বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

টুকরো স্মৃতি – ৬

[রচনাকাল ২০০৯]


আর বলবেন না, কি যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিনা। জুলাই এর শেষ। গড়িমসি করে হলেও শেষমেষ মাথার ওপর ঘন কালো মেঘ ঘুর ঘুর করছে। মনটা উড়ু উড়ু। কিন্তু গড়ের মাঠে এখনো বল গড়াচ্ছেনা। দিন গুলো কেমন যেন পানসে লাগছে। এই সময়টায় তো কলকাতা লীগের প্রথমদিকের খেলা বেশ কয়েকটা হয়ে যাওয়ার কথা। খবরের কাগজের পেছনের পাতায় কাগুজে হিসেব নিকেস, বড় দলের সমর্থকদের পয়েন্ট হারানোর চিন্তা, ছোট দলের ডিফেন্ডারের মরিয়া লড়াই, নবীন স্ট্রাইকারের নিজেকে ছাপিয়ে গিয়ে ম্যাচ রিপোর্টে নিজের জায়গা করে নেওয়া।
কিন্তু, এবারে সবই কেমন যেন খাপছাড়া, অন্যরকম। শুনছি সেই সেপ্টেম্বরের আগে নাকি বল গড়াবে না গড়ের মাঠে। মনে আছে, ১৯৮৩ সালে প্রথম খেলা দেখি, বাবার হাত ধরে। ১৯৮৬ তে প্রথম বড় ম্যাচ, মোহনবাগান – মহামেডান। ১৯৮৭ তে প্রথম মোহন – ইস্ট। সে ও বাবার হাত ধরেই। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই অধম, মোহনবাগান সমর্থক। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আজ এই বয়সে এসে, ছোটোবেলার ঘটি-বাঙ্গাল মার্কা রেশারেশির রেশ আর অবশিষ্ট নেই (অবশ্য বেশ কিছু ইষ্টবেঙ্গল সমর্থক ভিন্নমত পোষন করেন। কি আর করা? ব্যাটারা বরাবরই ওরকম বজ্জাত)ভালো লাগে মাঠের পরিবেশ, শেষ বিকেলের হালকা রোদ, সবুজ ঘাস, ভাঁড়ের চা, আড্ডা, আর উপরি পাওনা, যদি মোহন বাগান জিতে যায় (আমরা হারলে আবার ওনাদের মেজাজ টা শরিফ থাকে।)ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ি ফিরি। এত রকম মনোরঞ্জনের উপায় চারিদিকে আজকাল, কিন্তু আমার ধারনা, খেলায় জেতার মতো নির্মল- নির্দোষ আনন্দের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, এরকম মনোরঞ্জন কমই আছে। আরো একটা কথা কি জানেন? এই যে আপনার চারিদিকে আরো হাজার হাজার লোক, আনন্দে অথবা স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় একই সঙ্গে উদ্বেল অথবা কাতর হচ্ছে, এটাও মাঠে বসে খেলা দেখার একটা বড় পাওনা। খেলায় জিতলে অথবা হারলে, মাঠে বসে থাকা, সমাজের একেবারে ওপর তলার মান্যজন থেকে একেবারে অন্তজনের বাহ্যিক উত্তেজনা প্রকাশে বিশেষ তফাত থাকে না। কত জন কে দেখেছি। কেউ কেউ মনে থেকে গেছেন। কাউকে ভুলে গেছি। আবার এই খেলার মাঠ থেকেই পেয়েছি অনেক প্রকৃত বন্ধু কে, যাঁরা খেলার মাঠের বাইরেও আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছেন।

সমীরকে প্রথম দেখি ২০০৪ সালে। তার আগের দিন লীগের প্রথম বড় খেলা ড্র গেছে। রবিবারের সকাল, ক্লাবে প্রায় কেউ নেই। সকাল বেলায় এক মাঠতুতো দাদার ছেলে কে নিয়ে ক্লাব দেখাতে গেছেন, আমি সঙ্গী হয়েছি। সেই দাদা এখন প্রবাসী, প্রায় বছর পনের। তবু গড়ের মাঠের আবেগ থেকে এতটুকু দূরে থাকতে পারেন না আজও। ক্লাবের গেটের সামনে খেয়াল করিনি অতটা, আগের দিনের খেলা নিয়ে কথা বলতে বলতে ঢুকছিলাম, হঠাৎ একটা গলার আওয়াজ পেয়ে পেছনে দেখি, অচেনা মুখ শীর্ণকায় চেহারা। মাথায় সাড়ে পাঁচ মেরেকেটে। অত্যন্ত মলিন জামা কাপড়। পায়ে একটা ক্ষয়ে যাওয়া হাওয়াই চটি। লম্বাটে মুখ, বয়স খুব বেশী হলে একুশ-বাইশ। মুখে না কামানো দাড়ি।

-    দেখবেন দাদা, পরের খেলাতেই হারাবো ওদের। ঠিক হারাবো    

একটু নাকি সুরে বলা কথা। উচ্চারনে হালকা তোতলানোর সঙ্গে জিভের জড়তা ধরা পড়ছে। আমরা চলতি কথায় যাকে বলি, জিভের আড় না ভাঙ্গা, সেরকম আধো আধো উচ্চারনএকটু হেসে পা বাড়ালুম ক্লাবের ভেতর। কিন্তু কয়েক পা যেতেই দেখি ছেলেটি পিছু পিছু আসছে। বুঝলুম না, কি চায়। একটু সাবধান হতে হবে, আজ কাল সব জায়গায় ধান্ধাবাজ লোকে ভর্তি। যাইহোক, ক্লাবে ঢোকা হলো। যার জন্য আসা, সে কৈশোরের স্বাভাবিক কৌতুহলে দুচোখ ভরে দেখছিলো সব। পুরোনো ছবি, ট্রোফি, স্মারক। প্রথম প্রথম ছেলেটি ঘুরছিলো একটু তফাতে। কিন্তু মিনিট দশেক পর থেকেই সক্রিয় ভুমিকা নিতে শুরু করলো। নিজেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে শুরু করলো সব কিছু প্রথমটা অতটা গা করিনি। দেখাচ্ছে দেখাক। কিন্তু পরে দেখলাম, আমাদের পিছু ছাড়ার ব্যাপারে তার নিতান্তই অনিহা। বাধ্য হয়ে একটু আড়ো আড়ো – ছাড়ো ছাড়ো ভাব দেখাতে হলো। কিন্তু কোথায় কি? ছেলেটি তখন ১৯১১ নিয়ে বুঁদ, আর পাঁচজন মোহনবাগানীর মতো, এই এত বছর পরেও। যাই হোক, একটু পরে ক্লাব থেকে বেরিয়ে লন পেরিয়ে ক্যান্টিনের দিকটায় গেলাম। মোহনবাগানীদের কাছে যার আদরের নাম, কাজুদার দোকান। সামনে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে দাদা স্মৃতিচারন করছিলেন। শুনছিলাম আমি। এর মধ্যে মুর্তিমানের আবার আবির্ভাব। দাদা চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজিতে যা বললেন তার বাংলা ভাবার্থ দাঁড়ায় “ছিনে জ়োঁক”। পাত্তা দিলাম না এবারে। চা খেয়ে হাঁটা দিলাম গেটের বাইরে। ছেলেটা পেছন পেছন আসছিলো বকবক করতে করতে। ঠিক গেটের কাছে এসে থেমে গেলো। কথা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আমরা রাস্তা পেরিয়ে ইডেনের দিকটায় গেলাম। ওখান থেকে বাস বা ট্যাক্সি ধরা হবে। এবারে ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠলো –

-    আবার আসবে তো? যতবার খুশি আসবে কিন্তু। আমাদের ক্লাবে যখন খুশি যে খুশি আস্তে পারে। পাবে এরকম অন্য ক্লাবে?
বলেই একগাল হাসি। আজও আমি যখন সমীরের কথা মনে করি, ওর ওই হাসি মুখটাই সবার আগে মনে আসে। এত সরল আর সুন্দর হাসি আমি খুব কম দেখেছি। আমরা বন্ধুরা মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে মোহনবাগান ক্লাবকে মন্দির বলে ডাকি। কিন্তু সেই দিন, এবং তার পরেও, ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে সমীরের মুখে যে হাসি দেখেছি, তার সঙ্গে একমাত্র তুলনা চলে, আধ্যাত্মিকতার খোঁজে আসা তীর্থযাত্রির মুখের ভাবের।
পরের খেলায় মাঠে আবার দেখা সমীরের সঙ্গে। দেখতে পেয়ে ও নিজেই দৌড়ে এলো। মুখে সেই এক গাল হাসি।
-    কি গো দাদা? কেমন আছো?
-    এই তো, ভালোই।
-    আজ জিতবোই দেখো।
লাফাতে লাফাতে চলে গেল ছেলেটা। পাশ থেকে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক বললেন
-    চেনেন নাকি পাগলাটাকে?
