মঙ্গলবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১২

উন্নয়ন ও রোবোকপ

[রচনাকাল ২০১১ - pnachforon.blogspot.com এ প্রকাশিত হয়েছে]

ঢাকের বাদ্যি বাজতে এখনো অনেক দেরি। সবে জষ্টি মাসের শেষ। বঙ্গে পরিবর্তনের বায়ু বেশ দ্রুতগতিতেই বইছেন (এবং চারমূর্তির সেই ভাল্লুকের মতন টপাটপ মানুষ ও গিলছেন)। বাংলায় ভোটপর্ব চুকতে, আমরা আইপিএল নিয়ে কয়েকদিন লাফালাফি করলাম। কিন্তু কোলকাতার দল ইয়ের মতো পরপর দু খানা খেলায় হেরে প্রতিযোগিতার বাইরে চলে গেল। কয়েক দিন হাসপাতাল সুপার এর বরখাস্ত, অস্ত্র উদ্ধার, রেজ্জাক মোল্লার গোলা বর্ষন, রামদেব নিয়ে হইচই করলাম। কিন্তু কোনটাই ঠিক জমলো না। অগত্যা উত্তেজনায় ইতি। ওদিকে দার্জিলিং সমস্যার ও সমাধান  হয়ে গেল একটা সই দিয়ে। মাওবাদীরাও শুনছি নাকি দন্ডকারন্যে ফিরে গেছে। কিষেনজির টিআরপি পড়তির দিকে।

তেমন জমকালো ব্রেকিং নিউজ না থাকলে যা হয়, লোকে বাধ্য হয়ে খবরের কাগজে প্রথম পাতায় ভারতে সর্বাধিক প্রচারিত প্রথম শ্রেনীর বাংলা দৈনিক থেকে শেষ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রীট থেকে অভিক কুমার সরকার দ্বারা প্রকাশিত অবধি পড়ে। পড়তে গিয়ে দেখি, ব্রেকিং নিউজ ছাড়াও দেশে অনেক কিছু ঘটে। বিভিন্ন রাজ্যে চাষি রা কেমন মারমুখি হয়ে উঠেছে। উত্তর প্রদেশে তো মার মার কাট কাট হয়ে গেল, মায় আমাদের বীরভূমে পর্যন্ত দেখলাম চাষিরা জমির দখল নিয়েছে। হ্যাঁ, এই পরিবর্তনের হাওয়াতেও। তা এমন করলে তো মহা মুশকিল। কাগজ পড়তে গিয়ে চোখে পড়লো যে সেজ বা এস ই জেড (মার্কিনি এস ই জি) থেকে এবারে আর এক ধাপ এগিয়ে এন আই এম জেড তৈরি করা হবে। সেটা কি?

একটা মৌচাক বলতে পারেন। অনেক গুলো এস ই জেড একটা ঘেরাটোপের মধ্যে গড়ে তোলা হবে। সেখানে থাকবে উৎপাদনের জায়গা, শ্রমিক আবাসন, স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা ঘাট বাজার দোকান সমেত একখানা গোটা শহর। শুধু তফাত হলো, শহরের মতো থাকবে না কোন পৌরসভা। সবকিছুই থাকবে সেখানে যে সব কর্পোরেট সংস্থা থাকবেন, তাঁদের হাতে। তাঁরাই পরিষেবা দেবেন, রাস্তা ঘাট তৈরি করে দেবেন, স্কুল কলেজ বানিয়ে দেবেন। পড়ে বেশ লাগলো। নো পৌরসভা, নো ঘুঘুর বাসা, নো দুর্নীতি। কিছু লাগলে কর্পোরেট গুলো তৈরি করে দেবে। ঠিক সেই রোবোকপ ছবির মতো। রোবোকপ দেখেছেন তো? একটা বিরাট বড় কোম্পানি, ডেট্রয়েট শহর কে কিনে নিলো। পরিকল্পনা হলো, পুরনো শহরটা ভেঙ্গেচুরে নতুন আধুনিক একটা শহর তৈরি করবে তারা। নাম হবে ডেল্টা সিটি। সেই শহরের পুরো পরিচালন ব্যবস্থাই তাদের হাতে। এমন কি পুলিশ পর্যন্ত। লোকজনের বাড়ি ভেঙেচুরে তারা উদবাস্তু দের ব্যারাক বাড়িতে ঢোকালো। অনেক টা নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মত ব্যাবস্থা পত্র সেখানে। লোকে প্রতিবাদ করতে গেলো, খেলো গুলি। অবশ্য শেষে রোবোকপ (রোবট পুলিস, একটা মানবিক হৃদয় সমেত, সে ই এই গল্পের সুপার হিরো ) সমেত পুলিশ বাহিনি বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে কর্পোরেট এর কত্তা দের পিটিয়ে তক্তা করে দিলো। হ্যাপি এনড।

এক কর্পোরেট কত্তা বলেছেন, টেরিটোরিয়াল আর্মি গুলোকেও কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে। রনবীর সেনা, সানলাইট সেনা রা এবারে কর্পোরেট পালিশ পাবে, আধুনিক অস্ত্র শস্ত্র ও সরকারি অনুমোদন সমেত। এস ই জেড এর ভেতরে এমনিতেই সরকারি শ্রম আইন চলেনা। এন আই এম জেডের ভেতরেও চলবে এমন কোনো লক্ষন তো দেখছি না। সেখানে, কর্পোরেট কত্তারা যা বলবেন সেটাই আইন। শুনতে হবে এনাদের কথা। না শুনলে উড়ে পুলিস এসে একুশ দফা হাঁচিয়ে মারতে পারে। তবে সব পুলিস তো উড়ে নয়। তারা কি ভাবে মারবে তার নিশ্চয়তা নেই। গোটা দেশে টুকরো টুকরো এন আই এম জেড। খন্ড বিখন্ড ভারতবর্ষে কর্পোরেট হাউসের নিজস্ব খাশতালুক। সেখানে আইন চলেনা দেশের। মানুষের হাতে ক্ষমতা নেই সেখানে। মানুষের কন্ঠস্বর নেই। আছে শুধু কর্পোরেটের অঙুলিহেলন, আর আছে লক্ষ লক্ষ মূক সেবাদাস। দেশের মানুষ লড়াই করে নিজের হাতে ক্ষমতা এনেছে। পঞ্চায়েত হয়েছে, নগরপালিকা এসেছে। আজ সেই সব কিছুকে বেচে দেওয়া হচ্ছে বানিয়ার হাতে। আবার সেই বনিকের মানদন্ড। সাধু সাবধান।

দেশকে টুকরো টুকরো করে বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা। সংসদে বিল পাশ করিয়ে, আরো বেশি করে দেশের দরজা বানিয়াদের কাছে খুলে দিতে গেলে এখনো কিছু বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। সংখ্যায় খুব কমে গেলেও লাল ঝান্ডাধারীরা এখনো প্রানপনে বাধা দিয়ে যাচ্ছে। বাংলায় তো তাদের কাবু করাই গেছে দিদিমনি কে দিয়ে। কিন্তু তার পরেও নয়ডার প্রতিরোধ হচ্ছে। বীরভুমে চাষীরা বেয়াড়া হয়ে উঠছে। তাই, টুকরো করে বেচো। মানুষ কে ভাগ করে দাও। একদল পরিনত হোক কর্পোরেটের ঘেরাটোপের মধ্যে থাকা সেবাদাসে। যদি বেয়াড়াপনা করে, তার জন্য কর্পোরেট সানলাইট সেনারা তো রয়েইছে। আর রোবোকপ? সিনেমায় সে ছিলো। আর ছিলো তার বিবেক। বাস্তবে কি সে থাকবে? আর অন্য দল পড়ে থাক মাঠে ময়দানে। বেওয়ারিশের মত। বেওয়ারিশ, কারন তারা নিজের অর্জিত অধিকার কে রক্ষা করার , সেই জন্য লড়াইয়ের উত্তরাধিকার কে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। তাই বেওয়ারিশ। হয়ত বেওয়ারিশ কুকুর ধরা গাড়ির মত একদিন বেওয়ারিশ মানুষ ধরা গাড়ি ও আসবে। যেমন নাৎসিরা আনতো। তবে এখনো হয়ত অল্প সময় বাকি আছে। প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধের সময় এটা। প্রতিরোধ করুন এদের। না হলে একদিন ওই মূক সেবাদাস অথবা বেওয়ারিশ হবার জন্য তৈরি হোন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন