয়াছি। চুল্লিখানি বন্ধুবর
যৌতুক হিসাবে দিয়াছেন। কূলোকে কূকথা কহে। বোধ করি তাহা শূল্যপক্ক কুক্কুটের
নিমিত্ত ইর্ষা। পরিশেষে জানাই, আমি সংসার ধর্ম পালন করিয়াছি, রাজা পালন করিয়াছেন রাজধর্ম। ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়া এই ঊপাখ্যান লিপিবদ্ধ করিয়া
রাখিলাম। আশা করিব, রাজারা খেয়াল রাখিবেন।
chhepe rakhlum bhalo kore porbo bole. tobe shunlum vidyasagor ke biday dewa hochchhe , sobar to shokto shokto bangla r jonyo !!
উত্তরমুছুনBisesoto: madrisho orbachin durbhaga r nikot !!
Punoscho: avyontorin boktyobyer rosogrohon ekto sadharon er upojukto bhasa te hoyto bhalo hoto.
Tobe gorment er chokh kintu sorbotro , na bujhle o !!