বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ভূপর্যটক

- মানে আমি আসলে আমি নই?
- আপনি নিশ্চই আপনি, কিন্তু আপনার স্মৃতিগুলো আপনার নয় মিস্টার মুখার্জী
- মুখার্জী? আমার নাম জগবন্ধু নস্কর, তিনের আট হরি মিত্তির লেন ক...
- ওই যে বললাম মিস্টার মুখার্জী, এই স্মৃতিগুলো আপনার নয়
- আমার নয়? কি বলছেন আপনি ডাক্তারবাবু...আমি যে পস্টো...
- স্পষ্ট মনে করতে তো পারবেনই। মেমরি ইমপ্ল্যান্টেশন করলে সেই সব স্মৃতি আগের চেয়ে অনেক বেশী তাজা হয়ে যায়
- আমার ছেলে,  ছেলের বউ, নাতি... আহা, বড় আদরের নাতি মশায়...
- হ্যাঁ আপনার মেমরি সেই ভাবেই ডিজাইন করা হয়েছিলো মুখার্জীবাবু

- আমি যে, আমি যে..
- আপনি কি?
- গিন্নির করা চায়ের গন্ধটুকুও নাকে লেগে ডাক্তারবাবু। আপনি ডাক্তার তো? মানে আপনাকে দেখে সেরকমই...
- অ্যাবসোলউটলি কারেক্ট মিস্টার মুখার্জী। আমিই আপনার ডাক্তার। ডক্টর পিনাকপানি মিত্র
- ডাক্তারবাবু এসব কি হচ্ছে আমি তো কিছুই..
- না বোঝারই কথা। দাঁড়ান, এই আয়নাটায় নিজেকে দেখুন তো...
- বাবা গো... এ কে? ন্যাড়া মাকুন্দ একটা ইয়ে... আমার দাড়ি কই? আর অত সাধের চুল!!! এই বুড়ো বয়সেও...
- আপনার এই চেহারাই কিন্তু গত ৩০-৪০ বছর আছে মিস্টার মুখার্জী। আপনি এত বড় ভূপর্যটক.....
- আমি?  ভূপর্যটক? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ.. আমার দৌড় পুরী অবধি ডাক্তারবাবু। আর একবার শুধু হরিদ্বার গিয়েছিলাম গিন্নিকে নিয়ে।
- আপনি গত চল্লিস বছরে পৃথিবীর ৯১ টা দেশ ঘুরে ফেলেছেন মিস্টার মুখার্জী।
- মানে???
- কিন্তু দেশের ভেতরটা ভাল করে দেখা হয়নি বলে মাস দেড়েক আগে কলকাতা ফেরেন আর ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নামতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় মাথায়...
- এটা? এটা তো অনেক পুরোনো দাগ ডাক্তারবাবু। এটা তো সেবার সন্তোষের বাড়ির উঠোনে আছাড়....
- পুরোনো দাগ এত লালচে হয়না মিস্টার মুখার্জী?
- তা অবশ্য.... কিন্তু আমি কি সত্যিই মুখার্জী? আমার  নাম?
- সত্যরঞ্জন। আপনার মাথায় যে আঘাত লেগেছিলো তাতে আপনার পুরোপুরি জড়পদার্থে পরিনত হবার একটা আশংকা দেখা দিয়েছিলো মিষ্টার মুখার্জী।
- তার পর?
- আমরা আপনার মেমরি ইমপ্ল্যান্ট করি, আপনার ভেতরে সেই ইমপ্ল্যান্টেড মেমরি একটা তীব্র বাঁচার ইচ্ছে জাগিয়ে তোলে। আপনি দেড় মাস পর আজ প্রথম জ্ঞান ফিরে পেলেন।
- আমি আমি...
- বেশী ভাববেন না, এতে মনের ওপর চাপ পড়বে
- আমার পরিবার পরিজন?
- কেউ নেই মিস্টার মুখার্জী, আপনি একাই বিশ্বভ্রমন করে এসেছেন
- একাই?
- হ্যাঁ এবং আরো ভ্রমন করবেন নিশ্চিত ভাবেই।
- আমার বাড়ি হরি মিত্তির লেনে নয়?
- কখনোই নয়।
- মানে যা যা মনে পড়ছে সব ভূল? আমি আসলে সত্যরঞ্জন মুখার্জী? ভূপর্যটক?
- একদম ঠিক।
- আমি আবার ভূপর্যটন শুরু করতে পারি?
- নিশ্চই পারেন। আপনার শারীরিক অবস্থা বুঝে আপনাকে আমরা এক সপ্তাহের ভেতরেই ছেড়ে দেবো।
- আমি..... আমি...

*****

হাঁফ ছেড়ে বসে আরাম করে একটা সিগারেট ধরালেন সিধু স্যান্যাল। আজকাল সত্যিকারের অভিনয়ের কদর কে দেয়? নেহাত এই নস্কর ছোকরা দিলো। তবে ছোকরার মাথা আছে। বুড়ো বাপ মায়ের তুমুল অশান্তিতে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে খাশা পরিকল্পনা করেছিলো ছোকরা। দিন দুই ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে বাপ কে নিয়ে ভাড়া করা এই ফ্ল্যাটে এনে তুলেছিলো। তাঁকে ডাক্তার সাজিয়ে, আর দুজন নার্স ভাড়া করে হপ্তাখানেকের  নাটক চালিয়ে বাপকে বিশ্বাস করিয়েছে তিনিই সত্যরঞ্জন মুখার্জী। মাথার পুরোনো কাটা দাগকে টাটকা করার মেক আপ টা অবশ্য সিধু স্যান্যালেরই ছিলো।  এই ফ্ল্যাট ছেড়ে একটু আগে যখন উনি বেরোলেন, তখন উনি নিশ্চিত যে উনি ভূপর্যটক সত্যরঞ্জন মুখার্জী। ওনার নামের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, কার্ড, আইডেন্টিটি সবই দেওয়া হয়েছে ওনাকে। আরাম সে দিন চলে যাবার মত টাকা সে অ্যাকাউন্টে মজুদ। উনি আপাতত চললেন দিল্লি। ওখান থেকেই ভারত ভ্রমন শুরু। সারা জীবন কূপমন্ডুক হয়ে থেকেছেন। এবার নাহয় সত্যিই পর্যটক হলেন নস্কর, থুড়ি মুখার্জী বাবু।

সিগারেট শেষ করে উঠলেন সিধু স্যান্যাল। পাশের ফ্ল্যাটে নস্কর গিন্নি রয়েছেন। উনি আবার তন্ত্রসিদ্ধ গুরুমা হচ্ছেন। আগামী কাল ওনার ছুটি।

৪টি মন্তব্য:

  1. ভেবেছিলাম, একটা সাইকোলজিকাল থ্রিলার হবে। এগোচ্ছিলোও সেদিকে। কিন্তু, যথাস্থানে ওই যে টুক করে মোড় ঘুরলো, দারুণ দারুণ 😊

    এছাড়া যেটা বলার ছিলো, সেটা এই যে, একটা অত্যাধুনিক সায়েন্স ফিকশনগত কথোপকথনটা ফেলা হয়েছে একটা আদ্যন্ত ছাপোষা বাঙালি পটভূমিকায় - ব্রাভো।

    মানিকবাবুর আশীর্বাদ নিশ্চই আসবে। 😊

    উত্তরমুছুন