জলে আমার বিলক্ষন ভয়। জলে পড়লে এক্কেবারে পাথরবাটি। একমাত্র
ভরসা ঘাড়ের ওপর ফাঁপা ব্রেনবাকসো। তাইতে ঘিলুর জায়গায় প্রভূতপরিমানে বায়ু ভর্তি
করে দিয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তা, ফলে সে খানা হয়ত রবারের টিউব বা লাইফ জ্যাকেট হয়ে
আমাকে ভাসিয়ে রাখার একটা মরিয়া চেষ্টা করতে পারে। কাজেই নুলিয়া , মাঝি-মাল্লা,
নিদেন পক্ষে সাঁতারজানা লোকজন আমার বড়ই পছন্দের। মানুষের সুবুদ্ধি হয়, কুবুদ্ধি
হয়, আরো অনেক রকম বুদ্ধিই হয়ত হয়। কিন্তু আমি যে দলের মানুষ, সেখানে এসব হয় না।
কারন সুবুদ্ধি বা কুবুদ্ধি যাই বলুন, সেটা হতে গেলে ঘটে সামান্য বুদ্ধির দরকার,
সেখানেই তো বিশাল ঘাটতি। ভয় পেতে গেলে, আগে ভয়ের কারনটা ভেবে বের করতে হয়। যার
এসবের বালাই নেই, সে নির্ভয়। তাই ২০১৭ সালের অক্টোবর নাগাদ যখন প্রথম কথাটা উঠলো,
আমি দুম করে বলে দিলুম লোকজন হিমালয়ে গেলে আমি আছি। তা থাকতে আমার অসুবিধে নেই।
আগেও থেকেছি অনেক। কিন্তু বলে ফেলার কদিন পর অনুর্ধ ১৭ বিশ্বকাপে ব্রাজিল বনাম
জার্মানির খেলা দেখতে গিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে যুবভারতীর মাঝের টায়ারে উঠবার সময় সিঁড়ি
ভাঙতে ভাঙতে, আর প্রবল বেগে হাপরের মত হাঁপাতে হাঁপাতে খেয়াল হলো, কি নিদারুন
বিপদের মধ্যে নিজেকে নিয়ে গিয়ে ফেলতে চলেছি। খুলে কই।
জনগন তো বললে হিমালয়ের ওপরে বেশ নির্জন নির্বান্ধব জায়গায়
ট্রেক করতে যাবে। শুনেই আমার মন বেশ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল আর ঝোঁকের মাথায় বললুম “আম্মো
আচি”। কিন্তু ঘটনা হলো গত ক-বছরে আমার বপুখানি বৃদ্ধি পেতে পেতে আড়ে বহরে যেখানে
পৌঁছেছে, সেই নিয়ে হিমালয়ে উঠলে চাইলে ঠিক কি ঘটতে পারে, তা ভেবে তল পেলুম না। ২০১২
সালে খুব বিচ্ছিরি ভাবে ঠ্যাং ভাঙে আমার খেলতে গিয়ে। বগলে ক্রাচ, কোমর থেকে বুড়ো
আঙুল পর্যন্ত প্লাস্টার এসব সমেত কিছু মাস কাটানোর পর যদি বা পুনরায় দু-পেয়ে হবার
অনুমতি পাওয়া গেল, কিন্তু আগের মত ভাঙা পায়ে সেই জোর আর ফিরলো না। ভাঙ্গা ঠ্যাং ওই
যাকে বলে দেড় ব্যাটারি তাই হয়েই রইল। এর পর আছে কপাল আর সংসর্গ। গত ৬-৭ বছর নিজের
ওপরে বড্ড বেশী অত্যাচার করে ফেলেছি। নিরন্তর মানসিক চাপ, অবসাদজনিত খাদ্যাভ্যাস,
অনিয়মিত বেসামাল জীবনযাত্রা ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়ে আমাকে একজন ১০৪ কিলোর অসুস্থ
রূগ্ন প্রৌঢ়ে পরিনত করে ফেলেছিল।
“যে বসে থাকে তার ভাগ্যও বসে থাকে” গোছের বাংলা বেশ কিছু
ভাবসম্প্রসারন মাথায় ঘুরঘুর করতে শুরু করল। আর কিছু পারি না পারি, কল্পনাশক্তিটি
আমার বরাবরই খুব উর্বর, অনেকটা লালমোহনবাবুর মত। তা এই সব পাঁচরকম ভেবে কদিন পর,
গত ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসের এক বিকেলে আপিসের সামনে “ধুত্তেরি” বলে হাঁটা শুরু
করলাম। মনে হলো, কদিন একটু হাঁটাহাঁটি করলেই শরীরে সাড় ফিরবে, আর তখন হিমালয়েও
চড়তে পারব। কারন খোঁজখবর নিয়ে দেখলুম, যে পথে আমাদের যাবার কথা, সেখানে ঘুরে আসতে
কমবেশী প্রায় ৬২-৬৩ কিলোমিটার হাঁটা। শুরুর ৪০০ – ৫০০ মিটার প্রবল উৎসাহে ভালোই
হাঁটলাম, কিন্তু তার পর শুরু হলো সমস্যা। দু পা হাঁটি, তো বুক হাপরের মত হাঁপায়,
হাঁটু থরথর করে কাঁপে, গোড়ালির ওপর মনে হয় স্টিম রোলার চলছে, মাথা থেকে ঝর ঝর করে
ঘামের নির্ঝরধারা বইতে থাকে, চোখের সামনে ... কেমন যেন ... হলদে হলদে ... কিসের যেন
ফুলের...। এদিকে কতটা হাঁটবো সেটা মোবাইলে মাপছি। একটা পর্যায়ের পর মনে হলো,
আমার যতটুকু ক্ষমতা তার একেবারে শেষ বিন্দুতে পৌঁছে গেছি, আর সম্ভব নয়। মোবাইলে
দেখি ৮০০ মিটারের কিছু বেশী হেঁটেছি, এবং এখানেই ক্ষমতা শেষ। কিন্তু মনে হলো, অন্ততঃ
এক কিলোমিটার না হলে কি রনে ভঙ্গ দেওয়া ঠিক? ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে, ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে
আরো শ দুয়েক মিটার গেলাম। এক কিলোমিটার হাঁটা হলো। কিন্তু তখন খেয়াল করলাম যা
ভাবছিলাম, আসলে তার অর্ধেকটাই শুধু হয়েছে, সমস্যাসমুদ্রের বাকি আধখানা পেরোনো এখনো
বাকি। পান্ডববর্জিত জায়গায় আপিস আমার। শহর থেকে বহুদুরে। যান-বাহন মাথায় রাখুন,
মানুষের মুখের দেখা মেলাই ভার। কাজেই যে এক কিলোমিটার হেঁটে গেছি, সেই এক
কিলোমিটার আমাকে আবার হেঁটেই ফিরতে হবে। অন্য কোন উপায় নেই। একবার মনে হলো রাস্তায়
পা ছড়িয়ে বসে চেল্লামেল্লি করে কাঁদি। কিন্তু সন্ধ্যের ঝোঁক। চারিদিক ঝোপজঙ্গলে
ভরা। কাছেই সুন্দরবন। না জানি কি বেরিয়ে আসে! তাই উলটো দিকে মুখ করে আবার হাঁটা
শুরু করলাম।
পরের দিন সকালে বিছানা থেকে নামতে কষ্ট হচ্ছিল। পায়ের পাতা,
গোড়ালি, হাঁটুতে বিষফোড়ার মত ব্যাথা। কোমর শক্ত হয়ে আছে, ভাঁজ হতে চাইছেনা। পায়ের
ডিমে, থাইতে মনে হচ্ছে কেউ কামড়ে ধরে আছে। অতি কষ্টে লেংচে লেংচে অফিস পৌঁছলুম।
বুঝতে পারলাম আমার আর পায়ে হেঁটে পাহাড় চড়ে হিমালয় দেখা হলো না। মনটা খিঁচড়ে রইল
সারা দিন। দলের বাকিদের জানানো প্রয়োজন, কেননা তারা সেই ভাবে যাত্রার আয়োজন করবে।
বিকেলের দিকে কাজের চাপ সামলে একবার চা খেতে অফিসের বাইরে এলাম। মোবাইল খুলে গুগলে
খুঁজলাম আমাদের গন্তব্য। ছবি গুলো দেখতে থাকলাম। বরফে ঢাকা বিশাল হিমালয়ের
ধ্যানস্থ রূপ, মোহময়, কেমন যেন আবিষ্ট করে ফেলতে শুরু করল। কয়েক মিনিট পরে দেখি, ওই
ব্যাথা সমেত, যন্ত্রনা সমেত, ফোলা সমেত, ফোস্কা সমেত আমার একশো চার কিলোর বপুখানি
গতকালের পথ ধরে থপ থপ করে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে। তখনই বুঝেছিলাম, এই মোহ আমাকে
অনেক ভোগাবে।
২০১৮র জানুয়ারির শেষের দিকে এসে দলের কজন মিলে প্রায় রোজ
গুলতানি হতে লাগল। এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করে যোশীমঠে এক গাইডের খোঁজ পাওয়া গেল, যে
যোশীমঠ থেকে আমাদের বাকি রাস্তায় নিয়ে যাবে। ঘটনাচক্রে আবার দেখি সেই একই নাম এবং
ফোন নম্বর সমেত ওই অঞ্চলের এক ভ্রমন কাহিনিতে গাইড জওন সিং রাওয়াত উপস্থিত। সে
ভ্রমন কাহিনির লেখক ভাতৃপ্রতিম দুর্জয় রায়। তার কলম এবং ভ্রমন, দুটোই আমার চেয়ে
অনেক পোক্ত কাজেই পাঠক ও অঞ্চলের ভাল ভ্রমন কাহিনি পড়তে হলে দুর্জয়ের লেখা খুঁজে
দেখতে পারেন। জওন সিং রাওয়াত আমাদের মোটামুটি একটা ধারনা দিয়েছিল, কেমন রাস্তা, কত
সময় লাগতে পারে এসব নিয়ে। বাকি যাত্রাপথের পরিকল্পনা আমাদের নিজেদেরই। ফেব্রুয়ারি
পড়তেই ট্রেনের টিকিট কাটা হলো। এদিকে এই কমাস থপথপিয়ে বপুর আকার কিছুটা হ্রাস
পেয়েছে। ঠ্যাঙের জোর , দেড় ব্যাটারি থেকে পৌনে দুই ব্যাটারির দিকে যাচ্ছে বলে মনে
হচ্ছে। কিন্তু দলের বাকিদের প্রস্তুতি দেখে নিজেকে নিয়ে একটু চিন্তাতেই পড়ছি বলাই
বাহুল্য। একে তো দলের বাকিরা আমার হাঁটুর বয়সি। তার ওপরে তাদের দৌড়ঝাঁপ আর শারীরিক
কসরতের পরিমান আমার চেয়ে অনেক বেশী।
বাকিদের সম্পর্কে একটু বলি। তাদের সাকিন-ঠিকানা উহ্যই
রাখলাম। তবে যে নামে আমরা আমাদের অভিযানের সময় একে অপরকে ডেকেছি, সেই নামগুলোই
এখানে বলি। প্রথমেই হচ্ছে কানহাইয়ালাল, আমাদের দলের নেতা। তার নাম যদিও
কানহাইয়ালাল নয়, কিন্তু ট্রেকের দ্বিতীয় দিনে তাকে এই নামটাই দেওয়া হয়েছিল। সে
আমার নিজের রক্ত সম্পর্কের ভাই হয়ত নয়, কিন্তু তার চেয়ে কোন অংশে কমও নয়। সে মাঝে
মাঝে আমার অভিভাবক, কখনো শিক্ষক কখনো পথপ্রদর্শক এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমার আজে বাজে
বকবকানি শোনার একমাত্র মনোযোগী শ্রোতা। নিজেকে কি ভাবে ফিট রাখতে হয়, শারীরিক
সক্ষমতার তুঙ্গে নিয়ে যেতে হয়, এবং শারীরিক কসরতকে কি ভাবে উপভোগ করতে হয়, এটা হয়ত
এই ছেলের চেয়ে ভাল কেউ দেখাতে পারবে না। সে নিজেই নিজের অনুপ্রেরনা এবং নিজের
জন্যে নিজেই পরের লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে চলতে থাকে। ভাল শ্রোতা এবং বক্তা, লেখার
আর ছবি তোলার হাত ঈর্ষা করার মত ভাল কিন্তু এই দুটো গুন চুড়ান্ত অবহেলাও করে। এর
পরে আছে দু জোড়া, জোড়া। প্রথমেই আছে জগাই মাধাই। বলাই বাহুল্য এদের নাম জগাই মাধাই
নয়। জগাইয়ের খটোমটো নাম ছোট করে “জগা” করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বছর পঁচিশেকের
একটি সুশ্রী মেয়েকে জনসমক্ষে “জগা” বলে হাঁক পেড়ে ডাক দেওয়াটা একটু বেশীই ইয়ে হয়ে
যাচ্ছিল। তাই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকজন জগা থেকে ওটাকে জগাই করে দিল। আর যেহেতু তার
জুড়িদার আর একজন মেয়ে, একই বয়সি, এবং তার নামের শুরু “ম” দিয়ে, তাই স্বাভাবিক
ভাবেই এই জুড়ির খাতিরে তার নাম হয়ে গেল মাধাই। এর পরে আছে দাদা-বৌদি। অসাধারন
সুন্দর এক জুটি। যারা আমার অর্ধেক বয়সের হয়েও, জীবনের কয়েকটা মূল্যবান শিক্ষা
আমাকে দিয়েছে এই অভিযানের সময়।
রাজধানীতে রাজধানী তে
“আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি।
তুমি এই ঘাটে লাগায়ারে নাও
লিগুম কথা কইয়া যাও শুনি...“
ইয়োরোপে থাকার সময়,
আলিসাহেবের কাছে আব্বাসউদ্দিন আহমেদের গ্রামাফোন রেকর্ড শুনে এক রাশান ভদ্রলোক
বিশ্বাসই করতে পারেননি এই গান আসলে লোকগীতি। বার বার বলেছেন, লোকগীতিতে এত গুলো
নোট এত ওঠাপড়া থাকতেই পারেনা। ভাগ্যভাল ভদ্রলোক বাংলার মাটিতে পা রাখেননি। রাখলে
দেখতেন, দেশটাই সৃষ্টিছাড়া নোট আর ওঠাপড়া সমেত পাগলে ভর্তি। জল-কাদা, খাল-বিল নিয়ে
নিত্যি ঘরকরা মানুষগুলোই কেমন পাহাড়ের নাম শুনলেই লাফায়। মনের ভেতর রঙিলা নায়ের
মাঝি এসে শুধু দুটি কথা কইবার অপেক্ষা। আমার ক্ষেত্রে যেমন কানহাইয়ালাল রঙিলা নাও
এনে ঘাটে ভিড়িয়ে গপ্প জুড়েছিল। তা গপ্পই যখন জুড়ল, রঙিলা নাওখানি যখন বাইতেও রাজি,
তখন বাকি সব কিছু ওর ওপরেই ছাড়া সাব্যস্ত হলো। ট্রেনের টিকিট, দিল্লির বাস টাস,
হরিদ্বার থেকে যোশীমঠের বাহন। এমনকি ছেলেটা লোকজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে সেই কোন চুলোয়
বম্বে রোডের ধারে অতিকায় দোকান থেকে জামা জুতো ব্যাগ মোজা সর্বস্য কিনিয়েছে। সকলের
শারীরিক সক্ষমতা বাড়াবার জন্যে নিরন্তর উপায় ও উৎসাহ দিয়ে গেছে। এবং সর্বোপরি আমার
মত একখানা অকেজো মোট, নিজে থেকে ঘাড়ে করে পাহাড়ে তোলার এবং নামিয়ে আনার দায়িত্ব
গ্রহন করেছে। রোজ সকাল বেলা আমি যে বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করেছি, সেটা
শুধু এই কানহাইয়ালালের নিরন্তর উৎসাহের জন্যেই।টুকটাক জুতো জামা আমিও যোগাড় করলাম।
ব্যাগ ট্যাগ গোছানো সারা।
আস্তে আস্তে যাবার দিন
এগিয়ে এলো। বাড়িতে লোকজন কিঞ্চিত চিন্তিত। এই বয়সে আমার মত লোকে আবার হিমালয়ে চড়তে
যাচ্ছে পায়ে হেঁটে এইরকম পরিকল্পনায় কেউ খুব একটা আস্বস্ত বোধ করছেনা। আমার কন্যা
খুবই চিন্তিত, এবং তারই গলা সবার ওপরে। আমার নিজের মনের ভেতরেও তোলপাড় চলছিল, যদিও
সেটা প্রকাশ করিনি। আমার শারীরিক সক্ষমতা ও অবস্থা, প্রস্তুতি কতটা সম্পূর্ন
হয়েছে, আর আমি সত্যিই এই যাত্রার জন্যে প্রস্তুত কিনা, সেটা বোঝা কোন ভাবেই সম্ভব
নয়, যতক্ষন না হিমালয়ে চড়ছি। আবার অন্যদিকে একটা অদম্য আকর্ষণ সামনে টানছে, বলছে
চলে এসো, হিমালয় হাতছানি দিচ্ছে। আশা আশঙ্কার দোলাচলে কয়েকদিন খুব টানাপোড়েন গেল। একদিকে
উত্তেজনায় মাথা কুটকুট করছে, অন্যদিকে ভয়ে পেটের ভেতর কুলকুল করছে। কিন্তু এসব
বাইরে দেখানো যাবে না মোট্টে। তাহলেই হাজার একটা প্রশ্নচিহ্ণ লেগে যাবে যাওয়ার
ওপরে। তাই বাইরে বেশ নির্বিকার দেখাচ্ছিলাম নিজেকে। রওনা হবার দিন বিকেল বেলা
পিঠের ব্যাগ নিয়ে নিচে নামলাম। জুন মাসের ৮ তারিখ, বিকেল ৪টে, প্রচন্ড গরম। আমার
পরনে হাফ প্যান্ট, চটি আর একটা পাতলা টি-শার্ট। ব্যাগ পিঠে গলিয়ে বাড়ির সদর দরজা
দিয়ে বেরোচ্ছি, দেখি পেছনে আমার মেয়ে, তার মা, আমার মা আর বাবা খুব চিন্তান্বিত
মুখে চেয়ে আছে। পেছনে তাকাতে কেমন বাধল। মনে হলো, এই ভাবে তাকিয়ে থাকলে, উঠোন সমুদ্দুর
পার হওয়া আমার আর হবে না। তাই ব্যস্ত পায়ে হুড়মুড় করে বাইরের রাস্তায় নেমে এলাম।
মনে হচ্ছিল, এরা কেউ যদি একবার ও পিছু ডাকে, আমি হয়ত ব্যাগ নামিয়ে রেখে বাড়ি ফিরে
যাবো।
বাড়ির গলিটা পেরিয়ে আসতেই
একটা বাস পেলাম। আর তাতে উঠেই বাড়ির জন্যে টানটা কমে গেল। মনে হলো, এবার আমার
রাস্তা শুধু সামনের দিকে গেছে। ফেরার রাস্তা হিমালয় টপকে, কাজেই অন্য কিছু ভাবার
উপায় নেই। হাওড়া ইস্টিশনে পৌঁছে ভেপসে গেলাম গরমে আর দুশ্চিন্তায়। গরম তো হবেই,
কিন্তু দুশ্চিন্তা আবার কিসের? ইস্টিশনে ঢুকেই অভ্যেস বসতঃ পকেটে হাত দিয়ে দেখতে
গেলুম ট্রেনের টিকিট নিয়েছি কিনা। এ পকেট ও পকেট হাতড়ে কিছুতেই টিকিটের চিরকুট
বেরুলোনা। কি কেলো রে বাবা! শেষে এত কিছুর পর বিনা টিকিটে হাজির হলুম? শুনেছি
আজকাল নাকি পরিচয় পত্র থাকলেই হয়, কিন্তু চেকার যদি সেইটে না শুনে থাকেন? করে করে
শেষটায় মনে পড়ল টিকিট কেটেছে কানহাইয়ালাল। অতএব টিকিট আমার কাছে থাকবেই না।
দুশ্চিন্তা ৫০% কমল । আমার টি শার্ট ঘামে চপচপ করছে, প্ল্যাটফর্মে লোক থিক থিক
করছে। এদিকে গাড়ি বা সহযাত্রীদের দেখা নেই। কানহাইয়ালালকে দেখতে পেলুম সামনে,
ওদিকে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে রাজধানী এক্সপ্রেসও ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে। জিজ্ঞেস করলুম
“টিকিট???” কানহাইয়া হাতের মুঠোফোন তুলে দেখালো। যাক বাবা, এবার ...। সেদিন
শুক্রবার, জগাই মাধাই আপিসে কায়দা করতে পারেনি, কাজেই তারা দুই মক্কেল আগামী কাল
ভোর বেলা দমদম থেকে উড়ে দিল্লি পৌঁছবে। কামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ট্রেনে ওঠার ঠিক
আগে দাদা-বৌদিকে ফোন করলুম। তারা তৎক্ষনাৎ জানালো, তারা এই প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে,
সব কুছ তৈয়ার। আমরা নিশ্চিন্তে ট্রেনে উঠলুম। নিজেদের জায়গা দেখে শুনে বসেও পড়লাম।
মিনিট কাটছে। ট্রেন প্রায় ছাড়ে ছাড়ে এদিকে দাদা বৌদির পাত্তা নেই। আবার ফোন। এবার
ফোন লাগেনা। ধ্যাত্তেরি !! কামরায় এসির কল্যানে ঘাম একটু শুকোবার উপক্রম করছিল,
কিন্তু এখন টেনশনে আবার... । অবশেষে ফোন লাগল। দাদা-বৌদি জানালো তারা আমাদের জন্যে
প্ল্যাটফর্মেই অপেক্ষা করছে। এদিকে আমরা গাড়িতে উঠে বসে আছি। ভুলবোঝাবুঝি শেষ হতেই
হুড়মুড় করে দুজনে কামরায় উঠলো, আর মৃদু দুলুনি দিয়ে রাজধানী এক্সপ্রেসও হাওড়া
ছাড়ল।
ট্রেনে যাতায়াতের একটা বড়
প্রাপ্তি অচেনা সহযাত্রিদের সঙ্গে আলাপ। আজকাল দেখি লোকজন প্লেনে করে বেড়াতে যায়।
যেটা আমার দু চক্ষের বিষ। ট্রেনে না চাপলে আমার বাইরে যাবার আদ্দেক মজাই মাটি।
চারদিকে একটু দেখলুম। আমরা ৪ জন একটা ৬ বার্থ ওয়ালা খুপরিতে। একটা বার্থ খালি,
আমাদের ছাড়া খুপরিতে রয়েছেন এক মহিলা, বয়স ষাটের কোঠায়, চোখে চশমা, বেশ সম্ভ্রম
উদ্রেককারী চেহারা। ভদ্রমহিলা আমাদের দেখে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন বিকট সাজপোষাক আর
বিটকেল ব্যাগওয়ালা আমরা আসলে কারা। প্রথমেই দাদা বৌদি, ২৫-২৬ এর তাজা দুই মক্কেল,
আর দুটিতে এতটাই মিলমিশ, এক বাথরুম ছাড়া দুজনকে আলাদা করা মুশকিল। এর পরে আছে
কানহাইয়ালাল। পেটানো ঝরঝরে চাবুকের মত চেহারা, মধ্য তিরিশেও ঝানু স্পোর্টসম্যান
দেখেই বোঝা যায়। পরিশেষে আমি। বেঢপ এবং বেখাপ্পা, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, চোখে ভারি
চশমা, তার ওপরে হাফ প্যান্ট। আমাদের সকলের সঙ্গেই একটা করে বড় পিঠের ঝোলাঝাপ্পা
মার্কা ব্যাগ। এরকম উদ্ভট দল দেখে, তারা কি করতে এবং কোথায় চলেছে, সেইটা অনুধাবন
করার চেষ্টা করছিলেন। ইতিমধ্যে জলখাবার এসে গেছে, এবং আমাদের দলের লোকজন জোর গলায়
আলোচনা করে চলেছে নানান বিষয়ে। যেমন – কানহাইয়ালাল রোজ ৫০ কিলোমিটার কি করে সাইকেল
চালায়, আমি কফিতে দুধ চিনি কেন খাই না, আপিসে সবাই কেন রেগে থাকে, শুক্কুরবার
সন্ধ্যেবেলা লঙ্কা আর তেঁতুল জল দেওয়া রাস্তার ঘুঘনি খেলে শনিবার সকালে পেটের
গন্ডগোলের চান্স কতটা, রাজধানী এক্সপ্রেসে
রাতের মেনু কি, দিল্লিতে কেমন গরম, হরিদ্বারে এক রাতে কতগুলো দোকানে খাওয়া সম্ভব,
যোশীমঠে বরফ কতটা পাব ইত্যাদি... প্রভৃতি।
ভদ্রমহিলাকে দেখেই বুঝছিলাম
উনি খুবই ঘেঁটে গেছেন, এদিকে ওনার যথেষ্ট কৌতুহল ও হচ্ছে। শেষে যোগাযোগের সেতু
তৈরি করল একখানা বাসি লাড্ডু। চায়ের সঙ্গে রাজধানীতে সিঙাড়া আর লাড্ডু দিয়েছিল।
লাড্ডুটা বেশ শক্ত, আর কেমন শুকনো। দেখেই মনে হলো কদিনের পুরোনো হতে পারে। যদিও
আমার হিসেবে দিব্যি খাওয়া চলে, অল্প অম্বলের আশংকা থাকতে পারে যদিও। ভদ্রমহিলা
লাড্ডুটি না খেয়ে বৌদিকে জিজ্ঞেস করলেন আমরা লাড্ডু খাবো কিনা। দাদা রাজি হয়ে গেল
বাকিরা কিছু বলার আগেই। খালি বৌদি দেখলুম বেশ কটকটে চোখে তাকিয়ে রইল। বুঝলুম
ব্যাপারটা তোলা রইল। দাদার লাড্ডুর লোভের পরিনতি ভাল হবে না। ভবিষ্যত পরিনতি যাইহোক,
লাড্ডু দিয়ে আপাতত যোগাযোগের সেতু তৈরি হলো। ভদ্রমহিলা যাচ্ছেন দিল্লি। নয়ডায় ভাই
থাকেন, নিতে আসবেন স্টেশনে। ছেলে বৌ নাতি আমেরিকা প্রবাসী, তাই দিল্লিতে ভাইয়ের
কাছে কদিন থেকে যাবেন। এবারে আমাদের পালা। বৌদি ধিরে ধিরে আমাদের উদ্দ্যেশ্য
জানালো। মহিলার বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। আমরা হিমালয়ের ওপরে কোনোচুলোয়
জনমানবশূন্য অঞ্চলে হেঁটে হেঁটে এক হিমবাহে চড়ব। এবং তার পরেই ধেয়ে এল সেই অমোঘ
প্রশ্ন “কেন”। এই প্রশ্ন গত ছ মাসে অসংখ্যবার শুনতে হয়েছে। কিন্তু কাউকেই ঠিকঠাক
উত্তর দিতে পারিনি। এনাকেও কি বলব বুঝে উঠতে পারলাম না। ওদিকে দাদা বৌদি ততক্ষনে
তড়বড় করে বলতে শুরু করেছে, অ্যাডভেঞ্চার, থ্রিল, পাহাড়ের সৌন্দর্য্য, তাঁবুতে
রাত্রিবাস। অনেক কষ্টে ভদ্রমহিলা বলতে পেরেছিলেন – দার্জিলিং সিমলা মানালি গেলেই
তো হয়। এত হাঁটাহাঁটির ধকল পড়েনা। তার ওপরে বাথরুম নেই, পটি পেলে ...। হয়ত এ
প্রশ্নের উত্তর আছে। আবার হয়ত নেইও। এ যেন কিছুটা স্রুডিংগারের বেড়ালের মত। বন্ধ
বাক্সের ভেতরে বেড়ালটা মৃত না জীবিত সেটা বোঝার কোন উপায় নেই। তাই সেক্ষেত্রে
সম্ভাব্যতা হিসেবে, একখানা বেড়াল আসলে হয়ে যাচ্ছে দু খানা বেড়াল, একটা মৃত একটা
জীবিত। এক্ষেত্রেও তাই। যারা এমন বাউন্ডুলের মত বেরিয়ে পড়েছে পিঠের ঝোলা নিয়ে,
তারা বুঝবে কিসের মোহ টেনে নিয়ে যায়, কেমন করে সেই আকর্ষন হাতছানি দিয়ে ডাকে,
এতটুকু তিষ্টতে দেয়না ঘরে শান্তিতে। আর যারা কখনো এই ভাবে বেরোতে পারেনি, হিমালয়
দেখেছে সাজানো হোটেলের বারান্দা থেকে বা গাড়ির জানলা দিয়ে, তাদের বোঝানো ভারি
কঠিন, কিসের আকর্ষনে মানুষ বার বার ছুটে যায়। গপ্পে গপ্পে রাত গড়িয়ে সকাল হলো। জুন
মাসের শুরুতে না থাকে ট্রেন থামানো কুয়াশা, না থাকে ওভারহেড লাইন ছেঁড়া ঝড়বৃষ্টি।
ঝমঝমিয়ে রাজধানী এক্সপ্রেস নতুন দিল্লি স্টেশনে ঢুকে পড়ল নির্ধারিত সময় ঘড়ির
কাঁটায় কাঁটা মিলিয়ে। প্ল্যাটফর্মে সহযাত্রী ভদ্রমহিলাকে বিদায় জানানো হলো। ওনাকে
ওনার ভাই নিতে এসেছেন। ফোন নম্বর দিয়ে উনি বৌদিকে বললেন আমাদের হিমবাহের ওপরে ওঠার
ছবি পাঠাতে।উনি হয়ত তখনো বিশ্বাস করতে পারেননি, এরকম একটা বিদঘুটে গ্রুপ কেন এমন খোদার
খামোখা অভিযানে চলেছে।
প্রানান্তকর ঘন্টা-চার ,
হরিদ্বার ... হরিদ্বার
স্টেশনের বাইরে এসেই
খোঁজতল্লাশ নেওয়া শুরু হলো ফোনে। দমমের উড়ান ঠিক সময়মত নেমেছে কিনা দিল্লিতে।
প্লেন হাইজ্যাক হয়নি তো? জিনিস পত্র হারায়নি তো? সুন্দরী মেয়ে দেখে দিল্লির
রোমিওরা তুলে নিয়ে যায়নি তো? ভোরে উঠেছে বলে পটি হয়েছে তো ঠিক করে? কারন লম্বা
রাস্তা গাড়িতে যেতে হবে। জগাই ও মাধাই
পনের মিনিটের তফাতে দু খানা প্লেনে এসেছে, কারন ওরা আলাদা আলাদা টিকিট কেটেছিল।
দুজন দুজন কে খুঁজে পেয়েছে কিনা। পেয়ে না থাকলে কি করে পাওয়া সম্ভব। দিল্লি
মেট্রোর লাইন সোজা নিউ দিল্লি স্টেশন আসে, কাজেই তারা সেই মেট্রো খুঁজে পেয়েছে কি?
