[রচনাকাল ১৯শে মে ২০১১ - pnachforon.blogspot.com এ প্রকাশিত হয়েছে]
পয়লা এবং পঁচিশে , এই দুই সমেত বৈশাখ গত হয়েছেন। জষ্টী মাসের পচা গরমে বাজারে গুটি গুটি পায়ে হিমসাগরের আমদানি শুরু হয়েছে। ভোট পার্বন শেষ। পরিবর্তন বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ভোরের দিকে মিঠে মিঠে হাওয়ায় ঘুমের আমেজ গাঢ় হচ্ছে। যদিও রাত্রি বেলা পেটে ভিজে গামছা জড়িয়েও হাঁসফাঁস দশা কাটছেনা। তার ওপরে গতকাল বুদ্ধপুর্নিমা ছিল বলে রাত্রে পাতে পড়ল পরোটা আর আলুর দম। সঙ্গে রাবড়ী আর পান্তুয়া।
কিঞ্চিত গুরুভোজন হয়েই গেল। তা আর কি করা? লুঙ্গী হাঁটুর ওপর তুলে, পাখার তলায় বসে রইলুম। এগারোটা বাজার পর, আস্তে আস্তে হেলতে লাগলুম। ডান দিকে না বাঁ দিকে সেইটে মনে নেই ঠিক। আস্তে আস্তে বিশ্বচরাচর কেমন তরল হয়ে গেল। দেখলুম আমাদের সেই শিবপুরের পুরোনো বাড়ি, যেটা বিদ্যাসাগর সেতুর জন্য ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। সেই উঠোন, ঠাকুমা কয়লার উনুনে রান্না করছে। মা আর কাকিমা ঘুর ঘুর করছে। বাবা পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘরের দিকে গেল, বোধহয় বুদ্ধির গোড়ায় কিঞ্চিত ধোঁয়া দিতে চায়। কাকু গামছা পরে চৌবাচ্ছায় মাছেদের খাবার দিচ্ছে, ছোটোকাকু এক মনে সাইকেল পরিস্কার করছে। আর দেখি, দালানে চেয়ার পেতে টাক মাথা আর দুধ সাদা দাড়ি নিয়ে বসে আছে আমার দাদু। খবরের কাগজ পড়ছে। প্রথম পাতা। পরিবর্তনের কথা বেশ মন দিয়ে পড়ছে। মাথা তুলে বলল –
কিঞ্চিত গুরুভোজন হয়েই গেল। তা আর কি করা? লুঙ্গী হাঁটুর ওপর তুলে, পাখার তলায় বসে রইলুম। এগারোটা বাজার পর, আস্তে আস্তে হেলতে লাগলুম। ডান দিকে না বাঁ দিকে সেইটে মনে নেই ঠিক। আস্তে আস্তে বিশ্বচরাচর কেমন তরল হয়ে গেল। দেখলুম আমাদের সেই শিবপুরের পুরোনো বাড়ি, যেটা বিদ্যাসাগর সেতুর জন্য ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। সেই উঠোন, ঠাকুমা কয়লার উনুনে রান্না করছে। মা আর কাকিমা ঘুর ঘুর করছে। বাবা পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘরের দিকে গেল, বোধহয় বুদ্ধির গোড়ায় কিঞ্চিত ধোঁয়া দিতে চায়। কাকু গামছা পরে চৌবাচ্ছায় মাছেদের খাবার দিচ্ছে, ছোটোকাকু এক মনে সাইকেল পরিস্কার করছে। আর দেখি, দালানে চেয়ার পেতে টাক মাথা আর দুধ সাদা দাড়ি নিয়ে বসে আছে আমার দাদু। খবরের কাগজ পড়ছে। প্রথম পাতা। পরিবর্তনের কথা বেশ মন দিয়ে পড়ছে। মাথা তুলে বলল –
- বেশ হয়েছে
- কি হয়েছে দাদু?
- এই যে, পরিবর্তন
- সে কি দাদু? তুমি না স্বাধীনতার আগে থেকে দলের সদস্য? ভগত সিং এর সঙ্গে ছিলে? এত বছর জেল খাটলে?
- তাই তো বলছি, বেশ হয়েছে।
- বামপন্থীরা সরকার থেকে সরে গেল আর বেশ হলো?
- কার সরকার?
- কেন? বামপন্থী দের। মানুষ ই তো নির্বাচিত করেছিল।
- তা তারা আবার নির্বাচিত করলনা কেন?
- ভুল বুঝলো, ভুল বোঝালো, বামফ্রণ্ট সরকারের কিছু জায়গায় মানুষকে বোঝানো উচিত ছিলো আরো।
- ভুল বোঝাতেই বুঝে গেলো? ভারি বুঝদার তো মানুষ !!
- না না, সংবাদ মাধ্যমের প্রচার, ভুল ভাষ্য, বিদেশী শক্তি, সবই আছে এর মধ্যে। মানুষ বিভ্রান্ত।
- তা বামপন্থীরা ঠিক টা বোঝালো না কেন?তারা তো ঠিক টা বোঝে
- আসলে, সিঙ্গুর – নন্দীগ্রাম নিয়ে লোকে বড্ড উত্তেজিত ছিল। মুখ্যমন্ত্রি বললেন যে জোর করে জমি নেওয়া হবে না নন্দীগ্রামে। তাও ওখানে বিরোধী শক্তি কিছু নৈরাজ্যবাদী আর সন্ত্রাসবাদীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মানুষ খেপালো। প্রশাসন কে ঢুকতে দিলো না। তাই পুলিশ দিয়ে ঢুকতে হলো।
- মুখ্যমন্ত্রি গেলেন না কেন? তিনি তো ভালো মানুষ। আর নন্দীগ্রামের আগে ওনাকে লোকে রক্তখেকো টেকো বলার সুযোগ পায়নি।
- কি করে যাবেন? যদি পাবলিক খেপে গিয়ে গনধোলাই দেয়?
- জ্যোতি তখন যুক্তফ্রন্টের পুলিশ মন্ত্রি। একবার পুলিশ খেপে গিয়ে বিধান সভায় বন্দুক সমেত ওর ঘরের সামনে এসে গিয়েছিলো ওকে মারবে বলে। জ্যোতি ঘরের বাইরে এসে বললো, “কই , কে মারবে আমাকে, সামনে এস দেখি”। ব্যাস, দু মিনিটে সব হাওয়া।
- সব নেতাই আলাদা। এক এক জন এক এক রকম।
- বাকি লোক জন কি করে গেলো? বুদ্ধিজীবিরা তো গেছিল। ওদের সঙ্গে তো বুদ্ধ বাবুর ভালই জমতো। ওদের সঙ্গে নিয়েই যেতে পারতেন। ওখানে ওদের সঙ্গে বসে, অভিমান মিটিয়ে, একটা মঞ্চে উঠে আন্দোলন কে স্বীকৃতি দিয়ে চলে আসতেন। মানুষ বুঝতো, তারা না চাইলে কারখানা হবে না, আর এটাও বুঝতো, চাইলে কারখানা হবে। সিঙ্গুরে লোকজন এই দেখে ভরসা পেতো। হোর্ডিং দিয়ে লিখতে হতো না “আমার সরকার আমার পাশে”।
- তা পারতেন। সে কাসুন্দি এখন ঘেঁটে আর কি হবে? সিঙ্গুরে কিন্তু উলটো। এখানে মিডিয়া কিছুটা সমর্থন করেছিলো। হাজার হোক টাটা কোম্পানি।
- সমর্থন যখন ছিলো, তখন শক্তি প্রয়োগ করে দিদি কে গ্রেফতার করতেই পারতো। ২১ শে জুলাই তো গুলি চালিয়ে কংগ্রেসী গুণ্ডা দের ছত্রভঙ্গ করা হয়েছিলো। সরকার পড়েছিলো কি?
- তাহলে আগুন জ্বলতো।
- আগুন কি জ্বললো না? দুর্বল শাসক কে কে দেখতে চায়? রাহুলকে মায়াবতী গ্রেফতার করেনি?
- এখন তো আর কিছু করার নেই। এখন তো সরকার আর নেই। এখন বামপন্থীরা বিরোধী।
- কার বিরোধী?
- কেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের।
- সরকারটা কার?
- কেন? তৃনমূল আর কংগ্রেস জোটের। যাদের ভোট দিয়ে মানুষ নির্বাচিত করলো।
- তাহলে তাদের বিরোধীতা মানে তো বেশীর ভাগ মানুষের পছন্দের বিরোধীতা
- আ মোলো যা, তা হবে কেন? তুমি দাদু আজকের ভাষায় পুরো গাঁট পাবলিক। আরে বাবা, এরা আদতে দক্ষিনপন্থী, আধা ফ্যাসিস্ট, সেটা তো বোঝো? এদের আদর্শের বিরোধী আমরা। মানুষের বিরোধীতা কেন করবো?
- কিন্তু এরা তো বললো “মা-মাটি-মানুষ”। যেটা আসলে বামপন্থী স্লোগান।
- সেটা এদের মুখোশ, মেকি স্লোগান। এটা চলবে না বেশীদিন। এদের স্বরূপ উদঘাটিত হবে কয়েক দিনেই।
- তারপর? ২০১৬ তে অস্টম বামফ্রণ্ট? সে তো ১৯৭৭ সালেও শুনেছিলাম। অল্প দিনেই এই সরকার পড়বে। টিঁকে গেলো ৩৪ বছর। মানে ওরা ভুল করলে তবেই সরকার পড়বে, না হলে নয়?
- তা কেন? বামপন্থী রা মানুষের কাছে যাবে, তাদের কাজ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে। মানব বন্ধু সরকার একমাত্র বামপন্থীরাই গড়তে পারে।
- সে তো আগেও গেছে। হারলো কেন? পশ্চিমবঙ্গ সরকার আসলে তো ভারত সরকারের একটা অংশ। সে সরকার কে তো পুঁজিবাদী, বুর্জোয়া, সাম্রাজ্যবাদী বলেই জানি। সেই সরকারের একটা অংশ মানে, তার মধ্যেও এই সব ব্যাপারের কিছুটা চরিত্র থেকে যাবেই। যেমন পুলিশ, বা আমলাতন্ত্র। এগুলই তো উদাহরন যে বামফ্রন্ট সরকারের মধ্যে কি চরিত্রের সব লোকজন ছিলো। চাকরি থেকে অবসর নিয়েই তৃনমুলের হয়ে ভোটে নেমে গেলো।
- তা ঠিক।
- এই সরকারে ৩৪ টা বছর। পার্টির বামপন্থী চরিত্রে কিছু ভেজাল ঢোকেনি?
- সেটাও নাহয় মেনে নিলাম। কিন্তু তাই বলে তৃনমূল?
- নিরুপম সেন একটা বই লিখলেন বিকল্পের সন্ধানে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে থেকে, একটা অঙ্গরাজ্যের বামপন্থী দের মানব কল্যানের চেষ্টা। ভালো লেখা। যুক্তি আছে অনেক। যদিও এ হলো আরো ১৫ বছর আগেকার পরিকল্পিত শিল্পায়ন নীতির ব্যাখ্যা। সে গুলো করেছিলো জ্যোতি, পরে সপ্তম বামফ্রন্টের আগে অনিল বিশ্বাস এই শিল্পায়নের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু, যদি সেই পুঁজিবাদকেই মেনে নিয়ে থাকতে হবে, তাহলে পুঁজিবাদীদেরই ক্ষমতায় বসাই। বামপন্থীদের কেন বসাবো?
- কিন্তু মানুষের ভোট তো ওরা পেলো বামপন্থী স্লোগান দিয়ে।
- সেটা তো আরো হাস্যকর। স্লোগান চুরি। কেন? বামপন্থীদের কেউ স্লোগান দিতে বারন করেছিলো বুঝি? আজকাল গনসঙ্গীত বাজেনা, আন্তর্জাতিকের কথা বাদ ই দিলাম না হয়।
- আরে, পার্টি তো স্থানীয় হিসেব নিকেস করে বুঝতেই পেরেছিল যে লোকে খেপছে। কিন্তু তাই বলে তো নিজের সরকারের বিরোধিতা করতে পারে না।
- কোন সরকার? সে সরকারের কথা আর চরিত্র নিয়ে তো এখুনি বললাম। পশ্চিম বাংলায় সমাজ তন্ত্র, গুজরাটে পুঁজিবাদ, এরকম হয় নাকি? সরকার থেকে পার্টি কে আলাদা করা যায় না? সরকার নাহয় শাষক, পার্টি তো মানুষের।
- পার্টি নিজের সরকারের বিরোধিতা করবে? তাজ্জব।
- একটা পপুলার ফ্রণ্ট করুক। যেখানে কম্যুনিস্ট রা নেতৃত্ব দেবে। যে ফ্রন্ট ভোটে দাঁড়াবে। পার্টি সরাসরি ভোট থেকে সরুক। শ্রেনী ভিত্তিক আন্দোলন এবং রাজনীতি করুক। এতে করে সরকারের বিরোধীতা করতেও অসুবিধে থাকবে না। যেমন ছাত্র, যুব, শ্রমীক, কৃষক এবং মহিলাদের গনসংগঠন, তেমনই, ফ্রন্ট হোক নির্বাচন এবং সরকার চালানোর জন্য একটা অস্ত্র। পূঁজিবাদের ক্লেদ তাহলে পার্টির গায়ে সরাসরি লাগবে না। আর তা ছাড়া অন্য বাম শক্তি যারা সিপিআই(এম) এর জন্য বামফ্রন্ট থেকে দূরে, তারাও হয়তো পপুলার ফ্রন্টে প্রতিনিধি পাঠাবে। আর কম্যুনিস্ট ছাড়াও অন্যরা আসতে পারবে।
- মানে আর একটা পার্টি?
- না না, পার্টি না। পার্টি মানে ভোট নয়। এটা একটা ফ্রন্ট, ভোট এবং রাজ্য শাষনের জন্য। পার্টি থাকুক পার্টির জায়গায়। যখন ই দেখবে, ফ্রন্টের মধ্যে বিচ্যুতি, পার্টি তাকে লাগাম দেবে। দরকার হলে আন্দোলন করবে। যেখানে যা যা বিক্ষোভ, সেগুলো পার্টি ধরে নেবে এবং আন্দোলন পরিচালনা করবে। অন্য শক্তি কে পা রাখতে দেবে না।
- দাঁড়াও দাঁড়াও, আমাদের লোকাল কমিটি কোথায় যাবে? আর আমাদের শাখা সম্পাদক সমর দা? পার্টি তে? না ফ্রন্টে? এই দুটোয় মারামারি হলে?
- সমর তো গ্রীলের কারখানায় কাজ করে। বাড়ি বাড়ি গনশক্তি দেয়। পার্টি টা তো ওদেরই জন্য। ফ্রণ্টটা না। আর ফ্রন্টে পার্টি তে কামড়াকামড়িটাই ভালো। এটাই দরকার। না হলে লোকে বলবে পার্টি সরকারের দালালি করছে।
- কিন্তু এসব তো স্রেফ ধারনা। সত্যি তে তো এমন হতে পারেনা। পার্টি সরকারে নিজের স্থান ছাড়তে রাজি হবে কেন?
- কেন হবে না? না হলে জোর করে লোকে ছাড়িয়ে দেবে। এই তো দিলো। দিলো না?
- তা দিলো। তবে সেই অর্থে তো পার্টী এখনই সেরকম ভাবে কাজ শুরু করতে পারে।
- সে তো পারেই। এখান থেকেই শুরু করা যাক। পার্টি থাকুক মানুষের সঙ্গে।
- তা হলে তো পার্টির ক্ষমতায় থাকা না থাকা টা কোন ব্যাপারই না।
- ব্যাপার তো নয়ই। পার্টি পার্টির কাজ করেই যাবে। এটাই কাজ। এই ভাবেই একদিন গোটা দেশে বাম আন্দোলন কে নিয়ে যেতে হবে। হতাশার কোন জায়গাই নেই।
এই সময় আবার পরিবর্তন এলো। কর্কশ আওয়াজে তরল অবস্থা টা বায়বীয় হয়ে উবে গেল। ভোর পাঁচটা বাজলো। উঠে পড়তে হবে। নতুন দিন। পরিবর্তন এসেছে। জীর্ন পুরাতন ভেঙ্গে যাক। অনেক কাজ সামনে। অনেক কাজ আমাদের।
[আমার দাদু অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। অল ইন্ডিয়া রেলওয়ে মেনস ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন স্বাধীনতার আগে থেকে। শ্রদ্ধেয় জ্যোতি বসু তখন সেখানকার সম্পাদক। বয়সে একটু ছোট বলে, দাদু জ্যোতি বলে ডাকতেন। আমি শুধু দাদুর মুখে সম্বোধন টুকু বসিয়েছি।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন