শনিবার, ১৪ জুন, ২০১৪

সেলিন্‌থিপের দেশে

(১)
ব্যাঙ্কক শহরটা বিশাল বড়। কিন্তু ঠিক কলকাতার মতো না। কলকাতার মানচিত্র, আমার করা ডিমের পোচের মত দেখতে ছেতরে যাওয়া, একদিকটা লম্বাটে, কিছুটা যেন ছিঁড়ে আসছে, কুসুমটা গলে গড়িয়ে গেছেকিন্তু ব্যাঙ্কক অনেকটা ওস্তাদের হাতে তৈরি ডিমের পোচ (আসলে এটাই ফ্রায়েড এগ। আমাদের ডিম ভাজা হলো অমলেট, আর পোচড্‌ এগটা তৈরি হয় ফুটন্ত জলে ডিম ভেঙে ছেড়ে দিয়ে)। প্রায় গোলাকার, আর মাঝামাঝি হলো তার ধর্মতলা বা ডাউনটাউনবেশিরভাগ শহরেই ধর্মতলা থাকে শহরের কেন্দ্রে, বাত্যয় নিউ-ইয়র্ক। ওঁয়াদের ইয়েটা হলো শহরের এক প্রান্তে, সমুদ্দুরের ধারে
ওই যে, যেখানে পেল্লায় উঁচু দুটো বাড়িতে প্লেন দিয়ে ধাক্কা মেরে......। কলকাতা থেকে দু ঘণ্টা উড়ে যেখানে নেমেছি, সেটা আদতে ব্যঙ্ককের বিখ্যাত সুবর্নভূমি বিমানবন্দর নয়। শুনেছি সেটা নাকি অ্যায়সা ঝাঁ-চকচকে, যে দেখে আপনার মাথা ঘুরে যাবেই আর ব্রহ্মতালুর সেই ঘূর্ণীতে যাতে আপনি ধাঁই করে পড়ে মুন্ডু না ফাটান, তাই নাকি সেই বিমানবন্দর আদ্যপান্ত নরম কার্পেটে মোড়াপড়ে গেলেও লাগবেনাআর দোকানপাট? আমাদের নিউমার্কেট – সাউথ সিটি – মনি স্কোয়ার - অবনি নাকি তার কাছে তুশ্চুদেখলেই চোখ টেরিয়ে যায়। আর চোখের সেই ট্যারা ভাব ঠিক করার জন্যে নাকি বিমানবন্দরের সব দোকানের শো-উইন্ডোর শার্সিতে পাওয়ার দেওয়া আছেসুবর্নভূমির বর্ননা দিয়েছিলেন বন্ধুবর স্বনামধন্য সেন মহাশয় ব্যাটা একে বেঁটে, তায় বদ্যি তার ওপর আবার পদ্মাপারের, কাজেই সে বর্ননা আপনি পড়বেন কিনা, আর পড়লেও গিলবেন কিনা, সে ভার আপনার ওপরেই ছাড়লামকারন আমি সুবর্নভুমি দেখিনি। আমরা যেখানে নেমেছি, সেই বিমান বন্দরে শুধু আসে এয়ার এশিয়ার বিমান। এ হলো কিঞ্চিত সস্তার এয়ারলাইন। কলকাতা থেকে ছাড়ে রাত একটার সময়, আর দু ঘণ্টা পরে নেমে পড়ে ব্যাঙ্ককে। সেখানকার সময় অনুযায়ি তখন সূয্যি উঠি উঠি করছে। তা ওই মাঝরাতের উড়ানে খাবোই বা কি? ও তো আমাদের ঘুমের সময়। কাজেই খাদ্য পানীয় নাই বা দিলো? কেবল আমার কন্যারত্নের জন্যে এক বোতল জল এনেছি। আমাদের মধ্যে তার উৎসাহই সবচেয়ে বেশী। জীবনে প্রথম বার আকাশে ওড়ার টেনশনে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একবার রাস্তায় বমি করেছে, তারপর দমদম বিমানবন্দর দেখে খুশিতে প্লেনে ওঠার আগে ঘন্টা তিনেক দৌড়োদৌড়ি করেছে। আমি প্লেনে উঠে লাল স্কার্ট পরা বিমানসেবিকাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বিমানে বাথরুম আছে কিনা। কে জানে বাবা, খেতে দেবেনা বলে যদি ইয়ে করতে না দেয়? উত্তরে সাড়ে-বত্রিশ পাটি (আধখানা আক্কেল দাঁতও ছিলো) উজাড় করা একটা কিছু পেলাম। সেটা হাসি, না দাঁত খিঁচুনি, ঠিক বলতে পারবো না।  

ডন মুয়াং হলো ব্যাঙ্ককের পুরোনো বিমানবন্দর। সুবর্নভূমি তৈরি হবার পর এটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু দু বছর পরে, লোকের ভিড় সামলাতে, আর সুবর্নভূমির ওপর চাপ কমাতে এটা আবার খুলে দেওয়া হয়। এখন এখানে এয়ার এশিয়া সমেত কিছু সস্তার বিমান ওঠানামা করে। আমরা নেমেছি স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে চারটেয়। সে সময় মানুষ তো কোন ছার, বাড়ি-ঘরদোরও ঘুমোয়। ইমিগ্রেশনে কোন লাইন নেই। কাউন্টারের পেছনে নীলচে-কালো ইউনিফর্ম পরিহিতা আধঘুমন্ত থাই কন্যা আমাকে ভিসার ফর্ম গুলো দিলেন। সেখানে অন্য সব কিছুর সঙ্গে লিখতে হবে আমরা এ দেশে কোথায় থাকবো। আমি টিকিট কেটেছি আসবার মাত্র কয়েক দিন আগে। আগে থেকে ভিসা ও করাইনি। আমাদের ভিসা নেই। শুনেছি এখানে নাকি পনেরো দিনের কম থাকলে বিমানবন্দরে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে ভিসা দিয়ে দেয় ভারতীয়দের। এদিকে কোথায় থাকব তার ঠিকানা জানিনা। ইতি-উতি তাকিয়ে দেখি নানান বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে বিভিন্ন হোটেল আর রিসোর্টের। ফর্ম ভরবার অছিলায় কাউন্টার থেকে একটু সরে এলাম। বিজ্ঞাপনের একটা হোটেলের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর টুকে দিয়ে ফর্ম জমা দিলাম, সঙ্গে পাসপোর্ট আর ফেরার টিকিট আর আমাদের সকলের ছবি কাউন্টারের ভেতরে ঘপাত ঘপাত করে কয়েক প্রস্থ ছাপ্পা মেরে পাসপোর্ট গুলো আমার হাতে ফিরে এলো। থাইল্যান্ডে ঢোকার ছাড়পত্র সমেতসব মিলিয়ে সময় লাগলো মিনিট পাঁচেক এয়ারপোর্টের ঠিক বাইরেই দেখি বাসস্টপ। সেখানে আবার বসার জন্য চেয়ার পাতা সেখানে বসেই আমরা বাসের অপেক্ষা করতে লাগলাম। 

বড় বড় শহরে দেখেছি রাস্তা, রাস্তার ওপর ফ্লাইওভার, তার ওপরে আরো ফ্লাইওভার। এত গোলকধাঁধায় আমি ধাঁধিয়ে যাই। বুঝতে পারিনা, কোন দিকে চলেছি, কতদুর এলাম। এখানেও তাই হলো। একটু পরেই সব গুলিয়ে গুবলেট। একটা ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে চলেছি। খালি ভাবছি এবারে মাটিতে নামবে বুঝি। কিন্তু নক্ষত্রবেগে মিনিট কুড়ি ধরে ওই ভাবে চলার পরেও যখন আমাদের মিনি বাস মাটি ছুঁলোনা, তখন এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম আর কতক্ষন এই ফ্লাইওভার চলবে? হাসি হাসি মুখে সে উত্তর দিলো – “ইয়েস, ইয়েস, ফ্লাইওভার”। বড় নিশ্চিন্ত লাগলো, আমার অতুলনীয় ইংরেজি জ্ঞানের সঙ্গে তুলনীয় কাউকে পেয়ে। পরের কদিনে বার বার এরকম নিশ্চিন্ত লেগেছে, শুধু একদম শেষের বার ছাড়া। সে গপ্পে আসবো পরেগাড়ির একটা আসনে আমার কন্যরত্ন ঘুমে কাদা। বেচারার এখন মাঝরাত, দেশের হিসেবে। আর তার আগের সিটে বসে তার মা ও দেখলাম নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। প্রায় আধঘন্টা পরে ফ্লাইওভার থেকে নামলাম। পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ফ্লাইওভারটা নাকি সাতান্ন কিলোমিটার লম্বা ভেবে দেখুন, দমদম থেকে সাতান্ন কিলোমিটার একখানা ফ্লাইওভার যদি থাকতো, কল্যানী কি কোনা ছাড়িয়ে কাঁহা কাঁহা মুলুকে পৌঁছে যাওয়া যেত মাটিতে না নেমে। শহর ছাড়িয়ে গাড়ি চললো মাঠঘাটের ভেতর দিয়ে। দিব্যি চওড়া রাস্তা, আমাদের দুর্গাপূর এক্সপ্রেসওয়ের প্রায় দ্বিগুন চওড়া, আর আরো মসৃন। দু দিকে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত। বর্ষার শেষ বলে মাঠে কর্মরত মানুষের সংখ্যা খুব কম। কোথাও কোথাও টোকা মাথায় দু একজন কৃষক মাঠে কাজ করছে। মাঝে মাঝে বেশ বড় বড় কারখানা। সাদা সাদা বাড়ি, হালকা নীল ছাদ তাদের। ভাগ্যিস এখানে বেচা মান্না ......। 

