শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২০

স্বর্গপ্রান্তে সতোপন্তে


মনে হয়েছিলো সশরীরে স্বর্গারোহন হয়েই গেল বুঝি। সামনের কিলোমিটারটাক গেলেই নাকি দেখতে পাবো স্বর্গারোহিণী গ্লেসিয়ার। আর সেইখানেই ঢুকে গেলাম বরফের খাঁজে। পা ফেলতেই ভুস করে নরম বরফ ভেদ করে আমার দু মনি দেহকান্ডখানি বরফের ভেতর সেঁধিয়ে গেল।

সতোপন্ত হিমবাহ পার হবার সময়

দাঁড়ান দাঁড়ান । বয়স বাড়ার সঙ্গে কি ছিরির যে কথাবার্তা বলি, খেয়াল থাকেনা। মাঝখান থেকে বেমক্কা এসব বলতে শুরু করলে আপনার মানসপটে অশ্লীল শব্দসমূহ ঘোরাফেরা করার প্রভূত সম্ভাবনা। তাই শুরু থেকেই কই। 

উঠলো বাই তো কোথায় যাই?
আপিসের ঠিক সামনেই চায়ের দোকানে বসে আড্ডা আমাদের। সেথায় বসে প্রচুর উজির নাজির মারা রোজকার নিয়ম। ২০১৯ এর জানুয়ারি পড়তেই শীতের রোদ গায়ে মেখে ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড় সামনে রেখে শুরু হলো জায়গা খোঁজা। “বাগিনীর পিঠে” যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের কাছে কানহাইয়ালালের পরিচয় নতুন করে দেবার কিছু নেই। আর যাঁরা সেখানায় চোখ রাখেননি, তাঁদের কাছে বিনিত অনুরোধ – “এগবাটটি চোখ রেখেই দেখুননা মহায়“। এবারেও সেই কানহাইয়ালালই আমাদের নেতা। সঙ্গে আমি রয়েছি, আর আছে মাধাই। জগাই যেতে পারবেনা প্রচন্ড ইচ্ছে সত্ত্বেও। তাদের আবার দু বাড়িতে পাকা কথা হয়ে গেছে সে সময়। আর এ লেখা যতদিনে লিখছি, দুজনে ছাঁদনাতলা পার করে সংসার পেতেও ফেলেছে। দাদা-বউদিও এ যাত্রা থাকছেনা। কারন তারা কদিন আগেই গোচা-লা ট্রেকের সব কিছু পাকা করে ফেলেছে আর একটি দলের সঙ্গে। আমাদেরও বলেছিলো, কিন্তু আমরা আমতা আমতা করায় আর কথা এগোয়নি। তিনজনের দল আপাতত হলো। তার পর অভিযানের গন্তব্য ঠিক করার জন্যে ঝাড়া দু হপ্তা, শ দেড়েক ভাঁড় চা, গোটা তিরিশেক প্লেট ঘুঘনি আর খান পঞ্চাশেক ডিমের অমলেট ধ্বংশ করার পর ঐক্যমতে না আসতে পেরে জওনভাইকে ফোন করা হলো। জওন ভাই আমাদের ট্রেকের গাইড। যোশীমঠের লোক। আমাদের পরিকল্পনাগুলো তাকে বলা হলো। সব শুনে টুনে জওন সিং রাওয়াত বলল “চলো সতোপন্ত”। জওনভাইয়ের ওপরে আমাদের অগাধ ভরসা। তৎক্ষনাৎ মোবাইল পাকড়ে তিনজনে খুঁজে পেতে দেখলুম জায়গাটা বদ্রীনাথের উত্তর পশ্চিমে। ম্যাপ , লোকজনের লেখা আর ভিডিও থেকে জানলাম এ রাস্তা মহা দুর্গম। কানহাইয়ালাল তার পূর্বতন ট্রেকের দলের এক অভিজ্ঞ গাইডকে ধরে জিজ্ঞেস করল। তিনি একটু শব্দে বাতলে দিলেন – “ডিফিকাল্ট”। ট্রেক যাঁরা করেন, তাঁরাই জানেন ডিফিকাল্ট মানে কি। সহজ বা ইজিতেই আমার নাভিশ্বাস উঠতে থাকে। ইজি-মডারেট হলে তো কথাই নেই। আর পুরোপুরি মডারেট মানে নিজেই বুজে নিন। এবার আন্দাজ করুন ডিফিকাল্ট মানে কি হতে পারে। এই ভারতবর্ষে খুব বেশী হলে গোটা আষ্টেক ট্রেক আছে, যেগুলোকে ডিফিকাল্ট বলা হয়। যেমন ধরুন পিন-পার্বতী, চাদর, অডেনস কল, মায়ালি পাস, পানপাতিয়া ইত্যাদি। সতোপন্ত নাকি এই গোত্রে পড়ে। শুনেই পেটের ভেতরটা কেমনজানি একটা করেনি এটা হলফ কেটে বলতে পারিনা। কিন্তু ভাবলাম দেখাই যাক না, কদ্দুর কি হয়। কিছুটা ঝোঁকের মাথাতেই বলে দিলাম “চালাও পানসি বেলঘরিয়া”।

তিনজনে মিলে ট্রেক একটু চাপের। অন্য কিছুই না, খরচ পাতি একটু বেড়ে যায়। আমার আবার কিপটে বলে বাজারে ভারি সুনাম। কাজেই লোক খোঁজা শুরু হলো। প্রথমেই পাওয়া গেল আর এক জোড়া দাদা বৌদি। আপিসের বাইরে নিয়ে গিয়ে তাদের দুদিন হাঁটানোও হলো। কিন্তু কি জানি কেন, তাদের যাওয়াটা আর হলো না। অগত্যা আমাদের খোঁজাখুঁজি চলতেই থাকলো। এবার জালে উঠলো গজব। আজ্ঞে হ্যাঁ ওর আসল নামটুকু সব্বাই ভুলে মেরে দিয়েছি। এখনো করিডোরে দেখা হলে ওকে গজব বলেই ডাকা হয়। সে বেচারা আমাদের ভেতর সব চেয়ে ছোট। চেহারায় নয়, বয়সে। ছোটবেলা বাংলার বাইরে কাটার জন্যে বাংলায় ভারি মিষ্টি একটা টান, আর সেই টানেই অবাক হতে হতে কথায় কথা বলে বসে “গজব” (কায়দা করে “Ghazab” বলা নয়, খাঁটি বাংলা টানে “গজোব”)। এর মধ্যে একদিন বাড়ি ফেরার পথে আমি বাসে বসে আমাদেরই পাশের পাড়ার দুই মক্কেলের সঙ্গে গপ্প করছিলুম। তারা কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলে, এবার কোথাও যাচ্ছি কিনা। বললুম যাচ্ছি তো বটে কিন্তু দলে আরো খান দুই জায়গা আছে। তারা স্বামী স্ত্রী ২০১৮র বিশ্বকাপ দেখে এসেছে রাশিয়ায় গিয়ে। গিন্নিটি তো আল্পসের আশেপাশে বেশ কয়েক বছর কাটিয়েও এসেছে। হয়ত এসব কঠিন অভিযান তাদের পোষাবে না, এসব ভাবতে ভাবতেই বলে বসলুম তারা যাবে কিনা। আমাকে অবাক করে তারা রাজিও হয়ে গেল। ফিটনেস বাড়াবার রুটিন দিয়ে দেওয়া হলো নতুন তিনজন কে। জগাইয়ের জায়গায় গজব। আর পুরোনো দাদা বউদির জায়গায় এবার নতুন দাদা বৌদি। দাদা বৌদি বলছি বটে, কিন্তু বৌদি আমার মেয়ের স্কুলের সিনিয়র। আমার কাছে মেয়ের দিদিরই মত। কাজেই হিসেব মত আমি ওদের কাকার পর্যায়ে পড়ি। যাই হোক দলটি আমাদের বেশ লাগছিলো। দাদা বউদি যেহেতু পাশের পাড়ার, কাজেই আমি সকাল বেলা যে মাঠে দৌড়তে যাই, তারাও সেখানে আসে। এবং তারা কি করছে না করছে আমি দেখতে পাই। দাদা ফুটবলের পাগলা ফ্যান। ফুটবলের জন্যে করতে পারেনা এমন কাজের অস্তিত্ব নেই তার কাছে। আজকাল এরকম আত্মভোলা স্বল্পভাষী সহজ সরল মানুষ কমে আসছে। আর বৌদিও কম যায়না। সেও খুবই গুনি নৃত্যশিল্পি। এদিক ওদিক অজস্র অনুষ্ঠান করে থাকে নিয়মিত। সে দিক থেকে দেখতে গেলে, ফিটনেসের অভাব হবার  কথা নয় এদের।

কানহাইয়ালাল আগেরবারের মতই সবাইকে রোজ রোজ উৎসাহ জুগিয়ে গেল। মাধাই এবারে অনেক পাকা। সে নিজেই জানে তাকে কতটা কি করতে হবে। গজবের ভার মাধাই নিয়ে নিলো। তাকে ঠেলে ঠুলে হাঁটানো দৌড় করানো, সবই চলল। আমাকে দেখলেই দাদা বৌদি মাঠে জোরে জোরে হাঁটত থাকে আর মনে মনে অনেক ইয়ে দেয়। কারন আমি রোজ ওদের “আরো জোরে আরো জোরে” করি। এই করতে করতে আমাদের যাবার দিন এগিয়ে এলো। এবারে আমরা সবাই উড়ান দিচ্ছি দিল্লি অবধি। এক তো ট্রেনের ভাড়া আর প্লেনের ভাড়ায় তফাত কম। তার ওপরে সময় লাগে অল্প। আমাদের যাত্রার দিন ৮ই জুন, ২০১৯। সকলে আলাদা আলাদা টিকিট কেটেছি। এদিকে যাত্রার মাস খানেক আগে মাধাই বদলি হয়ে গেছে ব্যাঙ্গালোর। সে সোজা দিল্লি আসবে ব্যাঙ্গালোর থেকে। দাদা-বৌদি, আমি ও গজব, আমাদের উড়ানের সময় মোটামুটি সকাল বেলা মিনিট কুড়ির এদিক ওদিক। মাধাই আর কানহাইয়ার উড়ান আবার কাছাকাছি সময়ে। দিল্লি থেকে আমরা দেরাদুন জনশতাব্দী ধরে যাবো হরিদ্বার। রাতে সেখানেই থাকা। গজব আমাদের হরিদ্বারের হোটেল বুক করে রেখেছে।

মাঝরাত্তিরে কলরোল - এরোপ্লেনে গন্ডগোল
আজ্ঞে সে আর কইবো কি মশায়। একটা সময় মনে হলো ধুত্তেরি, এত টেনশন নিয়ে বেরোনো যায়? যত নষ্টের গোড়া ওই এরোপ্লেন কোম্পানী। খুলেই কই। যেহেতু আমরা টিকিট কেটেছি আলাদা আলাদা, যে যেমন ভাবে পেয়েছি তাই আমাদের সকলের আলাদা আলাদা এয়ার লাইন। পরের দিন আমার উড়ান সাড়ে সাতটা নাগাদ। কাজেই দমদম পৌঁছতে হবে ছটার মধ্যে, আর তার মানে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে পাঁচটায়। সেই হিসেব করে চারটে নাগাদ ঘুম ভাঙ্গা দরকার। এমনিতে পাঁচটায় আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়, কাজেই সমস্যা নেই। সেই হিসেব মত মালপত্তর বাঁধাছাঁদা করে রাত ১১টায় শুতে গেছি। ঘুম ভাঙ্গল দেড়টা নাগাদ। মাথার কাছে ফোনটা কোঁকোঁ করছে। কেউ ফোন করেনি বটে, কিন্তু এক গাদা বার্তা ঢুকে চলেছে। হাতে নিয়ে দেখি কেলেঙ্কারি। দাদা-বৌদির ফ্লাইট ক্যানসেল। লে হালুয়া! আর ঘন্টা ছয়েক পর প্লেনের আকাশে ওঠার কথা এখন বলে কিনা বাতিল? এ কি বিটকেল রসিকতা মাইরি! টেনশনে ঘেমে গেলাম। দেখলাম বাকিরাও খুব চিন্তিত। সকলেই কিছু না কিছু উপদেশ দিয়ে চলেছে। ঘন্টা কয়েক গেল। কিন্তু দেখলাম আমাদের এবারের দাদা বৌদি এসব সমস্যার সামনে দিব্যি চৌকস আছে। রাত দুপুরেই এদিক ওদিক ফোন করে, খুঁজে পেতে অন্য প্লেনে জায়গা করে নিলো। পাকাপাকি খবর আসতে ঘড়িতে দেখলাম তিনটে পাঁচ। ঘুম আর এলোনা। জুন মাসের গরম, তাই ভালো করে চান টান সেরে বেরিয়ে পড়লাম। ভোর বেলা এক রেল স্টেশন আর বিমানবন্দর ছাড়া ট্যাক্সি দাদাদের মেজাজ কিঞ্চিত নরম থাকে। ফুরফুরে হাওয়া খেতে খেতে পৌনে ছটায় বিমান বন্দরে ঢুকে গেলাম। দাদা বৌদির ফ্লাইট কিঞ্চিত আগে, তাই তারা আগেই চলে এসেছে। গজব বলল রাস্তায় আছে। তার বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট বেশি দূর না। আমার পিঠের ব্যাগটিকে চেক ইন করিয়ে, বোর্ডিং পাস নিয়ে মহাপ্রাণীর আর্তনাদ শুনতে শুনতে এসে দাঁড়ালাম টার্মিনালে।

কেন জানি বিমানবন্দরে সব রকমের খাবার দাবার অগ্নিমূল্য।  ক বার এদিক থেকে ওদিক সরেজমিনে তদন্ত করে এলাম যদি সস্তাগন্ডার কিছু থাকে। কিন্তু সাহস করে  কিছুই কেনা হলো না। ওদিকে খিদে ভালোই চাগাড় দিচ্ছে। এমন কিছু খেতে হবে যাতে অনেক্ষন খিদে না পায়। আড়াইশো টাকা দিয়ে তিন পিস পাউরুটি, দু চামচ সেদ্ধ চিকেন আর মেয়োনিজ খেতে মন চাইলোনা। শেষে দেখলাম এক্কেবারে শেষের দিকে এক জায়গায় রোল বিক্রি হচ্ছে। মানে সেরকমই লেখা আছে। ইয়া আলী!! সকাল সাড়ে ছটায় এগরোল? ভাবলুম যা থাকে কুলকপালে, চাইলাম রোল। কাউন্টারের ছোকরা বেশ মন দিয়ে মেপে দেখলো আমাকে। একশো কুড়ি টাকা গুনে নিয়ে রসিদ দিলো। এত দামী এগরোল আমি জীবনে খাইনি। পাশেই আর এক ছোকরা সেজে গুজে ঘুমন্ত চোখে চাটুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রসিদ নিয়ে ইনিও একটু মাপলেন আমায়। এত সকালে কেউ এগরোল হয়ত ইচ্ছে করেনি কখনো । যাই হোক, বেশ পরিপাটি করে রোলটি ভেজে দিলো। খেতে সময় লাগলো মিনিট খানেক। কোনো এক বাথ্রুমের আড়ালে , ফোয়ারার ক্ষুদ্র সংস্করন থেকে নাকে বিস্তর জল ঢুকিয়ে কিছুটা জল খাওয়ার পর ধাতস্থ হলাম। ইতিমধ্যে দেখি প্লেনের পেটের ভেতর লোকজন ঢুকতে আরম্ভ করেছে। আম্মো সেঁধিয়ে গেলাম। আসনে বসে বেশ নিশ্চিন্ত লাগলো। দাদা বৌদি ও গজবের বিমান আগেই উড়ে গেছে। এবার আমিও চললাম। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। একটু পরেই ঝিমুনি এলো। খালি একবার সেই ঝিমুনি ভেঙ্গেছিলো ঘন্টা খানেক পর, যখন দেখলাম জানলার বাইরে নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে বহু দূরে দেখা যাচ্ছে ধপধপে সাদা বরফে ঢাকা পর্বতমালা। একটু মন দিয়ে দেখে শৃঙ্গ গুলো চিনতে পারলাম। প্রথমে শিকদারবাবুর এভারেস্ট, তার পর নন্দাদেবী আর চৌখাম্বা চোখ টানলো। ওই মুলুকেই যাচ্ছি। এখনো কত দূরে ওরা। কাল সন্ধ্যের দিকে আমরা যোশীমঠ পৌঁছবো।

বিমান থেকে হিমালয়ের দেখা – একেবারে বাঁ দিকে নীলকন্ঠ ও চৌখাম্বা

চেষ্টা করলাম হাতের ক্যামেরা বাগিয়ে কটা ছবি তুলতে। বাধ সাধল লেন্স। আমার ক্যামেরা আমারই মত বেজায় মোটাসোটা ভারি বেঢপ। সে ক্যামেরা ঘাড়ে পাহড়ে উঠতে প্রানান্ত হয়। তাই টেলিফোটো লেন্স আনা হয়নি, কারন সেটিও যম ভারি। কাজেই প্লেনের জানলা দিয়ে ওয়াইড অ্যাঙ্গল বাগিয়ে তিনশ কিলোমিটার দুরের লক্ষ্যবস্তুর ছবি তোলা নেহাত মূর্খামি। আমার পাশের দুটি আসন খালি। ওপাশের আসনে এক ছোকরা একটি মহাকায় লেন্স লাগানো ক্যামেরা নিয়ে বসে বসে ঝিমোচ্ছে। তার ওপাশের আসনে প্রৌঢ় দম্পতি বাংলায় গপ্পগাছা (প্রানপনে পরনিন্দে) করে চলেছেন। আন্দাজে মনে হলো ছোকরাও বাঙালি, হয়ত বাপ মা ছেলে কোথাও যাচ্ছে। গলা খাঁকারি দিয়ে একটু হেঁকে বললুম বাইরে তাকিয়ে দেখতে, দুর্দান্ত সব জিনিস দেখা যাচ্ছে। ছোকরা উঠে এলো। পাহাড় টাহাড় চিনিয়ে দিলুম। তার ক্যামেরার নির্মাতা ও আমার ক্যামেরার নির্মাতা আলাদা, কাজেই তার লেন্স খুলে আমার ক্যামেরায় লাগানো যাবেনা। অগত্যা ওকেই বললুম ছবি তুলে রাখো। ছবিটবি তুলে ছোকরা বললে – কাকু আপনি এই পাহাড় গুলো চিনতে পারলেন এত দূর থেকে?  বললাম ওই ছবি টবি দেখে চেনাজানা হএ গেছে আর কি। ছোকরা চাকরি করে টিসিএসে। বাপ মা কে নিয়ে যাচ্ছে উত্তরাখন্ডে। এদিক ওদিক ঘুরবে। শুনে ভারি ভালো লাগল। বাপ মায়ের সঙ্গে আমি শেষ বেড়াতে গেছিলাম ১৯৮৯ এর ডিসেম্বরে। আর তার পর আবার ২০১১ সালের ডিসেম্বরে। মাঝের বছর গুলো যে কোথা দিয়ে চলে গেল, এখন ভেবেই পাই না। আমরা পাহাড়ে চড়ব জেনে ছোকরা উৎসাহী হয়ে পড়ল। তারও ভারি শখ এসবের। সুলুক সন্ধান দিলাম কিছু। গপ্পে গপ্পে শুনি করকরে গলায় ঘোষনা হচ্ছে অবতরণের। বিমান এবার দিল্লিতে নামবে।

সঙ্গীসাথী লটবহর - সরগরম দিল্লি শহর
আবার দিল্লি, সেই জুনের ৯ তারিখ, সকাল ১০টা। বাগিনী অভিযানের সঙ্গে দিনক্ষন মিলে যাচ্ছে। তফাত শুধু এবারে নতুন দিল্লি রেল ইস্টিশন নয়, আমরা এসেছি আকাশপথে, ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতীক হাওয়াই আডঢা দিয়ে। বাঙালি আড্ডাবাজ বলে তার বদনাম। কিন্তু দিল্লিতে যে বাস, বিমান সকলের এত গুলো আডঢা ছড়ানো তার বেলা? যাই হোক, নেমে একটা হালকা মুশকিলে পড়লাম। কিছুই না, আমাদের ঘন্টা দেড়েক অপেক্ষা করতে হবে মাধাই আর কানহাইয়ার জন্যে। সে নাহয় ঠিক আছে। কিন্তু দাদা-বৌদি নেমেছে টার্মিনাল দুইতে আর আমরা দুজন , মানে আমি আর গজব নেমেছি টার্মিনাল একে। দুই টার্মিনালে বেজায় আড়ি। একে অন্যের থেকে বেশ কিছুটা তফাতে। দাদা বলল বেরিয়ে চলে এসে আমাদের টার্মিনালের বাইরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু জুন মাসে দিল্লির গরমে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটা কিঞ্চিত ইয়ে টাইপ মনে হলো। কাজেই বললাম তারা যেন এয়ারপোর্টের ভেতরেই থাকে। মাধাইরা এলে বেরোলেই হবে। আমি আর গজব ইতি উতি ঘুরলাম। তিরিশ না পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কফিও খেয়ে ফেললাম। শেষে দু খানা কেদারা পেয়ে তাইতে শুয়ে ঝিমোতে ঝিমোতে বাকি দুজনের আসার সময় হয়ে গেল। তারাও আমাদের টার্মিনালেই আসবে। মালপত্র আসার চলমান বেল্টের সামনে লোকজন ভিড় করে। আমরাও সেখানেই গেলাম। আর মিনিট দশেক পর কানহাইয়া মাধাই যোগদিলো আমাদের সঙ্গে। দাদা বৌদিকে  বলে দেওয়া হলো তারা যেন সোজা মেট্রো স্টেশনে চলে আসে। আমরা টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে খুঁজতে লাগলাম কি ভাবে মেট্রো স্টেশন পৌঁছনো যায়। সামনেই বাস ছাড়ার কথা। তবে কিনা যতই রাজধানী হোক, ভারত বলে কথা। বিস্তর গলিঘুঁজি দালানকোঠা পেরিয়ে মিনিট সাত আট পর বাস খুঁজে পাওয়া গেল। বাস ওয়ালে ভাই সাহাব টিকিট দিলেন। মিনিট দশেক গরমে সেদ্ধ হবার পর বাস ছাড়ল, এবং বাতানুকুল ব্যাবস্থাও কাজ করা শুরু করল। কিলোমিটার তিনেক দুরেই মেট্রো। খোদার খামোখা এমন মাঠের মাঝখানে কেন করেছে ইস্টিশন কে জানে বাপু! যাই হোক, দাদা বৌদি তাদের টার্মিনালের কাছে অন্য একটা ইস্টিশন থেকে ট্রেন ধরেছে। যদিও ফাঁকা ফাঁকা গাড়ি, তবুও আর খোঁজাখুঁজির চাপ নিলাম না আমরা। নতুন দিল্লি রেল স্টেশনে পৌঁছে আমরা একে অপরদের খুঁজে নেবো। গতবারের মত আর রাস্তা দিয়ে হরিদ্বার পৌঁছনোর অ্যাডভেঞ্চার করিনি এবার আমরা। সোজা ট্রেনের টিকিট কিনে নেওয়া হয়েছে চার মাস আগেই।

মিনিট তিরিশেক পর আমরা নয়াদিল্লি রেল স্টেশনের বাইরে দুপুর একটার সময় জুন মাসের ঠেকো রোদ্দুরে সবাই এক জায়গায় হলাম। আমাদের ট্রেন ছাড়বে সেই তিনটে কুড়ি, কাজেই হাতে ঘন্টা আড়াই সময়। অনেকের আবার পেটেও খিদে। আমার সকালের এগরোল এখনো দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। যে টুকু খিদের ভাব আসছে, এই পাথর গলা গরমে সেটুকু সঙ্গে সঙ্গে চোঁ চাঁ দৌড় মেরে পালিয়েও যাচ্ছে। বাকিদের মুখ গুলো দেখি শুকিয়ে আমসি। আমারও নিশ্চই একই দশা। আমরা ভাবলাম কোথাও একটু বসি। খাওয়া দাওয়া করি। আজ রাত থেকে “শুদ্ধ শাকাহারী” এলাকায় প্রবেশ করব। কাজেই, একটু অন্য জিনিস পেটে পড়লে মন্দ হতো না। আশেপাশে যা দু চারটে খাবার জায়গা, সবই হয় “শুদ্ধ শাকাহারি”, নয়ত রোদে বেঞ্চি পাতা ঝুপস। একটা জায়গা আছে আমি জানি, কিন্তু সেখানে আবার খাবারের সঙ্গে কিঞ্চিত পানিয়ের ব্যাবস্থাও আছে। যদিও জায়গাটি বাতানুকূল এবং আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার থেকে স্রেফ মিটার কুড়ি দূরে। কান টান চুলকে ভেবে চিনতে সেখানেই যাওয়া স্থির হলো। ভেতরে ব্যাবস্থা আহামরি কিছু না। তবে কাবাব টাবাব পাওয়া যাচ্ছে আর ট্রেনের যাত্রিরা গরমে ঝলসে এসে “ঠান্ডি বিয়ার” হুকুম করছেন, আর ঢকঢকিয়ে গোটা দুত্তিন বিয়ার কন্ঠস্থ করেই আবার ট্রেন ধরতে ছুটছেন। আমরা কয়েক রকম কাবাব হুকুম করলাম। কাউন্টারে পুছতাছ করা হলো পানীয়ের ব্যবস্থা কি আমাদের। খান চারেক কোকা কোলা বলতেই আবার পুছ তাছ – “অওর?”। কানহাইয়া ভীষন কেজো গলায় দু খানা “ঠান্ডি বিয়ার” হুকুম করে ফেলল। টেবিলে বসে মালপত্তর রেখে একটু হাঁফ ছেড়ে বসলাম।  ভেতরের ঠান্ডায় গা জুড়িয়ে গেল। আমাদের সকলের পরনেই খুব হালকা পাতলা জামাকাপড়। মিনিট দশেক পর গরমা গরম কাবাব আর ঠান্ডা ঠান্ডা বিয়ার ও কোকাকোলা দেখা দিলেন। প্লেটে করে পেঁয়াজ লংকা টমেটো চাটমশলা দিয়ে মাখা চিনেবাদামও এলো। আমি আর গজব এক সঙ্গে বসেছি। ওদিকে দেখি কানহাইয়া একটা বিয়ারের বোতল ধরে ঢক ঢক করে কিছুটা খেয়ে মিনিট খানেক চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। আমিও দু এক চুমুক দিলাম। ওই চাষাড়ে গরমে এই ঠান্ডা তিতকুটে বস্তু যে কতখানি অমৃতের মত হয়ে যেতে পারে, সেটা না চাখলে বোঝা ভার। হঠাৎ দেখি বিয়ারের বোতল বিলকুল খালি। এই এলো আর এই খালি। কোকা কোলার একটি বোতল সবে অর্ধেক খালি হয়েছে। অতএব লাও বিয়ার।

ঘন্টা দেড়েক কাবাব আর বিয়ার সেবন করে শীতল মন-প্রান-পেট নিয়ে আমরা হরিদ্বারমুখি জনশতাব্দীতে উঠে পড়লাম। ছুটির মরশুম স্কুলে, তাই বিস্তর কচিকাঁচা সমেত বাপ মায়েরা এবং সঙ্গে কাকা-জ্যাঠা-কাকিমা-জ্যেঠিমা-দাদু-ঠাকুমা-দিদিমা-মাসি সব সমেত লোকজন পাহাড়ে চলেছেন। দিল্লির লোকজন একা একা ভ্রমন ভালোবাসেননা মনে হয় বড় একটা। গোটা কামরায় এক হুলুস্থুলু কান্ড। আর সেই সঙ্গে পেল্লায় আকারের সব বাক্স প্যাঁটরা। কোন রকমে এদিক ওদিক করে আমাদের আসনে গিয়ে বসে চারপাশের মজা দেখতে লাগলাম। কত রকমের প্রশ্ন আর রকমারি উত্তর। কিছু পেঁচোয় পাওয়া ছানার চিল চিৎকার সেই “মসালেদার গুফত-গু” এর ওপরে যেন রূপোর তবক দিয়ে সাজানো। আমাদের আসনগুলো কামরার একেবারে মাঝখানে। সামনেই তিনটি ছেলেকে দেখে কেন জানি মনে হলো তারাও আমাদেরই মত পাহাড়ে চড়ার বাসনায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। গাড়ি চলতে আরম্ভ করল, অন্য সব চেল্লামেল্লি আস্তে আস্তে থেমে গেল। গাজিয়াবাদ পেরোতেই দেখি সবাই হয় কানে হেডফোন গুঁজে, নয়ত চোখ বুঁজে আছে। আমার ছোটোবেলা থেকে রেলগাড়ির জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখতে খুব ভালো লাগে। আমি সেইটাই দেখতে থাকলাম। যদিও আমরা বাতানুকুল কামরায় রয়েছি, কিন্তু বাইরে তাকালে চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এ সেই আলি সাহেবের বর্ণনার খাইবার পাসের মত রুক্ষ। অথচ পশ্চিম উত্তর প্রদেশের এই সব অঞ্চল দস্তুরমত সুজলা সুফলা দোয়াব অঞ্চলের অংশ।

চুপচাপ হয়ে আসা কামরায় আলোড়ন তুলল তীক্ষ্ণ স্বরের একটা হাঁক। প্যান্ট্রি থেকে লোকজন এসে কিছু একটা ফিরি করতে শুরু করেছে। সামনে আসতে দেখি, আমুলের দই যেমন ১০০ গ্রামের প্লাস্টিকের কাপে বিক্রি হয়, সেরকম একটা জিনিস। এক কাপ কেনা হলো। ঢাকনা খুলে দেখি ইষৎ হলদেটে মালাই গোছের দুধ জাতীয় বস্তু। মুখে দিতেই মন প্রান জুড়িয়ে গেল। কেসরের গন্ধ ভুরভুর করছে। মিষ্টির পরিমানটি ভারি মাপা, মেকদার। আর তাবৎ বস্তুটি মখমলি মোলায়েম। দিল্লি সমেত গোটা উত্তরাপথে মিষ্টিতে বাদাম পেস্তার খিচখিচ পাবেন না, এমন চট করে হয় না। কিন্তু এ বস্তু তার চেয়ে ঢের আলাদা। বাছাধন আবার ঘুরে আসতে মাথা পিছু এক কাপ করে নেওয়া হলো। দাম যতদুর মনে পড়ছে ১০-১২ টাকার মধ্যে। একে একে এলো পকোড়া, চা এমনকি ভেজ বিরিয়ানি (কাঁঠালের আমসত্ত্বটাই শুধু আসেনি। দিল্লির লোকে এখনো সেটা বুঝে উঠতে পারেনি কিনা) পর্যন্ত। আমরাও বিক্রেতাকে নিরাশ করিনি। চাটপোট করে চেয়ে চেয়ে প্রতিটি বস্তু খেয়েছি। একে একে স্টেশন পেরোচ্ছে। যদিও নামে শতাব্দী আছে, তবুও গাড়ির গতি খুব একটা বেশী নয়। ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলেছে। একে একে পেরোলো মেরঠ, মুজাফফরনগর, টাপরি। এবার গাড়ি ঢুকছে রুড়কি। সামনের তিন ছোকরা নড়ে চড়ে বসল। কিঞ্চিত বাক্যালাপ শুরু হলো। এনারা ইন্দোরের বাসিন্দা। চলেছেন দেরাদুন। আগামী কাল ভোর বেলা গাড়ি ধরে যাবেন “হর কি দুন” ট্রেক করতে। কোন এক নামকরা ট্রেক কোম্পানির তত্ত্বাবধানেই যাচ্ছেন। আমরা নিজেরাই যাচ্ছি শুনে কিঞ্চিত অবাক। কিছু তথ্য আদানপ্রদান হলো। কথায় কথায় দেখি গাড়ির গতি কমতে লেগেছে। আমাদের বোঁচকা পিঠে বেঁধে দরজার সামনে দাঁড়ালাম।

বছরখানেক পার , আবার হরিদ্বার
আজ্ঞে শুধু দিন তারিখই নয়, ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক আগের বারের মত পৌনে আটটায় আমরা ছয় মূর্তি পা রাখলাম হরিদ্বারে। আগের বারের মতই থিকথিকে ভিড়, আর চিটচিটে গরম। গজবকে বলা হলো আমাদের হোটেল খুঁজে বের করতে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমরা হাঁটছি ভিড় ঠেলে। বাসস্ট্যান্ড পেরোলাম। রাস্তার দু ধারে অতি লোভনীয় খাবার দাবার বিক্রি হচ্ছে। সিঙাড়া, জিলিপি,গোলাপজাম,কচুরি, ছোলে বাটুরে, ভুট্টা, ফুচকা, দুধ, মালাই। আপাতত আমরা ঠিক করেছি হোটেলে ব্যাগপত্তর রেখে তার পর আবার বেরোবো। বার দুই রাস্তা হারিয়ে চক্কর কেটে অবশেষে মিনিট তিরিশেক পর হোটেল খুঁজে পাওয়া গেল রিসেপশনের ছোকরা অমায়িক। তাড়াতাড়ি আমাদের ঘরটর দেখিয়ে দিলো। দিব্যি ঘর। মালপত্তর রেখে হালকা হয়ে দুলকি চালে বেরোলাম আমরা। কানহাইয়া আর আমি যাবো বাসের টিকিট কাটতে। ফেরার টিকিট কেটে নিতে হবে আজই। নয়ত ফেরার দিন জায়গা পাবোনা। মাধাইও চলল আমাদের সঙ্গে। দাদা বৌদি আর গজব গেল হর কি পৌড়ি দেখতে। বলল ওখানেই কিছু খেয়ে ফিরবে।

হরিদ্বারের রাস্তাঘাটে হাঁটা এখন পূজোর মুখে ধর্মতলার সঙ্গে তুলনীয়। কেবল মাথা আর মাথা। গিজগিজে থিকথিকে বিরক্তিকর ভিড়। শান্তিতে হাঁটার উপায় নেই। বিস্তর গুঁতো টুঁতো খেয়ে বাসস্ট্যান্ডে এলাম। টিকিটও কাটা হলো। ইতিমধ্যে মাধাইয়ের পেলো খিদে। সে আবার খিদে পেলে এক পা ও চলতে পারেনা। এদিক ওদিক দেখে, বাস স্ট্যান্ড থেকে দু পা এগিয়ে একটা পাঞ্জাবী রেস্তোরাঁয় ঢোকা গেল। দিব্যি সাজানো গোছানো অন্দরমহল। যথেষ্ট পরিস্কার পরিচ্ছন্নও বটে। ঢোকার সময় দেখলাম সামনেই ইয়াব্বড় তন্দুরের ভেতর থেকে শিকে গাঁথা কি সব বেরোচ্ছে। গন্ধে মালুম হলো এসব নিরামিষ বস্তুই বটে, তবে খুশবুটি সত্যিই খাশা। জিজ্ঞেস করলাম ও কিসের শিক? উত্তর এলো পনির টিক্কা, মাশুরুম, এটা, সেটা। আমরা ইচ্ছে করলুম পনির টিক্কা, কড়াই মাশরুম আর তন্দুরি নান। সঙ্গে এক থালা স্যালাড। আহা স্বাদে অতুলনীয়। একটা কথা হলফ কেটে বলতে পারি, এতদঞ্চলের রান্না খেলে, আপনি আমিষ খাচ্ছেন না নিরামিষ খাচ্ছেন এই বোধটুকুও চলে যায়। বড় ভালো খাওয়া দাওয়া হলো। রাত দশটা নাগাদ মৌরি চিবোতে চিবোতে বেরিয়ে এলাম খাওয়া দাওয়া সেরে। যদিও বাইরে তখন  নিদেন পক্ষে ৩৭-৩৮ ডিগ্রি, কিন্তু পেট ঠান্ডা তো সব ঠান্ডা।  গতবারের তুলনায় এবারের হরিদ্বার আসা এবং থাকাটা অনেক ভালোভাবে আর নির্ঝঞ্ঝাটে হচ্ছে। খেয়ে দেয়ে বাসের টিকিটের ফোটো কপি করানো হলো। সকলের কাছে যাতে এক একটা করে থাকে। তা ছাড়া দেখলাম ফোনে মেসেজও এসে গেছে বাসের সময় ও আসন সংখ্যা সমেত। বেশ একটা নিশ্চিন্তি নিশ্চিন্তি ভাব। তবে কাছাকাছি সমস্ত এটিএম হয় বন্ধ, নাহয় টাকা নেই, এই সমস্যায় কানহাইয়া সমেত আরো এক দুজন একটু কাতর হলো। আগামী কাল রাস্তায় কোথাও না কোথাও নিশ্চই এটিএম পাওয়া যাবে বলে তাদের কিঞ্চিত ভরসা দেওয়া গেল আপাতত।

গত বছর হোটেল, গাড়ি সব মিলিয়ে একটা হুলুস্থুলু কান্ড হয়েছিলো। এবারে তাই জওনভাইকেই বলা হয়েছে গাড়ির বন্দোবস্ত করে রাখতে। সে গাড়ি বলে রেখেছে ঠিক ভোর চারটেয় রওনা দিতে হবে, কারন ট্র্যাফিক জ্যাম। আমরা গতবারের ঘরপোড়া গরু। আমাদের দুবার বলতে হবে না হরিদ্বার ঋষিকেশের যানজট কি ভয়াবহ হতে পারে। আমি কানহাইয়া আর মাধাই তো জানিই। বাকিদেরও পইপই করে সাবধান করা হয়েছে যেন একদম দেরি না করে। হোটেলে ফিরে দেখি দাদা বৌদি গজব সমেত ফিরে এসেছে। দাদা-বৌদিরা দাদা-বৌদিতে খেয়ে এসেছে। কোন দাদা-বৌদি সেই প্রশ্নে গেলাম না। হরিদ্বারে অসংখ্য দাদা-বৌদির হোটেল। এবারে যেটা দেখে ভালো লাগছে তা হলো এরা সকলেই খুব ঝাড়া হাত পা আর পরিপাটি। কোন কিছুতেই মাত্রা ছাড়া সময় নেয়না। বাহুল্যহীন ভাবে থাকতে পারে অনায়াসে। যদিও গরম আন্দাজ করেই আমাদের এবারে হরিদ্বারের ঘরগুলো বাতানুকুল নেওয়া হয়েছিলো। রাত ১১টা নাগাদ সকলেই বিছানা নিলাম। কেননা তিনটের ভেতর উঠে পড়ে তৈরি হওয়া আছে। গুগল ম্যাপে দেখলাম হরিদ্বার থেকে হৃষিকেশের রাস্তা ঘোর লাল রঙের দেখাচ্ছে এই রাতেও। মানে ঘোরতর যানজট। যা কপালে আছে, তা হবে, ভাবতে ভাবতে ঘুমে তলিয়ে গেলাম। সকালে হাওড়ার বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, রাতে ঘুমোচ্ছি হরিদ্বারে। একটা লম্বা দিন শেষ হলো।

 আমার ফোনে অ্যালার্মের টোনটি ভারি মিঠে। প্রায় ঘুম পাড়ানি।  ভোর ভোর পিলে চমকানিয়া আওয়াজ শুনতে ভালো লাগেনা। কিন্তু তিনটের সময় ওই মিঠে মিঠে আওয়াজ কানে যেতেই ধড়মড় করে উঠে বসলাম। গতকাল এবং আজকের কম ঘুমের জন্যে চোখ জ্বালা করছে। কিন্তু উপায় নেই। হুড়মুড় করে তৈরি হলাম। ইয়ে টিয়ে, চান টান সেরে আধ ঘন্টায় বাথরুম ছেড়েদিলাম গজব কে। আমাদের বোতল গুলোয় জল ভরলাম, কারন রাস্তায় জল লাগবেই। অন্য ঘর গুলোয় টোকা দিয়ে সাড়া পেয়ে নিশ্চিন্তি হয়ে সামনের নিঝুম রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। গঙ্গার দিক থেকে ভারি সুন্দর হাওয়া আসছে। শরীর জুড়িয়ে গেল। এত সকালে কিচ্ছুটি খোলা নেই। আমাদের হোটেলটা একটু গলিঘুঁজির ভেতর। বড় রাস্তায় হয়ত খান কতক চায়ের দোকান খোলা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমার খুব একটা সকাল বেলা চায়ের অভ্যেস নেই।

কানহাইয়ালালের ফোনে গাড়িওয়ালে ভাই সাহাবের ফোন এসে গেল। উনি স্টেশনের কাছে আছেন। আমাদের চৌমাথায় আসতে বললেন।  আমরা সেখানেই ছিলাম। ক মিনিটেই গাড়ি এসে গেল। টাটা সুমো। আমাদের ব্যাগ গুলো তুলে দেওয়া হলো গাড়ির মাথায়। আমরা সেঁধোলাম ভেতরে। যাত্রা শুরু হলো, ঘড়ি দেখলাম, কাঁটায় কাঁটায় চারটে বেজে সাত মিনিট। প্রথমে ভাই সাহাব চেষ্টা করলেন বুঝতে যানজটের হকিকত। শুরু থেকেই দুস্তর গাড়িঘোড়া আর ভোরের রাস্তায় পোড়া ডিজেলের গন্ধ। প্রায় আধ ঘন্টা সে যন্ত্রনা ভোগ করার পর ভাই সাহাব বুঝে শুনে গলি টলি পেরিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে গঙ্গা টপকে সোজা রাজাজী ন্যাশনাল পার্কের রাস্তা ধরলেন সেই গত বারের মত, আর আমরাও হরিদ্বার ছেড়ে রওনা দিলাম যোশীমঠের দিকে।

সূয্যী পাটে যোশীমঠে
সতোপন্ত-স্বর্গারোহিনী গ্লেসিয়ারের ওপরে মানুষের পদার্পন নতুন নয়। আজকাল আমাদের মত কিছু সখের ট্রেকার যাচ্ছেন সেটা অন্য কথা। কিন্তু বহু যুগ আগে থেকেই এ অঞ্চলে মানুষের যাতায়াত রয়েছে। প্রমান হিসেবে বলি, এই সতোপন্ত-স্বর্গারোহিনীর রাস্তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরন রয়েছে মহাভারতে। এই রাস্তাই পান্ডবদের মহাপ্রস্থানের রাস্তা। মহাভারতকে যদি কল্পকাহিনী হিসেবেই ধরি, তাহলেও স্থান এবং মার্গের এত নিখুঁত বিবরন কখনোই দেওয়া সম্ভব নয়, যদি না সে অঞ্চলে লেখক বা লেখকের পরিচিত কারোর যাতায়াত থাকে। বিভূতিভূষন আফ্রিকা না গিয়েই চাঁদের পাহাড় লিখেছেন। এবং তাঁর দেওয়া বর্ণনা প্রত্যক্ষদর্শণকেও হার মানায়। তবু ভেবে দেখুন, বইয়ের শেষে বিভুতিবাবু কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বইয়ের তালিকা দিয়েছেন, যে বইগুলো থেকে উনি আফ্রিকার বর্ণনা পেয়েছেন। অতএব মহাভারতকার বা মন্ডলী যদি এ অঞ্চলে নাও এসে থাকেন, তবুও তাঁরা নিশ্চিত ভাবেই এ বর্ণনা  প্রত্যক্ষদর্শীর থেকে সংগ্রহ করেছেন। পৌরাণিক কাহিনি বলছে, মহাপ্রস্থানের পথে পান্ডবরা বদ্রীনাথ পেরিয়ে সরস্বতী ও অলকানন্দার সঙ্গমস্থলে পৌঁছন এবং এখানেই দ্রৌপদির পতন হয়। এই সরস্বতী কিন্তু এলাহাবাদের, থুড়ি প্রয়াগরাজের সরস্বতী নন। ইনি উচ্ছল পাহাড়ি কিশোরী। সরস্বতী ও অলকানন্দার সঙ্গম এখনো আছে, এবং এই সঙ্গমের ঠিক ওপরেই ভারতের শেষ জনপদ মানা গ্রাম। সেখান থেকে উত্তরে কিছুদুর গেলেই তিব্বত, তথা চীন সীমান্ত। সেখানে চীনা সীমান্তরক্ষীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় ইন্ডো-টিবেটান বর্ডার পুলিস বা আই টি বি পি। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সীমান্ত পাহারা দেয় বর্ডার সিকিওরিটি ফোর্স বা বি এস এফ। লাদাখ থেকে হিমাচল পেরিয়ে উত্তরাখন্ডের ভারত-চীন সীমান্ত রক্ষার ভার আইটিবিপি র ওপর। ভারত নেপাল সীমান্ত যদিও মোটের ওপর অরক্ষিত, তাও সেখানে সীমানা রক্ষার ভার সশস্ত্র সীমা বল বা এসএসবি র ওপর। সিকিম থেকে অরুনাচলের ভারত চীন সীমান্তে যদিও ভারতীয় সেনারা গুরুত্বপূর্ণ অনেক জায়গায় মোতায়েন রয়েছেন, তবুও মোটের ওপর সীমান্ত রক্ষা করেন আসাম রাইফেলসের জওয়ানরা। আইটিবিপি, বিএসএফ, এসএসবি এবং আসাম রাইফেলস , ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশ নয়। তারা আধা সামরিক বাহিনী এবং স্বরাস্ট্র মন্ত্রকের অধীন, যেমন সি আর পি এফ, সি আই এস এফ। যেহেতু সীমান্তের অত্যন্ত কাছে আমাদের অভিযান, তাই আগে থেকে ছবি ও পরিচয়পত্র সমেত পারমিট করাতে হয়েছে। সে ব্যাপারে যা কিছু করার সবই করেছেন শ্রীযুক্ত জওন সিং রাওয়াত।


যাঁরা বদ্রীনাথ গেছেন, এবং সেখান থেকে আরো তিন কিলোমিটার পার হয়ে মানা অবধি গেছেন, তাঁরা নিশ্চই জানবেন। এখনো মানাতে ব্যাসদেবের গুহা(!) এমনকি শ্রীগনেশের গুহাও বিদ্যমান। ব্যাসদেব মহাভারতের কাহিনী বলে গিয়েছিলেন, এবং গনেশ সেইটি লিপীবদ্ধ করেন শুনেশুনে। দুই গুহার মধ্যে বেশ কিছুটা দুরত্ব। ভাবছিলাম ব্যাসদেবের কথা গনেশ শুনলেন কি করে! তার পর মনে পড়ল গনেশ বাবাজীর শ্রবন শক্তি আমার মত “আর্ডিনারি নেহি, এস্কট্রা আর্ডিনারি আছে মিস্টার মিত্তর”। অমন বড় বড় হাতির কান কি এমনিই ফিট করা হয়েছে? তার ওপরে হাতিরা আবার শব্দেত্তর ও শব্দোত্তর দু রকমই শুনতে পায়, আর গনেশের তো দৈবশক্তি রয়েইছে, কাজেই সন্দেহের স্থান যদি কিছু থেকেই থাকে, সে সব নিপাতনে সিদ্ধ। সতোপন্তের রাস্তায় দ্রৌপদির পর আপনি পাবেন একে একে সহদেব, নকুল, ভীম ও অর্জুনের পতনের স্থান। তার নামগুলো ভারি কাব্যিক। সাধে কি আর মহাভারতকে বিশ্বের সেরা মহাকাব্য বলি আমি? ও কাব্যের তুলনা আর দ্বিতীয়টি নেই। স্থানের নাম ও মাহাত্ত্য যথা সময়ে বলব, এখন সেসব বলে পাঠকের বিরক্তি বাড়াচ্ছিনা। কারন রাজাজী ন্যাশনাল পার্ক শেষ হয়ে আমরা উঠে এসেছি হাইওয়েতে। আর চার ধাম কানেক্টিং হাইওয়ে প্রোজেক্টের জন্যে এই কাক ভোরেও সে রাস্তায় ধুলোয় ধুলো। কাজেই আমরা সবাই চোখ নাক ঢেকে ফেললাম। আগেরবারের ধুলোর অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম এরকম কিছু হতেই পারে। তাই এবার সবাই নাক মুখ ঢাকার ব্যবস্থা করেই এসেছি। 

যোশীমঠের পথে – ধুলো থেকে বাঁচতে মুখ ঢাকা (ছবিঃ গজব)

এবারেও সেই লোহার সিঁড়িওলা গতবারের ঢাবা। আবার সেই আলুর পরোটা। শুধু এবার আমরা দোতলায় না বসে একতলাতেই খাওয়া দাওয়া সারলাম। আধঘন্টাটাক বিরতির পর গাড়ি চলল। আধ ঘন্টা পর দেবপ্রয়াগ এলো। যতবার এই জায়গাটা পেরোই, মুগ্ধতার রেশ লেগে থাকে মনে ভাগীরথী ও অলকানন্দা মিশেছে এখানে। ভাগীরথীর পান্না সবুজ জল মিশে যাচ্ছে অলকানন্দার গেরুয়া-সবজেটে জলের সঙ্গে। একটুক্ষন বৈশিষ্ট বজায় রেখে চলার চেষ্টা, তার পর মিলে মিশে এক হয়ে যাচ্ছে দুজন।  সামনে শ্রীনগর। সেখানে এটিএম খোঁজা হবে। শ্রীনগর আসার কিলোমিটার দশেক আগে থেকে মনে হলো রাস্তার হাল গতবারের থেকে একটু ভালো। হয়ত এদিকে রাস্তা প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, ৫০০ – ৭০০ মিটার চমৎকার রাস্তা, তার পরের ৫০০-৭০০ মিটার আবার ভাঙাচোরা ধুলো মাটি। ঠিক বুঝলাম না এরকম রসিকতার অর্থ কি। যাই হোক, শ্রীনগর এসে যেতেই এটিএমের খোঁজে সকলে বাইরে চোখ রাখলো। রাস্তাঘাটে বেশ ভিড়, তার ওপরে আবার রাস্তা সরু। কয়েকটা এটিএম পাওয়া গেল বটে, কিন্তু সেখানে গাড়ি থামিয়ে টাকা তুলতে গেলে পেছনে লম্বা যানজটের সমূহ সম্ভাবনা, আর উত্তরাখন্ড পুলিশও এ ব্যাপারে ভারি সজাগ। কাজেই এগোতে লাগলাম আমরা। আস্তে আস্তে শহর ছাড়িয়ে এলাম প্রায় জনবসতি কমে এলো। আমরা প্রানপনে খুঁজে চলেছি যদি কোথাও এটিএম থাকে। অবশেষে ধুত্তেরি বলে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়া গেল, সামনের দোকান থেকে ঠান্ডা জল আর পানীয় কেনা হলো ক বোতল। ও মা, দোকানের পাশেই আড়ালে ছোট্ট এটিএম। পাহাড়ি এটিএমে টাকা না থাকাটাই দস্তুর। কিন্তু ইনি পেট খালি করে ফেলেননি দেখা গেল। যে যার প্রয়োজনমত টাকা পয়সা তুলে ট্যাঁকে গুঁজে আবার যাত্রা শুরু হলো।

এবারের যাত্রা বেশ ঘটনাবিহীন। রূদ্রপ্রয়াগের পর যদিও সামান্য একটু যানজটে পড়তে হয়েছিলো রাস্তা সারানো হচ্ছে বলে, কিন্তু কর্ণপ্রয়াগ দুপুর দুপুর পৌঁছে গেলাম। যদিও ভাই সাহাব, কর্ণপ্রয়াগের কিছু আগে এক “শুদ্ধ শাকাহারী ভোজনালয়” এর সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই সকলে হাঁ হাঁ করে উঠলো। কানহাইয়া, মাধাই আর আমি তো অভিজ্ঞতায় পুষ্ট, কিন্তু বাকি তিনজন মনযোগ সহকারে হয় “বাগিনীর পিঠে” পাঠ করে এসেছে, নাহয় গপ্প গাছা শুনেছে। কাজেই কর্ণপ্রয়াগের রাওয়াত হোটেলের বিখ্যাত মাটন কারি ছেড়ে কেউই শাকাহারী ভোজনে রাজী নয়। আরো কিছুক্ষন পরে কর্ণপ্রয়াগের ব্রিজ টপকেই সামনে রাওয়াত হোটেল পাওয়া গেল। দেখলাম পাশের “ভেজ” রেস্তোরাঁটি উধাও। কারন সম্পর্কে আমার মনে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এমন পাঁঠা ফেলে কে আর পাঁঠার খাদ্য খায়? বসেই চোখ বন্ধ করে ইচ্ছে করলাম “মাটন কারি অওর চাওল।  সেই একই ভাবে বিশাল বাটি ভর্তি খেমো খেমো ছ টুকরো মাংস আর অসাধারন ঝোল এলো, সঙ্গে বাসমতি চালের ভাত। লেবু, লঙ্কা, পেঁয়াজ সমেত। কারোর মুখে কথা নেই। ভাতের থালা কোথা দিয়ে সাবাড় করে ফেললাম ঠিক বুঝতেও পারলাম না। আজ আবার রবিবার। গুরুভোজনের পর, নেহাত স্যুভেনির হিসেবেই বৌদি দোকান থেকে এক বাক্স লাড্ডু কিনল। আজ্ঞে হ্যাঁ এখানে মিঠাইও পাওয়া যায়।

কর্ণপ্রয়াগ থেকে চড়াই শুরু। যদিও রাস্তা অত্যন্ত ভালো। আমাদেরও খাওয়া দাওয়ার পর একটু ঘন ঘন লাগছে। কিন্তু ঝকঝকে চারপাশ আর পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে ঘুম উধাও হলো। ওপরে যত উঠছি তত গরম কমে আসছে। এখন তো বেশ আরাম লাগছে। ভাই সাহাব জানালেন বাকি সব ঠিক হ্যায়, কিন্তু যোশীমঠের আগে আগর জ্যাম লাগ গেয়া তো বহোত মুশকিল। আমি আর টুঁ শব্দটি করলাম না। এ রাস্তায় আমার অনন্য রেকর্ড আছে, এলেই অন্ততঃ দু বার গাড়ির টায়ার পাংচার হয়। বলা যায় না, যদি নামিয়ে দেয়? পেরোলাম পিপলকোটি। গোটা অঞ্চলটাই কেমন বদলে গিয়ে ঘিঞ্জি জনবসতি হয়ে গেছে গত তেরো চোদ্দ বছরে। এবার পাক খেয়ে খেয়ে ওপরে ওঠা। মাঝে এক জায়গায় চায়ের বিরতি দেওয়া হয়েছিলো শুধু। যোশীমঠ আসার পনের কিলোমিটার আগে থেকেই সতর্ক হয়ে বসে রইলাম। কোথাও যানজট দেখতে পেলেই বলব। কিন্তু আস্তে আস্তে এক এক করে কিলোমিটার গুলো পেরিয়ে একটা সময় দেখি আমরা যোশীমঠের সেই চেনা চত্তরে এসে হাজির হয়েছি। ঝট পট গাড়ি থেকে নামলাম। ঘড়িতে এখন সোয়া ছটা। একদম নির্ঝঞ্ঝাটে এই ভাবে যোশীমঠ পৌঁছবো ভাবিনি। আমার রেকর্ড ভেঙ্গে গেল, একবারও গাড়ির চাকা ফাঁসলো না। রেকর্ড ভাঙায় দুঃখিত না আনন্দিত, ঠিক কি হলাম সেটাই বুঝলাম না। মাধাইকে বললুম আয় দুজনে একটা সেলফি তুলি। রেকর্ড ভাঙ্গাটার স্মরণিকা থাকুক। ব্যাগ পত্তর ঝটপট নামিয়ে ফেলা গেল। শরীর খুব যে পরিশ্রান্ত তা নয়। তবে একটু হাত পা ছাড়ানোর দরকার। গাড়ি একদম হোটেলের দোর গোড়ায় নামিয়েছে। হোটেলের রিসেপশনের দিকে পা বাড়ালাম।