-    না তো। কে ও?
-    আরে ও তো সমীর। কেউ পাত্তা দেয় না। সারা দিন রাত এখানেই পড়ে থাকে। দেখুন আপনাকে আবার ফিনাইল গছায় কিনা।
বলেই হাঁটা দিলেন ভদ্রলোক। ফিনাইলের রহস্যটা ঠিক বুঝলুম না। খেলা শুরু হলো। কিন্তু সেদিন বিধি বাম। যাচ্ছেতাই খেলা হলো। পেনাল্টি মিস। গোল হলো না। ছোট দলের কাছে আটকে গিয়ে পয়েন্ট হারাল মোহনবাগান। মেজাজটা গেলো খিঁচড়ে। আমরা যারা একসঙ্গে খেলা দেখি, তাদের মুখগুলো চিরেতা খাওয়া। মাঠ থেকে বেরোবার সময় দেখলাম সমীর দাঁড়িয়ে আছে। একবার দেখলো। তারপর আবার মাঠের দিকে চেয়ে রইলো। গেটের কাছে এসে বেরোতে যাচ্ছি, এমন সময় পেছন থেকে এসে ডাকলো।
-    দাদা, তুমি পরের খেলায় আসছো তো?
-    দেখি, চেষ্টা তো করবই, তবে অফিস থেকে বেরিয়ে আসা তো। জানিনা পারবো কিনা।
-    তোমাকে একটা কথা বলবো।
-    বলো।
-    আজ না। পরের দিন। মোহনবাগান জিতুক, তারপর বলব।
পরের খেলায় মাঠে যাওয়া হলো না। পরের বেশ কয়েকটা খেলাতেই আর যেতে পারিনি। লীগ শেষ হয়ে গেলো। কিছু দিনের বিরতি। আইএফএ শিল্ড শুরু হলো। প্রথম খেলাতেই শ্রীলঙ্কার একটা দলকে মোহনবাগান দুরমুশ করলো ৯ গোলে হারিয়ে। আমরা চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। এই তো চাই। আসুক না ওরা আমাদের সামনে, উড়িয়ে দেব। খেলা হচ্ছিলো সল্টলেকে। সেখানে গ্যালারি তে পরিচিত মানুষ কে খুঁজে পাওয়াটা এক ঝকমারি। যাই হোক, একে একে গ্রুপ লীগ, কোয়ার্টার ফাইনাল পেরিয়ে সেমি ফাইনাল। বিপক্ষে ইষ্টবেঙ্গল। সন্ধ্যেবেলায় কোনোক্রমে অফিস পালিয়ে হাজির হলাম স্টেডিয়ামে। খেলা শুরু হয় হয়। বন্ধু – বান্ধব কে খুঁজে নিয়ে ঝটপট বসে পড়লাম। অতঃপর কণ্ঠার কাছে হৃদপিন্ড আটকে থাকা আড়াই ঘণ্টা। কেননা খেলা গড়ালো টাইব্রেকার অবধি, থুড়ি, সাডেন ডেথ অবধি। অবশেষে সেই মুহুর্তটা এলো। আটকে থাকা উৎকণ্ঠা বদলে গেলো বাঁধন ভাঙ্গা উচ্ছাসে। স্টেডিয়াম ছাপিয়ে একদিক দিয়ে সেই উচ্ছাসের  স্রোত বয়ে চললো পাশের রাস্তায়, চওড়া বাইপাসে। অন্যদিক দিয়ে তখন স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বুকে চেপে নিরবে বাড়ি ফিরতে থাকা মানুষের ভিড়। বাইপাসের ওপরে কয়েকটি ছেলে এগিয়ে এলো-
-    দাদা, মাথাটা বাড়ান, একটু আবীর দেবো।
মনের আনন্দে আবীর মাখালো ওরা। আমাকে। আমার আশে পাশে আরো অসংখ্য মানুষকে। এদের মধ্যেই দেখলাম সমীর কে। আনন্দে প্রায় পাগল হয়ে গেছে। জড়িয়ে ধরে প্রায়।
-    আসোনা কেন মাঠে? এই তো জিতলাম। দেখলে তো?
-    এই তো এসেছি।
-    রোজ আসবে। রোজ জিতবো। খেতে না পেলেও কষ্ট হয়না গো দাদা, শুধু যদি টিম জেতে। সব ভুলে যাবো, শুধু ফাইনালটা জিতে যাক।
-    জিতবে নিশ্চই। দেখা যাক।
-    দাদা, তোমার আজ নিশ্চই খুব আনন্দ। একটা জিনিষ দেবে আমায়? চাইবো?
প্রায় অচেনা কেউ আমার কাছে এমন অকাতরে কোনো দিন কিছু চায় নি। একটু থতমত খেয়ে গেলাম।
-    কি চাও?
-    আমাকে কুড়ি টা টাকা দেবে দাদা?
একটু থমকে গেলাম। সরাসরি টাকা চায় কেন? মতলব টা কি? তবু, সেদিন মনটা খুব হালকা ছিলো বলে দিয়ে দিলাম।
-    তুমি দেখে নিও, সামনের মাসেই তোমাকে দিয়ে দেবো।
এই কথাটা আশা করিনি। দেবার সময় ভাবিনি টাকাটা ও কোনো দিন ফেরত দিতে চাইবে। তবে বুঝলাম, এবার থেকে এই ছেলেটাকে একটু এড়িয়ে চলাই ভালো।
মাঝে মাঝে সকালের দিকে ক্লাবে গেলে দেখতাম সমীর একমনে খেলোয়াড়দের অনুশীলন দেখছে। চেষ্টা করতাম ওর থেকে দুরে থাকার। দূর থেকে হাত নাড়তো মাঝে মাঝে। শেষে একদিন সামনা সামনি পড়ে গেলাম। ক্যাণ্টিনে চা খাবার সময়। বললাম ওকেও এক কাপ চা দিতে।
-    আমাকে দুটো টোস্ট খাওয়াবে?
-    আচ্ছা, খাও। আমি দাম দিয়ে দেবো।
-    ঘুঘনি খাওয়াবে?
-    ঠিক আছে। নিয়ে নাও।
-    আমাদের ক্লাবের ঘুঘনি সবচেয়ে ভালো, জানোতো? অন্য ক্লাবে পাবে এরকম?
দেখতাম, সমীরের কাছে মোহনবাগানের সব কিছুই ভিষন ভালো। সে ক্লাবই হোক, মাঠই হোক, খেলোয়াড়রাই হোক বা সমর্থক। কথায় কথায় বলতো “আছে অন্য ক্লাবে এরকম”? ধিরে ধিরে সয়ে এলো সমীরের উৎপাত। মাঝে মাঝে টাকা চাইতো, তা সে ১০ বা ২০ টাকার বেশী কোনোদিনই নয়। মাঝে মাঝে তাও চাইতোনা। শুধু পাউরুটি বা ঘুঘনি। ওর চাহিদা ছিলো খুব কম। বুঝতে পারতাম ওর অভাব বেশ ভালো মতোই। সারা দিন মাঠেই পড়ে থাকে। রোজগারপাতিও কিছু আছে বলে মনে হয়না। কিছুটা করুনার নজরে দেখতাম ওকে। মনে মনে একটু যে নিচু নজরেও দেখতাম না তা নয়। বাড়ির অবস্থা ভালো নয়। জোয়ান ছেলে, কোথায় দু পয়সা উপায় করে বাপ মায়ের পাশে দাঁড়াবে, তা নয়, সারা দিন শুধু ক্লাবেই পড়ে আছে।
২০০৫ সালে মোহনবাগান ক্লাবে ভোট হলো বহু বছর পর। সে যেন এক উৎসব। হাজার হাজার লোক ভোট দিচ্ছেন। লোকসভা স্পীকার থেকে আমার মতো সাধারন মানুষ সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিচ্ছেন এক সঙ্গে। সারা দিন টিভি চ্যানেল গুলোর কভারেজ। সে এক দেখার মতো বিষয়। যাঁদের মেম্বারসিপ কার্ড আছে, তাঁদের ছাড়া কাউকে টাঊন হলের কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছিলো না। ওই টাউনহলের ভেতরেই চলছিলো ভোটগ্রহন পর্ব। আকাশবানীর সামনে আরো বহু লোকের সঙ্গে দেখি সমীর দাঁড়িয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই হাত নাড়লো।
-    দেখছো দাদা, আমাদের ক্লাবে কেমন ভোট হচ্ছে। আছে অন্য ক্লাবে এরকম সব মেম্বার?
-    তুমি কি করছ এখানে? এই রোদের মধ্যে?
-    তোমরা ভোট দিচ্ছো আমি দেখছি। আমার খুব ভালো লাগছে। তুমি খুব ভালো করে ভোট দিও দাদা।
মাথায় ঢুকলোনা ভোট কি করে খুব ভালো করে দেওয়া যায়। ভোট দেওয়া হয়ে গেলে বেরোচ্ছি, সঙ্গে বাবা। বাবা ও ভোট দিয়েছে। দেখি সমীর আকাশবানীর উলটো দিকে ফুটপাথে বসে রয়েছে। আর ওকে ঘিরে আরো কয়েকটি ছেলে যেন কি সব বলছে। হাসাহাসি করছে। ওদের মধ্যে আমার চেনা একটি ছেলেও রয়েছে। কিছু বললাম না। কয়েক দিন পরে সেই চেনা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম যে ওরা সমীরের পেছনে লাগে কেন।
-    আরে ওই পাগলা? তুমি চেনো নাকি ওকে? ফিনাইল গছিয়েছে নাকি তোমাকে?
-    ফিনাইলের গপ্পটা কি বলোতো? এই নিয়ে দ্বিতীয় বার ফিনাইল নিয়ে কিছু শুনছি।
-    আরে পাগলটার তো কোনো রোজগার নেই। সোদপুরের দিকে কোন বস্তিতে থাকে। ফিনাইল বিক্রি করে। তা সারা দিন তো পড়ে থাকে এখানেই। কোথায় আর বিক্রি করবে? এক এক দিন কোনো পয়সা না থাকলে যাকে তাকে ধ রে ফিনাইল গছায়। তাই নিয়েই লোকে হাসাহাসি করে।
-    যাকে তাকে মানে?
-    আরে সে এক কান্ড। কর্মকর্তা, মালী, সাংবাদিক কাউকে বাদ দেয়নি। শেষে এক দিন আমাদের ডূ কে গছাতে গিয়েছিলো।
যাঁরা মাঠের খবর রাখেন, তাঁরা জানেন, ডু হলো ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় এডুয়ার্ডো চাকোন লাকার্ডা র ডাকনাম। সেরেছে। ডু খুব ভাঙা ভাঙা ইংরিজি জানে। আমাদেরই কথা বলতে ঘেমে নেয়ে অস্থির হতে হয় (অবশ্য সেটার জন্য ডু এর ইংরেজি জ্ঞান পঞ্চাশ শতাংশ দায়ী, বাকি পঞ্চাশ শতাংশ আমার ইংরেজি জ্ঞান এর খাতে জমা করুন)। শুনলাম অনুশীলন শেষে খেলোয়াড়রা যখন ড্রেসিংরুমে ফিরছে, সমীর সেই সময় ডু কে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করে, যে আগের ৩ দিন ওর এক বোতল ফিনাইল ও কেউ কেনেনি। হাতে একটাও পয়সা নেই। ডু যদি অন্তত একটা বোতল কেনে, তাহলে ওর বড় উপকার হয়। কিন্তু, এত কথা ও বলল কি ভাবে ডূ কে?
-    বলল আর কোথায়? একে তো ওর আধো আধো কথা আমাদেরই অনেক কষ্টে বুঝতে হয়। তার ওপরে ডু ভালো করে ইংরিজিই জানে না তো ওর কথা কি করে বুঝবে? সে তো এক দৌড়ে দেখলাম ড্রেসিংরুমে ঢূকে গেল।
-    তারপর?
-    তারপর আর কি? সমীর দেখি লনের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় আধ ঘণ্টা বাদে ডু বেরোলো। আর যায় কোথা? সমীর এক লাফে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দু হাতে দুটো ফিনাইলের বোতল তুলে ধরে নিজস্ব ইংরিজিতে বোঝাতে চাইলো – ডু , ডু , ওয়াশ, ওয়াশ।
-    ডু কিনলো নাকি?
-    মাথা খারাপ তোমার? ডু বুঝতেই পারেনি ঘটনাটা কি ঘটছে। কলকাতায় নতুন। বয়সটাও বেশী নয়, ভাষাও বোঝে না। ডু এক দৌড়ে গেটের বাইরে গিয়ে গাড়িতে উঠে হাওয়া। পেছন পেছন সমীর দৌড়েছে, হাতে ফিনাইলের বোতল। ডূ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে সমীর ফিরলো।
-    তারপর ?