()
আগে নাম ছিলো থাপ ফ্রায়া। অর্থাৎ কিনা ফ্রায়ার সেনাবাহিনি। ফ্রায়া ছিলেন শ্যাম দেশের রাজা। সে সময় দেশের রাজধানী ছিলো আয়ুত্থায়া। শ্যামদেশ তথা আজকের থাইল্যান্ডে যেখানেই যান, রামায়ণের প্রভাব আপনার চোখ এড়াবেনা। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের আদীকবি বাল্মিকির রামায়ন। সে প্রভাব এমনই গভীর, যে ওনারা নিজেদের রাজধানীর নাম রাখলেন অযোধ্যা। একবার ভাবুন দিকি, ইউপির “আওয়াধ” থেকে এসে চিত্তরঞ্জন পেরোতেই আপ কান্ট্রির “আইয়োধ্যা” হয়ে গেলো বাংলা “অযোধ্যা”
তাহলে এতখানি সমুদ্দুর পেরিয়ে সুদুর শ্যাম দেশে গিয়ে সে “আয়ুত্থায়া” হলে তাকে চিনবোনা কেন? এ দেশের রাজার নাম রাম। ঠিক নাম নয়, বরং বলা ভালো উপাধি। যিনিই যান আয়ুত্থায়া, তিনিই হন রাম। আগের রাজধানি আয়ুত্থায়া, এখন অবশ্য ব্যাঙ্কক। সব রাজারই উপাধি রাম। এখনকার রাজা ভূমিবল অদুল্যদেজ হলেন দশম রাম। মহারাজের নামটা লক্ষ্য করুন। আদতে ভূমিবল অতূল্য তেজ। পশ্চিম বাংলার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন অতূল্য ঘোষ। অতুল্য নামটা আমাদের চেনা। হিন্দুস্থানি “আতুল” নয়, বাংলা “অতুল্য”। ঠিক একই ভাবে, থাই কথা আর নামের মধ্যে অনেক চেনা শব্দ পাবেন। অভ্যর্থনার সময় থাইরা একটু ঝুঁকে হাত জোড় করে যেটা বলেন, সেটা শুনে প্রথমে ঠাওর হয় – “সদি খা”। এই সদি আসলে “স্বস্‌দি” বা স্বস্তি। আমরাও বহু আগে শুভ-মস্তু বা স্বস্তি-মস্তু বলতে অভ্যস্ত ছিলাম। পরে শান্তি আর স্বস্তি হারিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে অভ্যাসও। এখন শুধু শান্তির জল ছিটনোর সময় ঠাকুরমশায়রা “ওঁ স্বস্তি” বলেন। এই যে ব্যাঙ্কক থেকে বেরিয়ে যে প্রদেশের মধ্যে দিয়ে এলাম, তার নাম চোনবুরি। ব্যাঙ্ককের উত্তরে আবার আছে কাঞ্চনাবুরি। বুরি আসলে পুরি। কাঞ্চনপুরি আর স্বর্ণপুরি হয়ে গেছে কাঞ্চনাবুরি আর চোনবুরি। যাই হোক, তো সেই রাজা ফ্রায়া তাঁর সেনা নিয়ে দক্ষিন দিকে এই চোনবুরি রাজ্যের ভেতর হানা দিলেন। সে সময় এই এলাকার রাজা , ফ্রায়ার সুশিক্ষিত সেনা দেখে এতই অভিভুত হয়েছিলেন যে যুদ্ধ না করে, অধীনতা মেনে, ফ্রায়ার বাহিনিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেই থেকে ওই জায়গার নাম হয় থাপ ফ্রায়া, বা ফ্রায়ার সেনাবাহিনি। বিংশ শতকের পঞ্চম দশক পর্যন্ত থাইল্যান্ড উপসাগরের তীরবর্তি এই সুন্দর ছোট্ট জনপদের নাম তাই ই ছিলো। কিন্তু ততদিনে পাশের দেশ ভিয়েতনামে জোর লড়াই বেঁধেছে। লম্বা চওড়া গোলাপী গালের মার্কিনী বীরদের লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে এট্টু আমোদ-প্রমোদেরও দরকার হয়। পূর্বতন ফরাসি ইন্দোচিনের, তথা তৎকালীন দক্ষিন ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গনের আবার এদিকে ছিলো বিস্তর খ্যাতি। কিন্তু বিধি বাম। ভিয়েতনামের ক্ষয়াটে চেহারার চাষাভূষো লাল গনফৌজ চোয়াল শক্ত করে, মার্কিনী পল্টনকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিলো। সাধের সায়গন ছেড়ে গেলেন প্রভুরা এয়ার আমেরিকা চড়ে। এই নামে একটা ছবিও হয়েছে হলিউডে। দেখতে পারেন, সিআইএর নির্লজ্য আগ্রাসন এবং বানিজ্য করার আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী কুকীর্তির জাল বিছোনোর পদ্ধতি। কিন্তু ভিয়েতনামের গনফৌজ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে সায়গনকে মুক্ত করার পরে, মার্কিন জলপাই উর্দির, জলকেলীর জন্য জল পাই কোথায়? চোখ পড়লো থাপ ফ্রায়ার দিকে। সেদিনের থাপ ফ্রায়া হয়ে গেলো আজকের পাট্টায়া। ইন্দোচিনের লাস ভেগাস। এখানে কি না হয়? আর যা হয়, তা এখানেই থাকে। বাইরে যায় না।

সকালে জলখাবারটা বেশ বেশিই হয়ে গেলো। আমার আবার বাইরে গেলে খিদেটা একটু অতিরিক্ত পায়। তবে কিনা দেখলাম আমার এক টুকরো পাউরুটি খাওয়া মেয়ে আর তার মা, দু তিন বার করে প্লেট ভরে ভরে খাবার নিয়ে এলো। সুইমিং পুলের পাশে , ছাতার তলায় বসে ব্রেকফাস্ট খেতে দিব্যি লাগছিলো। মেয়েকে দেখে বুঝলাম, সামান্য একটু পরিবেশের তফাত একটা মানুষ কে কি ভাবে বদলে দিতে পারে। যে মেয়ে বাড়িতে কোনো দিন একটুকরো ফল মুখে দিতে চায়নি, সে দেখলাম দু গ্লাস ফলের রস খেয়ে ফেললো। আরো ফলের দিকে নজর ছিলো, কিন্তু এক যাত্রায় অতিরিক্ত ফলাফল ভালো নয়, তাই বারন করলাম। এদিকে ঘড়িতে প্রায় সকাল সাড়ে দশটা বাজে। তাই দুপুর বেলা খাবার পরিকল্পনাটা একটু পালটে নিলাম। বাইরে একটা সেভেন ইলেভেন স্টোরে খাবার জল কেনার সময় খোঁজ নিয়ে পরিকল্পনা করলাম কাছেই একটা গ্রামে এখানের কিছু প্রথাগত নাচের অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়া যায় আমাদের দেশে কিছু অঞ্চলে দেখেছি শহুরে “বাবু” রা “জঙ্গলে” বেড়াতে গিয়ে “আদিবাসী” দের লাচ দেখেন সন্ধ্যে বেলা হুইস্কিতে চুমুক দিতে দিতে। হয়ত ছোটবেলায় শহুরে পরিবেশে মানুষ হইনি বলেই, এরকম ভাবে নাচ দেখতে মনের ভেতরে কোথাও একটা আটকায়। কিন্তু যখন নিজেদের উৎসবের সময় সাঁওতাল মেয়েরা লালপেড়ে শাড়ি পরে নাচতে থাকে, সেখানে খুব খোলা মনে তাদের নাচ উপভোগ করতে পারি। এখানে নাচ হবে বিকেল বেলা, আর মঞ্চের ওপর। সেখানে পান ভোজনের কোনরকম ব্যবস্থা নেই। যদি থাই সংস্কৃতিতে আপনার কৌতুহল থাকে, তাহলে আসুন, দেখুন আর উপভোগ করুন। নাহলে স্বচ্ছন্দে বাদ দিন আপনার ভ্রমনের তালিকা থেকে। আমার এই থাই নাচ দেখার উৎসাহ ছিলো অনেক দিন ধরে। আগে কিছু ছবি দেখেছি এই নাচের, কিন্তু চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ফোন করে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করলাম। ড্রাইভার ছেলেটির মুখে হাসি মিলিয়ে যেতে দেখিনি। খুব ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরিজি বলে। আমারই মতো। আকারে-ইঙ্গিতে কাজ চালিয়ে নিলাম। যেতে হবে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। হোটেল থেকে বেরিয়ে ঘিঞ্জি রাস্তা। ইতি উতি খাবারের দোকান, কোনোটা থাই, কোনোটা চিনে, ইতালিয়ান বা রাশিয়ান ও রয়েছে। আর রয়েছে যথেস্ট সংখ্যায় ভারতীয় খাবারের দোকান, বেশিরভাগ পাঞ্জাবীদের, আর ঢাবা (ধাবা নয়, ঢাবা স্বচ্ছন্দে কোন পাঞ্জাবী বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে দেখুন) বলে লেখা আছে। এখানে বলে রাখি, দেশের বাইরে নেহাত ঠেকায় না পড়লে ভারতীয় খাবারের দোকান এড়িয়ে চলাই ভালো। এটা বলছিনা যে সব জায়গাই বাজে, তবে কিনা শতকরা নব্বইভাগ ভারতীয় রেস্তোরাঁ আপনাকে যাহারপরনাই নিরাশ করবে। পাট্টায়া শহর ছাড়িয়ে গাড়ি হাইওয়ে ধরলো। মসৃন গতিতে প্রায় ঘন্টায় ১২৫ কিলোমিটার বেগে পঁয়তাল্লিস মিনিটে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। নেমে দেখি লোকে লোকারন্য। সাদা, কালো বাদামী, হলদে সব রকমের সব দেশের মানুষ এসে জুটেছে সেখানে। খালি দেখবেন না দেশী, অর্থাৎ ভারতীয়-পাকিস্তানি-বাংলাদেশী মানুষ। কান পাতলেই শুনছি “স্পাসিবো”, “নিয়েৎ” কিম্বা “পাংলুশকি দা?”, প্রচুর রুশি। আর তারা এসেছে আন্ডা-বাচ্চা-ভাই-ভাতিজা-বাপ-পিতেমো সমেত। চুষিকাঠি মুখে কয়েক মাসের লালচে রাশিয়ান ছানা থেকে সাদা কাগজের মত গায়ের রঙ, তলস্তয়ের মত দেখতে টাকমাথা, দাড়িওয়ালা খাঁটি রুশি দাদু, সবাই আছেন দলে। আর দেখলাম দলে দলে চিনে ট্যুরিস্ট। ভাষা বাবদ তাদের আবার আরো খারাপ অবস্থা। চিনে ছাড়া কোন ভাষা জানেনা। একে অন্যের হাত বা জামা ধরে আছে। আর দলের সামনে গাইড একটা রঙ্গিন পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ হারিয়ে গেলে, ওই পতাকা দেখে চিনতে পারবে। আছেন আমেরিকান ট্যুরিস্ট, আছেন জাপানিরা। চিনে আর জাপানি দেখে আলাদা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কথা বললে তবু কিছুটা বোঝা যায়। আর দেখলাম কিছু পশ্চিম এশিয়ার লোকজন। সঙ্গে বোরখা পরে মহিলারা। 


চত্তরে কিছু হাতি ঘুরছে। তাদের পিঠে ভারি সুন্দর কারুকাজ করা হাওদা। দেখলাম একটা সিঁড়ি আর মঞ্চ। একটা করে হাতি এসে দাঁড়াচ্ছে সেখানে আর সবাই সিঁড়ি বেয়ে উঠছে হাতির পিঠে। চত্তরে একপাক ঘুরে এসে আবার ওইখানেই সওয়ারি নামিয়ে দিচ্ছে হাতি। মেয়ের মা দেখলাম চকচকে চোখে দেখছে হাতির দিকে। নির্ঘাত চড়ার সখ হয়েছে। মধ্যতিরিশে মেয়েদের মধ্যে ছেলেমানুষী কমে আসে বটে, কিন্তু একেবারে যায়না। কিন্তু বাধ সাধলো মায়ের মেয়ে। আমার মেয়ে আমার মতোই। রাম ভিতু গোছের। অতবড় জানোয়ার দেখে পুঁচকি বেচারা গেলো ঘাবড়ে। কিছুতেই রাজি হলো না উঠতে। হস্তিবিহারের সেখানেই ইতি ঘটলো। পা বাড়ালাম আরো ভেতরের দিকে। দেখলাম একজায়গায় গোল করে ঘেরা, আর তার চারিদিকে বসার জন্যে বেঞ্চি পাতা আছে। আমরা গিয়ে মাঝামাঝি একটা ভালো জায়গা বেছে বসলাম। মঞ্চের আয়োজন খুব সাধারন, জাঁকজমক নেই তেমন। ধিরে ধিরে নর্তক নর্তকিরা মঞ্চে উঠে এলেন। ঢাকের বাজনা শুরু হলো, সেই সঙ্গে তারের যন্ত্রের বাজনা। অনেকটা চিনে বাজনার মত, তবে সুর ও তাল একেবারেই আলাদা। ঠিক নাচ না বলে, নৃত্যনাট্য বলা ভালো। বিষ্ণুর অবতার রাম, তাঁর ও সীতার বিয়ে, বনবাস, রাবন, রাক্ষস, হনুমান, শূর্পনখা, যুদ্ধ, সবই ছিলো, এমনকি একটা জায়গায় অকাল বোধন পর্য্যন্ত দেখলাম মনে হলো। কি অপূর্ব আর রঙিন পোষাক কুশীলবদের। আর তেমনই সুন্দর তাঁদের নাচের ভঙ্গি। 

নাচের মুদ্রা কিছুটা যেন আমাদের মনিপুরি নাচের সঙ্গে মেলে। কোথা দিয়ে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। যাঁরা নৃত্যনাট্যে সরাসরি অংশ নিলেন, তাঁরা তো মঞ্চে ছিলেনই, কিন্তু উপরি পাওনা হলো মঞ্চের ওপর বাজনদারদের উপস্থিতি। আমাদের গ্রামের যাত্রাপালায় বাজনদাররা বসেন মঞ্চের একপাশে, এখানেও তেমনই শুধু দেখলাম, এখানে বাজনদাররা বসে নেই। দাঁড়িয়ে বাজাচ্ছেন, আর শুধু দাঁড়িয়েই নয়, বাজনার গমকের তাকে তালে লাফিয়ে উঠছেন বাজাতে বাজাতে। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম প্রানশক্তি আর উচ্ছলতা। থাইল্যান্ড হঠাৎ করে বড্ড ভালো লেগে গেলো। ছুটকিটা আমার পাশে বসে বসে পুরোটা দেখলো আর দেখলাম খুব জমে গিয়ে উপভোগ করলো। সংস্কৃতি ভিন্ন করে মানুষকে, আবার জুড়েও দেয়। নাচের প্রানশক্তি আর উচ্ছলতা এখানে মুগ্ধ করলো বটে, কিন্তু নাচের অনুষ্ঠানের পরে তার আরো এক রূপ দেখলাম। দেখলাম ঠিক বক্সিং এর মতো দেখতে রিং, আর তার দু ধারে নেমে পড়লেন বক্সিং এর দস্তানা পরে দু জন থাই বক্সার। এর নাম মুয়ে থাই, আদতে থাই মার্শাল আর্ট। জাপানিদের যেমন জুদো, চিনে দের কুং ফু, কোরিয়ান দের তাইকোনদো, ঠিক সেরকমই থাই দের রয়েছে মুয়ে থাই। আমদের কাছে মুয়ে থাই পরিচিত কিক্‌ বক্সিং নামে। অর্থাৎ হাত দিয়ে ঘুষোঘুষি তো চলেই, পা দিয়ে লাথালাথি ও চলে সেই সঙ্গে, যেটা বক্সিং এ চলেনা লড়াই শুরু হবার পর হাত আর পা সমান তালে চললো। আগে টিভি তে বা সিনেমায় কয়েকবার দেখেছি বটে কিক্‌ বক্সিং, কিন্তু সামনে বসে দেখতে গিয়ে প্রতিটি ঘুষি আর লাথির শব্দে গা সিরসির করছিলো। তিন রাউন্ড লড়াই হলো, আর শেষে একজন ধরাশায়ী ও হলো। কিন্তু সত্যি বলছি, খেলাটা খুব একটা উপভোগ করতে পারিনি। মেয়ে তো একটু ভয়ই পেয়ে গেলো। আর তাছাড়া সারা রাত বিমান যাত্রা। তার পরে ২৫০ কিলোমিটার গাড়িতে। দুপুর বেলায় এখানে লম্ফঝম্ফ। দেখলাম মা মেয়ে দুজনেই নেতিয়ে পড়েছে। ফিরলাম হোটেলে। ওরা দুজনে ঘুমিয়ে নিলো খুব খানিকটা। কেউ ঘুমোলে কেন জানি আমার খুব মায়া লাগে। কেমন নিশ্চিন্ত মুখে ঘুমোই আমরা। ঘুম থেকে উঠে সন্ধ্যে বেলা দেখলাম মা মেয়ে চাঙ্গা। বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। 


(৩)
পাট্টায়ার খ্যাতিই বলুন আর কুখ্যাতিই বলুন, দুই ই তার রাতের জন্যে। এ শহর সন্ধ্যে বেলায় জেগে ওঠে, আর রাতে তার চোখে ঘুম আসে না। অনেকের কাছে শুনি তাঁরা নাকি পাট্টায়াতে দক্ষিন চিন সাগর (সাউথ চায়না সি) দেখে এসেছেন। কিন্তু দক্ষিন চিন সাগর, থাইল্যান্ড থেকে বহু দূরে। মালয় উপদ্বীপ ঘুরে মলাক্কা প্রনালী পেরিয়ে মাকাউ – হংকং – তাইওয়ানের দিকে গেলে দক্ষিন চিন সমুদ্র পেতে পারেন। সে সমুদ্র বেজায় বেয়াড়া, ভয়ঙ্কর ওস্তাদ মাল্লারাও সে সমুদ্র পেরোতে কেঁপে যায়। যাঁরা বিভুতিভুষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের “মরনের ডংকা বাজে” পড়েছেন, তাঁরা মনে করে দেখতে পারেন, বিভুতিভুষন এই সমুদ্র পার হবার কি অপূর্ব বর্ননা করেছেন। দক্ষিন চিন সমুদ্রকে আমি হংকংয়ে এক ঝলক দেখেছিলাম। পাট্টায়াতে আপনি দেখবেন তেলুক সিয়াম, বা শ্যাম উপসাগর, যার বর্তমান পরিচিতি থাইল্যান্ড উপসাগর নামে। সে সমুদ্র শান্ত আর সুন্দর । থাইল্যান্ড উপসাগরের তীর ধরে একটা রাস্তা ধনুকের মত বেঁকে চলে গেছে দক্ষিন থেকে উত্তরে, ঠিক যেন একটা কাস্তে। এ রাস্তার উত্তরের দিকে কিঞ্চিত উচ্চকোটির লোকজনের থাকার জায়গা। হলিডে ইন্‌ সমেত নামকরা সব পাঁচতারা হোটেল আছে, আছে অনেক গুলো রিসোর্ট, দিব্যি দেখতে, দারুন সাজানো সব বাড়ি, ঘর রাস্তা, দোকান, মল, রেস্তোরাঁ। যত দক্ষিনে আসবেন, ততই ঘিঞ্জি বাড়বে, আর জমজমাটি ও বাড়বে। এ রাস্তার একদিকে সমুদ্র আর তার বেলাভূমি, অন্যদিকে দোকানপাটে ভর্তি ভিড়। রাত যত বাড়ে, পাল্লা দিয়ে বাড়ে লোকের ভিড়। আর দোকান গুলো যদি দেখেন, সেখানে পাবেন না এমন জিনিস নেই। ঘর সংসারের টুকিটাকি, জামা, জুতো, প্রসাধন, বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি, উপহার সামগ্রী। তবে শতকরা তিরিশ ভাগ দোকান হয় খাবারের, নয়ত থাই ম্যাসাজের। দোকানের সামনে এক সারি সুবেশা তরুনি বসে আছেন, আপনি তাদের মধ্যে কোনো একজন কে বেছে নিতে পারেন আপনাকে দলাইমলাই করে দেবার জন্য। তিন চার রকমের ম্যাসাজ হয়। একটা হলো থাই প্রথাগত ম্যাসাজ, যে খানে শরীরের বিভিন্ন অংশে কিছু ভাবে মালিস ও দলাই মলাই করে আপনার পেশী গুলোকে আলগা করা হয়, আর স্নায়ুতন্ত্রকে চাঙ্গা করা হয়। এ ছাড়া আছে ফুল বডি ম্যাসাজ, ব্যাখ্যা নিস্প্রয়োজন, তা ছাড়া আছে ফুট ম্যাসাজ, আপনার পায়ের পাতা ও আঙ্গুলের ওপর ম্যাসাজওয়ালির আঙুলের কারিকুরি আর আছে ফিস ম্যাসাজ। একটা গামলায় জল ভর্তি করে আপনাকে পা ডুবিয়ে বসতে বলা হবে। সেই জলে ছাড়া থাকবে কিছু ছোট ছোট মাছ, যারা আপনার পায়ের মরা চামড়া খেয়ে নেবে, আর পা টা বেশ তাজা লাগবে। নিশ্চিন্তে ম্যাসাজ নিতে পারেন। সত্যিই ভালো লাগবে। খরচাও এমন কিছুই না। তবে এর বাইরেও কিছু কিছু ম্যাসাজ পার্লারে অনৈস্বর্গিক অনেক কিছুই হয়, কিন্তু সে সব নেহাতই শোনা কথা। আমি যে ম্যাসাজ পার্লার দেখেছি, সেখানে এরকম কিছুই নেই। তবে কিনা সাধারন পার্লারগুলোতেও সম্পুর্ন অপরিচিতা এক সুন্দরী আপনার শরীরে দলাইমলাই করে দিচ্ছে ঘন্টাখানেক ধরে, এই ব্যাপারটা অনেকের কাছেই বেশ শিহরন জাগানো অনুভূতি। 

শহরের একেবারে দক্ষিনে, কাস্তে রাস্তার হাতলের কাছে, সমুদ্রের ধারে একটা টিলার ওপর বিশাল আকারের রোমান হরফে লেখা আছে পাট্টায়া। এ লেখা আবার রাত্রে আলো হয়ে জ্বলতে থাকে। আর তার কিছুটা আগে, রাস্তার শেষ ভাগটুকুতে সন্ধ্যের পর থেকে গাড়ি চলা বারন। সেটার নাম “ওয়াকিং স্ট্রীট”। শুধু হাঁটা ছাড়াও এ রাস্তার খ্যাতি অন্য জায়গায়। হাজারো কিসিমের নৈসর্গিক, অনৈসর্গিক মৌজ-মস্তির আড়ত হলো এই ওয়াকিং স্ট্রীট। সন্ধ্যে বেলায় এখানে ঢুকে হাঁটতে থাকুন, সত্যিই চোখ টেরিয়ে যাবে। কত রকমের সাজু-গুজু করে মেয়েরা ঘুরছে, শুধু মাত্র আপনার মনোরঞ্জন করার জন্যে, তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। রাস্তার ধারে লাইন দিয়ে বিয়ার বার। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়েরা বসে আছে। তাদের সিংহভাগ থাই হলেও, কিছু অন্য দেশের মেয়েরাও রয়েছে দেখলাম। ভারতীয় ও চোখে পড়লো দু এক জন। ট্যুরিস্টরা এখানে আসবেন, এসে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কোন একটা বিয়ার বারে ঢুকবেন, তার পর এই মেয়েদের সঙ্গে আলাপচারিতা ও বিয়ার চলবে। বিয়ারের দাম, আপনার জন্যে হয়ত ৫০ বাত(Baht), আর মেয়েটির জন্য ১০০। এটাই এখানের দস্তুর। আপনি বিয়ার কিনে না দিলে, কোন মেয়েই আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসবে না। কিছু আলাপচারিতার পরে পছন্দসই কোনো একটিকে নিয়ে চলে যাওয়া যাবে হোটেলের ঘরে, অবশ্যই কিছু অর্থমূল্য চুকিয়ে। কিছু বিয়ারখানায় নাচা-গানার ব্যবস্থা থাকে। সেখানে কোন নর্তকীকে মনে ধরলে তার সঙ্গে আলাদা আলাপচারিতার ব্যবস্থা আছে। মনে ধরলে তাকেও হোটেলের ঘরে নিয়ে যাওয়া চলবে, তবে কিনা, যেহেতু সে বেতনভুক নর্তকী, তাই বিয়ার বারে কিঞ্চিত পয়সা ক্ষতিপুরন দিয়ে যেতে হবে। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল রাখা দরকার। অত্যন্ত উদ্ভট শুনতে লাগলেও, এই মেয়েদের সকলেই কিন্তু আদতে মেয়ে নয়। প্রায় ২০% আসলে ছেলে, তারা মেয়ে সেজে এখানে বসে আছে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন পছন্দ। থাইদের দেখে এমনিতেই ছেলে-মেয়ে আলাদা করা শক্ত। আর এক্ষেত্রে, এরা এমন ভাবে সেজে থাকে, কে ছেলে, আর কে মেয়ে, সেটা চেনা প্রায় অসম্ভব। কাজেই, সুধী পাঠক, যদি এই বিয়ার বারে পছন্দসই বান্ধবী খোঁজেন, আগে একটু ভালো করে বাজিয়ে নেবেন। তবে কিনা, বিয়ার বার ছাড়াও রাস্তায় অজস্র মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে সেজে গুজে। এদের সঙ্গে বিয়ার বারে গিয়ে বিয়ার খাবার দরকার নেই, গপ্প-আড্ডার ও তেমন ধার ধারেনা এরা কেউ। একদম সোজা সাপটা বিনিময়। যেটা লক্ষ্য করলাম, সেটা হলো, বিয়ারখানায় বসে গপ্প করছে যারা, তারা প্রায় সবাই সাদা ট্যুরিস্ট। আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের সঙ্গে যারা দরদস্তুর করছে, তাদের মধ্যে আমাদের দেশী লোকজনের সংখ্যা সিংহভাগ। এদের বিয়ারপান, বা গপ্প আড্ডার সময় নেই। তবে হ্যাঁ, একটা কথা অবশ্যই বলবো। আপনি যদি পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঘুরতে আসেন, আপনার দিকে কেউ ফিরেও তাকাবেনা, বিরক্তও করবেনা। এত বিয়ারখানা, হাজারে হাজারে বার, কিন্তু একটাও মাতাল দেখিনি থাইল্যান্ডে, দেখিনি রাস্তায় কোনরকম অসভ্যতা বা মহিলাদের অসন্মান করা। মাঝ রাত পর্য্যন্ত রাস্তায় ঘুরুন নিশ্চিন্তে। 

পাট্টায়াতে ক্যাবারে আছে। আপনি ক্যাবারে বলতে ইয়োরোপ আর আমেরিকার  বিখ্যাত ক্রেজি হর্স শো ভেবে বসবেন না। আবাল্য সংস্কারের মাথা খেয়ে একবারই দেখেছিলাম সেই নাচ। দেখেছিলাম নর্তকীদের অসাধারন সুন্দর জমকালো পোষাক, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে মেয়েগুলোর উর্ধাঙ্গ নিরাবরন। তাই এই ক্যাবারে নিয়ে কিছুটা সন্দেহ ছিলো। এদিক ওদিক খবর নিয়ে জানলাম, এখানে সেরকম কিছু হয় না। অনেক ভেবে, যা থাকে কুল-কপালে বলে ক্যাবারে দেখতে ঢুকে পড়লাম সপরিবারে। দু খানা ক্যাবারে শো খুব নামকরা। একটা আলকাজার শো, আর একটা টিফানিজ শো। যে কোন একটায় ঢুকতে পারেন। একদম সামনে বসে দেখলে টিকিটের দাম বেশি। নাচা-গানা তো ভালোই হলো। বহু দেশের এবং ভাষার গান এবং নাচ হলো। বলিউড ও ছিলো – “দোলা রে... দোলা রে” বলে থাইরা ভালোই কোমর দোলালেন। তবে আমার ভালো লাগলো একটা চিনে গান ও নাচ। সুরটা ভারি মায়াময়। বহু বছর আগে, রেডিও পিকিং (আমার ছোটো বেলায় পিকিং , বেইজিং হয়। যদিও, রেডিও বলতে এখনো পিকিংটাই মনে আসে প্রথমে) এরকম কিছু গান ও সুর শোনাতো তাদের বাংলা অনুষ্ঠানে যদিও গানের ভাষার বিন্দুবিসর্গ বুঝলাম না। কেন জানি মনে হলো, এখানে জাঁকজমক হয়ত অনেক বেশি, কিন্তু সেই প্রথম দেখা রামায়নের নৃত্যনাট্যে যেন প্রানের ছোঁয়া আর একটু বেশি ছিলো। ওহো, আর একটা কথা বলে রাখি, যদিও অবিশাস্য শোনাবে, তবুও, এই দুটো শো কিন্তু আসলে লেডি-বয় শো। অর্থাৎ যাঁরা নাচেন, তাঁরা সবাই পুরুষ। যদিও এঁদের আওয়ার গ্লাস ফিগার, সুললিত বাহু ও পদ যুগল এবং বাকি সব শারীরিক লক্ষন দেখে কিছুতেই আপনি ভাবতে পারবেন না এঁরা ছেলে। আমিও পারিনি। একটা দুটো ক্ষেত্রে একটু খটকা যে লাগেনি তা নয়, যেমন গলার স্বর। কিন্তু সন্দেহ নিরসনের পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। পরে বিশ্বাস না হওয়াতে ইন্টারনেটে খুঁজে দেখে তারপর নিশ্চিত হয়েছি, আর বুঝেছি, কেন ক্রেজি হর্স শো এর থেকে এই ক্যাবারে আলাদা।    


(৪)
একটা সময় পাট্টায়ার খ্যাতি ছিলো শুধুই ওয়াকিং স্ট্রীটের জন্য। কিন্তু গত কিছু বছরে থাই সরকার এই ভাবমূর্তী বদলাবার অনেক চেষ্টা করেছেন। আজকের পাট্টায়ায় শুধু প্রমোদবিলাসী লোকজন নয়, বহু মানুষ পরিবার পরিজন নিয়েও আসছেন। এমনকি আমার তো মনে হলো তাঁদের সংখাই বেশি। পরিবার নিয়ে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বোধহয় রুশ দেশের মানুষ, তার পরেই আছেন চিনেরা। ভারতীয়দের মধ্যে দল বেঁধে ছেলে ছোকরারা মৌজ-মস্তি করতেও এসেছে, আবার অনেকে পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতেও এসেছেন। সেরকম মানুষের জন্যে প্রবাল দ্বীপ (কোরাল আইল্যান্ড) ভ্রমন খুব ভালো একটা পরিকল্পনা। পাট্টায়ার সমুদ্রতীর থেকে সমুদ্রের ভেতরে প্রায় ৬-৭ কিলোমিটার দূরে একখানা প্রবাল দ্বীপ রয়েছে। পাট্টায়ার সৈকত থেকে স্পীডবোট নিয়ে আসে এই দ্বীপে। স্পীডবোটে যেতেযেতে দূর থেকে ফিরোজা রঙের জলের মধ্যে ঘন সবুজ গাছপালা ঢাকা দ্বীপটা চোখে পড়তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো – “এ তো সবুজদ্বীপ”। আপনি যদি তপন সিংহের “সবুজ দ্বীপের রাজা” ছবিটা দেখে থাকেন, তাহলে আন্দামানের ঠিক এরকম দেখতে একটা দ্বীপকে আপনি দেখেছেন সবুজ দ্বীপ বলে। আন্দামানও কিন্তু আদতে প্রবালের তৈরি দ্বীপ। আমাকে, আমার খুব ঘনিষ্ঠ একজন বার বার আন্দামানের গল্প শুনিয়েছে, যেতে বলেছে। কিন্তু পোড়া কপাল আমার, আমি কখনো আন্দামান যেতে পারিনি। যদি যেতে পারি, তার বর্ননার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারবো আন্দামান। যাইহোক, স্পীডবোটে উঠে সোজা গিয়ে ওই সবুজ দ্বীপে পৌঁছনোর বদলে, আপনি মাঝপথে থামতে পারেন প্যারাশ্যুটে ওড়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্যে। আপনি যদি আমার মত দুর্বলচিত্ত হন, তাহলে এই রোমাঞ্চ আপনার জন্যে নয়। একমাত্র সাহসীরাই এখানে রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে পারেন। এ ছাড়া জলের তলায় ডুবুরি হয়ে প্রবাল দেখতেও যেতে পারেন সবুজ দ্বীপে। সাঁতার জানার দরকার নেই।



সমুদ্রের মাঝখানে একটা বিশাল জেটি তৈরি করা হয়েছে। সেই জেটির পেছন দিকে বসার জায়গা, আর সামনে দিকে কিছুটা খোলা জায়গা। স্পিডবোট আপনাকে এখানে নামিয়ে দেবে। সামনের খোলা জায়গায় গিয়ে দেখবেন অনেকে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে, ঠিক বুঝতে পারছেনা, সাহস করে উড়বে কিনা। ওদিকে সামনে কিছু ইয়ে পাকা ওস্তাদ এগিয়ে গিয়ে লাইফ জ্যাকেট আর প্যারাশ্যুট পরে তৈরি হচ্ছে ওড়ার জন্যে। ব্যাপারটা কিছুটা এরকম। আপনাকে লাইফ জ্যাকেট পরানো হয়, তারপর আপনাকে একটা প্যারাস্যুটের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। আপনার আর প্যারাস্যুটের এই গাটবন্ধন আবার দড়ি দিয়ে জোড়া আছে একটা স্পীডবোটের সঙ্গে। স্পীড বোট নিচে, জলে। আর আপনি জেটির পাটাতনের ওপরে। তার পরে শুরু হয় মাদারি কা খেল। স্পীড বোট আপনাকে টেনে নিয়ে যায়। পাটাতন থেকে যেই আপনি পড়বেন জলে, সেই মুহুর্তে হাওয়া পাকড়ে নেয় আপনার প্যারাশ্যুট, আর মানুষ শূন্যে উড়তে থাকে। স্পীডবোটে করে এদিক ওদিক জলের ওপর ঘুরিয়ে এনে আবার আপনাকে ওই জেটির ওপর নামিয়ে দেবে। অন্যরা প্যারাশ্যুট জড়িয়ে ওখানে দাঁড়ালে আপনি পেছনে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিতে পারেন। “ওই তো সবাই করছে, আমরাই শুধু ভয় পাই। কিছু হবে না, এরা খুব ভালো করে করিয়ে দেবে”। কিন্তু নিজে উড়বার জন্যে দড়িদড়া বেঁধে ওই খোলা যায়গায় দাঁড়ালেই চিত্তির। হাতের তেলো বরফের মত ঠান্ডা, জিভ তালু শুকিয়ে কাঠ। আপন চতুর্দশ পুরুষের নামগোত্র স্মরনের চেষ্টা, কিন্তু কার্য্যতঃ পিতৃদেবের নামও স্মরন করতে না পারা, যে বা যিনি সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়ে ঠেলে ঠুলে আপনাকে এই বিপদে ফেললেন , মানসপটে তাঁর নামে অশ্লীল শব্দ সমূহের ঘোরাফেরা, আর পরিশেষে তলপেটে প্রবল কনকনে একটা চাপ মত। যারা এই গোটা ব্যাপারটার ব্যবস্থাপনায়, সেই সব লোকেরা আপনাকে অনেক কিছু বলছে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরিজিতে, কিন্তু সে সব শোনার মত অবস্থায় আপনি তখন নেই। একে লাইফ জ্যাকেট, তার ওপর ইঁড়িমিড়িকিড়ি বিভিন্ন দড়ির বাঁধন। সে বাঁধন আবার বাঁধা হয়েছে আপনার অস্থান-কুস্থানের খুব কাছাকাছি জায়গা দিয়ে। আপনি আরো সিঁটিয়ে আছেন তাই জন্যে পেছনে ফিরে একবার দেখার চেষ্টা করলেন বাকিদের, কিন্তু সেই মুহুর্তেই একটা বোম্বাই হ্যাঁচকা এসে লাগলো আপনার বপুতে। হিড় হিড় করে টানছে কেউ আপনাকে সামনে। যে ছোকরা এতক্ষন আপনাকে ধরাচুড়ো পরাচ্ছিলো, সে ব্যাটাও আপনার কাঁধে একটা চাপড় মেরে আপনাকে বাই বাই করে দিলো। এতক্ষন মনে হচ্ছিলো আপনি ভিতু, এখন এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে আপনি বিশ্রি রকম অসহায়। পাটাতনের ওপর দিয়ে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো আপনাকে, কিন্তু সেটা এক মুহুর্ত মাত্র। তার পরেই পাটাতন শেষ। প্রায় কুড়ি বাইশ ফুট নিচে সমুদ্রের জল। আপনার কানে একটা হুহু করে শব্দ, শিরদাঁড়ায় গঙ্গোত্রীর বরফ গলা জল, তলপেটে একটা কনকনে ঘুর্নিঝড় তান্ডব। যাঁরা প্লেনে চেপে কখনো এয়ার পকেটে পড়েছেন, তাঁরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন। শোঁ শোঁ করে জলের দিকে নেমে যাচ্ছেন আপনি। কমলা রঙের স্যান্ডোগেঞ্জি পানা লাইফ জ্যাকেট আপনাকে জলে ভাসিয়ে রাখতে পারে, এই সম্ভাবনাটাই মাথা থেকে গায়েব হয়ে যায় তখন। 

আরো নামছেন, নামছেন, পায়ে সমুদ্রের জলের একটা ঝাপ্টাও বোধহয় লাগলো। কিন্তু হঠাৎ কেউ একজন আপনার কাঁধ, কোমর, পেট জাপটে ধরে ওপর দিকে একটা হ্যাঁচকা টান মারলো। আপনি এক ঝটকায় কিছুটা শুন্যে উঠে গেলেন। আর পড়ছেন না নিচে। প্রথমটা ধাঁধা লাগে, কি ঘটলো সেটা ভালো করে বোঝা যায় না। কিন্তু তার পরে ওপর দিকে তাকিয়ে দেখবেন প্যারাশ্যুটে হাওয়া ধরে নিয়েছে। আর সে ই আপনাকে উড়িয়ে নিয়েছে। ধড়ে একটু প্রানের স্পন্দন অনুভব করা যাচ্ছে। এ যাত্রা হয়ত বেঁচেই গেলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখুন। আপনার সামনে একটু দূরে পাট্টায়া শহরে উঁচু উঁচু বাড়ি ঘর। নিচে নীল জল, আর তাতে সাদা ফেনা তুলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে স্পীডবোটেরা। আপনাকে যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সে ডান দিকে ঘুরে একটা চক্কর মারে, আপনি দেখতে পার বহু দুরের সবুজ দ্বীপ, আরো পেছনে থাই উপসাগর আর দিকচক্রবাল। পাখির মত মনে হয় নিজেকে। মনে হয় শুধু উড়ে চলা যেত যদি এই ভাবে। ঠিক যে মুহুর্তে আপনি উপভোগ করতে শুরু করেন, তখনই স্পীডবোট আরো একটা বাঁক ঘুরে আপনাকে জেটির কাছাকাছি নিয়ে এসে গতি কমাতে থাকে, আপনি ও নামতে থাকেন নিচের দিকে। জেটির ওপর আপনাকে ধরে নেয় কিছু লোক জন। ধরাচুড়ো ছেড়ে বেরিয়ে আসেন আপনি। মুখে বিজয়ীর হাসি, আর পকেটে আগামী বেশ কিছু বছর ঘরোয়া আড্ডা জমাবার রসদ সংগ্রহ করে।

(৫)
নানা রকম আনন্দ ও বিনোদনের উপকরনের মাঝখানেও মন খুঁতখুঁত করছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য খুব বেশীক্ষন টানেনা আমাকে। আমি একটু সৃষ্টিছাড়া আছি। বরং অচেনা কোন শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় আমাকে ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁটতে বলুন, আমি এক পায়ে খাড়া। আর আকর্ষন করে মানুষ এবং মানুষের কীর্তি। অনেক বছর আগে, সেটা বোধহয় ১৯৮৯ সাল, আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম রাজগীর। সকাল বেলা বেরোনো হলো, যাবো নালন্দা দেখতে। এক ভদ্রলোক, তিনিও বাঙালি, মন্তব্য করেছিলেন, নালন্দায় তো সবই ভাঙাচোরা। সেই বয়সেই কথাটায় খুব অবাক লেগেছিলো। থাইল্যান্ডে আমি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে আর কেনাকাটা করতে আসিনি। হাতে সময় মাত্র পাঁচ দিন। তারই মধ্যে যতটা পারি দেখে নিতে হবে। গ্রাম্য নৃত্যনাট্য মন কেড়েছিলো। ব্যাঙ্ককের রাস্তায় এদিক ওদিক হেঁটে বেড়িয়ে ভালো লাগছিলো। কিন্তু তবুও যেন ঠিক যা মন চাইছে, তার সব কিছুর নাগাল পাচ্ছি না। কোন কিছু চেয়ে, না পেলে, আমার বড্ড খিদে পায়। রাস্তার ধারে অসংখ্য ঠেলাগাড়িতে খাবার দাবার বিক্রি হচ্ছে। আর আগেই বলেছি, দোকানপাটের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ খাবারের দোকান। 

থাই খাবারের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। চিনে রান্নার ধারালো স্বাদ যেমন আছে থাই রান্নায়, তেমনি আছে ভারতীয় পাকশালের মাখো মাখো জমাটি বৈঠকি ভাব। আমার কেমন জানি মনে হলো, ভৌগোলিক অবস্থানের মতই, এ রান্না চিনে ও ভারতীয় রান্নার মাঝামাঝি। থাই রান্নায় মশলার ব্যবহার আছে, তবে সেটা উত্তর ভারতীয় রান্নার মত প্রচুর নয়। আর থাই মশলা প্রধানতঃ টাটকা আর কাঁচা সবজি। এদিক থেকে বরং খাঁটি বাঙালী রান্না, থাই রান্নার অনেক কাছাকাছি, যেখানে মশলার ব্যবহার উত্তর ভারতের তুলনায় অনেক পরিমিতথাই দের আসল খাবার হচ্ছে ভাত। তার সঙ্গে ঝোল আর কিছু তরি-তরকারি। মাছের ব্যবহার খুব বেশি। মাংসের মধ্যে প্রধানতঃ মুরগি আর শুয়োর। পাঁঠার মাংস অজানা। গরুর মাংস খাওয়া হয়, তবে বহুল প্রচলিত নয়। বরং দেখলাম মাছ ছাড়াও আরো অনেক সামুদ্রিক প্রানী খাওয়া হচ্ছে। কিছু আমাদের খুব পরিচিত, যেমন কাঁকড়া-চিংড়ি, আবার কিছু অচেনা, যেমন ঝিনুক, অক্টোপাস বা স্কুইড। তবে প্রধানত সাধারন মানুষের খাবার হলো ভাত আর একটা মাছের ঝোল গোছের ব্যাপার। সেই ঝোলে থাকে কিছু সবজি, মাছ বা মাংস, চিংড়ির মলম, লেবু পাতা আর নারকোলের দুধ। বেশ একটা টক্‌ মিষ্টি স্বাদ। আমাদের জিভে ভালোই লাগে। রাস্তার ঠেলাগাড়িতে বিক্রি হচ্ছে “সাতে”। এ হলো ইন্দোচিনের কায়দায় তৈরি কাবাব। মুঘলাই কাবাবের বপু স্বাদ বা মেজাজ কোনোটাই এর নেই। কিন্তু অতিশয় হালকা, আর সস্তাও বটে। দশ বাত মানে আমাদের কুড়ি টাকা দিয়ে এক কাঠি তে অনেক গুলো কাবাব পাবেন। আমার তো দিব্যি লাগলো। ছোটো ছোট কাঠিতে গাঁথা সসেজ বিক্রি হচ্ছে। মাংসের সসেজ ছাড়াও রয়েছে মাছ, স্কুইড বা চিংড়ির সসেজ বা বল। মাছ বা মাংসের কিমা করে, সে গুলো লাড্ডু পাকিয়ে বল তৈরি করা হয়েছে। খাবার কায়দাটা দিব্যি। কাঠিতে গাঁথা এই বস্তুগুলোর মধ্যে যেটা যেটা আপনার পছন্দ, সেটা সেটা আঙুল দিয়ে দেখালে দোকানি (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলা) সেই কাঠি গুলো তুলে গ্রীলে বসিয়ে দেন। সেটা একটা কয়লার আগুন, আর তার ওপরে একটা ধাতব তারের জাল। একটু পর, সেঁকা হয়ে গেলে, একটু সস্‌ আর স্যালাড সহযোগে আপনাকে পরিবেশন করেন। সস আবার মূলতঃ মিষ্টি-ঝাল। একটু অদ্ভুত মনে হলেও, মিঠেকড়া স্বাদটা কিন্তু দিব্যি জমে। এর সঙ্গে থাই মানুষজন খান একতাল ভাত। থাই ভাত, আমাদের ভাতের মত নয়। এদের ভাত ঝরঝরে হয়না। কেমন একটা তাল পাকানো চটচটে মন্ড। খুব নতুন আতপ চালের ভাত যেমন হয়, তেমন দেখতে। তবে খেতে খুবই ভালো। থাইরা মূলতঃ এই ভাত খান দিনে ৩ থেকে ৪ বার। আর তার সঙ্গে ঝোল ঝোল কিছু একটা। প্রধানতঃ মাছ বা মাংস আর তার সঙ্গে সবজি দিয়ে তৈরি ঝোল। তাতে নারকোলের দুধের ব্যবহার খুব বেশী। লেবুর গন্ধ ওয়ালা পেঁয়াজশাকের মত দেখতে একরকম সবজি হয় এখানে, যা এরা প্রায় সব কিছুতে দেয়। এর নাম লেবু ঘাস। যদিও ঘাসের সঙ্গে এর দৃশ্যত মিল কমই। আর তার সঙ্গে কাফির লেবু। পাতি লেবুর মত ছোট্ট লেবু। ঘন সবুজ রঙ। গা টা এবড়ো খেবড়ো আর রঙটা ঘন সবুজ। কাফির লেবুর খোসাটাই প্রধানতঃ ব্যবহার হয় গন্ধের জন্য। যে কোন থাই খাবারই খান না কেন, তাতে এই লেবু লেবু একটা গন্ধ পাবেন। এর সঙ্গে ব্যবহার করা হয় গালাংগাল বলে আদা জাতীয় এক রকম মূল। দেখতে অনেকটা আদারই মত, তবে রঙ আর স্বাদ গন্ধ অনেক হালকা। অনেক রান্নায় কাঁচা হলুদ ব্যবহার করা হয়। এর সঙ্গে পড়ে চিংড়ির মলম। ঘুষো চিংড়ি কে পিষে, কয়েক দিন গাঁজিয়ে সেটা রান্নায় ব্যবহার করা হয়। খেতে কিন্তু বেশ। রান্নার স্বাদ নিছক নোনতা বা চাষাড়ে ঝাল নয় , বরং বেশির ভাগ পদে, হালকা তেঁতুল আর সামান্য গুড় দিয়ে ঘটিদের রান্নার মিঠে-কড়া ভারসাম্যের স্বাদের জাদু এনারাও দেখিয়ে থাকেন। থাই ঝোল বা তরকারি প্রধানতঃ তিন চার রকমের মশলার কম্বিনেশন ব্যবহার করে তৈরি হয়। প্রথম রকম মশলা টক্‌টকে লাল, এবং বলাই বাহুল্য পরের দিন সকালে মনে করিয়ে দেয় আগের দিন কি খেয়েছেন। এর পরে আছে এক রকম সবুজ মশলা আর হলদে মশলা। সবুজ মশলা দেওয়া পদ গুলো খুব হালকা আর সহজ পাচ্য। লাল গুলো ঘোরতর গুরুপাক। কিন্তু স্বাদ ওই লালেই বেশি। হলদে গুলো এই দুই এর মাঝামাঝি। সব দিক থেকেই। 

ব্যাংকক শহরটা অতিকায় আগেই বলেছি। আর শহরের চেয়েও যেন বড় অসংখ্য শপিং মল আছে এখানে। ভারতীয় পর্যটককূলের সিংহভাগের গন্তব্য ইন্দ্র শপিং কমপ্লেক্স। একবার ঢুকে দেখার ভিমরতি হয়েছিলো। ঘিঞ্জি শস্তা জামাকাপড়ের দোকান। মাছির মত লোক ভনভন করছে। বেসমেন্টে রাজ্যের ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যের বেসাতি। উন্মত্তের মতো কেনাকাটা করে চলেছে ভারতীয় পর্য্যটককূল। তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ আবার বাঙালি। আপনি ব্যাংককে এসে এই যায়গায় না এলে কিছুই হারাবেন না। বিশ্বাস করুন, আমাদের নিউ মার্কেটের মেজাজের ১০% ও নেই এখানে। এই বাজারের বাইরেটা হলো শহরের ব্যস্ততম রাস্তা সুখুম্‌ভিত। আমাদের চৌরঙ্গি যেমন। চৌরঙ্গি প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমি জানিনা খোদার খামোখা কেন এত সুন্দর একটা রাস্তার নাম পালটে জওহরলাল নেহেরু রোড করা হলো। এতে ও রাস্তার বিলক্ষন মানহানী হয়েছে বলে আমি মনে করি। চৌরঙ্গি আমার কাছে চৌরঙ্গি ই থাকবে। যাই হোক, এখানে সুখুমভিতের দু পাশে ঠিক গড়িয়াহাট বা হাতিবাগানের মত হকার্স স্টল। মাঝে মাঝে পা ফেলার জায়গা নেই। আমার ব্যংককের সবচেয়ে ভালো লেগেছে দু খানি চিজ। রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো, আর রাস্তার খাবার। এ ছাড়া জাঁকজমক আমোদ আহ্লাদ বা দর্শনীয় স্থান অনেক আছে। কিন্তু কি জানি কেন, একটাও ঠিক মন ছুঁতে পারলো না। নদীর ধারে, প্রাসাদে, মন্দিরে, বহুতল বিপনীতে, রাজপথে বা হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে, আমি ব্যাঙ্কককে ঠিক ছুঁতে পারলাম না যেন। বড্ডবেশি কেনাবেচা যেন চারিদিকে। আর প্রতিটি মোড়ে মোড়ে রাজা-রানী ও বুদ্ধের ছবি বা মুর্তি। এই যে ব্যক্তি বন্দনা, যতদিন মানুষ ভক্তি অটুট রাখবেন, ততদিন চলবে। কিন্তু কখনো, কোন প্রজন্মে যদি এই ব্যক্তি বন্দনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন কি হবে জানতে ইচ্ছে করে।  রাত্রি বেলা একা একা ঘুরে ফিরে হোটেলে ফেরার সময় এক অমায়িক থাই ট্যাক্সি ড্রাইভার ফুটপাথের ওপরে উঠে এসে স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে আমাকে “গুড গাল”, “ভেলি নাইস গাল” আর “প্লেটি গাল” দের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার অনেক চেষ্টা করার পরেও আমার ভয় কাটাতে পারলো না। সব “গাল” মন্দ তার বৃথা গেল। আমার মধ্যবিত্ত মন হিমালয়ের চুড়ায় হয়ত উঠতে পারে, কিন্তু সামাজিক বিধির ফুটপাত পেরোতে পারেনা। এটা ব্যাঙ্ককের ট্যাক্সি ড্রাইভার বেচারা কি করে জানবে? বাঙালি মধ্যবিত্ত মন আর মূল্যবোধ , ৩৪ বছর ঘর করেও বোঝা যায়নি, আর এ তো এক অচেনা ভিনদেশী মানুষ। এ ঘটনাকে পাঠক কি হিসেবে নেবেন আমার জানা নেই। এমন কি আমি নিজে কি হিসেবে নিয়েছি, সেটাও পরিস্কার করে বলতে পারবো না। তবে হ্যাঁ, আমি নেহাতই সাধারন মানুষ। নিজেকে জিতেন্দ্রীয় মহাপুরুষ বলে দাবী করার কোন বাসনা আমার নেই। ব্যঙ্কক শহরে ভালো লাগা আর দুটো জিনিষের কথা না বললেই নয়। একটা হলো মেট্রো রেল। শহরের পৃথিবী বিখ্যাত ট্রাফিকজ্যামের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ উপায়, আর একটা হলো রঙ-বেরঙের ট্যাক্সি। আমি কোথাও এত রঙিন ট্যাক্সি দেখিনি। কলকাতা, মুম্বাই, নিউ ইয়র্কে দেখেছি ট্যাক্সি প্রধানতঃ হলদে। ফিলাডেলফিয়া বা সান ফ্রান্সিসকোতেও তাই। সিঙ্গাপুর বা হংকং এ ট্যাক্সিতে কিছু রঙ আছে বটে, কিন্তু তা এত ঝকঝকে রঙিন নয়। এখানে ট্যাক্সিতে টুকটুকে লাল, ডগমগে কমলা, মিঠে মিঠে গোলাপি, কচি কচি কলাপাতা সব রকম রঙই পাবেন। দেখলেই চড়তে ইচ্ছে করে। 

মেয়ের কথা ভেবে একদিন গেলাম ব্যাঙ্ককের চিড়িয়াখানা দেখতে। আমাদের চিড়িয়াখানা একবার আলীপুর ছেড়ে সোনারপুরে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা হয়েছিলো শুনেছিলাম। কিন্তু তার পরে বোধহয় ব্যাপারটা বিশেষ এগোয়নি। এখানে দেখলাম চিড়িয়াখানা ব্যাঙ্ককের সোনারপুরেই। মানে শহরের বেশ কিছুটা বাইরে। প্রথমে উড়ালপুল আর আকাশঝাড়ু ব্যাঙ্কক পেরোলাম। তার পর সরু গলি, ঘিঞ্জি রাস্তা আর ভিড়ে ভর্তি বাজারের শহরতলি পেরোলাম। শেষে কেমন ফাঁকা হয়ে এলো চার দিক। একটু সবুজ দেখা যাচ্ছে, ছোটখাটো বাগান। একতলা বা দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে গোলগাল থাই বাচ্চারা খেলছে। সবাই বড্ড হাসি মুখ এখানে। এ দেশের নামের মানে নাকি হাসি মুখের দেশ। কে জানে? হতেও পারে। আগে নাম ছিলো শ্যাম, এখন হয়েছে থাই। রোজ রোজ ওই তম-ইয়াম-কুং বা চিংড়ি আর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেলে, আমিও বাকি জীবন এদের মতই হাসতে পারি। থাই রান্নার তুলনা নেই। যাই হোক। চিড়িয়াখানা আমাদের আলিপুর উদ্দ্যানের অন্ততঃ ১০ গুন বড়। আর আমোদ প্রোমোদের উপকরন ও অনেক বেশি। যদি শিশুর মন নিয়ে আসতে পারেন এখানে, তাহলে এই সাফারি ওয়ার্ল্ড নামের চিড়িয়াখানা আপনাকে হতাশ করবে না। এখানে হাতিরা ফুটবল খেলে, ওরাং-উটানরা বক্সিং করে, ডলফিনরা ডাইভ দেয়। তবে কিনা আমার মনে হয় অতিকায় শপিং মলে ঢুকে নিজে নাচার চেয়ে ওরাং-উটানের নৃত্য দেখা ঢের ভালো। মেয়ে খুশ্‌, তার মা বাপ ও দিব্যি খুশ্‌। আফসোস লাগে, আমাদের চিড়িয়াখানায় কি এরকম কিছু করা যায় না?


(৬)
ফেরার দিনের পরিকল্পনাটা একটু দুঃসাহসিক ছিলো। আগে থেকে ব্যবস্থা করা ছিলোনা কোন। কিন্তু মাথায় ছিলো আয়ুত্থায়া দেখবো। আগেই বলেছি আয়ুত্থায়া হলো শ্যামের পুরোনো রাজধানী। খোঁজখবর নিয়ে এক ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করে ব্যবস্থা করলাম। বললো তাদের লোক আসবে সন্ধ্যে বেলায় আমার থেকে টাকা নিতে আর কাগজ পত্র দিতে। নাম সেলিন্‌থিপ। হোটেলের লবি তে বসে অপেক্ষা করছি, নাম শুনে মনে হয়েছিল ইনি মহিলা। পরে ইনি ফোন করে কথা বলার সময় নিশ্চিত হলাম। তাই আর হোটেলের ঘরে ডাকিনি। যদিও ইনি হোটেলের ঘরের নম্বর নিয়েছিলেন। লবি তে বসে দেখছিলাম কোন থাই মহিলা ঢুকছেন কিনা। অনেকেই ঢুকছে বেরচ্ছে। কেউ থাই, কেউ সাদা, কেউ ভারতীয়। ঠিক বুঝতে পারলাম না। লবি তে অনেকেই বসে আছেন। রিসেপশানে এক বিপজ্জনক সুন্দরী ভারতীয় মহিলা। খুব সম্ভবতঃ পাঞ্জাবী। দেখি রিসেপশনিষ্ট আমার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন, আর ওই পাঞ্জাবী মহিলা আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন হাসি হাসি মুখে। একটু ঘেঁটে গেলাম। সামনে এসে খাঁটি থাই টানে ইংরিজি তে বললেন “হাই আই অ্যাম সেলিন্‌থিপ”। বুঝলাম না পাঞ্জাবী বাপ-মা এরকম নাম রেখেছেন কেন। মহিলা একটা কার্ড দিলেন আমাকে। দেখি তাতে লেখা স্বরণদীপ কাউর। ও হরি, ইনি অভিবাসী ভারতীয়। থাই উচ্চারনে স্বরনদীপ হয়ে গেছেন সেলিনথিপ। পরের দিন যাবার ব্যবস্থা পাকা হলো। শেষ মুহুর্তের ব্যবস্থা, তাই ঘুম থেকে উঠতে হলো ভোর ৫টায়। সকাল ৬টায় গাড়ি এসে তুলে নিলো। হোটেলের পাওনাগন্ডা মিটিয়ে বাক্স-প্যাঁটরা-ঝোলা-ঝুলি সমেত উঠে বসলাম মিনিবাসে। টেম্পো ট্র্যাভেলার গোছের গাড়ি। গাড়ি ভর্তি পর্য্যটকের দল। এখানেও সেই এক গল্প। চার তালঢ্যাঙা জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এসেছে ডুসেলডর্ফ থেকে। সদ্য বিবাহিত ইতালিয় দম্পতি, ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ। আমেরিকান যুগল। চিনে আর জাপানী কয়েকজন একলা। একজন ব্রাজিলিয়। নেই কেবল ভারতীয়। আমি বসলাম সেই ব্রাজিলিয় ছেলেটির পাশে।ওর নাম এদুয়ার্দো। জিজ্ঞেস করলাম, ব্রাজিলে ঠিক কতজন এদুয়ার্দো আছে ? হাসাহাসি আর ফুটবল নিয়ে গল্প জমে গেলো। 

রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। গাড়ি চলেছে মসৃন গতি তে আসলে ৩ খানা মিনিবাস কাঁঠাল বোঝাই হয়ে আমরা চলেছি রাজধানী আর রাজবাড়ি দর্শনে। আজ্ঞে হ্যাঁ, রাজবাড়ী ও দেখা যাবে বলছে গাইড। গাইড একটি কমবয়সি থাই মেয়ে। এতরকমের জগাখিচুড়ি লোকজন আর ভাষা নিয়ে তার ঘাম ছুটছে। তার ওপরে তার নিজের ইংরেজিও বিশেষ সুবিধের না। একবার একটা শব্দ বললো “কোসুমা”। অনেক কষ্টে বুঝলাম বলতে চাইছে কাস্টমার। ঘন্টা আড়াই পর গাড়ির সামনে রাস্তার ডান দিকে গাছ পালার মাথা ছাড়িয়ে একটা সাদা রঙের মিনার দেখতে পেলাম। আরো প্রায় মিনিট দশেক চলার পরে গাড়ি হাইওয়ে ছাড়িয়ে ডান দিকে মোড় নিলো। আমরা গিয়ে পৌঁছলাম ওয়াত ফু খাও থং। ওয়াত মানে মন্দির। একেবারে গোড়ার দিকটা চার চৌকো, প্রায় একটা ফুটবল মাঠের অর্ধেক। প্রথমে ধাপে ধাপে পিরামিডের মত গড়ন উঠতে শুরু করেছে। শুরুর দিকে ঢাল খুব একটা খাড়া না, বড় জোর ৩০ ডিগ্রি মত। সামনের দিকে সিঁড়ি আছে।সেটা বেয়ে ওঠা যায়। সাদা রঙের প্লাস্টার আর ইঁটের কাঠামো। এ অঞ্চলে পাথরের অভাব বলে, সব কিছুই ইঁটের তৈরি। এমনকি অতিকায় বুদ্ধমূর্তি পর্য্যন্ত। আস্তে আস্তে সেই চারকোনা পিরামিডের ধাপ গোল হয়ে ওপরে উঠতে উঠতে স্থাপত্যের ঢাল শুরুর দিকের তিরিশ ডিগ্রি থেকে নব্বই ডিগ্রি হয়ে গেছে, আর শেষে সরু ছুঁচলো চুড়ো যেন আকাশ ফুঁড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। অদ্ভুত আকৃতি। এরকমটা দেখিনি আগে। নীল আকাশের পটভুমিকায় শ্বেতশুভ্র মন্দির তার অভ্রংলেহী শিখর নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এত বড় স্থাপত্য। কিন্তু তবুও এ স্থাপত্যে কোন অহংবোধ নেই, দেখনদারি নেই। বরং মন শান্ত হয়ে আসে, আর মাথা নিচু হয়ে আসে। বৌদ্ধ ধর্ম নাস্তিক। ইশ্বরের অস্তিত্ব নেই এখানে। কর্ম এবং কর্মফলই সব। কিন্তু তবুও এই মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে মন এক অদ্ভুত মেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়। মনে হয় কিছুক্ষন ওই গাছ তলায় বসি, আর চুড়ার দিকে তাকিয়ে, কোন সৃষ্টি কর্তার কথা ভাবি আমার মত নাস্তিক যে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বই স্বীকার করেনি কোনোদিন, তারও এরকম ইচ্ছে করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো নাস্তিকের এই ধর্মে এরকম স্থাপত্যের প্রয়োজন হলো কেন? তবে এখানে শুধু সেই সৃষ্টিকর্তাই নন, যাঁরা এই মন্দিরের পরিকল্পনা করেছেন, এবং রূপ দিয়েছেন, এই মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রতিও শ্রদ্ধায় মানা নুয়ে আসে। ক্যামেরা বার করে কয়েকটা ছবি তুলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মনে হলো এই স্থাপত্যকে, এই রূপকে, এই গাম্ভীর্য্যকে ক্যামেরা বন্দী করার ক্ষমতা আমার নেই। বন্ধুবর অনির্বান মিত্তির হয়ত পারবে। কিন্তু তাকে এখানে নিয়ে আসি কি করে? সে বেচারা আধুনিক কলকাতায় , পুরোনো রোম্যান্টিক, প্রাসাদোপম, রাজকীয় ক্যালক্যাটা খুঁজে চলেছে ক্যামেরা ঘাড়ে। আর তার কীর্তির সৌরভ এই বাংলা ছাড়িয়েও ছড়িয়ে গেছে কাঁহা কাঁহা মুল্লুকে। জিস্‌কি খুশবু পঁহোছে হামারে হিন্দোস্তাঁ সে লন্‌দন্‌ তক। প্রবাদ প্রতিম আলোকচিত্রি ডেরিল মুর , খোদ লন্ডনে বসে মিত্তিরের প্রদর্শনি দেখে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে দার্জিলিং চা খাইয়েছেন। তবে একবার এখানে এসে তম্‌ ইয়াম কুং খাবার ইচ্ছে করলে অনির্বান মিত্তির পস্তাবেনা এটুকু বলতে পারি। 

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলাম। অফিসের ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে ঠ্যাং ভেঙেছিলাম বুড়ো বয়সে আগের বছর। সে পায়ে এখনো তেমন জোর আসেনি। তার ওপর পিঠে ভারি ব্যাগ। আমার আগে আগে সিঁড়ি তে উঠছে সেই চার জন জার্মান ছাত্র। সিঁড়ির ধাপগুলো বিরাট বড় বড়। আমাদের সাধারন সিঁড়ির চেয়ে প্রায় দু গুন উঁচু। কিছুটা উঠলেই দম চলে যায়। পাহাড়ে ট্রেক করার অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম, উঠতে হবে দম বাঁচিয়ে রেখে, আস্তে আস্তে। বাহাদুরি করে দুম দাম সিঁড়ি ওঠার চড়ার কোনো দরকার নেই। তাতে একটু পরেই দম ফুরিয়ে যায়। বহু সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠলাম। এটা চুড়া নয়। মাঝামাঝি একটা ধাপ। এর পরে আর ওপরে ওঠা যায়না। এই মাঝামাঝি জায়গায় এসে দেখি, এক চিলতে বারান্দা মত করা, যেখান থেকে বাকি চুড়ার স্থাপত্য শুরু হয়েছে। এই বারান্দা মূল স্তুপের চারিদিক প্রদক্ষিন করে আছে। এখান থেকে নিচে তাকালে বহুদুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। এ তল্লাটে পাহাড় পর্বত তো দুরস্ত্‌ , সামান্য একটা ঢিবি ও দেখা যায়না। একদম চ্যাটালো জমি, দিগন্ত রেখাও একদম সোজা সাপ্টা। প্রদক্ষিন করে পেছন দিকে গিয়ে দেখি একটা ছোট্ট দরজা। কাঠের পাল্লা ওয়ালা। পাল্লা গুলো খোলা। ভেতরটা অন্ধকার সুড়ঙ্গ। দরজাটা আমার কোমরের চেয়ে একটু উঁচু। সামনে চারজন তালঢ্যাঙা জার্মান ছোকরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে দেখে, আমিই এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে। মাথা ঝুঁকিয়ে অনেক কষ্টে আমার বপু ওই দরজার খুপরি তে ঢুকিয়ে ৪ টে মূল্যবান তথ্য আবিস্কার করলাম। প্রথমঃ – সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকার, নিজের হাত পা দেখা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ঃ – ভেতরে মানুষ আছে, কারন টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছে। তৃতীয়ঃ- সামনে এগোতে পারছিনা, কারন আমার পিঠের বেঢপ ব্যাগ সমেত আমি সুড়ঙ্গে আটকে গেছি আর চতুর্থ্যঃ আমি পেছিয়েও যেতে পারছিনা, কারন পেছনে জার্মান গুলো ঢুকে এসেছে, আর আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না, কারন সুড়ঙের মুখ আমার বপু আর ব্যাগ সমেত ছিপি আঁটা। 

মারো জওয়ান হেঁইয়ো, আউর থোড়া হেঁইয়ো, দম লাগাকে হেঁইয়ো, ইত্যাদি শুনলাম। অবশ্যই জার্মান আর ইতালিয়ান ভাষায়। সামনে ততক্ষনে একজোড়া ইতালিয়ান হাজির। কিছুক্ষন টানা হ্যাঁচড়ার পর হুড়ুস করে আমি ছিপি খোলার মত খুলে এলাম। কিন্তু এলাম না বলে, গেলাম বলাই ভালো। চার জার্মানের ঠেলা সামলাতে গিয়ে পড়লাম সুড়ঙ্গের ভেতরে। তারপর হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করে হামাগুড়ি দিয়ে সূচীভেদ্য অন্ধকারে কিছুদুর এগোলাম। সামনে টা ঢালু হয়ে নেমে গেছে, তার পরে একটা হালকা হলদেটে আলোর রেখা। দেখলাম ডান হাতি সুড়ঙ্গটা একটু চওড়া। সেখানে একটা ছোট্ট বুদ্ধমূর্তি, আর তার সামনে একজন মুন্ডিত মস্তক সন্ন্যাসী। থাই দের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হলে ভারি সুন্দর মানায়। মাথা চক্‌চকে মোড়ানো, নাক চোখ ও তেমন চোখা না। কেমন একটা গোল গাল মোলায়েম ভাব। ওই চেহারার চোখা ভাবের জন্যেই বোধহয় আফগানরা বৌদ্ধ ধর্ম ছেড়ে ইসলামের শরন নিয়েছিলো।  বুদ্ধ মুর্তির সামনে একটা প্রদীপ জ্বলছে, আর কয়েকটা ধুপ। বেশ শান্ত সমাহিত একটা ভাব। কিন্তু কি জানি কেন, আমার মনে হলো, আর একটু খেলে-ছড়িয়ে বন্দোবস্ত করলে বেশ হতো। বড্ড যেন চাপাচুপি। যে ভাবে ভেতরে ঢুকেছিলাম, তার চেয়েও খারাপ ভাবে বাইরে বেরিয়ে এলাম। তখন বেলা সাড়ে দশটা। গরমে গন্‌গন্‌ করছে চারিদিক। কিন্তু বেরিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নিচে নেমেও এলাম। সামনে আর একটা মন্দির। তবে তার আকার তত বড় নয়। ভেতরে ঢুকে দেখি অজস্র মূর্তি। সিংহভাগ বুদ্ধমূর্তি হলেও বাকি মূর্তির মধ্যে আছেন প্রজাপতি ব্রহ্মা, যম রাজ এবং খুব সম্ভবতঃ মা সরস্বতি। কয়েকটি মেয়ে, খুব সম্ভবত আমেরিকান, দেখলাম সবচেয়ে বড় বুদ্ধ মূর্তির সামনে নানা রকম পোজ দিয়ে ছবি তুলছে। একজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসী বসে আছেন এখানে। মুখে হালকা হাসি। কিন্তু কেন জানি মনে হলো হাসির আড়ালে কিছুটা অসন্তোষ লুকিয়ে। সামনে গিয়ে বললাম আমি ভারতবর্ষ থেকে এসেছি। আমি বুদ্ধগয়া ও সারনাথ দেখেছি। বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। সত্যিকারের হাসি। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে আশীর্বাদ করলেন, তার পর ঘুরিয়ে দেখালেন মন্দির। ফু খাও থং মন্দির থেকে চললাম ঘুমন্ত বুদ্ধকে দেখতে। থাইল্যান্ডে যেখানেই যান না কেন, এনারা, কোন্‌ শায়িত ও ঘুমন্ত বুদ্ধ কত বড়, তার একটা জটিল হিসেব নিকেস পেশ করেন। মিনিবাস থেকে নেমে যে অতিকায় বুদ্ধের সামনে দাঁড়ালাম, সেটা আগাগোড়া ইঁট দিয়ে তৈরি, ওপরে প্লাস্টার। শুনলাম ইউনেস্কো থেকে এই মুর্তিকে সংরক্ষন করা হয়। গাইড মেয়েটিকে একটু আড়ালে জিজ্ঞেস করতে বললো দশ বছরে একবার করে চুনকামের পোঁচড়া টানে। সেইটাই সংরক্ষন। 

অতিকায় বুদ্ধমূর্তি দর্শন করে আবার মিনিবাসে ওঠা। ওয়াত মাহাদাত। সেটা কাছেই। যেতে দশ মিনিটও লাগলো না। বুদ্ধমূর্তি ছিলো মাঠের মাঝখানে, ঠাঠা রোদ্দুরে যেন ঝলসাচ্ছে সবকিছু। এতো রোদের মাঝে কেউ ঘুমোতে পারে এইটাই যেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়না। ওয়াত মাহাদাত পৌঁছে দেখি, সেখানে গাছের মেলা। অশ্বত্থ গাছের ছড়াছড়ি। বেশ ছায়া ছায়া ঠাণ্ডা একটা ভাব। গাইড মেয়েটি খুব উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বললো, কিন্তু সেটা বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম মাথা নিয়ে কিছু বলছে। কিছু না বুঝতে পেরে সামনে এগোলাম। বাকি ট্যুরিস্টদের সঙ্গে। একটা বড় অশ্বত্থ গাছের তলায় সবাই কিছু একটা দেখছে। এপাস ওপাস কনুই মেরে সামনে গিয়ে দেখি হাসি মুখে গৌতম বুদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আজ্ঞে হ্যাঁ। গৌতম বুদ্ধ। এত জীবন্ত মূর্তি আমি দেখিনি। আরো অদ্ভুত কি জানেন? মূর্তি বলতে শুধুই মাথা। আর তার চারিদিকে গাছের কান্ড আর শাখা প্রশাখা। ঠিক যেন মাথাটা গাছের ভেতর থেকে উঁকি মারছে। জমি থেকে প্রায় দু হাত উচুঁতে এই মাথাটা দেখে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো। পাথরের স্থাপত্যকে চার পাশ থেকে ঘিরে ধরেছে একটা গাছ। ইশ্বরহীন মানব ধর্মের প্রবর্তক তথাগত বুদ্ধের পাথরের নিস্প্রান মুর্তিকে তুলে ধরে রেখেছে এই গাছটা। পাথরের মুর্তিকে সজীব করেছে। তথাগত যেন বলছেন - কে বলেছে আমি নেই? এই তো আছি, এখানে। এই মাটিতে এই বিশাল গাছের শেকড়ের চেয়েও গভীরে মানবিক ধর্মের বিশ্বাস আর মূল্যবোধ চলে গেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী গেছে। বর্মি দস্যুর হাতে আয়ুত্থায়া ধ্বংশ হয়েছে। কিন্তু আমার শিকড় এখানে এতটাই গভীর, যে কালের নিয়মে ধ্বংশ আর মৃত্যুর ধাক্কা তাকে স্থানচ্যুত করতে চাইলেও জীবন তাকে ঠিক আগলে ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে। পাট্টায়ার “ওয়াকিং স্ট্রীট” দেখে থাইল্যান্ড কে চিনো না। শ্যামদেশ কে চেনো এইখানে এসে। এই প্রথম বার এদেশে এসে মনে হলো শুধু বৌদ্ধ ধর্ম নয়, আমার ও কিছু একটা আছে এখানে। বিস্ময়ের তখনো বাকি ছিলো।
একটা ঝুপ্‌স্‌ দোকানে ভাত আর ঝোল খেয়ে পৌঁছোলাম ওয়াত ফ্রা সি সানফেত। মানে ফ্রা সি সানফেতের মন্দির। এটা ঠিক একটা মন্দির নয়। স্তুপ আছে অনেক গুলো, আবার গুলো মন্দিরও আছে। তাদের মধ্যে একটি মন্দির আবার জীবন্ত। মানে সেখানে এখনো পূজোপাট হয়। সেই মন্দিরের নাম ফা মঙ্খনবোফিত। এখানে মন্দির এবং প্রাসাদ চত্তর অনেকটা ছড়ানো। বড় রাস্তা থেকে একটা পায়ে চলা বীথি চলে গেছে মন্দিরের দিকে। সেই পথ একটা ছোট্ট খাল পেরিয়েছে ছবির মতো একটা সাঁকোর ওপর দিয়ে। ওপাশে আবার গাছ পালার মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে চলা। কানে একটা হাল্কা সুর ভেসে আসছে। প্রার্থনা সঙ্গীতের মত কিছু একটা। গাছ পালার ফাঁক দিয়ে মন্দিরটা দেখতে পেলাম। সামনে একটা মাঠ, তার মাঝখানে রাস্তা চলেছে মন্দিরের দিকে। আস্তে আস্তে প্রার্থনার শব্দ স্পষ্ট হচ্ছে। সে সুর কেমন, তা কথায় লিখে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। চটুল সঙ্গীত নয়, কিছুটা হয়ত একঘেঁয়ে, কিন্তু কি অপার্থীব আমি লিখে বোঝাতে পারবো না। একটা অলস ভাব, একটা ভাবাতুর সমর্পন রয়েছে সে সঙ্গীতের সুরে। যেন জাগতিক সব কিছুর বহু ওপরে কোন এক শান্তির খোঁজ। গানের ভাষা বুঝিনি। কিন্তু মনে হচ্ছিলো এ গান উঠে আসছে বহু যুগের ওপার থেকে, শ্যামদেশের হৃদয় থেকে। আর এ দেশের সেই হৃদয়ে প্রান প্রতিষ্ঠা করেছেন ভারতবর্ষ থেকে আসা সন্ন্যাসী আর ভিক্ষুরা। মন্দিরের ভেতরে অতিকায় ধাতব বুদ্ধমূর্তি। সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নত করার বদলে চিবুক উঁচিয়ে তাকালাম তথাগতের দিকে। মনে হলো এ তো আমার নিজের আপন আমার খুব চেনা কোনকিছু! ধুপ জ্বালালাম। দক্ষিনার বাক্সে থাই ২০ বাতের নোট ঢুকিয়ে দিলাম, আর তার পর কি মনে হওয়াতে পকেট হাতড়ে একটা ভারতীয় পাঁচ টাকার কয়েন ও দিলাম। মন্দিরের বাঁ পাশে আয়ুত্থায়ার সব চেয়ে বড় পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন – ওয়াত ফ্রা সি সানফেত। 

যখন দাঁড়ালাম এই মন্দির, স্তুপ আর প্রাসাদের ভগ্নস্তুপের মধ্যে, প্রথমেই মনে হলো কিছু কিছু যেন খুব চেনা। আয়ুত্থায়া বহু শতক ধরে শ্যামের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকে এখানে রাজারা থাকতেন। প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো আয়ুত্থায়া। কিন্তু আজকের আয়ুত্থায়াতে আপনার চোখ কেড়ে নেবে এখানকার মন্দির, স্তুপ আর বুদ্ধমুর্তি। নজর এড়াবেনা, এই সব স্থাপত্য আর মুর্তিতে ভারতবর্ষের প্রভাব থাকলেও আদতে এগুলো শ্যাম দেশের একান্ত নিজেরই। হয়ত এই ভাবে, এইখানে সূদুর অতীতে আমারই মত হয়ত কেউ এসেছিলো ভারতবর্ষ থেকে। এবং এখানে যে বীজ ছড়িয়েছিলো, সেই অঙ্কুর আর মহীরুহে পরিনত হয়েছে। আর মাটির বহু গভীরে তার শেকড় ছড়িয়ে গেছে। মনে করতে চেষ্টা করলাম সেই অদেখা পূর্বপুরুষকে। বহু বছর আগের যে পথ ধরে তিনি এসেছিলেন, আমি সেই পথে আসিনি। তিনি যে উদ্দ্যেশ্যে এখানে এসেছিলেন, আমি তার ধারে কাছেও যাইনা। তবুও আজকে এত শতাব্দী পরে এইখানে এসে দাঁড়িয়েছি, আমার পূর্বপুরুষের পদাঙ্কে, এটা ভাবতেই কেমন গায়ে কাঁটা দিলো। এই মুহুর্তটাই থাইল্যান্ডে আমার সেরা মুহুর্ত। নিজেকে আবিস্কার করা একটা আনন্দ আর বিস্ময়। ঠিক এরকম একটা কিছু দেখতেই আমি যেন এসেছিলাম এদেশে। প্রতিটি স্তুপের সামনে দাঁড়িয়ে, প্রতিটি মন্দির বা ভাঙ্গা বুদ্ধ মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে নতুন করে শ্যামদেশ কে চিনলাম। এতদিন এদেশে এসে ঠিক যেন মন ভরছিলো না। আজ এইখানে সেটা হলো। স্থানীয় জনজাতি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট বজায় রেখে ভারত থেকে আগত ধর্ম কে আর সংস্কৃতিকে গ্রহন করেছে। আর আত্তিকরন হয়ে  তৈরি হয়েছে আজকের থাইল্যান্ড। স্বরনদীপ কাউর নয়, সেলিনথিপ। ভারত এখানে মিশে গেছে শ্যামে। সেটাই ওর আসল নাম। আয়ুত্থায়ায় দাঁড়িয়েই বলে এসেছি, আবার আসবো। সেলিনথিপের দেশে।  

1 টি মন্তব্য :