আগের বার আমরা ছিলাম রাস্তার উলটো দিকে। এবারে হোটেল একদম রাস্তার ওপরেই। রিসেপশনে আমাদের নাম ধাম লিখে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চাবি দিয়ে দিলো। আমরা ঘরে গিয়ে আগে বিছানায় দশ মিনিট পড়ে থেকে কোমর ছাড়ালাম। তার পর হাত পা মুখে জল দিয়ে, সারা দিনের ধুলো ধুয়ে ফেলে বেরোলাম বাইরে। অনেকটা পশ্চিম বলে সন্ধ্যে সাতটাতেও দিব্যি দিনের আলো। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। বদ্রীনাথের আর হেমকুন্ট সাহেবের তীর্থযাত্রীর ঠাসাঠাসি ভিড় বদ্রীনাথে। এদিক ওদিক পায়চারি করতে করতে দেখি বাকিরাও গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে এলো। সকলেই জামা কাপড় বদলে হাত মুখ ধুয়ে নিয়েছে। এখন অনেকটা তাজা লাগছে তাই। আমরা রাস্তায় বেড়াতে বেরোলাম। সামনে শ চারেক মিটার গেলেই “দ্রোন অ্যাডভেঞ্চার”। নরিন্দর সিং রাওয়াত ও জওন সিং রাওয়াতের সংস্থার ছোট্ট অফিস, দোতলার ওপরে। অফিসটি বেশ স্বতন্ত্র। একতলায় মোটর গ্যারাজ। সামনে বিস্তর কালিঝুলি মাখা যন্ত্রপাতি, গাড়ি, ইঞ্জিন ছড়িয়ে আছে। সেগুলো টপকে টপকে (লাফিয়ে লাফিয়ে) পৌঁছনো যায় সিঁড়ির সামনে। সিঁড়িটি সত্যিই রোমাঞ্চকর। এক একটি ধাপের উচ্চতা মোটামুটি সাধারন সিঁড়ির ধাপের চার থেকে পাঁচ গুন। মানে চারটি ধাপ এক সঙ্গে পেরোতে গেলে আপনাকে যতটা ঠ্যাং এর কসরত করতে হয়, এখানে একটি ধাপেই তা করতে হবে। তার ওপরে স্থানাভাবে তারা প্রস্থের দিকে নিতান্তই সংকুচিত। সর্বোপরি সিঁড়ির এক একটি ধাপের উচ্চতা এক এক রকম এবং তারা জল ও তেলের মাখামাখিতে কিঞ্চিত পিচ্ছিল। মনে হয় জওন ভাই প্রথমেই পাহাড় চড়িয়েদের পরীক্ষা নেয় এই সিঁড়ির মাধ্যমে। এই রকম সিঁড়ি কেউ উঠতে নামতে পারলে, পাহাড়ে আরাম সে চড়তে পারবে পাথর টপকে।

জওন ভাই চা আনালো। বাইরে সন্ধ্যের হালকা গা শিরশিরে ভাব। দাদা বৌদি আর গজবের সঙ্গে জওন ভাইয়ের আলাপ পরিচয় হলো। আগামী কালের পরিকল্পনাও পুরো করে নেওয়া হলো। কাঁটায় কাঁটায় ভোর ছটায় আমরা রওনা হবো যোশীমঠ থেকে। আমাদের গন্তব্য ৫০ কিলোমিটার দুরের মানা গ্রাম। চা খেয়ে আমরা বিদায় নিলাম। গত দুদিনের ভোর বেলা ওঠা ও সারা দিনের যাত্রার ধকল আজ রাতে ঝেড়ে ফেলতেই হবে ভালো করে ঘুমিয়ে। কারন কাল হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আছে। বাকিরা খাওয়া দাওয়া করবে। দুপুরের গুরুভোজনের পর আমার মহাপ্রাণী যাহারপরনাই শান্ত । আমি আর চাপ নিলাম না। সোজা হোটেলের ঘরে ঢুকে খাটের ওপর লম্বা হলাম চাদর মুড়ি দিয়ে। কখন ঘুমিয়েছি মনেও নেই।

নেই মানা, যাই মানা
ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙ্গল। শরীর একদম ঝরঝরে। ঝটপট বাথরুম সেরে নিলাম। ভাল করে চান করে নিয়েছি। কারন এর পরে আবার কবে চান করতে পারবো তা জানিনা। বোতলে জল ভরে, পিঠে ব্যাগ এঁটে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। আজ পোষাক আশাকে বদল ঘটেছে। আজ আমার পরনে একটু মোটা কাপড়ের পুরো হাতা টি শার্ট, আর পাহাড়ে হাঁটার জন্যে উপযুক্ত প্যান্ট, যা কিনা জলে ভেজেনা, খোঁচা খেলে সহজে ছেঁড়েও না। পায়ে পাহাড়ে হাঁটার উপযোগী জুতো। আমার কোমরে একটা গেঁজে গোছের ছোট পাউজ ব্যাগ বাঁধা থাকে। সেটাও আছে। তাতে জরুরি ওষুধ, দাঁত মাজা বুরুশ, সাবান, ছুরি এসব অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস থাকে। পৌনে ছটায় রাস্তায় বেরিয়ে এসে দেখি, শহর ইতিমধ্যেই জেগে উঠেছে। বদ্রীনাথ এবং হেমকুন্ট সাহেবের তীর্থযাত্রীরা দলে দলে গাড়িতে উঠছেন এবং রওনা দিচ্ছেন। এখান থেকে বদ্রীনাথ ৪৬-৪৭ কিলোমিটার মত। গাড়িতে যেতে ঘন্টা দুই বড়জোর। মাঝে গোবিন্দঘাটে চা পানের বিরতী। আগে এই রাস্তায় যেমন খুশী যাতায়াতে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের মানা ছিলো। কারন এতটাই সরু ছিলো, যে একটি মাত্র গাড়ি যাতায়াত করতে পারত। যার ফলে এক মুখি গাড়ি চলত দু ঘন্টা। আবার পরের দু ঘন্টায় উলটো দিকের গাড়ি চলত। এখন রাস্তা চওড়া হয়ে যাবার পরে আর সে মানা নেই।


ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ৬ টার সময় আমরা একটা টাটা সুমোয় করে রওনা দিলাম। গাড়িতে আমরা ছ জন আর চালক। আমাদের গন্তব্য মানা গ্রাম। জওন ভাই আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে সেখানে। আমাদের সঙ্গে যে চারজন মালবাহক যাবে, তারাও ওখানেই যোগ দেবে। মালপত্র সমেত তারা আর একটা গাড়ি করে এগিয়ে গেছে। যোশীমঠ থেকে প্রথমে কিছুটা উৎরাই বেয়ে অলকানন্দার কাছে চলে এলাম আমরা। এবারে নদীর ওপর ব্রিজ পেরিয়ে ওপাড়ে গিয়ে নদীর ধার বরাবর রাস্তায় এগোনো গেল। শেষ যেবার এ রাস্তায় এসেছি সেবারে রাস্তার হাল খারাপ ছিলো বললে ভুল বলা হয়। বরং ভয়াবহ বলাই যুক্তিযুক্ত। এবারেও তেমন একটা পিলে চমকানিয়া রাস্তার জন্যে তৈরি হয়ে বসলাম। যদিও গাড়িওয়ালে ভাইসাহাব আস্বস্ত করলেন যে এখন রাস্তা নাকি অনেক ভালো হয়ে গেছে। ঠিক মন থেকে বিশ্বাস হলো না। সেই পশ্চিম সিকিমের সাড়ে চার কিলোমিটারের মত। যাঁরা “তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা” পড়েছেন, তাঁরা জানবেন।  রাস্তার হাল এখনো সন্তোষজনক তো বটেই। বরং বলতে পারি দেবপ্রয়াগের আশেপাশে থেকে রুদ্রপ্রয়াগ অবধি রাস্তার যা হাল, তার চেয়ে শতগুনে ভালো। আপাতত আমরা গোবিন্দঘাট পৌঁছে চা জলখাবার খাবো।  

যোশীমঠ থেকে গোবিন্দঘাটের দিকে। রাস্তায় যে দিকে পাথর ঝুলে আছে, তার উল্টোদিকে কিন্তু খাদ।

রাস্তায় দু পাশের দৃশ্য বড় মনোরম। তবে এ রাস্তায় কিছু না কিছু লোকবসতি আছে। গেল বারে ধৌলিগঙ্গার ধার ধরে যাবার সময় একেবারে জনশূন্য হাইওয়ে ধরে গিয়েছিলাম। এ দিকের রাস্তায় দস্তুরমত গাড়ির ভিড়। তীর্থের ভরা মরশুম। দলে দলে পূন্যার্থী চলেছেন দেবদর্শনে পূন্য অর্জন করতে। আমার নিজের পাপ-পূণ্যের বিচার বড় কম। ব্যাপারটা বেশ জটিলও বটে। এমনিতেই আমার বুদ্ধিশুদ্ধির ওপর নিজের ভরসা কম, তার ওপরে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলে অন্য জরুরি ব্যাপারে বুদ্ধি কম পড়ে যেতে পারে। এ যাত্রা আমরা বদ্রীনাথে থামছিওনা। তবে থামার কথা মনে হতেই দেখলাম মহাপ্রাণী কুঁইকুঁই করছেন। সেই গতকার দুপুরে ভাত খেয়েছি। তার পরে আর পেটে চা ছাড়া তেমন কিছু পড়েনি। দেখলাম রাস্তার ধারে বেশকিছু কাজ হচ্ছে। বেশীরভাগই জলবিদ্যুত প্রকল্পের কাজ। গতকাল রাতের ভালো ঘুম ও বিশ্রামের পর আজকে আমাদের দলের সবাই বেশ চনমনে। দাদা বৌদি খুব উপভোগ করছে। ছোট ছোট গল্প চলছে। দাদা মিতভাষী, বৌদি দাদার হয়ে কোটা পুরন করে দেন, কিন্তু তাই বলে তিনি যাকে বলে বখতীয়ার খিলজি তেমন মোটেই নন। ধিরে সুস্থে কথা বলেন। সামনের আসনে বসেছে গজব। তার হাতে একখানি সেলফি স্টিক সমেত মোবাইল। মোটামুটি ৬০-৭০ সেকেন্ডের বিরতিতে হরিদ্বারের পর থেকে গজব আমাদের গোটা যাত্রার ছবি তুলে গেছে, এমনকি পাহাড়ে চড়ার সময়েও। কানহাইয়ালাল আর মাধাই চুপ চাপ। দু পাশের দৃশ্য দেখছে। যোশীমঠ ছাড়াবার কমবেশী ঘন্টাখানেক পর রাস্তার ধারের ফলক জানান দিলো গোবিন্দঘাট আর কিলোমিটারটাক দূরে। তখনই হুড়মুড় করে সকলের খেয়াল পড়ল প্রকৃতি অনেক্ষন থেকেই হাতছানি দিচ্ছে। একবার না নামলেই নয়। ভাই সাহাব কে বলা হলো, এমন জায়গায় গাড়ি দাঁড় করান, যেখানে একদম সামনেই ছোট ইয়ে টিয়ে করা যাবে।

কজনের ইয়েতে একটু সময় লাগাতে আমি আর কানহাইয়া সামনের দোকানে ঢুকে গরম গরম পকোড়া আর চা ইচ্ছে করলাম। কড়া লিকারের মালাইদার আদা দেওয়া চা। এমন আবহাওয়া ও পরিবেশে মানানসই। আর সঙ্গে পকোড়া নিয়ে কি আর বলব? ধরেনিন ভীমসেন কালোয়াতের সঙ্গে জাকির তবলচির যুগলবন্দী। আমাদের চা পকোড়া শেষ হতে হতেই বাকিদের আগমন ঘটল। তারাও আমাদের রাস্তায় হাঁটলো। আমি আর কানহাইয়া যুগলবন্দীতে মুগ্ধ হয়ে তালি বাজিয়ে বলেছি “এনকোর এনকোর…”। দ্বিতীয় রাউন্ড চা পকোড়া এসে গেল আমাদেরও। ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে সাতটার দিকে কাঁটা এগোচ্ছে। সবাইকে তাড়া দেওয়া হলো। কারন আমাদের ঠিক সকাল ৯টায় মানা পৌঁছবার কথা। মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই গাড়িতে উঠে বসা গেল। আমার স্মৃতিতে এই গোবিন্দঘাটের পরের রাস্তাই সবচেয়ে কঠিন আর খাড়াই ছিলো। আমাদের ডান দিকে, অর্থাৎ পূব দিকে দেখি ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স আর হেমকুন্ট সাহেব যাবার রাস্তা চলে গেছে। আর সামনে উত্তরে সামনে বদ্রীনাথের রাস্তা। হয়ত এ ধরাধামে অন্য কোনো দেশে এখানের দৃশ্য অন্য রকম হতো। এ পর্যন্ত হিন্দু ও শিখ পূণ্যার্থীরা এক সঙ্গেই আসছিলেন আর এই গোবিন্দঘাটে এসে শিখ ও হিন্দু পূণ্যস্থানের রাস্তা ভাগ হয়ে যাচ্ছে, কাজেই এখানে হেমকুন্ট সাহেবের দিকে শুধু শিখ আর বদ্রীর দিকে শুধু হিন্দুদের যাবার কথা। কিন্তু এখানেই ভারতবর্ষ আলাদা। আমার ভেতরে সেই অহংবোধ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে, যে পাঁচ হাজার বছর ধরে দুনিয়াকে শিখিয়ে এসেছে, পরমতসহিষ্ণুতা কি করে দেখাতে হয়। শুধু তাই নয়, কি করে মিলে মিশে যেতে হয় দুই নদীর মত, বৃষ্টির ফোঁটার মত। গোবিন্দঘাটের পর বদ্রীর রাস্তায় দেখবেন বিস্তর পাগড়ি ও শ্মশ্রুগুম্ফে সজ্জিত একগাল হাসি মুখে আঁটা শিখ চলেছেন বদ্রী দর্শনে আর অন্যদিকে হেমকুন্ট সাহেবের রাস্তায় কপালে লাল তিলক কাটা গলায় গেরুয়া নামাবলি গোছের কিছু একটা পেঁচিয়ে বিস্তর হিন্দু চলেছেন গুরুদ্বারে। এবং বদ্রী ও হেমকুন্টের লোকজন কে ভাল করে লক্ষ্য করলে আমি নিশ্চিত আপনি অপরাপর ধর্মবিশ্বাসের অসংখ্য মানুষকে দেখতে পাবেন। কখনো দেখিনি এসব জায়গায় কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করছেন তার ধর্ম কি, তার বিশ্বাস কি এসব নিয়ে কারোর মাথা ব্যাথা নেই।  পূণ্য অর্জনের কোন জাত ধর্ম হয়না। হয়ত পূন্যস্থানের এই অনুভুতিটাই সবচেয়ে পূণ্যের।

এক কালে বলে বলে খান তিরিশের লুচি কচুরি লাবিয়ে দিতুম মশায়। সঙ্গে সমপরিমান তরকারি, মিষ্টি। কিন্তু এখন সেসব করতে গেলে মাঝ রাতে পেটে ভিজে গামছা জড়িয়ে হাঁসফাঁস, হজমের ওষুধ, পরের দিন নিরম্বু উপবাস ইত্যাদি নানাবিধ কর্মফলের সমূহ সম্ভাবনা। সেরকমই, আমার মত ধর্মহীন নাস্তিকের মুখে আপনি পাঠক চার লাইনের বেশি ধর্মকথা বা ধর্মস্থানমাহাত্ম্য শুনলে আপনারও কিছু বিপজ্জনক কর্মফলের আশঙ্কা থেকে যায়। তাই এ যাত্রা আর বেশী কিছু বলছিনা। বলছিনা কারন এসব ভাবতে ভাবতে গাড়ি হনুমান চটি পেরিয়ে গেল। আর শুরু হলো প্রানান্তকর চড়াই ভাঙ্গা। গাড়ির ইঞ্জিন প্রায় আর্তনাদ করছে। সামনের গাড়িগুলোকেও দেখছি অতি ধিরে ধিরে চলছে। পাহাড়ের গায়ে অতি কষ্টে খাঁজ খেটে তৈরি করা রাস্তা। আগে শুধু খাঁজটুকুই ছিলো, কিন্তু এবার দেখি ময়দানবের স্পর্শে ঝকঝকে অ্যাসফল্টের সুন্দর রাস্তা। এখানে ময়দানব মানেই BRO (বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন)। সীমান্তের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী এই রাস্তা ভারতীয় সেনার কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমশঃ ওপরে উঠছি আমরা আর হাওয়া পাতলা হচ্ছে সেটা বুঝতেও পারছি। এখানে রাস্তার ধার বেয়ে একদম খাড়াই খাদ নেমে গেছে বহু নিচে। তাকালে মনে অনেক রকম চিন্তার উদয় হয়। আর রাস্তা প্রতি মুহুর্তে বাঁক নিচ্ছে। ভাই সাহাব দেখলাম পুরো মনোযোগ রাস্তার ওপরেই দিয়েছেন। হনুমান চটি ছাড়িয়ে এক কিলোমিটার আসার পর থেকেই রাস্তার ধারে ধারে দেখছিলাম বরফ জমে আছে যদিও রাস্তা একেবারেই পরিস্কার। 

বদ্রীনাথের পথে

এক জায়গায় দেখি রাস্তার ধারে কিছু লোকজন একখানা অতিকায় বরফের চাঙ্গড়ের তলায় ঢুকে ফোটোশেশন করছেন। বরফের চাঙ্গড়টা মোটামুটি খান তিনেক বাড়ির সমান। আর জায়গায় জায়গায় অত্যন্ত পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে এসেছে। এবারে একদিন ফেটে ভেঙ্গে রাস্তা টপকে নিচে চলে যাবে। এ হলো প্রকৃতিক নিজস্ব চক্র। আমার মনে হলো এই ভাবে ওই ফাটলের ভেতর ঢুকে ছবি তুলতে যাওয়াটা খুবই বিপজ্জনক কাজ। কিন্তু কিছু বলব বলব ভাবতে ভাবতেই জায়গাটা পেরিয়ে এলাম আমরা। আরো মিনিট কুড়ি পর আমরা চড়াইয়ের শেষ বাঁকটা ঘুরে উঠে এলাম ওপরে। সামনেই দেখি বিশাল তোরণ বদ্রীনাথে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। বদ্রীনাথে থিক থিকে ভিড়। মানুষজনের হাঁকডাক আর যানবাহনের গর্জনে তুমুল হট্টগোল। যেতে যেতে দেখতে পেলাম দূরে মন্দিরের চুড়া। ওদিকে যাবার সময় বা ইচ্ছে কোনটাই এই মুহুর্তে আমাদের নেই।  দেখলাম প্রকান্ড সব ঝাঁ চকচকে হোটেল হয়েছে এই কবছরে। মনে হলো আধুনিক আরামের, সুযোগ সুবিধের কিছুমাত্র অভাব আর বদ্রীনাথে অবশিষ্ট নেই। বদ্রী পেরোবার পর আর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার গেলেই মানা। মানার রাস্তায় পড়তেই ভিড় গেল হালকা হয়ে। তীর্থযাত্রীরা সকালে বদ্রী দর্শন সেরে  একটু বেলার দিকে মানায় বেড়াতে আসেন। কাজেই এই সকাল বেলা মানা একদম খালি। বদ্রী থেকে মানার রাস্তা উপত্যকার মধ্যে দিয়ে। এ জায়গাটা সমতল বলাই যায়। কেবল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৩০০ মিটারের কিছু বেশী। ফুটে মাপলে ১১ হাজার ফুট মত। মানা গ্রামের ঠিক আগে দেখি একটা বিশাল তোরণে লেখা হয়েছে “ভারতের অন্তিম গ্রাম”। আমাদের গাড়ি সেটা পেরিয়ে কিছুটা গিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়ালো। আমরাও গাড়ি থেকে নেমে একটু হাত পা ছড়ালাম। জায়গাটি অতীব সুন্দর। চারদিকে উঁচু উঁচু বরফে ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ। মাঝের এই সরু ফালি উপত্যকায় ছবির মত এই ছোট্ট গ্রামের মানুষজন কিছু চাষবাস করেছেন। গাড়ি যেখানে দাঁড়ালো, তার থেকে আরো ৪০০ মিটার মত সামনে গেলে আসল গ্রাম শুরু। কিন্তু এইখানেই জওন ভাই আমাদের জন্যে দাঁড়িয়ে। গাড়ি থেকে নামতেই বলল দশ মিনিট দাঁড়াতে হবে, লাঞ্চ প্যাক হচ্ছে। তার পর যাত্রা শুরু।



আমাদের গাড়ির সামনেই আর একটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিলো লক্ষ্য করিনি। এখন দেখি তাতে চারজন বসে আছে। মুখের ধাঁচ স্থানীয় গাঢ়োয়ালিদের সঙ্গে খুব একটা মেলে না। জওন ভাই সামনের বাড়িটা থেকে একটা বড় প্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে এসে ওই গাড়িটায় বসল আর আমরাও আমাদের গাড়িতে উঠলাম। এবারে গাড়ি একটু সামনে গিয়েই বাঁধানো রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকে একটা মেটে রাস্তা ধরে নেমে এলো অলকানন্দার একেবারে পাশে। সামনেই একটা কেমন নড়বড়ে গোছের সেতু। সেটা পেরিয়ে সামনের গাড়িটা একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। আমাদের গাড়িও পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মালপত্র নামিয়ে আমরা পিঠে ব্যাগ আঁটলাম। জওন ভাই বলল এই রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাও। পায়ে চলা মেঠো পথ। তার সামনেই আইটিবিপির বড় একটা ক্যাম্প। ক্যাম্পে দেখলাম আইটিবিপির গাঢ় খাকি রঙের দু খানা ট্রাক যেমন দাঁড়িয়ে, তেমনই সেনাবাহিনির গাঢ় সবুজ রঙের একখানা ট্রাক ও রয়েছে। অন্য গাড়ির চারজন আমাদের মালপত্র বহন করবেন। এ রাস্তায় ঘোড়া বা খচ্চরের পিঠে মাল নিয়ে যাওয়া যায়না, কারন রাস্তা অত্যন্ত খারাপ। এখানে মানুষই একমাত্র উপায়। বৌদির স্পন্ডেলিসিসের সমস্যা আছে। তাই অত ভারি ব্যাগ সে পিঠে নিয়ে যেতে পারবেনা। এটা সে বহুদিন আগেই বলে দিয়েছিলো। আর আমরাও জওন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করেছিলাম যে বৌদির ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাবেন একজন মালবাহক। মালবাহকদের দেখে মনে হলো হয়ত নেপালের লোক। পরে জেনেছিলাম বস্তুতপক্ষেই তাঁরা নেপালের। এবং তাঁরা যে কি পরিমানে অতিমানবিক কাজকর্ম করতে পারেন তা সেদিন এই অত্যন্ত সাধারন চেহারার চারটি ছেলেকে দেখে কোনভাবেই বুঝিনি। যথা সময়ে এদের কথায় আসবো।

  হাঁটা শুরুর ঠিক আগে

সব মিলিয়ে এগারোজনে, রাত্রিযাপন লক্ষীবনে
১০ই জুন, ২০১৯। কাঁটায় কাঁটায় সকাল ৯টা ৪৫শে আমাদের হাঁটা শুরু হলো। প্রথম দিনে একদম শুরুতে চলাটা কিঞ্চিত আড়ষ্ঠ থাকে। কারন পিঠে ব্যাগ। ব্যাগের ওজন যে অনেকখানি সেটা ঠিক, কিন্তু এটা ঠিক ওজনের জন্যে অতটা নয়, যতটা ভারসাম্যের জন্যে। কেননা অতখানি ভারি একখানা ব্যাগ (এই ধরুন ১৫ কিলো মত) পিঠে আঁটলে শরীরের উপরিভাগ নিচের চেয়ে ভারি হয়ে পড়ে। ফলে হাঁটার সময় কিঞ্চিত ভারসাম্য বিগড়োয়। এর সঙ্গে জুড়ুন এবড়ো খেবড়ো পথ, অসমান পদক্ষেপ এবং ক্রমাগত চড়াই ভাঙ্গা। যদিও শুরুর দিকে ক্ষমতা থাকে বেশী, মন ও ফুরফুরে তাই । আধ কিলোমিটার চলে এলাম মিনিট দশেকে। পাহাড়ে কিন্তু এইটে বেজায় তাড়াতাড়ি। একটা হিসেব দিলে বুঝবেন। আজকে আমাদের গন্তব্য লক্ষীবন। সেখানে কি আছে? কিছুই নেই। খাড়াই পাহাড় আর খাদের মাঝে এক টুকরো ছোট্ট ফালি জমি, যেখানে তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটানো যায়। সেই জায়গার দুরত্ব সাত কিলোমিটার। আমরা আন্দাজ আজ বিকেল নাগাদ সেখানে পৌঁছবো। বাকিটুকু হিসেব করে নিন। আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে পেছনে একটু নিচে দেখা যাচ্ছে মানা গ্রাম। তার ঠিক সামনেই অলকানন্দা একটা সমকোনে ঘুরে চলে এসেছে আমরা যেদিকে যাচ্ছি অর্থাৎ পশ্চিম দিকে। ঠিক যে জায়গায় অলকানন্দা বাঁক নিয়েছে, সেই জায়গাটিতে ছোট্ট সরস্বতী এসে মিলিত হয়েছে অলকানন্দার সঙ্গে। আর এই সঙ্গমস্থলেই দ্রৌপদীর পতন হয় বলে মহাভারত বলছে। আমাদের সামনে একটা জলের উৎস। সেখানে আমরা বেশ পেট ভরে জল খেলাম। বোতলগুলো যে টুকু খালি ছিলো ভরে নেওয়া হলো।  এখানে পায়ে চলা একটা হালকা রেখা রয়েছে। সেটাই পথ হিসেবে ধরে এগোচ্ছি আমরা। এখানে দুজনের সঙ্গে দেখা হলো, যাঁরা ফিরছেন সতোপন্ত থেকে। কুশলবার্তা বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করলাম ওপরের অবস্থা কেমন। যা উত্তর পেলাম তা খুব একটা আশাব্যঞ্জক না। আবহাওয়া খুব খারাপ আর প্রচন্ড বরফের জন্যে এগনো যাচ্ছে না। দেখাই যাক আমরা কতদুর যেতে পারি।


লক্ষীবনের পথে – অনেক নিচে অলকানন্দা

দুপাশের দৃশ্যাবলীর তুলনা নেই। ঘাস গুলো দেখে মনে হচ্ছে বুঝি মখমলের তৈরি। রোদের তেজ খুব। মাথা বাঁচাতে টুপি পরেছি, আর পুরো হাতা টি শার্ট। হাতে পরেছি আমার সাইক্লিং এর গ্লাভস। এতে সুবিধে হলো আঙুল গুলো বেরিয়ে থাকে। পিঠে ব্যাগ, গলায় ক্যামেরার ব্যাগ ,সব মিলিয়ে একটু জবুথবু লাগছিলো। কিন্তু ঘন্টাখানেক এই রাস্তায় চলার পর ওজন আর ভারসাম্যের বদলটা সয়ে এলো। ততক্ষণে পথ কঠিন হতে শুরু করেছে। মোটামুটি মিনিট তিরিশেক চলার পরেই একবার করে থামতে হচ্ছিলো। আর যখনই থামছিলাম, আরো বেশী করে মুগ্ধ হচ্ছিলাম চারপাশের সৌন্দর্য্যে। মাথা তুলে তাকালে আকাশ গাঢ় নীল। এক ফোঁটা ধুলো ধোঁয়ার চিহ্ণ নেই। চারিদিকে উঁচু উঁচু অসংখ্য নাম না জানা পর্বত শৃঙ্গ। আমরা যেদিক থেকে এসেছে, অর্থাৎ পূব দিক, সেদিকে তাকালে মানা গ্রাম এখনো বহু দূরে দেখা যায়। তার পেছনেও খাড়া পাহাড় উঠে গেছে, যার চুড়াগুলোয় শ্বেত মুকুট পরানো। আমাদের নিচে, অনেক নিচে অলকানন্দা ভীমবেগে বয়ে চলেছে। জুন মাস, মাথার ওপর সূর্য্য। রোদের তেজ ভয়ানক। কিন্তু উচ্চতার জন্যে তাপমাত্রা অনেক কম। তার ওপরে মাঝে মাঝে একটা কনকনে হাওয়াও আসছে। ফলে পাহাড়ে ওঠার পরিশ্রমটা তেমন টের পাচ্ছিনা। আমরা এখন মোটামুটি বারো হাজার ফুটের আশেপাশেই হবো। তাই হালকা হাঁফ ধরা টের পাচ্ছি। এ সময় বেশী করে জল খাওয়া প্রয়োজন। সবাইকে এই নিয়ে অল্প জ্ঞানগম্যি দিলাম। কানহাইয়ালাল ওস্তাদ ছেলে। সে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কখনো এগিয়ে যাচ্ছে। কখনো ফিরে আসছে। সঙ্গে মাধাইও তাই। দাদা-বৌদির চলায় কোন স্লথতা নেই। মসৃন ভাবে চলেছে। আর মাঝে মাঝে দুটিতে থেমে ছবি তুলছে, কিছু দেখছে। গজবের উৎসাহের শেষ নেই।

আমাদের সামনে আরো একটা দল চলেছে দেখলাম। প্রচুর হাঁকডাক চলছে তেনাদের। আমাদের দলটি তুলনামূলকভাবে অনেক চুপ চাপ। এমনিতেও পাহাড়ে ওঠার সময় পরিশ্রমের চোটে কেউই খুব একটা মুখ খোলে না। জওন ভাই আগের মতই চলেছে। কখনো আমাদের সামনে, কখনো পেছনে। আমাদের মালবাহকদের দেখা নেই। তারা চলে নিজেদের গতিতে। নিজেদের রাস্তায়। সেখানে অনেক শর্টকাট। যদিও এই পথে যে কোথা দিয়ে শর্টকাট সম্ভব সেইটা আমার মাথায় ঢুকলো না। কিছুক্ষন থেকেই দেখতে পাচ্ছি সামনে অলকানন্দার খাতের ওপর একটা সাদা রঙের ছাপ। ওটা কি বরফ? না কি পাথর? আরো কিছুটা এগিয়ে ব্যাপারটা স্পষ্ট চোখে পড়ল। অলকানন্দার ওপরে সত্যিই বরফ জমে আছে। এ নরম ভুরভুরে বরফ নয়। শক্ত বরফ। আর তার ওপরে এক অতিকায় ফুটো। ফুটোর কাছাকাছি গিয়ে দেখেছিলাম তার যা আকার তাতে আরাম সে গোটা তিনেক টেনিস কোর্ট এঁটে যেতে পারে। যদিও দূর থেকে দেখে ওটা যে এতবড় , তা বুঝতে পারিনি। একবার ওতে পড়লে একেবারে সিধে স্বর্গারোহন ঠেকায় কে? মুশকিল হলো ওই অতিকায় ফুটোর বাঁ দিক দিয়ে আমাদের পেরোতে হবে, আর সেখানে বরফ একেবারে খাড়াই। উপরন্তু শক্ত ও পেছল। ভেবেই পেলাম না কি করে পেরোনো যেতে পারে। জওন ভাইয়ের মুখেও দেখলাম একটু চিন্তার রেখা। এই প্রথম বার। যাই হোক, এসেছি যখন, যেতে তো হবেই এ বাধা টপকে। যতই মনে আশঙ্কা জমুক। তাই পা বাড়ালাম। আস্তে আস্তে বরফের জায়গাটা এগিয়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে।  ইতিমধ্যে দাদা ওই গর্তের নামকরণ করেছে – হোয়াইট হোল, শ্বেত গহ্বর।  হিমশীতল শ্বেত গহ্বরের দিকে দূর থেকে তাকিয়েই তলপেটটা কেমন কেমন করছিলো। পাহাড়ের গা বেয়ে একদম খাড়াই বেয়ে প্রায় একশ দেড়শো ফুট নেমে আসতে হলো। সে রাস্তাও সুবিধের না। বিচ্ছিরি খাড়াই নেমে গেছে। রাস্তা বলে আলাদা কিছু নেই। আগা গোড়া আলগা নুড়ি পাথরে ভর্তি। পা ফেললেই হড়কাচ্ছে। এদিক ওদিক আঁকড়ে ধরে পিছলে হড়কে কোনক্রমে নেমে এলাম নদীর খাত বরাবর। এবার দেখলাম আসল সমস্যা কতটা গভীর।
শ্বেত গহ্বর ও অলকানন্দার ওপরে জমে থাকা বরফ। একেবারে বাঁ দিকের ঢালু অংশ দিয়ে পেরোতে হবে

সামনে দেখতে পাচ্ছি শক্ত পেছল বরফের অতিকায় ফুটো। সে বরফ শক্ত হয়ে কাচের ওপর জল পড়ার চেয়েও পেছল। পা ফেললেই হড়কে যাচ্ছে। দাঁড়ানো তো দুরস্ত, হামাগুড়ি দেওয়াও বড়ই কঠিন সেখানে। উপরন্তু সে বরফের এলাকা ঢালু হয়ে ওপরে উঠে গেছে। আর তার ডান পাশে ওই বিশাল গর্ত। পা পিছলে গেলে আঁকড়ে ধরবার সামান্য কিছু নেই।  হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম এর পর সামনে যাবো কি করে। আর ঠিক এইখানেই প্রথম বার বুঝতে পারলাম আমাদের সঙ্গে চারজন অতিমানব চলেছেন। বিল্লা ঠাকুরি, ভীম, ধনরাজ আর বাসা ভাই। চার নেপালী। সত্যি যদি বলতে বলেন তো জটায়ুর ভাষায় বলব “নেপাল কা অস্ত্র”। একে তো চার জন ডাঁই করে বস্তা বেঁধে জিনিস বইছে। কিন্তু চলেছে দিব্যি হাসিমুখে। জওন ভাই কিছুক্ষন বরফ দেখলো। তার পর নিজে দু পা হেঁটে এলো ওই রাম পেছল বরফের ওপরে। স্পাইডার ম্যান না কি কে জানে বাপু! এসে চার নেপালি কে বলল “খোদ দো”। সেরেচ, কি খুঁড়বে? কাকে পুঁতবে? এই আপদের জায়গা পেরোতে না পারলে আমাদের স্বর্গারোহীনির স্বপ্নকে যে এখানেই কবর দিতে হবে তা বেশ বুঝছি। বিল্লা ঠাকুরি দেখলাম এক খানা আইস অ্যাক্স বের করে ওই সুকঠিন বরফের ওপরে ঘষে ঘষে সমান্তরাল কতগুলো লাইন টানতে লাগল। এক একটা রেখা বা খাঁজ আন্দাজ এক ফুট লম্বা, আধ ইঞ্চি গভীর আর দুটো খাঁজের ভেতর ফুট খানেকের তফাত। বুঝলাম ধাপ কাটা হচ্ছে। এইতে পা রেখে এগোতে হবে। যা থাকে কুলকপালে, যেতে যখন হবেই, তখন নেমে পড়াই ভালো।  পা রাখলাম প্রথম খাঁজে। নিজেকে ঠিক প্রাচীন মিশরীয় ছবির মত দেখতে লাগছিলো। মানে মুখ সামনে, আর পা রাখছি আড়াআড়ি। পিঠে আবার ব্যাগের বোঝা, গলায় ক্যামেরার ব্যাগ। সুধী পাঠক, এসব জায়গায় একটাও ছবি তুলতে পারিনি। দাঁড়াতেই পারছিনা তো ছবিটা তুলবো কি করে? এই অদ্ভুত ভাবে হাঁটা শুরু করার পর দশ কি বারো পদক্ষেপের পরেই আমার বউনি হয়ে গেল। ধপাস করে পড়লাম পা পিছলে। ভেবেছিলাম হয়েই গেল। রাতের মধ্যে আমি, থুড়ি আমার দেহ হরিদ্বারে পৌঁছে যাবে। কিন্তু ঘটনাচক্রে হাতের ছড়ির ছুঁচলো মুখটা বরফে গেঁথে আটকে দিতে পেরেছিলাম। তাতেই ভর করে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। আর পরের খাঁজে পা বাড়ালাম। সামনে দেখছিনা। আমার লক্ষ্য কেবল পরের ধাপ। মাঠে যাঁদের সঙ্গে খেলা দেখি, তাঁদের মধ্যে এক দাদা আছেন, যিনি বলেন “আমার লক্ষ্য কেবল পরের খেলায় জেতা, ব্যাস”। দাদা অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত এবং সুলেখক ও রসিক মানুষ। তাঁর ওই কেবলমাত্র  পরের খেলায় জেতার দর্শণটুকু এইখানে এসে উপলব্ধি করলাম। আরো বেশ কয়েকবার আছাড় টাছাড় খেয়ে আমরা সকলে একটা সময় ওই বরফের জায়গাটা পেরিয়ে এলাম। সব মিলিয়ে ঘন্টা দেড়েক লেগে গেল ওই  ৩০০-৩৫০ মিটার পেরোতে। তবে বুঝলাম সবই অভ্যেস হয়ে যায়। প্রথম দিকে বরফের ওপর হাঁটায় যতখানি আত্মবিশ্বাসের অভাব বোধ করছিলাম, পরের দিকে সেটা কমে আসছিলো। আর বুঝলাম, পড়ে গেলেই সব কিছু শেষ হয়ে যায় না। উঠে দাঁড়ানোর উপায় থেকেই যায়, বরফ থাকুক বা না থাকুক।
যে পথ পেরিয়ে এলাম

বরফ পার করে এসে বসবার জায়গা নেই বিশেষ। কেননা এখানে একটা প্রানান্তকর খাড়াই দেখতে পাচ্ছি। দম নেওয়ার ফুরসত হলো না। খাড়াই ভাঙার জন্যে প্রস্তুত হলাম। হাওয়া ইতিমধ্যেই বেশ পাতলা, উচ্চতাজনিত কারনে। যদিও এখনো সামান্য হাঁফানো ছাড়া আর কোন উপসর্গ নেই। সকলকে পেট ভরে জল খাইয়েছি হাঁটা শুরুর আগে। নিজেও খেয়েছি। এই খাড়াইটা ভাঙ্গতে গিয়েও সেই চিরন্তন সমস্যার মুখোমুখি হলাম। ভুরভুরে মাটি আর নুড়ি পাথর। তাতে পা দিলেই ভেঙ্গে গিয়ে পা পিছলোচ্ছে। যাই হোক, হাঁতড়ে হাঁতড়ে, টাল খেতে খেতে উঠতে থাকলাম। মিনিট পনের পর যে জায়গায় উঠে এলাম, সেরকম জায়গা আমি কখনো দেখিনি। বলা যেতে পারে, আমার “ডুংলুং ডো” দর্শণ ঠিক এই জায়গাটা থেকেই শুরু হলো।  বড় বড় সোনালী ঘাস। হাওয়া বয়ে যাবার সময় মনে হচ্ছে সোনালী সমুদ্রে ঢেউ খেলছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সে ঘাস উঠে গেছে অনেক ওপর পর্যন্ত। সোনালীর ভেতর থেকে উজ্জ্বল সবুজের আভা উঠে আসছে কোথাও কোথাও। সামনের রাস্তা বেশ কিছুটা তেমন চড়াই উৎরাই কিছু কিছু নেই। হালকা চড়াই অবশ্য আছে, তবে সে তেমন কিছু নয়। আমরা এখানে একটু বসে জিরিয়ে নিলাম। জল খাওয়া হলো। সূর্য্য এই মুহুর্তে মাথার ওপরে। কিন্তু গায়ে সে রোদ লাগছেনা উচ্চতার জন্যে। এখানে বসে বসেই দেখছিলাম নিচে থেকে উঠে আসছে আর একটি দল। এদের আমরা দেখেছিলাম বরফ পার হবার সময়। এবার একটু ভালো করে লক্ষ্য করলাম। সে দলের গাইডের তৎক্ষনাত নামকরন করা হলো চেঙ্গিজ খান। মানুষটির আকার প্রকারে সেরকম ভাবই প্রকট। মঙ্গোলিয় মুখ, হালকা গোঁফদাড়ি আছে। মাথার চুল ঝুঁটি করে বাঁধা। আড়ে বহরে শালপ্রাংশুমহাবাহু। আর সব চেয়ে বড় কথা প্রবল প্রতাপ।তেনার হাঁকডাকের চোটে বাকি দল তঠস্থ। যদিও পরে দেখেছিলাম ভদ্রলোক যথেষ্ট খেয়াল রাখেন সকলের আর খুবই অতিথিবৎসল এবং রসিক। 
কয়েক মিনিটের একটু বিশ্রাম

চেঙ্গিজ খানের দল কে আসতে দেখে আমরাও গতর তুললাম। সাধারনতঃ স্বল্প সময়ের বিশ্রামে আমরা কেউ ব্যাগ নামাইনা। যার ফলে তাড়াতাড়ি চলা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু যেখানে বেশী সময়ের জন্যে থামা হয়, সেখানে পিঠ থেকে ব্যাগ খোলার পর মনে হয় শরীরটা এত হালকা, বোধহয় জোরে হাওয়া দিলে উড়েই যাবে। সামনের রাস্তা অল্প অল্প ওপরে উঠেছে, কিন্তু সেটা পাহাড়ের ঢাল বরাবর। কাজেই ওপরে উঠবার কষ্টটুকু বাদ দিলে আর তেমন কোন সমস্যা নেই। সামনে বহু দূরে দেখতে পাচ্ছি নদীর অন্য দিকে অনেক উঁচু থেকে একটা জল প্রপাত নেমে এসেছে। সাদা ফেনা ফেনা জল, স্লেট রঙা পাথরের ওপরে বহুদুর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম ওইটিই হল বসুধারা জলপ্রপাত, এবং ওরই ঠিক উলটো দিকে নদীর এপারে আমাদের আজকের ক্যাম্প হবে লক্ষীবনে। পাহাড়ে দুরত্ব বোঝা কঠিন। এত পরিস্কার আবহাওয়া, বহু দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। এদিকে দেখলাম পেছনে তাকালে আর মানা গ্রাম দেখা যাচ্ছে না। আমরা বেশ কিছুটা চলে এসেছি। চারিদিকের দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। বৌদি বেশ কয়েক বছর সুইৎসারলান্ডে কাটিয়ে এসেছে। আমিও সদ্য সদ্য কয়েক মাস আগে অস্ট্রিয়া ঘুরে এসেছি। দুজনেই স্বীকার করলাম এখানের হিমালয়, এক্কেবারে আল্পসের মত দেখতে তো বটেই, বরং একটা অদ্ভুত বন্য গাম্ভীর্য্য ধারন করে আছে বলে, বোধহয় আরো বেশী সুন্দর। মিনিট তিরিশেক চলার পর থামা হলো। জওন ভাই দেখলাম পিঠের ব্যাগ নামিয়ে খাবারের প্যাকেট বের করেছে। কিন্তু জনগন দেখলাম প্রথমেই খাবারের দিকে হাত বাড়ালোনা। আমরা যে জায়গাটায় থেমেছি, এটা একটা পাহাড়ের ঢাল। আর সেখানে চারদিকটা এত অবশ্বাস্য ধরনের সুন্দর, যে প্রথমটা বিশ্বাসই হতে চায় না। ব্যাগ নামিয়ে সকলেই একটু লাফ ঝাঁপ করে এতক্ষনের আড়ষ্ঠ হয়ে যাওয়া পিঠ কোমর ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। কয়েকটা ছবিও তোলা হলো লাফালাফির। কিন্তু মিনিট দশেক যেতে না যেতেই মহাপ্রানী আর্তনাদ করে উঠলো আর আমরা জওন ভাইয়ের সামনে লাইন দিলাম। আজকে দুপুরের খাওয়া পরোটা আর আচার। আমার দিব্যি চলে। সকলেরই দিব্যি চললো। খিদের মুখে শুকনো রুটিও অমৃত আর এ তো দস্তুরমত রেওয়াজি পরোটা। জল টল খেয়ে আবার পা বাড়ানো গেল পরবর্তী পর্যায়ের দিকে। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, সকালের দম কিছুটা কমে এসেছে। চলতে সময় লাগছে। অবশ্য তাড়াহুড়োর কিছুই নেই। আস্তে আস্তে পা ফেলে শুরু করলাম।
 “কম্পজ্বরে কাঁপিস কেন লম্ফ দিয়ে চলরে সবাই লম্ফ দিয়ে চল”

এর পরের রাস্তাটা ক্রমশঃ কঠিন হতে থাকলো। বড় বড় বোল্ডার, আর তার ফাঁক দিয়ে রাস্তা সমানে চড়াইয়ের দিকে চলেছে। কিছুটা করে চলছি, আবার দাঁড়াচ্ছি। এই করতে করতে বেশ কয়েকটা বরফের ঢাল পেরোলাম। প্রথমটার মত এই বরফগুলোর কোনোটাই অতটা পেছল নয়। কিন্তু পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে নেমে আসার জন্যে এরা নিজেরাও বেশ খাড়াই। আর আমাদের পেরোতে হচ্ছে আড়াআড়ি।  একখানা তো বেশ কঠিন লেগেছিলো মনে পড়ছে। বরফে জুতোর সামনেটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে লাথি মেরে মিনিট খানেকের চেষ্টায় একটা করে খাঁজ কাটা যাচ্ছে। সেই জায়গায় অন্য পা রেখে আবার তার পরের খাঁজ কাটা শুরু হচ্ছে। গোটা ব্যাপারটা যেমন ধীরগতি তেমনই ক্লান্তিদায়ক। মুশকিল হলো এ এমনই বেখাপ্পা জায়গা, যে দম ফুরিয়ে গেলে দুদন্ড বসে জিরিয়ে নেবার অবকাশ বা স্থান কোনোটাই নেই। পুরোটা যতক্ষন না অতিক্রম করা যাচ্ছে, কিছুতেই বিশ্রাম নেওয়া সম্ভব নয়, কেননা পেছনে বাকি দলের সবাই আছে।  একদম শেষের দিকে এসে, যখন আর দু কদম বাকি, ঠিক তখনই তাকিয়ে দেখতে গেলাম আর কতটা বাকি। আর ওই দু কদম দেখেই তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যেতে চাইলাম। যা হবার হলো। দেখলাম দিগন্ত (আন্দাজ মত), চারপাশের পাহাড় সবাই আড়াআড়ি হয়ে গেল কেমন, এক লহমার ভারশূন্যতা অনুভব করলাম, তার পর শরীর জোড়া প্রবল ঝাঁকুনি। সোজা আছাড় খেলাম। হ্যাঁচড় প্যাঁচড় করে উঠতে গিয়ে কেবলই পা ফস্কায়। শেষে হাত বাড়িয়ে বরফের শেষে একখানা পাথর নাগালে পেয়ে আঁকড়ে ধরে কোনক্রমে সেই শেষের দু কদম পার হলাম।  

পথের শেষ দেখা যাচ্ছেনা। জওন ভাইকেও জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। সে খালি বলে অওর থোড়াসা। আমি সামনে বসুধারাকে দেখছি। সেটা এখন কিছুটা দুরেই মনে হচ্ছে। বাকিদের দেখছি ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট সকলের চোখে মুখে। সাধারনতঃ যাত্রা শুরুর দিনে এতটা পথ হাঁটা হয়না কখনো। কিন্তু এই সতোপন্তের ব্যাপারই আলাদা। সাধে কি আর চট করে কেউ এ তল্লাটে আসতে চায় না? গতবছরের বাগিনীর দ্বিতীয়দিনের সঙ্গে এবারের সতপন্তের প্রথম দিন মিলছে। কিন্তু এ রাস্তা আরো অনেক বেশী বিপজ্জনক। আমার লেখা পড়ে কেউ যদি এ রাস্তায় আসেন, তাহলে কেবল দু খানি কথা বলব। এক কখনোই এই ট্রেক কে হালকা ভাবে নেবেন না। নিলে আতান্তরে পড়তে পারেন। দুই, ইউটিউবে অনেক ভিডিও আছে সতপন্তের। দয়া করে সেগুলো দেখে সতোপন্ত সম্পর্কে কোনো রকম ধারনা করতে যাবেন না। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, পথের কঠিনতম জায়গাগুলোতে কেউ কোনো ছবি বা ভিডিও তুলতে পারেনা। কাজেই আপনি যা দেখেন, সেগুলো সুধুই সেই সব সহজ সরল অংশ, যা আপনি অনায়াসেই পেরিয়ে যেতে পারেন। যাই হোক। একটা বেশ মাঝারি গোছের খাড়াই টপকে এসে সামনে দেখি বেশ কিছুটা খালি সমতল জায়গা। দেখে বড় ভালো লাগল। সামনে বেশ কিছুটা দূরে কতগুলো তাঁবুও দেখছি। মনে হলো লক্ষীবন পৌঁছেই গেছি। না থেমে হাঁটা লাগালাম। তাঁবুগুলোর কাছে গিয়ে দেখি জওন ভাই আর চেঙ্গিজ খান গপ্প জুড়েছে। কিন্তু ধারে কাছে কোথাও আমাদের চার মুর্তি নেপালিদের দেখলাম না। সামনে যেতেই জওন ভাই আগে আঙুল তুলে বলল আগে চলো দাদা। জিজ্ঞেস করলাম কতটা? আমি ভেবেছিলাম আরো সামনে কোথাও তাঁবু খাটিয়েছে হয়ত আমাদের। কিন্তু জওনভাই বলল এক কিলোমিটার। সেরেচে, আরো এক কিলোমিটার হাঁটাবে? তার মানে এটা লক্ষীবন নয়? যাই হোক। হতাশা চেপে রেখে পা বাড়ালাম। চেঙ্গিজ খান আর তার দল আজ রাতে এখানেই থাকবে। এ জায়গাটার নাম শুনলাম চামতোলি।

সামনে একটা টিলা মত জায়গা টপকে ওপাশে গিয়ে দেখি একেবারে খাড়াই উঠে গেছে পাহাড়ের রিজ, আর তার গায়ে বোল্ডার ভর্তি। এরকম আলগা বোল্ডার চড়া এবং তার ওপর দিয়ে হাঁটা খুবই কসরতের কাজ। তা আজ সকাল থেকে বরফ টরফ সবই যখন হলো, তখন এটাই বা বাকি থাকে কেন? এদিকে সূয্যি আস্তে আস্তে ঢলছে। ছায়া লম্বা হচ্ছে।  আস্তে আস্তে বোল্ডারের ওপরে উঠে খাড়াই চড়তে লাগলাম। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে। প্রায় ঘন্টা সাতেক হাঁটছি একটানা। বোল্ডারের ভেতর থেকে আবার বেরিয়ে আছে শুকনো কাঁটাঝোপ। তাতে পাহাড় চড়াটা আরো অস্বস্তিকর হয়ে উঠলো। ঘন্টাখানেক এই উদ্ভট বোল্ডার ভ্রমনের পর দেখলাম সামনের চড়াইটা সমতল হয়ে গেছে। আর বোল্ডারও আর নেই। সামনে ঘাসজমি। ঘাসজমিতে নেমে এলাম পাথর পেরিয়ে। তার পর এটা বিরাট পাথরের চাঁই পেরিয়ে একটু বাঁদিকে দেখি দু খানা নীল নীল তাঁবু আর একটা হলদে রঙ এর তাঁবু। আর তার সামনে বসে ভীম আর বাসা। বুঝলুম অদ্য এই ময়দানেই আমাদের যাত্রার ইতি ঘটল। সামনে একটা ঢিপির পাশে ব্যাগপত্তর রেখে হেলান দিয়ে বসলাম। 

পথের শেষে বিশ্রাম

লক্ষীবন পৌঁছে প্রথম আধ ঘন্টা স্রেফ পড়ে রইলাম ঘাসের ওপর। ইতিমধ্যে চা এসে গেছে। চায়ের সঙ্গে এলো বিস্কুট। চা খেয়ে একটু গায়ে বল পেলাম। ইতিমধ্যে বেশ শীত শীত করছে। গায়ে হালকা জ্যাকেট চাপালাম। তার পর ইতি উতি একটু রোঁদে বেরোলাম। এমনিতে জায়গাটা আর চারপাশ একটু দেখাও হবে, আবার কাল প্রাতঃকালীন স্থান নির্বাচনও হয়ে যাবে। গজব, দাদা, বৌদি সকলেই জানতো যে শেষ বিকেলের আলো থাকতে থাকতেই স্থান নির্বাচনটা সেরে রাখা ভালো। দেখলাম সকলেই ইতি উতি ঘুরছে।  আমি গেলাম অলকানন্দা দেখতে। অনেক নিচে অলকানন্দার বরফজমা খাত। ওপাশে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে অনিন্দ্যসুন্দর বসুধারা। পাহাড়ের ওদিকটা নেহাত ছায়া ঢেকে গেছে এখন, নয়ত দিব্যি রামধনু দেখা যেত। পকেটে হাত পুরে ইতি উতি ঘুরে পাক্কা একখানি বিলায়েতি ইস্টাইল পাথরের সমারোহ পেয়ে গেলাম। সক্কাল বেলা দিব্যি সুবিধে হবে এখানে। ভাঙ্গা পা বলে উবু হয়ে বসতে পারিনা মোটে। তাই এইটুকু ব্যবস্থা আমাকে খুঁজে নিতেই হয়।

ফিরে এসে তাঁবুর বাইরে একটু ঘোরাঘুরি করলাম। দেখলাম সকলেই কম বেশী ক্লান্ত, যার ফলে বাইরে বসে আড্ডা দেবার পরিকল্পনা বাতিল হলো। রোদের জোর অনেকটাই কমে এসেছে। ঠিক এই সময় দেখলাম বড় তাঁবুটা থেকে ধনরাজ হাঁক পাড়লো। ভেতরে যেতেই হাতে উঠলো গরম গরম চায়ের কাপ, আর সেই সঙ্গে গরম গরম পকোড়া।  আহা, বেঁচে থাকো জওন ভাই। মাধাই, কানহাইয়ালাল আর আমি আগেই জানতাম। এবার দেখলাম গজব, দাদা বউদিও পকোড়ায় কামড় মেরেই চোখ বুঁজলো। আর কয়েকটা পকোড়ার পরেই হুড়মুড় করে আমাদের গল্পেরা বেরিয়ে এলো। সারাদিনের পথ চলার পরিশ্রমে সে সব গল্প লুকিয়ে ছিলো। এখন ক্লান্তি কাটতেই সে সব বেরিয়ে এলো। প্রথমেই জানতে চাইলাম যে গজব আর দাদা বউদির কেমন লাগছে।   গজবের একটা শব্দেই মতামত প্রকাশ পেল। “গজব”। দাদা বৌদি অনেক ঘুরেছে, দেশে এবং বিদেশে। তবে ঠিক এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়ত প্রথম। তবে দুজনেই যে শুধু মানিয়ে নিয়েছে তাই নয়, কষ্ট মেনে নিয়ে রীতিমত উপভোগ করছে। হাসি গল্প চুটকিতে সময় কাটতে লাগল। আলাপ পরিচয় হলো ভীম, ধনরাজ, বাসা আর বিল্লা ঠাকুরির সঙ্গে। তারা নেপালের মানুষ। নানা রকম পেশায় ঘুরছে পড়াশোনা শেষ করে। ট্রেকিং এর মরশুমে এদিকে চলে এসেছে কাজের খোঁজে। আবার ফিরে যাবে শীতের মুখে। কথা বলে বুঝলাম ধনরাজ, ভীম আর বিল্লা কাঠমান্ডুর কলেজে পড়া ছেলে এবং চৌকস। ধনরাজ বলল কয়েক মাস দার্জিলিং এ কাটিয়ে এসেছে। কলকাতাও তার দেখা। এবারে আমাদের সঙ্গে কোনো রাঁধুনি আসেনি। জওন ভাই নিজেই আমাদের রান্না করছে। জওন ভাইয়ের ওপরে আমার অগাদ ভরসা। আর রাতের খাবার পাতে পড়তেই সবাই স্বীকার কর সে ভরসার সঙ্গত কারন আছে। সাধারন কুকারে সেদ্ধ করা খোসা সমেত মুসুর ডাল আর ভাত যে এত সুস্বাদু হতে পারে, ভাবা যায় না। সঙ্গে আবার পাঁপড় ভাজা। খেয়ে দেয়ে আমরা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নিজেদের তাঁবুতে সেঁধোলাম। একটা তাঁবুতে দাদা বৌদির সঙ্গে আমি। আমরা এপাড়া-ওপাড়া হাওড়ার লোক। কাজেই এক জায়গায় আমরা। বাকি তিনজন অন্য তাঁবুতে। তাঁবুতে ঢোকার গল্প, জুতো খোলার গল্প, স্লিপিং ব্যাগের ভেতর সেঁধোবার গল্প এর আগের লেখায় (বাগিনীর পিঠে) বিস্তারিত লিখেছি। কাজেই এবার আর সে স  লিখে লেখার ভার বাড়াচ্ছি না।


লক্ষীবনে আমাদের তাঁবু

হিমবাহের ঘাড়ে, বরফের ঝড়ে

দিনের শুরুটা ভারি ভালো। ঝকঝকে আকাশ। সোনা সোনা রোদ। চড়া ঠান্ডায় দাঁতের কত্তাল বাজাতে বাজাতে ভোর ভোর ভাল করে আলো ফোটার আগেই ইয়ে টিয়ে সেরে নিয়েছি। দাঁত ও মেজেছি। বাকি সব কিছু তোলা রইলো যোশীমঠের জন্যে। ব্যাগের ভেতর থেকে খুব বেশী কিছু বের করিনা। তাই খুব বেশী কিছু গোছানোরও থাকেনা। যে টুকু থাকে, সেটুকুও গুছিয়ে নিলাম সকাল সকাল। ওদিকে টের পাচ্ছি জওন ভাইদের বড় তাঁবু থেকে ছ্যাঁক ছোঁক আওয়াজ আর মনোহরা গন্ধ আসছে। সকালের জলখাবার আর দুপুরের পথ চলতি লাঞ্চ দুটোই তৈরি হচ্ছে। বাকিরাও দেখলাম তৈরি হয়ে নিয়েছে। দাদা বৌদি বোধহয় রাত থাকতেই উঠে বেরিয়ে গেছিলো বাইরে। গজব আমাদের ভেতর সবচেয়ে ছোটো আর সবচেয়ে বেশী ছটফটে। সে ই আমাদের জমিয়ে রেখেছে গপ্পগাছা করে। সাতটার ভেতরে আমরা সকলে তৈরি হয়ে গেলাম। আর দেখলাম ঠিক তখনই, তাঁবুর ম্যাট গুলো বের করে বাসা ভাই বাইরে পাতল আর জওন ভাই আমাদের ব্রেকফাস্টের খাবার দাবার এনে রাখলো তার ওপর। আজকের আয়োজন দেখে আমার চোখ কপালে। ট্রেকিং না পিকনিক ঠিক বুঝতে পারছিনা। গরম গরম টোস্ট, মাখন জ্যাম, পাস্তা (আজ্ঞে হ্যাঁ) আর চা। আমরা গতকাল খেয়েছি রাত আটটায়। আর দিনের বেলায় পরিশ্রমের চোটে সে খাবারও হজম হয়ে গেছে কখন। এখন পেটে বড়ই ভুখ, না খেলে নাই কোনো সুখ। তাই গড়পরতা বাঙালির হিসেবে কিছুটা বেশীই খেয়ে ফেললাম। যদিও অবচেতনে কেউ সাবধান করছিলো, ওরে আর খাসনি, এর পর ওই বিশ মনি বোঝা নিয়ে পাহাড়ে চড়তে হবে। যাই হোক, খেয়ে দেয়ে ,পেট ভরে জল খেয়ে যাত্রা শুরু হলো। দেখলাম চেঙ্গিজ খান দল বল নিয়ে চলে এসেছে এর মধ্যেই। মানে ওরা আমাদের ঘন্টাখানেক আগেই বেরিয়েছে।     
লক্ষীবনে জলখাবার

ভরা পেটে আমরাও রওনা দিলাম। জওন ভাই সামনের পাথর ভর্তি খাড়াই দেখিয়ে বললো আগে চলো। মোটামুটি ৬৫-৭০ ডিগ্রি চড়াই ভাঙ্গা শুরু হলো। এবারে যদিও পায়ের তলায় ভুরভুরে মাটি নেই, কিন্তু আছে অতিকায় বোল্ডার। এক একটা তিন থেকে পাঁচফুট উঁচু, আর এবড়ো খেবড়ো। কোনোটা আবার আলগা। পা ফেললেই হড়কে যেতে পারে।  থেকে অন্য বোল্ডারে লাফাতে হচ্ছে। পা ফস্কে গেলে ওই খাঁজে ঢুকে পা যে কত টুকরো হয়ে ভাঙবে কে জানে। তার ওপরে চড়াই ভাঙ্গা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, পাহাড়ের ওপর দিক থেকে বরফ গলে নেমে আসা প্রবল জলস্রোত। সেগুলো পেরোতে আরো কসরত করতে হচ্ছে। এখানেও সেই আগের মত চললাম। দূরে কোথাও তাকাচ্ছিনা। সামনে দেয়ে দেখছি কেবল পরের পাথরটার দিকে। সেটা যদি জুতসই মনে না হয়, তাহলে এদিক ওদিক দেখে, যেটা তুলনামুলক একটু পা রাখার মত, সেটার ওপরে পা রাখা। আধ ঘন্টা মত এই কসরত চলার পরে দেখি সামনে একটা অতিকায় পাথর, প্রায় পাঁচতলা বাড়ির সমান। মনে পড়লো গতকাল জওন ভাই নিচে থেকে এই পাথরটাও দেখিয়ে বলেছিলো এর পাস দিয়ে সোজা এগিয়ে যেতে হবে। পাথরের টুকরোটা পেরোতেই দেখি রিজটা আমরা পেরিএ এসেছি। এদিকের রাস্তা অতটা খাড়াই নয়, আর অত বোল্ডারও নেই। সামনে অন্ততঃ শ দুয়েক মিটার পাথরের খাঁজে খাঁজে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটার জায়গা আছে।

চলার পথ কিছুটা ভালো হলে, চারপাশে তাকানো যায়। এখানের পাহাড়ের চেহারা গুলো একদম আলাদা। চেনা জানা সবজে ঘাস আর গাছে ঢাকা পাহাড় আমরা পেরিয়ে এসেছি অনেক আগে। এখন আমরা যে উচ্চতায়, সেটা চার হাজার মিটারের ওপরে। এই উচ্চতায় সাধারন উদ্ভিজ্জ জন্মানো সম্ভব নয়। তাই গাছ পালা ঘাস এসব কিছুরই দেখা নেই। কিন্তু তা বলে কি প্রানের দেখা নেই? নিশ্চই আছে। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে নাম না জানা অদ্ভুত চেহারার কিছু গুল্ম উঁকি দিচ্ছে। চেহারা দেখে বুঝলাম জুনের শুরুতে এদের আবির্ভাব, আর হয়ত অক্টোবরের মধ্যেই শুকিয়ে মরে যায় আর বরফে চাপা পড়ে যায়। পাহাড়ের গা গুলো স্লেট পাথরের মত। তার ওপরে ধপধপে সাদা বরফ পড়ে আছে। আমাদের সকলের চোখেই রোদ চশমা। কেননা এক তো এখানে রোদের তেজ অনেক বেশি, তার ওপরে বরফের ওপরে রোদ পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়ে স্নো-ব্লাইন্ডনেস নামক বিদঘুটে ব্যারাম হতে পারে। অক্সিজেন অত্যন্ত কম বলে এখানে দশ পা হাঁটলেই মনে হয় প্রচন্ড পরিশ্রম হয়েছে। তাই খুব সাবধানে চলা নিয়ম। হুড়মুড় করে হাঁটা আর বকবক করা, এই দুটিই খুব ক্ষতিকর। উচ্চতাজনিত অসুস্থতা থেকে বাঁচার জন্যে আমার সঙ্গে তিনটি জিনিস সব সময় থাকে। এক, রক্তের অক্সিজেন মাপার জন্যে একখানা যন্ত্র। যেটা আঙুলের ডগায় পরিয়ে দিলে আপনা থেকেই রক্তে অক্সিজেন কত শতাংশ সেটা মেপে দেয়। এছাড়া থাকে ডায়ামক্স নামের একটি ওষুধ, যা আমি কখনো খাইনি, কিন্তু যদি কারোর লাগে সেই কথা ভেবে রেখে দিই। এ ছাড়া থাকে পর্যাপ্ত পরিমান জল, যা রক্তকে ঘন হতে দেয় না। এই উচ্চতায় এসে জল তেষ্টা কমে যায় ঠান্ডার কারনে। কিন্তু হিসেব করে জল খেয়েই যেতে হয়, না হলেই উচ্চতাজনিত সমস্যা দেখা দেবে। আর সে অসুস্থতা থেকে মানুষের মৃত্যু খুব সহজেই হতে পারে। এর একমাত্র চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আক্রান্তকে নিচে নামিয়ে আনা। যেহেতু জলপান এখানে সুস্থ থাকার একটা প্রধান অবলম্বন, তাই আমরা সুযোগ পেলেই নিজেদের জলের বোতল ভরে নিচ্ছি পাথর বেয়ে নেমে আসা বরফ গলা জল দিয়ে। যদিও সে জল মুখে দেওয়া মাত্র মনে হচ্ছে গোটা কয়েক দাঁত খুলে বেরিয়ে আসবে, অ্যায়সা ঠান্ডা। এখানে না আছে ফিল্টার, না আছে নোংরা, না আছে দুষণ।  

জলপানের বিরতি

কিছুক্ষন ধরেই দেখছিলাম একটা লোমওয়ালা বাদামী রঙের কুকুর কোথা দিয়ে যেন এসে আমার পেছনে পেছনে আসছে। মনে পড়ল ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী হয়েছিলেন মহাপ্রস্থানের পথে, সারমেয় রূপে। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে আমার অবস্থান বিপরিত মেরুতে। আর এ যাত্রা আমার অন্তিম যাত্রা হবে এরকম কোন ইচ্ছেই আমার নেই। আমার স্বর্গ আছে ঘিঞ্জি হাওড়া শহরের কোনো এক এঁদো গলিতে। তার খোঁজে আমার হিমালয় ভ্রমন নয়। জ্যাকেটের পকেটে গতকাল যোশীমঠে সাতসকালে কেনা এক প্যাকেট টাইগার বিস্কুট ছিলো। প্যাকেট খুলে একখানা দিলাম। ধর্মরাজ গম্ভীর মুখে একবার আমাকে আর একবার বিস্কুটের দিকে দেখে এগিয়ে এসে একটু ঘ্রান নিলেন। তার পর নিমেষে উদরস্ত করলেন। বাকি বিস্কুট গুলোও দিলাম, তিনি ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। আমিও পা বাড়ালাম। এরকম নির্বান্ধবপুরিতে একা একা ও কি করছে কে জানে? কি খায়, কোথায় থাকে, কিছুই ভেবে পেলাম না। পাথরে ভরা এবড়ো খেবড়ো একটা রিজে চড়তেই অন্যদিকের দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। এর আগে পেছনে ফেলেছি সুজলা সুফলা বাংলাদেশ, দিল্লির বাদশাহী, হরিদ্বারের গঙ্গা, যোশীমঠের পাহাড়ি শহর, মানা গ্রাম, সবুজ পাহাড়। আর এবার? পাথরের দেশ পেরিয়ে এসে কি পা রাখতে চলেছি বরফের রাজ্যে?  সামনে যত দূর দেখা যায়, পুরোটাই বরফে ভর্তি। রিজটা উঁচু বলে চারি দিকটা ভালো করে দেখছিলাম। সামনে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে সামনে দেখতে পাচ্ছি একটা হিমবাহ এসে মিশেছে অলকানন্দার খাতের সঙ্গে। আসলে একটা নয়, দুটো। দক্ষিন আর পশ্চিম দিক থেকে দু খানা হিমবাহ এসে মিশেছে এক জায়গায়, আর সেখানেই শুরু হচ্ছে অলকানন্দার খাত। অর্থাৎ আমার চোখের সামনে এখন অলকানন্দার উৎসস্থল। একে ম্যাপে বলেছে অলকাপুরি। জওনভাই ও সেই নামই বলল। পশ্চিমের হিমবাহের নাম ভাগীরথি খড়ক। সে হিমবাহ অবশ্য মানচিত্রের হিসেবে এই সঙ্গমস্থলের একটু আগেই শেষ। দক্ষিনে যে ভীমকান্তি হিমবাহ দেখতে পাচ্ছি, সেইটিই বিখযাত সতোপন্ত। অর্থাৎ সামনের বরফে ঢাকা অঞ্চলটা থেকে সতোপন্তের এলাকা শুরু। আর এই সতোপন্তেরই ওপর দিকে, চৌখাম্বার গায়ে হিমবাহ কেমন যেন ধাপ কেটে উঠেছে ওপরে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সিঁড়ি। স্বর্গের সিঁড়ি। আর এই থেকেই তার নাম স্বর্গারোহিনী। সতোপন্ত হিমবাহের ওপরেই আছে সতোপন্ত হ্রদ। যার পৌরানিক গুরুত্ব অনেক। অনেকে বিশ্বাস করেন ঠিক এই হ্রদের ওপরেই সাক্ষাত বৈকুন্ঠের অবস্থান। অর্থাৎ স্বর্গ।


দুরে নিচে অলকানন্দার উৎসস্থল


অনেক্ষন থেকেই মনের ভেতরে খচর খচর করছিলো ওই সামনে দেখা বরফে ঢাকা জায়গাটা। এর আগের বরফটা তেমন সুবিধের ছিলোনা। শুধু তাই বা বলি কেন? অতলান্তিকের ওপারে প্রবাসে থাকাকালিন অজস্র আছাড়, পিছলোনো, মচকানো, খামচানোর অভিজ্ঞতারা ঠেলাঠেলি করে উঠলো মাথার ভেতরে। যাই হোক, পেরোতে হলে, পেরোতে হবে। গুটি গুটি পায়ে সামনে এগোলাম। বরফ দেখেই আমাদের চার নেপালী আনন্দে পাগল হয়ে গেল। পিঠের মালপত্তর নামিয়ে রেখে চারজনে বরফে নেমে হুটোপাটি করতে শুরু করে দিলো। ছেলেগুলো কি খায় কে জানে বাপু ! আমাদের যেখানে দশ পা চলতে জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে কম অক্সিজেনে, এরা আমাদের তিন চার গুন বেশি ওজন নিয়ে তরতর করে উঠছে তো বটেই, তার ওপরে আবার লাফালাফিও করছে। বরফ যেখানে শুরু, সেখানে পা রাখলাম। বিরাট পেছল এমন নয় যদিও, আবার একদম নরম কুড়মুড়ে ভুষভুষে তুষারও নয়। কিছুটা শক্ত বরফই, তবে তাতে পা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খাঁজ কেটে ওপরে ওঠা সম্ভব। আমার ছড়িগাছা বের করলাম। সেটার ছুঁচলো ধাতব মুখ বরফে গিঁথে এগনো যাবে। কিন্তু মুশকিল হলো, এ বরফ আগে থেকে জমে থাকা বরফ নয়, আবার সদ্য পড়া বরফও নয়। এ হলো পাহাড়ের ওপর থেকে ধ্বস নেমে আসা বরফ, যার তলায় পাথর বা খাদ দুইই আছে। আর সেই কারনেই এই ধ্বসের বরফ খুবই বিপজ্জনক। ওপরের পাতলা আবরনের তলায় কোথাও গর্ত বা খাদ থাকলে, আর সেখানে একবার পড়ে গেলে, উঠে আসা প্রায় অসম্ভব। আরো একটা বড় সমস্যা হলো। এই ধরনের বরফে, পা দিয়ে বরফ খুঁড়ে খাঁজ কেটে এগোতে হয় বলে, সাধারন পথ চলার থেকে অনেক বেশী পরিশ্রম হয়। আর একদম খাড়াই উঠতেও হচ্ছে। ফলে দশ বারো পা চলার পর পরই একটু দাঁড়াতে হচ্ছে। কিন্তু দাঁড়ানোও যাচ্ছেনা ভালো করে, কেননা বরফের ওপরে পায়ের চাপ পড়ে বরফ গলছে, আর সে জায়গাটা দস্তুর মত পেছল হয়ে যাচ্ছে। অনুভব করছিলাম টানা বরফের ওপর দিয়ে চলার পরেও পায়ের পাতা ঠান্ডা হয়নি তেমন। জুতোটা ভালোই কাজ দিচ্ছে তাহলে। দেখলাম চেঙ্গিজ খানের দলবলের লোকজনও উঠছে এই জায়গা দিয়ে। আমাদের সঙ্গে ও দলের একটা বিশেষ তফাত হলো, ওপরে ওঠার সময় আমাদের কেউই খুব একটা কথা বলছে না। কিন্তু ও দলের একটা জনা পাঁচেকের উপদল রয়েছে, তাঁরা দেখলাম প্রচন্ড হই হল্লা করে চলেছেন। এবং বেশ আছাড় টাছাড়ও খাচ্ছেন। যদিও ওই দলের সকলেরই প্রায় মালপত্র বহন করার জন্যে আলাদা লোক রয়েছে। ওনাদের পিঠে একটি করে ছোট্ট ব্যাগ।   

তুষার সরণী বেয়ে উত্তরণ

চার পাশে রঙিন পাহাড়ের চুড়ো। রঙিন বলতে সবুজ নয়, কিন্তু স্লেট রঙা পাথরের সঙ্গে সেখানে মিশেছে আরো অনেক রকমের, অনেক রঙের পাথরের স্তর। চেয়ে দেখলে সারা দিন পেরিয়ে যায় এই আশ্চর্য্য জগতকে। পাহাড়ের চুড়োয় ঝকঝকে মুকুটের মত সাদা বরফ। আর সে বরফ আমাদের পায়ের তলাতেও। আমার চেনা জানা পৃথিবীর বাইরে এই দুনিয়া অপার্থীব। নিজেকে কেমন জানি মনে হচ্ছিলো অনধীকার অনুপ্রবেশকারী। এই সৌন্দর্য্য, এই জগত, এ সাধারন মানুষের জন্যে হতে পারে না। আমার হিসেব মতো আজ পর্যন্ত কোন ক্যামেরা বেরোয়নি যা এই জগৎকে আমাদের বৈঠকখানায় পৌঁছে দিতে পারে। হয়ত ঠিক এই অনুভূতি থেকেই এরকম পরিবেশে স্বর্গের কল্পনা করেছেন আমার বহুযুগ আগের কোন পর্যটক। অনেক্ষন ধরে উঠতে উঠতে এক জায়গায় পৌঁছে মনে হলো এবারে একটু বিশ্রাম না নিলে আর চলছে না। এই খাড়াই বরফের ওপর দাঁড়ানো খুব সমস্যার। তাও ভাবলাম বরফের মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় পাথর উঁচু হয়ে আছে, সে গুলোর ওপর একটু বসি গিয়ে। ভাবতেও পারিনি এইখানেই আমি করছি সবচেয়ে বড় ভুল। আমার সামনে আমাদের দলের বাকিরা এগিয়ে গেছে বেশ কিছুটা। কারন আমি মাঝখানে অল্প সময় ছবি তোমার চেষ্টা করছিলাম আর অলকাপুরির কাছে কিছুটা সময় দাঁড়িয়েছিলাম। পেছন দিকে কে কে আছে দেখিনি। তবে আন্দাজ চেঙ্গিজ খানের দলের লোকজন থেকে থাকবে। সকলে বরফের ওপরে যে লাইন ধরে গেছে, সেটা থেকে ডান হাতি সরে গিয়ে আমি কাছের পাথরের ঢিপির দিকে যেতে চেষ্টা করলাম। প্রায় চলেও এলাম। আর হয়ত পা দশেক গেলেই পাথর পেয়ে যাবো। এমন সময় ঘটনাটা ঘটল। এতটাই আকস্মিক, যে আমি মানসিক ভাবে একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। এমন সুন্দর ঝকঝকে একটা দিন। চার পাশের দম বন্ধ করা সৌন্দর্য্য। তার মাঝে এরকম কিছু ঘটতে পারে সে সম্ভাবনাই মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ মনে হলো শরীরটা হালকা হয়ে গেল। পায়ের তলা এবং মাথায় একটা ভাসমান অনুভুতি। প্রথমটা ভালো বুঝতেও পারিনি। যখন বুঝতে পারলাম, ততক্ষনে আমার বুক পর্যন্ত বরফে ঢুকে গেছে। পুরোটাই ঢুকে যেত, কিন্তু আশ্চর্য্যভাবে আমার প্রতিবর্ত্মক্রিয়া কাজ করেছে, এবং আমার হাতের ছড়িটাকে আড়াআড়ি করে বরফের ফাটলের দুই পাশে গেঁথে ফেলেছে, এবং এই ছড়িতে ভর করে আমি দুলছি। ভাবিনি, একটা ভাঁজকরা অ্যালুমিনিয়ামের ছড়ি পিঠের বস্তা সমেত আমার ওজন ধরে রাখতে পারবে কিন্তু এই মুহুর্তে রেখেছে। পায়ের তলায় কিছুই নেই। শূন্যে ঝুলছি। অর্থাৎ যে বরফের ফাটলে পড়েছি, তার নিচেটা আরো অনেক দূর। কোনোভাবে আটকে না গেলে, একেবারে সটান তলায় চলে যেতাম। সেখান থেকে উদ্ধার পাবার আশা প্রায় শূন্য। কেননা একটু পরেই ওপরের ওই ফাটলটুকুও বুঁজে যাবে বরফ পড়িলেই। আর যেহেতু রাস্তা থেকে সরে এসেছি, কেউ লক্ষ্যও করবে না। খুঁজেও পাবে না। অতএব পরিনতি হলো অক্সিজেনের অভাব, ও ঠান্ডায় জমে গিয়ে ধিরে ধিরে মৃত্যু। এবার আসেপাশে দেখলাম। মাথা ঘোরাতেও পারছিনা ভালো করে। তার ওপরে বেশী নড়াচড়া করলে এই বরফ ছড়ি সমেত ভেঙ্গে ঢুকে যেতে পারে। এক একটা সেকেন্ড মনে হতে লাগল এক একটা ঘন্টার মত। আর আমি আড়াআড়ি আটকে যাওয়া লাঠিতে ভর করে ঝুলতে থাকলাম।

আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন, আমার স্মৃতি কি বলছে, কতক্ষন আমি ঝুলেছিলাম, আমার স্মৃতি দাড়ি ফাড়ি চুলকে বলবে ঘন্টা তিনেক। যদি জওন সিং রাওয়াত কে জিজ্ঞেস করেন, সে বলবে মিনিট খানেক। বাকি আপনার ওপরে ছাড়লাম। যখন শুনলাম অকম্পিত স্বরে জওন সিং এর গলায় – “আ রাহা হুঁ দাদা, হিলো মাত”, তখন মনে হলো, তামাম হিন্দুস্তানে এর চেয়ে সুখশ্রাব্য কন্ঠস্বর আর হয়নি, হবেওনা। জওন ভাই ওস্তাদ লোক। আমাকে আলতো টেনে হাতের ভর ধরিয়ে পাস ফিরিয়ে গড়িয়ে দিয়ে গর্তের বাইরে বের করে আনলো। বিশ্বাস করুন, এর চেয়ে ভালো বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা আমি সত্যিই জানিনা, ঠিক কি করে আমাকে টেনে বের করেছিলো। বাইরে বেরিয়ে এসে একটু সময় বরফের ওপর শুয়ে রইলাম। তার পর জওন ভাইয়ের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম। তাকিয়ে দেখলাম ক্রিভাসের গর্তটার দিকে। এরকম একটা আপাত নিরিহ গর্ত যে কি ভয়ংকর হতে পারে, সেটা সম্ভবতঃ ওর ভেতরে না পড়লে বোঝা যাবে না। লক্ষ্য করলাম স্নায়বিক আঘাত পেয়েছি কিনা। হাত পা সব ঠিক মত কাজ করছে, কেউ কাঁপছে না। মোটর স্নায়ু চমৎকার সাড়া দিচ্ছে। পা বাড়ালাম ওপরের দিকে। যত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক স্রোতে ফিরবো, তত তাড়াতাড়ি মানসিক ধাক্কাটা চলে যাবে। এ নিয়ে বেশী ভাবলে বা আলোচনা করলে ভয়টা গেঁথে বসবে। তাই আমার সহযাত্রীদের সঙ্গে এই গর্তে পড়ে যাওয়াটা নিয়ে একেবারেই আলোচনা করিনি গোটা অভিযানে। আরো মিনিট পনের বরফ বেয়ে ওঠার পর সামনে দেখলাম কিছুটা জায়গা একটু চ্যাটালো। আর সেখানে দেখতে পেলাম বরফের মস্ত ফাটল তৈরি হচ্ছে। এখন নাহয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ফাটল, কিন্তু একবার তুষারপাত হলেই এ ফাটল ঢেকে যাবে, আর কোনো মতেই তাকে দেখা যাবে না। সে সময় ওই ভুসভুসে বরফের ওপর পা দিলেই কেলেঙ্কারী।

বরফের ফাটল

এইখানে পৌঁছে কিছু ফোটোশেশন হলো। এক্কেবারে লেখার শুরুতে পাঠক যে ছবিটি দেখতে পাচ্ছেন, সেই ছবি এখানেই তোলা। বুঝতেও পারিনি, নয় নয় করে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় পেরিয়ে গেছে এবং এখন ঘড়ির কাঁটা ১২ ছুঁই ছুঁই। সামনে এখনো বেশ কিছুটা বরফের রাস্তা দেখতে পাচ্ছি। কিছুটা চ্যাটালো অংশের পর সেটা খাড়াইও হয়েছে আবার। বেশীক্ষন সময় না কাটিয়ে তাই ভাবলাম এগিয়ে যাই। সকলেই আবার চলা শুরু করলো। আমরা পূর্ব দিক থেকে এসে অলকাপুরির পর আস্তে আস্তে বাঁ দিকে বেঁকে প্রায় দক্ষিনমুখি। আর একটু গেলেই খুব সম্ভবতঃ চৌখাম্বা ও স্বর্গারোহিনীর সিঁড়ি দেখতে পাবো। আন্দাজ করছি আমাদের ডান দিকের যে উঁচু রিজটা রয়েছে, ওটার অন্যপাশেই সতোপন্ত গ্লেসিয়ার। অর্থাৎ আমরা মূল গ্লেসিয়ারে পৌঁছে গেছি। এই অঞ্চলের নাম সহস্রধারা। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই হাজার হাজার জলের ধারা নেমে আসছে একদম সোজা পাঁচিলের মত আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের ওপর থেকে। জুন মাসের মাঝামাঝি, তাই বরফ গলছে। আর সেই বরফ গলা জল এই ভাবে অসংখ্য ধারায় নেমে আসছে বলেই এর নাম সহস্রধারা। মাঝে মাঝে বিপজ্জনকও বতে, কারন এক এক জায়গায় পাহাড় থেকে নেমে আসা জলের ধারাগুলো মিলে একটু চওড়া হয়ে, জমে থাকা বরফ কেটে বেরোচ্ছে। আর সেই জায়গা গুলো পার হওয়া খুব মুশকিল। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই লাফিয়ে পার হওয়া ছাড়া পেরোনো অসম্ভব। আর জলের ধারা একটু চওড়া হয়ে গেলে তো কথাই নেই। তখন এদিক ওদিক ঘুরে খুঁজতে হয়, কোথায় এতটুকু পেরোনোর মত অনুকুল পরিবেশ রয়েছে। 

সহস্রধারা ও বরফ কাটা জলের নালা। একেবারে ডান দিকে আমাদের দু জন।

আরো ঘন্টা খানেক চলার পর আমরা এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম, সেখানে বরফ থাকলেও, বরফ ছাড়া এমনি পাথরও আছে, আর সেখানে দিব্যি বসে বিশ্রাম নেওয়াও যায়। আমরা ব্যাগপত্তর নামিয়ে বসলাম। আরাম করে হয়ত বসলাম না, কিন্তু অনেক্ষন পর বোঝা নামিয়ে বসতে পেরে দিব্যি আরাম পেলাম। জল খাওয়া হলো। জওন ভাইয়ের ব্যাগ থেকে বেরোলো পরোটা আর আলুর তরকারি। এতক্ষন চলেছি, পরিশ্রমও হয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু দেখলাম আমাদের কারোরই তেমন খিদে নেই। অল্প স্বল্প খেয়ে নেওয়া হলো, কিছুটা জোর করেই। কেননা সেটা না হলে আরো অবসন্ন লাগবে পরিশ্রমের ফলে।  ওদিকে দেখি চেঙ্গিজ খানের দলও আমাদের থেকে মিটার পঞ্চাশেক দূরে বসে খাওয়া দাওয়া করছে। যা বুঝলাম দু দলের মেনুতে পার্থক্য নেই। আর সেই জনা পাঁচেকের উপদল সেই নিয়ে দিল্লির লোস্ট্রভাষায় প্রতিবাদ জানাচ্ছিলো এমন উচ্চাঙ্গে, আমি ভাবলাম বরফের ধ্বসটস না নেমে যায়। ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করি গিয়ে ওনারা ফাইভ কোর্স মিল আশা করেছিলেন কি না। খাওয়া দাওয়ার পর ব্যাগ ঘাড়ে করে চলা শুরু হলো। বুঝতে পারছিলাম ক্লান্তি জাঁকিয়ে বসতে চাইছে। একে তো আমরা প্রায় সাড়ে চার-পাঁচ ঘন্টা চলেছি। তার ওপরে উচ্চতা জনিত অবসাদ, ভারি ওজন আর সবার ওপরে বরফের ওপরে পা দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে পা রাখার জায়গা করে খাড়াই চড়ার অনভস্ত্য পরিশ্রম।

সামনে দেখলাম  একটা রিজ। আমাদের চলতে হবে ওই রিজের ওপর দিয়ে। আমাদের ডান দিকে দেখতে পাচ্ছি অতিকায় সতোপন্ত হিমবাহ। সে হিমবাহ ধরে সোজা দক্ষিনে তাকালে বহু দূরে চৌখাম্বা আর তার নিচে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া স্বর্গারোহিনী হিমবাহ দেখতে পাচ্ছি। দৃশ্যপট তুলনাহীন। চতুর্দিক নিস্তব্ধ, শুধু বহু ওপর থেকে সহস্রধারার জলের শব্দ। আর মাঝে মাঝে হিমবাহের দিক থেকে কড়কড় করে আওয়াজ। সেগুলো পাথর বা বরফ ভাঙ্গার শব্দ। এই বরফ পাথরের মতই শক্ত এবং সেই রকম রঙের। কারন হিমবাহের গতি বছরে হয়ত দু সেন্টিমিটার। কাজেই দশ হাজার বছরে হয়ত ২০০ মিটার এগিয়েছে বরফ। অথচ তার ওপরে পাথর আর নুড়ি জমেছে আবহবিকারের ফলে চারপাশের পাহাড়ের পাথর ভেঙ্গে। উষ্ণায়নের জন্যে হিমবাহের বরফের তলায় আজকাল অনেক দূর পর্যন্ত গলে জল বের হচ্ছে। সেই কারনেই ওপরের বরফের স্তর কোথাও কোথাও পাতলা হয়ে গেছে অনেক খানি। সমস্যা হলো, ওপরের পাতলা বরফের স্তর ও তার ওপরে পড়ে থাকা নুড়ি ও পাথরের আবরন দেখে কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয়, ভেতরে ঠিক কোথায় বরফ পাতলা ও ফাটল ধরেছে। আর ওই ফাটল বা ক্রিভাসে একবার পড়লে দুনিয়ায় কোন শক্তি আর বাঁচাতে পারবে না। নির্ঘাত মৃত্যু। তাই হিমবাহের ওপরে হাঁটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন। আমরা অবশ্য সরাসরি হিমবাহের ওপর দিয়ে না হেঁটে তার ঠিক কানা ধরে ধরে হাঁটছি। আর সে রাস্তাও কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তার নমুনা একটু আগেই দেখে এসেছি।    

ছবির ডান দিকে ছাই রঙা অতিকায় সতোপন্ত হিমবাহ আর দূরে মেঘে ঢাকা চৌখাম্বা ও স্বর্গারোহিনীর ধাপ। একেবারে বাঁ দিকে বহু দূরে বরফের ওপরে দুটি বিন্দু, আমাদের দলের দু জন – ভীম আর বাসা।

রিজ ধরে চলাটা তুলনামূলকভাবে সহজ। কারন খুব বেশী চড়াই ভাঙার কিছু থাকে না। বড় জোর একতলা কি দোতলা সমান ওঠা নামা। কিন্তু সরু একটা জায়গা ধরে চলা। দু পাশে দেখতে দেখতে চলেছি। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম আমাদের সকলেরই ক্ষমতা শেষের দিকে। তার প্রধান কারন বোধহয় বরফের ওপরে চলতে অতিরিক্ত কসরত করে শক্তিক্ষয়। এর সঙ্গে উচ্চতাজনিত একটা ব্যাপার তো আছেই। আমরা সাড়ে চার হাজার মিটারের আসেপাশে উঠে এসেছি। এখানে শারীরিক ক্ষমতা কমতে বাধ্য।  ঘন্টাখানেক চলার পরেই লক্ষ্য করলাম দূরে চৌখাম্বার মাথায় দেখা ছোট্ট এক টুকরো মেঘ আস্তে আস্তে গোটা আকাশ ছেয়ে ফেলছে। আর সামনে বহু দুরের পাহাড় গুলো প্রায় অন্ধকার।  অতটা পাত্তা দিইনি প্রথমটা। দেখলাম মেঘের কিছুটা ছায়া জওন ভাইয়ের মুখেও পড়েছে। আমরা ছোট্ট বিরতি নিয়েছি। পাথরে ঠেস দিয়ে একটু জল খাচ্ছি। জওন ভাই বলল থোড়া জলদি চলো, ওয়েদার ঠিক নেহি লাগ রাহা। জওন ভাই চট করে এরকম বলেনা কখনো। ওর মুখে এ কথা শুনে একটু চিন্তাই হলো। আমাদের আজকের ক্যাম্পসাইট চক্রতীর্থ বলে একটা জায়গায়। সেখান থেকে সতোপন্ত তাল অল্পই দূরে। জল খেয়ে সবে আবার পা বাড়িয়েছি, হঠাৎ শুনি পেছনে একটা কড়কড় গুমগুম করে বিকট আওয়াজ। বেশ পিলে চমকানিয়া শব্দ। এদিক ওদিক পাহাড়ের গায়ে সে শব্দের প্রতিদ্ধনী চলল অনেক্ষন ধরে। যদিও বেশ কিছুটা দূর থেকেই আসছে আওয়াজটা তবুও ভয় ধরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। মনে হচ্ছিলো পাহাড় ভেঙ্গে পড়ছে যেন। বুঝতে পারছিলাম না কি ঘটল। বরফের ধ্বস কি? জওন ভাই পেছনে তাকিয়ে দেখলো। রোদ চলে গেছে বলে রোদ চশমা খুলে রেখেছি আমরা সবাই। জওন ভাইয়ের চোখে যেন মনে হলো আশঙ্কার একটা ছায়া দেখলাম। যাই হোক। ভেবে লাভ নেই। ওটা হয়েছে আমাদের পেছন দিকে। আমাদের আপাতত যেতে হবে সামনে। শ খানেক মিটার এগিয়ে, রিজটা শেষ হয়ে গিয়ে আবার পাহাড়ের ঢাল আর বরফে এসে পড়লাম।
একটু বিশ্রাম। বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়জন আমি। ছবি - দাদা

ইতিমধ্যে হাওয়ার জোর বেড়েছে, মেঘে আকাশ ঘন কালো হয়ে এলো। হাওয়ার চোটে সামনে তাকানো যাচ্ছে না ভালো করে। ঝুর ঝুর করে বরফ পড়ছে। খাড়াই বরফের ওপর হাঁটাটা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, তাপমাত্রা হু হু করে নেমে গেছে অনেকখানি। আর ঝড়ের মত হাওয়ায় মনে হচ্ছে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে। চারপাশে কে কোথায় ঠিক বুঝতে পারছিনা। সামনে অস্পষ্ট দুটো অবয়ব দেখছি মিটার দশেক আগে। মনে হচ্ছে দাদা আর বৌদি। আরো কিছুদুর এগোবার পর আকাশ আর অন্ধকার করে এলো। কিন্তু দুটো পাহাড়ের খাঁজে পড়ে যাবার জন্যে হাওয়ার বেগ কিঞ্চিত কম হলো। দাদা বৌদিকে দেখলাম সামনে। তাদেরও মুখ শুকিয়ে গেছে। একটু আগে গজব দাঁড়িয়ে। বাকিরা সামনের দিকে গেছে বুঝতে পারছি। পায়ের ছাপ রয়েছে অনেক। আমরা সেই ছাপ ধরে ধরে চলতে লাগলাম। এখনো ওপর দিকে উঠছি বটে, কিন্তু খাড়াই কমে এসেছে। কিন্তু বরফ কোথাও কোথাও পেছল, আবার কোথাও এতই পাতলা, পা দিলেই ভেঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল আর পা চলছে না। তার ওপরে কেমন একটা ঘুম ঘুম ঝিমুনি আর কাঁপুনি। একটু পর বুঝতে পারলাম এ সেই বইতে পড়া হাইপোথার্মিয়ার প্রাথমিক উপসর্গ। অর্থাৎ শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখা যাচ্ছে না। যদিও আমি সব রকমের ধরাচুড়ো চাপিয়ে রেখেছি। সবার ওপরে যেটি রয়েছে, সেটি বরফ ও বৃষ্টি আটকায়। তার নিচে মোটা জ্যাকেট। তার তলায় ফুল হাতা মোটা টি শার্ট, তার তলায় আরো একটা টি শার্ট। মাথায় পশমের টুপি, তার ওপরে হুডি। হাতে দস্তানা। পায়ে গরম মোজা, ও বিশেষ ভাবে তৈরি জল ও বরফ নিরোধক গরম প্যান্ট। কিন্তু এত কিছুর পরেও শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে মানে বুঝতেই পারছি কি ভাবে তাপমাত্রা নেমে এসেছে।

আরো কিছুটা যাবার পর দেখলাম সামনে সোজাসুজি আর যাবার উপায় নেই। বরফ গলা জলে একটা বড় হ্রদ তৈরি হয়ে আছে। জলটা আধা বরফ আধা জলে ভর্তি। পায়ের ছাপের রেখা ডান দিকে গেছে, আমরাও সেদিকে চললাম। ডান দিকে পাঁচতলা উঁচু দেওয়ালের মত একটা রিজ। সেটার ধার ধরে ধরেই এগোতে লাগলাম। কিন্তু কিছুটা এগিয়ে দেখি ফের সেই অতিকায় বোল্ডার অঞ্চল, আর সেই সঙ্গে কোথা থেকে কে জানে, অদ্ভুত কিছু শুকনো কাঁটাঝোপ। সেখান দিয়ে পার হয় কার সাধ্যি! আর এখানে এসে পায়ের ছাপগুলোও গেছে হারিয়ে। আমরা বহু কান্ড করে বোলডার টপকাতে লাগলাম। শরীর ক্ষমতার শেষ বিন্দুতে। কেবলই মনে হচ্ছে একটু বসি, একটু বিশ্রাম নিয়ে ঝিমিয়ে নিই। কিন্তু বসলে আর উঠতে পারবো না। দানা দানা বরফ পড়েই চলেছে। মিনিট কুড়ি এদিক ওদিক করে শেষে এক জায়গায় মনে হলো কাঁটাঝোপ কিঞ্চিত হালকা। আমরা সেই দিকে এগোলাম। কিছুটা লাফিয়ে, কিছুটা ঝুলে, টাল খেয়ে, আছাড় খেয়ে, ঘষটে আরো যা যা করা সম্ভব ও অসম্ভব সব কিছু করে বিস্তর কাঁটার আঁচড় সহ্য করে আমরা একটা খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসতে পারলাম। সামনে অন্ধকার হয়ে আসা দৃশ্যপটে দেখতে পেলাম হালকা নীল রঙের দু খানা তাঁবু। বুঝলাম বাসা, ভীম, ধনরাজরা আগেই এখানে পৌঁছে তাঁবু খাটিয়ে ফেলেছে। আমরা টলতে টলতে তাঁবুর দিকে এগোলাম। ততক্ষনে চারিদিক ঘন সাদা বরফে ঢাকা পড়তে শুরু করেছে।

তাঁবুর ভেতরে ঢুকতে হয় হামাগুড়ি দিয়ে। প্রথম খোপে আমাদের জুতো আর ব্যাগ থাকে, পরের খোপে আমরা। ব্যাগ নামিয়ে জুতো খুলতে যাচ্ছি, ধনরাজ এসে হাঁ হাঁ করে উঠলো। পেহলে চায়ে পিজিয়ে, ফির যা না অন্দর। বস্তুতপক্ষে তখন মনে হচ্ছিলো কখন গিয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকবো! চা চাই না। খাবার চাই না। বাড়ি যেতে চাই না। আগেও যেতে চাই না। শুধু তাঁবুতে ঢুকে স্লিপিং ব্যাগে সেঁধোতে চাই। ধনরাজ কোন ওজর আপত্তি শুনলো না। টেনে টুনে ওদের বড় তাঁবুটায় ঢোকালো। সেখানে দেখি কানহাইয়ালাল আর মাধাই বসে আছে গুটিশুটি মেরে। আমরাও বসলাম। এক দিকে স্টোভ জ্বালিয়ে জওন ভাই স্যুপ বসিয়েছে। আমরা ঢুকতেই হাতে এক কাপ গরম গরম স্যুপ পেলাম। সঙ্গে সামনের থালায় পড়লো বিস্কুট। চা টা ঠিক যেন মৃত সঞ্জীবনীর মত কাজ করল। কিন্তু কাঁপুনিটা কিছুতেই যাচ্ছেনা। আর প্রচন্ড অবসন্ন লাগছে, আমরা ঠিক করলাম ৬ জন মিলে একটা তাঁবুর ভেতরেই ঢুকে বসব। কারন বাইরে এত বরফ পড়ছে,আর ঝড়, যে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। ছোট্ট তাঁবু, বসলে মাথা প্রায় ঠেকে যায় চালে। তিন জন কোনক্রমে শুতে পারে। তার ভেতরে আমরা ছ জন ঢুকে বসলাম। সকলেই অত্যন্ত ক্লান্ত। জওন ভাই বলে দিয়েছে মাঝে মাঝে তাঁবুর ওপর থেকে জমা বরফ ঝাঁকুনি দিয়ে ফেলতে। না হলে ওই বরফের চাপেই তাঁবু ভেঙ্গে যাবে। আমরা তাঁবুতেএ ওর ঘাড়ে পা ও এর কোলে মাথা এই ভাবে সেঁধিয়ে গেলাম। সকলেই খুব ক্লান্ত। একমাত্র দেখলাম গজবের উৎসাহের অন্ত নেই। সকলেই জানি, এই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়াটা শরীরের পক্ষে ভালো নয়। আমরা এখন যে জায়গাটায় রয়েছি, সেটা চক্রতীর্থ নয়। তার একটু আগে একটা মোটামুটি ক্যাম্প করার মত জায়গা। এই খারাপ আবহাওয়া আর ঝড়ের মধ্যে আর এগোনো ঠিক হবে না মনে করে জওন ভাই এখানেই ক্যাম্প করার হুকুম দিয়েছে। কাল সকালে দেখা যাবে কি হয়। কিছুতেই গা গরম হচ্ছিলো না। কিছুক্ষন পর  এক রাউন্ড চা পাওয়া গেল। আমরা অল্প অল্প গপ্পগাছা শুরু করলাম। কত দূরে বাংলাদেশ, হাওড়া শহর, কলকাতা, বাড়ি অফিস, মানুষজন। এই সময় বিকেল বেলা আমাদের এলাকায় সদ্য দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। প্রচন্ড গরমে লোকজনের প্রান ওষ্ঠাগত। একটু পর সন্ধ্যে নামলেই আলো ঝলমলে রাস্তায় পা ফেলার জায়গা থাকবেনা ভিড়ের চোটে। কিন্তু সে যেন স্বপ্নের ওপারে অন্য এক দেশ। এখানে এই মুহুর্তে অরকম কিছুর চিন্তা কেমন অবাস্তব লাগছিলো। তাও মনে পড়ছিলো রাস্তার মোড়ের সাইকেলের আওয়াজ, গাড়ির হর্ণ, লোকের ভিড়, সন্ধ্যের শাঁখের আওয়াজ। হঠাৎ ঝাঁকুনি লাগলো জোর। আমাকে সবাই মিলে ঝাঁকাচ্ছে। ঘুম ভাঙাচ্ছে। আমি ঝিমিয়ে গেছিলাম। পালা করে এক এক জন ঝিমিয়ে যায়, আর বাকিরা তাকে জাগিয়ে রাখে। এই ভাবেই চলছিলো। আমাদের সঙ্গে ভাগ্যিস মাথায় লাগানো আলো আছে। সেই আলোই জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁবুর ছাতে আর গায়ে টোকা মেরে মেরে বরফ ফেলা হচ্ছিলো। কিন্তু এত বরফ পড়ছে, তাঁবু হেলে পড়ছে বার বার। কানহাইয়ালাল একবার বেরোলো। বেরোলো মানে এতো আর দরজা খুলে সাধারন বেরোনো নয়, তাকে প্রথমে ঘুরতে হলো, তার পর পায়ে জুতো গলাতে হলো। তার পর হামাগুড়ি দিয়ে বেরোতে হলো। তার পর দাঁড়িয়ে তাঁবুর ওপর থেকে বরফ ঠেলে সরিয়ে আবার ওই কাজ গুলো করে তাঁবুর ভেতরে ঢুকতে হলো। বাইরে তখন ভয়াবহ ঠান্ডা হাওয়া, এবং তাপমাত্রা শূণ্যের বেশ কিছুটা নিচে। সব মিলিয়ে কানহাইয়ালাল ভেতরে ঢুকে মিনিট কুড়ি কোন কথা বলতে পারলো না। ঝিম মেরে রইলো। পরেরবার এই কাজটি করলো গজব। বয়ঃজ্যেষ্ঠ বলেই হয়ত আমাকে কেউ বলেনি বেরোতে। বললেও আমি বেরোতাম কিনা নিশ্চিত নই। কি মনে হওয়াতে সকলের অক্সিজেনের মাত্রা পরীক্ষা করলাম। কানহাইয়া ৮৬%, মাধাই ৭৮%, দাদা বৌদির ওই ৮০র আসেপাশে , গজব ৯০ আমার ৯২।

একথা সেকথায় আমরা ঘন্টা দেড়েক সময় পার করলাম। ঝড়ের দাপট কিছুটা কমলো। বরফপাতও কমে এলো। কিছুটা ভরসা পেলাম। কালকের যাত্রা নিয়ে ভাবছি সকলেই। একটু পরেই ও তাঁবু থেকে ডাক এলো। বাইরে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। অল্প অল্প তুষারপাত হয়েই চলেছে। জওন ভাই থালায় গরম গরম ভাত আর বেশ অনেক রকম সবজি দেওয়া ডাল দিলো বড় এক বাটি করে। সঙ্গে পাঁপড় আর শশা,টমেটো,পেঁয়াজের স্যালাড। কিছুক্ষন বিশ্রাম ও এই উচ্চতায় শরীর নিজেকে মানিয়ে নেবার ফলে প্রথম গ্রাসের পরেই বিশ্বগ্রাসী একটা খিদে অনুভব করলাম। গড়পরতা যা খাই তার চেয়ে কিছুটা বেশিই ভোজন হয়ে গেল। তাঁবুতে ফিরে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢোকার পর খেয়াল হলো আজ ঝড় আর বরফের চোটে আগামী কাল সকালের জায়গাটাই খোঁজা হয়নি। যা থাকে কুল কপালে, সব হবে কাল সকালে, আওড়াতে আওড়াতে চোখ বুঁজলাম।

স্বর্গপ্রান্তে সতোপন্তে

আজ্ঞে হ্যাঁ। সেরকমই লেগেছে বটে। যদিও সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গে দেখি নিশ্বাসের সঙ্গে বেরোনো জলীয় বাস্প বরফের বিন্দু হয়ে জমে আছে তাঁবুর ছাতে। আর তাঁবুর ওপরে বেশ পুরু বরফের পরত জমে ছাত ঝুলে আছে।  অনেক কসরত করে স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরোলাম। আরো অনেক বেশি কসরত করতে হলো জুতো পরতে আর তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসতে। বাইরে এসে দেখি রক্ত জমে যাওয়া ঠান্ডা। আমি আজ আরো এক পরত গরম জ্যাকেট চাপিয়েছি। কাজেই অতটা কাতর হলাম না ঠান্ডায়।যদিও এখন কাক ভোর, সবে সাড়ে পাঁচটা, আর আলোও নরম, তবুও চারিদিকে শুধুই সাদা। দেখলাম আমাদের তাঁবুর পেছন দিকে আরো কিছুটা দূরে আরো কতগুলো তাঁবু। বুঝলাম গতকাল শুধু আমরাই নয়, চেঙ্গিজ খানের দল ও এসে পৌঁছে গেছে। অবশ্য গতকাল যখন খারাপ আবহাওয়ার সময় অত্যন্ত ক্লান্ত শরীরে এগোচ্ছিলাম, তখন মাঝে মাঝে এদিক ওদিক ও দলের কয়েক জন কে দেখতে পাচ্ছিলাম বটে। আমাদের তাঁবু গুলোর ওপরের জমে থাকা বরফ সরানো হলো। এই ঝিরঝিরে বরফের ভেতরেই জায়গা খুঁজে হালকা হওয়া গেল। এবার দরকার একটু গরম কিছু সেবন। ভাবতে ভাবতেই দেখি ভীম তাদের তাঁবুর কানাত সরিয়ে ডাকছে। কাছে যেতেই এক কাপ চা ধরিয়ে দিলো। পেটে চা পড়তেই চাঙ্গা লাগল অনেকটা। এবার এদিক ওদিক দেখলাম ভালো করে। এক দিকে আকাশ ছোঁয়া কালো দেওয়ালের মত একদম খাড়াই পাহাড়। অন্য দিকেও একটা রিজ। তার ওপাশে সতোপন্ত হিমবাহ। বরফ আর মেঘলা থাকার জন্যে বেশী দূর দেখা যাচ্ছে না। ঠান্ডায় হাড়ের ভেতর মজ্জা অবধি কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এরকম অবস্থায় কি ভাবে সামনে এগনো হবে ভেবে পেলাম না। তাঁবুর ভেতরে ঢোকা মানে আবার জুতো খোলা, আবার হামাগুড়ি দেওয়া, আবার ঘুপচি জায়গায় ঢোকা। এদিকে বাইরেও যা কাঁপুনি ধরেছে, তাতে থাকতে পারছিনা। কিছু না পেয়ে পায়চারি শুরু করলাম। এ জায়গাটা একটা বাটির মত। এখানে সেই জন্যে পাহাড়ের আরো ওপর থেকে বরফ গলে নেমে আসা ধারা এসে পড়েছে, ও মাঝে মাঝেই ছোটখাটো সোতা তৈরি হয়েছে। আপাতত বরফে আর ঠান্ডায় সে সব জমে আছে, কিন্তু একবার তাপমাত্রা কিছুটা বাড়লে সেই সোতা গুলো হয়ত জলে ভরে উঠবে, তখন এখানে তাঁবু খাটানো আর হাঁটাচলা করা দুস্কর হএ যাবে। কিছুটা হাঁটাচলা করে একটা জিনিস স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, শরীরে শক্তি অনেক কমে গেছে। সেটা শুধু আমার না বাকিদেরও সেটা জানার ইচ্ছে রইলো। তবে এ ছাড়া আর কোন অসুবিধে বোধ করছিলাম না।  

বরফে ঢাকা ঝাপসা সকাল। এই তাঁবুগুলো চেঙ্গিজ খানেদের

মিনিট দশেক পায়চারি করে ঠান্ডা কিছুটা কমল। দেখলাম বাকিরাও আস্তে আস্তে বেরিয়েছে। দাদা বৌদি আমার আগেই বেরিয়েছিলো। এখন তারা ফিরে আসছে। সবাই আসার পর আমরা এক জায়গায় হয়ে আলোচনা করলাম, আজকের পরিকল্পনা কি। কারোর মতে এই আবহাওয়া আর বরফে এগোনোটা খুব বিপজ্জনক, কারন সামনে ঠিক সতোপন্তের আগে এক কিলোমিটার মত বোল্ডার ভর্তি। সেখানে বরফ ঢাকা পড়ে থাকবে। ফাঁক গলে গেলে আর চিন্তা নেই। তার ওপরে যদি ঝড় ওঠে তাহলে তো হয়েই গেল। অন্য মত বলছে এগিয়েই দেখা যাক না কিছুটা তেমন দেখলে আবার ফিরে আসা হবে। জওন ভাই আমাদের আলোচনায় যোগ দিয়েছে। সব শুনে টুনে বলল দেখাই যাক। কি হয়। তবে হ্যাঁ নিরাপত্তার দিকটা রাখতে হবে সবার আগে। সতোপন্ত থাকবে, আমরাও থাকলে যতবার খুশি আসাই যায় এখানে। আমরা সহমত হলাম। ঝুঁকি নেবোনা কেউ। দেখাই যাক না কতটা যাওয়া যায়। আমরা ঠিক করলাম যতটা হালকা হয়ে যাওয়া সম্ভব আমরা যাবো। কেউ ব্যাগ নেবোনা। ক্যাম্প যেমন আছে থাকবে। শুধু থাকবে জলের বোতল আর লাঠি। আমার সঙ্গে অবশ্য কোমরের পাউচটা থাকবেই। তাতে থাকে টুকটাক ওষুধ, ছুরি, দড়ি, কম্পাস, ম্যাপ আর টুকিটাকি। অনেক ভেবে চিনতে ক্যামেরার ব্যাগ নিলাম না। কারন ওটার ওজন প্রায় চার কিলো। আর সামনে যেখান দিয়ে আমরা যাবো, সেটা প্রায় ৭০ ডিগ্রি খাড়াই বরফ। অতটা ওজন গলায় ঝুললে ব্যালেন্স বিগড়োবেই। এমনিতেই একটা ছোট্ট ব্যাগ থাকছে পিঠে, তাতে থাকছে জলের বোতল। জওন ভাই আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে ফেলল তাড়াতাড়ি। গরম গরম আলুর পরোটা খেয়ে আমাদের চলা শুরু হলো। শুরুর সময়টা দেখছিলাম মাঝে মাঝে মেঘের ফাঁক দিয়ে নীলচে আকাশ উঁকি মারছে। আর আমাদের ঠিক আগে, চেঙ্গিজ খান আর তার দলের অল্প কয়েকজন বেরিয়ে পড়ল আমাদেরই মত। ওদের দলের বাকিরা রয়ে গেল ক্যাম্পে।
চড়াই ভেঙ্গে চলতে থাকা।

প্রথম দুশো মিটার চলার পরেই খাড়াইটা শুরু হয়ে গেল। খাড়াই যেখানে শুরু হয়েছে, তার ঠিক আগে একটা অতিকায় চৌকো পাথর আছে। সে পাথর আড়ে বহরে এক এক দিকে প্রায় ৬০-৭০ ফুট হবে, আর উচ্চতা মোটামুটি ৩০ ফুট। লোকে এটাকে বলে ভীমের সমাধি। তা মধ্যম পান্ডবের মত শক্তিশালী পুরুষের অন্তিম শয্যার উপযুক্ত স্থানই বটে এই জায়গা। ভীমের সমাধি পেরিয়ে চড়াই ভাঙ্গা শুরু করতেই বুঝলাম দূর থেকে যা ভেবেছিলাম, আসল চড়াই তার চেয়ে অনেক বেশী আর অনেক অনেক বড়। যাই হোক, পা যখন বাড়িয়েছি, তখন এসব ভেবে লাভ নেই। মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর হাঁপাতে হাঁপাতে প্রথম থাকটার ওপরে উঠে এলাম। এর পরে আরো আধ খানা থাক ওঠা বাকি। এখানে বসে কিছুক্ষন নিচে দেখলাম। অনেক নিচে ছোট্ট ছোট্ট বিন্দুর মত আমাদের তাঁবু গুলো দেখা যাচ্ছে। মিনিট পাঁচেক জিরিয়ে আবার পাহাড়ে ওঠা শুরু হলো। বরফে পাহাড়ে ওঠায় এখন অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই আলাদা করে কিছু মনে হচ্ছে না। কিন্তু উচ্চতা জনিত পাতলা বায়ুমন্ডল একটা বড় প্রভাব ফেলছে সক্ষমতার ওপর এটাও ঠিক।

আরো আধ ঘন্টা পর ওপরটায় উঠে এসে দেখলাম সম্পুর্ণ বরফে ঢাকা দুটো শৃঙ্গের মাঝখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। শুনলাম আমাদের সামনে ডান দিকে নাকি চৌখাম্বা। কিন্তু প্রচন্ড মেঘ আর কুয়াশার জন্যে আমরা কিচ্ছুটি দেখতে পাচ্ছিলাম না। সামনে আরো কিছুটা এগিয়ে দেখলাম পাহাড়ের গায়ে ঢাল বেলে মিহি বরফের মোটা আস্তরন। এইটি দেখে লোকজন যাহারপরনাই আহ্লাদিত হয়ে কিঞ্চিত “সিলিপ কাটা” খেলে নিলো। তার পর আবার আমরা এগোতে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষন চলার পরে কিছুটা খাড়াই উঠে এক জায়গায় পৌঁছলাম যেখান থেকে সামনে খুব বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না যদিও কিন্তু আন্দাজ করা যাচ্ছে, এর পরে বড় কোন খাড়াই নেই। এদিকে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ঘন কালো মেঘ এসে জমেছে এর মধ্যেই। আলো কমে এসেছে। সকলের মুখের দিকে তাকালাম। ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আর সেই সঙ্গে আমাদের সকলের মুখেও মেঘ জমছে। আগের দিনের আবহাওয়ার দুর্ভোগ আমরা ভুলিনি। ঝটপট সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কেননা এসব জায়গায় সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ার মানে নিজেকে অযথা ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া। একটা জায়গায় আমি আর মাধাই বসেছিলাম। মাধাইয়ের কটা ছবি তুলে দিলাম ওর ক্যামেরায়। আমার ও ছবি তুলেছিলো, কিন্তু সে ছবি এই মুহুর্তে খুঁজে পাচ্ছিনা। এদিক ওদিক খুঁজে এক খানা পাথরের টুকরো খুঁজে তার ওপরে আমার ছুরি দিয়ে খোদাই করে দুটো নাম লিখলাম। আমার মনের খুব কাছের দুটো মানুষের নাম। তার পর পাথরটা যেখানে ছিলো, সেখানেই রেখে দিলাম। সকলের একটা ছবি তোলা হলো গজবের মোবাইলে। ছবি তুলে দিলো ধনরাজ। তার পর আমরা পথ কে বিদায় জানিয়ে ক্যাম্পের দিকে ফিরলাম। আবহাওয়া খুব তাড়াতাড়ি খারাপ হতে শুরু করেছে। 
স্বর্গপ্রান্তে সতোপন্তে

এগিয়ে যাওয়া কি যেতনা? নিশ্চই যেত। বিপদ কি নিশ্চিত ছিলো? নিশ্চিত বলে তো কিছুই হয় না, তবে সম্ভাবনা তো নিশ্চিত ছিলোই। অভিযান কি ব্যার্থ? কখনোই কোন অভিযান ব্যার্থ হয়না। শুধু হয়ত অভিষ্ট লক্ষ্যের থেকে ভিন্ন ভাবে শেষ হয়। রোল্যান্ড আমুন্ডসেন বা এডমান্ড হিলারির চেয়ে কি ক্যাপ্টেন স্কট বা জর্জ ম্যালোরি কোন অংশে কম খ্যাতি অর্জন করেছেন? সব অভিযানই আমাদের কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা দেয়। এ অভিযানও দিয়েছে। আর সেটাই আসল। ঘরে ফিরব অভিজ্ঞতার ঝুলি ভর্তি করে, আর এবারের মত সতোপন্ত কে পেছনে ফেলে। কেননা পরের বার আবার আসতে হবে। আর সেবার এসে নিশ্চই আর কিছুদুর যেতে পারা যাবে। ফেরার সময় আমরা কিছুটা পা চালিয়ে চলার চেষ্টা করছিলাম। কেননা একবার ঝড় আর বরফ পড়া শুরু হলে আমাদের পক্ষে এই বিচ্ছিরি খাড়াই বেয়ে নামা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। এদিকে ঝুর ঝুর করে বরফ পড়তে শুরু হয়েছে। যদিও অল্প। আধ ঘন্টাটাক চলার পরে আমরা খাড়াই জায়গাটার ওপরে এসে দাঁড়ালাম। যাবার সময় এই রাস্তাই আমাদের এক ঘন্টা সময় নিয়েছিলো। নামার সময় জলদি হয়। এবারে এই চরম খাড়াই বেয়ে নামতে হবে। আমার এক পায়ে জোর কম। একটু অসুবিধে হচ্ছে দেখে ভীম এগিয়ে এলো, আমাকে হাতে ধরে কয়েক রকমের কদম ফেলা শিখিয়ে দিলো। গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে বরফে গিঁথে গিঁথে নামা। এবার চলাটা তুলনামূলকভাবে একটু সহজ হলো। বহু নিচে দেখতে পাচ্ছিলাম আমাদের বিন্দু বিন্দু তাঁবু গুলো। এরোপ্লেন যখন মাটিতে নামে, তখন যেমন নিচের বাড়ি ঘর দোর আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে, সেই ভাবেই সব কিছু একটু একটু করে বড় হতে লাগল। তবে ঠিক প্লেনের মত মসৃন ভাবে নয়, আমার অবতরনে গোটা দুই চিৎপটাং, গোটা চারেক হাতের মোচড়, কয়েকটা খ্যাঁচকা আর অল্প হাঁটু ব্যাথা ছিলো। প্রথম বার পাহাড় থেকে নামার সময় একটু হাঁটু ব্যাথা করতেই পারে অনভ্যাসের কারনে। পরের দিন থেকে সেটা ঠিক হয়ে যাবার কথা। আমরা সোয়া বারোটা একটা নাগাদ ফিরে এলাম ক্যাম্পে।  

ক্যাম্পে পৌঁছে একটু বিশ্রামে বসলাম। ওদিকে ততক্ষনে আবহাওয়া বেজায় খারাপ হয়ে পড়েছে। দিন দুপুরে হাড় কেঁপে যাচ্ছে ঠান্ডায়। ঝিরি ঝিরি বরফও পড়ছে। দূরে ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেদিকের আকাশ ঘন কালো, আর কিছুটা দূর থেকে সামনের পাহাড়ের সব কিছু ঝাপসা। বুঝলাম ওদিকে প্রবল তুষারপাত শুরু হয়েছে ততক্ষনে। আমরা যদি গিয়ে পড়তাম ওই দুর্যোগের ভেতরে, তাহলে কি ঘটত কিছুই বলা যায় না।  তিন ধরনের বিপদের আশঙ্কা ছিলো। প্রথমতঃ বোল্ডারের ওপরে হালকা তুষারের আস্তরন, তার ফলে বোল্ডারের খাঁজগুলো দেখা যেতোনা, আর তাতে পা পড়লে সেই ফাটলে পড়ে যাবার আশংকা। দ্বিতীয়তঃ এই প্রবল তুষারপাত ও দুর্যোগের পর গ্লেসিয়ারের ওপরে পথ চেনাবার কিছু চিহ্ণ করা থাকে পাথর সাজিয়ে, সেই গুলো দেখা যাবে না, ফলে আমরা গ্লেসিয়ারের ওপরে গিয়ে পড়তে পারি, ও আরো বড় ক্রিভাসের ভেতর সমাধিলাভ হতে পারে। এবং পরিশেষে, তুষারপাতের কারনে, বাঁ দিকের পাহাড়ের ওপরে জমে থাকা বরফের স্তুপ, ধ্বস হয়ে নেমে এসে আমাদের তুষার সমাধি ঘটতে পারে। আর এর পরে, ওই উন্মুক্ত প্রান্তরে, কোনো সাহায্য ছাড়া অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় হাইপোথার্মিয়া, অর্থাৎ ঠান্ডায় জমে গিয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে। আমরা একটু উষ্ণতার সন্ধানে জওন ভাইদের বড় তাঁবুটায় এসে ঢুকলাম। এখানে খাওয়া দাওয়াও হবে। কারোর মুখেই কথা নেই। এক দিকে সকলেই কিছুটা আশাহত, যে এতদুর এসেও শেষ কিলোমিটার দেড়েক আর যাওয়া গেল না। আবার অন্যদিকে কিছুটা নিশ্চিন্তও যে আমরা অযথা আর বিপদের ঝুঁকি বাড়াইনি। ডাল, ভাত, পাঁপড়, স্যালাড আর আলুর তরকারি দিয়ে খাওয়া হলো। গরম খাবার পেটে পড়তে একটু ঠান্ডার কষ্টটা কমলো। ঘন্টা খানেক পর জওন ভাইয়ের তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখি হাওয়ার তেজ আর ঝুরঝুরে বরফ দুটোই কমেছে। এবং বাইরে দিব্যি হাঁটা যাচ্ছে। যদিও দূরে তাকালে এখনো সেই ঘন কালো মেঘ আর তুষারপাতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া পাহাডের গা।

আমাদের বাইরে ঘোরাঘুরি আর কথা বার্তা শুনে চেঙ্গিজ খানেদের তাঁবু থেকে জনা তিনেক বেরিয়ে এলেন। তিনজনেই মহিলা। এনারা সকালে বেরোননি। আমাদের বাংলায় কথা বলতে দেখেই এসেছেন। এনারাও বাঙালি। আমি ভেবেছিলাম এনাদের গোটা দলটাই হয়ত দিল্লির। কিন্তু এনারা এসেছেন কলকাতা থেকে। এক মহিলা একাই এসেছেন। ওনার নামটা বলেছিলেন, আমি একদম ভুলে গেছি। আর অন্য জুটি মা ও মেয়ে। ভাবলাম একবার বলি, বলিহারি আপনাদের সাহসের। এ রাস্তায় চট করে কেউ আসেনা। একলা ভদ্রমহিলাম বয়স চল্লিসের আসেপাশে। শুনলাম ছেলে আর বর কে বাড়িতে রেখে একলাই এসেছেন ফেসবুক থেকে এই ট্রেকিং দলের তল্লাস লাগিয়ে। হরিদ্বার থেকে বাস ধরে যোশীমঠ পৌঁছেছেন রাত আড়াইটের সময়। কিছুই খুঁজে না পেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন সকাল পর্যন্ত।  মনে মনেই বললুম ধন্যি মেয়ে। কথা বার্তার মধ্যেই দেখি দূরে ঢাল বেয়ে চেঙ্গিজ ও আরো কজন নেমে আসছেন। কাছে আসতে জানা গেল, আমাদের মতই ওনারাও ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। যদিও আরো এগোনোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রবল খারাপ আবহাওয়ায় পড়ে যান। দেখলাম এনাদের অবস্থা বেশ কাহিল। সময় কাটানো এবং গা গরম করার জন্যে এদিক ওদিক হেঁটে বেড়ালাম। আমাদের চার নেপালি, আমাকে ছাড়া বাকি পাঁচ জন এবং চেঙ্গিজের দলের তিন বাঙালি মেয়ে কবাডি খেলতে শুরু করল গা গরম রাখতে। বিকেল চারটে নাগাদ মনে হলো দুরের আকাশ অল্প অল্প পরিস্কার হচ্ছে। আরো ঘন্টা খানেক পর দেখলাম সত্যিই মেঘ সরতে শুরু করেছে। সন্ধ্যে সাড়ে ছটার সময় আকাশে কিছুটা নীল নীল দেখা যেতে লাগল। যদিও সন্ধ্যে সাড়ে ছটা, তাও এদেশে, পশ্চিমে হওয়ার কারনে এ সময় কটকটে রোদ থাকে। পাহাড়ের চুড়া গুলো তখনো মেঘে ঢাকা, চৌখাম্বার পেছনে মেঘে ঢালা সূর্য্য অস্ত গেলেন। আর আমরাও আবার হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে আড্ডা জমালাম। কোথা থেকে কে জানে ধনরাজরা কিছু শুকনো কাঁটা ঝোপ জোগাড় করে আগুন জ্বাললো। আগুনের উত্তাপে ঠান্ডাটা একটু সহনশীল হলো। 
একটু উষ্ণতার জন্য

ঘন অন্ধকার হতে হতে প্রায় রাত আটটা। আর সে সময় আমাদের রাতের খাওয়াও হয়ে যায়। আজও হলো। আর খেয়ে দেয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে প্রচন্ড ঠান্ডায় জমে যেতে যেতে দেখলাম স্বর্গের প্রতিচ্ছবি। একরাশ তারা ভরা আকাশের ফ্রেমে আঁটা জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে চৌখাম্বা ও বালাকুন। ঠিক মুহুর্তে এসে, এক্কেবারে এই মুহুর্তে এসে, এতক্ষনে আমার এবারের যাত্রা সার্থক রূপ পেলো। হ্যাঁ এই দেখতেই তো আসা। এই রূপ দেখার জন্যেই তো বহু শতাব্দী ধরে, আবহমানকাল ধরে আমার পূর্বজ অভিযাত্রীরা ছুটে এসেছেন সব কষ্ট, সব বিপদকে উপেক্ষা করে। আজ আমার সশ্রদ্ধ প্রনাম জানালাম সেই সব অনামা অখ্যাত অভিযাত্রীকে, যাঁরা বছরের পর বছর এই অভিযান কে জীবিত রেখেছেন, মানুষের বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে দেন নি। আর প্রনাম জানালাম এই হিমালয় কে, এই প্রকৃতিকে, এই নীলচে সবুজ ছোট্ট গ্রহটাকে, যে আমাকে এই অপার্থিব দৃশ্যের সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। আমি নাস্তিক মানুষ, কিন্তু এই পরিবেশে এসে অনুভব করতে পারি, মানুষ কোন ভাবাবেগে ঈশ্বরের অস্তিত্ব কল্পনা করে।

আকাশ ভরা অসংখ্য তারার মাঝে জ্যোৎস্না মেখে সামনে সোজা চৌখাম্বা ও তার ডান দিকে বালাকুন শৃঙ্গ

শরীর জমে যাচ্ছিলো। তবুও আশ মিটছিলো না। কি মনে হলো, গুটি গুটি পায়ে তাঁবুর দিকে এগোলাম। যদিও কোন ভাবেই এই স্বর্গীয় দৃশ্যের সামান্য অংশও ক্যামেরাবন্দি করা সম্ভব নয়, তবুও নিতান্তই নিজের স্মারক কটা ছবি হিসেবে রাখার জন্য ক্যামেরাটা বের করলাম। দস্তানা খুলে ফেলাতে আঙুল গুলোয় খুব দ্রুত সাড় চলে যাচ্ছিলো। তার ওপরে ঠক ঠক করে কাঁপছি, ফলে হাত স্থির রেখে ছবি তুলতে পারাও যাবেনা। একটা মধ্যম গোছের চ্যাটালো পাথরের ওপর ক্যামেরাটা বসিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। সেই ছবিই এখানে দিয়েছি। পেছনে তাকিয়ে দেখি দক্ষিনে চৌখাম্বা ও বালাকুনের মুখোমুখি উত্তর প্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন নীলকন্ঠ। সেদিকেও কিছুক্ষন অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে একটা ছবি তুললাম। তার পর কাঁপতে কাঁপতে তাঁবুতে ঢুকে সোওওওওওজা স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে। গত ক দিনে এই প্রথমবার মনে হলো, এবার বাড়ির দিকে পা বাড়ানো যাক। 


তুষার ও জ্যোৎস্না স্নাত নীলকন্ঠের শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে পেছনে

চামতোলি ঘরচলি
ভোর বেলায় ঘুম ভাঙার পর শীতটা বড্ড জাঁকিয়ে বসে। কাজকম্ম সারার পর আমি কিছুক্ষন হেঁটে বেড়াই, যাতে গা গরম হয়। যত বয়স হচ্ছে, ঠান্ডার বোধটা যেন বেড়ে যাচ্ছে। আগে এত শীত করত না। ইতি উতি তাকিয়ে পূবের পাহাড়ের গায়ে বরফের ওপর চোখ আটকে গেল। বরফের ওপরে অতিকায় অক্ষরে কানহাইয়ালালকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। বাপ রে, এ কি ময়দানবের কান্ড নাকি? অবিশ্যি চার খানি সুপারম্যান আমাদের সঙ্গেই আছেন, যাঁরা কোনো ঠান্ডা, বাড়তি ওজন, খারাপ আবহাওয়া এসবে কাবু হন না। আমাদের চার নেপালি ভাই। পরে জানলাম কম্মটি তেনাদেরই, আর পরিকল্পনা ও শিল্প নির্দেশনা মাধাইয়ের। ধণ্যি মেয়ে বাপু। রাত বিরেতে অত ঠান্ডায় ওই উঁচুতে বরফে ঐ সব লিখে এসেছে এরা। আজ দলের একজনের জন্মদিন বলে জওন ভাই ঘোষনা করল দুপুরে পোলাও খাওয়াবে। আর সকালে আমরা খেলাম গরম গরম পুরি সবজি। জওন ভাইয়ের রান্নার হাত দিন কে দিন খোলতাই হচ্ছে।  আসার সময় কর্ণপ্রয়াগে রাওয়াত হোটেল থেকে লাড্ডু কেনা হয়েছিলো। এটাও খাওয়া হলো। এবার আমাদের ফেরার পালা। তাঁবু গোটানো হচ্ছে যখন, মনটা কেমন যেন খারাপ লাগছিলো। পিঠে ব্যাগ এঁটে পা বাড়ানো গেল। আবার সেই কাঁটাঝোপ পেরিয়ে এলাম। বরফে ঢাকা সামনের উঁচু ঢিপিতে ওঠার আগে শেষ বার পেছনে ফিরে তাকালাম। সকালের কাঁচা রোদে ঝলমল করছে চৌখাম্বা আর বালাকুন। এবার আমরা ফেরার পথে পা বাড়ালাম। সামনের কিছুটা রাস্তা কিঞ্চিত উঁচু নিচু হয়ে চলেছে। চলা শুরুর ঘন্টাখানেকের ভেতর আমরা এসে পড়লাম সেই রিজটার সামনে। এখন আমাদের এই রিজের ওপর চড়ে সরু জায়গা দিয়ে হেঁটে যেতে হবে।

সকাল বেলা শেষ বারের মত ফিরে দেখা

রিজ পেরোতে কিছুটা কসরত করতে হলো। আসার সময়েও হয়েছে। প্রায় কিলোমিটার দেড়েক চলার পরে রিজ শেষ হলো। আর এইবারেই সামনের দৃশ্য একেবারে বিষ্ময়ে হতবাক করে দিলো। আমরা আসা র সময় যে জায়গা দিয়ে, যে ভূপ্রকৃতির মধ্যে দিয়ে এসেছি, এখন দেখলাম সেটা আমূল বদলে গেছে। পরশু দিন যাবার সময় পেছনে শুনতে পেয়েছিলাম প্রচন্ড গুড়গুড় গুমগুম আওয়াজ। বরফের ধ্বস নামছিলো। সেই ধ্বস এসে এ অঞ্চলের ভুগোলটাকেই পুরো বদলে দিয়েছে। চারিদিকে কেবল বরফ আর বরফের ছোটোবড় টুকরো। জওন ভাই সাবধান করে দিয়ে বলল যে জায়গাগুলোয় সদ্য বরফ এসে পড়েছে, সে গুলোয় আমরা যেন পা না দিই। বরং পাহাড়ের ঢাল বেয়ে থাকা কিঞ্চিত পুরনো শক্ত বরফের ওপর দিয়ে হাঁটাই ভালো। ভালো সে তো বুঝলুম, কিন্ত ঐ শক্ত ঢালু বরফের ওপর আড়াআড়ি হাঁটা প্রচন্ড কঠিন। কেবল পিছে যাবার আশঙ্কা। কি আর করা? পা বাড়ালাম অগত্যা। ঘন্টা খানেক নাকানি চোবানি আছাড় ইত্যাদি খেয়ে শেষে একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম, যেখান থেকে বরফ একদম খাড়াই নেমে গেছে অন্তত শ দেড়েক মিটার। বহু বহু নিচে দেখতে পাচ্ছি একটু সমতল জায়গা, যদিও সেটাও বরফে ঢাকা। এই প্রায় ৯০ ডিগ্রি ঢাল বেয়ে নামবো কি করে? আমি কিছুই ভেবে পেলাম না। জওন ভাইও দেখলাম কিছু একটা ভাবছে। শেষে, যা থাকে কূল কপালে ভেবে প্রস্তাবটা পেড়েই ফেললাম। বললাম স্লিপ খেয়ে চলে যাবো? আমার প্যান্ট টা বিশেষ ভাবে তৈরি। এ প্যান্ট জলে ভেজে না, বরফও ঢুকতে পারে না। দারুন শক্ত বস্তু দিয়ে তৈরি। যদি বসে বসে স্লিপ খেয়ে নেমে যাই, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি নামাও হবে, আবার পেছলাতেও হবে না। জওন ভাই মাথা নেড়ে সায় দিলো। আর কেউ কিছু বলার বা ভাবার আগেই আমি ধপ করে বসে পড়ে হাত দিয়ে ঠেলা মেরে নিজেকে এগিয়ে দিলাম। আমার পা দুটো শূন্যে, বরফের লাঠি আড়াআড়ি ভাবে কোলের ওপর দুই হাতে ধরা, বাকি দেহ কিঞ্চিত পেছনে হেলে।

কানে শোঁ শোঁ আওয়াজ, ঘষ ঘষ শব্দে তুমুল গতিবেগে নিচের দিকে নামতে থাকা, দ্রুত বড় হতে থাকা সামনে নিচের বরফে ঢাকা অঞ্চল সব কিছুর ওপরে উঠে আমার মনে একটা চরম প্রশান্তি বিরাজ করতে লাগল। যে আমাকে এই চরম খাড়াই হেঁটে নামতে হয়নি। খুব বেশী হলে তিরিশ বা চল্লিশ সেকেন্ডে নিচে এসে গেলাম। থামা বা বেগ কমানোটা মুশকিলের। কিন্তু কি করে কে জানে, হয়ত প্রতিবর্ত্ম ক্রিয়াতেই আমার পায়ের গোড়ালি দুটো বরফের ওপর নেমে এসে ব্রেক কষে আমার একদম ঠিক জায়গায় থামিয়ে দিলো। প্রথমে সোজা হয়ে বসলাম। তার পর হুররে বলে দাঁড়িয়ে উঠে হাত ছুঁড়লাম। একে একে অন্যরাও নেমে এলো। একই পদ্ধতিতে।


বরফে স্লিপ খেয়ে নেমে আসার পরের রাস্তায়। কানহাইয়ালালের পেছনে আমি। ছবি - গজব

কিছুটা বরফে ঢাকা পথ, কিছুটা অসমতল পাথুরে ঢাল এসব টপকে আমরা এসে পৌঁছলাম অলকাপুরির কাছে, এখান থেকে আমাদের ডান হাতি, অর্থাৎ পূব দিকে যেতে হবে। একটা সহজ গোছের বরফে ঢাকা জায়গা পেরোতে পেরোতে দেখলাম সামনে আর তেমন বরফ নেই। পেছন ফিরে বাকিদের বললাম আর বরফ দেখছিনা সামনে। বলে শেষ পদক্ষেপ নিলাম ওই বরফের ওপরে, এর পরের পদক্ষেপই শক্ত পাথরে। কিন্তু ব্যাটা বরফ গেল ভেঙ্গে, আর আমি আবার খেলাম আছাড়। ভাবলাম আগে গুনে রাখলে হতো, ঠিক কতগুলো আছাড় খেয়েছি। এ জায়গাটা থেকে কিলোমিটার দেড়েক গেলেই লক্ষীবন। যেখানে আমরা প্রথম রাতে ক্যাম্প করেছিলাম। কিন্তু আজকের পরিকল্পনা মত আমাদের লক্ষীবনে থামার কথা নয়। আমরা আরো একটু এগিয়ে চামতোলি চলে যাবো, যেখানে প্রথমদিন চেঙ্গিজ খানেদের ক্যাম্প হয়েছিলো। হাঁটতে এবার ক্লান্ত লাগছে। লক্ষীবনের আগে, বিশাল বোল্ডারে আর বরফ গলা জলে ঢাকা পাথুরে অঞ্চলটা পেরোলাম। আমাদের ক্যাম্প যেখানে হয়েছিলো, সেখানে বিশ্রাম নিতে থামা হলো। বেলা একটা বাজে। জওন ভাই আমাদের জন্যে পোলাও বের করল। বড় দু খানা ক্যাসারোলে ভর্তি করে পোলাও এনেছে। এখনো গরম আছে। আমরা বুভুক্ষুর মত খেলাম। আধ ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার চলা শুরু হলো। আসার সময় আন্দাজ ঘন্টাখানেক লেগেছিলো চামতোলি থেকে লক্ষীবন আসতে। কিন্তু এখন খাওয়া দাওয়ার পর পা যেন আর চলতে চাইছে না। সেই কাঁটা ঝোপে ভরা বোল্ডার এলাকা পেরোলাম। উঁচু নিচু হয়ে চলেছি তো চলেইছি। পথ যেন ফুরোয় না। সামনে দেখলাম একটা ঢিপি, সেটার পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। ঢিপির ওপর বসে জওন ভাই বিশ্রাম নিচ্ছে। আমাকে দেখে বলল আগে চলো, আ গয়ে চামতলি। ডিপিটা পেরিয়েই দেখলাম সামনে ঘাসে ঢাকা সমতল অনেকটা। চোখ জুড়িয়ে গেল। ওদিকে দেখি ধনরাজ ভীম আর বাসা তাঁবু নিয়ে টানাটানি করছে। আজকের মত আমাদের হাঁটার সমাপ্তি ঘটল।

চামতোলি

চামতোলি জায়গাটা বড় সুন্দর। তার একটা বড় কারন হয়ত গত কয়েকদিনের টানা বরফ আর ন্যাড়া পাথুরে অঞ্চলে কাটানোর পর এই প্রথম আমরা আবার ঘাসে ঢাকা প্রান্তরে এসে পড়েছি। এখানে প্রানের ছোঁয়া আছে।  একেবারে সামনে সোজা জমি আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে পূব দিকে নেমে গেছে। ঐ দিকেই বহু দূরে দেখা যাচ্ছে বরফে ঢাকা পাহাড়ের চুড়া। ওই পাহাড়ের নিচেই মানা গ্রাম। কাল সেখানে পৌঁছে আমাদের যাত্রা সাঙ্গ হবে। পিঠ থেকে ব্যাগ খুলে নরম ঘাসের ওপর কিছুক্ষন শুয়ে রইলাম। যেদিকে অলকানন্দার খাত, তার উল্টোদিকে খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়ের দিকে তাকালে দেখতে পাচ্ছি অসংখ্য ভুজ গাছের বন। এই গাছের ছাল থেকেই আগেকার দিনে তৈরি হতো ভূর্জ পত্র। যার ওপরে পুথি পত্র লেখা হতো। কলকাতায় বা নানান জায়গার মিউজিয়ামে সে সব পুথিপত্র দেখেছি। কিন্তু চোখের সামনে এই ভুজ গাছ দেখলে কেমন অদ্ভুত লাগে। মজার কথা, এ গাছ নিচের দিকে হয় না। হিমালয়ের ওপরেই কেবলমাত্র জন্মায়। আর এই উচ্চতায় কেবল ওই ভুজ গাছা ছাড়া আর কোন গাছ পালা নেই। কেবল আছে ঘাস। রোম্যান্টিক পাইন গাছের আলপাইন বন আরো অনেক অনেক নিচের জন্মায়। কিছুক্ষন চুপ চাপ শুয়ে থাকার পর দেখলাম এক বয়স্ক ভদ্রলোক আর সঙ্গে আরো দু জন আমাদের তাঁবুর কাছাকাছি তাঁবু ফেলছেন। আমি উঠে গিয়ে ব্যাগ গুলো তাঁবুর ভেতরে ঢোকালাম, কারন বাইরে পড়েছিলো সেগুলো। আমাদের কথা বার্তা শুনে ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে আসছি। কথায় কথায় যা জানতে পারলাম তা প্রায় অবিশ্বাস্য। ভদ্রলোক দুর্গাপুরে থাকেন। অবসরপ্রাপ্ত ইস্পাত কর্মী। ছেলে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন পাহাড়ে পাহাড়ে এই ভাবে ঘুরে বেড়ান। বয়স বললেন একাত্তর বছর। দেখে সেরকমই মনে হয়, তবে চাবুকের মত চেহারা আর ফিটনেসও সেরকম মনে হলো। সবিনয়ে জানতে চাইলাম, কত বছর ধরে পাহাড়ে ঘুরছেন? আন্দাজ করেছিলাম নিশ্চিত ভাবে চল্লিশ কি পঞ্চাশ বছর হবে। আমাকে আবার চমকে দিয়ে বললেন বছর দুয়েক আগে ঠিক করেন পাহাড়ে উঠবেন। তার পর থেকে এখানে ওখানে গেছেন, বলে গোটা কয়েক নাম করা ট্রেক রুটের কথা বললেন। অবাক হয়ে দেখছিলাম ওনাকে। গতকালই সকাল বেলা ভাবছিলাম আমার বয়স তো অনেক হলো, এবার আস্তে আস্তে এসবে ইতি টানা দরকার। কিন্তু ইনি? কি বলি এনাকে? আমার চেয়ে পঁচিশ ছাব্বিস বছরের বড়, আর মাত্র দু বছর আগে, উনসত্তর বছর বয়সে ঠিক করলেন পাহাড়ে উঠবেন। যে বয়সে মানুষ বাড়িতে বসে সকালে খবরের কাগজ, টুক টাক বাজার দোকান, বিকেলে পাড়ার পার্কে বয়স্কদের আড্ডা আর টিভিতে খেলা, খবর বা বা সিনেমায় নিজেকে আটকে ফেলে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ইনি একেবারে অন্য পথে হেঁটেছেন। কতখানি মনের জোর থাকলে এ জিনিস করা যায় ভেবে পেলাম না।

চেঙ্গীজ খানের দল ও এসে গেছে। তারাও এদিক ওদিক বসে আছে। অন্য একটি দলকেও দেখলাম, যারা এখন উঠবে। এরা দিল্লির ছেলে অল্প বয়স্ক। জিজ্ঞেস করল কোথা থেকে আসছি। শুনে টুনে বলল বেঙ্গলি হো কে ইতনি হিম্মত? জওন ভাই সামনেই ছিলো, হেসে ফেলে সবিনয়ে জানালো এখানে যাঁরা আসেন, তাঁদের সিংহ ভাগই বাঙালি। বরং দিল্লির লোকের এদিকে আসার ঘটনা কম। গোঁত খেয়ে দিল্লির ভাই সাহাবের একটু আঁতে লাগল মনে হয়। এক গাদা এদিক ওদিক বেড়ানোর গল্প শুরু করলেন। আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে অল্প হাসলাম। কিছ পরে অল্প অল্প করে একে একে সরে পড়লাম। আমাদের চার নেপালি ভাই দেখলাম ফুর্তির চোটে লাফালাফি করছে। কানহাইয়ালাল সেই লাফালাফির কিছু ছবি তুললো। এবার আমাদের দুই মেয়ে মাঠে নামল। মোবাইলে গান চালিয়ে নাচ শুরু হলো।  বৌদি তালিম পাওয়া নাচিয়ে। মাধাইও ভালোই নাচে। বাকিরাও যোগ দিলো। কেবল আমি আর দাদা বাদ রইলাম। নাচ গানে অনেকটা সময় কাটানো হলো। চা পকোড়া খাওয়া হলো। যদিও বেশ রোদ রয়েছে, তবুও ঠান্ডাটা ভালোই জানান দিচ্ছে। বুঝলাম রোদ চলে গেলে ঠান্ডার কামড়টা জোরদার হবে। এখানে বেশ খোলা প্রান্তর, তাই রোদ থাকতে থাকতে একটু হেঁটে গিয়ে কাল সকালের জন্যে একটা জায়গা দেখে এলাম। সামনেই একটা ঝোরা, সেটার ধারে একটু দাঁড়িয়ে দেখলাম। বোতলে জলও ভরলাম। ফিরে এসে দেখি সবাই মিলে আগুন জ্বালানো হয়েছে। কিন্তু ধনরাজ আর বাসার সেই আগুনে মন ভরলো না। তারা সামনের খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে গেল ওপরে ওই ভুজ গাছের ভেতরে। কি করে উঠলো সে নিয়ে আমার কোনো ধারনে নেই। যদিও চোখের সামনেই উঠলো। স্পাইডারম্যানের মত একদম খাড়া দেওয়ালের মত জায়গা বেয়ে কি করে কে জানে উঠে গেল তারা। পরের ঘন্টা খানেক বেশ উৎকন্ঠায় কাটল। কারন দুজনকে আর দেখা যাচ্ছিলো না, ইতি মধ্যে অন্ধকারও হয়ে গেল। নিচে থেকে চেল্লামেল্লি করে তাদের ডাকা হতে লাগল। অনেক পরে টর্চের আলো দেখা গেল। দুই মক্কেল ফিরলেন। সঙ্গে প্রচুর গাছের ডাল।
বাসার উদ্দাম নাচ, বিল্লা, ধনরাজ আর ভীম বসে তাল দিচ্ছে

একটানা মানা
সকালে ঘুম ভেঙ্গেই যে কথাটা প্রথম মাথায় এলো, সেটা হলো আজ আবার আমাদের সেই হোয়াইট হোল পেরোতে হবে। হোয়াইট হোলের কথা ভেবেই পেটের ভেতরটা কেমন করে উঠলো, ফলে সকালের কাজটা ভারি সহজে হয়ে গেল। ভোর ভোর কিছুক্ষন ঘুরে বেড়ালাম এদিক ওদিক। চামতোলি জায়গাটা বড়ই সুন্দর। গত বছরের বাগিনী গ্লেসিয়ার যাবার সময় লঙ্গাতুলির মত মত না হলেও, বড় সুন্দর জায়গা। যতটুকু পারা যায় দেখে নেওয়া। সক্কাল সক্কাল এক প্রস্থ চা হয়ে গেল। জওন ভাই আলুর পরোটা ভাজছে। খাশা গন্ধ পাচ্ছি। ধনরাজ আর ভীম মিলে তাঁবু গুটোচ্ছে। আজ শেষ দিন বলেই কিনা কে জানে, আমাদের সকলেই একটু দুলকি চালে। রোজকার তাড়া নেই। হোয়াইট হোল বাদ রাখলে বাকি রাস্তা চেনাশোনা এবং উৎরাই। কাজেই কষ্ট কম। খেয়ে দেয়ে আর এক রাউন্ড চা পানের পর আমরা পিঠে ব্যাগ আঁটলাম আবার। যেহেতু এখন উৎরাইয়ে নামা তাই হাঁফ ধরবেনা সহজে। আর উচ্চতাও কমতে থাকার কারনে শারীরিক সক্ষমতাও বাড়তে থাকবে। তবুও আস্তে আস্তে হেঁটে নামাই উচিত। তাড়াহুড়ো করলে অনেক সময়তেই শরীর নিতে পারে না, এবং কতগুলো ক্ষেত্রে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে। আমাদের তাড়া নেই কোনো। কারন পথ কিলোমিটার ছয়েক কি বড় জোর সাত। দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া উচিত। মনে কেবল খচ খচ করতে লাগলো শ্বেত গহ্বর। সকালে চলা শুরুর সময় ক্ষমতা থাকে সবচেয়ে বেশী। কাজেই এই সময়টুকুতে না থেমে যতটা পেরিয়ে যাওয়া যায় ততই ভালো। কিলোমিটার দুই চলার পর হালকা পায়ে চলা দাগ দেখা যেতে লাগল কিছু কিছু জায়গায়।
ফেরার পথে একটা ধ্বস নামা অঞ্চল পেরোচ্ছি আমরা। আমার ঠিক পেছনেই জওন ভাই।

চারিদিকে দেখতে দেখতে চলেছি। আসার সময় এত দিকে চোখ রাখতে পারিনি। কিন্তু এখন দেখছি ভালো করে। গত চব্বিশ ঘন্টায় ভু প্রকৃতির আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। মাঝে মাঝে কিছু ধ্বস নামা অঞ্চল পেরোচ্ছি বটে, কিন্তু সেটুকু বাদ দিলে ঘাস জমি ক্রমশ বাড়ছে। আর পায়ের তলায় পাথরের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা মাটির আভাসও দেখা যাচ্ছে। পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটা একটু কঠিন। তাড়াতাড়ি ক্লান্তি আসে। মাঠি কিছুটা নরম বলে, সেখানে হাঁটার সুবিধে। কিন্তু নিচে নামছি বলে হাঁটু আর পায়ের পেশীর ওপর চাপ পড়ছে অনেক বেশি। সেই সঙ্গে গত কয়েকদিনের ক্লান্তিও আছে। জওন ভাইকে বললাম, ওই হোয়াইট হোলের বরফ পার করবার সময় আমার হয়ত একটু সাহায্য লাগবে। জওন ভাই সেই শুনে বলল, ও পরিকল্পনা করেছে, আমরা হোয়াইট হোল পেরিয়ে আগের রাস্তায় না ফিরে, বরফের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি পেরিয়ে অলকানন্দার অন্য পাড় ধরে মানা ফিরবো। এতে করে এক তো গহ্বরের একদম পাস দিয়ে পেরোতে হবে না, কিছুটা ওপর দিকে বরফের ওপর দিয়ে অলকানন্দার ওপারে চলে গেলেই হবে, আর দ্বিতীয়তঃ এ রাস্তাটা নতুন আর সোজা গিয়ে মানাতে ঢুকে পড়েছে। মনে হলো এটা বেশ ভালো পরিকল্পনা। 

শ্বেত গহ্বরের কাছে এসে পড়া। আমার আগে আগে চলেছে গজব

চলা শুরুর ঘণ্টা খানেকের ভেতরে আমরা এসে পড়লাম শ্বেত গহ্বরের সামনে। বরফে পা রাখা হলো অতি সাবধানে। টাল খাচ্ছিলাম, ভীম ধরে ফেললো। তার পর ওরই শেখানো সেই গোড়ালির ওপর ভর করে এক পা এক পা করে নামতে থাকলাম। শ খানেক মিটার পরেই বরফ সমতল, সেখানে একটু বিশ্রাম নেওয়া হলো। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম কানহাইয়ালাল আর মাধাই ব্যাগ থেকে বর্ষাতির প্যান্ট বের করে পরছে।  বুঝলাম ওরা বরফের ওপর দিয়ে পিছিলে নামতে চায়। এ কথাটা আমারও মনে এসেছিল একবার। কিন্তু এখানে দেখেছিলাম বরফের ভেতরে ছোটোখাটো পাথরের টুকরো জমে রয়েছে। সে সবে আঘাত পেলে বিলক্ষন সমস্যায় পড়তে পারি। তাই আর ও পথে যাইনি। কানহাইয়া আর মাধাই অবশ্য নিরাপদেই পিছলে চলে এলো। এবার অপর পাড়ে যাবার জন্যে কিছুটা বরফের চড়াই ভাঙ্গতে হবে। আশা করলাম এইটিই শেষ বরফে হাঁটা, এর পরে আর বরফ নেই। সেই অল্প অল্প গর্ত করে করে মিনিট পনেরোর ভেতরে চলেও এলাম অলকানন্দার অন্য পাড়ে। এখানে এসে আমরা ব্যাগ নামিয়ে সকলেই কিছুক্ষন বসলাম। কঠিন পথ মোটের ওপর শেষ। এর পরে ঢাল বেয়ে নেমে আর কিলোমিটার চার পাঁচ গেলেই মানায় পৌঁছনো যাবে। আমাদের পেছন পেছন বরফ পেরিয়ে এলো চেঙ্গিজ খানের দল। আমরা চেঙ্গিজ খানের সহকারি গাইডকে বললাম আমাদের সকলের একটা ছবি তুলে দিতে।  

অলকানন্দা পেরিয়ে আসার পর আমাদের পুরো দলের ছবি। ছবিটি তুলে দেন চেঙ্গিজ খানের সহকারি গাইড

এদিকটা দিয়ে হাঁটাটা কিঞ্চিত সহজ মনে হলো। কেননা মানা পর্যন্ত এসে কিছু অত্যুৎসাহী বসুধারা ফলস দেখতে যান। যদিও সে রাস্তা অনেকটাই। মানা থেকে সাত কিলোমিটার মত। তবুও অনেকে যান। এঁকে বেঁকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাস্তা চলেছে। হালকা মনে আমিও চলেছি। জল তেষ্টা পাচ্ছিলো বলে জল খেতে খেতে চলেছি। একটা সময় দেখলাম আমার দুটো বোতলই খালি। এবার সমস্যা। আমি একা একা অন্যদের থেকে কিছুটা এগিয়ে এসেছি। যদিও আমার সামনে আরো এগিয়ে গেছে ধনরাজরা চারজন। রাস্তায় কোন জলের ধারা পেলে বোতল ভরে নেওয়া যাবে, কিন্তু সেরকম কিছুই চোখে পড়ছে না। আরো কিছুটা যাবার পর বহু দূরে নিচে দেখতে পেলাম পাহাড়ের গায়ে একটা সাদা রেখা। ওইটিই মানা গ্রাম। আধ ঘন্টা মত হাঁটার পর অনেকটাই এগিয়ে এসেছি। একটা পাথুরে রাস্তাও পেলাম পায়ের নিচে। এমন সময় দেখি এক প্রৌঢ় দম্পতি রাস্তার ধারে বসে আছেন। দেখে মনে হলো ক্লান্ত। আমাকে দেখেই বললেন গুড মর্নিং। আমি মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করে সুপ্রভাত জানালাম। ভদ্রলোক ইংরিজিতেই জিজ্ঞেস করলেন আমি সতোপন্ত থেকে আসছি কিনা। আমি হ্যাঁ বলাতে আমার হাতটি ধরে ঝাঁকিয়ে দিলেন। উচ্চারন শুনে বুঝলাম দক্ষিন ভারতীয়। জিজ্ঞেস করলাম কতদুর যাবেন? বললেন বসুধারা দেখার ইচ্ছে। সে কত দূর? আমি মোটামুটি একটা আন্দাজ দিলাম। শুনে বললেন জানিনা পঊঁছতে পারবো কিনা। দেখি কতদুর যেতে পারি। গিন্নি আমাকে বোতল এগিয়ে দিলেন জলেন। প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে যদিও, তবুও এক ঢোকের বেশী খেলাম না। কেননা আগে অনেক দূর পর্যন্ত জলের উৎস দেখিনি। এনাদের জল শেষ হলে মুশকিলে পড়বেন। আরো কিছুটা এগিয়ে দেখি আমাদের চার মক্কেল বসে আছে রাস্তার ধারে। বললাম পানি পিলাও। বাসা জলের বোতল এগিয়ে দিলো। ঢক ঢক করে খেয়ে ধড়ে প্রান এলো। আবার হাঁটা শুরু করলাম।

বহু দূরে নিচে পাহাড়ের গায়ে একটা সাদা রেখা। ওইটিই মানা গ্রাম।

মানা যত কাছে আসতে লাগল, আমার মনে বিরক্তির মাত্রা একটু একটু করে বাড়তে লাগল। লোকজনের সংখ্যা বাড়তে লাগল এবং চিৎকার হই হল্লা করা লোকজন, গুটখার পিক ফেলা লোকজন, মাথায় সিঁদুরের তিলক কেটে অল্পবয়স্ক মেয়েদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানো লোকজন, ধর্মব্যবসায়ী, ধান্ধাবাজ, ট্যুরিস্ট, সেলফি শিকারিতে চারিদিক থিক থিক করছে। অলকানন্দার ওপরে ছোট্ট একটি সেতু, সেটির নাম ভীম পুল। ইচ্ছে ছিলো সেখানে একটু দাঁড়াবো। কিন্তু সেলফি তুলতে ব্যস্ত লোকজন এমন ধাক্কাধাক্কি করছে, এতটুকু ইচ্ছে হলো না দাঁড়াতে। সামনেই সরস্বতীর মন্দির। সেখানেও সেই একই রকমের নোংরা ভিড়। এতটুকু আধ্যাত্মিক বা দৈবিক কোনো কিছুর অস্তিত্ব সেখানে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। আরো কিছুদুর গিয়ে দেখি রাস্তার ধারে আমাদের চার মক্কেল বসে আছে। বলল বাকি রা আসুক। আমিও ওদের সঙ্গে বসলাম। টুকটাক গপ্প গাছা হলো। এখান থেকে ভীম পুল দেখা যাচ্ছে। আমরা যেখানে বসে আছি, তার ঠিক পাশ দিয়ে একটা রাস্তা পেঁচিয়ে উঠে গেছে ওপরে সেটা দিয়ে ব্যাস দেবের গুহা দেখতে যাবার স্রোতের মত ভিড় চলেছে। কিন্তু এই বিচ্ছিরি ভিড়ের মধ্যে পড়ে সকালের ফুরফুরে মেজাজটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেল। আধ ঘন্টা পর দেখলাম আমাদের বাকিরা ধির পায়ে ভীম পুল পার হচ্ছে। সকলে এক হয়ে আরো কিছুটা এগোলাম। একটা চায়ের দোকানে আমাদের অপেক্ষা করতে বলে জওন ভাই এগিয়ে গেল। আমরা চা আর পকোড়া খেলাম। বৌদি বলল তুমি যোশীমঠ পৌঁছে আগে দাড়ি কাটবে কাটবে। উদ্ভট লাগছে দেখে। আমার রোজ সকালে ক্ষৌরকর্মের অভ্যেস। এবারে এক দিনও করিনি। কাজেই বেশ বড় হয়ে গেছে দাড়ি গত কদিনে। আমার ফোনে এখনো সিগনাল নেই। গজবের একটা বিএসএনএল এর সিম ওয়ালা ফোন আছে, সেটায় সিগনাল পাওয়া গেল। মায়ের ফোনে ফোন করে শুধু এইটুকু জানিয়ে দিলাম, মানা অবধি চলে এসেছি। যোশীমঠ পৌঁছে ফোন করব। এসব করতে করতেই দেখি জওন ভাই একটা টাটা সুমোর পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এবারের মত হাঁটা শেষ আমাদের।

পরিশিষ্ট
গাড়িতে যোশীমঠ, সেখান থেকে পরের দিন ভোরে বেরিয়ে বিকেলে হরিদ্বার পৌঁছে চল্লিশ ডিগ্রিতে ভাজা ভাজা হওয়া, ভারত সেবাশ্রম সংঘের দালানে শুয়ে বিশ্রাম, রাতের ভোলভো ধরে দিল্লি আর প্লেন ধরে দমদম হয়ে দুপুর ১টায় বাড়ি ফেরার মধ্যে আর তেমন বিশেষ কিছু বলার নেই। তাই সযত্নে ওই অংশ বাদ রাখছি। যে টুকু বলার জন্যে পরিশিষ্ট রাখলাম সে টুকু নিতান্তই এ পথে ভবিষ্যতে যাঁরা আসবেন তাঁদের জন্যে। এ পথে এলে মে – জুন মাস এড়িয়ে চলবেন পাঠক। কেননা আমার অভিজ্ঞতা বলে, বরফ সম্পূর্ণ গলেনা বলে রাস্তা বেশ বিপজ্জনক। স্বাভাবিক ভাবেই, অনেক খুঁটিনাটি আমি এড়িয়ে গেছি, কেননা আমি চাইনি এ লেখা কাউকে স্বর্গারোহিনীর রাস্তায় যাওয়ার থেকে নিরুৎসাহ করুক। বরং যদি কেউ এ লেখা পড়ে ও অঞ্চলে পা রাখেন, তো মনে করব আমার এ লেখা সার্থক। তবে হ্যাঁ আমার আগের লেখায় কিছু শারীরিক প্রস্তুতির কথা বলেছি। আবারও বলছি, উপযুক্ত শারীরিক প্রস্তুতি ছাড়া এসব অঞ্চলে যাবার চেষ্টা না করাই ভালো। তাতে অহেতুক বিপদ বাড়ে। আবার দেখুন, নিজের চোখেই দেখেছি, বাঙালি গৃহবধু, একাত্তর বছরের বৃদ্ধ এঁরাও তো গেছেন ও পথে। শারীরিক সক্ষমতা যেমন দরকার, তেমনি ভাবে মনকেও তৈরি রাখতে হবে। বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে দিশেহারা হয়ে চেল্লামেল্লি করলে (কর্পোরেট দুনিয়ায় যে মনোভাবের জয়জয়কার) কিন্তু ওখানে পরিত্রান পাবেন না। বরং ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে, পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে সে বিপদ থেকে আপনাকে নিজেকেই বেরিয়ে আসতে হবে। আর এসব অভিযানে বিপদ আপনার নিত্যসঙ্গী। এইটুকু মেনে নিয়ে যদি এগোতে পারেন, তাহলে আপনার জন্যে একটি সফল অভিযান অপেক্ষা করছে জানবেন। আর যদি মনে করেন, একলা কি করে যাবেন, কার সঙ্গে যাবেন, কোথায় খোঁজ পাবেন, সে ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। সুলুক সন্ধান আমি দিয়ে দেবো সানন্দে। আর হয়ত বলা যায় না, এই অধম আপনার সঙ্গে ঝুলেও পড়তে পারে আর একবার স্বর্গপ্রান্তে উঁকি দিতে।     

২২টি মন্তব্য :

  1. খুব সুন্দর গল্প। দারুন লাগলো।

    উত্তরমুছুন
  2. পড়ে বেশ আনন্দ হলো, শিহরিত হলাম, তোমার পরিশিষ্ট পড়ে সস্তির নিশ্বাস ফেললাম। বেশ রোমহর্ষক ব্যাপার। আমার মন ভরে গেলো পড়ে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক অনেক ধন্যবাদ দাদা। একটা কথা এখানে লেখা দরকার, সেটা হলো, এবারের ভ্রমন বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করার পেছনে আপনার একটা বড় অবদান আছে। ক্রমাগত উৎসাহ দিয়েগেছেন, আর তার ফলেই লেখাটা শেষ পর্যন্ত দিনের আলোর মুখ দেখেছে।

      মুছুন
  3. আপনার খুঁটিনাটি মনে রাখা এবং তা লিপিবদ্ধ করার ক্ষমতা "বাগিনীর পিঠে" পড়ে জানা ছিল, তাই এবার আর চমৎকৃত হইনি, কিন্তু হওয়ার মতোই ব্যাপার। একনিঃশ্বাসে পড়েছি। অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের থেকে কোনও অংশে কম নয়। খুব ভালো লাগল, সোমনাথ। আমি ওই জায়গায় যাওয়ার সাহস করব না কোনওদিন, কিন্তু আপনার এই অসামান্য বৃত্তান্তের মধ্য দিয়ে খানিকটা হলেও জায়গাটাকে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য থ্যাংক ইউ।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ কুন্তলা। পুরোটা না হলেই বসুধারা অবধি ঘুরে আসা সম্ভব। ফেরার সময় দেখেছি রাস্তা মোটামুটি ভালোই। বাকিটা ইচ্ছে।

      মুছুন
  4. অত্যন্ত সৌভাগ্য লেখক ভীমের সমাধি দেখে অক্ষয় অজয় অবস্থায় ফিরে এসেছেন। বরফ সমাধি ,ধ্বস , বৃষ্টি থেকে স্মৃতি টুকু নিয়ে। আমাদের মত গৃহপালিত জীবরা অবশ্য বলবে প্রকৃতি র কিছু নিজস্ব গোপনতা থাকা উচিত। মানুষের প্রবেশ অধিকার থাকা উচিত নয়। আবার জানার দেখার উৎসাহ আছে বলেই আমরা মানুষ। করোনা ভাইরাস কে ও ধন্যবাদ দেব, এই lockdown না হলে সোমনাথ এত ভাল লেখা এত তাড়াতড়ি প্রকাশ করত না।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এই ব্যাপারে একদম একমত যে প্রকৃতির কিছু জায়গায় মানুষের প্রবেশ উচিত নয়। গত পাঁচ বছরে উত্তরাখন্ড ও হিমাচলের সরকার বহু জায়গায় বিধিনিষেধ বসিয়েছেন। কিন্তু এই পথে স্মরনাতীত কাল থেকে মানুষে যাতায়াত। আর বহু কাল ধরে মনের সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো একটি বার চোখে দেখবো মহাপ্রস্থানের পথ। এই রকম ইচ্ছে আরো দু একটা পথের জন্যে আছে।।জানিনা এ জীবনে কতটা হবে। আমার আফসোস নেই সব না হলে। যে টুকু মনিমুক্ত মেলে পথের ধারে, তাই আমার ভান্ডার ভরে দিয়ে যায়।

      মুছুন
  5. বন্ধু আমার... এত দিনে ও তোর কোনটা যে নেশা আর কোনটা যে পেশা বুঝে উঠতে পারিনি.... তবে আমার মতে তুই যেটাতে হাত দিস সেটাই সোনা হয়ে যায়... তা সে তোর আঁকা ছবি ই হোক বা লেখা.... আর এই হাড় হীম করা পাহাড়ে চড়ার অভ্যাস তোর মধ্যে কখন যে জন্মালো.... তা জানিনা....এবার তো বেশ বিপদেও পড়েছিলি বুঝলাম.... ভাবলাম এর পর হয়তো বিরত থাকবি... কিন্তু dsp retired ভদ্রলোকের কথা আর ওই একলা মহিলার কথা শুনে মনে হলো এরকম আরও চলতে থাকবে.... আর তোর এই বর্ণনা করার অদ্ভুত ক্ষমতা..এমন প্রাণবন্ত.... মনে হয় চোখের সামনে স....ব দেখতে পাচ্ছি,যেন আমি তোর ই সহযাত্রী....তবে তোর মতো গুছিয়ে লেখা টা ঠিক আসেনা তাই যা মনে এলো লিখলাম...হয়তো কিছুটা এলোমেলো।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. নেশা? ঠিকই বলেছিস। একরকম নেশাই। আর এ নেশা এমনই, এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া খুব কঠিন। জীবনে যত রকমের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছি, তাতে যে অভিজ্ঞতা যত ভয়ংকর তার স্বাদ তত তীব্র। আর সেই জন্যেই লেখার কাজটা তত সোজা। বরং নরম সরম অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখাটা বড় বেশী কঠিন।

      মুছুন
  6. Manash vromon r trekking complete korlam just...ashadharon.

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এবার দেশে ফিরলে একবার চলো একটা ছোটোখাটো ট্রেকে যাওয়া যাক

      মুছুন
  7. তোমার লেখার সঙ্গী হয়েই গতবার বাগিনী পিঠে চরেছিলাম...এবারও স্বর্গের পথে আরও কিছুটা মানসভ্রমন হল...সমস্ত খুটিনাটি খুটিয়ে পড়লে মনে হয়...যেন আমিও ছিলাম তোমাদের সাথে...
    অসংখ্য ধন্যবাদ তোমায় ...এই অভূতপূর্ব ভ্রমন অভিজ্ঞতা এমন মনোজ্ঞভাবে তুলে ধরার জন্য৷৷

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. স্থানমাহাত্য, একেবারেই স্থানমাহাত্য। ওখানে বসে ব্যাসদেব মহাভারত লিখে ফেলেছিলেন।।কাজেই বুঝতেই পারছো। আমি তো নিমিত্তমাত্র।

      মুছুন
  8. Akhono pora seshh hoini, jotota porlam tate sei smriti jeno gaye kanta jagachche.mone hochche ami ghore nei.Thik choukhamba r swargarohinir padodeshe bose.r tabu Theke borof gulo sorate jawan bhai k ami help krchi r kanaiyalal dur thke uki mere dekhche😍😍😍

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. চল আর একবার যাই। এবার গেলে অক্টোবরে।।তখন বরফ থাকে না

      মুছুন
  9. Hai bakitao porlam. Notun kichu holar nei. Sudhu duchokher samne bosudhara falls, lakhkhibon, chamtoli eigulor e smriti vese asche.ebar ki r hobe?? Eibarer asha chere diyechi.😑

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এবার মানে, যে বার আবার যেতে পারবো। কখনো তো যাওয়া যাবেই।

      মুছুন
  10. Ami etotai Vaggoban Author amader priyo Somnath dar mukh theke description ta samne bose sunechi.....picture gulo tokhon e chokher samne dekhechilam......lucky got a chance to work closely with this Gentleman....Everything is not about designation it's about the relationship what is called a Elder and Younger brother...thank you Somnath da

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ভীষন ভালো লাগল এই মন্তব্যটি পড়ে। উৎসাহী হলাম পরের লেখার জন্যে।

      মুছুন
  11. সোমনাথ, কানহাইয়ালাল, মাধাই,গজব, দাদা-বৌদির সাথে আমিও পাশাপাশি ঘুরে এলাম, মানস ভ্রমন!!! না না একবারও তা মনেহল না। ঐ যে শ্বেতগহ্বর বা উমমম লক্ষীবন আর ঐ হিম ঝরানো রাতে আকাশের তার দেখা ... আমি তো সাথেই ছিলাম। তবে সারা লেখায় এবারের প্রাপ্ত ওই একাত্তর বছরের যুবক ..... সত্যি এভাবেও জীবনে আর একবার নতুন করে বাঁচা যায়। কুর্নিশ তোদের সবাইকে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আমিও ওনাকে দেখেই আরো উৎসাহী হয়েছি। ওনার নাম, যতদুর মনে পড়ছে পুলক দাস। জানিনা দাস বাবু আমার লেখাটি কখনো দেখবেন কিনা। কিন্তু যদি দেখেন, ওনার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য রইলো।

      মুছুন