-    পাগলা টা তখন আমাদের বোঝাতে ব্যস্ত, যে ডু কে ইংরেজি ও বোঝাতে পারেনি বলেই ডু পালালো। আসলে ডু এর দোষ নেই এক ফোঁটাও।
গল্পটা শুনে সবাই একচোট হাসাহাসি করলো। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, এক শ্বেতকায় দীর্ঘদেহী শক্তসমর্থ চেহারার ফুটবলার দৌড়ে পালাচ্ছে, আর তাকে তাড়া করে আসছে এক শীর্নকায় খর্বাকৃতি বাঙালি যুবক, আর তাকে তাড়িয়ে আনছে তার পেটের ক্ষুধা। সেই দৌড়ের সামনে বোধহয় পৃথিবীর সেরা খেলোয়াড় ও হার স্বীকার করবে।
আস্তে আস্তে জেনেছি সমীর সম্পর্কে আরো তথ্য। ওর বাবা নেই। থাকার মধ্যে মা আর এক দাদা। দাদা ওদের দেখে না। আলাদা থাকে। ওর মা লোকের বাড়ি রান্না করে কোনো রকমে চালান। তাও চলেনা। কিন্তু সমীরের মাঠে আসা চাইই চাই রোজ। মোহনবাগান ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না ছেলেটা। একদিন অনেক কষ্ট করে বলে ফেলেছিলো, একটা কাজ কর্ম যদি জোগাড় করে দিতে পারি ওর জন্য। পারিনি। পড়াশোনা ক্লাশ নাইন অবধি। আর খুব একটা শক্তপোক্ত ও নয়। সবরকম কাজের পক্ষেই ও বড় বেশী করে আনফিট। মাঝে মাঝে ১০ – ২০ টাকা দিতাম ওকে। যেদিন চাইতো বুঝতাম সারা দিন হয়তো কিছুই খাওয়া হয়নি ওর। কেননা টাকা নিয়েই সঙ্গে সঙ্গে চলে যেত। আর ফিরে আসতো কিছু খেয়ে মুখ মুছতে মুছতে। এক দিকে তীব্র জীবন সংগ্রাম, অন্য দিকে হাজার হাজার প্রতিকূল আর বিষন্নতার মধ্যেও ওর মুখে হাজার ওয়াটের হাসি জাগায় খেলায় একটা জিত। শুধু মোহনবাগান নয়। অন্য ক্লাবে যান, সেখানেও দেখবেন সমীর দের অভাব নেই। এই ভাবেই বেঁচে আছে সমীর। সমীরেরা। আর বাঁচিয়ে রেখেছে কলকাতা ফুটবল কে। খবরের কাগজে যখন মাঝে মাঝে পড়ি, কলকাতা ফুটবল নাকি শেষ হয়ে গেছে, তখন হাসি পায়, আর সমীরের মুখটা মনে পড়ে। মনে হয়, ছাপার অক্ষরে লেখা কথা গুলো শুধুই কতগুলো অর্থহীন তথ্য মাত্র। তার বেশী কিছু নয়।
২০০৭ সালের ২৯শে জুলাই মোহনবাগান দিবসের শেষ হচ্ছিলো রাজকিয় নৈশভোজ দিয়ে। যাঁরা সদস্য অথবা মান্যগন্য মানুষ, তাঁদের জন্য ছিলো বিপুল আয়োজন। এটা প্রতিবছরেই হয়। আর খুব জাঁকজমক করেই হয়। ক্লাবের লনে খাওয়া দাওয়ার শেষে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে বেরোচ্ছি। দেখি সমীর কাঁটাতার ধরে দাঁড়িয়ে দেখছে সেদিন একটা বিশেষ দিন ক্লাবের পক্ষে। ১৯১১ সালে এই দিনেই মোহনবাগান প্রথম ব্রিটিশ দের হারিয়ে আইএফএ শীল্ড জিতেছিলো। ক্লাবে এই দিনটায় আসেন সমাজের মাথারা। সদস্যরা, তাঁদের পরিবারের লোকজন। সমীর ক্লাবের সদস্য নয়। তাই সে এই নৈশভোজ এলাকার বাইরে। আমাকে বেরোতে দেখেই হাত নাড়লো।
-    ভালো করে খেয়েছ তো দাদা? আমাদের ক্লাব খাওয়ানোতেও এক নম্বর। অন্য ক্লাব পারবে এরকম খাওয়াতে?
আমি নিশ্চিত। সমীর তখনো অভুক্ত ছিলো। ওর চোখ মুখ বলে দিচ্ছিলো সে কথা। হয়ত সেই গোটা রাত্রেই ও অভুক্ত ছিলো। কিন্তু ক্লাবের এই খাওয়াতে পারার গর্বে ওর চোখ মুখ ঝকঝক করছিলো।  

২টি মন্তব্য: