মঙ্গলবার, ১০ জুন, ২০১৪

মুর্গ ভর্তা

পাবলো পিকাসো কে তাঁর আঁকার গুরুদেব নাকি টানা ছ-মাস কেবল পায়রার পা আঁকিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে পাবলোর গুরুদেব খুব সম্ভবতঃ তাঁর পিতৃদেব, কাজেই বেচারাকে মুখ ব্যাজার করে পায়রার পা আঁকতেই হয়েছিলো ছ মাস। তবে কিনা, এর পরে, পাবলো পিকাসো কে নিখুঁতের মাপকাঠি নিয়ে কখনো ভাবতে হয়নি। ওই ছটা মাসেই, নিখুঁত মানে যে কেমন নিখুঁত , সেটা তাঁর বোঝা হয়ে গিয়েছিলো।

নিখুঁত স্বাদ, মানে যেটা যেমন, সেটা তেমন কি করে আনা যায়? বাঙালি রান্না করতে গেলে মা-ঠাকুমারা দু এক খানা অমুল্য টিপ্‌স দেন, তাতেই কেল্লা ফতে হয়ে যায়। এই যেমন ধরুন, লুচি ভাজার সময় খুন্তিটা লুচির পিঠে একবার বুলিয়ে দেওয়া। কিন্তু মুশকিলটা হয় যখন অবাঙালি রান্না হয়। ইতালি চিন ছেড়েই দিন, ভারতেরই অন্য প্রদেশের রান্না, বাঙালি হেঁসেলে ঢুকে একটু বাঙালি হয়েই যায়। আমার সঙ্গে অনেকেই হয়ত একমত হবেন না। আসুন একটা উদাহরন দি।
আপনার পাড়ায় বা কাছাকাছি তল্লাটে নিশ্চই রুমালি রুটি আর তড়কা পাওয়া যায়। যদিও তড়কা বলে কোনো বস্তু পাঞ্জাবি খাদ্যতালিকায় নেই। তেল মশলা দিয়ে ডাল বা কোনো রান্না সাঁতলানোকে ওনারা বলেন তড়কা দেওয়া। তো, আপনি তড়কার দোকানে তড়কা কিনবেন বলে দাঁড়িয়ে। আপনার সামনেই ছোকরা কড়ায় দিলো তেল, এক এক করে পেঁয়াজ রসুন আদা টমেটো ও দিলো, জিরে, ধনে লঙ্কা নুন টুন দিলো, একটা ডেকচি থেকে ডাল সেদ্ধ বের করে কড়ায় দিয়ে নাড়লো, তার পর আপনাকে দিলো। আপনি খেয়ে আহা উহু করলেন, আর পরের সপ্তাহে, ঠিক একই ভাবে, খুব যত্ন করে বাড়িতে রান্না করলেন তড়কা। কিন্তু হা হতস্মি, দোকানের তড়কা আর বাড়ির তড়কায় হলো আকাশ পাতাল তফাত। স্বাদ অনেকটা ফিকে ফিকে, গন্ধও তেমন জমাটি হলো না। সবই আছে, কিন্তু কি যেন একটা নেই। আপনি বোকা বনলেন, আর ভাবলেন, ওই ছোকরা নিশ্চই এমন একটা কিছু দেয়, যেটা ও আপনাকে দেখতে দেয় না।

বাঙালি রান্নায় যেমন, পাঞ্জাবি রান্না বা আওয়াধি রান্নাতেও তেমন কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, যেটা না মানলে রান্নায় স্বাদ ঠিকঠাক আসে না। পদ্ধতি বলা হয়তো ভুল হলো, বরং বলা ভালো কতিপয় টিপ্‌স্‌ , যা ব্যবহার করলে, আপনার মনে হবে, বাড়িতে নয়, হানি-দা-ঢাবা তে বসেই খাচ্ছেন বুঝি।

মুর্গ ভর্তা বেশ সোজাসাপ্টা রান্না। ঝামেলা নেই তেমন। করাও সহজ আর খেতেও ভালো। নিচে পদ্ধতিটা লিখছি, কিন্তু আবার ও বলছি, যদি ওই মাখো মাখো জমাটি মজলিশি স্বাদ পেতে চান, এ পদ্ধতি আর উপকরনে কিছু মাত্র পরিবর্তন করবেন না। তবে আগে ভাগেই বলে দি, এ রান্না কিন্তু আর পাঁচটা পাঞ্জাবী রান্নার মতই বেশ ভারি-ভরকম। হালকা পাতলা পেটরোগা রান্না নয়। আর খাওয়ার সময় রুটি দিয়েই খাবেন। এ রান্না ভাত জাতীয় জিনিষের সঙ্গে নিতান্তই বেমানান।


উপকরন
হাড় ছাড়া মুর্গি ৩০০ গ্রাম। দোকান থেকে এনে, টুকরো গুলো খুব পাতলা পাতলা লম্বাটে ফালি করে নেবেন। একটু মোটা টুকরো হয়ে গেলে কিন্তু স্বাদে বদল আসবে। কতটা পাতলা করে কাটবেন? ধরে নিন তিন থেকে চার খানা ক্রেডিট কার্ড পাশাপাশি ধরলে যতটা মোটা হয়, ততটুকুই। তার বেশি নয়। আরো সহজ করে বললে বলবো, ধরে নিন আলু ভাজা কাটছেন। তাহলে যেমন কাটেন, সেরকম কাটুন।

একটা বড় পেঁয়াজ, বা দু খানা ছোটো আকারের পেঁয়াজ কুচিয়ে নিন। একটা মাঝারি টমেটো একদম ছোটো ছোটো করে কুচিয়ে নিন। চায়ের চামচের তিন চামচ আদা বাটা আর দু চামচের একটু বেশি রসুন বাটা, দু চামচ জিরে গুঁড়ো, দু চামচ ধনে গুঁড়ো, এক চামচ কাশ্মীরি লঙ্কা গুঁড়ো, এক চামচ লাল লঙ্কা গুঁড়ো, আধ চামচ হলুদ গুঁড়ো, দু চামচ মেথি পাতা (বাংলায় পরিচিত কাশুরি মেথি নামে), চার-পাঁচ খানা ছোটো এলাচ ও লবঙ্গ, এক ইঞ্চি পরিমান দারচিনি, দেড় চামচ পাঞ্জাবী গরম মশলা গুঁড়ো (যে কোনো মুদিখানায় কিনতে পাওয়া যায়)। এক কাপ কাজু বাটা, এক কাপ দই। আধ কাপ সাদা ক্রীম (এটা আপনার পছন্দের ওপর। দিতেও পারেন, নাও পারেন)। সাদা তেল লাগবে কিছুটা। সূর্‍্য্যমুখী বা বাদাম তেল হলেই হবে। এক চামচ মাখন। সামান্য একটু ধনে পাতা ও পাতি লেবু – এগুলো সাজাবার জন্যে, স্বাদ বা গন্ধের জন্যে নয়।

প্রস্তুতি
এ রান্নায় প্রস্তুতি নেই তেমন। শুধু মুরগি টুকরো করা, পেঁয়াজ কাটা, আদা রসুন বাটা, কাজু বাটা আর দই ফেটানো।

জিরে, ধনে, হলুদ আর দু রকম লঙ্কা গুঁড়ো একটা বাটিতে নিয়ে খুব অল্প জল দিয়ে একটা পেস্ট গোছের করে নিন। এতে রান্না করতে সুবিধে হবে।

মুরগিতে নুন হলুদ মাখিয়ে নিন খুব অল্প।

প্রনালী
কড়া বা প্যানে তেল নিন। তেল গরম হলে, তাতে দারচিনি, লবঙ্গ আর ছোটো এলাচ দিন। ১০-১২ সেকেন্ড পর পেঁয়াজ ছাড়ুন তেলে। ভাজতে থাকুন যতক্ষন না পেঁয়াজ সোনালী হচ্ছে। নাড়তে থাকবেন, নাহলে এক পিঠ পুড়ে খয়েরি হয়ে যাবে, অন্য পিঠ সাদা থেকে যাবে। চিনে রান্নায় ওপরটা পোড়া আর ভেতরটা আধ সেদ্ধ , এই ব্যাপারটা দুরন্ত একটা স্বাদ আনে। পাঞ্জাবী রান্নায় কিন্তু ব্যাপারটা আলাদা। সবটা একরকম রান্না হতে হবে। একটু সোনালি হচ্ছে দেখলে পেঁয়াজের ওপর আদা রসুন বাটা দিন। আর নাড়তে থাকুন। তবে কিনা এবারে একটা কায়দা করতে হবে আপনাকে। অনেকেই যদিও এটা জানেন। আদা রসুন বাটা দিয়ে নাড়তে নাড়তে দেখবেন মশলা কড়া বা প্যান যাতে করে রান্না করছেন, তাতে তলা লেগে যেতে শুরু করেছে। অথচ তখনো মশলা থেকে তেল বেরিয়ে আসছেনা, অর্থাৎ রান্না পুরো হয়নি। তাই এক্ষেত্রে একটা বাটিতে একটু জল নিয়ে উনুনের পাশে রেখে দিন। যেই দেখবেন তলা লাগছে, এক চামচ বা দু চামচ জল দিয়ে নাড়ুন। এতে করে তলা লাগবে না, পুরো মশলা ঠিকঠাক রান্না হবে।

আদা রসুন থেকে এক দেড় মিনিটেই তেল বেরিয়ে আসছে দেখলে এবারে তাতে টমেটো কুচি দিন, জিরে, ধনে, লঙ্কা, হলুদের ভিজিয়ে রাখা মিশ্রনটা দিন, আর একটু সামান্য নুন দিয়ে নাড়তে থাকুন। তলা লেগে যেতে দেখলেই একচামচ জল দেবেন। টমেটো গলে মিশে যাবে মশলার সঙ্গে, মিনিট দুই তিন সময় লাগবে। এবারে মুরগি গুলো ছাড়ুন কড়ায়। মাঝারি আঁচে মুরগি নাড়তে থাকুন। নাড়া থামাবেন না। তাহলে ঠিক ভাবে রান্নাটা হবে না। তলা লেগে গেলে এক চামচ করে জল দিন। কিন্তু জল বেশি দেবেন না। সাত থেকে দশ মিনিট মুরগিটা রান্না করুন। এবারে কাজু বাটা (এক কাপ) দিয়ে দিন রান্নায়। ভালো করে মিশিয়ে দিন কাজু বাটা। মিশে গেলে এবারে দিন দই (এক কাপ)। সেটাও ভালো করে মিশিয়ে নিন। মিশে গেলে ক্রিমটা ঢেলে দিন। ভালো করে নেড়ে চেড়ে মিশিয়ে দিন। নুন টা চেখে নেবেন। কম মনে হলে একটু দিয়ে দিন। এক চামচ মাখন দিন রান্নায়। এবারে নামাবার পালা। নামাবার আগে কাসুরি মেথি বা মেথি পাতা ছড়িয়ে দিন আর পাঞ্জাবী গরম মশলা দিন। ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে নামান।   


পরিবেশনের সময় টুকরো করে পাতি লেবু আর ধনেপাতা কেটে সাজিয়ে দিতে পারেন। কোনো এক অজানা কারনে আমি এভাবে সাজাই না। বরং ওগুলো স্যালাডের সঙ্গে দিয়ে দি। গরম গরম খাবেন। ঠান্ডা করে লাভ নেই। স্বাদ কমে যাবে তাতে।

২টি মন্তব্য :

  1. dada apnake onek thanku eirakom darun ekta chiken recipe upohar deyor jonno songe darun tips.

    উত্তরমুছুন
  2. রান্না করে খেয়ে বলবেন কেমন লাগল। ভালো লাগলে আমার ও ভালো লাগবে।

    উত্তরমুছুন