না পেলে ডাইনে দেখুক, কিম্বা বাঁয়ে দেখুক। শেষে দুজনে দু জন কে ফোন করুক। আমরা
ওদের জন্যে অপেক্ষা করছি ইত্যাদি। এর মাঝখানে মাধাই একবার কোনক্রমে বলতে পেরেছিল,
যে প্রায় মাঝরাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে বলে কিছুই খেয়ে আসেনি। প্লেনেও খাবারের বড্ড
দাম। সে খিদের চোটে ... । আর পাঁচটা শহরে স্টেশনের আসেপাশে ভাল খাবার জায়গা থাকে।
কিন্তু নতুন দিল্লি স্টেশনের পাসেপাশে তেমন পদের জায়গা খুব একটা নেই। যা আছে, সেখানে
আলু-মুলে, আলু-ছোলে টাইপ কিছু তিন চার দিনের বাসি বস্তু সুলভে পাওয়া যায়। এদিক ওদিক
ঘুরঘুর করে কয়েকটা পনির কুলচা কিনে নিলাম। নামেই কুলচা। আসলে পিতা-ব্রেডের ভেতরে
আগের রাতের পনিরের তরকারি ভরে মাইক্রোওয়েভে গরম করে বিকিকিরি করছে। তবে আপাতত এতেই
আমাদের খুন্নিবৃত্তি হয়ে যাবে।
আমাদের পরিকল্পনা ছিল এখান
থেকে কাশ্মিরি গেট গিয়ে হরিদ্বারের বাস ধরা। কিন্তু ঘটনাচক্রে একটা ওলা আউটস্টেশন
পাওয়া গেল দিব্যি সস্তায়। বাসের যা ভাড়া তার থেকে বড়জোর ১০% এদিক ওদিক। বুক করা
হলো। ভাই সাহাব জানালেন তিনি আধঘন্টায় আসছেন, আমরা যেন তৈরি থাকি। আমরা তো তৈরিই
আছি, কেবল জগাই মাধাই এলেই হয়। তারা অবিশ্যি তেমন কোন বড় ঘটনা ছাড়াই এসে পৌঁছে
গেল। আর ভাই সাহাবও গাড়ি নিয়ে চলে এলেন যথা সময়ে। কুলচায় কামড় দিতে দিতে গাড়িতে
উঠে বসলাম। দিল্লি ছাড়িয়ে রওনা দিলাম হরিদ্বারের পথে। নতুন দিল্লির ঝাঁ চকচকে
রাস্তাঘাট পেছনে পড়ে রইল। পেছনে পড়ে রইল যমুনার হুই পারের লম্বা লম্বা ফ্লাইওভার।
গাড়ি চলল গাজিয়াবাদ হয়ে মেরঠের পথে। ঝামেলা ঝঞ্ঝাট সামলে এই প্রথমবার আমাদের পুরো
দল এক জায়গায় হয়েছে। ফলে কলকল করে আড্ডা শুরু হলো। কানহাইয়ালাল একে দলের নেতা, তার
ওপরে কিঞ্চিত অন্তর্মুখি। দাদাও কিছুটা চুপচাপ। কিন্তু বাকিরা দিব্যি চালিয়ে গেল।
জগাই আর বৌদি পালা করে পেছনে লাগা শুরু করল বাকিদের। আমাকে খুব একটা খেয়াল করলনা
কেউই, কেননা একে আমি ওদের চেয়ে বয়সে অনেকটা বড়, তার ওপরে বসেওছি পেছনে। কাজেই আমার
সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাদের ঘাড় ঘোরাতে হবে। মাধাইয়ের বাড়ি থেকে একেবারে শেষ
মুহুর্তে এই যাত্রার অনুমতি পাওয়া গেছে, এবং সে অনুমতি পাওয়া গেছে আমাকে দেখিয়েই।
একটা আধবুড়ো লোক যখন যাচ্ছে সঙ্গে, তখন বকা-ধমকানো-কানমোলা টোলা গুলো দিতেই পারবে।
কাজেই মাধাইটাকে একটু চোখে চোখে রাখতে হবে। দলের মধ্যে ওটাই একটু ছেলেমানুষ, অনেকটা
আমার কন্যারই মত।
দিল্লি পেরিয়ে অনেকটা চলে এসেছি। রাস্তার দু ধারে এখনো বেশ ঘন জনবসতি। তবে গ্রামই বটে। অনেক আগে এ রাস্তায়
যখন গেছি বা এসেছি, এত ঘর বাড়ির ভিড় দেখিনি। গ্রামের বাড়ি বলেই বাড়ির বাইরে গুলো সবই
ইঁটের গাঁথুনি, প্লাস্টার নেই। হরিয়ানা বা পাঞ্জাবের তুলনায় পশ্চিম উত্তর প্রদেশের
অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা খারাপ। কাজেই দিল্লি থেকে পানিপত – কার্নাল – চন্ডিগড়ের
রাস্তার জাঁকজমক এখানে নেই। বরং এখনো পুরোনো ধরনের দোকানপাঠ, মানুষজনের চেহারায়
প্রকট মালিন্য এবং দারিদ্র। মানুষজনের মুখে একটা ক্ষুব্ধ অসন্তোষ লেগে রয়েছে।
মোটের ওপর খুব একটা দৃষ্টিসুখকর নয়। মেরঠ পেরোবার পর দৃশ্যপট বদলালো। রাস্তার দুদিকে
বাড়িঘর কমে এলো। এখন দুদিকে খোলা মাঠ। দূরে দূরে গ্রাম। রাস্তায় মানুষজনের চেহারাও
একটু সামান্য যেন নরম সরম। হয়ত জনসংখ্যার ঘনত্ব কম বলেই। মুজফরনগরের উপকন্ঠের
বাড়িঘর দেখা দিতেই পেটের ভেতর কেমন একটা খিদে খিদে ভাব জেগে উঠলো। ভাই সাহাব কে
বলা হলো, কোথাও খাবার জায়গা দেখে দাঁড়াতে। ভাই সাহাব দেখলাম তুরন্ত গাড়ি নিয়ে
হাজির হলেন একটা রেস্তোরাঁর সামনে। বেশ সাজানো গোছানো জায়গা। সামনে আবার ছোট ছোট
গাড়ির মডেল। বেশ একটা ঢাবা ঢাবা ভাব। টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করা হলো কি আছে। যে ছোকরা
অর্ডার নিতে এসেছিল সে সামনে একটা মেনুকার্ড ফেলে দিয়ে চিকেন মটন আন্ডা ইত্যাদি
আউড়ে গেল। জগাই মাধাই মেনু থেকে এদিক ওদিক দেখে বাটার চিকেন, বাটার নান করছিল।
দাদা বলল একটু ভাত হলে মন্দ হয় না। দাদার ছোটবেলা কেটেছে এলাহাবাদে। আমাদের মধ্যে
ওর হিন্দিই সবচেয়ে ভাল। খানা হুকুম হয়ত দাদাই করে ফেলত। কিন্তু আমি মেনু কার্ড
উলটে পালটে দেখি একদম শেষের দিকে লেখা রয়েছে রাজমা চাওল। ছোকরাকে আমার খাশ
হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলুম “আপকা দুকান কা বিখ্যাত খানা কেয়া হ্যায়?”। ছোকরা জাট হলে
কি হবে? আমার হিন্দি দিব্যি বুঝে (অথবা কিচ্ছু না বুঝে) বললে “রাজমা – চাওল”। মানে
ভাত আর রাজমার তরকারি? হে পাঠক, কোন কিছু না ভেবে চিন্তে আমার মাথায় ঢুকলো আমি ওই
রাজমা চাওলই খাবো। এ অঞ্চলে রাজমা চাওলের দর্জা আমাদের বাংলার মাংস ভাতের মত। আমার
দেখাদেখি একে একে বাকিরাও তাই হুকুম করে ফেলল। এক যাত্রায় পৃথক ফল কেউই চায়না।
পেটখারাপ যদি হয়, সবার একই রকম হোক। একটু পরেই গরমাগরম দেরাদুন চালের ঝরঝরে ভাত,
লালচে, ঘনঘন রাজমার তরকারি, একটু পেঁয়াজ কুচি আর আচার এসে হাজির হলো। অল্প একটু
রাজমা তুলে মুখে দিয়ে দেখলাম। রাজমা অত্যন্ত মোলায়েম, প্রায় ক্রিমের মত, মুখে
মিলিয়ে যাচ্ছে। মশলা যথাযথ। তাবৎ বস্তুতে দেশী ঘিয়ের তড়কা মারা হয়েছে। বড় ভাল
লাগল। পাঁচ মিনিটে আমার আর পনের মিনিটে সকলের খাওয়া শেষ। ভরা পেটে আবার চড়লাম
গাড়িতে।
বাইরে বেশ ফুরফুরে আবহাওয়া।
বিকেল হচ্ছে হচ্ছে ভাব। হু হু করে মাঠ-ঘাট খেত-খামার পেরোচ্ছে। বেলাবেলি হরিদ্বার
পৌঁছে যাবো। সন্ধ্যেবেলা হর কি পৌড়িতে বসে আরতি দেখবো, মালাইদার দুধ খাবো এই সব
ভাবছি। এমন সময় রুড়কির উপকন্ঠে এসে সেই ঘটনাটা ঘটল। সামনে লম্বা ট্র্যাফিক জ্যাম। ভাই
সাহাব দেখলাম গুগল ম্যাপের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি হাইওয়ে থেকে নামিয়ে বাঁ দিকের সরু
মেঠো পথ ধরলেন। সেই সঙ্গে শুরু হলো ঝাঁকুনি। এই রাস্তায় বোধহয় শেষ পিচ পড়েছিল
ব্রিটিশ আমলে। তার পর থেকে প্রকৃতির আবহবিকারের ঠেলায় রাস্তার হাল অনেকটা
চন্দ্রপৃষ্ঠের বড় করে রাখা ফোটোগ্রাফের মত। মিনিট পনের পরে ঝাঁকুনির ঠেলায় হাড়গোড়
আলগা হতে শুরু করল। আধ ঘন্টা পরে ভাই সাহাব কে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম যে পথ আর কতটা
বাকি। তাতে ভাই সাহাবের জবাব শুনে পিলে আরো চমকে গেল। এটা নাকি বাইপাস “আন্দাজ”
করে ভাই সাহাব গাড়ি ঢুকিয়েছেন এখন বুঝতে পারছেন না কতটা যেতে হবে। যাই হোক, কয়েক
মিনিট পর দেখলাম ওই সরু রাস্তাতেও সামনে এক ঝাঁক গাড়ির জটলা। ভাই সাহাব গাড়ি থেকে
নেমে পুছতাছ করলেন। বার্তা পাওয়া গেল আর ৬০০-৭০০ মিটার মত গেলেই নাকি অন্য দিক
দিয়ে আবার হাইওয়েতে উঠে পড়া যেত। কিন্তু সামনের জট দেখে তখন আমাদের পেছনে আসা গাড়ি
গুলো আবার উলটো দিকে মুখ ঘোরাতে শুরু করেছে। ভাই সাহাব কে বলা হলো এখানে আটকে না
থেকে পিছু হটি। আরো এক খানা নাকি গলিপথ আছে, যেটা দিয়ে শহরের মাঝ বরাবর হাইয়েছে
ওঠা যায়। ভাই সাহাব নিমরাজি হয়ে গাড়ি ঘোরালেন, এবং প্রায় তিন কিলোমিটার পেছিয়ে এসে
সেই গলির মুখ পাওয়া গেল।
আমি হাওড়ার লোক, সরু গলি
আমাকে খুব একটা প্যাঁচে ফেলতে পারেনা। কিন্তু এই গলি দেখে দমে গেলাম। বড়ই সরু। এবং
উলটো দিক থেকে যদি অন্য একটা গাড়ি চলে আসে কোন গতিকে, তাহলেই চিত্তির। নট নড়চড়ন
হয়ে যাবে। যাই হোক, ঢোকানো হলো গাড়ি গলিতে। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলেছি। দু
দিকে ইঁট বের করা বাড়ি। একটা ছুঁচ গলার জায়গা নেই। মাঝে মধ্যে দু একটা গাড়ি যে
এলোনা উলটো দিক থেকে এমন নয়। গাড়ি এলো, জাঠ বোলিতে কিছু আর্টিলারি ফায়ারিং হলো দু
তরফেই। তার পর এদিকের বাড়ির উঠোন, ওদের গোয়ালঘর এসবে ঠেকে ঠুকে দু খানা গাড়ি একে
অন্যকে অতিক্রম করল। ভাগ্যিস কেশব নাগ রুড়কির গলিতে ফেঁসে যাননি। যদি যেতেন, তাহলে
বাংলার কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর মাধ্যমিক পেরোনো আর হতো না।
মিনিট পয়ঁতাল্লিশ পর একটা মোড়
ঘুরেই দেখি সামনে হাইওয়ের মুখ। আনন্দে আত্মহারা হতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু দেখি হাইওয়ে
ভর্তি বড় বড় ট্রাক আর বাস। সব কিছুই এক্কেবারে নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু। অগত্যা
অপেক্ষা। অনেকক্ষন পর পর ট্রাকবাস ইঞ্চিখানেক করে এগোয়, আর ভাই সাহাব আমাদের গাড়ির
নাক খানা ওই ইঞ্চিখানেক করেই দু খানা ট্রাকের মাঝখানে ঢোকাতে থাকেন। তার আগুপিছু
চলে খাশ জাঠ বোলির আর্টিলারি ফায়ার। সে বোলিকে আক্ষরিক রূপ দেবার হিম্মত আমার নেই।
এদিকে গাড়ির ভেতরে লোকজন নেতিয়ে পড়েছে। জগাই মাধাইয়ের কলকলানি অনেক্ষন বন্ধ। কানহাইয়ালাল
আরো অন্তর্মুখি, দাদা আরো গম্ভীর, বৌদিও কিছুটা ভাবুক হয়ে কানে হেডফোন গুঁজে কিছু
একটা শুনছে। নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছিনা, তাই নিজেকে বর্ননা করার চেষ্টা আর করলাম
না। ভেবেছিলাম হরিদ্বারে পৌঁছে একটু গায়ে জল ঢেলে তাজা হওয়া যাবে। এখন দেখছি গলায়
ঢালার মত জলও কমই অবশিষ্ট। এই প্রানান্তকর ট্র্যাফিক জ্যামের মধ্যে পড়ে আস্তে
আস্তে অনুভুতি গুলো ভোঁতা হতে শুরু করল। কিছুক্ষন পরে দেখি সময়ের হিসেব ও হারিয়ে
যেতে শুরু করেছে। গাড়ি শামুকের মত রুড়কি শহরের বাইরে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় তখনো
প্রচুর যানবাহনের ভিড়। কাজেই গতি বাড়ানো যাচ্ছেনা। ভাই সাহাবের মেজাজ এদিকে সপ্তমে
চড়েছে। কিছু জিজ্ঞেস করতেও ভয় করল। শেষে গুগল ম্যাপ খুলে দেখলাম এখনো হরিদ্বার
অনেকটা পথ। আর ট্র্যাফিক জ্যামের ঠেলায় রাস্তাগুলো সবই লাল লাল দেখাচ্ছে। গাড়ির
জানলার বাইরে ঘিনঘিনে শহুরে ভিড় আর আওয়াজ। আমরা জ্যামে পড়েছিলাম বিকেল পৌনে
চারটেয়। রাত আটটার সময় হরিদ্বার রেল স্টেশনের একটু আগে একটা পেট্রলপাম্পে এসে আমরা
অবতরন করলাম।
চারঘন্টার প্রানান্তকর
ট্র্যাফিক জ্যামের পর শরীরে আক্ষরিক অর্থেই তখন আর ক্ষমতা নেই। চারিদিকে থিক থিকে
ভিড়। শুধু কালো কালো মাথা। এবং এত ভিড়ে যা অবশ্যম্ভাবি, কোন হোটেলেই ঘর পাওয়া গেল
না। এদিক ওদিক ঘুরে, যোশীমঠে আমাদের গাইড জওন সিং রাওয়াতের কিছু যোগাযোগ লাগিয়ে
কিছু পরে হোটেল মিলল। দু খানা ঘর। অত্যন্ত নোংরা। টিমটিমে আলো, বিষন্ন চেহারার
দেওয়াল। আমি দাদা আর কানহাইয়ালাল একটা ঘরে ঢুকে গেলাম। বৌদি আর জগাই মাধাই অন্য
ঘরে সেঁধোলো। ঝটপট হাত মুখ ধুয়ে আবার বেরোনো হলো। কারন ইতিমধ্যে ৯টা বেজে গেছে।
আমাদের খাওয়া দাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে কেননা কাল ভোর ৫টায় গাড়ি পাওয়া
গেছে একটা। সে যোশীমঠের গাড়ি। যাত্রি পৌঁছতে এসেছিল হরিদ্বার, এখন ফিরবে। তাই কম
খরচায় হয়ে যাবে। কিন্তু শর্ত একটাই। ভোর পাঁচটায় রওনা দিতেই হবে। না হলে নাকি
ট্র্যাফিক জ্যাম... । পুরো বাক্য তাকে শেষ করতে হয়নি। আমরা সমরস্বরে “জি হাঁ, জি
হাঁ” বলে এমন চেল্লামিল্লি শুরু করেছিলাম, যে তিন কিলোমিটার দূরে হর কি পৌড়ির
পুরুতেরাও নাকি চমকে গিয়েছিল। যাই হোক, শংকর শুদ্ধ শাকাহারি ভোজনালয়ে অতি উপাদেয়
পনির ভুর্জি আর রুটি দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে হোটেলে ফিরেই শুতে গেলাম। হরিদ্বারে
সেদিন উনচল্লিশ ডিগ্রি গরম। রাতে ডিগ্রি পাঁচেক কমেছিল। তার বেশী নামাবোনা, সে
আপনি যতই কোনাচে চোখে তাকান না কেন।
লটঘট যোশীমঠ
ভোর চারটে বাজতেই টপাটপ বিছানা
থেকে উঠে পড়লাম সকলে। রাতে ঘুম টুম মোটেই হয়নি। একে খাটখানি তিনজনের পক্ষে ছোট,
তার ওপরে ভ্যাপসা গরম। পাখা একটা আছে বটে মাথার ওপর, কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে ঠাওর
করতে হচ্ছে যে সে পাখা আদৌ ঘুরছে কিনা। আমরা ছ জন, কিন্তু বাথরুম মোটে দু খানা।
আগের দিন রাতেই তাই হিসেব করে নেওয়া হয়েছিল কে কার আগে পরে বাথরুমে ঢুকবে। আমিই
বিসমিল্লাহ করলাম। চান টান সেরে বেরিয়ে ব্যাগ পত্তর হিসেব করে নিলাম। দাদা ও
কানহাইয়ালাল ও ঝটপট তৈরি হয়ে নিল। মহিলাদের ঘরেও টোকা মেরে আসা হয়েছে বার দুয়েক।
ঠিক পৌনে পাঁচটায় যোশীমঠওয়ালে গাড়ির ভাই সাহাব ফোন করে জানালেন তিনি এসে গেছেন, আর
রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছেন। হুড়মুড়িয়ে তাড়া দিতে দিতে নিচে নামা হলো। জলের বোতলে
জল ভরা হলো ঘুমন্ত লোকজনকে জাগিয়ে। হোটেলের হিসেব-নিকেশ আগের রাতেই চুকিয়ে
রেখেছিলাম। কাজেই সোজা গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়ি বলছি বটে, তবে এটি আসলে
ছোটখাটো বাসই। টেম্পো ট্র্যাভেলার। নেহাত খালি ফিরলে লোকশান, তাই আমাদের পেয়ে গিয়ে
আর কিছু না হোক ওর তেলের খরচটুকু উঠে যাবে। আর আমাদেরও সস্তায় যোশীমঠ পৌঁছনো হয়ে
যাবে। গাড়ি ছাড়ল কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটায়। কিন্তু ভাই সাহাব বললেন এই কাকভোরেই নাকি
জ্যাম শুরু হয়ে গেছে। হরিদ্বার ছেড়ে হৃষিকেশ হয়ে আমাদের এগোনোর রাস্তা। কিন্তু
হরিদ্বার থেকে হৃষিকেষ এখনও নাকি গাড়ি আটকে গতকাল রাত থেকে। তাই ভাইসাহাব গঙ্গা
পেরিয়ে রাজাজী ন্যাশনাল পার্কের ভেতর দিয়ে অন্য রাস্তা ধরলেন।
এ রাস্তায় আমি আগে আসিনি
কখনো। যদিও কিঞ্চিত ঘুরপথ হয়, আর রাস্তা একটু ভাঙ্গাচোরাও বটে। কিন্তু এই ভোরবেলা
সেখানে জ্যামে পড়বার সম্ভাবনা নেই। গঙ্গা পেরোতে পেরোতে দেখলাম অন্য পারে রাস্তা
ভয়াবহ জ্যামজমাট। ভাই সাহাব আমাদের মিথ্যে বলেননি। যাই হোক, রাজাজী ন্যাশনাল
পার্কের রাস্তা বেশ মনোরম। জঙ্গলে ঢোকার চেকপোস্ট পেরলাম। রক্ষীরা কিছুই বলল না, মনে
হলো তারা এই নিত্যনৈমিত্যিক জ্যাম ও ঘুরপথে অভ্যস্ত। জঙ্গলের ভেতরে রাস্তার একদিকে
সেচের খাল চলে গেছে। তার ধার বেয়ে রাস্তাও চলেছে। মনটা হালকা হয়ে গেল। সকাল হচ্ছে
আস্তে আস্তে। এখনো রোদের তেজ বাড়তে আর হাওয়া গরম হতে অনেক দেরি। ততক্ষনে আমরা যদি
রুদ্রপ্রয়াগ পেরিয়ে যাই তো আর গরম তেমন লাগবে না। যদিও আমরা মোটামুটি সবাই আজ অত্যন্ত
হালকা পোষাকে। আমি একখানা স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট। বাকিরাও একটু এদিক ওদিক
করে যৎকিঞ্চিত। গাড়ির ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরাম করে বসেছি।আজ আমাদের মেজাজ অনেক
হালকা। গাড়ির ভেতরে জোর গলায় আড্ডা চলছে। এমনকি কানহাইয়ালাল ও আজ জোর কদমে আড্ডায়
যোগ দিয়েছে। হৃষিকেশের কাছাকাছি এসে ভাই সাহাব একবার দেখার চেষ্টা করলেন জ্যামের
অবস্থা কি। একটু কমের দিকে হলে একটা ব্রিজ পেরিয়ে ওপাশে গিয়ে মুল রাস্তা ধরা যাবে।
কিন্তু দেখা গেল জ্যাম একেবারে জমজমাট। নদীর এই পার থেকেই বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে
সারি সারি গাড়ি, নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাই পাহাড়ি পাকদন্ডির সরু রাস্তা ধরা হলো
গঙ্গার পূব-দক্ষিন পাড় দিয়ে।
এঁকে বেঁকে চলে আরো ঘন্টা
খানেক পর গাড়ি বেরিয়ে এলো গঙ্গার একেবারে তীরে। একটু এগিয়ে সামনেই একখানা ছোট
লোহার সেতু। গঙ্গার প্রবল স্রোতের আওয়াজে ঘড়াং ঘড়াং করে ব্রিজ পেরোনোর সঙ্গত করতে
করতে আমরা আবার এসে মূল হাইওয়েতে উঠলাম। এবং উঠেই ধুলোয় ধুলো হয়ে গেলাম। সরকারি
পরিকল্পনায় হরিদ্বার থেকে বদ্রীনাথ পর্যন্ত সাত নম্বর জাতীয় সড়ক চওড়া করার কাজ
চলছে। প্রকল্পের নাম চার ধাম যোজনা। চার ধাম অর্থাৎ গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী,
কেদারনাথ এবং বদ্রীনাথ। যাত্রিদের এবং গাড়ির ভীড় ও ট্র্যাফিক জ্যাম সামলাতে সরকার
এই পাহাড়ি রাস্তাকে চওড়া করার এবং স্থানে স্থানে কিছু পার্কিং লট ও বিশ্রামের
জন্যে যাত্রি আবাস তৈরিতে হাত দিয়েছেন। বহু কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ চলছে। কিন্তু সেই
মুহুর্তে আমাদের ওপর তার প্রভাব হলো ওই ধুলো। কারন গোটা রাস্তায় বড় বড় পাহাড় কাটা
যন্ত্র বসিয়ে পাথর ও মাটি কাটা হচ্ছে, ফলে উড়ছে ধুলো। আর সেই ধুলো পথচলতি গাড়ির
চাকায় পাক খেয়ে সোজা যাত্রিরের নাকে মুখে। মিনিট দুয়েকের ভেতরেই মুখের ভেতরটা
কিচকিচে হয়ে গেল। বাকিদের দিকে তাকিয়ে দেখি তাদের মুখচোখ ও ওই হলদে ধুলোর বর্ণ
ধারন করেছে। তড়িঘড়ি গাড়ির সমস্ত জানলা এঁটে বন্ধ করা হলো। ভাই সাহাবের
উইন্ডস্ক্রিন দেখি ঝাপসা, তিনি ওয়াইপার চালালেন। কিন্তু কয়েক মিনিট পর অন্য
অস্বস্তি শুরু হলো। এখনো যথেষ্ট উচ্চতায় উঠিনি, কাজেই জায়গাটা দস্তুর মত গরম। গাড়ি
ছাড়ার পর ঘন্টা তিনেক পেরিয়ে গেছে, রোদ চড়া হচ্ছে। গাড়ির ভেতরে ভ্যাপসানো শুরু
হলো। এই ভাবে আধঘন্টাটাক চলার পর দেখি ভাই সাহাব রাস্তার ধারে এক ফালি খালি জায়গা
ঘেঁসে গাড়ি দাঁড় করালেন। সামনেই একখানা ছোট্ট ঢাবা। দোতলায় খাবার জায়গা।
বাড়ির পাশে লোহার নড়বড়ে
সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম। প্রথমেই খোঁজ করা হলো বাথরুমের। জলযোগের আগে জলবিয়োগের আশু
প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে বেসিনের ধারা প্রপাতে ধুলোর হাত থেকেই কিঞ্চিত রেহাই
পাওয়া গেল। আরাম করে বসে মেজাজে জিজ্ঞেস করলুম “কেয়া কেয়া মিলেগা”। জবাবে অনেক
বস্তুর নামই ভেসে এসেছিল, কিন্তু প্রথমেই “আলু কে পরাঠে” কর্নকুহরে ঢোকার পর আর
কিছু প্রবেশ করলোনা। এখানেও আগের দিনের রাজমা চাওলের মতই ব্যাপারটা ঘটল। আমি আলু
কে পরাঠে বলার পরে, বাকিরাও পৃথক ফলে রাজি হলো না। জগাই মাধাই ডিম ভাজা ইচ্ছে
করেছিল মনে আছে। ওপরে সাদা মাখন দেওয়া আলুর পরোটা আর ঘরে পাতা টক দই দিয়ে জলখাবার
সাঙ্গ করে, কফিতে চুমুক দিতে দিতে জানলার বাইরে দেখছিলাম। সামনে রাস্তা। তার পরে
খাড়াই নেমে গেছে একদম প্রায় শ চারেক ফুট, আর ওই নিচে পান্নার মত মরকত সবুজ গঙ্গা। এখানে
গঙ্গাকে দেখে বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়, এই আমাদের হাওড়া ব্রিজের নিচে দিয়ে বয়ে যাওয়া
ঘোলাটে জলের স্রোত। সাধে কি আর পতিতোদ্ধারিনী নাম দিয়েছিলেন পন্ডিতেরা?
যাই হোক। কাব্যি ছেড়ে আবার
গাড়িতে উঠে বসা গেল। শেষ এদিকে এসেছিলাম বছর এগারো আগে। সেবার এক “ভাই সাহাবের”
পাল্লায় পড়ে সকাল ছটায় হরিদ্বার ছেড়ে বেলা ১১টায় রুদ্রপ্রয়াগ ঢুকে পড়েছিলাম। সেই
বিক্রম ভাই সাহাবকে নিয়ে অন্য একটা গোটা লেখা আছে আমার। এবারের ভাই সাহাব অতটা নন।
তবুও দিব্যি চালাচ্ছেন। রাস্তায় মাঝে মাঝেই ফৌজি কাফেলা চলেছে। বড় বড় জলপাই-সবুজ
রঙের ট্রাকের সারি। উঁকি মেরে দেখলুম ট্রাকে ভর্তি ঘোড়া। ভাই সাহাব জানালেন এরা চলেছে
যোশীমঠ। যোশীমঠ আমাদের সেনাবাহিনীর বড় ঘাঁটি। কিছু দুরেই চিনের সীমান্ত। সেখানে
এতটুকু ঢিলে দেবার উপায় নেই। এদিকে ধুলোর চোটে জানলা বন্ধ, আর তার ফলে আবার গরমে
প্রান ওষ্ঠাগত হয়ে গেল। এবারে দেখলাম ভাই সাহাব এসি চালালেন। এ আমার জীবনে প্রথম
অভিজ্ঞতা, যেখানে হিমালয়ে গাড়ির এসি চালাতে হচ্ছে। রাস্তার ধারে ধারে দেখি শিখ
তীর্থযাত্রিদের জন্যে অসংখ্য বিশ্রামের জায়গা আর লঙ্গর। যোশীমঠ থেকে আরো ঘন্টা
খানেক উত্তরপানে গেলে আসে গোবিন্দঘাট, সেখান থেকে হাঁটা শুরু হয় শিখদের সর্বোচ্চ
তীর্থস্থল হেমকুন্ড সাহিব। ও অঞ্চলেই আছে ফুলোঁ কি ঘাটি, বা ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স।
জুনের শেষ বা জুলাইতে এলে অসম্ভব সুন্দর এই উপত্যকার দর্শন হতে পারে। দেখলাম দলে
দলে শিখ তীর্থযাত্রি চলেছেন। সিংহভাগই মোটরসাইকেলে। একে এই ভাঙাচোরা রাস্তা। তার
ওপরে ওই ধুলো। হরিদ্বার থেকে যোশীমঠ ২৯৪ কিলোমিটার রাস্তা। গোবিন্দঘাট আরো বোধহয়
২৫-৩০ কিলোমিটার হবে। এই পুরো রাস্তা এনারা ওই বাইকে চড়ে যাবেন। নাঃ ভক্তির জোর
আছে এটা মানতেই হবে। কিছুক্ষন চলার পর দেবপ্রয়াগ পেরোলাম। এই জায়গাটা যতবার পেরোই
ততবার ভাল লাগে। ওই নিচে ভাগীরথী (গঙ্গা) আর অলকানন্দা মিশেছে। দুই নদীর জলের রঙ
দু রকম। জগাই মাধাই বউদি কিছুক্ষন তিস্তা-রঙ্গীতের সঙ্গমের তুলনা করল। বহু মিল,
কিন্তু দুই নদীর কখনো তুলনা হয়না। সকলেই আলাদা। নারীর মত। ভাগীরথী আসছে তুলনামূলক
শক্ত পাথুরে অঞ্চল দিয়ে, তার জলের রঙ পান্নার মত সবুজ। অন্যদিকে অলকানন্দা আসছে
অনেক ধুলোমাটির দেশ পেরিয়ে তাই তার জলের রঙ ইষৎ ঘোলাটে হালকা সবজে। দুই জলধারা
মেশার পরে কিছুটা দুজনের জল রঙ রূপ স্রোতের বেগ সমেত আপন আলাদা সত্ত্বা বজায়
রেখেছে, কিন্তু একটা সময়ের পর দুজনে মিলে মিশে একাকার হয়েই গেছে।
দেবপ্রয়াগ ছেড়ে এগোতে
রাস্তার ভিড় সামান্য হলেও একটু যেন কমল। ধুলোবালি আর যান্ত্রিক কর্মকাণ্ডও কিছুটা
কমল। ইতিমধ্যে জানলার কাচে নাক ঠেকালে বাইরের তাপমাত্রা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। তবুও
আমরা এসি বন্ধ করে জানলা খুলে দিলাম। কারন গাড়ির ভেতর কেমন একটা দম বন্ধ লাগছিল। বাইরের
খোলা হাওয়ায় ভাল লাগল। আর এখানে আর যাই হোক, সমতলে গ্রীষ্মের যেই গা-জ্বালাকরা
ভাবটা নেই। গাড়ি এবার রাস্তা কিছুটা ফাঁকা পেয়ে জোর কদমে ছুটছে। দেখতে দেখতে আমরা
শ্রীনগর ঢুকে পড়লাম। এ জম্মু কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর নয়, এ হলো উত্তরাখন্ডের
শ্রীনগর, বেশ বড় জেলা শহর। ২০১৩র বানে এই শহরের বিরাট ক্ষতি হয়েছিল। এবার স্বচক্ষে
দেখতে পেলাম সেই ক্ষয়ক্ষতি। নদীর অন্য পারে মনে হলো কেউ একটা বিশাল আকৃতির সেফটি
রেজার চালিয়েছে। শহরে ঢোকার ঠিক আগে রাস্তার ধারে একটা কল দেখতে পেয়ে আমরা জলের
বোতল ভরে নিতে নামলাম। জলের বোতল ভরতে ভরতে কি মনে হলো, মাথাটা কলের নিচে পেতে দিলাম।
হিম ঠান্ডা জল নেমে এলো সারা শরীর বেয়ে। অদ্ভুত আরাম লাগল। আমার দেখাদেখি বাকিরাও
একটুখানি চান করে নিল। সামনের বাড়ির দাওয়ায় দেখি এক তাউজি হাসি হাসি মুখে বসে আমাদের
কান্ড কারখানা দেখছেন। এদিকপানে আসেন যাঁরা, এক তীর্থযাত্রি বাদ দিলে, বাকি
ট্যুরিস্টের সিংহভাগই বাঙালি। তাউজির নিশ্চই এসব দেখার অভ্যেস আছে।
শ্রীনগর পেরোবার পর রাস্তা
আরো খালি হয়ে গেল। ভাই সাহাব মিনিট চল্লিশের ভেতর আমাদের রুদ্রপ্রয়াগের উপকন্ঠে
এনে ফেললেন। এখানে মন্দাকিনি এসে মিসেছে অলকানন্দায়। এই রুদ্রপ্রয়াগ থেকে রাস্তা
ভাগ হয়ে একটা রাস্তা গেছে উত্তর দিকে গুপ্তকাশী হয়ে গৌরিকুন্ড। সে রাস্তা
কেদারনাথের রাস্তা। শেষবার এসেছিলাম ২০০৭ সালে। তার পরে ২০১৩র বিশাল বিপর্যয়। আগে
দেখা রুদ্রপ্রয়াগকে ভাল করে চিনতে পারলাম না। সর্বাঙ্গে বিপর্যয়ের প্লাস্টার
ব্যান্ডেজ। ভুপ্রকৃতিটাই পুরো মনে হলো বদলে গেছে। মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল।
রুদ্রপ্রয়াগ পেরিয়ে যাবার পর কিন্তু রাস্তাঘাট একেবারেই বদলে গেল। এদিকে ধুলো বালি
কম। রাস্তা ভাল। আর গাড়ির ভিড়ও অনেক কম। ভাই সাহাব জোরসে হাঁকালেন খালি রাস্তা
পেয়ে। গরমটাও এখন অনেক কম লাগছে। রাস্তা এখন অলকানন্দার গা ঘেঁষে চলেছে। এমন সময়
ঘটল বিটকেল একটা ঘটনা। সিঁইঁইঁইঁ করে একটা তিক্ষ্ণ সিটির মত শব্ধ, আর কয়েক সেকেন্ড
পরেই স্যাট-স্যাট-স্যাট-স্যাট করে আওয়াজ। ভাই সাহাব গাড়ি রাস্তার ধারে নিয়ে গিয়ে
দাঁড় করালেন। সেই অমোঘ ঘটনা ঘটেছে। আমার রেকর্ড অক্ষুন্ন থাকলো। এ রাস্তায় আমি
এলেই টায়ার ফাঁসে দু বার করে। এবারেও নিয়মের অন্যথা হলো না।সবাই নেমে এসে হাত
লাগালাম। জগাই মাধাই ঝটপট ফোন বের করে কিছু সেলফি তুলে নিলো, এবং অল্প সময়েই সে সব
ফেসবুক ইন্সটাগ্রামে স্থানও করে নিল। মিনিট দশেকের ভেতর ভাই সাহাব গাড়িকে
চলনে-লায়েক করে ফেললেন।
আবার যাত্রা শুরু হলো। কথা
হলো দুপুরের খাওয়ার জন্যে যেখানে দাঁড়ানো হবে, ভাই সাহাব সেখানেই গাড়ির চাকা
সারিয়ে নেবেন। রাস্তা খালি বলে এক নাগাড়ে চলে বেলা আড়াইটে নাগাদ আমরা কর্ণপ্রয়াগ
পৌঁছে গেলাম। শহর পেরিয়ে একটা গঞ্জ মত জায়গায় ভাই সাহাব গাড়ি থেকে আমাদের নামালেন।
সামনেই দু খানা খাবার জায়গা। একটি নিরামিষ, অন্যটি আমিষ। আমাদের আধ ঘন্টা সময় দিয়ে
গাড়ি নিয়ে ভাই সাহাব এগিয়ে গেলেন। গাড়িতে আমাদের সকলের ব্যাগ লাদাই করা। কিন্তু এক
বারের জন্যেও কাউকে বলতে শুনলাম না, যে ব্যাগ গুলো নামিয়ে নিই, যদি ব্যাটা গাড়ি
নিয়ে ভেগে যায় ! উত্তরাখন্ডের অপর নাম দেবভুমি, এখানের জলহাওয়ার গুনই এমন, ওসব
চিন্তা কারোর মনেও আসেনা। সযত্নে নিরামিষ রেস্তোরাঁর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে আমরা রাওয়াত
হোটেলে ঢুকলাম। হাত মুখ ধুয়ে বসতেই লোক এসে জিজ্ঞেস করে গেল কি খাবো। বললুম
যাচ্ছেতাই, মানে যা ইচ্ছে তাই, যা যা আছে নিয়ে আসা হোক, আমরা প্রচন্ড ক্ষুধার্থ। উপদেশ
এলো, আপনারা তাহলে থালি নিন। থালিতে থাকে ভাত, ডাল, তরকারি, ভাজা, চাটনি, আচার
পাঁপড়... । রোববারের দুপুরে শেষে এই সব খেতে হবে? আমার খাশ হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলাম
– “পাঁঠা কা মাংস হোগা?”। উত্তরে একটা বোকা বোকা চাউনি পেয়ে ইংরিজি ঝাড়লুম – “মাটন
... হোগা?” । “জি হাঁ, জি হাঁ” কর্ণকুহরে সুধা বৃষ্টি করে গেল। বললুম সব ছাড়ো ভাত
আর মাটন কারি নিয়ে এসো। কতটা করে থাকে এক প্লেটে? বলল দু জন আরাম সে খাবে। আমরা
তিন প্লেট আনতে বললাম। আর ভাত। মিনিট দশেকে এসে গেল। প্লেট দুরস্থান, মাঝারি
আকারের হাঁড়িতে করে তিন হাঁড়ি মাংস এলো। এক এক হাঁড়িতে বোম্বাই সাইজের ছ টুকরো করে
মাংস।চামচ দিয়ে নেড়ে দেখলাম লাল টুকটুকে ঝোলের মধ্যে নধর চর্বিওয়ালা মাংসের টুকরো।
একটু ঝোল ভাতে মেখে মুখে দিলাম। রোববার সার্থক হলো। বুঝলুম এ হলো “খাড়ে মশালে কা মাটন”
অর্থাৎ গোটা মশলা দিয়ে রান্না। অপূর্ব স্বাদ। তিন মিনিটে আরো তিন প্লেট মাটন কারির
অর্ডার চলে গেল। এ স্বাদ কেউ ভাগ করতে রাজি না। মাধাই শুধু চিকেন কারি নিয়েছিল।
কিন্তু একটু মাটন মুখে দিয়েই তারও ভুল ভেঙ্গে গেল। সব শেষে আরো এক প্লেট নিয়ে
ভাগাভাগি করা হলো। আমরা ছ জনে মোট আট থালা ভাত, সাত প্লেট মাংস আর এক প্লেট চিকেন
খেয়ে উড়িয়ে দিলাম। বেশীদিন এ অঞ্চলে আমরা বিরাজ করলে, উত্তরাখন্ডে খাদ্যাভাব দেখা
দিতে পারে।
মৌরি চিবোতে চিবোতে
বেরোচ্ছি, দেখি ভাই সাহাব গাড়ির চাকা সারিয়ে হাজির। টপাটপ উঠে পড়লাম গাড়িতে।
কর্নপ্রয়াগ পেরোবার পরেই প্রকৃতপক্ষে রাস্তার চড়াই শুরু হলো। এঁকে বেঁকে গাড়ি
উঠছে। নন্দপ্রয়াগ পেরোলাম, পেরোলাম পিপলকোটি। এগারো বছর আগের এক ঘটনাবহুল অপরাহ্ণ
, সন্ধ্যে এবং রাতের স্মৃতি ফিরে এলো। সে গল্প আর এক জায়গায় লিখেছি। কিন্তু দেখে
ঠিক চিনতে পারছিলাম না। এগারো বছর আগে যাকে দেখেছিলাম ঘন জঙ্গল এবারে দেখি গিজগজ
করছে বাড়িঘর। পিপলকোটির একটু আগে বিরহি বলে একটা জায়গায় একটা ব্রিজ পেরোলাম এগারো
বছর আগে এই ব্রিজের ঠিক আগে গাড়ির ফাটা চাকা মাথার ওপর তুলে মাথা আড়াল করেছিলাম
ওপর থেকে নেমে আসা ধ্বসের পাথরের টুকরো থেকে বাঁচতে আর দৌড়ে পার হয়েছিলাম একশ
মিটার রাস্তা। এবারে অচঞ্চল ভাবে গাড়ির ভেতর বসে বসেই কেমন জায়গাটা পেরিয়ে এলাম!
পিপলকোটি দেখলাম এবারে একটা ব্যাস্ত ঘিঞ্জি গঞ্জে পরিনত হয়েছে। পিপলকোটি পেরিয়ে
আরো ঘন্টা খানেক আসার পরে আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। আবার টায়ার ফাঁসলো
গাড়ির। নিয়মের অন্যথা হবার জো নেই। এবারে ভাগ্যিভাল একটা ছোট্ট গ্রামের ভেতরে
রাস্তার ধারে সারাইয়ের দোকানের সামনে এসেই টায়ারবাবু দম তোড়লেন। কান্ডজ্ঞান আছে
বলতে হবে। অগত্যা আবার চাকা খোলা হলো। এবার আর সুযোগ না নিয়ে ভাই সাহাব এখানেই
টিউব সারাতে দিলেন। জগাই মাধাই সেলফি তুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। কানহাইয়ালাল দেখি
চায়ের দোকানে তাউজির সঙ্গে টুকুস টুকুস আলাপ জুড়েছে। দাদা-বৌদি দুজনে একা একা
বাথরুম খুঁজে এলো। অতঃপর আমরাও চা নিয়ে রাস্তার ধারে বসে গেলাম।
চা খেতে খেতে ইতি উতি
তাকিয়ে দেখি, রাস্তার ধারে চায়ের দোকানের পেছনে অতলস্পর্শী খাদ নেমে গেছে। নিচে
প্রায় অন্ধকার, কেননা ঘড়িতে ছটা বেজে গেছে, যদিও অনেকটা পশ্চিমে বলে এখানে এখনো
হাল্কা রোদ রয়েছে। খাদের ওপাশে আবার আকাষ ছোয়া পাহাড়রের সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে।কিন্তু
তার পেছনে যা দেখলাম, সারা দিনের পথশ্রম এক মুহুর্তে হাওয়া হয়ে গেল। দেখলাম সামনের
ওই পাহাড়ের সারির পেছনে এক আসাধারন সুন্দর তুষারধবল গিরিশৃঙ্গ। চুড়োটা দেখে ঠিক
চিনতে পারলাম না। কিন্তু নামে কি এসে যায়? মন যেখানে প্রথম দেখায় মুগ্ধ হয়ে গেছে,
সেখানে নাম অপাংতেয়। জগাই মাধাই দাদা বৌদি হই হই করে উঠল। পথশ্রমে তাদের হারিয়ে
যাওয়া উৎসাহ আবার ফিরে এসেছে ওই তুষার ধবল শৃঙ্গের দর্শন পেয়ে। এবারের যাত্রাপথে
এই প্রথম হিমাদ্রির দেখা, হিমালয়ের মূল শৃঙ্গমালার দেখা পেলাম। সারাদিনের অজস্র
ঝামেলায় আর বিরক্তিতে অশান্ত মন এক লহমায় শান্ত হয়ে এল। মনে হলো এই দৃশ্যের দর্শন
পেতে তেরো ঘন্টা কেন একশ তেরো ঘন্টা ওই রকম রাস্তায় গাড়িতে চড়তে হলেও আক্ষেপ থাকার
কথা নয়। চাকা সারানো হলো। মনের মুগ্ধতা মনে চেপে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। রাস্তা
এবারে একদম খাড়াই উঠছে।ধিরে ধিরে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে। আর ঠান্ডাও বাড়ছে। আমার বাড়ি
হাওড়ার উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ৯ মিটার, দিল্লি ২৩০ মিটার, হরিদ্বার ৩১৫ মিটার,
রুদ্রপ্রয়াগ ৯০০ মিটার, কর্ণপ্রয়াগ ১৪৫০ মিটার আর যোশীমঠ ১৮৭৫ মিটার। আমরা এক দিনে
যোশীমঠে উঠে এসেছি প্রায় সমতল থেকে। সন্ধ্যের মুখে গাড়ি এসে ঢুকলো যোশীমঠ।
আমাদের গাইড জওন সিং
রাওয়াতের দাদা, নরেন্দর সিং রাওয়াতের অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের ব্যাবসা। ভদ্রলোক
প্রাক্তন ফৌজি। ফোনে বলা হয়েছিল ওনাকে, তাই আমাদের জন্যে হোটেল ঠিক করে রেখেছেন। দু
খানা ঘর। আমরা তিনজন করে থাকবো। হোটেল দেখে মন ভাল হয়ে গেল। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন
ঝকঝকে ঘরদোর, বাথরুম। ধপধপে বিছানা। রাত আটটায় গাড়ি থেকে নেমে হোটেলে ঢুকে পড়লাম।
জগাই মাধাইকে নিয়ে কানহাইয়ালাল গেল নরিন্দর সিং রাওয়াতের অফিসে। সেটা আমাদের হোটেল
থেকে হেঁটে মিনিট পাঁচেক। ওদের জন্যে ওয়াকিং স্টিক কিনতে হবে। কানহাইয়া ওস্তাদ
ছেলে, তার এসব লাগে না। আমি একখানা পুরোনো বস্তু এনেছি, অনেক আগে কেনা ছিল। দাদা
বউদি বলল লাগবে না, গাছের ডালপালা দিয়ে চালিয়ে নেবে যদি প্রয়োজন হয়। অবশেষে পনেরো ঘন্টার
যাত্রাইতি ঘটল আমাদের। চান করলাম গরম জলে। আর তার পরেই – “কেবল পেটে বড় ভুখ, না
খেলে নাই কোনো সুখ”। যৎকিঞ্চিত চা পকোড়া খাওয়া হলো। পেটে খাবার পড়তেই চক্ষুদুটি ঘন
হয়ে এলো। রাতে তার পর লোকজন কে কি খেলো, কোথায় শুলো, কি কি গপ্পগাছা করল, এসব আর কিচ্ছুটি
...।
বুক দুরু দুরু, হাঁটার শুরু
সক্কাল সক্কাল ঘুম ভেঙ্গে
গেল অভ্যেসবসে। বাইরে তখনো প্রায়ান্ধকার। বাথরুমের কাজ সেরে নিলাম, কেননা অন্যেরা
ঘুমন্ত। চান সেরে শীত ধরল। সাত সকালে যোশীমঠে বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। আজ গাড়ি
আসবে বেলা দশটার আগুপিছু। এখন সবে সকাল সাড়ে ছয়। রাস্তায় বেরোলুম। দু একটা দোকান
খুলেছে, চা আর জলখাবারের দোকান। যোশীমঠের চারপাশে ভারি সুন্দর পাহাড়ের সারি। ঠিক
যেন মুকুটের মত ঘিরে রেখেছে ছোট্ট শহরটাকে। পাহাড়ি শহরের তুলনায় বেশ পরিস্কার
পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। একটু পায়চারি করে বুঝলাম পেটে গরম কিছু পড়া দরকার। একটা
পাতলা টি শার্ট আর হাফ প্যান্ট পরে বেরিয়ে এসেছি, এদিকে তাপমাত্রা মোটামুটি ষোলো
সতের ডিগ্রির আসেপাশে। জুন মাস বলে আরো বেশী গা শিরশির করছে। সামনেই একটা দোকান
দেখে ঢুকলাম। দেখলাম সদ্য ভাজা পকোড়া তুলছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম ১০ টাকায় আড়াইশো
গ্রাম পকোড়া। দশ টাকার পকোড়া আর একটা চা বলে এসে টেবিলে বসলাম। এক ছোকরা গরমা গরম
পকোড়া দিয়ে গেল। মুখে পুরে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এমন স্বাদের পকোড়া বহুকাল খাইনি।
বোধহয় আলু, পালং শাক আরো কয়েক রকম সবজি মিশিয়ে বেসনে ডুবিয়ে ভাজা। বেসনে গোটা ধনে
আর যোয়ান মেশানো, আর ভাজাও খুব হালকা, যদিও কুড়মুড়ে। বেসন ভেজে কালচে করে ফেলেনি। নিমেষের মধ্যে
আড়াইশো পকোড়া উড়ে গেল। আর খালি প্লেটে বসে গুঁড়ো চাটা শুরু করতেই ছোকরা আমার চায়ের
গ্লাস নিয়ে চলে এল। এখন এই গরম চা খাবো শুধু শুধু? ছোকরা কে বললুম আরো আড়াইশো
পকোড়া আনতে।
চায়ে চুমুক দিলাম। শরীর গরম
হয়ে গেল। কাঁচের গেলাসে শেষ চুমুক দিচ্ছি, এমন সময় সদ্য ভাজা গরম পকোড়ার প্লেট এসে
গেল আবার। কেলো করেছে। এবার কি পকোড়া শুধু শুধু খেতে হবে? ছোকরাকে আবার চায়ের
হুকুম করলুম। এই চক্র আরো কয়েকবার চলল। কিলোখানেক পকোড়া আর খান চারেক গ্লাস চায়ের
পর দোকানের ভেতর থেকেই দেখলাম, আমাদের হোটেলের ছাত দেখা যাচ্ছে, আর ছাতে উঠে বউদি
হাত নেড়ে প্রবলভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করছে। অগত্যা চা-পকোড়ার চক্রে
ছেদ পড়ল। দাম মিটিয়ে হোটেলের ছাতে এসে উঠলাম।দেখি বউদি কিছু কাচাকুচি করেছে, আর
সেগুলো শুকোবার জন্যে ছাতে উঠে, পড়েছে মহা মুশকিলে। ঝকঝকে রোদ তো আছে, কিন্তু
সঙ্গে হাওয়াও আছে। আর নেই ক্লিপ বা দড়ি। ফলে শুকোবার সমস্যা। খুঁজে পেতে কয়েকটা
ইঁট পেলাম। তাই দিয়ে আলসের ওপর চাপা দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। নিচে নেমে তখনো যারা
ঘুমন্ত তাদের ঠেলাঠেলি করে তোলা হলো। কেননা ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। দশটায় গাড়ি আসবে।
এই গাড়ি আমাদের নিয়ে যাবে ৫০ কিলোমিটার দূরে ধৌলিগঙ্গার ধারে জুম্মা বলে একটা
জায়গায়। এখানে ধৌলিগঙ্গার ওপর ব্রিজ পার হয়ে আমাদের হাঁটা শুরু।
ধৌলিগঙ্গার
ধার ঘেঁসে ধু ধু হাইওয়ে
আজকের গাড়ি একটা টাটা সুমো।
যথা সময়ে সে চলে এলো হোটেলের সামনে। সঙ্গে এলো জওন সিং রাওয়াত। সামনের কটাদিন সে ই
আমাদের ফ্রেন্ড, ফিলোজফার এবং গাইড। ছোটোখাটো রোগা পাতলা চেহারা। চেহারায়
মোঙ্গোলিয় ছাপ প্রকট। শ্রশ্মু-গুম্ফের ঘনত্ব কিঞ্চিত লঘু। মুখের হাসি ফ্রেমে
বাঁধিয়ে রাখার মত। কম কথার মানুষ জওন ভাই। কখনো কিছু চাপিয়ে দেয় না এটা করতেই হবে
বলে। নিজেকে অন্যদের সঙ্গে খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। পরের কটা দিন লোকটার আরো
অনেকগুলো গুনের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছি। গাড়ির মাথায় বেশ কয়েক বার এদিক ওদিক করে
সরিয়ে নড়িয়ে আমাদের পিঠের ব্যাগ গুলো রাখলাম। শুনলাম আর একটা গাড়িতে আমাদের তাঁবু,
রসদ, গাইডের দুই সহকারি রওনা হয়ে গেছে জুম্মার দিকে।
জওন ভাই চলল আমাদের সঙ্গেই
এই গাড়িতে। কে কোথায় বসবে সেই নিয়ে প্রথমে একটু আলোচনা হলো। কিন্তু শেষে দেখা গেল
রাস্তা মোটে ঘন্টা দুই আড়াইয়ের, তাই যে শেষে যে যেখানে পারল সেঁধিয়ে গেল। আগের
দুদিনের অভ্যেসবসতঃ দু আড়াইঘন্টা আমাদের কাছে নেহাতই তুশ্চু। শুরুতেই পেরোলাম
যোশীমঠের ফৌজি আস্তানা। তার আকার আয়তন যোশীমঠের মত পুঁচকে শহরের তুলনায় অতিকায়।
দেখলাম জায়গায় জায়গায় আইবেক্সের ছাপ মারা সেনাবাহিনির চিহ্ণ। এই আইবেক্স আমাদের
ভারতীয় সেনার অন্যতম সেরা পর্বত যোদ্ধাদের রেজিমেন্ট লাদাখ স্কাউটস এর প্রতীক।
বুঝলাম এখানে ঘাঁটি আগলে বসে আসে লাদাখি সেনারা। গাড়ি পাক খেয়ে খেয়ে পাহাড়ের গা
বেয়ে উঠে চলল ওপরে। ম্যাপ অনুযায়ি আমরা এখন চলেছি দক্ষিন-পূব দিকে, একটু পরে আস্তে
আস্তে বাঁদিকে ঘুরে উত্তর পূর্বে যাবো। মাধাইয়ের খুব ইচ্ছে গোটা অভিযানখানা সে
ভিডিও রেকর্ডিং করে। এদিকে তার ক্যামেরার ব্যাটারি মোটে একটাই। আর যোশীমঠ ছাড়াবার
পর বিদ্যুৎ সংযোগ, মোবাইল নেটওয়ার্ক এগুলো স্রেফ মঙ্গলগ্রহের কথা মনে হয়। মাধাই
মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে ক্যামেরা বের করে ভিডিও তোলার চেষ্টা করছিল বটে, কিন্তু
গাড়ির ঝাঁকুনির চোটে বিশেষ ফলপ্রসু হচ্ছিলনা তার চেষ্টা। গাড়িতে উঠে প্রথমেই যা
হয়, কলকল করে কথা, কিন্তু কয়েক মিনিট যেতেই কথার তোড় আস্তে আস্তে কমে এল। জগাই
মাধাইয়ের প্রিয় টাইমপাস – কানহাইয়ালালের পেছনে লাগা, সেদিকেও দেখি ঢিলে পড়েছে। তার
প্রধান কারন রাস্তা আর চারপাশের দৃশ্যপট। এদিকের রাস্তায় গাড়ির চলাচল প্রায় নেই
বললেই চলে। রাস্তার প্রথম বিশ কিলোমিটারের পাকদন্ডি বাদ দিলে বাকিটুকু মোটামুটি
ভাল। মাঝে মধ্যেই আসছে ভেড়া আর ছাগলের পাল। পাল বলতে আমাদের কল্পনায় যেমন আকার
প্রকার আসে, এ তেমন নয়। বরং তার চেয়ে বহুগুনে বড়। এক একটা পালে অন্ততঃ কয়েকশো
ছাগল, আর তার পেছনে একটা সদাহাস্যময় গাড়োয়ালি মুখ। সে মুখ আপাতদৃষ্টিতে হয়ত দৃষ্টিনন্দন
নয়। কিন্তু শহুরে বিউটিপার্লার আর ক্রিম টিমের চেয়ে অনেক দামী একখানা ফ্রেমে আঁটা
হাসি তাকে যে সৌন্দর্য্য দিয়েছে, তার তুলনা আর কোথায় পাবো? এ সৌন্দর্য্য মনের
ভেতরে অপার অনন্দের। আমাদের মত সমাজে, যেখানে সকলে মুখোশ পরে থাকে, সেখানে এ জিনিস
পাওয়া সম্ভব নয়। এ রকম হাসি কেবল হিমালয়ের ওপরেই দেখেছি।
যোশীমঠ ছেড়ে যতই এগোচ্ছি,
মানুষের মুখে মঙ্গোলীয় প্রভাব তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যোশীমঠের পর কয়েকটা ছোটখাটো
গ্রাম। ঢাক বলে একটা গ্রাম পেরোলাম। দেখলাম এখানে ফৌজি ডিপোও আছে। যদি যোশীমঠ থেকে
কোন রসদ আনতে কেউ ভুলে যায়, তাহলে এই ঢাক থেকে সেটা তুলে নেওয়া যেতে পারে। রাস্তায়
চোখ রাখলাম ঢাকের পরে ঢোল বা কাঁসর বলেও কোন জনপদ আসে কিনা দেখতে। মালপত্র আর
রসদের গাড়ি আগেই এগিয়ে গেছে আমাদের। আমরাও আর থামলাম না। কিছুদুর এগিয়ে খালি একবার
প্রাকৃতিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে গাড়ি দাঁড় করানো হলো। তখনই অনুভব করলাম, কি অদ্ভুত এক
দেশে আমরা এসে পড়েছি। দু দিকে উঁচু উঁচু পাহাড়। রাস্তার ধার দিয়ে ধৌলিগঙ্গা বয়ে
চলেছে, আর তাতে দুর্দান্ত স্রোত। দু পাশের পাহাড় গুলোর মাথা টপকে পেছনে দেখা
যাচ্ছে আরো অনেক শৃঙ্গ।পাহাড়গুলো প্রায় ন্যাড়া। অল্প কিছু ঘাস আর গুল্ম। মাঝে মাঝে
নেহাত অকিঞ্চিতিকর ভাবে মাথা তুলেছে একটা গাছ। পাহাড়গুলোর মাঝখানে কালো ফিতের মত ধুধু
করা খালি রাস্তাটা পড়ে আছে। আর আছি আমরা, সভ্যতার অকিঞ্চিতিকর প্রমান স্বরুপ একটা
গাড়ি আর কিছু মালপত্র সমেত কয়েকজন মানুষ। রাস্তায় একটাও গাড়ি নেই। ধৌলিগঙ্গার
স্রোতের আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দও নেই। শনশনে হাওয়া দিচ্ছে বেশ। জায়গাটা এতটাই
অদ্ভুত, আমাদের কেউই কথা বলছিল না। এমন কি জগাই মাধাইয়ের কলকল ও বন্ধ। মিনিট দশেক
পর গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। এবারে আর না থেমে এক টানা আধঘন্টা পর হঠাৎ রাস্তার
ধারে একটা লোহার ব্রিজে উঠে পড়লাম আমরা। নিচে ধৌলিগঙ্গা। ঘড়াং ঘড়াং করে ছোট্ট
ব্রিজ পেরিয়ে এসে ধৌলিগঙ্গার অন্য পারে এসে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। আর গাড়িচলাচলের
রাস্তা নেই। এবার সামনে পায়ে চলা পথ দেখা যাচ্ছে। এই তাহলে জুম্মা। অদ্ভুত লাগল।
একটা মানুষ নেই। কোন ঘরবাড়ি নেই। আছে চার দিকে উঁচু উঁচু পাহাড়, নিচে ধৌলিগঙ্গা,
আর একখানা লোহার ঝুলন্ত ব্রিজ।
যোশীমঠ
থেকে জুম্মার পথে
গত আড়াই দিনে আমরা
দক্ষিনবঙ্গ থেকে বহু কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছেছি জুম্মা। এই গোটা রাস্তাই আমরা
এসেছি বিভিন্ন যানবাহনে সওয়ার হয়ে। আজকের আড়াই ঘন্টার যাত্রা হয়ত সবচেয়ে কম ঘটনাবহুল
ছিল। গাড়ি থেকে নামা হলো। আমাদের পিঠের ব্যাগ গুলো নামানো হলো। আজ আমরা সকলেই যোশীমঠ
থেকে তৈরি হয়ে বেরিয়েছি। পায়ে পাহাড়ে হাঁটার জন্যে বিশেষ জুতো, প্যান্ট আর টি
শার্ট সকলের পরনে। রোদ বাঁচাতে মাথায় টুপি। কারন হিমালয়ের ওপরে যত উচ্চতায় ওঠা
যায়, বাতাস তত পাতলা হয়ে আসে, আর ততই ধুলোবালি কমে যায়। ফলত রোদের তেজ ভয়ানক বেড়ে
যায়। জুম্মাতে নেমে দেখি শনশনে হাওয়া দিচ্ছে। হাওয়ার এতই জোর যে সোজা হয়ে দাঁড়ানো
মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। পিঠে ব্যাগ তুলে কয়েক পা হেঁটে দেখলাম। হাওয়ায় ঠেলা দিচ্ছে
বটে, কিন্তু হাঁটা যাবে। ব্যাগখানা পুরো ভর্তি করে ওজন নিয়ে দেখেছিলাম, ১৭ কিলোর
কিছু বেশী হয়েছিল। তার মধ্যে দু কিলো অবশ্য দু লিটার জলের ওজন। বাকি আরো অনেক
বস্তু তাতে ভরা আছে। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ফিতে গুলো এঁটে ব্যাগটাকে ব্যবস্থা করলাম
যেন আমি পড়লেও ব্যাগ আমার থেকে সহজে আলাদা না হয়। এবার সামনে এগোনো। পায়ে চলা মাটি
আর পাথরের রাস্তা। দেখে মনে হলো রাস্তাটা কিঞ্চিত চওড়া করা হচ্ছে যাতে করে ছোটখাটো
গাড়ি যেতে পারে।
আজকে আমাদের গন্তব্য রুইং।
সেখানেই প্রথম ক্যাম্প করা হবে। হিমালয়ের এত ওপরে এই নির্জন জায়গায় কোন স্থায়ী বসতি
নেই। যা দু-চার ঘর লোকজন আছে, তারা সবাই অস্থায়ি আস্তানায় থাকে। এবং প্রায় সকলেই
পশুপালক। গরমের কয়েকমাস, মে এর শেষ থেকে আগস্ট কি বড় জোর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত
অস্থায়ী আস্তানা গুলোয় কিছু লোক থাকে, তাদের পশুপাল নিয়ে। আবার ঠান্ডা বেড়ে বরফ
পড়া শুরু হতেই তারা সকলে নিচে নেমে যায়। আবহমান কাল ধরে এই চক্র চলে আসছে। রুইং
এরকমই একটা অস্থায়ী আস্তানা বা গ্রাম। জুম্মাতে আমরা যেখানে গাড়ি থেকে নেমেছি,
সেখান থেকে কিলোমিটার চারেক। আমরা হাঁটতে আরম্ভ করলাম। এই আমাদের দল হিসেবে প্রথম
হাঁটা। কাজেই একটু এদিক ওদিক হবেই। একদম প্রথমে দাদা ও বৌদি। দুটিতে দিব্যি গল্প
করতে করতে চলেছে। অমসৃন রাস্তায় এ হোঁচট খেয়ে বেসামাল ও হাতে ধরে সামাল দিচ্ছে,
আবার ও বড় বড় পদক্ষেপে একটু এগোতে চাইলে এ হাত টেনে ধরে রাখছে। একদম পেছনে
কানহাইয়ালাল ও মাধাই। মাধাইয়ের গলায় কলকল করে কথা শুনতে পাচ্ছি। মাধাইয়ের প্রকৃতি
অনেকটা আমার মেয়ের মত। কথা না বলে সে খুব একটা থাকতে পারে না। আমার সঙ্গে চলেছে
জগাই। মেয়েটা বয়স অনুসারে বেশ পরিনত। প্রথম বার উঁচুতে উঠছি আজকে, কাজেই আজকের ওঠা
আমাদের কাছে বেশ কঠিন হবে। কেননা শরীর অভ্যস্ত নয় এখনো উচ্চতা ভাঙায়।
ক্যামেরা বার করে একটা দুটো
ছবি তুলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মোটে পাঁচ মিনিট হাঁটার পরেই হাপরের মত হাঁপাতে
শুরু করেছি। তাই একটু পরেই ছবি তোলার উৎসাহ চলে গেল। রাস্তাটা দেখতে নিরীহ হলে কি
হবে? খাড়াই যথেষ্ট, আর আমরা অনভ্যস্ত পায়ে চড়াই ভাঙতে ভাঙতে চলেছি। মিনিট দশেক পর
দেখি জগাইয়ের মুখ শুকনো। নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না, না হলে নির্ঘাত দেখতে
পেতাম আমারও মুখ পাংশুবর্ণ। অনেকটা পেছনে দেখি কানহাইয়ালাল আর মাধাই একটা বড়
পাথরের টুকরোর ওপর বসে আছে। আমরাও ঠিক করলাম মিনিট খানেক দাঁড়ানো যাক। সামনে দাদা
বৌদিকে দেখতে পাচ্ছিনা। তারা বোধহয় আরো অনেকটা এগিয়ে গেছে। রাস্তার বাঁ দিকে সোজা
খাদ নেমে গেছে ধৌলিগঙ্গা পর্যন্ত। নদীর ওপারে পাহাড়ের গায়ে খাঁজকাটা জনশূন্য
হাইওয়ে। আমরা এতক্ষন এলাম একটাও গাড়ি দেখিনি রাস্তায়। মিনিট খানেক পর আবার গা ঝাড়া
দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। পিঠের অনভ্যস্ত বোঝাটা বেশ অস্বস্তি করছে। নিজের ওজনের
সঙ্গে বাড়তি আরো পনের কিলো ওজন বয়ে চলা সহজ নয়। তার ওপরে চড়াই ভাঙতে হচ্ছে। রাস্তা
আস্তে আস্তে ওপর দিকে উঠছে। রাস্তার কাজ চলছে কয়েক জায়গায় দেখলাম। এখানে
যন্ত্রপাতির বড়ই অভাব। কাজ হয় আদিম পেশী শক্তিতে। তবুও একদম ব্রিজের কাছে একটা ছোট
পাথরকাটা যন্ত্র দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা যে কাজে লাগানো হয়েছে বা হচ্ছে, সেরকম
কিছু চিহ্ন দেখলাম না।
শনশনে
হাওয়াটা প্রথমে শীত ধরিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু শ পাঁচেক মিটার পার হতেই দেখলাম শীত
গায়েব। একে তো মাথার ওপরে ঝকঝকে রোদ। এরকম চোখ ধাঁধানো রোদ সমতলে কখনো দেখিনি।
চোখে কালো চশমা পরতে হয়েছে রোদ আটকাতে। চড়াই ভাঙার পরিশ্রমে ঘাম ঝরছে, যদিও সঙ্গে সঙ্গেই
শুকোচ্ছেও বটে, কেননা আবহাওয়া খুব শুকনো। পাহাড়ের ঢালে পাইন গাছ রয়েছে কিছু। তা
ছাড়া আরো অনেক নাম না জানা গাছ। গাছপালা বাবদে আমি একেবারেই অজ্ঞ। পঞ্চাশ ষাট পা
করে চলছি আর একবার করে থামতে হচ্ছে। আমার ব্যাগে একটা ভাঁজকরা হালকা লাঠি ছিল
হাঁটার জন্যে। সেটা বের করে হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। চলা একটু সহজ হলো। কিন্তু
ভাবছিলাম, প্রথম দিনের হাঁটাতেই যদি এই হাল হয় আমার, তাহলে সামনে যে কঠিন যাত্রা
অপেক্ষা করে আছে, সেগুলো পার হবো কি করে! বুকের ভেতর একটা অজানা আশংকায় দুরুদুরু
করতে লাগল। যাত্রা শুরুর আনন্দটা ঠিক নিতে পারছিলাম না যেন। পাহাড়ি রাস্তা পাক
খেয়ে খেয়ে ওপরে উঠেছে। আমাদের কথাবার্তাও বন্ধ। সকলেই হাঁপিয়েছে। পেছনে মাধাইয়ের
গলাও শুনতে পাচ্ছিনা অনেক্ষন। সামনে দূরে বাঁকের মাথায় দেখলাম দাদা বৌদি একটা পাথরের
ওপর বসে দম নিচ্ছে। ঠিক ঠাওর হচ্ছিলনা কতটা রাস্তা আসা হয়েছে এ পর্যন্ত। পাহাড়ি
রাস্তার দুরত্বের হিসেব সব সময়েই একটু গোলমেলে হয়। কখনো দুজনকে জিজ্ঞেস করে এক
উত্তর পাইনি। যদি ধরে নিই আধাআধি এসেছি, তাহলে বলব, এই খাড়াই রাস্তা ভেঙ্গে আজকের
মত দম আমার শেষ। বাকিদের অবশ্য জানিনা। কানহাইয়ালালের এরকম অসুবিধে হবার কথা নয়।
সে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সক্ষম। কিন্তু বাকিদের অবস্থা দেখে মনে হলো, আমার চেয়ে খুব
ভাল কিছু নয়। পেছনে বা নিচে তাকালে ধৌলিগঙ্গার ওপর লোহার ব্রিজখানা আর চোখে পড়ছে
না। পাহাড়ের বাঁকে সে খানা কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে! এ রাস্তাতেও একেবারেই লোক
চলাচল নেই। আমরা যে এতটা উঠে এলাম, একটিও লোক দেখিনি, শুধু শুরুর দিকে কয়েকজন
শ্রমিক রাস্তা তৈরি করছে।
জুম্মা
থেকে রুইং এর পথে
|
কোন রকমে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে
চলছি। হাঁপাতে হাঁপাতে পুরোটাই কেমন অভ্যেসে পরিনত হয়ে গেছে। ঘন্টা দেড়েক পর মনে
হলো রাস্তাটা একটু যেন সমতল হতে শুরু করেছে। পাহাড়ের গা যেন একটু ধাপ কাটা ফালি
জমি সামনে। এদিক ওদিক ছড়ানো বড় বড় পাথরের টুকরোর ফাঁক দিয়ে আর বড় বড় পাইন গাছের
গুঁড়ির পাশ কাটিয়ে চলতে চলতে দেখি সামনে এক সারি ঝোপঝাড় আর তার মাঝখান দিয়ে একটা
ঘাসের জমির ওপর দু খানা ব্যাগ, দাদা আর বউদির। আরো একটু এগিয়ে দেখি দুই মক্কেল পা
ছড়িয়ে বসে আছে ঘাসের ওপর। সামনে বেশ কিছু মালপত্রের ঝোলা-ঝুলি-বোঁচকা-ব্যাগ ছড়ানো।
জওন ভাই আর একটি অল্পবয়সি ছোকরা একখানা তাঁবুর ব্যাগ থেকে টানাটানি করে তাঁবু বের
করছে। তবে কি আজকের মত এখানেই যাত্রার সমাপ্তি? সব সন্দেহের অবসান করে তৎক্ষনাৎ
জওন ভাইয়ের সদাহাস্যময় মুখ ঘোষনা করল “রুইং আ গয়ে দাদা”। যাক, আর হাঁটা নেই। ধপাস
করে পিঠের ব্যাগ নামিয়ে ঘাসের ওপর থেবড়ে বসলাম। তার পর শুয়েই পড়লাম। একেবারেই দম
নেই আর ওঠার। ব্যাগ থেকে বোতল টেনে বের করে চুমুকে চুমুকে জল খেলাম। সেই সকাল বেলা
ভরপেট পকোড়া আর চা খেয়ে বেরিয়েছি। কিন্তু খিদের নামগন্ধ নেই এতক্ষনেও। একটু দূরে
দেখি আর এক ছোকরা, পরে জেনেছিলাম তার নাম বিপিন, স্টোভ ধরিয়ে একটা ডেকচিতে কি সব
নাড়ানাড়ি করছে। এদিকে পেছনে দেখি কানহাইয়ালাল আর মাধাইও এসে গেছে। ব্যাগ নামিয়ে
সকলেই মিনিট দশেক সময় নিল ধাতস্থ হতে। তার পর এল জল ভরার পালা। আমাদের বোতলে জল প্রায়
শেষ। আমরা যে জায়গাটায় এসে বসেছি, এখানটা ছোট্ট একটা থাক কাটা ঘাসে ঢাকা সমতল
জায়গা। পশ্চিম দিকে খাড়াই ঢাল নেমে গেছে অনেক নিচে ধৌলিগঙ্গা পর্যন্ত। ওপাশের
পাহাড়ের গায়ে জনশূন্য হাইওয়েটা এখনো দেখা যাচ্ছে সরু দাগের মত। খানিক উত্তরে
ধৌলিগঙ্গার সঙ্গে মিশেছে বাগিনী। এক খরস্রোতা পাহাড়ি খামখেয়ালী কিশোরী। আগামী কাল
থেকে আমরা ওই বাগিনীর স্রোত ধরে ধরেই এগোবো বাগিনীর উৎসের দিকে, বাগিনী হিমবাহের
দিকে। আমাদের এবারের গন্ত্যব্য ওই বাগিনী হিমবাহ।
কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে
সকলেই উঠে দাঁড়ালো। রুইং এ সামান্য কিছু ঘরবাড়ি আছে। আছে পঞ্চায়েত, আছে জলের
ব্যবস্থা। নেই বিদ্যুত, চিকিৎসাকেন্দ্র। তবে অস্থায়ী আস্তানায় যে টুকু থাকা সম্ভব
রুইং এ প্রায় তার সবই আছে। প্রকৃতি নির্ভর সহজ সরল জীবনযাত্রা। প্রকৃতি থেকে
বাঁচার রসদ আহরন করা হচ্ছে বটে কিন্তু অত্যন্ত সচেতন ভাবে। পরিবেশের কোন ক্ষতি না
করে। আমাদের ক্যাম্প যেখানে খাটানো হচ্ছে, তার পূব দিকে ঘরবাড়ি আর সেখানেই জলের কল
আছে। পাহাড়ি ঝরনার জল পাইপে করে নিয়ে আসা হয়েছে গ্রামের ভেতরে। আমরা জল ধরতে
গেলাম। সকলের সঙ্গেই দুখানা করে এক লিটারের বোতল। সবাইকেই বলে দেওয়া হয়েছে যেন
পর্যাপ্ত জল খাওয়া হয়। না হলে উচ্চতাজনিত সমস্যা হতে পারে। হাই অল্টিচিউড মাউন্টেন
সিকনেস পাহাড়ে ট্রেকিং এর সময় এক অবসম্ভাবী সমস্যা, এবং এর একমাত্র চিকিৎসা হলো
আক্রান্ত মানুষকে নিচে নামিয়ে আনা। উচ্চতাজনিত বাতাসের চাপ কমে যাওয়া এবং
অক্সিজেনের অভাব থেকেই মূলতঃ এর উৎপত্তি হয়।। গা গুলোনো, মাথা যন্ত্রনা, বমি এসব
হলো এর প্রাথমিক উপসর্গ। সময়মত ব্যবস্থা না নিলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে
পারে। জওন ভাইয়ের কাছে পরে শুনেছিলাম গত বছর বাগিনীতে নাকি দু জন প্রান হারিয়েছেন।
আমরা সকলেই আমাদের বোতল
গুলো ভরে এনে দেখি, বাকি তাঁবু গুলোও ব্যাগ থেকে বের করে রাখা হয়েছে। আমরাও
অল্পস্বল্প হাত লাগালাম। দেখতে দেখতে তাঁবু খাড়া হয়ে গেল। একটা বড় তাঁবু, আমাদের
খাওয়া দাওয়া আর বসে গল্পগুজব করার জন্যে। এক খানা রান্নাঘর। আর বাকি দু খানা আমাদের
শোবার জন্যে। তিনজন তিনজন করে এক একটা তাঁবুতে আমরা সেঁধিয়ে যাবো রাতে। বড় তাঁবুর
ভেতরে গিয়ে বসতেই দেখি বিপিন ডেকচিতে করে কিছু একটা খাবার জিনিস নিয়ে হাজির হয়ে
হাঁক দিল “লাঞ্চ”। পরের কদিনে “বিরেকফাস্ট”, “লাঞ্চ”, “চায়ে” আর “ডিনার”, বিপিনের
গম্ভীর গলায় এই হাঁকগুলো বড় পরিচিত হয়ে গেছিল। আমরা বড় তাঁবুর ভেতরে গিয়ে বসতেই হাতে
থালা আর চামচ ধরিয়ে দিল ছোকরা, আর গরমাগরম খিচুড়ি জাতীয় একটা বস্তু এসে পড়ল থালায়।
সময় বাঁচাতে সমস্ত সবজি আর চাল একসঙ্গে রান্না করা। কিন্তু দিব্যি খেতে। গরম গরম
এক চামচ মুখে দিতেই খিদে ফিরে এলো। আবার দেখি বিপিন গিয়ে এক থালা ভর্তি ডিমের অমলেট
আর পাঁপড় ভাজা এনে ফেলেছে। ফুর্তির চোটে গুরু ভোজন হয়ে গেল। ট্রেকে গিয়ে সাধারনতঃ
রুটি আচার দিয়েই খাওয়া সাঙ্গ হয়। এরকম খাওয়া আশা করিনি। হয়ত প্রথম দিন বলেই পাওয়া
গেল।
গুরু ভোজনের বেলায় দেখলাম আমি
একা নই। বাকিদেরও একই হাল। দাদা আমারই মত খাইয়ে মানুষ। আমাদের দুজনকে বাদই রাখলাম।
মাধাইটা খালিপেট একেবারেই সহ্য করতে পারেনা। ঘন্টা দুই অন্তর কিছু না খেলে ওর মাথা
যন্ত্রনা শুরু হয়। কাজেই সে ও খারাপ খেলেনি। শেষে দেখি বৌদি আর জগাইও ডেকচি আর
হাতা ধরে টানাটানি করছে। তখন বুঝলাম ব্যাপারটা ভালোই জমেছে। একমাত্র কানহাইয়ালাল
নিরুদ্বেগ এবং অকম্পিত। এত বড় অভিযানের পুরো দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে আমাদের
সকলকে নিয়ে এসেছে। নেতা হিসেবে তার একটা চিন্তা তো আছেই। খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা আর
তাঁবুর ভেতরে বসে রইলাম না। পড়ন্ত রোদে বাইরের ফালি ঘাস জমিটায় বেরিয়ে এলাম। শনশনে
হাওয়া ঠিক তেমনিই আছে। এবং খাওয়া দাওয়া আর বিশ্রামের পর, আর টি শার্ট গায়ে থাকা
যাচ্ছে না। হালকা গরম জামা গলাতেই হলো একটা করে। ওদিকে একটু দূরে একটা সরু নীল
রঙের তাঁবু খাটানো হয়েছে। দেখে বুঝলাম সে খানা টয়লেট টেন্ট। মোটামুটি একটা অলিখিত
নিয়ম থাকে দলে, যে সাধারনতঃ দলের মহিলারাই টয়লেট টেন্ট ব্যবহার করেন আগে। বাকিরা
পরে।
আমার ঘুম ভাঙ্গে সকলের আগে।
এবার যদি অপেক্ষা করে থাকতে হয় সকাল সকাল, সে বড় জ্বালা। কাজেই চারিদিকে সরেজমিনে
একটু দেখাশোনা করতে শুরু করলাম, যে কোনদিনে একটু ফাঁকা আর ঝোপঝাড়ের আড়াল রয়েছে।
দেখে শুনে একটা জায়গা বেছে রেখে এসে একটা পাথরের ওপরে বসে রইলাম চুপ করে। চারিদিক
একেবারে নিস্তব্ধ। এরকম নিস্তব্ধতা আমি এর আগে খুব কম পাহাড়ি জায়গাতেই অনুভব
করেছি। যে সমস্ত জায়গায় গাড়ি করে পৌঁছনো যায়, সেখানে এরকম পরিবেশ পাওয়া অসম্ভব।
কাজেই যাঁরা এরকম জায়গায় কখনো আসেননি, তাঁদের জন্যে আমার ভান্ডারে পর্যাপ্ত বাংলা
শব্দের বড়ই অভাব, যা দিয়ে আমি এই অসামান্য সুন্দর জগতকে বর্ননা করতে পারি। আমরা
বসে আছি একটা পাহাড়ের ঢালে। যার আসেপাশে আকাশছোঁয়া আরো অনেকগুলো শৃঙ্গ। সামনে
পশ্চিমের শৃঙ্গমালার পেছনে সূর্্য্য ধিরে ধিরে ঢলে পড়ছে। আমাদের সামনে বহু নিচে
ধৌলিগঙ্গা আর তাতে এসে মিশেছে বাগিনী। এখানে বসে কেবলই মনে হতে লাগল, বহু দুরের
ছদ্মব্যস্ত শহর, সেখানকার ছদ্মবেশ আর মুখোশধারী মানুষজন, যান্ত্রিক সভ্যতা, সবই
আসলে অলীক মায়া। পৃথিবীকে যদি কোথাও স্পর্শ করা যায়, তাহলে তা এইখানেই করা সম্ভব।
রুইং
এ আমাদের ক্যাম্পসাইট
|
একে জুন মাসের মাঝামাঝি,
তার ওপরে আমরা চলে এসেছি অনেকটা পশ্চিমে। সন্ধ্যে ছটাতেও তাই বেশ ঝকঝকে রোদ এখানে।
যদিও এক এক সময় কনকনে হাওয়ার ঝলক এসে কাঁপুনি ধরিয়ে দিতে শুরু করেছে । জওন ভাই বলল
হপ্তা দুয়েক আগেও নাকি রুইং এ অল্প অল্প বরফ জমে ছিলো। সাড়ে ছটার পর দেখলাম রোদ
খুব তাড়াতাড়ি কমতে শুরু করল। সাতটার পর একেবারেই চলে গেল, কিন্তু দিনের আলো থেকে
গেল। আকাশে প্রচুর মেঘ। আসছে যাচ্ছে। দেখতে ভালোই লাগছিল, কিন্তু মনে হলো, আগামী
কদিন বৃষ্টি হবে না তো? যদিও বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদের সকলের সঙ্গেই
রেনকোট বা পঞ্চো আছে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। বৃষ্টিতে পাহাড়ি পায়ে চলা রাস্তায়
হাঁটা বেশ কষ্টকর ও বিপজ্জনক। পাথর গুলো পেছল হয়ে যায়। আর থাকে কাদা। পা পিছলোলে
নিশ্চিন্ত। কাজেই প্রানপনে চাইছিলাম আর যাই হোক, বৃষ্টি যেন না হয়। এই ভাবতে
ভাবতেই বিপিনের গলা শুনলাম “চায়ে”। ব্যাস, ভাবনা চিন্তা পাথরের পাশে রেখে, বড়
তাঁবুর ভেতরে সেঁধোলাম। থেবড়ে বসে দেখি চায়ের সঙ্গে গরম গরম পকোড়া হাজির। বিপিন আর
জওন ভাই করছেটা কি? পাহড়ে উঠে কি শেষে খেয়ে খেয়ে ওজন বাড়িয়ে ফিরবো? অত ভাবার সময়
নেই। পকোড়া আর চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। বিপিন একটা মহাকায় কেটলি নিয়ে চা দিতে আসে।
গ্লাসে চা শেষ হলেই আবার একটু ঢেলে দেয়। বুঝলুম চায়ের চরিত্র গাঢ়োয়ালি হলে কি হবে,
পরিবেশন এবং খাওয়ার রেওয়াজটি খাঁটি পেশাওয়ারি। আলীসাহেবের লেখায় এমনতর চা খাওয়ার
কথা পড়েছি, যেখানে পাত্র খালি হলেই তৎক্ষনাত সেটা ভরে দেওয়া হয়। আর চা খেতে না
ইচ্ছে হলে, পাত্রটি উলটো করে রাখার নিয়ম। কিন্তু এই কনকনে শনশনে হাওয়ার তিন গ্লাস
চা খাওয়ার পরেও দেখলুম কেউই সেগুলো উলটো করে রাখছে না।
চায়ের পর তাঁবুর ভেতরে এসে
বসল জওন ভাই। আগামী কাল এবং বাকি দিনের পরিকল্পনা ভাল করে বুঝিয়ে দিতে লাগল। আগামী
কাল আমাদের লক্ষ্য দ্রোনাগিরি। এটাও এক অস্থায়ী গ্রাম। বছরের তিন চার মাস সেখানে
মানুষ থাকে, পশুপালন করে। আবার বরফ পড়তে শুরু হলেই নিচে নেমে আসে। রাস্তা অনেকটা
কাজেই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে। রাস্তায় এক জায়গায় থেমে দুপুরের খাওয়া। তার পরে
আবার পথ চলা। জিজ্ঞেস করলাম তার পরের দিন গুলোতে পরিকল্পনা কি। জওন ভাই সবিনয়ে
জানালো – “ আপলোগ কাল ক্যায়সে চলতে হো দেখেঙ্গে, উসকে বাদ সোচেঙ্গে কাঁহা তক জানা
হ্যায়”। তখন বুঝিনি, কিন্তু পরের দিন বুঝেছিলাম, দ্রোনাগিরির রাস্তা কেন এক বড়
পরীক্ষা। সে কাহিনী ক্রমশঃ প্রকাশ্য। আপাতত জওন ভাই কিছু মূল্যবান উপদেশ দিলো
আমাদের। সকালে যথা সময়ে তৈরি হওয়া বা লাইন করে হাঁটা এগুলো তো রয়েছেই। সেই সঙ্গে
পর্যাপ্ত পরিমান জল খাওয়া। কেননা আমরা আগামীকাল অনেকটা উচ্চতা এক দিনে উঠবো।
মোটামুটি আটশ মিটার। যেখানে প্রতিদিনের সহনশীল উচ্চতা ধরা হয় ৩০০ মিটার, সেখানে এক
দিনে তার দ্বিগুনেরও বেশী উচ্চতায় উঠে যাওয়া শরীরের ওপর অনেক রকম বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
প্রায় দশ কিলোমিটার হাঁটা পথ আমাদের অতিক্রম করতে হবে।
তাঁবুর ভেতরে বাইরের শনশনে
হাওয়া ঢুকছে না, সেই কারনে ঠান্ডা অতটা মালুম হচ্ছেনা। কিন্তু বাইরে বেরোলেই ছুরির
মত ঠান্ডা হাওয়া বিঁধছে। তাই আমরা তাঁবুর ভেতরেই বসে কিছুটা গল্প টল্প করছিলাম।
যদিও এটা বুঝতে পারছিলাম, পরিশ্রম এবং উচ্চতাজনিত কারনে শরীর বেশ ক্লান্ত। এসবের
মাঝেই রাত আটটা নাগাদ বাইরেটা একেবারে কুচকুচে কালো ঘন অন্ধকার হয়ে গেল। আর বিপিন
বড় তাঁবুর পর্দা সরিয়ে হাঁক দিল “ডিনার”। আমরাও বসেই ছিলাম। হাতে হাতে থালা চলে
এল। গরম গরম ভাত আর সবজি দেওয়া ডাল। সেই সঙ্গে পাঁপড় আর স্যালাড। ঠান্ডার মধ্যে
অমৃতের মত লাগল। প্রথমটা মনে হয়েছিল এই তো দুপুরে দেরি করে খেলাম, বিকেলে পকোড়াও
পেঁদিয়েছি ভালোই, রাতে হয়ত খিদে হবে না। কিন্তু কোথায় কি? দু তিন বার করে ভাত চেয়ে
চেয়ে খাওয়া হলো। হাত ধুতে গিয়ে মালুম পেলুম আগামী কদিনে জলের ব্যবহার কি ধরনের
পীড়াদায়ক হতে চলেছে। হাতের আঙুল, জলের ছোঁয়া লাগতেই প্রায় অসাড় হয়ে গেল। কাল সকালে
কি হবে ভেবে বেশ দুশ্চিন্তা ঘনিয়ে এলো।
এবার আমাদের এই যাত্রায়
প্রথম রাতের তাঁবুতে ঘুম। আগের তিন রাত তবু ট্রেন আর হোটেল মিলে কেটেছে। শোয়ার
তাঁবুগুলো ছোট ছোট। মনে মনে এগুলোর নাম দিয়েছিলাম সিল্কের ইগলু। যে কাপড়ে তৈরি,
সেগুলোর সঙ্গে রেশম বা সিল্কের মিল আছে। নীল রঙের এই কিচুয়া (Quechua – নামটি এক নেটিভ আমেরিকান
জাতীর। এঁরা আন্দিজ পর্বতের পাহাড়ি মানুষ) তাঁবু খুব হালকা এবং ভাঁজ করে একজন মানুষ
পিঠে বয়ে নিয়ে যেতে পারে আরাম সে। এক একটা তাঁবুতে তিন জন থাকার ব্যবস্থা। সামনের
চেন খুলে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলে একটা ছোট্ট খুপরি, ফুট তিনেকের। তার পর আরো একটা চেন
ওয়ালা দরজা, সেটা খুললে ভেতরের ঘর। সেখানে মাটিতে রবারের ম্যাট পেতে স্লিপিং
ব্যাগের ভেতর ঢুকে শুতে হবে। তাঁবুতে ঢোকা বেরোনোটা বেশ কসরতের। কেননা হামাগুড়ি
দিয়ে ঢুকতে হবে। তার পর কোনক্রমে বসে পা থেকে জুতো খুলতে হবে। এ জুতো আবার কায়দার।
এতে সাধারন জুতোর তিনগুল বেশী ফিতের ঘাট, আর সেগুলো বেশ কিছুটা না খুললে জুতো পা
থেকে আলগা হয় না। আর আলগা হবার পরে এই উঁচু গোড়ালির জুতোকে কিঞ্চিত টানাটানি করতে
হয় মিনিট খানেক। তার পরে তিনি পা থেকে আলাদা হন। জুতোজোড়া তো খুলে গেল।
এবারে দ্বিতীয় পর্দার দরজা
খুলে অন্দরমহলে ঢোকা। একটা কথা কয়ে রাখি এই তালে, যেটা না লিখলে আপনি বলবেন
চাটুয্যের নাক বোঁচা বলে ঘ্রানশক্তিও কি...। সারা সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যে ওই
জুতো আর মোজা পরে কেটেছে। জুতো খোলার পরেই আনকোরা নতুন মোজা নিজের উপস্থিতি জানান
দেবে আপনার ঘ্রানশক্তির ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করে। এবং তখন, আপনাকে সেই মোজা
জোড়াও খুলে জুতোর ওপর রেখে তার পর অন্দরমহলে যেতে হবে। না হলে অন্দরমহলে বায়ু
অ্যায়সা দুষিত হয়ে পড়বে, যে আপনাকে তাঁবু ছেড়ে হিমঠান্ডায় বাইরে রাত কাটাতে হতে
পারে। কেননা স্তালিনগ্রাদ আর সাইবেরিয়ার হিমে জমতে জমতেও কিছু জার্মান ফৌজি ১৯৫৫
সালে দেশে ফিরেছিল, কিন্তু হিটলারের গ্যাস চেম্বার থেকে কেউ ফেরেনি। আর মোজার
দৌলতে তাঁবুর ভেতরেও গ্যাস চেম্বারের খুব কাছাকাছি অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। অতএব
জুতো খোলা ও মোজা হইতে অতীব সাবধান। এর পরে দ্বিতীয় অধ্যায়। আমার মত সকলের জীবনেই
থাকে। এই অধ্যায়ে এসে আপনি ধরাচুড়ো খুলতে শুরু করবেন একে একে। গরম জ্যাকেট, টুপি,
এই সব খোলার পর শেষ যুদ্ধ। স্লিপিং ব্যাগ নামক এক মূর্তিমান অশান্তির সঙ্গে আপনাকে
রাত কাটাতে হবে। এই অশান্তি গোটানো থাকে একটা ব্যাগের মধ্যে। সেখান থেকে বের করলেই
খুলে লম্বা আকার নেয়। এর পর আপনাকে তার অভ্যন্তরে সড়াৎ করে সেঁধিয়ে যেতে হবে।
যতটা সহজে বললাম ব্যাপারটা
মোটেই তত সোজা নয়। ভেবে দেখুন না, ইশ্বর সৃষ্ট দুই অঙ্গ, যা একে অপরের জন্যেই
তৈরি, একজন অন্যজনের ভেতরে প্রবৃষ্ট হওয়াতেই মোক্ষলাগ করে ত্যাগের মহিমায়, এবং
অন্যজন প্রথমজনকে ধারন করে ও গ্রহন করে তার থেকে, আর সেই দানেই প্রানীজগৎ পরিপুষ্ট
হয়, জীবনচক্র চলতে থাকে। অথচ প্রথম প্রথম ইশ্বর সৃষ্ট এই দুই অঙ্গও ব্যাপারটা করতে
হিমসিম খায়। বাচ্চাদের খেতে দেখেননি? মুখের বদলে সারা গায়ে খাবার মেখে ফেলে তারা।
আপনি কি আমার কথা থেকে অন্য কিছু ভাবছিলেন পাঠক? আমি কিন্তু নিয্যস মুখ আর হাতের
কথাই...। যাই হোক, অনেক কায়দা কসরত করে পা জোড়া ভেতরে সেঁধিয়ে স্লিপিং ব্যাগের
কানা ধরে টান দিতে গেলাম, দেখি ব্যাগের খোলা চেন দিয়ে পা জোড়া সড়াৎ করে বাইরে চলে
এলো। এই কসরত চলতে চলতে কিছুক্ষন পরে মনে হলো আমি সেঁধিয়েছি ব্যাগের ভেতর। সঙ্গে
সঙ্গে চেন টেনে বন্ধ করলাম। কি জানি বাবা, যদি আবার কোথাও দিয়ে বেরিয়ে আসি বাইরে।
মনে একটা শান্তির প্রলেপ পড়তে পড়তে টের পেলাম অন্যকিছু। উচ্চতা বৃদ্ধির কারনে জওন
ভাই খুব সতর্ক করেছিল, আমরা যেন পর্যাপ্ত পরিমানে জল খাই। শুয়ে পড়তেই বুঝলুম
পর্যাপ্ত পরিমানে জল খাওয়ার পরিনাম কি হতে পারে। প্রাকৃতিক ডাক উপেক্ষা করা সম্ভব
নয়। এদিকে এই ত্রিস্তরীয় প্রতিরক্ষা ও অশান্তির বলয় দু বার ভেদ করার অনিচ্ছা। একবার
যাওয়া এক বার আসা। ভাবলুম চেপে শুয়ে পড়ি। কিন্তু রাত অনেক বাকি। ঘড়িতে সবে সাড়ে
আটটা। এই সময় আমি বাসে করে বাড়ি ফিরি এমনি দিনে। অগত্যা উঠতেই হলো।
টপকে পাহাড় টপকে সিঁড়ি, পৌঁছে
গেলাম দ্রোনাগিরি
ভোর বেলায় ঘুম ভাঙল। কিছুটা
অভ্যেস বসতঃ, আর কিছুটা সাবধানতায়। কেননা প্রাকৃতিক কাজকর্ম অন্যরা উঠে পড়ার আগেই
সেরে ফেলতে হবে। মিনিট দশেক বেশ কঢ়ি মেহনতের পর প্রথমে স্লিপিং ব্যাগ আর তার পর
তাঁবুর ঘেরাটোপ থেকে নিজেকে টেনে বের করে আনতে পারলাম। বাইরে বেশ অন্ধকার অন্ধকার
ভাব। পূব দিকে তাকালাম, সামনের বরফ ঢাকা চুড়োগুলোর ওপরে মায়াবী গোলাপী আভা ধরতে
শুরু করেছে। কনকনে ঠান্ডা। বাইরে গেলে আমার কোমরে একটা খাকি পাউচ ব্যাগ আঁটা থাকে
সর্বক্ষন। তার ভেতর টুকিটাকি বস্তু, যেমন দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম, দাঁত মাজার পেস্ট
ও বুরুশ, মানিব্যাগ, পরিচয়পত্র এসব থাকে। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে আমার ব্যাগ থেকে
কিছুটা টয়লেট পেপার বের করে ওই পাউচে ঢুকিয়ে রেখেছি, ভোরবেলা ঘুমচোখে যদি ভুলে
যাই। আমার শারীরিক চক্রে একদম ঘুম ভেঙ্গেই ত্যাগের কাজ শুরু হয়ে যায়। তাঁবু থেকে
বেরিয়ে এলাম। বহু দূরে পশ্চিম দিকে পাহাড়ের চুড়োগুলো খুব অল্প গোলাপি রঙ ধরতে শুরু
করেছে। হাঁ করে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। ঘন অন্ধকারের ভেতর ঝুলন্ত শিখর গুলো হালকা
গোলাপী। মনে হতে লাগল হলিউডের “অবতার” ছবিতে দেখানো হালেলুইয়া মাউন্টেন দেখছি। সেখানে
আস্ত একখানা পর্বত এরকম হাওয়ায় ভেসে থাকে। ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে, কনকনে ঠান্ডা।
আমার গায়ে একটা সাধারন হুডি, কলকাতায় বেশ ভাল শীতে যেগুলো পর সেই রকম। একটু পরেই
প্রকৃতির শোভায় বাধ সাধল প্রকৃতিরই ডাক। হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে গতকাল খুঁজে রাখা
জায়গার দিকে পা বাড়ালাম। জায়গাটা আমাদের
ক্যাম্প থেকে একটু নিচের দিকে। কাজকর্ম সেরে আবার উঠে এলাম সেই হি হি করতে করতে।
ভাবলাম একটু পায়চারি করি, তাতে হয়ত কাঁপুনি একটু কমবে। ওদিকে দেখি আমাদের রান্নাঘর
তাঁবুর ভেতর থেকে পাম্প দেওয়া স্টোভের হিস হিস শব্দ বেরোচ্ছে। এই কাকভোরে করছে কি
এরা? কাছে যেতেই বিপিন ছোকরা এক গাল হাসি মুখে একটা কাপ হাতে ধরিয়ে দিলো। গরম গরম
ধোঁয়া ওঠা চা। বেঁচে থাকো বাবা বিপিন। চায়ে চুমুক দিতেই মনে হলো, এইবার ব্যাগ
কাঁধে তুলে পা বাড়ানোই যায়।
ঘন্টাখানেকের ভেতর আমাদের লোকজন সবাই উঠে পড়ে কাজকম্ম সেরে ফেলল। আমাদের মোটামুটি হিসেব ছিলো সকাল আটটার ভেতর সবাই হাঁটা শুরু
করবে। সকাল সাতটায় আমি আমার নিজস্ব একটা টোটকা শুরু করলাম। কোঁত কোঁত করে একদম
মেপে দু লিটার জল খেলাম। জল যত বেশী খাবো, রক্ত ঘন হবার সম্ভাবনা তত কমবে এবং রক্ত
ঠিক ঠাক তরল থাকলে অক্সিজেন বহন করতেও সুবিধে, ফলে আমার মাউন্টেন সিকনেস হবার
সম্ভাবনাও কমবে। ফিরে আসার পরে লিখছি বলেই লিখতে পারছি, আমার এই টোটকা ১০০% সফল
হয়েছিল। আমার অবাক জলপান খতম হতেই বিপিনের অমোঘ আহ্বান ভেসে এলো বড় তাঁবুর মুখ
থেকে “বিরেকফাস্ট”। গিয়ে দেখি চিঁড়ের পোলাও আর হালুয়া। আহা, গরম গরম বড় ভাল লাগল।
ঝটপট খেয়ে ব্যাগ বের করে আনলাম তাঁবু থেকে। আর তার পরেই সেই কঠিনতম কাজে নামতে হলো
আমাদের সকলকে। না, পাহাড়ে ওঠা নয়, স্লিপিং ব্যাগ ভাঁজ করা।
আগেই বলেছি, স্লিপিং ব্যাগ
ভারি বেয়াড়া জিনিস, এক মুর্তিমান অশান্তি। ওদিকে তাঁবু গুলো খুলে ভাঁজ করা হচ্ছে।
এদিকে আমরা নিজেদের স্লিপিং ব্যাগ ভাঁজ করে সেগুলোকে স্লিপিং ব্যাগের ব্যাগে
ঢোকাবার লড়াই করে চলেছি। স্লিপিং ব্যাগ ভাঁজ করার পদ্ধতি আপাতদৃষ্টিতে ভারি সোজা।
বস্তুটাকে সোজা করে পাতুন, টিপে টুপে ভেতরের হাওয়া বের করুন। রাতে আপনার পেট যদি
এদিক ওদিক হয়ে থাকে, তাহলে একটু সাবধান, নাকে রুমাল বেঁধে নিতে পারেন। এর পর পায়ের
দিক থেকে চেপে চেপে রোল করুন, আর রোল হয়ে গেলে সেটাকে ব্যাগের ভেতর পুরে ফেলুন।
কিন্তু বেয়াড়া স্লিপিং ব্যাগ বাঁদরামো শুরু করে ঠিক রোল করার মাঝামাঝি সময় থেকে।
আপনি যখন প্রায় ভেবেই নিয়েছেন কেল্লা ফতে, ঠিক তখনই দেখবেন ফসফসে প্যারাস্যুট কাপড়ে
তৈরি ব্যাগের রোল একদম ভেতরের দিক থেকে ফসকাতে শুরু করেছে। আপনি তখনো বেশ
আত্মবিশ্বাসী। এক হাত দিয়ে রোলকরা অংশ চেপে ধরে, অন্য হাত দিয়ে ফসকে যাওয়া অংশকে
চেপে জায়গা মত বসাতে গেলেন, তার ফলাফল হলো, নিচের ফসকে যাওয়া অংশ আরো একটু ছেতরে গেল,
আর ওপরের রোলটি ভেতরে চাপ খেয়ে একটু ফুলে গেল। এই করে করে আপনি মিনিট সাত আট পর ওই
কনকনে ঠান্ডায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিয়ে রোল করা শেষ করলেন। চোখে দেখেই বোঝা
যাচ্ছে রোলটি নিখুঁত হয়নি। কিন্তু কি এসে যায়? ব্যাগে ঢোকাতে পারলেই তো হলো। তাই
আবার এক হাতে রোল পাকড়ে ধরে অন্য হাতে ব্যাগ নিয়ে তাতে ঢোকাবার চেষ্টা শুরু করলেন।
ফলাফল, ব্যাগের চেয়ে রোলের আকার বড়, তাই কিছুতেই ঢুকলোনা। এর পর আপনি একটা কানা,
আগে ব্যাগের মুখে ঢুকিয়ে পরে বাকিটুকু
ঢোকাতে চাইলেন চেপে, এবারে ফলশ্রুতি হিসেবে আপনার সাধের রোল করা বস্তু আরো ছেতরে গেল।
কেমন যেন লাচ্ছেদার পরোটা বেলতে শুরু করার ঠিক আগের অবস্থা্র মত দেখতে হয়ে গেল।
এবার আপনার মাথায় খুন চেপেছে। আপনি জেদের বশে হেঁইয়ো বলে ব্যাগ ধরে এক টান মেরে
ছেতরে যাওয়া কিঞ্চিত সরু দিকটা ঢোকাতে গেলেন। হরি হরি, এবার বেখাপ্পা ছাপ পড়ে পুরো
রোলটিই খুলে আবার একেবারে শুরুর অবস্থায় চলে গেল। এবার আবার শূন্য থেকে শুরু। ঠিক
কতবারের চেষ্টায় আপনি এই স্লিপিং ব্যাগ বাগে আনতে পারবেন, বলা কঠিন। তবে চেষ্টা
চালিয়ে যেতেই হয়। নাম যখন স্লিপিং, তখন স্লিপ যে করবেই সেটা আগে থেকে ধরে নেওয়াই
ভাল।
আধঘন্টাটাক প্রানান্তকর
পরিশ্রমের পর আমাদের বাহিনি উঠে দাঁড়ালো। বিপিন আর জওন ভাই ততক্ষনে বাকি জিনিসপত্র
সব গুছিয়ে ফেলেছে। আমাদের সকলের জলের বোতলে জল আছে কিনা দেখে নেওয়া হলো। দু লিটার
জল সঙ্গে নিয়ে হাঁটার নিয়ম ধার্য্য করা হয়েছিল। জল কম খাওয়া মানেই মাউন্টেন সিকনেস
ডেকে আনা। কাঁটায় কাঁটায় না হলেও আটটার সামান্য এদিক ওদিক করেই রওনা দেওয়া গেল। আজ
আমাদের গন্তব্য দ্রোনাগিরি। দ্রোনাগিরি একটি পর্বতের নাম, আবার একটি অস্থায়ী
জনপদেরও নাম। অস্থায়ী কেন? কারন দ্রোনাগিরি জনপদ যে উচ্চতায় অবস্থিত, সে জায়গা
বছরের মধ্যে মাস চারেক বরফ মুক্ত থাকে। ওই চার মাসের জন্যে নিচে চামোলির কাছাকাছি
এলাকা থেকে পশুপালকরা উঠে এসে দ্রোনাগিরিতে আস্তানা জমায়। তা বলে মোটেই ভাববেননা
দ্রোনাগিরিতে গুচ্ছের ছাগল ভেড়া আর কিছু গরীব পশুপালকের কোনমতে মাথা গোঁজার জন্যে
যেমন তেমন করে তৈরি করা ছাউনি ছাড়া আর কিছু নেই। যে চারমাস দ্রোনাগিরিতে মানুষ
বসবাস করে, সেই চার মাস সেখানে মানুষের তৈরি সমাজের প্রতিটি সংগঠন কাঁটায় কাঁটায় কাজ
করে চলে। পাহাড়ের এত ওপরে এই উচ্চতায় জীবন খুব কঠিন। তাই সামাজিক ভেদাভেদ এখানে
কম, এবং পারস্পরিক সহযোগিতা অনেক অনেক বেশী। আমরা আজ দুপুরের দিকে পৌঁছবো
দ্রোনাগিরি। দেখবো সেখানে কেমন জীবন অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্যে।
সকলে দু লিটার করে জল ভরে
নিয়েছি। আর সেই জলের বোতল গুলো আছে আমাদের পিঠের ব্যাগের মধ্যে। এ ছাড়া আছে আমার
জামা কাপড়, আনুসঙ্গিক যা যা লাগবে অভিযানের সময়। আছে আমার যম ভারি ক্যামেরা ও তার
লেন্স। পরে একবার ওই পিঠের ব্যাগে যা যা ছিলো, সব কিছু ভরে ওজন করে দেখেছিলাম, ১৭ কিলো হয়েছিলো সব মিলিয়ে। ওই ১৭ কিলো ওজন নিয়ে রুইং থেকে দ্রোনাগিরির রাস্তায় পা
বাড়ালাম। রাস্তা বলতে পাহাড়ের গায়ে একটা খাঁজ। কখনো ওপরে উঠেছে, কখনো নিচে নেমেছে।
আপাতত আমরা ওপরের দিকেই উঠবো, কারন দ্রোনাগিরির উচ্চতা রুইং এর থেকে অনেক বেশী। পথ
মাটি ও পাথরের। মাঝে মাঝে বেশ বড় বড় পাথরের টুকরো। দ্রোনাগিরিতে বছরের এই সময়ে
বাসিন্দারা উঠে আসে পশুপালন ও অন্য কাজকর্মের জন্যে। তাই যাতায়াত বাড়ে, আর সেই
কারনেই পাহাড়ের গায়ে একটা খাঁজ হয়ে গেছে পায়ে পায়ে। ওটাই রাস্তা। রুইং থেকে পা
বাড়ালাম। প্রথমেই কিছুটা চড়াই। প্রায় ১০০ মিটার মত। এই চড়াই টপকে রুইং এর চৌহদ্দি
আমরা পেরিয়ে এলাম। রুইং এও সামান্য কিছু
অস্থায়ী জন বসতি আছে। সব মিলিয়ে শ খানেক লোক হবে। আমাদের দেখে এক বৃদ্ধ গুটি গুটি
পায়ে এগিয়ে এলেন। ভাঙ্গা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে আসছেন, যাবেন কোথায়? বৃদ্ধের
গলার স্বর ঘষাঘষা অস্পষ্ট, উচ্চারন বয়সজনিত কারনে কিছুটা জড়ানো, কথা বলেন খুব
আস্তে। কাজেই কান পেতে মন দিয়ে না শুনলে বোঝা মুশকিল। আমরা বললাম আসছি কলকাতা
থেকে, অনেক দূর। যাবো বাগিনী। এখানে মানুষজনের জগত যোশীমঠ বা খুব বেশী হলে রুদ্রপ্রয়াগেই
শেষ। তার পরের দুনিয়ার আকার সম্পর্কে খুব বেশী ধারনা কারোরই নেই। দিল্লি, কলকাতা,
নিউ ইয়র্ক সবই সেখানে এক রকম। মাথা নাড়তে নাড়তে এবার বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন,কি পাবে
সেখানে? বললাম ঘুরতে এসেছি। একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পর বৌদির
গলায় ঝোলা ক্যামেরাটা দেখিয়ে বললেন ওতে ছবি ওঠে? বললাম আজ্ঞে হ্যাঁ, তা ওঠে। একটু
চুপ করে থেকে মৃদু হেসে বললেন, আমার একটা ছবি তুলে দেবেন? আমার কোন ছবি নেই। কখনো
কেউ তোলেনি।
পাহাড়ি সৌন্দর্য্য,
সোনাঢালা সকাল, পাখির ডাক, ঝিরিঝিরি হাওয়া সব কিছু ছাপিয়ে কোথা থেকে পাঁচ হাজার
বছরের পুরোনো খানদানী সভ্যতার কংকালসার ভুতুড়ে মুখ আমাকে কিছু বলতে চাইলো। আমার
সামনে দাঁড়িয়ে খুব কম হলেও নব্বই পার করা এক বৃদ্ধ, যিনি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের
নাগরিক, যে দেশ মঙ্গলগ্রহে মহাকাশযান পাঠিয়ে দুনিয়ায় সাড়া ফেলতে পারে, অথচ রাজধানী
দিল্লি থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে তার নিজের নাগরিকের জন্যে ন্যুনতম শিক্ষা স্বাস্থ
জীবনধারনের ব্যবস্থাটুকুও করতে পারেনা। চলে যেতে আর হয়ত কিছু দিন বাকি, বৃদ্ধের বড়
সখ, একখানি ছবি যেন থাকে তাঁর, স্মৃতি হিসেবে। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম। কিসের যে
বড়াই করি আমরা কে জানে! শপিং মল, ফ্লাই ওভার আর নাইট ক্লাবের কনজিউমার ফেটিসিজমের
বুর্জোয়া বড়াই এখানে এসে এক নিমেষে গুঁড়িয়ে যায়। বৌদি তাড়াতাড়ি ক্যামেরা তাগ করে
কয়েকটা ছবি তুলল। আর আমাদের টুটাফুটা হিন্দিতে বুঝিয়েও দিলো যে ছবি সে প্রিন্ট
করিয়ে জওন সিং রাওয়াতের হাতে পাঠিয়ে দেবে। জওন সিং রাওয়াতের এখানে একখানা অস্থায়ী
আস্তানা আছে। আমাদের কিছু জিনিস পত্র, যেগুলো ওপরে আমাদের আপাতত লাগবে না, সে গুলো
সেখানে রেখে দিলাম। আসার দিন নিয়ে নিলেই চলবে। একশ মিটার মত চড়াই ভেঙ্গেই মনে হচ্ছিল বেশ হাঁফ
ধরছে। পরের কদিনে অবশ্য এই হাঁপিয়ে যাওয়াটা কায়দা করার একটা মানসিক উপায় বের করে
নিয়েছিলাম। সেটা ক্রমশঃ প্রকাশ্য।
রাস্তা মনোরম। সকালের ভিজে
ভিজে আবহাওয়ায় চলতেও বেশ লাগছে। শুধু চড়াই এলেই আমরা সকলে কয়লার ইঞ্জিনের মত শব্দ
করছি, আর জওন সিং রাওয়াত শিস দিতে দিতে তুড়ুক তুড়ুক করে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে
হিংসে হচ্ছিল। আজও আমরা শুরু করেছি দুজন দুজন করে। দাদা বৌদি সকলের আগে। তার পরে
আমি আর জগাই আর আমাদের ঠিক পেছনেই মিটার তিনেক দূরে আসছে কানহাইয়ালাল আর মাধাই। আধ
ঘন্টাটাক চলার পরেই পথ একটু অভ্যস্ত হয়ে এলো। মানে সব মিলিয়ে রাস্তা ফুট তিনেক কি
ফুট চারেক চওড়া। কোথাও কোথাও আরো সরু। এক দিকে একদম খাড়াই পাথর উঠে গেছে দেওয়ালের
মত। আর উলটো দিকে অনেক নিচে অবধি খাড়াই খাদ। বহু নিচে একটা সাদা সফেন জলের ধারা
বইছে প্রচন্ড শব্দ করে। ওটাই বাগিনী গাদ (গাদ – ছোট নদী)। ওই গাদ ধরে ধরেই আমরা
এগোবো আর ওর উৎসস্থল পেরিয়ে বাগিনী হিমবাহের ওপরে উঠে পড়ব।
রুইং
থেকে রওনা হবার পর
|
প্রথম মিনিট কুড়ি হাঁটার
সময় রাস্তার ধারে একটা সরু জলের পাইপ দেখছিলাম। একটু এগিয়ে দেখলাম পাহাড়ের গায়ে
একটা ঝরনা থেকে ওই পাইপে করে জল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিচে। মনে পড়ল রুইং এ আমরা যেখান
থেকে জল ভরেছি আমাদের বোতলে সেটা একটা পাইপের মুখই ছিলো বটে। রুইং এ কোন জলের ব্যবস্থা
নেই বলে কিছুটা ওপর থেকে জল এই ভাবে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে ঝরনার দেখা পেলাম, তার
ঠিক পরেই রাস্তা ঘুরলো একটা বাঁকে আর শুরু হলো আসল চড়াই। বাপ রে বাপ। মাঝে মাঝে
মনে হচ্ছিলো কোমরের ওপর রোলার চলছে। আসলে আমার দুটো পায়ে ঠিক সমান জোর নেই। ভাঙার
পর ডান পায়ে, বাঁ পায়ের তুলনায় বড়জোর ৪০-৫০% জোর পাই। সেই জন্যে বাঁ পায়ে কিঞ্চিত
বেশি জোর পড়েই যায়, আর সে কারনে তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হই অন্যদের তুলনায়। তা ছাড়া বয়স
জনিত একটা ব্যাপার তো আছেই আমার। যাই হোক। ঘন্টা খানেক পর জওন ভাই একটু বিশ্রামের
হুকুম দিলো। একটা চড়াই ভেঙ্গে উঠে কয়েকটা চ্যাটালো পাথরের টুকরো, ঠিক যেন বসার
জন্যেই। তাকিয়ে দেখি তার ওপরে একটা অস্থায়ী ছাউনিও কেউ করে রেখেছে। জওন ভাই বুঝিয়ে
বলল, যদি বৃষ্টির সময় কেউ এ রাস্তায় আটকে পড়ে তাহলে তার আশ্রয়ের জন্যে এরকম কয়েকটা
জায়গা ছাউনি করে দেওয়া আছে দ্রোনাগিরি পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে। এই জায়গায় এসে,
আমাদের সকলের ব্যাগ থেকে একটি বস্তু বেরোলো, যা আমাদের বাকি রাস্তায় বিস্তর হাসাহাসি
ও কান্নাকাটির কারন হয়েছিল। শুরুটা বলি। আমরা জলের বোতল বের করে কয়েকঢোক করে জল
খাচ্ছি। আমাদের গায়ে হালকা টি শার্ট কারন চড়াই ভাঙতে ভাঙতে গা বেশ গরম হয়ে আছে।
ঠান্ডা একেবারেই লাগছে না। ব্যাগ নামিয়ে বসতে গিয়ে বুঝলাম, পরিশ্রমের অনযতম প্রধান
কারন পিঠের ব্যাগের ওজন। যদি ব্যাগ একটু হালকা করা যায়, তাহলে সুবিধে হবে। এমন সময়
কে একজন বলে উঠলো, তাহলে সঙ্গে আনা খেজুর খেলেই হয়, ব্যাগের ওজন কমবে। ব্যাস,
আমাদের সকলের ঝুলি থেকে... খুলে কই। যখন আমাদের পরিকল্পনা, জিনিশ গোছানো এসব
চলছিলো, সে সময় একবার কথা প্রসঙ্গে উঠে এসেছিল, খেজুর বহন করা সোজা, খেতে ভাল, খেলে
প্রচুর শক্তি পাওয়া যায়, পেট ও ভরে আর সবার ওপরে, খেজুর পেট পরিস্কার করতে সাহায্য
করে, কোষ্ঠকাঠিন্যের মহৌষধ। ব্যাস, এই এত গুনগান
শুনে সকলেই নিজের নিজের হিসেবে খেজুর এনেছে। আমি নিয়েছিলাম কিলো খানেক।
দেখা গেলো আমিই সবচেয়ে কম। কেউ দেড়, কেউ দুই কেউ আরো বেশী কিলো খেজুর নিয়ে এসেছে
কলকাতা থেকে। সকলের ঝুলি থেকে খেজুর বেরোতে শুরু করল। সব্বোনাশের মাথায় বাড়ি, এত খেজুর খাবে কে? বইবে কে? বেশী খেলে হাঁটব কি
করে? আর ক্ষনে ক্ষনে রাস্তার ধারে উবু হয়ে বসতে হলে টয়লেট পেপার কম পড়বে যে! জওন
ভাই দেখলুম কেমন একটা অবাক দৃষ্টিতে আমাদের কিলো কিলো খেজুরের প্যাকেটের দিকে
দেখছে। শেষে নিরবতা ভঙ্গ করে আমার আনা একটা প্যাকেট জওন ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে
বললুম ইয়ে সককর কা মশহুর খাজুর হ্যায়, পাকিস্তান কা সিন্ধ প্রদেশ যে আতে হ্যায়, খা
কে দেখিয়ে। বস্তুতপক্ষে প্যাকেটের ওপরে তাই লেখা ছিলো। আমাদের দেশের ৭০% খেজুর
পড়শীর দেশ থেকেই আমদানি হয় বটে। জওন ভাই আর বাকি আমরা সকলে কেমন উদাশীন মুখ করে
মিনিট দশেক খেজুর চিবোলাম। পাহাড়ের অল্পই কমল। আবার খেজুর যে যার ব্যাগে ঢুকে গেল।
পরের কদিন সবাই সবাইকে
খেজুর খাওয়ানোর আর ব্যাগ হালকা করার অক্লান্ত চেষ্টা করে গেছে। জওন ভাই আমাদের
হাতে খেজুরের প্যাকেট দেখলেই হাওয়া। হাসিমুখ বিপিন খেজুর দেখলেই কানে কম শুনত,
আমাদের খচ্চর ওয়ালা, খচ্চর কাউকেই বাদ রাখা হয়নি। নিজেরাও প্রচুর খেয়েছি। তবু অনেক
খেজুর আমাদের সঙ্গে আবার ফেরত এসেছিল। জওন ভাই দেখালো আমাদের পশ্চিমে হাতি, ঘোড়া
এই সব শৃঙ্গগুলো দেখা যাচ্ছে। আমরা সমরস্বরে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলাম – “হাতি ঘোড়া
পালকি, জয় কানহাইয়া লাল কি”। সে না থাকলে সত্যিই আমাদের এখানে আসা হতো না। খেজুর
খাওয়ার পর দেখি রাস্তা বেশ ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে। প্রথমটা বড় আহ্লাদ হলো। পরে
মনে হলো, আমাদের এখন কেবল ওপর দিকে উঠতে হবে। অতএব কোথাও যদি নামা হচ্ছে, তার মানে
এর পরে আরো বেশী উঠতেও হবে। আনন্দ সেখানেই মিইয়ে গেল। ব্যাপার টা হলোও তাই। প্রায় দশ তলা মত নিচে নেমে এসে আবার চড়াই ভাঙ্গা শুরু হলো। পিঠ কোমর ভেঙ্গে পড়ছে। বুকে
দম পাচ্ছিনা। এর মধ্যেই আমরা বেশ উচ্চতায় এসে গেছি। তাই অল্প অল্প করে অক্সিজেনের
পরিমান কম হতে শুরু করেছে। মুশকিল হলো, এরকম টানা খাড়াই রাস্তা দাঁড়িয়ে দু দন্ড
বিশ্রাম নেওয়ায় যায় না। কারন দাঁড়াবার জায়গাই নেই। বড় বেশী ঢালু। জোর করে দাঁড়াতে
গেলে পায়ের কাফ মাসলে প্রচন্ড চাপ পড়ে। কাজেই ধিরে ধিরে চলতে হবে। আর পাহাড়ে ওঠার
এটাই নিয়ম। বার বার বিশ্রাম নিয়ে তাড়াতাড়ি চলা নয়। খুব আস্তে আস্তে, সমানে চলতে
থাকা। বেশীক্ষন বিশ্রাম নিলেই শরীর আর উঠতে চাইবে না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল চড়াই
বুঝি এবার কমে আসছে, কিন্তু পরক্ষনে একটা মোড় ঘুরেই দেখছি আবার অনেকটা রাস্তা ওপরে
ওঠা।
চলা শুরু করার ঘন্টা তিনেক
পর পেছনে ছোট ঘন্টার ঠুনঠুন শব্দ পেলাম। ফিরে দেখি বিপিন আর আমাদের মালবাহক দুটি খচ্চর
ও তাদের মালিক আসছে। খচ্চরের পিঠে আমাদের তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ,খাবার দাবার,
স্টোভ, তেল বাদবাকি আনুসঙ্গীক। মুন্ডূ
নাড়তে নাড়তে, ফোঁসফাঁস করতে করতে অশ্বতরদ্বয় নিকটবর্তী হলেন। পাহাড়ে ঘোড়াদের
নিশ্বাস প্রশ্বাসের মতই আরো দুটি কর্ম নিরন্তর চলতে থাকে। একটি বাতকম্ম, অন্যটি
নাদা। কাজেই সরে দাঁড়ালাম। জওন সিং বলল দাদা আপনি যেখানে দাঁড়িয়েছেন ওরা সেখান দিয়েই
শর্টকাট করবে। শুনে তাড়াহুড়ো করে দু পা সরতে না সরতেই হুস হাস ফিস হাস করতে করতে
তেনারা এসে , বললে বিশ্বাস করবেন না প্রায় ৭০ ডিগ্রি খাড়াই পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে
কোথায় চলে গেল। এরা ঘোড়া না টিকটিকি কে জানে বাপু! যাই হোক, তেনারা তো গেলেন।
আমরাও আগে বাঢ়লাম। এদিকে ভুপ্রকৃতি অনেকটা বদলে গেছে। আগে নিচে অনেক রকম গাছ ছিলো,
যত ওপরে উঠছি সে সব গাছ কমতে কমতে এখন আর নেই, এখন খালি পাইন আর ভূর্জ পত্রের গাছ
চারিদিকে। ঝোপ ঝাড় কমে এসেছে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে অনেক নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে বাগিনী
গাদ। এতটাই খাড়া আর নিচে, যে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলে মাথা ঘুরে যায়। এদিকে বেলা
প্রায় ১২টা বাজতে চলল, রোদের জোর মারাত্মক। গায়ে লাগলে জ্বালা করছে। এখানে বাতাসে
ধুলোবালি বা জলীয় বাষ্প এতটাই কম, যে আকাশ খুব ঘন নীল। ওরকম রঙের আকাশ কেমন যেন
অবাস্তব মনে হয়। রোদে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, তাই রঙিন চশমা সঙ্গে রাখা ভাল। কিন্তু এত
সুন্দর পরিবেশেও ওই খাড়াই বেয়ে ওঠাটাই খালি গন্ডগোলের। একটা যায়গায় পাক খেয়ে খেয়ে
কিছুটা চড়াই ভেঙ্গে একটা ঝরনা পার হচ্ছিলাম পাথর টপকে, এমন সময় আমার কমজোরি ডান পা
পড়ল একটা পাথরে, আর পিঠের ব্যাগ সমেত আমি হেলে পড়ে গেলাম। ভর রাখতে গিয়ে হাত দিয়ে
ঝরনার পাশে একটা বড় পাথর ধরলাম, এতে বাকিটা বেঁচে গেল, কিন্তু হাতের কবজি দস্তুরমত
জখম হলো। একবার ভাবলাম ব্যাগ থেকে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বের করে বাঁধি। তার পর মনে হলো
চলতে থাকি। শুধু শুধু দেরি করে লাভ নেই। হাত একটু চেপে ধরে আর ঝরনার হিমঠান্ডা জল
লাগিয়ে চলনসই অবস্থায় আনা গেল। হাঁটা শুরু করলাম।
ক্লান্তি এবার আস্তে আস্তে
চেপে বসছে। হাঁটু ভেঙ্গে আসছে। এমন সময় দেখি সামনে এক ফালি সমতল, খুব বেশী হলে ২০
মিটার করে দৈর্ঘে ও প্রস্থে হবে। কিন্তু সেখানে আমাদের ঘোড়া দুটো ঘাস খাচ্ছে,
বিপিন বসে আছে, আর জওন ভাই ব্যাগ থেকে কি একটা বের করছে। আমি আর পারলাম না।
বিপিনের পাশে ধপাস করে বসে পড়লাম। এতই ক্লান্ত লাগছিল যে পিঠ থেকে ব্যাগটাও খুলতে
পারিনি। মিনিট পাঁচেক পর দেখি দাদা ও বৌদি আসছে। আসলে এই রাস্তার ওঠাপড়ায় আমাদের
শুরুতে যে ভাবে চলা আরম্ভ হয়েছিলো, সেটা একদম ঘেঁটে ঘন্ট হয়ে গেছে। কোনো ভাবে আমি
চলে এসেছি সকলের আগে। জওনভাই যেটা বের করছিলো ব্যাগ থেকে, সেটা হলো পরোটা আর আলুর
তরকারির প্যাকেট। এ জায়গাটার নাম নাকি ছাচা। উচ্চতাজনিত কারনে, না কি অত্যধিক
ক্লান্তির জন্যে ঠিক বুঝলাম না, কিন্তু খিদে একেবারেই নেই। কোন রকমে এক খানা পরোটা
আর একটু আলুর তরকারি খুঁটে খেলাম।মনে হচ্ছিলো এখানেই, এই ছোট্ট চ্যাটালো জায়গাটাতেই
শুয়ে থাকি আর ট্রেকের বাকি কটা দিন কাটিয়ে দিই, আগে গিয়ে আর দরকার নেই। হাতের
কবজিটা বেশ ভোগাচ্ছে। গরম হয়ে ফুলে উঠেছে। বুঝতে পারছিনা চিড়-ফাট ধরল কিনা। বোতলের
ঠান্ডা জলে টয়লেট পেপার ভিজিয়ে একটু যন্ত্রনা কমাবার চেষ্টা করলাম।
দ্রোনাগিরির
পথে
|
পেছনে ফিরে তাকালাম। নিচে
থেকে জওন ভাই বলে উঠলো চলো দাদা, রাস্তা হ্যায়। হ্যায় তো বটে কিন্তু কিধার হ্যায়?
ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড থে লাস্ট ক্রসেড ছবিতে শেষের দিকে এক জায়গায় অতলস্পর্ষী
খাদ পার হবার সূত্র হিসেবে ইন্ডিয়ানা জোন্সের বাবার ডায়রিতে লেখা ছিল, কেবল মাত্র
বিশ্বাসের জোরে পা ফেললেই খাদ পেরিয়ে ওপাশে যাওয়া যাবে। সেই টুকু মনে করে, আর
জওনভাইয়ের হাতযশের ওপর ভরষা রেখে দু কদম এগিয়ে একেবারে খাদের কিনারায় দাঁড়ালাম। ও
মা দেখি আমার ডান পাশে রাস্তাটা একদম ৯০ ডিগ্রিতে বেঁকে এগিয়ে গেছে। ওই জন্যে
দেখতে পাচ্ছিলাম না। বাঁক ঘুরেই থমকে দাঁড়ালাম। এদিকে কোন সবুজের চিহ্ণমাত্র নেই। পাহাড়ের
ওপর দিক থেকে কেউ যেন একটা বড় হাতুড়ি পিটিয়ে সব কিছু ভেঙ্গে চুরে গুঁড়োগুঁড়ো করে
দিয়েছে। বিরাট একটা অংশ প্রায় সামনের শ চারেক কি শ পাঁচেক মিটার এই ধ্বস নামা
জায়গা। রাস্তার অবস্থাও তথৈবচ। শুরুর দিকটা তবু চালিয়ে নিচ্ছিলাম। যত এগোতে লাগলাম
পায়ের তলায় ভুসভুসে নরম বালি আর পাথর পিছলে যেতে লাগল। হাতের ছড়ি দিয়ে খুব সাবধানে
ভর দিয়ে দিয়ে হাঁটছিলাম। কোথাও ধ্বসের ফলে পাহাড়ের খাঁজ তিন তলা নেমে গেছে, আবার
পরক্ষনেই ওপরে উঠে এসেছে। এক জায়গায় একটা ঝুলন্ত মহাকায় পাথর দেখলাম, যেটার আকার
আমাদের হাওড়ার বাড়ির সমান হবে। সেখানে ৭০% ঝুলন্ত অবস্থায় রয়ে গেছে, ৩০% মাত্র
পাহাড়ের গায়ে লেগে আছে। মনে হচ্ছিলো যে কোন সময়ে ওইটা খুলে হুড়মুড়িয়ে নিচে নেমে
যাবে।
পাথরের নিচে ফুট চারেক
উচ্চতার একটা সরু খাঁজ। কোনক্রমে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সেটা পেরিয়ে এলাম। এবারে
রাস্তাটা একটা কাস্তের মত অর্ধচন্দ্রাকারে ঘুরে গেছে। খুব বেশী উঁচু নিচু নেই। তাই
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এই ভুরভুরে ভুষভুষে জায়গাটা পেরিয়ে এলাম। বেশীক্ষন থাকলে যদি
পা পিছলে নিচে বাগিনীতে চলে যাই আর দেখতে হবে না। ধৌলিগঙ্গা-অলকানন্দা-মন্দাকিনী-গঙ্গা
হয়ে আমাদের রামকেষ্টপুর ঘাটে গিয়েই হয়ত পৌঁছলাম। অন্ততঃ দেহটা। এতসব ভেবেটেবে
পেছনে ফিরে দেখি আমাদের বাকি দল তখনো ধ্বসের এলাকায় হাঁটা শুরু করেনি। এপাশ থেকে
হাত নাড়লাম। ওরাই কি একটা ইশারা করল ঠিক বুঝিনি। আমার পেছনেই আসছিলো একটি স্থানীয়
ছেলে। রুইং থেকেই এ আসছে জওন ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে। আমাকে দেখে বলল চলো
দাদা, আ হি গয়ে সমঝো দ্রোনাগীরি। ভারি ভাল লাগল ওর কথা শুনে। তখনো বুঝিনি বিধাতা
অলক্ষে খিক খিক করে গা জ্বালানে হাসি আসছেন। ছেলেটি সামনে এগিয়ে গেল, আমিও পা
বাড়ালাম। আমার ধারনা ছিলো পাহাড়ের গা ধরে বাগিনীর খাত বেয়ে রাস্তা সামনে গেছে।
কিন্তু দেখলাম ছেলেটা বেমালুম কেমন অদ্ভত ভাবে খাড়া পাহাড়ে গায়ে একটা হালকা ছাপ
ফেলা আধ ফুট চওড়া দাগ ধরে ওপরে উঠতে শুরু করল। শুকিয়ে যাওয়া গলা, হিম হয়ে যাওয়া
কলিজা নিয়ে চিঁচিঁ করে জিজ্ঞেস করলাম – ইয়ে কেয়া শর্টকাট হ্যায়? উত্তর এলো – নেহি
দাদা, দ্রোনাগিরী ও উপর মে হ্যায়।
ওপরের দিকে দেখলাম। খাড়াই
পাহাড় উঠে গেছে দেওয়ালের মত। আমার শরীরে আর শক্তি ছিলোনা। মনের জোরও কমতির দিকে।
একদিনে এতটা পরিশ্রম নিতে পারছিনা। মনে হলো থেবড়ে বসে পড়ি এখানেই। কিন্তু পাহাড়ে দুপুরের পর আবহাওয়ার কোন ঠিক নেই। মানে মানে পা চালানোই ভালো। যদিও এখন রোদ আছে, কিন্তু বৃষ্টি এসে গেলে এই ধ্বস নামা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার মত সাহস আমার নেই। মনে
কিঞ্চিত জোর এনে পা বাড়ালাম আমাদের যাত্রার প্রথম কঠিন অংশে। যাঁরা এর পর বাগিনী
গ্লেসিয়ার যাবেন, তাঁরা যদি আমার লেখা পড়ে তার পরে যান, তাহলে রাস্তার কঠিন অংশ
গুলো সম্পর্কে তাঁদের একটা ধারনা যাতে হয়, আমি সেই চেষ্টা করব। এখনো পর্যন্ত বাগিনী
নিয়ে যা কিছু পড়েছি বা ভিডিওতে দেখেছি, কোথাও এই কঠিন জায়গাগুলো নিয়ে আলাদা করে
কিছু বলা নেই। অথচ এগুলো পার হবার সময় অত্যন্ত বেশী সতর্কতা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়,
যথেষ্ট পরিশ্রম হয় বলে, শারীরিক সক্ষমতাও দরকার। খুব ক্লান্ত হয়ে থাকলে একটু
বিশ্রাম নিয়ে তবেই এই জায়গা গুলো পার হওয়া ভাল। নয়ত মুহুর্তের ক্লান্তিতে, অসতর্ক
মুহুর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। খাড়াই পাহাড়ের গায়ে একটা হালকা দাগ। পশুপালকদের
চলাচলের চিহ্ণ, সেটাই এখন আমাদের রাস্তা। এ রাস্তা আবার প্রচুর পরিমানে ঢিলে নুড়ি
পাথর, ভুসভুসে মাটি আর বালি দিয়ে সাজানো। ঠিক ওই ধ্বসের জায়গারই মত। পা দিতেই হড়কে
যাচ্ছে। প্রতি পদক্ষেপে দম ফুরিয়ে আসছে মনে হচ্ছে একটু দাঁড়াই, কিন্তু দাঁড়ানো
কোনোভাবেই সম্ভব নয়, কেননা প্রথম কথা এতই খাড়া আর সরু রাস্তা, দাঁড়াবার বা বিশ্রাম
নেবার জায়গাই নেই। তার ওপরে বেশীক্ষন পা রেখে দাঁড়াতে গেলেই নুড়ির ঢালে পা পিছলে
পিছলে নেমে আসছে, আর কাফ মাসলে ভয়নক চাপ পড়ছে। এই অবস্থায় পায়ে একবার টান ধরলেই
হয়ে গেল। তাই হাজার কষ্ট সত্ত্বেও ওপরে ওঠা থামালাম না। এক এক জায়গায় পায়ের সামনের
অংশ ঘষে ঘষে একটু খাঁজ মত কেটে তাতে পা রেখে উঠতে দেখলাম সামনের ছেলেটিকে। আমিও ওই
কায়দাটা নিলাম। জুতোর বারোটা বাজে তো বাজুক, আগে নিরাপত্তা। কিন্তু বেশ দাম দিয়ে
ডেকাথলন থেকে কেনা হাইকিং এর উঁচু গোড়ালিওয়ালা জুতো আমাকে গোটা রাস্তায় নিশ্চিন্ত
ভরসা দিয়ে গেছে। এবং অক্ষত অবস্থায় বাড়িও ফিরে এসেছে।
বুঝতে পারছিলাম প্রতি
পদক্ষেপে একটু একটু করে শারীরিক ক্ষমতা কমে আসছে। এবং যে টুকু বাকি আছে, সে টুকু একটু
বাঁচিয়ে চলতে না পারলে আমি ওপর অবধি পৌঁছবো না। ঠিক কতটা সময় এই ভাবে পেরিয়েছিলো
ঠিক মনে নেই, কিন্তু দেখলাম আমার সামনে একটু ওপরে একটা বেরিয়ে আসা পাথরে ঠেস দিয়ে
দাঁড়িয়ে সেই ছেলেটি যে রুইং থেকে আমাদের সঙ্গে আসছিলো। আমাকে দেখে বলল দাদা থোড়া
ঠহর যাও। আমি সত্যিই আর পারছিলাম না। নির্জীবের মত পাথরটার গায়ে পড়ে রইলাম হেলান
দিয়ে। কথা বেরোলোনা মুখ দিয়ে। একটু পরে চোখ খুলতে ছেলেটি একদিকে ডান হাতের তর্জনি
তুলে দেখালো। দেখলাম পাহাড়ের চুড়ার দিক। সেখানে দু খানা পোস্ট পোঁতা আছে অনেক
ওপরে। বলল ঐ পোস্টের পরেই দ্রোনাগিরির এলাকা শুরু। নিচে তাকালাম। বহু নিচে দেখতে
পেলাম আমাদের বাকি দল আসছে ধ্বসের জায়গাটা পেরিয়ে। প্রায় পেরিয়েই এসেছে, এবার তারা
চড়াই ভাঙ্গতে শুরু করবে। শরীর চাইছিলো আরো কিছুক্ষন জিরিয়ে নিতে, কিন্তু এই
অবস্থায় দু মিনিটের বেশী বসে থাকলেই অবসাদ এসে গ্রাস করবে শরীরকে। তাই ঠিক ১২০ সেকেন্ড
পর ঝটকা দিয়ে হিঁচড়ে তুলে রাস্তায় খাড়া করলাম নিজেকে। এবারে পিঠের ব্যাগ নামিয়ে রাখিনি,
কারন হাতে চোটের কারনে ব্যাগ নামিয়ে রাখা এবং আবার পিঠে চড়ানো বেশ পরিশ্রম সাপেক্ষ
কাজ আমার কাছে। আবার শুরু হলো প্রানান্তকর চড়াই। এক একবারে এক একটা খাঁজে পা রেখে যেখানে
উঠতে হচ্ছে, সেগুলো যদি সিঁড়ির ধাপ মনে করি তাহলে এক একটা ধাপ
আমাদের সাধারন সিঁড়ির তিনটি কি চারটি সিঁড়ির সমান। তবুও উঠতে হবেই, কারন দ্রোনাগিরী
সামনে, পেছনে নয়। সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এক একবার ভারসাম্য টলে যাচ্ছে, তার দুটো কারন,
এক পায়ের তলায় নুড়ি আর ভুসভুসে মাটি-বালি, আর দুই আমার পিঠের সতেরো কিলোর ব্যাগ। বাগিনী নিয়ে যত ভিডিও দেখেছি, ছবি দেখেছি, তার কোথাও এই চড়াইয়ের চিহ্ণমাত্র
নেই কেন জানেন? কারন এখানে ক্যামেরা বের করে ছবি তোলার দুঃসাহস কেউ দেখায়না। এমনকি
যে গুটি কতক লোক বাগিনী নিয়ে লিখেছেন তাঁদের লেখাতেও এ জায়গার
উল্লেখ পাইনি। হয়ত এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। যাই হোক, আগেই বলেছি আমি কোথাও কিচ্ছুটি এড়িয়ে
যাবোনা। আপনি যদি এই লেখা পড়ে এই টুকু পড়ে ভেবে থাকেন এত কঠিন রাস্তায় আপনি আসতে চাননা,
তাহলে পাঠক লেখার বাকি অংশে আপনাকে বাগিনী নিয়ে আসার উৎসাহ জাগানোর
দায় আমার। আর সে উৎসাহ যদি আপনার না জাগে, সে দায় ও আমার ওপরেই বর্তায়। পরিশেষে এই
ধরনের কঠিন অংশ পার হবার কিছু কলাকৌশল আছে, এ ছাড়া আছে অভিজ্ঞতা। লেখার একেবারে শেষে
সেই নিয়ে কিছু বলার ইচ্ছে রইল।
আরো ঠিক কতক্ষন চড়াই ভেঙ্গেছিলাম আমার এক্কেবারে
খেয়াল নেই। একটা সময় মনে হচ্ছিল কেমন যেন ঘোরের মধ্যে উঠছি। ওপরের দিকে তাকালে কিছুই
দেখা যায়না কেবল খাড়া দেওয়ালের মত পাহাড় ছাড়া, আর তাতেই সামান্য খাঁজ কাটা যেখান দিয়ে
হাঁটছি। এ ছাড়া একবার নিচের দিকেও তাকিয়েছিলাম। বহু নিচে পাহাড়ের গায়ে দেখলাম সেই ধ্বস
নামা জায়গাটা কিছুটা দেখা যাচ্ছে। এতটা ওপরে উঠে এসেছি ভাবতে পারছিলাম না! মাথা কেমন
যেন খালি খালি লাগছিলো। কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না। হয়ত অক্সিজেনের অল্প অভাবের
জন্যেই হবে। কেননা ইঞ্জিনের মত হাঁপাচ্ছিলাম অনেক্ষন ধরেই। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছিলাম,
যদিও খুবই কষ্টকর, কিন্ত কিছুটা সময় একটানা চড়াই ভেঙ্গে উঠতে উঠতে শরীর নিজে থেকেই
ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলো। প্রথম দিকে যতটা কঠিন লাগছিলো, বুঝেই পাচ্ছিলাম না
পা কোথায় রাখবো, এখন সেটা অনেকটাই কমে এসেছে। সামনের ছেলেটি এক সময় বলল দাদা, অওর বাস
থোড়াসা হি বাকি হ্যায়। দেখলাম ও নিজেও খুব হাঁপাচ্ছে। বুঝলাম কথাটা ও আমাকে যতটা বলল
, ততটাই নিজেকেও বলল। ও স্থানীয় ছেলে। ওর যদি এখানে উঠতে এই অবস্থা হয়, তাও আমার মত
পিঠে একখানা যম ভারি মোট বয়ে নিয়ে চলছে না, আর আশা করি ওর দু পায়েই সমান জোর, আমার
মত ডান পা কমজোরি নয়। টেনে হিঁচড়ে দাঁত চেপে একটু একটু করে উঠতে উঠতে একসময় হঠাৎ দেখি
সামনে কিছুটা ঘাসে ঢাকা সমতল। পাহাড়ের গা এখানে ঢালু হয়ে ওপর দিকে উঠে গেছে, আর সামনেই
সেই নিচে থেকে দেখা দু খানা পোস্ট। আমরা দ্রোনাগিরির এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়েছি।
ঘাসজমিটা যেন চোখের ওপর একটা ঠান্ডা জলের আলতো ঝাপটা
দিলো। আর পারলাম না, দুপা এগিয়ে ঘাসের ওপর ধপাস করে শুয়ে পড়লাম। অবসাদ আসবে? আসুকগে,
কোই পরোয়া নেহি। যে দ্রোনাগিরির চড়াই ভাঙ্গতে পারে, সে সব পারে। মিনিট দুই চোখ বন্ধ
করে পড়ে রইলাম ঘাসের ওপর। তার পর আস্তে আস্তে উঠে বসে পিঠের ব্যাগের স্ট্র্যাপ গুলো
খুললাম। খেয়াল হলো গলা শুকিয়ে কাঠ। জলের বোতল বের করে অল্প অল্প চুমুক দিলাম। এই জল
সকালে রুইং এ ভরা হয়েছে। এখনো কনকনে ঠান্ডা। দাঁত শিরশির করে খেলে। নিচের দিকে তাকালাম।
বহু নিচে আমাদের পেরিয়ে আসা রাস্তা। ছেলেটাকে জলের বোতল দিলাম। ২৩-২৪ বছর বয়স। নাম
বলল অনিল। দেরাদুনে পড়ছে কলেজে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কিছু একটা বলেছিলো, আমার এখন খেয়াল
নেই। বলল ওর পরিবার এখন দ্রোনাগিরি এসেছে, কারন আগামী কদিন পরেই এখানে একটা ধর্মীয়
উৎসব আছে। সেই উপলক্ষে কিছু লোকজন আসে। সেই কারনে ও চলে এসেছে। এর পরে বলল ও নাকি বিভিন্ন
পর্বতারোহী দলের সঙ্গে অভিযানে গেছে। কিছুদিন আগে গেছিলো কামেট। আমার এলাকার এভারেস্ট
বিজয়ী মলয় মুখার্জীর নাম করলাম। বলল খুব ভালোই চেনে। হাওড়া ট্রেকিং অ্যান্ড মাউন্টেনিয়ারিং
ক্লাবের আরো কয়েকজন না করল, সেগুলোও আমার পরিচিত। বললাম আমি অনেক টেনে হিঁচড়ে উঠেছি,
ওর হয়ত আমার কারনে দেরি হচ্ছে, চাইলে এগোতে পারে। বলল দাদা আপকা চলনা বিলকুল সহি হ্যায়।
কথাটা শুনে বেশ লাগল। নিজেকে যতটা ভাবছিলাম অতটাও নই। বলল জওনভাই আর বাকিরা এলে একসঙ্গেই
উঠবে। দ্রোনাগিরি এখান থেকে আর এক কিলোমিটার মত। এসব কথা বলতে বলতেই দেখি দাদা আর বৌদি
টেনে হিঁচড়ে নিজেদের তুলছে। ঘাসের জমিটায় এসে দুজনেই আমারই মত ধপাস করে পড়ল। মিনিট দুয়েক পর কথা বলার মত
অবস্থায় এসে বৌদি জানালো তার ব্যাগের স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেছে। চিরন্তন সমস্যা। এটা
হয়েই থাকে কারোর না কারোর। এই খাড়াই রাস্তা নাকি দাদা তার ছেঁড়া ব্যাগ এবং বৌদি কে
কিছুটা সাপোর্ট দিতে দিতে এসেছে। ভাল করে দেখলাম ছেলেটাকে। চুপচাপ মানুষ। একটু
মোটাসোটাও বটে, ফিটনেসের মাপনিতে তলার দিকেই থাকবে। এতটা উঠে এসে হাঁপাচ্ছে, ঠিক
মত কথা বলার অবস্থাতেও নেই। কিন্তু এত কিছুর ভেতরেও শুধু নিজেরই নয়, আর একজনের
পিঠের ব্যাগ সাপোর্ট দিয়ে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। ছেলেটাকে নতুন করে ভালো লেগে
গেল। আরো একটু পর কানহাইয়ালাল আর জগাই মাধাই হাজির হলো। জওন ভাই সবার পেছনে। একই
ভাবে তারাও এসেই শুয়ে পড়ল ঘাস জমিতে।
একটু পর কথা বলার মত
অবস্থায় এসে সকলেরই মত, এ জায়গাটা খুব কঠিন ছিল। যাই হোক, পেরিয়ে এসেছি যখন ভালোয়
ভালোয় আর চিন্তা নেই। এবার সামনের দিকে তাকালাম। প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিলো না, তার
পর ভালো করে দেখলাম সত্যিই তাই, ঢালু ঘাসজমির ওপর দিয়ে একটা বাঁধানো সত্যিকারের
রাস্তা দেখা যাচ্ছে যেটা দ্রোনাগিরি জনপদ অবধি গেছে। বহু দূরে ওপরের দিকে দু একটা
চালা ঘর দেখা যাচ্ছে খেলনা বাড়ির মত। বসে থাকতে থাকতে শীত এসে জাঁকিয়ে বসল। হঠাৎ
কেমন কন কনে একটা অনুভুতি। ব্যাগ থেকে পাতলা জ্যাকেট বের করে গায়ে চড়ালাম। আমাদের
সব মিলিয়ে মিনিট কুড়ি মত বিশ্রাম নেওয়া হয়েছে। অবসাদ আর ক্লান্তি কতটা জাঁকিয়ে
বসেছে সেটা বুঝলাম উঠে দাঁড়াতে গিয়ে। প্রথমটা মনে হলো পড়ে যাবো, হাতে পায়ে জর নেই
একেবারেই। একটু একটু করে উঠে দাঁড়ালাম। অনেক কসরত করে, চোট লুকিয়ে পিঠে তুললাম
ব্যাগ। কিন্তু মনে হচ্ছিলো পা ফেলতে পারবোনা। একফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই। সকাল ৮টা
থেকে হাঁটছি। এখন বাজে বিকেল সড়ে চারটে। আট ঘন্টা হাঁটছি আমরা। বৌদির ব্যাগের ফিতে
কি একটা কায়দা করে দিলো জওন ভাই। বলল এই নিয়ে চলো, দ্রোনাগিরি পৌঁছে দেখছি কি করা
যায়। আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। যদিও রাস্তা ভালো, এবং খাড়াই অনেক কম। তবুও ঢালু
তো বটেই। আর তা ছাড়া মাটি বালিতে ঢিলে নুড়িতে পায়ের তলায় কিছুটা নরম আস্তরন পাওয়া
যায় এমনি সময়, কিন্তু পাথরের বাঁধানো রাস্তা বড় শক্ত লাগে। চলতে মেহনত বেশী করতে
হয়। তার ওপরে আছে পাহাড় প্রমান অবসাদ আর ক্লান্তি। ফলতঃ মিনিট দশ পরেই আমরা খুবই
কাহিল হয়ে পড়লাম আবার। এক মিনিট দাঁড়ানো হলো। কেউ কোনো কথা বলছে না। বুঝতে পারছি,
দেখে যা মনে হয়েছিলো, পাহাড়ের ঢাল তার চেয়ে অনেক বেশী, আর ওঠাও কষ্টকর। আমরা আগের
চড়াইটা ভেঙ্গেই ভেবেছিলাম কঠিন অংশ শেষ সেটা ভুল ছিলো। যাই হোক। ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে
চলতে চলতে খুব ধিরে ধিরে সামনের চালা গুলো কাছে আসতে লাগল। ওপরে দেখলাম নীল নীল
তাঁবু দেখা যাচ্ছে রাস্তার ডান দিকে। বিপিনরা আমাদের তাঁবুও খাটিয়ে ফেলেছে।
দ্রোনাগিরিতে
আমাদের ক্যাম্প
|
তাঁবুর কাছে পৌঁছে প্রথমেই
বড় ডাইনিং টেন্টে ঢুকে পড়লাম সকলে। ধপাধপ ব্যাগ নামিয়ে রেখে লম্বা হলাম। ঢক ঢক করে
জল খেলাম। তার পর কিছুটা ঘোরের মধ্যে শুয়ে রইলাম কিছুক্ষন। হুঁশ ফিরলো বিপিনের
ডাকে – “স্যুপ”। স্যুপ? কোথায়? কিসের স্যুপ? দেখি বিপিন বাবাজি একটা থালায় কতগুলো
কাপ আর একটা কেটলি হাতে ঝুলিয়ে ঢুকেছে। প্রথমটা ইচ্ছে করছিলোনা উঠতে। বিপিন কিছুটা
জোর দিয়েই বলল স্যুপ পি লো, আচ্ছা লাগেগা। নিলাম একটা কাপ। তাতে বিপিন গরম গরম
ধোঁওয়া ওঠা টমেটো স্যুপ ঢেলে দিলো। চুমুক
দিয়ে দেখি স্যুপ কোথায়? এ তো মৃত সঞ্জিবনী সুধা। এক এক চুমুকে সারা দিনের ক্লান্তি
অবসাদ কেটে যাচ্ছে। ঠান্ডা সইবার ক্ষমতা আস্তিন গুটোচ্ছে। বেঁচে থাকো বাবা বিপিন।
এই স্যুপটি তুমি যা খাওয়ালে এর তুলনা ফাইভস্টারেও মিলবে না। এক কাপ শেষ করে আবার
কাপ বাড়ালাম। সঞ্জীবনী এক কাপ খাওয়া শাস্ত্রে মানা। আমার দেখাদেখি বাকিরাও উঠে
বসেছে। সকলেই অল্পবিস্তর কাবু। অবশ্য ওদের বয়স কম বলে আমার চেয়ে অনেক কম ক্লান্তির
খপ্পরে পড়েছে। স্যুপ খেয়ে সকলেই তড়বড় করে কথা বলতে শুরু করে দিলো। আমি একটু
জায়গাটা সরেজমিনে দেখতে বেরোলাম। আমাদের সামনে রাস্তার উলটো দিকে চার সারি ঘরবাড়ি
পাহাড়ের গায়ে। সেটাই হলো অস্থায়ী দ্রোনাগিরি জনপদ। এখন লোকজন আছে কারন এটাই মরসুম।
দেখলাম অনেক বাড়ির সামনেই দু একজন লোক দেখা যাচ্ছে। আমাদের ক্যাম্প থেকে সামনে ডান
হাতি একটু ওপরে একটা বড় পাকা বাড়ি। সেটা গাঢ়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের থাকার জায়গা।
কিন্তু দরজা জানলা সব বন্ধ দেখে মনে হলোনা ওখানে কেউ আছে বা থাকার কোন ব্যবস্থা
আছে। শুনলাম ওটার সামনে খোলা মাঠটা নাকি হেলিপ্যাড। এই রাস্তা দিয়ে বাগিনী বেসক্যাম্প
ও চংবং গ্লেসিয়ার হয়ে অনেক গুলো শৃঙ্গ অভিযান হয়। কাজেই এখানে একটা হেলিপ্যাড থাকা
খুব জরুরি আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে।
এবারে যে দিক থেকে আমরা এসেছি
সেই দিকে তাকিয়ে দেখলাম। সামনে ঢালু হয়ে পাহাড় নেমে গেছে। বহু দূরে বরফে ঢাকা হাতি
,ঘোড়া আর পালকি শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। রুইং থেকে এই বরফে ঢাকা শৃঙ্গ গুলো দেখাই
যাচ্ছিলো না প্রায়, সামনের পাহাড় গুলো ঢেকে দিচ্ছিলো। অনেক ওপরে তাকালে তবে বরফে
ঢাকা চুড়া দেখা যাচ্ছিলো। এখানে দেখে মনে হচ্ছে আমরা ওই বরফের সমান সমান উচ্চতায়
উঠে এসেছি। দ্রোনাগিরিতে এসে দেখছিলাম, বড় গাছ খুব কম। উচ্চতার কারনে এখানে খুব
বেশী বড় গাছ হয়ত হয়না ঘাসজমি আর কিছু ঝোপঝাড়, যা অতি উত্তম পশুখাদ্য। আশেপাশে কিছু
ছাগল ভেড়া দেখেছি আসার সময়। তাদের স্বাস্থ দেখেই বুঝেছি, দিন রাত পাহাড়ে চড়লেও
তারা সুপুষ্ট। এখানে ছাগলের লোম খুব বড় বড়। আমাদের সমতলের ছাগলের চেয়ে জাত আলাদা।
গরু খুব একটা কেউ পোষেনা। বরং দ্রোনাগিরি তে দু খানা চমরী গাই দেখলাম। দুধের জোগান
আসে ছাগল থেকেই। এদের খাওয়া দাওয়াও খুব সাদাসিধে। ডাল ভাত বা রুটি একটা কিছু সবজি
কিম্বা স্রেফ আচার। এখানে আমিষের যোগান কম, খাওয়া হয়ও কম। বরং বহু মাস অত্যন্ত
ঠান্ডায় থাকতে হয় বলে সংরক্ষন করা খাবার, যেমন আচার আর শুকোনো জিনিসপত্রের ব্যবহার
বেশ বেশী কারন সারা বছর টাটকা সবজি মেলেনা।
আমাদের তাঁবু থেকে একটু
দূরে একটা জলের ব্যবস্থা দেখলাম। ওপর থেকে নামা বরফ গলা জল এসে একটা বড় চৌবাচ্ছায়
জমা হচ্ছে। সেখান থেকে একটা পাইপে করে জল বেরিয়ে আসছে। টলটলে পরিস্কার কাচের মত
জল। বোতল গুলো খালি হয়ে গেছিলো। ভরতে গিয়ে একটু থমকালাম। সামনেই এক তাউ জল নিচ্ছেন
বড় বালতিতে করে। জিজ্ঞেস করলাম তাউ জি, এইসে হি পি সকতে হ্যাঁয়? তাউজি মস্ত পাকা
গোঁফের ফাঁক দিয়ে একটা দিগন্ত ছোঁয়া ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ধরা হাসি উপহার দিয়ে জানালেন
বে শক পিও , এক দম সাফ পানি হ্যায়। তার পর প্রমান দেবার জন্যেই দু হাতে দু বালতি
ভর্তি জল নিয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ শিরদাঁড়া সোজা করে সামনের খাড়াই ধাপকাটা পাহাড় ধরে
টপাটপ উঠে গেলেন। আমিও নিশ্চিন্তে বোতলে জল ভরলাম। ফিরে এসে দেখি আমাদের দলবল
চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। দু এক জন ক্যামেরা বার করেছে। যতই ফিট হোক, এতদুরের রাস্তার
ধকলে বেচারিদের সুখ গুলি মুখিয়ে গেছিল। এখন গরম স্যুপ আর বিশ্রামের পর সেই ক্লান্ত
মুখগুলোতে প্রান ফিরে এসেছে, তাই ফোটো শেশন চলছে। ঘড়িতে সোয়া ছটা, তবে হালকা রোদ
আছে এখনো। ফোটো শেশন দেখলাম কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িতে। ইতিমধ্যে বিপিনের হাঁক ভেসে
এলো – “চায়ে”। ও বাবা, ছোকরা এর মধ্যে চা ও করে ফেলল? আহা বড় দরকার ছিলো এই চায়ের।
সঙ্গে ওটা কি? থালায়? “পকোড়ে লে লো”। বলে কি ছোঁড়া! তাড়াতাড়ি দে দেখি বাবা। চায়ে
চুমুক আর পকোড়ায় কামড় দিয়েই বুঝলাম পেটে প্রলয়ঙ্কর খিদের উপস্থিতি। নিশ্চিন্ত লাগল,
এখনো পর্যন্ত শরীর একদম ঠিক আছে। না হলে খিদে পেতোনা। খিদে যখন আছে, তখন
নিশ্চিন্ত।
আমরা চা আর পকোড়া নিয়ে বড়
তাঁবুর ভেতর বসলাম। কানহাইয়ালাল আর জগাই মাধাই গেল একটু ওপরে বাড়ি গুলো এক চক্কর
মেরে আসতে। আমার যে ইচ্ছে করছিলোনা এমন নয়, কিন্তু নিজেকে একটু বিশ্রাম দিলাম।
কেননা এখন ঘুরতে যাওয়া মানে আবার সামান্য হলেও পাহাড় ভাঙ্গা। কিছুটা চাপ পড়বেই।
কিন্তু এখন টানা ১২ ঘন্টা বিশ্রাম নিলে কাল সকালে তাজা হয়ে যাবো একদম। সেই তাজা
হওয়াটা আমার অনেক বেশী দরকার। বড় তাঁবুর ভেতর, ব্যাগ পত্তর সাজিয়ে হেলান দিয়ে বসে
আড্ডা শুরু করলাম দাদা বউদির সঙ্গে। তারা দুজন পাহাড় অন্তঃপ্রান। আগেও ট্রেক
করেছে, কিন্তু এতটা ওপরে পায়ে হেঁটে এর আগে আসেনি। অনেক বাধা ছিলো আসার আগে। অফিসের ছুটি এবং
অন্যান্য আরো পাঁচরকম। সব কিছু ঠেলে সরিয়ে ওরা দুজন আসতে পেরে যাহারপরনাই খুশী। দাদা
গল্প বলছিলো কেমন করে তার ছেলেবেলার এক বন্ধুর বাড়ি প্রায় মাঝরাতে গিয়ে তারা দুজন
হাজির হয়েছিলো। দাদা বড় হয়েছে বাংলার বাইরে। উত্তরপ্রদেশে। বাংলা পরিস্কার বলে, আর
হিন্দি আরো পরিস্কার বলে। গল্প করতে করতেই শীত বাড়তে লাগল। আস্তে আস্তে গুটি শুটি
মারছি। আধঘন্টা পরেই দেখি কানহাইয়ালাল আর জগাই মাধাই এসে ঢুকলো তাঁবুর ভেতর।
অন্ধকার হয়ে আসছে বাইরে। নিস্তব্ধতা আর ঠান্ডা জাঁকিয়ে বসছে। এরা তিন জন আসাতে আরো
একটু গপ্পগুজব হলো। আমি আমার ছোট্ট অক্সিমিটার বের করে সকলের আঙুলে পরিয়ে অক্সিজেন
মাপলাম। আমার নিজের ৯৬%। বাকিদের সবার ৮৫ থেকে ৯২ এর মধ্যে। কাল যদি দেখি এদের
কারোর আরো কমছে, তাহলে ডায়ামক্স বের করতে হবে। যদিও বলাহয় ডায়ামক্স খাবার নিয়ম
উচ্চতায় পৌঁছনর ১২ ঘন্টা আগে। সাড়ে সাতটা নাগাদ আলো খুবই কমে এলো। আকাশটা শুধু
পশ্চিমে হালকা রঙ ধরে আছে।
পৌনে আটটায় বিপিন বড় তাঁবুর
ভেতরে মাথা গলালো, তার পরে সুড়ুৎ করে গলে এলো। হাতে একটা ছোট্ট আলো, ব্যাটারিতে
চলে। রেখে দিয়ে আবার মিনিট খানেক বাদে ফিরে এলো হাসি হাসি মুখে, হাতে বিস্তর
বাসনকোসন। এবার একটু আস্তেই হাঁক দিল – “ডিনার”। থালায় পড়ল গরম ধোঁওয়া ওঠা ভাত, সবজি
দেওয়া ডাল, পাঁপড় আর আচার। পেট পুরে খেলাম চেটেপুটে। সাধারন সেদ্ধ ডাল, তাতে অল্প
ফোড়ন দেওয়া। কিন্তু তাতে এত স্বাদ যে কি করে আনে বিপিন কে জানে! মনে হচ্ছিল ডালই
খেয়ে যাই খালি। যেহেতু দেরাদুন এ রাজ্যের রাজধানী, কাজেই দেরাদুন চাল এখানে
নিশ্চিত সহজলভ্য। দোকানপাট যেখানেই খেয়েছি সব জায়গাতেই দুর্দান্ত দেরাদুন চালের
ভাত। এখানেও তাই। আতপ চাল হলেও আমার অসুবিধে হয়না। খিদের চোটে গুরুভোজন হয়ে গেল। আর
তার পর শুরু হলো তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ জুতো সব কিছু নিয়ে যুদ্ধ। উপরি হিসেবে যোগ
হয়েছে ভর পেট আর ক্লান্তি। আধঘন্টার যুদ্ধ শেষে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর সেঁধোতেই শীত
একটু কমল আর চক্ষুদুটি জুড়িয়ে এলো।
দ্রোনাগিরি
|
একঘুমে রাত কাবার হলে সকালে
খুব চাঙ্গা লাগে। কনকনে ঠান্ডায় কাকভোরে ঘুম ভাঙ্গল। হ্যাঁচড় প্যাঁচড় করে তাঁবুর
বাইরে এসে দেখি আকাশ ফর্সা তবে সূর্য্য এখনো সামনের পাহাড়ের পেছনে। পশ্চিমে বহু দূরে
হাতি পর্বতের চুড়ায় গোলাপী আভা। আমাদের তাঁবুর চারিদিকে ঘাসের ডগার শিশির জমে বরফ
হয়ে আছে। জোরে শ্বাস নিলাম। ভেতর পর্যন্ত ঝরঝরে হয়ে গেল। মনে হলো এভারেস্টে উঠে
পড়তে পারি। কনকনে ঠান্ডা। কিন্তু কিছু করার নেই। এখনো সবাই ঘুমন্ত। মোক্ষম সময়।
পকেটে আগের দিন রাত্রে ভাঁজ করে রাখা টয়লেট পেপার বের করলাম। জলে হাত দিতে গিয়ে
হাতের চেটো অসাড় হয়ে গেল। সে যাক। বাকি দিনের জন্যে ঝরঝরে লাগছে। দেখলাম দু একটা
বাড়ির সামনে এই এত সকালেও একটা দুটো লোক দেখা যাচ্ছে। বিদ্যুত সংযোগ না থাকার
কারনে এখানে সন্ধ্যের পর পরই সবাই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে, আর উঠেও পড়ে কাকভোরে।
চারিদিকে একটু সরেজমিনে দেখতে বেরোলাম। সামনের বাড়িগুলোর সারি ধরে কিছুটা উঠলাম।
আবার এক তাউজির সঙ্গে দেখা। বাড়ির সামনে বসে আরাম করে বিড়ি ধরিয়েছেন হয়ত এটা হলে
চাপ তৈরি হয়। ধুমপায়িদের ভেতরে এই ব্যাপারটা আগেও লক্ষ্য করেছি। ঘুরছি বুঝেই তাউজি
দেখালেন সামনে একটা বড়্র উঁচু বাড়ি। সেখানা নাকি সরপঞ্চের।
একটু এদিক ওদিক ঘুরে আবার
নেমে এলাম। খালি হাতেই চলে এসেছি, ক্যামেরা আনিনি, তাই ছবি তোলা হলো না। নেমে এসে
আবার দু লিটার জল খেলাম আস্তে আস্তে। সাতটার সময় বিপিনের অমোঘ আহ্বান ভেসে এলো –
“চায়ে”। এই ঠান্ডায় কে না চায়? সঙ্গে এক থালা বিস্কুট। আমি বিস্কুট খাইনা। বাকিরা
খেলো। আর এক প্রস্থ ফোটো শেশন হলো। তার পর ব্যাগ আর স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে পড়া গেল।
আমার হাতের কবজির অবস্থা গতকালের চেয়ে কিছুটা ভাল। কিন্তু সামান্য চাপ পড়লেই ভয়ংকর
লাগছে। আমাকে স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে বেকায়দা দেখে এগিয়ে এলো দাদা। চওড়া হাতের তেলোর
তিন থাপ্পড়ে দেখি অমন বেয়াড়া স্লিপিং ব্যাগ সুড়ুৎ করে সেঁধিয়ে গেল খাপের মধ্যে।
সমস্যা হলো বৌদির পিঠের ব্যাগটা নিয়ে। এমন ভাবে স্ট্র্যাপ ছিঁড়েছে, যে এখানে
মেরামত করা কোনো মতেই সম্ভব না। শেষে মুশকিল আসান করে দিলো জওন ভাই। বলল “ঘোড়ে পে
ডাল দো”। আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে যার যার যা কিছু কিঞ্চিত ভারি বস্তু
ছিল জলের বোতল ছাড়া, সেগুলো সব ওই ব্যাগের ভেতর দিয়ে দিলাম। আমার ক্যামেরার ব্যাগ ও
গেল। ফলে আমার পিঠের ব্যাগ প্রায় কিলো তিনেক হালকা হলো। আজ আমাদের গন্তব্য
লঙ্গাতুলি। কি আছে সেখানে। এক অর্থে বলতে গেলে লঙ্গাতুলি নেহাতই ম্যাপের ওপরে একটা
বিন্দু। সেখানে না আছে কোনো লোকবসতি, না আছে কোনো বিশেষ চিহ্ণ। কিন্তু তার পরেও
কিছু কথা থেকেই যায়। সে কথা আমি বলব, যখন আমাদের এই কাহিনি লঙ্গাতুলি পৌঁছবে।
“বিরেকফাস্ট” হাঁক শোনা
যেতেই সকলে গিয়ে বড় তাঁবুর ভেতরে সেঁধোলাম। আলুর পরোটা আচার সহযোগে সুন্দর
বিরেকফাস্ট সারা হলো। আর এক চক্কর চায়ের ও দেখা মিলল। আজ যেহেতু হাঁটার পাল্লা
গতকালের চেয়ে কিছুটা কম, তাই একটু গদাইলস্করি চালে এগোনো হচ্ছে। সাড়ে আটটা নাগাদ
আমরা হাঁটা শুরু করলাম। প্রথমেই খাড়াই রাস্তা শুরু, পাক খেয়ে খেয়ে উঠে গেছে। উঠতে
কসরত করতে হচ্ছিলো বিস্তর, কিন্তু রাস্তা গতকালের মত নয়। ওঠার কষ্ট টুকু বাদ দিলে
তেমন কিছু নয়। হাঁপাতে হাঁপাতে মিনিট চল্লিশ পর দ্রোনাগিরি আর বাগিনীর মাঝের
পাহাড়টার ওপরে উঠে পড়লাম আজকে আমি সকলের সামনে চলেছি। এ রাস্তায় সামান্য কিছু
পশুপালকের যাতায়াত আছে। সেই বাবদে একটা পাহাড়ের গায়ে একটা হালকা পায়েচলা রাস্তা
আছে। সেই রাস্তা ধরেই এগিয়ে চললাম। পাহাড়ের ওপরের রিজ বরাবর কিছুটা হেঁটেই সে
রাস্তা নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। পাহাড়ের একেবারে নিচে প্রবল শব্দে বাগিনী বয়ে
চলেছে। দেখলাম বহু নিচে বাগিনীর ওপর একটা সেতু। টুক টুক করে নামতে থাকলাম। পাহাড়ি
রাস্তায় ওঠার চেয়ে নামা কিন্তু কম শক্ত নয়, বিশেষ করে যখন শরীর চড়াই ভাঙতে অভ্যস্ত
হয়ে যায়। তাই সাবধানে নেমে এলাম।
গতকাল পর্যন্ত চোখে একটা
সানগ্লাস পরে রোদ আড়াল করছিলাম। অনেক শখ করে, খরচ করে বস্তুটি করিয়ে এনেছি। আমার
চোখের পাওয়ার খুব বেশী। ফলে চশমা ছাড়া আমার এক মুহুর্ত চলেনা। গতকাল ঝরনা টপকাতে
গিয়ে যখন পড়ে গেছিলাম, তখন আমার সানগ্লাসে সরু ফ্রেম একটু বেঁকে গেছে, ফলে সে খানা
পরে থাকলে মাথা ঘুরছে একটু পরেই। তাই আজ আর সেটা পরার সাহস করিনি। মিনিট কুড়ি
পঁচিশ পর আমি বাগিনীর ধারে নেমে এলাম। সামনেই সেতু। এইখানে এই জনমানবশূন্য জায়গায়
কে ই বা সেতু তৈরি করল, কেনই বা করল কে জানে! দুটো কারন হতে পারে। এক এ রাস্তায়
পশুপালকদের যাতায়াত আছে। হয়ত ওপারে পশু চরানোর জন্যে বুগিয়াল আছে। বুগিয়াল হলো
পাহাড়ি ঘাস জমি, যেখানে পশুপালনের জন্যে খুব ভাল ঘাস জন্মায় গরম কালে। সেই ঘাস এই
পাহাড়ি ছাগল ভেড়ার অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য। তাই বরফ গললেই পশুপালকেরা নিচের
গ্রামগুলো থেকে পশুর পাল নিয়ে উঠে আসে ওপরে। এছাড়া হয়ত নন্দাদেবী, ত্রিশুল, চংবং
ইত্যাদি শৃঙ্গে পর্বতারোহনের জন্য যাঁরা আসেন, তাঁদের জন্যও এ এরাস্তা ব্যবহার হয়।
এ অঞ্চল থেকে সিধে দাগ কাটলে কৈলাস , মানস সরোবর মেরে কেটে ৭০ কিলোমিটার মত। চীন
সিমান্তও ধারেকাছে। হয়ত এই ধরনের সেতুর কিছু স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বও থেকে থাকবে।
তবে এতই ছোটো সেতু, এবং যেহেতু রাস্তাও আর নেই, তাই এই সেতুর স্ট্র্যাটেজিক
গুরুত্ব হয়ত তেমন কিছু নেই। যাই হোক। সেতুর ধারে একটু বসলাম। নিচে ভীম বেগে বাগিনী
বয়ে চলেছে। সাদা ফেনার মত জল। সেতুর ওপর রাস্তা বন্ধ করা কয়েকটা গাছের গুঁড়ি আর
কিছু শুকনো কাঁটাঝোপ ফেলে।
জওন ভাই নিচে এসে পৌঁছে বলল
এ রাস্তায় নাকি নদীর ওপাড় থেকে রাতের দিকে মাঝে মধ্যে হিংস্র জন্তু জানোয়ার চলে
আসে, তাই এই ভাবে রাস্তা বন্ধ করা। কি ধরনের হিংস্র জানোয়ার সেটা আর জিজ্ঞেস করলাম
না। আজ থেকে আমরা নদীর ওই পাড়েই রাত কাটাবো। কি দরকার বেশী জেনে? বাকি সবাই নেমে
আসতে হাত লাগিয়ে গুঁড়ি সরিয়ে যাবার মত রাস্তা বের করা হলো। আমরা পেরিইয়ে আসার পর জওনভাই
আবার যত্ন করে রাস্তা আটকে দিলো। পাহাড়ে মানুষের সমাজ ও পরিবেশের প্রতি এই
দায়বদ্ধতা আমার খুব ভাল লাগে। বাজি রেখে বলতে পারি, সমতলে শহুরে মানুষ কখনো
রাস্তাটি আবার আটকে রেখে তবে সামনে পা বাড়াবে না। কেউ আমার নয়, আমি কারর নই, আমি
স্বাধীন এই বলে সে নিজের মত চলবে। পেছনে কি কুকীর্তি সে করে এলো, সেটা নিয়ে তার না
আছে কোনো ধারনা, না নেবে সে কোনো দায়। নদী পেরিয়ে রাস্তা দেখতে পেলাম না প্রথমটা।
অনেক খুঁজে পেতে একটা হালকা দাগ দেখতে পেলাম, যেটাকে ঠিক রাস্তা বলা চলে না।
বুঝলাম এ হলো পশুপালকদের ব্যবহার করা পায়ে চলা পথ।
পথ তো বলছি, কিন্তু সত্যি
কি তাই? এক দিকে পাহাড়, একদম খাড়া উঠে গেছে। গাছপালা কিছু নেই। এই উচ্চতায়
গাছপালার দেখা মেলা ভার। পাথর আর বালির পাহাড়, তাতে জায়গায় জায়গায় কিছু ঘাস আর
ছোটো ছোটো কাঁটাঝোপ। পাহাড়ের ঢাল প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ ডিগ্রি। বিশ্বাস করুন একেবারে
খাড়াই। আর সেই পাহাড়ের গায়ে। নদীর সমান্তরালে চলেছে একটা দাগ, কখনো উঠেছে, কখনো
নেমেছে। সেই নুড়ি পাথর আর বালি, সঙ্গে ভুসভুসে মাটি। পা ফেললে পা পিছলে নেমে যেতে
থাকে। ধরার কিছু নেই। কিচ্ছু করার ও নেই। এই ভাবেই এগোতে হবে সামনে। যা থাকে
কপালে, বলে পা ফেললাম। রাস্তা ওপর দিকে উঠছে। পা ফেললেই ভুরভুরে দানায় পিছলে আসছে
পা। কোন রকমে লাঠিতে ভর করে উঠতে চেষ্টা করলাম। এ যেন তেল মাখা বাঁশে বাঁদর চড়ার
গল্প। আপনি ১০০ পরিশ্রম করলে মোটামুটি ৬০-৬৫ মত উঠতে পারছেন। তাই সই। এদিকে সেই
রাস্তার দাগটিও এতই সরু, পাশাপাশি দুটো পা রাখা যায়না। কোনক্রমে একটা পা রেখে তার
সামনে আর একটা পা ফেলতে হচ্ছে। এখানে একবার ব্যালেন্স হারালে আর দেখতে হবে না।
মিনিট পনেরোর ভেতরেই আমরা অনেকটা ওপরে চলে এসেছি। যদিও রাস্তার এই হাল দেখে, স্রেফ
নিজের সামনেটুকু ছাড়া আর কোনো দিকে নজর দিতে পারিনি, কিন্তু মিনিট পনেরো পর একবার
প্রবল হাঁপাতে হাঁপাতে চারিদিকে তাকাতে চেষ্টা করলাম। না করলেই হয়ত ভাল করতাম।
দেখলাম নদী থেকে আমি প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ মিটার কি তারও একটু বেশী ওপরে। ওই নিচে
দেখা যাচ্ছে পেছনে ফেলে আসা সেতু। আর সামনের রাস্তা ওই খাড়াই দেওয়ালের মত ন্যাড়া
পাহাড় ধরে ওপরের দিকে উঠে গেছে। জানিনা কি ভাবে সামনে এগোবো, কতক্ষন এই দড়ির ওপর
হাঁটা ব্যাপারটা চলবে। সামান্য একটা পা হড়কানো বা ভারসাম্য এদিক ওদিক হলেই নিজেকে
আর কোনো ভাবেই ধরে রাখা সম্ভব নয়। জওন ভাই আসছিলো পেছনে। বলল দাদা আপ সামনে কা মাত
সোচিয়ে, ধিরে ধিরে চলিয়ে, কোই জলদি নেহি, অওর প্যায়র কো অ্যায়সে রাখিয়ে, বলে বিশেষ
ভাবে পা রাখার কায়দা দেখিয়ে দিলো। দু পা চলে দেখলাম সত্যিই চলাটা কিছুটা সহজ হলো।
কায়দাটা আর কিছুই না, আমার পা পড়ে একে অপরের সমান্তরাল হয়ে। পায়ের পাতা দুটো
সমান্ত্রাল থাকে। নতুন কায়দায় পা কিছুটা বেঁকিয়ে পায়ের পাতা কিছুটা বাইরের দিকে
মুখ করে ফেলতে হবে। বোঝাতে পারলাম কি? না পারলে মনে করুন চার্লি চ্যাপলিনের
বিখ্যাত হাঁটার কায়দা। এক্কেবারে ১০০% ওই কায়দায় হাঁটলেই হবে।
কায়দা তো নাহয় হলো, কিন্তু
পথের দুর্গমতা একটুও কমলোনা। বরং যত এগোতে লাগলাম, ততই ওই দাগটুকু আরো সরু হয়ে
আসতে লাগল, এবং মাঝে মাঝে, একটা পা ফেলাও দুস্কর হয়ে যাচ্ছিলো। আমার ঠিক পেছনেই
আসছিলো বৌদি। তার পিঠে আজ ব্যাগ নেই। দাদার ব্যাগই দুজনে পালা করে বইছে। কিন্তু
তার একটু হালকা ভার্টিগো দেখা দিচ্ছিলো। মানে কিছুই না, নিচে তাকালে মাথা ঘুরছিলো।
কেননা খাড়াই খাদ সোজা নেমে গেছে। বহু নিচে দেখা যাচ্ছে বাগিনীর জলধারা। কয়েকবার
ওকে বললাম নিচে তাকিওনা। কিন্তু তাকিওনা বললেই কি হয়? চোখ চলেই যায়। তাই শেষে তার
টুপির কানাটা মুড়ে টুপির স্ট্র্যাপের সঙ্গে আটকে দেওয়া হলো, যাতে করে দৃষ্টি শুধু
মাত্র সামনের দিকেই চলে। এবার ওর পক্ষে চলা একটু সহজ হলো। প্রচন্ড হাঁপ ধরছিলো।
কারন ক্রমাগত উচ্চতা বাড়ছে, আর অক্সিজেন কমছে। আর রাস্তাও এমনই যে দাঁড়াবার এতটুকু
উপায় নেই। আস্তে আস্তে চড়াই উঠতে উঠতে দেখলাম আমরা এপাশের পাহাড়ের প্রায় রিজের
কাছাকাছি এসে গেছি। এমন সময় পেছনে শুনলাম ঠুন ঠুন আওয়াজ। সেরেচে, বিপিন আর আমাদের
মালপত্তর সমেত ঘোড়ারা এসে গেছে। এই মারাত্মক সরু রাস্তায় এদের পাশ দিই কি করে ? জওন
ভাই হয়ত আমার চিন্তা বুঝতে পেরেছিলো, অভয় দিয়ে বলল “দাদা আপ আগে বাঢ়ো, ঘোড়া উপর সে
চলা জায়গা”। এই মেরেচে, ওপর মানে? আমার ওপর না পাহাড়ের ওপর? থাকগে আর ঘাঁটালাম না।
পেছনে ঘুরতে হলে যে টুকু জায়গা বা ভারসাম্য সামলাতে লাগে, সেটুকুরও নিতান্তই অভাব।
পেছনের ঠুনঠুন শব্দ হঠাৎ দেখি কেমন ওপর দিকে চলে গেল। দেখি ওই খাড়া পাহাড়েই গা
দিয়ে কেমন তেল তেল মুখ করে ঘোড়াগুলো আমাদের মাথার আর ফুট দশেক ওপর দিয়ে চলে
যাচ্ছে। বাবা, এগুলো ঘোড়া না স্পাইডারম্যান? কে জানে !
ঘোড়ারা
আমাদের পেরিয়ে যাবার পর আরো মিনিট পনের কুড়ি পর দেখলাম ওই কালান্তক পিলে চমকানো
রাস্তাটা শেষ হচ্ছে একটা ঘাসে ঢাকা চত্তরে। এখানটা অনেকটা সমতল মত। ঠিক পুরোপুরি
সমতল বলা যায়না যদিও। পাহাড়ের ঢাল আছে, এদিক ওদিক প্রচুর বিশাল বড় বড় পাথর আছে।
কিন্তু ওই খুন জমানিয়া খাদ নেই। আর দু পায়ের পাতা পেতে দাঁড়াবার প্রচুর জায়গা আছে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যদিও মনের ভেতরে কোথাও একটা খিচ লেগেই রইলো, যে ও রাস্তা ফেরার
সময় আবার পেরোতে হবে। ঘাসের মাটিতে ব্যাগ রেখে আমরা সবাই একটু বসলাম। নদীর
অন্যদিকে দেখলাম ঠিক এদিকেরই মত একটা ঘাসজমি, আর তাতে পাথর সাজিয়ে চৌকো জমি
চিহ্নিত করা আছে। বুঝলাম না কিসের। জওন ভাই বলল, সরকারি কিছু একটা ক্যাম্প হবার
কথা আছে সেখানে। এই ঘাসের হাল্কা ঢালু জমিটা এতই সুন্দর, যে উঠতে ইচ্ছে করছিলোনা।
মনে হচ্ছিলো এখানেই বসে থাকি সারা দিন। বিশেষ করে ঐ ভয়ংকর রাস্তাটা পেরিয়ে আসার পর
তো আরোই উঠতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু তবুও গতকালের অবসাদের কথা মনে হওয়াতে একটু
পরেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লাম। আমার আগে আগে কানহাইয়ালাল চলছিলো। এখানে সেই অর্থে
আর কোন রাস্তা নেই। একদিকে নদী, এই ঘাস জমি থেকে কিছুটা নিচে। ঘাসজমিটা ঢালু হয়ে
ওপর দিকে উঠে গেছে। চড়াই এখানেও ভাঙতে হচ্ছে, কিন্তু সেটা প্রানান্তকর নয়। একটু
ধিরে ধিরে রয়ে সয়ে চললে চলা যায়। যেদিকে নদী, তার ঠিক উলটো দিকে খাড়া পাহাড় উঠেছে
দেওয়ালের মত। মাঝখানে এক ফালি জমি যেখান দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি। এদিক ওদিক বড় বড়
পাথর পড়ে আছি। বহু হাজার বছর আগে, হয়ত বিগত শেষ তুষারযুগের সময় হিমবাহ এই অঞ্চলের
ওপর দিয়ে আরো নিচে পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেই হিমবাহই এই সব অতিকায় পাথর গুলো বয়ে
এনেছে। জুন মাস বলে এখানে কচি কচি ঘাস গজিয়েছে। আরো দু এক রকম বুনো গুল্ম দেখলাম।
সব কিছুই অসম্ভব সুন্দর এখানে। তাকালে চোখ ফেরানো যায়না। একবার পেছন ফিরে তাকালাম।
দেখলাম রুইং থেকে যে সব বরফ ঢাকা শৃঙ্গ ওপর দিকে তাকিয়ে দেখতে গিয়ে ঘাড় ব্যাথা হয়ে
যাচ্ছিলো, আমরা এখন মোটামুটি সে উচ্চতায় এসে গেছি।
লঙ্গাতুলির পথে ফিরে দেখা পেছনের পেরিয়ে আসা পথ |
এক একবার একটু জিরিয়ে নিতে
ইচ্ছে করছিলো। গতকালের তুলনায় অনেক কম হলেও আজ সকালে রওনা হবার পর ঘন্টা তিনেকের
ওপর কেটে গেছে। তিনঘন্টা পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা সহজ নয়। তার ওপর অমন একটা জায়গা
পেরিয়ে এসেছি। কিন্তু এত সুন্দর চারদিকের পরিবেশ, হাঁটা থামাতেও মন চাইছিলোনা। তাই
এগিয়ে চললাম। একটু করে এগোই, মনে হয় ওই সামনের উঁচুটায় যেতে পারলেই বাকি টুকু
সমতল। কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখি চড়াই যেমনকার তেমনই আছে। বোতল বার করে জলে দু
চুমুক দিয়ে আবার এগোই।
এরকম এগোতে এগোতে একটা
জায়গায় এসে দেখি একটা অতিকায় পাথর, সেটা প্রায় একটা দোতলা বাড়ির মত উঁচু, আর তার চারিদকে
আরো কটা ছোটোখাটো পাথর পেরিয়ে আবার একটু সমতল জমি দেখা যাচ্ছে। আর অদ্ভুতভাবে বাগিনীও
নিচের খাদ ছেড়ে একেবারে এই ছোট্ট সমতল ফালি জায়গাটার একদম গায়ে চলে এসেছে। সামনে
একটা ভারি সুন্দর বাঁক নিয়ে বাগিনীর খাত চলেছে হিমবাহের দিকে। আরো দূরে তাকালাম।
সামনে পাহাড়ের খাড়াই উঠে গেছে যেখান থেকে সেখানে খুব সম্ভবতঃ আমি হিমবাহের সাদাটে
ভাব দেখতেও পাচ্ছি। জায়গাটা এত ভাল লেগে গেল, ভাবলাম একটু বসি ওই বাগিনীর ধারে। এ
যেন প্রায় প্রোফেসর শঙ্কুর ডুংলুং ডোর মত অবিশাস্য সুন্দর। এখানের ঘাস, গুল্ম,
ফুল, লতা, কোনোটাই চেনা নয়। কিন্তু সবকিছুই যেন কল্প লোকের বাসিন্দা। গায়ে চিমটি
কেটে দেখলাম, উচ্চতাজনিত হ্যালুসিনেশন কিনা। পায়ে পায়ে নদীর দিকে এগোতেই দেখি
বিপিন আর আমাদের ঘোড়াওয়ালা একটা তাঁবু ধরে টানাটানি করছে। সিদ্ধান্তে এলাম,
লঙ্গাতুলির চেয়ে সুন্দর জায়গায় আমি এর আগে কখনো রাত কাটাইনি। পিঠের ব্যাগ নামিয়ে
রেখে নদীর ধারে গেলাম। গায়ে যদিও গরম জ্যাকেট, এবং সময়টা ভরদুপুর, মাথার ওপর সূর্্য্য
আর রোদের আঁচ বড্ডই চড়া, তবুও কেমন যেন গা শিরশিরে একটা ভাব রয়েছে এখানে। আর একটা
জিনিস লক্ষ্য করছিলাম। গা হাত পা কেমন যেন এলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটু শুয়ে পড়ি।
এ হলো শরীরের ওপর উচ্চতাজনিতকারনে কম অক্সিজেনের প্রভাব। দু পা হাঁটলেই মনে হচ্ছে
খুব পরিশ্রম হয়েছে। বুঝলাম মানিয়ে নিতে অন্ততঃ আজকের দিনটা লাগবেই। এ সময় নিয়ম
হচ্ছে বসে না থেকে অল্প হাঁটাচলা করা। তাতে শরীর ধাতস্থ হয়।
বাগিনীর ধারে গেলাম। সরাসরি
ঐ প্রবল জলস্রোতে হাত না দিয়ে, বাঁ দিকের পাহাড় থেকে নেমে আসা একটা ছোট্ট সোতার জল
গন্ডুষ করে তুললাম। হাত প্রায় অবশ হয়ে গেল ঠান্ডার চোটে। কি সাঙ্ঘাতিক ঠান্ডা জল
রে বাবা! মনে পড়লো সকালে ঠান্ডার জন্যে দাড়ি কামাইনি। কি মনে হলো, কোমরে আটকানো
ছোট পাউচ ব্যাগ থেকে দাড়ি কামানোর জিনিসপত্র বের করে দাড়ি কামাতে শুরু করলাম। রোজ
সকালে নিয়ম করে দাড়ি কামাই আমি। বাইরে গেলেও নিয়ম ভাঙ্গে না। এটা নিয়ে আড়ালে কিছু
রসিকতাও আছে জানি। এবং পরে দেখেছি, লঙ্গাতুলিতে পরের দিন সকালে বিকট মুখভঙ্গী করে
দাড়ি কামাচ্ছি সেই ছবিও তোলা আছে। যাই হোক, হিমঠান্ডা জলে দাড়ি কামাবার পরেও যেন
জলটা হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো। এদিক ওদিক দেখলাম। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, সোতার ধারে, সে
জায়গাটা একটা বড় পাথরের আড়ালে। আমার সঙ্গে একটা প্লাস্টিকের মগ থাকে সব সময়। এখন
যেমন সেটা দিয়ে দাড়ি কামালাম। এ ছাড়া একটা মাদ্রাজি তোয়ালে। হালকা, বেশী জায়গা
নেয়না। ইতি উতি দেখে জ্যাকেট, টি শার্ট, জুতো, মোজা প্যান্ট সব ছেড়ে ওই মাদ্রাজী
তোয়ালে পরে খালি পায়ে হাতে মগ নিয়ে সোতার একবারে ধারে গেলাম। সঙ্গে একটা ছোটো
সাবান। যোশীমঠ ছাড়ার পর আর চান হয়নি। এই দুপুর রোদে লঙ্গাতুলিতে একটা সুযোগ নিয়ে
দেখলাম। জলে নামা বা ডুব দেওয়ার জন্যে জল একেবারেই অপ্রতুল এখানে। অগত্যা মগ। মনে
প্রচন্ড জোর এনে, মিনিট পাঁচেক দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে গায়ে ঢেলেই দিলাম এক মগ জল। বাপ
রে বাপ। কচুয়া ধোলাই, কম্বল ধোলাই ইত্যাদি আসুরিক চিকিৎসাতেও ব্রিটিশ সরকার যে সব
কয়েদীদের কথা বলাতে পারতেন না, তাদের মাথায় ওই জল এক মগ ঢাললেই কাজ হয়ে যেত। সতর্ক
ছিলাম বলে মাথায় জল ঢালিনি। কারন অত্যধিক ঠান্ডা জল হঠাৎ মাথায় পড়লে রক্ত চলাচলে
বিঘ্ন ঘটে তাড়াতাড়ি একটু সাবান ঘষে আরো দু তিন মগ ঢাললাম আর আঁজলা করে জল তুলে
সাবধানে মাথায় ঘাড়ে দিলাম।
জলের স্পর্শ পেয়ে শরীর অনেক
ঝরঝরে লাগল। তাড়াতাড়ি উঠে গা মুছে আবার পোষাক পরে নিলাম। পেছনে লোকজনের গলা পেয়ে
দেখি সবাই এসে হাজির হয়েছে। এবং এই অদ্ভুত সুন্দর ক্যাম্পসাইট দেখে সকলেই খুব
উত্তেজিত, যদিও শরীর হয়ত পুরোটা দিচ্ছে না। এই ঠেকো রোদের মধ্যেই একটা কনকনে হাওয়া
দিতে শুরু করেছে যেটা হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আমাদের লোকজন দেখলাম জল দেখে খুব খুশী।
প্রথমটায় সবাই খুব হুটোপাটি করল। একতু পরেই হাঁপিয়ে গিয়ে সকলে এদিক ওদিক বসে পড়ল।
কানহাইয়ালাল একটা পাথরের ওপর বসে রোদ পোয়াচ্ছিলো। জগাই মাধাই তাদের প্রিয় কাজ পেয়ে
গেল, কানহাইয়ালালের পেছনে লাগা। দাদা বৌদি জলের ধারে বসেই একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলো।
আমি জায়গাটা একটু সরেজমিনে দেখে আসতে এদিক ওদিক ঘুরতে বেরোলাম। প্রধান কারন পরের
দিন সকালে দ্রুত কাজকর্ম সারার উপযুক্ত স্থান। কেননা জওন ভাই বলে দিয়েছে আগামী কাল
অনেকটা হাঁটা এবং অনেক চড়াই ভাঙ্গা বাকি আছে। আমাদের ক্যাম্প থেকে কিছুটা পেছনে,
পাহাড়ের দিকে একটা সুন্দর জায়গা পাওয়া গেল। প্রায় পশ্চিমি ধাঁচের টয়লেটই বলা চলে।
নিশ্চিন্ত মনে ফিরে এসে ক্যাম্পের কাছেই একটা পাথরের ওপর বসলাম। এমন সুন্দর জায়গায়
অনেকের অনেক কিছু ইচ্ছে করে। কেন জানি আমার মনে বহু দূরে আমার শহরের কথা মনে
পড়ছিলো। সেখানে কেউ পাহাড় বড় ভালোবাসে। কিন্তু এই ধরনের যাত্রায় সে আসতে পারবে না
কখনো। তাই তার জন্যে নিয়ে যাবো ছবি আর অভিজ্ঞতা। সে সব অবশ্য অন্য এক গল্প। কিছুক্ষন
বিশ্রাম নিতেই দেখি পেট কেমন খালি খালি লাগছে। যদিও সকাল বেলা দ্রোনাগিরি থেকে পেট
পুরেই জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছি, কিন্তু এখন প্রায় বেলা দুটো বাজতে চলল। পেটের চিন্তা
মাথায় আসতেই কানে ঢুকলো প্রেসার কুকারের “ফিইইইইস” আর মিনিট দশেক পরেই বিপিনের
হাঁক “লাঞ্চ”।
লঙ্গাতুলি
ক্যাম্প – বহুদূরে হিমবাহের শুরু ও তার পেছনে ঋষি শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে
|
বিকেল চারটের পর থেকেই
দেখলাম তাপমাত্রা লাফিয়ে লাফিয়ে কমছে। ছাওয়ায় থাকলেই হাড় কেঁপে যাচ্ছে ঠান্ডার
চোটে। তখনো ভালোই রোদ থাকার জন্যে অসুবিধে হচ্ছিলোনা। কিন্তু ভাবছিলাম রোদ চলে
গেলে কি হবে! এদিকে আকাশ পুরো পরিস্কার নয়, প্রচুর মেঘের ঘোরাফেরা চলছে। বহু দূরে
হিমবাহ ও তারও ওপারে ঋষি শৃঙ্গ দেখতে পাচ্ছিলাম কিছুক্ষন আগেও। কিন্তু এখন আর
শৃঙ্গ দেখতে পাচ্ছিনা। কারন মেঘ এসে ওদিকটা ঝাপসা হয়ে গেছে। আমি পাহাড় গুলো দেখছি
দেখে জওনভাই আমাকে ডান দিকে একটা শৃঙ্গ দেখিয়ে বলল এইটে নাকি গন্ধমাদন। সেই যেটাকে
তুলে নিয়ে হনুমান শ্রীলংকা গেছিল। ভাগ্যিস তখন কাস্টমস ছিলোনা, নয়ত প্রাকৃতিক
সম্পদ শ্রীলঙ্কায় পাচার করার দায়ে হনুমান বাবাজিকে হাজতবাস করতে হতো। গন্ধমাদনের
দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন। মনে কিছু একটা ভাব আনতে অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু
কিস্যু এলোনা। একেবারেই কাঠ নাস্তিক লোক আমি। বরং বার বার এটাই মনে হচ্ছিলো, যে
মুর্গী আগে না ডিম? আগে রামায়ন লিখে তার পর পর্বতের নাম দেওয়া না কি পর্বতের নাম
থেকে রামায়নের কাহিনী এখানে এনে ফেলা? যাই হোক, পরিচিত নাম তো বটেই। আর রামায়নে হনুমান
আমার দুটি খুবই প্রিয় চরিত্রের একটি। অন্যটি হলেন কুম্ভকর্ণ। বিকেল ঢলে ঢলে
সন্ধ্যে নামছে। কেবল মাত্র দুরের পাহাড়গুলোর মাথায় হলদেটে রোদের ছিটে লেগে আছে।
ঠান্ডায় হি হি করছি, আর অল্প অল্প পায়চারি করছি, এমন সময় হাঁক এলো “চায়ে”। একটু
উষ্ণতার জন্য মানুষ কতকিছুই তো করে। আমি শুধু পকেটের গরম থেকে ডান হাতের চেটো টুকু
বের করলাম চায়ের কাপ ধরব বলে।
ছটার পর আর বাইরে থাকা
গেলনা। সবাই মিলে জমিয়ে বসলাম বড় তাঁবুর ভেতর। এটা আমাদের খাওয়া দাওয়ার তাঁবু।
রাতে ইচ্ছে হলে থাকাও যায়। তবে কিনা এই তাঁবুর নিচের দিকে একটু ফাঁক ফোকর রয়ে যায়।
ফলে হুহু করে হাওয়া ঢোকে। আমরা আমাদের ব্যাগপত্তর দিয়ে সেই ফাঁক গুলো যতটা সম্ভব ঢেকে
ঢুকে বসলাম। আজকে আবার অক্সিজেন মাপলাম সকলের। গতকালের চেয়ে সবারই অক্সিজেনের
মাত্রা কিছুটা করে কম। সবচেয়ে কম বেরোলো ৮২%, আমার বেরোলো ৯৪% এখনো পর্যন্ত সকলের
চেয়ে বেশী। জানিনা কি করে এরকম হচ্ছে। তবে আমি সাধারনতঃ প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশী
খাই আর রোজ কার্ডিওভাস্কুলার এক্সারসাইজ করি, সেই কারনেই হয়ত বেশী। তবে বাকিরাও
করে, আর তারদের ফিটনেস আমার চেয়ে অনেক বেশী। যতক্ষন না খুব কম হচ্ছে অক্সিজেন,
ততক্ষন চিন্তার কিছু নেই। তবুও দুজন কে ডায়ামক্স দেওয়া হবে ঠিক হলো আলোচনা করে।
যথা সময়ে বিপিন আমাদের ডাল, ভাত, রুটি, আলুর তরকারি আর স্যালাড খাইয়ে দিলো। সে
রাতে আর বেশীক্ষন রাত জাগা হলোনা। রাতে বেরোতে হলে লোকজন কে সাবধান করে দেওয়া হলো,
কেউ যেন তাঁবু থেকে বেশী দূরে না যায়। কেননা অচেনা বন্য জন্তুর উপস্থিতি একেবারে
উড়িয়ে দেওয়া যায়না। ঠান্ডা যে রকম জাঁকিয়ে পড়েছে, তাতে করে কেউ রাতে বেরোতে চাইবে
এরকম সম্ভাবনাও কমই। রাতে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর দু খানা বোতলে জল ভরে সেগুলো সমেত
ঢুকলাম। শরীরের গরমে জল কিছুটা গরম হবে। না হলে সক্কাল সক্কাল ওই হিমঠান্ডা দু
বোতল জল গিলতে খুব কষ্ট হবে। অথচ ওই জলটা খাওয়া খুবই প্রয়োজন, নাহলে অ্যাকিউট মাউন্টেন
সিকনেস (AMS) হতেই পারে।
লঙ্গাতুলি
ক্যাম্প থেকে বাগিনী হিমবাহ
|
হেঁটে হেঁটে বাগিনীর পিঠে
কনে দেখার আদর্শ আলো যেমন
গোধুলি লগ্নে, লঙ্গাতুলি দেখার আদর্শ সময় সেরকম সক্কাল বেলা। রাতের শিশির গুলো
ঘাসের ডগায় জমে গিয়ে সাদা হয়ে আছে। সদ্য ওঠা রোদে সেগুলো গলছে আর টুপটাপ করে পড়ছে।
কনকনে ঠান্ডায় সোনালি রোদে মাখামাখি হয়ে লঙ্গাতুলি আমার চোখে দেখা সবচেয়ে সুন্দর
জায়গার রানী হয়েই হয়ত থেকে যাবে সারা জীবন। এত কঠিন রাস্তায় আসা সার্থক। এর পরে আর
কি দেখবো, কতটা যেতে পারব, তা জানিনা। কিন্তু লঙ্গাতুলি যে রূপ আমায় দেখালো, তাতে
আমার চোখ সত্যিই ধাঁধিয়ে গেছে। আগের দিনের আবিস্কার করা প্রাকৃতিক পশ্চিমি টয়লেটের
কাজ সারা। দাড়ি কামিয়ে নিয়েছি। স্লিপিং ব্যাগ খাপে ঢুকে গেছে (অবশ্যই দাদার
হাতযশ)। বিপিনের দু প্রস্থ চা আর ম্যাগি দিয়ে “বিরেকফাস্ট” সেরে আমরা তৈয়ার আগে
বাঢ়ার জন্যে। জওন ভাই হাত তুলে দূরে দেখালো এক জোড়া চমরী গাই ঘুরছে প্রায় এক
কিলোমিটার দূরে। এখানে আবহাওয়া এত ধুলোবালি শূন্য, বহু দূর পর্যন্ত পরিস্কার দেখা
যায়। আমরা গুটি গুটি পায়ে এগোলাম। জওন ভাই সাবধান করে দিয়েছিলো, আজ আমাদের একটা
খাড়াই পাহাড় চড়তে হবে। সেটা সামনে আমরা দেখতেও পাচ্ছিলাম। একেবারে খাড়া হয়ে উঠে
গিয়ে হিমবাহে মিশেছে। আর বাগিনী একটা জলপ্রপাতের রূপ ধরে সেখান থেকে নেমে আসছে।
প্রথম কিলোমিটার খানেক উঁচু নিচু জমি দিয়ে হাঁটা। আস্তে আস্তে সে জমি ওপর দিকে
উঠছে। কিন্তু বাঁ দিকের পাহাড় থেকে ৫০-১০০ মিটার পর পরই একটা করে নালা বা পার্বত্য
সোতা এসে পড়েছে বাগিনীতে। সেই জলধারা গুলো টপকে টপকে হাঁটতে হচ্ছিলো।
আমার জুতোর বিবরণীতে বলা
ছিলো জলনিরোধক এখন সেটা কয়েকবার পরীক্ষাও হয়ে গেল। গ্রীক নামওয়ালা ফরাসি কোম্পানির
নেটিভ আমেরিকান জনজাতীর নামধারী জুতো হিমালয়ে আমাকে দুর্দান্ত ভরসা দিয়েছে।প্রথমদিকটা
হাঁটা একেবারেই কিছু মনে হচ্ছিলোনা। আমরা বেরিয়েছি সক্কাল সক্কাল। যাতে দুপুরের
ভেতর বাগিনী বেস ক্যাম্পে পৌঁছতে পারি। কিলোমিটার দেড়ে দুই পেরোনোর পর আমরা সেই
খাড়াই জায়গাটায় এসে পৌঁছলাম যেখান থেকে ওপরে উঠতে হবে। সামনেটা একদম পাথুরে আর
বালি বালি নুড়িতে ভর্তি। পা দিলেই হুড় হুড় করে পিছলে নেমে আসছে। কিন্তু গত দুদিন
এরকম রাস্তায় কিছুটা চলে অনেক অভ্যস্ত এখন আমরা। কাজেই বাগিনীর চড়াই আমাদের
প্রথমটা সেই আগের দুদিনের মত হতবাক করে দিতে পারলোনা। এখন আমরা জানি, যে পা ফেলার
পর প্রথমটা একটু ঘষটে পিছলে আসবে ঠিকই, কিন্তু একটু এসেই পা আটকাবে। আর সেটাই হবে
আমার পদক্ষেপ। অন্যথায়, পা ফেলার সময়, দৌড়নোর মত করে পায়ের পাতার একদম সামনের দিক,
মানে বুড়ো আঙুলের জায়গা দিয়ে একটু খুঁচিয়ে পা রাখা গেলে একটা ধাপের মত তৈরি হচ্ছে,
আর ওঠা সহজ হচ্ছে। কিন্তু এই দুটোই বেশ পরিশ্রমসাপেক্ষ দেখা গেল। তার ওপরে অক্সিজেনের
অভাবটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি সকলে। কারোর মুখেই কোনো কথা নেই। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে।
প্রায় মিনিট চল্লিশ চড়াই
ভাঙার পর আমরা একটু দাঁড়ালাম। কিন্তু এমন খাড়াই পাহাড়, এখানে ঠিক করে দাঁড়ানোরও
জায়গা নেই। কাজেই মিনিট খানেক পরেই আবার চড়াই ভাঙ্গা শুরু হলো। আমি দু বোতল জল
ভর্তি করে এনেছি নদী থেকে। এখানে সব জায়গাতেই আমরা ওই নদীনালা আর ঝরনার জলই
খাচ্ছি। সব ঝরনার জল খাবার উপযুক্ত নয়। জওন ভাইকে জিজ্ঞেস করেই তবে জল ভরা হচ্ছে।
এই উচ্চতায় এসে দেখছি একটা সামান্য সবুজের চিহ্ণও কোথাও নেই। এত ওপরে, শুকনো পাথরে
উদ্ভিদ জন্মাতে পারেনা। কিন্ত এই রুক্ষ পাথরেরও একটা অদ্ভুত আকর্ষণ রয়েছে। ক্রমশঃ
আমার দম ফুরিয়ে আসছিলো। একটু করে উঠি, ওপর দিকে তাকাই, মনে হয় ওই তো একটু উঠলেই
চড়াই শেষ, কিন্তু সেই জায়গাটায় পৌঁছে আবার দেখি আবার নতুন চড়াই শুরু হয়েছে। পিঠের
ব্যাগটা অসম্ভব ভারি লাগতে শুরু করেছে। আর মনে হচ্ছে হাতে পায়ে জোর নেই তেমন। তবুও
উঠতে হচ্ছে। কারন আমাদের গন্তব্য ওই সামনের দিকেই। ঘন্টা দেড়েক পর একটা জায়গায় এসে
আর পারা গেলনা। কোনক্রমে অল্প একটু জায়গা আছে, সেখানে দাঁড়ানো যায় বা খুব বেশী হলে
পেছনে পাথরের ওপরে ব্যাগ ঠেসান দিয়ে একটু কাঁধ-পিঠ কে আরাম দেওয়া যায়। এখানে এসে
আমরা সকলেই দাঁড়ালাম। কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না ক্লান্তিতে। সকলেরই চোখ মুখ বসে
গেছে পরিশ্রমের চোটে।
সকলের পেছনে এসে পৌঁছলো
জগাই। দেখলাম ক্লান্তিতে পা পড়ছে এলোমেলো। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। ভাল লাগলোনা দেখে।
আর দেখলাম সঙ্গে সঙ্গেই ও আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল ওই সরু রাস্তার ওপর। যদিও পড়ে
যাবার ভয় নেই এখানে পেছন দিকে ছাড়া, কারন দুদিকের পাথর উঁচু উঁচু। আমি আমার পিঠের
ব্যাগ নামিয়ে ঝটপট পরীক্ষা করলাম। অক্সিজেনের মাত্রা ৭৩%। চোখের তারা ছোটো হয়ে
এসেছে, চোখের কোলের লাল অংশ কালচে। জিভ গুটিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।। নাড়ি বেশ
ক্ষীণ। তাড়াতাড়ি আমার একটা বোতল বের করে তাতে দু খানা ওআরএস গুলে খাওয়াতে শুরু
করলাম। মেয়ের মোটামুটি অজ্ঞান অবস্থা। কিন্তু কোনক্রমে একটু একটু করে জল খেতে শুরু
করল। আমি বাকিদের বললাম এগিয়ে যেতে, আমি জগাইকে নিয়ে আসছি একটু পরে। কিন্তু সকলেই
চিন্তিতঃ। কেউ এক পা নড়লনা। দেখে ভালো লাগল। এই স্পিরিট না থাকলে দল হিসেবে কোনো
কাজে সফল হওয়া সম্ভব নয়। মিনিট দশেকের চেষ্টায় পুরো এক লিটার জল জগাইকে খাওয়াতে
পারলাম। এদিকে জওন ভাই ততক্ষনে প্যাকেট বের করে সবাইকে পরোটা আলুর তরকারি ধরিয়ে
দিয়েছে। থামা যখন হলোই, তখন সেটা কাজে লাগানো যাক। আরো মিনিট দশেক পরেই জগাই গা
ঝাড়া দিয়ে বসে আমাদের সকলকে একটা সুন্দর হাসি উপহার দিলো। বুক থেকে একটা ভার নেমে
গেল। গত মিনিট বিশেক প্রচুর আজে বাজে চিন্তা করেছি। মেয়েটা এক হাসিতে সেগুলো ঝেঁটিয়ে
বিদেয় করল। ওর হাতেও পরোটা আলুর তরকারি ধরানো হলো। আমি খুব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস
করলাম, সকালে দু লিটার জল খাওয়ার বিধান সে মেনেছিলো কিনা। ভয়ে ভয়ে তাকানো দেখেই যা
বোঝার বুঝে গেলাম। বললাম আরো মিনিট চল্লিস পঁয়তাল্লিস পর যেন ও আরো এক লিটার সে জল
খায়। আর বাকিদের দিকে তাকাতে দেখি জনা দুয়েক কোঁতকোঁত করে জল খেতে শুরু করেছে বোতল
বের করে। বুঝলাম এই চরম ঠান্ডায় সকালে অতটা জল খাবার ধকল অনেকেই নিতে চায়নি।
খেয়ে দেয়ে আবার হাঁটা শুরু
হলো। এবারে খেয়াল করলাম প্রানান্তকর খাড়াইটা আর নেই। যদিও চরাই ভাঙতে হচ্ছে,
কিন্তু এ হলো পাহাড়ে যেমন সাধারন উঁচুনিচু বেয়ে আস্তে আস্তে ওপরে ওঠা হয়, সে রকম।
কিন্তু আমার সামনে প্রধান সমস্যা দেখা দিলো অক্সিজেনের অভাব। দু পা হাঁটলেই হাঁফ
ধরছে। অথচ থামার উপায় নেই। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলেছি বলে মনে হচ্ছে। দলের
বাকিরা কোথায় ভাল দেখতে পাচ্ছিনা। আমার থেকে কিছুটা পেছনে জওন ভাইকে দেখছি শুধু।
বিপিন ও ঘোড়ারা আগে এগিয়ে গেছে। মালবাহক ও গাইডের ভুমিকা পুরোপুরি আলাদা হয় এই রকম
ট্রেকের ক্ষেত্রে। মালবাহক এক জায়গা থেকে মাল পত্র অন্য ক্যাম্পে পৌঁছে দেন। তিনি অভিযাত্রীর
সঙ্গে নাও যেতে পারেন। নিজের ছন্দে নিজের রাস্তায় , কখনো নিজের শর্টকাট ধরে
মালবাহক ঠিক পৌঁছে যান পরের গন্তব্যে। কিন্তু গাইডের ভুমিকা আলাদা। তিনি কখনো
অভিযাত্রীর সঙ্গ ছাড়েননা। সব সময় সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকেন। তাকে সাহায্য করেন।
অনেকেই আমাকে বলেন, যে পোর্টার অর্থাৎ মালবাহকই তো রাস্তা চেনেন, তাহলে আর আলাদা গাইড
নেবার কি দরকার। পাঠক, আপনি যদি এই লেখা পড়ে হিমালয়ের এই সব অঞ্চলে ভ্রমনে উৎসাহী
হন, তাহলে সেটা আমার পরম সৌভাগ্য হিসেবে বিবেচনা করব। কিন্ত ভুলেও কখনো পোর্টার কে
গাইড হিসেবে ব্যবহার করতে যাবেন না। তার তালে চলতে গেলে যে দম ও অভ্যেস লাগে, তার
একটাও আপনার নেই, কেননা আপনি সমতলের মানুষ। জওন ভাই গোটা রাস্তায় কোথাও একবারের
জন্যেও আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি, এবং যখনই কোনো সমস্যা হয়েছে, এই মিতভাসি সদাহাস্যমুখ
লোকটা তখনই সেখানে এসে আমাদের সমস্যা থেকে বের করে নিয়ে গেছে। আবার অন্যদিকে গায়ে
পড়ে জ্ঞান দিতে আসেনি, হামবড়া ভাব দেখায়নি। আপনাদের যদি ইচ্ছে হয়, এই লোকটার সঙ্গে
ঘুরে আসবেন। বড় নিশ্চিন্ত ভরসার মানুষ।
একবার পেছন ফিরে জওন ভাইকে
ইশারা করে জিজ্ঞেস করলাম ঠিক যাচ্ছি তো? এই দিকেই তো? কেননা জওন ভাই আমার থেকে
অন্ততঃ ২৫০-৩০০ মিটার পেছনে। জওন ভাই হাত তুলে থাম্বস আপ দেখালো। আমিও আবার পা
বাড়ালাম। কোথাও বড় পাথরের বোল্ডার, কোথাও নুড়ি, কোথাও দু রকম এক সঙ্গে। এরই মাঝখান
দিয়ে টপকে টপকে এগোচ্ছি। কখনো মিনিট খানেক একটু দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছি। আজকে
রোদ প্রায় নেই। আকাশ ঘোলাটে মেঘলা। আর ঠান্ডাও আস্তে আস্তে বাড়ছে। হাওয়ার জোরও
বাড়ছে সেই সঙ্গে। এত কঠিন জায়গায় ক্যামেরা বের করে ছবি তোলার কথা একবারও মনে
আসেনি। কারন সেটা সম্ভব ছিলোনা। শেষের দিকে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলতে লাগলাম। কোনোমতে
নিজেকে টেনে নিয়ে এগোনো। পাথরে হোঁচট খাচ্ছি, বুঝতেও পারছি হোঁচট খেতে পারি, কিন্তু
চিন্তা শক্তি ও প্রতিবর্ত্ম এতটাই ঢিমেতালে কাজ করছে, যে ঠিক সময় পা সরাতে
পারছিনা। জওন ভাই আজ সকালে বলেছিলো, এখানে পাথরের খাঁজে কিছু অর্কিড বা ছত্রাক
গোছের বস্তু হয়, যে গুলো সংগ্রহ করতে দু একজন লোক মাঝে মাঝে এ তল্লাটে আসে। বাইরের
বাজারে এসবের নাকি অগ্নিমূল্য। জওন ভাইয়ের কথা অনুযায়ি আমরা যেখানে ক্যাম্প করব
তার একটু আগেই নাকি এই সব সংগ্রাহকদের একটা আড্ডা আছে। সেখানে তাদের সঙ্গে আমরা
কিছুটা সময় কাটাতে পারি।
একটা সময়ের পর দেখি, একটা
ছোট ঢিবির ওপর উঠে ওপাশে জমিটা সামান্য একটু নেমে গেছে। রাস্তার বাঁ দিকে তিরিশ
মিটার মত একফালি জমি চলে গেছে সামনে, আস্তে আস্তে উঁচু হয়েছে, তার পর খাড়া
দেওয়ালের মত পাহাড় উঠে গেছে। আর ডান দিকে নজর ফেরাতে যা দেখলাম, সেই দৃশ্য আমার
আজীবন মনে থাকবে। দেখলাম ডান দিকে ওই সরু ফালি জমিটার পরে নুড়ি আর বোল্ডারের
সামান্য উঁচু একটা রিজ খুব বেশী হলে কোমর সমান উঁচু। আর তার ওপাশে অতিকায় সুবিশাল
এক হিমবাহ, যার ওপরে অসংখ্য পাথরের টুকরো, আর সেগুলোর তলায় কোথাও চাপা পড়ে আছে
বরফের স্তুপ। হিমবাহের ওপাশে আর মাথার দিকে অসংখ্য শৃঙ্গ। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা
চারিদিকে। পরিবেশ অসম্ভব গম্ভীর। একটু সময় তাকিয়ে দেখে, আবার ক্লান্ত শরীর টেনে
নিয়ে চললাম সামনের দিকে। আর একটা ঢিবি পেরিয়ে দেখি দূরে উজ্জ্বল হালকা নীল রঙের
আমাদের তাঁবু গুলো খাটিয়ে ফেলা হয়েছে। বিপিনরা নিশ্চই অনেক আগেই চলে এসেছে ঘোড়া
সমেত। গন্তব্য দেখে পা চালালাম। আর সত্যিই ক্ষমতা নেই। সময় এখন প্রায় বিকেল চারটে।
আজকের দিনটা আমাদের বড়ই লম্বা ছিলো। বড় তাঁবুতে ঢুকে ধড়াস করে কাঁদের ব্যাগ
নামালাম। ঘোড়া থেকে বৌদির ব্যাগ নামিয়ে সেটা বড় তাঁবুতেই রাখা ছিলো। ওটা খুলে আমার
ক্যামেরা বের করলাম। বাইরে এসে কয়েকটা ছবি তুললাম এই অপার্থিব জগতের। এ যেন
পৃথিবীর বাইরে কোনো গ্রহ। বাতাস এত পাতলা আর ধুলোবালিহীন, পাহাড় আর তার বরফ ও পাথর
কেমন অবাস্তবের মত পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। বিশ্বাস হতে চায়না এত দূরে এত পরিস্কার
দেখতে পাওয়া যায়।
বাগিনী
হিমবাহ
|
অনেকটা নিচে হিমবাহের দিকে
তাকালে বুক কেঁপে ওঠে। চারিদিক নির্জন। এতটুকু শব্দও নেই কোথাও। নিজের শ্বাস ফেলার
শব্দে নিজেই চমকে উঠছি। হঠাৎ কোথাও একটা কড়কড় কড়াৎ করে শব্দ হলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে
দেখলাম। মিনিট দশেক পর আবার একই রকম আওয়াজ। পরে বুঝলাম হিমবাহের বরফ আর পাথর
ভাঙ্গার আওয়াজ এগুলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে চলেছি, এমন সময় দেখি দূর থেকে দাদা আর
বৌদি আসছে। দুজনেরই অবস্থা খুব কাহিল। দাদাকে বৌদি ধরে ধরে নিয়ে আসছে। আমি কাছে
যেতে বুঝলাম দাদার পায়ের গোড়ালিতে চোট লেগেছে।জুতো খোলা হলো। মোজা খোলা হলো। আঙুল
নাড়তে বললাম। ঠিক ঠাক নড়ল আঙুল। তার পর হাত দিয়ে ব্যাথার জায়গা দেখে মনে হলো হাড়ে
লাগেনি তেমন। কিন্তু পেশীতে মোক্ষম টান লেগে চোট ভালোই। আমি ভোলিনি স্প্রে করে
ক্রেপ ব্যান্ডেজ দিয়ে ভাল করে পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিলাম। দেখলাম উচ্চতাজনিত কারনেও
দুজনেই খুব কাহিল হয়ে পড়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। আজ সকালে যাত্রা শুরুর সময় জওন ভাই
সকলকে এক প্যাকেট করে ফ্রুট জ্যুস দিয়েছিলো। ওদের দুটো প্যাকেট খাওয়া হয়নি দেখে
বললাম খেয়ে নিতে। জল কম খাওয়া হয়ে যায় এই ঠান্ডায় আর উচ্চতায়। তখন রক্ত ঘন হতে
থাকে আর অক্সিজেন বহনক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। দেখলাম কানহাইয়ালাল আর জগাই মাধাইও এসে
উপস্থিত। জগাই এখন ফিট। বেচারি জল কম খেয়েই একটু বিপত্তি বাঁধিয়ে ফেলেছিলো। সবাই
পৌঁছে গেছে দেখে বিপিন হাজির হলো গরম গরম স্যুপ নিয়ে। এই কনকনে ঠান্ডায়, ক্লান্ত
শরীরে এই গরম পানীয় একদম চাঙ্গা করে দিলো আমাকে। বোধহয় সকলকেই। দুপুরে আমরা খেয়েছি
অল্পই। দু কাপ করে স্যুপ খেয়ে সকলে বাইরে এসে সামনের ছোট রিজটার ওপর দাঁড়িয়ে হিমবাহ
দেখতে লাগলাম।
বেশীক্ষন দাঁড়ানো গেলনা।
সামনে মেঘের আনাগোনা দেখে বোঝা যাচ্ছিল বরফ পড়ছে। আর সেই কনকনে হাওয়া আমাদের
জামাকাপড় ভেদ করে হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিলো। যদিও আমার স্নো জ্যাকেট বের করে
পরে নিয়েছি, তবুও হাওয়াটা মাঝে মাঝে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছিলো। আর মেঘ করে থাকার জন্যে
দিনের আলোও কমে আসছিলো। সব মিলিয়ে পরিবেশের মধ্যে কোথাও যেন একতা গম্ভীর আর
বিষাদের সুর মিশে ছিলো। হয়ত এই অপার্থিব পরিবেশে আমাদের মন নিজেকে মানিয়ে নিতে সময়
নিচ্ছিলো। এই সব ভাবতে ভাবতে হিমবাহের দিকে তাকিয়েছিলাম। সম্বিত ফিরলো বিপিনের হাঁকে।
“চায়ে”। আমরা হুড়মুড় করে গিয়ে ঢুকলাম তাঁবুর মধ্যে। ঢুকেই অবাক। আজ চায়ের সঙ্গে
টায়ের পরিমান কিঞ্চিত বেশী। আলুভাজা আর পেঁয়াজি। বড় ভাল লাগল। কারন কিছুক্ষন
বিশ্রামের পর শরীর চাইছিলো কিছু খাবার। আর ধোঁয়া ওঠা চায়ের সঙ্গে গরম গরম আলুভাজা
আর পেঁয়াজির চেয়ে সুখাদ্য কিই বা হতে পারে? কিছুক্ষন পর আমি সকলের অক্সিজেন মাপলাম
রক্তে। আজ অবস্থা আরো খারাপ। সর্বনিম্ন নামতে নামতে ৭৪% পৌঁছে গেছে। আমার ৯১%।
এটাই সবচেয়ে বেশী। কানহাইয়ালাল বলল আমি নাকি লুকিয়ে লোহা খাই। নইলে এত হিমোগ্লোবিন
হতেই পারেনা। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে এক সহকর্মীর দাদার জন্যে টাটা
মেডিকযাল সেন্টার ফর রিসার্চে গিয়েছিলাম রক্তদান করতে। সেখানে আমার রক্তে
হিমোগ্লোবিনের পরিমান ১৬% দেখে ডাক্তার মেয়েটি বেশ অবাক হয়ে দেখেছিলো আমাকে।
জানিনা কেন এত থাকে আমার। তবে এরকমই থাকে আর কি। বাগিনী হিমবাহ দেখতে এসেছিলাম,
সেখানে আমরা সকলে পৌঁছতে পেরেছি, এবং সুস্থ শরীরে আছি, এইটাই অনেক বড় কিছু পাওয়া।
মনে একটা তৃপ্তির ভাব, আবার অল্প মন খারাপও বটে, কেননা কাল থেকেই আমাদের ফেরার
রাস্তা ধরতে হবে। আপাতত আমাদের যে ক্যাম্প সাইট, এটাই হলো বাগিনী বেস ক্যাম্প। আরো
এগিয়ে একটা জায়গা আছে ক্যাম্প করার মত, কিন্তু এখানে জলের উৎস আছে বলে, এখানেই
ক্যাম্প করা হয়েছে।
বাগিনী
বেস ক্যাম্প
আগামীকালে পরিকল্পনা নিয়ে জওন ভাই আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেল। প্রায় রাত থাকতেই আমাদের বেরোতে হবে। মালপত্র সবই রেখে যাওয়া হবে। স্রেফ একটা জলের বোতল আর ক্যামেরা নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে চার কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে সব কটা শৃঙ্গ একদম ১৮০ ডিগ্রিতে দেখা যায়, আর সেই ভিউ পয়েন্টের নিচে আছে ছোট্ট একটা তেকোনা পুকুর, যার নাম ঋষিকুন্ড। ওই পর্যন্ত গিয়ে আমরা আবার ফিরে আসবো। এসে মালপত্র নিয়ে নিচে নেমে যাবো যতটা পারি। কোথাও একটা ক্যাম্প করে রাত কাটানো হবে। সেটা ঠিক হবে, আমরা কেমন ভাবে কতটা চলতে পারি তার ওপর। আমরা যদিও মোটের ওপর সুস্থ আছি সকলেই, কিন্তু কয়েকজন অল্পবিস্তর আহত, হেমন আমার হাত। সেগুলোকে সকলে মিলে একবার দেখে নেওয়া হলো। নিজেরাই নিজেদের উৎসাহ দিলাম। রাত যত গড়াচ্ছে, ঠান্ডা তত বাড়ছে। ডাল ভাত আর স্যালাড খেয়ে নেওয়া হলো তাড়াতাড়ি, তার পর আমরা ঝটপট স্লিপিং ব্যাগে সেঁধোলাম। একে কম অক্সিজেন, তার ওপর সারা দিনের ক্লান্তি, সব মিলিয়ে ঘুম আসতে চাইছিলোনা। শুতে যাবার আগে আমি বার বার করে সকলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মাথা যন্ত্রনা বা বমি পাওয়া এরকম কোনো উপসর্গ কারোর দেখা দিয়েছে কিনা। তখনো পর্যন্ত কারোর সেরকম কিছু দেখা যায়নি, অতএব AMS থেকে বাঁচোয়া। নয়ত ওই সমস্যার একমাত্র সমাধান, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিচে নেমে যাওয়া। কিন্তু কম অক্সিজেনের প্রভাব তো একটা আছেই। আমরা যে সময় বাগিনী গিয়ে পৌঁছেছিলাম, সেই সময় কৃষ্ণপক্ষ, একদিন আগেই অমাবস্যা গেছে, তার ওপর আকাশে ঘন মেঘ। কাজেই আলো ছাড়া নিজের হাত পা দেখা যাচ্ছিলোনা। সেই রাতে অনেক কিছুই ঘটল। যেমন আমাদের তাঁবু গুলোর বাইরে কোনোকিছুর চলার শব্দ শুনে আমাদের কেউ জেগে উঠে “কে কে ... “ বলে হাঁক পাড়লো, আবার অন্য কেউ দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝ রাতে অমানুষিক আর্তনাদ করে উঠলো। আর ভোরবেলা আমরা ঘুম থেকে উঠে আবিস্কার করেছিলাম আমাদের শোবার জন্যে ধার্য্য একটা তাঁবু একেবারে খালিই ছিলো। সকলেই এদিক ওদিক অন্য তাঁবুতে বা বড় তাঁবুতেই শুয়ে পড়েছিলো। মোটমাট সব মিলিয়ে বেশ ঘটনাবহুল রাত।
চলতে চলতে অবশেষে,
নন্দাদেবীর আপন দেশে
অন্ধকার থাকতেই উঠে পড়েছি।
ওপাশে বিপিনের স্টোভের হিস হিস শব্দ আসছে। বিপিন বোধহয় চা করছে। তাঁবুর পর্দা
সরিয়ে দেখি বিপিন চা চড়িয়েছে, আর জওন ভাই গুটিশুটি মেরে পাশে বসে আগুনে হাত গরম
করছে। জিজ্ঞেস করলাম ঠান্ডা কিরকম হবে? জওন ভাই বলল মাইনাস দশের কমই হবে। বিপিন বাজখাঁই
গলায় কইলো “পন্ধরা ভি হো সাকতা হ্যায়”। ছেলেটা যে স্যুপ, চায়ে, বিরেকফাস্ট,
লাঞ্চের বাইরেও কথা বলে, এই প্রথম শুনলাম। পরে ফেরার রাস্তায় বিপিন অনেক গল্প
করেছিলো। ও ইন্ডিয়াহাইকস বা ট্রেক দ্য হিমালয়া এসব কোম্পানির সঙ্গেও কাজ করেছে,
তাদের সঙ্গে হিমাচলে হামতা পাশেও গেছে রাঁধুনি আর গাইডের সহকারি হিসেবে। অনেক অভিজ্ঞতা
ওর। এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারততীয় সেনাবাহিনীতে যাবে বলে। আমার ধারনা বিপিন
নির্ঘাত সেনায় ভর্তি হবেই হবে। আর এরকম একটা শক্তপোক্ত পোড়খাওয়া ছেলে যে কোনো কাজে
ঢুকলেই তা প্রতিষ্ঠানের লাভ।
সত্যিই এই ভোরবেলাটা বড্ড
ঠান্ডা লাগছে। একটা জ্যাকেটের ওপরে আর একটা মোটা প্যাড ওয়ালা স্নো জ্যাকেট চাপিয়েও
রেহাই মিলছেনা। তলায় বোধ হয় তিন চারটে স্তরে টি শার্ট আছে। প্যান্টের তলায়ও একপ্রস্থ বস্তু আছে। কিন্তু সব কিছুর
পরেও একটা হি হি করা কাঁপুনি কিছুতেই যেতে চায় না। এদিকে এই উচ্চতায় দুমদাম ছুটোছুটি
বা ব্যায়াম করাটাও বিপজ্জনক অক্সিজেন কম বলে। দেখলাম একটা ইঞ্চি ছয়েক চওড়া নালীর জল
পুরো জমে আছে। কিন্তু বরফটা প্রায় স্বচ্ছ। লাঠি দিয়ে ঠুকে দেখলাম, বেশ শক্ত। বিপিন চা খাওয়ালো। সেই সঙ্গে আমাদের হাতে অল্প কিছু খাবারও ধরিয়ে দিলো।
দেখলাম একটা জ্যুসের প্যাকেট আর একটা সেদ্ধ ডিম। ফিরে এসে আমরা খাবো এরকমই ঠিক
হলো। পিঠে ব্যাগ ছাড়া হাঁটছি, তাই আজকে হাঁটাটা একটু হলেও সহজ লাগছিলো। আবার যে
ভারসাম্যে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম, সেটা বদল হওয়াতে একটু সাবধানও হতে হচ্ছে। রাস্তা
কিছু নেই। স্রেফ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আস্তে আস্তে ওপরে ওঠা আর সামনে এগিয়ে চলা। তবে
পথের জন্যে নয়, একটু হেঁটেই হাঁফ ধরছিলো পাতলা বাতাসের জন্যে। মাথাটাও হালকা
লাগছিলো। তবে গতকাল বিকেলের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থা এমন। শরীর উচ্চতা সইয়ে নিয়েছে
অনেকটাই।রাস্তার মাঝে মাঝে একটা করে সরু সোতা। কিছু কিছু তখনো জমে আছে, কয়েকটা
দিয়ে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে। আরাম সে টপকে যাওয়া যাচ্ছে, কেননা কোনোটাই বেশী চওড়া
নয়।
বিপিনের
দেওয়া সেদ্ধ ডিমটা পকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে মুঠো করে ধরে আছি। বেশ গরম গরম লাগছে।
কিন্তু তা ছাড়া কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে অনেক স্তরের জামা কাপড় ভেদ
করে। তবে মিনিট কুড়ি চলার পরেই গা কিছুটা গরম হলো খাড়াই ভাঙতে ভাঙতে। মাঝে মাঝে থেমে
একটু দম নিচ্ছি, আবার চলছি। এই উচ্চতায় কোন গাছ পালা বাঁচা সম্ভব নয়, তাই নেইও। কিন্তু
দেখলাম, নেহাত জুন মাস বলেই হয়ত, এখানে ওখানে পাথরের ফাঁকে খুব লাজুক লাজুক ভঙ্গীমায়
অন্য ধরনের কিছু ঘাসের মত দেখতে গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ উঁকি মারছে। এবং ভারি সুন্দর
একরকম হালকা বেগুনী আর উজ্জ্বল হলুদ ফুল ধরেছে তাতে।
ঋষিকুন্ডের
রাস্তায় পেছনে ফিরে একঝলক দেখা পেরিয়ে আসা পথ
|
জওন ভাই আসছিলো আমার সঙ্গেই। বাকিরা কিছুটা পেছনে। জওন ভাই আমাকে হাত উঁচিয়ে বাঁ
দিকের পাহাড়ের গায়ে কিছু একটা দেখালো। আমি দাঁড়িয়ে পড়ে ভাল করে দেখলাম, কিন্তু কিছু
দেখতে পেলাম না। জওন ভাই এবার ফিস ফিস করে বলল – “উও দেখিয়ে দাদা ভারাল্”। ভারাল
অর্থাৎ পাহাড়ি বুনো ছাগল। গৃহপালিত ছাগলের চেয়ে অনেকটাই আলাদা দেখতে। কিন্তু
এবারেও আমি কিছুই দেখতে পেলাম না, খালি পাহাড়ের গায়ে আটকে ঝুলে থাকা অসংখ্য পাথর ছাড়া।
এবার আমি জিজ্ঞেস করে ফেললাম “কাঁহা?” ওমা দেখি পাহাড়ের গায়ে আটকে থাকা একটা পাথর
মুন্ডু তুলে আমার দিকে তাকিয়ে। আমার গলা পেয়েই সতর্ক হয়ে গেছে। এবার ভাল করে দেখলাম,
ধুসর লোমে ঢাকা দেহ, আর সে লোম চকচকে নয়, যার ফলে অবিকল পাথরের টুকরোর মত দেখতে
লাগছে ওদের। একবার বুঝতে পেরে এক এক করে পুরো এক পাল ভারাল আবিস্কার করলাম পাহাড়ের
গায়ে। সাধারন ছাগলের তুলনায় শিং অনেক বড়, আর দেহের পেছনের দিকের আকারের সঙ্গে
হরিনের কিছুটা মিল আছে, এই টুকু দেখলাম। ক্যামেরা বের করে ভাবলাম ছবি তুলি, কিন্তু
ক্যামেরায় লাগানো একখানি ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স, যার দুরের ছবি তোলার ক্ষমতা খুবই
সামান্য।তবুও একটা ছবি তুলতে চেষ্টা করলাম। পরে সে ছবি নিয়ে অনেক লড়াই করেও কোনো
মতেই কিছু বোঝা যায়নি। এমনিই কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে দেখলাম। একটু বিশ্রাম নেওয়াও হলো।
তার পরে আবার পা বাড়ালাম।
আজ আমাদের শেষ গন্তব্য বাগিনীর ধারে একটা ছোট্ট রিজের ওপরে একটা স্থান। সেখান থেকে
চারিদিকের অনেক গুলো শৃঙ্গ দেখা যায়। আর ঠিক সেই রিজের নিচেই রয়েছে একটা ছোট্ট
তেকোনা পান্না সবুজ জলের হ্রদ। তার নাম ঋষিকুন্ড। এই জায়গায় পৌঁছে আমরা আবার ফেরত
আসবো। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা এগিয়ে দেখি, এক জায়গায় পাথর সাজিয়ে একটা ফুট দুয়েক
উঁচু জায়গা চৌকো করে ঘিরে ফেলা। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বড়জোর, দশ ফুট করে হবে। ভেতরে
আগুন জ্বালার চিহ্ন, পোড়া ছাই, এবং একখানা হালকা দামী পাম্প দেওয়া বিদেশী স্টোভ
তোবড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে। আরো কাছে গিয়ে দেখি কয়েকটা ছেঁড়া খোঁড়া কাপড়ের টুকরো, কয়েকটা
খালি খাবারের কৌটো, জ্যামের শিশি, আর কয়েক খানা প্লাস্টিকের প্যাকেট, তার মধ্যে সিংহ
ভাগই খুব চেনা ম্যাগির হলদে রঙের প্যাকেট, বাকি একটির গায়ে তখনো স্পষ্ট বাংলা অক্ষরে
লেখা “বাপী চানাচুর”। মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার দেশোয়ালি ভায়েদের এই বাঁদরাম দেখে। খোদার
খামোখা পাহাড় নোংরা করে গেছে। পেছন ফিরে
দেখলাম, দলের বাকিদের দেখতে পাচ্ছি না। জওন ভাই বলল একটু দাঁড়িয়ে যান। পেছন থেকে
ওরা আসুক, তার পর একসঙ্গে এগোবো। তাই হলো। একটু পরেও বাকিরা এসে গেলো, আর আমরা
আবার পা বাড়ালাম। ডান পাশে বাগিনী হিমবাহের ভেতর থেকে পাথর আর বরফ ফাটার আওয়াজ আসছে
মাঝে মধ্যে। আর আমরা এগিয়ে চলেছি জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে। এ ছাড়া আর কোন শব্দ
নেই। আজকে আমাদের সঙ্গে কোনো মালপত্র নেই বটে, কিন্তু অক্সিজেনের অভাবটা রীতিমত মালুম
হচ্ছে। দশ পা হাঁটার পরেই হাঁপ ধরে যাচ্ছে। ক্যামেরার ব্যাগটা যম ভারি মনে হচ্ছে। যতই
চলছি ততই দেখি সামনের জমি আরো ওপরে উঠে গেছে। ক্রমাগত ওপরে উঠতে উঠতে একটা সময় দেখলাম
ছোটোবড় পাথরের টুকরোর এক বোল্ডার রাজ্যে এসে পড়েছি। আর সামনের জমিটা প্রায় ৭০
ডিগ্রি খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে। জওন ভাই ওপরের ওই রিজটা দেখিয়ে বলল ওটাই ভিউ পয়েন্ট।
ওই অবধিই আমরা যাবো। এতক্ষন সামনে তাকিয়ে ভাল করে দেখিনি। এখন দেখলাম। আর দেখেই স্ট্যাচু
হয়ে গেলাম। এ কোথায় এলাম আমি? কোন দেশে?
ঋষিকুন্ড
ও পেছনে ত্রিশূল (ছবিটি কানহাইয়ালালের তোলা)
|
বেস ক্যাম্প থেকে দেখছিলাম ঠিক বাংলার শিব মন্দিরের মত দেখতে হরদেওল শৃঙ্গ, আরো
ডান দিকে একে একে সাত-মিনাল, কলঙ্ক, চংবং আর দুনাগিরী। এবারে দেখলাম রিজের মাথা ছাড়িয়ে
আরো কারা যেন সব উঁকি ঝুঁকি মারছে বাঁ দিকে। পা বাড়ালাম কৌতুহলে। এই শেষ চড়াই ভাঙা।
কিন্তু বড়ই বেখাপ্পা জায়গা। যে পাথরেই পা দিই না কেন, সেই ব্যাটা ঢিলে পাথর হড়কে
গড়িয়ে যাচ্ছে, আর আমি পড়ো পড়ো হয়ে যাচ্ছি, ক্রমাগত ব্যালেন্স হারাচ্ছি। হাতের ছড়িটা
দিয়ে বযালেন্স বজায় রাখার অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেটাও যেখানে রাখছি, ওই একই
ভাবে হড়কাচ্ছে। মনে করুন একটা খোয়ার স্তুপ, আর আপনাকে উঠতে হবে সেটার ওপরে। প্রতিটি
খোয়ার আকার দশ বারো গুন বড়ো। এবারে কিছুটা আন্দাজ পেতে চলেছেন আপনি। ওঠাটা সত্যিই
কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো। কিছু পা যেতে যেতেই দেখছিলাম ক্যামেরার ব্যাগটা দুলছে, আর
আরো বেশী ব্যালেন্স হারাচ্ছি। এই করতে করতে, একটা জায়গায় গিয়ে আমার বাঁ পা পিছলে
গেল একটা পাথরের ওপরে, আর শরীরের সমস্ত ভার এসে পড়লো আমার কমজোরী ডান পায়ের ওপর,
আর একটা তীব্র যন্ত্রনা কোমর থেকে বুড়ো আঙুল পর্যন্ত ডান পায়ে ছড়িয়ে পড়ল। যখন পা
ভাঙে, তখন আমার দুখানা লিগামেন্টই ছিঁড়েছিল। আর সেই লিগামেন্ট এখনো কমজোরী। এই চাপ,
ঝটকা ও ওজন সামলাতে গিয়ে সেই লিগামেন্ট বেশ ভাল রকম চোট পেলো এটা বুঝলাম।
যন্ত্রনার চোটে মিনিট খানেক কথা বলতে পারছিলাম না, নড়া বা হাঁটা দূরে থাক। তার
পর অতি কষ্টে আবার খুব ছোট ছোট পা ফেলে আস্তে আস্তে এগোতে চেষ্টা করলাম। এবারে পিছলে
গেল ডান পা। ইতি মধ্যে গোটা তিরিশেক পদক্ষেপ উঠতে পেরেছি। মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে বাঁ
হাত দিয়ে একটা পাথর ধরে সামলাতে চেষ্টা করলাম। যার ফলে পড়ার বেগটা কমে গেল, কিন্তু
চোট পাওয়া কবজি আবার জখম হলো, সেই সঙ্গে ডান পায়ের হাঁটু ঠুকলো একটা পাথরে। এবার
চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। আর ৭০-৭৫ মিটার গেলেই রিজের ওপরে উঠে পড়তে পারবো। জওন ভাই
আমাকে পড়ে যেতে দেখে, এসে আমার কাঁধ থেকে ক্যামেরার ভারি ব্যাগটা খুলে নিজের কাঁধে
নিলো। আমি একটু অপেক্ষা করে আবার চলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পা ভাঁজ করে পাথরে রেখে
চাপ দিয়ে নিজেকে তুলতে পারছিনা। এক তো যন্ত্রনা হচ্ছে। তার ওপরে আবার জোর পাচ্ছিনা।
শেষে বাঁ পা, আর ডান হাতে ধরা লাঠিতে চাপ দিয়ে ওপরে চড়ার চেষ্টা করলাম। কয়েক পা
গিয়ে হুড়মুড় করে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। এবারে তেমন ভাবে নতুন কোথাও চোট লাগেনি, তবে
লাগা জায়গাতেই জোর ঝটকা লাগল। এখানে পাথরের ওপরে বসার উপায় ও নেই। বড়জোর আর ৭০-৮০
পা গেলেই আমি রিজের ওপর পৌঁছে যাবো। উঠে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করলাম চলার। কিন্তু কিছুতেই
পা ভাঁজ করে চাপ দিয়ে নিজের দেহকে তুলতে পারছিলাম না। সোজা বাংলায় সিঁড়ি ভাঙার ক্ষমতা
আমি হারিয়ে বসেছিলাম। কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন পারলাম না, তখন চুপ চাপ দাঁড়িয়ে দু
দন্ড ভাবলাম, আমার কি করা উচিত। এই অবস্থায়, চোট সমেত ঝুঁকি নিয়ে শেষ টুকু ওঠার চেষ্টা
করা? না কি এখান থেকেই ফেরার পথ ধরা আস্তে আস্তে। এর ওপর চোট পেলে, আমি কোন অবস্থাতেই
আর হেঁটে নিচে নামতে পারবোনা। আমাকে ফেলে রেখে বাকি দল নিচে যাবে, আর সেখান থেকে
সাহায্য নিয়ে আসবে।
মিনিট খানেক পর, আমি অত্যন্ত সাবধানে কিছুটা বসে বসে, ঘষটে ঘষটে নিচে নামা
শুরু করলাম। তবে ঠিক যে রাস্তায় এসেছি, সেখান দিয়ে নয়। বরং রিজটা যেখানে ঢালু হয়ে
হিমবাহের দিকে নেমে গেছে, সেই দিকে। কারন, ওই রিজের ধারটায় গেলে আমি ওপাশের শৃঙ্গগুলোকে
দেখতে পাবো। দাঁতে দাঁত চেপে, যন্ত্রনা সয়ে, ওই ভাবে ঘষটে ঘষটে এসে রিজের ধারটায় পৌঁছতে
পারলাম কিছুক্ষনের চেষ্টায়। একটা চ্যাপ্টা পাথরের ওপর কোন রকমে বসে দৃষ্টি রাখলাম
সামনের দিকে। অনেক লেখায় পড়েছি, এই জায়গাটাকে বলে দেবতাদের সিংহাসন। দেখলাম
একেবারে বাঁ দিক থেকে পর পর দেখতে পাচ্ছি ত্রিশুল, হরদেওল, ঋষি, সাত-মিনাল, কলংক,
চংবং, দুনাগীরি এবং সবার মাঝে রানীর মত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নন্দাদেবী। এর আগে দূর
থেকে দেখেছি এদের। ছবিতে অসংখ্যবার দেখেছি। কিন্তু চোখের সামনে এত কাছ থেকে দেখে
এত পরিচিত শৃঙ্গমালা যে এই রকম শিহরন তুলতে পারে দেহে-মনে, এটা কখনো কল্পনা করিনি।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম, কি অদ্ভুত এক জগতে এসে পড়েছি আমরা। কোথাও মানুষের
এতটুকু চিহ্ণ নেই। মনে হচ্ছে এ যেন পৃথিবীর কোনো জায়গাই নয়। রিজের এই নিচু ধারটা
একটু ঘুরে ঢুকে এসেছে বলে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা অংশটা আমার দৃষ্টি থেকে ঋষিকুন্ডকে
আড়াল করে রইল। উঁকিঝুঁকি মেরে একটা কানা দেখলাম। তাতে অবশ্য আমার আফশোষ নেই কিছু।
এখানে বসে বসেই শুনতে পাচ্ছিলাম রিজের ওপর থেকে টুকরো টুকরো উচ্ছাস ভেসে আসছে।
অভিযানের মোক্ষে পৌঁছে আনন্দ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মন অল্প হলেও বিষন্ন
হতে শুরু করেছিলো। কারন এতদিন সামনে এগোচ্ছিলাম, এবার পেছনে ফেরার পালা। আরো কিছুক্ষন
বসে বসে দেখলাম দেবতাদের সিংহাসন, সেই অবিশাস্য সুন্দর এক জগৎ। ঐ ত্রিশুলের পেছন
দিকে আছে মিলাম গ্লেসিয়ার। অনেক দিনের শখ একবার মিলাম গ্লেসিয়ার দেখবো নিজের চোখে।
কুমায়ুনের দিক থেকে আসতে হয় ওখানে। বাগেশ্বর হয়ে। মোট ১২০ কিলোমিটার মত হাঁটা।
রাস্তাও দুর্গম। কিন্ত সেটাই তো আকর্ষণ। যে হিমালয়ের এই রূপ দেখেনি, তাকে আমার পক্ষে
শুধু ভাষা দিয়ে বোঝানো অসম্ভব, সে কিসের আকর্ষণে এত কষ্ট, এত বিপদ সয়েও লোকে এই উচ্চতায়
আসে। সে চেষ্টাও করছিনা। হয়ত আসা হবে কোনো দিন আবার ঐ মিলাম গ্লেসিয়ারে। আসা হবে
রূপিন পাসে, আসা হবে তপোবন নন্দনবনে, আসা হবে সতোপন্ত স্বর্গারোহিণী হিমবাহের পথে।
আমি কেবল আশাটুকু করতে পারি। আর আবার আসতে গেলে ফিরতে হবেই সেই ক্লেদাক্ত জগতে,
সেই হিংসে দ্বেষ লোভ আর আদিম কংক্রিটের জঙ্গলে, শুধু পরের অভিযানের পাথেয়টুকু সংগ্রহ
করে আনতে। পায়ের অবস্থা ভাল ঠেকছিলো না। লক্ষ্য করলাম, ডান হাঁটু ভাঁজ করতে পারছিনা।
সোজা করে পা ফেললে তবু যন্ত্রনাটা সহ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু সামান্য ভাঁজ হয়ে গেলেই
যন্ত্রনায় চোখে সর্ষেফুল দেখছি। এখন এই খোঁড়া ঠ্যাং নিয়ে কয়েক হাজার ফুট নামি কি
করে?
খুব অল্প অল্প করে ছড়িতে ভর দিয়ে কিছুটা নেমে পেছনে আসতে লাগলাম। শ দেড়েক মিটার
এসে ঢালু জমিতে বসলাম। ব্যাথার চোটে হাঁপাচ্ছি তখন। একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসলাম।
হাঁটুটা ধিরে ধিরে মুড়তে চেষ্টা করলাম। মিনিট দশেক পর দেখলাম রিজের ওপর থেকে
বাকিরা নামছে। আরো মিনিট দশেক পর সবাই এসে আমার চারিদিকে ঘিরে বসল দম নিতে। তেমন
ভাবে দেখতে গেলে, এই লম্বা ভ্রমনকাহিনীটা ঠিক এইখানে এসে শেষ করলে ভারি লাগত আমার।
পাঠকদেরও নিস্কৃতি মিলত। কিন্তু এর পরেও কয়েকটা ঘটনা এমন রয়েছে, যে সেগুলোকে যদি
এই লেখার মধ্যে না বলি, তাহলে আর কখনো হয়ত বলাই হবেনা। তাই “যব তক প্যায়ের চলেগি,
কলম ভি চলেগি” ধরেই এগোচ্ছি।
ফেরার
আগে একটু বিশ্রাম
|
চারিদিকে কাঁচা সোনার মত রোদ। একটা সফল অভিযানের তৃপ্তি সকলের ভেতর। কিন্তু ...
কিন্তু কি? কিন্তু “কেবল পেটে বড় ভুখ, না খেলে নাই কোন সুখ”। মন্ডা মিঠাই আর চাইবো
কার কাছে? আমাদের পকেটে ছিলো সেদ্ধ ডিম, আর অন্য পকেটে জ্যুসের প্যাকেট। সেই গুলোই
খাওয়া গেল। এবার নামার পালা। সবার আগে হাঁটা শুরু করলাম আমি। কেননা জখম পা নিয়ে
আমারই নামতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগার কথা। কিন্তু উৎরাইতে চলার সময় দেখলাম অদ্ভুত
ভাবে ততটা অসুবিধে হচ্ছেনা। একটু কায়দা করে পা ফেললে দিব্যি হাঁটা যাচ্ছে। জানিনা
কতক্ষন এই ভাবে চলতে পারবো। তাই পেছন ফিরে দেখছিলাম না। লেংচে লেংচে সমানে নিচে
নামছিলাম ঢালু জমি বেয়ে। একটা বড় ঝরনা টপকাতে গিয়ে মনে হলো যদি টাল খাই, একটু দাঁড়িয়ে
জওন ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করি। জওন ভাই কাছাকাছি আসতে তার পর আমি ঝরনাটা পেরোলাম। এইখানে
এসে জওন ভাইকে আমার ক্যামেরাটা দিয়ে বললাম আমার একটা ছবি তুলে দিতে। সেই ছবিই
দেওয়া আছে এই লেখার শুরু তে। পাঠক আমার দাঁত খিঁচুনি সমেত মুখচ্ছবি দেখলেই বুঝবেন
ল্যাংড়া ঠ্যাং আমাকে কেমন বেগ দিচ্ছিলো।
ক্যামেরা ফেরত নিয়ে দেখছি কেমন ছবি উঠলো, এমন সময় হঠাৎ দেখি, মুখে অদ্ভুত একটা
“হুই হুই” আওয়াজ করতে করতে জওন ভাই পাহাড়ের দিকে চলে গেল। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখি
সেখানে দু খানা ঘোড়া। ও বাবা, এদুটো তো আমাদেরই মালবাহক। এরা এখানে চলে এলো কি করে?
জওন ভাই ঘোড়া গুলোকে তাড়া দিতে দিতে নিয়ে চলল। যা বুঝলাম, ভর বেলা এনারা কচি ঘাসের
খোঁজে এদিকে উঠে এসেছেন। ফেরার সময় অনেক তাড়াতাড়ি রাস্তা পেরোচ্ছিলাম। তার মূল
কারন বোধহয়, একবারও বিশ্রামের জন্যে থামিনি। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমরা বেস ক্যাম্পে
পৌঁছে গেলাম। আমাদের অন্য তাঁবু গুলো সব খুলে ফেলা হয়েছে। শুধু বড় তাঁবুটা রয়েছে।
সেটার ভেতরেই সেঁধোলাম। একটু দম নিতেই বিপিন হাজির হলো “লাঞ্চ” নিয়ে। ডাল ভাত পাঁপড়
আর আচার খেয়ে আবার ব্যাগ পিঠে নিলাম। বাঁ হাতের কবজিতে সকালে আর একবার চোট লেগেছে।
সাবধানে থাকতে হবে। এদিকে আকাশের অবস্থা ভালো নয়। ঘন্টাখানেক ধরেই মুখ গম্ভীর হতে
শুরু করেছে তার, এখন দেখলাম বেশ কালচে কালচে মেঘেদের দেখা যাচ্ছে। কবিটবি হলে নাহয়
মেঘ দেখে একটা বেশ রোম্যান্টিক ভাবনা আসত। কিন্তু খোঁড়া ঠ্যাং নিয়ে এই খাড়াই
পাহাড়ের ঢিলে পাথরওলা গা বেয়ে নামার সময় যদি আবার বৃষ্টি এসে উপস্থিত হয়, তাহলে যে
কি হবে কে জানে বাপু! কাজেই বেশী এদিক ওদিক না তাকিয়ে, মন দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
আবার পেরোলাম সেই বোল্ডার ভরা রাস্তা, আবার পেরোলাম সেই জায়গাটা যেখানে জগাই পড়ে
গিয়েছিলো। অনেক নিচে দেখতে পেলাম লঙ্গাতুলির সবুজ জমি ঝলমল করছে।
এবার শুরু হবে সেই প্রানান্তকর উৎরাই। ওপরে ওঠার সময় অতটা ভাল করে দেখিনি,
কিন্তু এখন দেখে বুঝলাম, কি প্রচন্ড খাড়া পাহাড় বেয়ে আমরা উঠে এসেছি। এবার নামার
পালা। এখানে বলে রাখি পাঠক, পাহাড়ে ওঠার মতই, পাহাড় থেকে নামাও অত্যন্ত কঠিন কাজ।
এমনকি কিছু ক্ষেত্রে, ওঠার চেয়েও কঠিন। হাতের ছড়িতে অনেকখানি ভর রেখে খুব আস্তে
আস্তে নামা শুরু করলাম। এ পাথর ও পাথরে পা রেখে নামছি, কারন নুড়ি পাথর আর ঢিলে বালি
বালি মাটিতে পা ফেললেই পা পিছলে যাবে, আর আমি ভর রাখতে পারবো না। বাকিরা টুক টুক
করে নেমে গেল আমার আগে। আমি অনেক সময় নিয়ে একটু একটু করে এগোচ্ছি। সামনে অনেক নিচে
লঙ্গাতুলি দেখা যাচ্ছে। আমার ধারনা আজ আমরা লঙ্গাতুলি পেরিয়ে আরো একটু গিয়ে হয়ত
আমাদের ক্যাম্প হবে। খাড়াই জায়গাটার নিচে যখন পৌঁছলাম ততক্ষনে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের
দিকে চলে গেছে সময়। আরো আশংকার কথা, আকাশের মুখ বেশ ভার। সামনে দেখি জওন ভাই আর
কানহাইয়ালাল দাঁড়িয়ে। বিপিনকেও দেখতে পেলাম। একটা বড় ঝরনা আছে, সেটা কায়দা করে পার
হতে হবে। আমার জন্যেই ওরা দাঁড়িয়ে আছে, যদি এই পা নিয়ে আমি পার হতে না পারি এই
ভেবে।
আমি অবশ্য ঠিক অনায়াসে না হলেও মোটামুটি ঠিকঠাক ভাবেই ঝরনাটা পেরিয়ে গেলাম। বাকিরা
হাঁটা শুরু করলো। আমিও পিছু নিলাম। এদিকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একবার
ভাবলাম থেমে গিয়ে ব্যাগ খুলে বর্ষাতি বের করি। কিন্তু তার পর মনে হলো, এই টিপটিপে
বৃষ্টিতে আর একটু হাঁটা যাক। জোরে এলে দেখা যাবে। যদিও সামনে সোজা রাস্তা, কিন্তু মাঝে
মাঝেই বড় বড় দোতলা তিনতলা সমান উঁচু পাথর আর উঁচু নিচু জমির জন্যে একটু পরেই বাকিদের
আর কাউকে দেখতে পেলাম না। যেহেতু এখানে রাস্তা বলে কিছু নেই, তাই মোটামুটি দিক ঠিক
করে নিয়ে, সেই দিকে হাঁটাই দস্তুর। গাইড অবশ্য কিছু চিহ্ণ ধরে চলেন, আর বাকিরা
অনুসরন করে গাইডকে। কিন্তু এখানে আমার চোখের সামনে না দেখতে পাচ্ছি জওন ভাইকে, না
দেখছি দলের অন্যদের। মিনিট দশেক পর দেখলাম বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। আরো একটু হেঁটে
ব্যাগ নামিয়ে বর্ষাতি বের করতে গেলাম। আমার পিঠের ব্যাগেরও একটা বৃষ্টি নিরোধক ঢাকনা
আছে বটে। কিন্তু সেই মুহুর্তে না পেলাম আমার, না পেলাম ব্যাগের বর্ষাতি খুঁজে। শেষে
ভাবলাম নির্ঘাত সেগুলো বৌদির ব্যাগে ঢুকে ঘোড়ার পিঠে চলে গেছে। নিজেকেই নিজে
গালমন্দ করতে করতে হিমঠান্ডা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে চললাম। আধ ঘন্টা পর লঙ্গাতুলি
পেরোলাম। সেই অনন্যসুন্দর জায়গা, যা চিরকাল আমার মনে থেকে যাবে। আরো এগিয়ে ঢালু
জমি পেরিয়ে মিনিট কুড়ি পর এসে গেলাম সেই জায়গাটায়, যেখানে দ্রোনাগিরী থেকে লঙ্গাতুলি
আসার সময় সেই ভয়ংকর রাস্তাটা শেষ হয়েছিল। এসে দেখি বিপিনরা তাঁবু খাটিয়ে ফেলেছে। হুড়মুড়
করে বড় তাঁবুর ভেতরে ঢুকলাম বৃষ্টি এড়াতে। যদিও বৃষ্টি ঝমঝম করে পড়েনি, তবুও বড়ই ঠান্ডা
জল। মজার কথা হলো, আমি তাঁবুর ভেতর ঢুকতেই বৃষ্টি গেল থেমে। এদিকে দেখলাম আমার আগে
কেবল এসে পৌঁছেছে কানহাইয়ালাল। একটু পরেই এলো দাদা বৌদি। আর আরো পরে জগাই মাধাইকে
নিয়ে জওন ভাই। বিপিন চায়ের কাপ ধরিয়ে দিলো সবার হাতে। দিনের আলো পড়ে আসছে। একটু
পরেই ঝুপুস করে অন্ধকার নেমে এলো। ভোর ৫ টা থেকে সন্ধ্যে ৬ টা পর্যন্ত হেঁটেছি
আমরা সবাই। সকলেই খুব ক্লান্ত। আমাদের অভিযানের একটা ঘটনাবহুল দিনের শেষ হলো বিপিনের
হাতের গরম গরম পরোটা দিয়ে।
ফেরার পথে , উল্টোরথে
শেষের দিনে সকালটা খুব ঝকঝকে লাগছিলো। আগের দিনের মেঘ সব গায়েব। আকাশ ঘন নীল। ভাল
ঘুম হওয়ায় দিব্যি তাজা লাগছে। হাঁটুটা অসাড় হয়ে আছে ফুলে গিয়ে। ভাঁজ করতে পারছিনা।
সাত সকালেই বিপিন তাক লাগিয়ে দিলো পুরি আর চানা পরিবেশন করে। ঠিক সাড়ে ছটায় আমি পা
বাড়ালাম দ্রোনাগিরী, রুইং হয়ে জুম্মার পথে। রাস্তা অনেকখানি। দুপুর তিনটের সময়
গাড়ি আসবে জুম্মাতে আমাদের নিতে। সন্ধ্যের মধ্যে আমরা যোশীমঠ পৌঁছে যাবো। ক্যাম্প ছেড়ে
বেরোবার মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই সেই ভয়ংকর জায়গাটায় এসে পড়লাম। একটা পায়ের পাতা কোন
মতে ফেলা যাচ্ছে, এমন সরু রাস্তা। কিন্তু আশ্চর্য্য ভাবে লক্ষ্য করলাম, এখন
রাস্তাটা আর অতখানি ভয়ংকর লাগছেনা। এমনকি এই ল্যাংচানো অবস্থাতেও আসার সময়ের চেয়ে
এখন অনেকটা বিনা আয়াসে যেতে পারছি। আধঘন্টার ভেতর দেখলাম আমি বাগিনীর ওপর সেতু পেরোচ্ছি।
আরো আধঘন্টা পর দ্রোনাগিরীর ভেতর দিয়ে নিচের দিকে চলেছি। এইখানে এসে টিপ টিপ করে
আবার একটু বৃষ্টি শুরু হলো। কিন্তু আমি থামার চেষ্টা করলাম না। বাঁধানো রাস্তাটা পার
হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই চড়াই ও তার আগের ধ্বসের জায়গাটা পেরিয়ে যাওয়া যায়, ততই
ভালো। বৃষ্টি জোরে এলে ওই ভয়ংকর নুড়ির রাস্তা আর ধ্বসের জায়গা যে কি রূপ নেবে কে
জানে!
জোড়া পোস্ট দু খানা পেরিয়ে নামতে শুরু করলাম। আশংকার সঙ্গে দেখলাম, এই অল্প বৃষ্টিতেই
এই জায়গায় অসংখ্য জলধারা দেখা দিয়েছে, আর তাদের স্রোতের বেগ বড় কম নয়। হাতের ছড়িতে
ভর দিয়ে নামতে নামতে হাত টাটিয়ে গেছে। একটু একটু করে নামতে নামতে দেখি একটা খাঁজ
যেখানে দু মিনিট দাঁড়ানো যায়। প্রায় দু ঘন্টার ওপর হাঁটছি, তাই এবার একটু থামলাম
বিশ্রামের জন্যে। মিনিট কয়েক পর দেখি আর একজন স্থানীয় মানুষ, আমারই মত ওপর থেকে
নিচে নামছেন। উনিও দাঁড়ালেন আমাকে দেখে। একটু খোশগল্প হলো। দেখলাম হাবভাব আর
চেহারা দেখেই বুঝে নেন আমিও হলুম গিয়ে “দাদা”, মানে বাঙালী অভিযাত্রী। এনাদের সঙ্গে
বাঙালী অভিযাত্রীদের যোগাযোগ বেশ ভালোই। ইনি চলেছেন রুইং। পেশায় পশুপালক। ছাগলের
জন্যে কিছু ওষুধপত্র আসার কথা যোশীমঠ থেকে সে গুলো নিয়ে দুপুরের ভেতরেই ফিরবেন। একথা
সেকথার পর জিজ্ঞেস করলেন আমি কবে বাড়ি পৌঁছবো। পরশু শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
ক্যায়সে? দিল্লি সে তো এক দিন লাগ যায়েগা কলকত্তা যানে কে লিয়ে, অওর যোশীমঠ সে পুরা
এক দিন দিল্লি তক। আমি আর ভাঙলুম না দিল্লি থেকে প্লেনে ফিরবো। কেমন লজ্জা করল। এর
আগে একজন কে কথাটা বলার পর দেখেছিলাম সহজ সরল আলাপে কেমন যেন বালি কিচকিচ করতে
শুরু করেছিলো। গাড়ি, এসি, প্লেন এই শব্দগুলো এখনো আমাদের দেশে একটা সামাজিক অবস্থান
নির্দেশ করে। এমনিতেই বাইরে থেকে গেছি, তার ওপর এই সব বলে আর দুরত্ব বাড়াতে চাইলাম
না।
আরো কিছুক্ষনের কসরতের পর ধ্বসের জায়গায় নেমে এলাম। অল্প অল্প করে পেরিয়েও
এলাম। এবার তুলনামুলকভাবে সহজ রাস্তা। হ্যাঁ রাস্তাই বটে। দ্বিতীয় দিনে যেখানে বসে
পরোটা আর আলুর তরকারি দিয়ে লাঞ্চ করেছিলাম, সেই ছাচা বলে জায়গাটা পেরোতে পেরোতে
হাতের ছড়িতে ভর দিয়ে এক মিনিট দাঁড়িয়ে দম নিচ্ছি, এমন সময় পেছন থেকে এক অনিন্দ্য
সুন্দর নারী মুর্তির আবির্ভাব ঘটল। প্রায় ইয়োরোপীয়দের মত গায়ের রঙ। গালে যেন
কাশ্মীরি আপেল ফিট করা, এত লালচে। চকচকে কাটাকাটা চোখ-মুখ-নাক। মাথার চুল কায়দা
করে বাঁধা। কপালে টিপ পরতে ভোলেননি। পরনে ভারি সুন্দর রঙিন সালওয়ার কামিজ। দেখেই
বোঝা যাচ্ছে নতুন। পিঠে এক খানা ব্যাগ। আমাকে দেখেই একখানি ভূবন ভোলানো হাসি উপহার
দিলেন ইনি। আমার টুটা ফুটা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলুম কোন ক্লাসে পড়ো খুকি? উত্তর এলো
ক্লাস সিক্স। ও বাবা, ইনি হাইস্কুলে পা রেখেছেন! জানিনা খুকি শুনে ইনি খচলেন কিনা।
মুখে এখনো হাসি বিদ্যমান। আমার কোঁচড়ের ব্যাগে কিছু লজেন্স ছিলো। হাত গলিয়ে এক মুঠো
বের করে দিলুম। ভারি খুশী হয়ে নিলো। তার পর কলকল করে গল্প করতে করতে চলল। বলল ওর
নাম দিয়া রাওয়াত। বললুম আমার ও একটি কন্যা আছে বাড়িতে। তার ও ডাক নাম দিয়া। সে ও
ক্লাস সিক্সেই পড়ে। বলল উসকো লায়ে কিঁউ নেহি? আপকে প্যায়ের মে চোট হ্যায় আংকল? মেরে
পাপা কা ভি প্যায়ের টুটা হুয়া হ্যায়। আভি ম্যায় রুইং যাউঙ্গি, অওর কুছ রিস্তেদার আ
রহে হ্যাঁয়, উনকো লেকে ফির শাম তক দ্রোনাগিরী ওয়াপস। কাল তো হামারা তিওহার হ্যায়।
আপ এক দিন রুক যাওনা আঙ্কল, কাল তিওহার দেখকে যানা। কলকল করে কথা বলছিলো দিয়া
রাওয়াত, আর আমার মনে পড়ে যাচ্ছিলো দু হাজার কিলোমিটার দূরে আর একটা কলবলে মুখের কথা।
আধ ঘন্টা পর আমি আবার একটু দাঁড়ালাম। দিয়া বলল ওকে এগোতে হবে, কেননা ওর মা আর ভাই
আগেই পৌঁছে গেছে। হাত নেড়ে বিদায় নিলো।
আমি মিনিট পাঁচেক বসে বিশ্রাম নিলাম। তার পরে আবার উঠে পড়লাম এবার আস্তে আস্তে
এগোচ্ছি। বেলা বেড়েছে অনেক। নিচেও নেমে এসেছি অনেকটা। এখন গায়ে আমার হালকা টি শার্ট।
আরো কিছুটা এগিয়ে পড়লাম বিশাল ছাগলের পালের মাঝে। গম্ভীর মুখে তারা দাড়ি নেড়ে কি সব
চিবোতে চিবোতে আমাকে চোখের কোনা দিয়ে মেপে এগিয়ে গেল দ্রোনাগিরীর দিকে। পালের শেষে
এক তাউজি। জিজ্ঞেস করলাম রুইং আর কদ্দুর তাউ? বললে রুইং বহোত দূর হ্যায়, দ্রোনাগিরী
পাশ মে হ্যায়। আপ আও মেরে সাথ দ্রোনাগিরী। সব্বোনাশ, কয় কি? আবার ওই চড়াই ভাঙ্গা?
রক্ষে করো বাবা। ছাগলের পাল কে বিদায় জানিয়ে আবার পা বাড়ালুম। টানা উৎরাইতে নামার
সময় হাঁটুর ওপর প্রচন্ড চাপ পড়ে। যদিও আমার জখম পা, তা সত্বেও দেখলাম আমার নিয়মিত হাঁটা
ও দৌড়ের অভ্যেস থাকার জন্যে আমার হাঁটু সেই চাপ সহ্য করে নিতে পারছে। যাঁরা আমার
এই দীর্ঘ ক্লান্তিকর লেখা পড়বার পরেও পাহাড়ে এই ধরনের অভিযানের ঝুঁকি নেবেন, তাঁরা
যেন সবার আগে নিজের শরীরকে ঠিক মত তৈরি করে তার পরে আসেন। এতে বিপদের আশঙ্কা যেমন
কমবে, তেমনই কমবে পথশ্রম, আর হিমালয়ের যে রূপ দেখতে আসা, তাকে আরো ভাল করে উপভোগ
করতে পারবেন আপনি। মাঝে মাঝে অল্প একটু চড়াই ভাঙতে হচ্ছিলোনা এমন নয়। আমরা যেখানে
বসে খেজুর খেয়েছিলাম, তার আগে বিশাল চড়াই ভাঙতে হলো। আসার দিন খেয়াল করিনি এতখানি
চড়াই ছিলো এখানে। কিন্তু শরীর এখন চড়াই ভাঙায় এতটাই অভ্যস্ত হয়ে আছে, যে হাঁপাতে
হাঁপাতে চড়লেও অস্বস্তি হচ্ছে না। এই জায়গায় এসে পেছন থেকে আমার নাগাল ধরে ফেলল
দাদা আর বৌদি।
একটু পরেই আমরা পেরোলাম সেই ঝরনা যেখান থেকে রুইং এ জল সরবরাহ হয়। দেখলাম
এদিকে সকালের দিকে বৃষ্টি হওয়াতে রাস্তা কাদা কাদা হয়ে আছে জায়গায় জায়গায়। আরো
মিনিট কুড়ি পঁচিশ পর রাস্তার ডান দিকে একটু নিচুতে দেখতে পেলাম রুইং এর প্রথম
বাড়ি। ঘড়িতে তখন সাড়ে বারোটার কাছাকাছি। ঝরনার একটু আগেই বিপিন আমাদের ঘোড়া আর মালপত্র
সমেত আমাদের পেরিয়ে গিয়েছিলো। এখানে এসে দেখলাম ঘোড়া দুটো জল খাচ্ছে। আমরা যে
বাড়িতে মালপত্র রেখে গিয়েছিলাম সেখানে পৌঁছে দেখি বুড়ি দরজার পাশে বসে আছে হাসি
হাসি মুখে। এই বুড়ি জওন সিং এর মা। আমায় দেখে হাসতে হাসতে বললেন – “সামান তো সব
চোরি হো গেয়া বেটা”। তাহলে তো আম্মা তোমার বাড়িতেই থাকতে হয়, আমার ফেরার টিকিট ছিলো
ওই সামানের মধ্যে। হাসাহাসি হলো খুব কিছুটা। বুড়ি একটু আগে জওন ভাইকে দেখে চা
বসিয়েছিলো আমাদের জন্যে। চা এলো। বিপিন রুটি আর আলুর তরকারি নিয়ে এলো। সে সকাল
বেলা লাঞ্চ প্যাক করে নিয়ে তবে বেরিয়েছে। আজ আমার কেন জানিনা বেশ খিদে পেয়েছিলো।
চেটে পুটে অনেক গুলো রুটি মেরে দিলাম ঝাল ঝাল আলুর তরকারি দিয়ে। সঙ্গে চা। অমৃতের
মত লাগল।
একটু পরেই কানহাইয়ালাল এসে হাজির জগাই মাধাইকে নিয়ে। তারাও খেলো। কোথা থেকে খবর
পেয়ে দিয়া রাওয়াত দু খানা পুঁচকে ভাই সমেত হাজির হলো। বৌদির ব্যাগে একটা বড়
লজেন্সের প্যাকেট ছিলো। বৌদি সেটা দিয়া কে দিয়ে বলল ভাগ করে নিতে রুইং এর বাকি
বাচ্চাদের সঙ্গে। লাফাতে লাফাতে সবাই চলে গেল। তার পর আমাদের চলার শেষ পর্যায়
আরম্ভ হলো। আধ ঘন্টা বিশ্রামের পর হাঁটছি বলে কিনা কে জানে, টের পেলাম পায়ের আঙুলের
ডগা গুলো ভয়ানক টাটিয়েছে। আর চার কিলোমিটার চলতেই হবে। কোনো উপায় নেই। দাদা বৌদি আর
আমি চলতে শুরু করলাম ঢিমে তালে। গুটি গুটি পায়ে চলতে চলতে একটা সময় দেখলাম খাড়াই খাদের
নিচে ধৌলিগঙ্গা আর তার ওপাশে কালো মসৃন ফিতের মত হাইওয়েটা ফিরে এসেছে। আমাদের
ক্লান্ত পায়ের ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলা নতুন করে প্রান পেলো। বেলা সোয়া দুটো নাগাদ, ধৌলিগঙ্গার
ধারে লোহার সেতুর প্রান্তে পৌঁছে ধুলো মাটি ভরা রাস্তার ওপরেই আমরা বসে পড়লাম। বিপিনরা
আগেই এসে মালপত্র নামিয়ে রেখেছে। ব্রিজের ওপাশে ধু ধু করছে হাইওয়ে। একটাও গাড়ি
চলেনা এই রাস্তায়, কেন জানিনা। আমাদের গাড়ি আসবে যোশীমঠ থেকে। তারই অপেক্ষা। ইতিমধ্যে
ছবি তোলা হলো সকলে মিলে। ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ ধরে আমি এই লেখার সঙ্গে নিজের ছাড়া
অন্য কারোর এমন ছবি দিইনি, যাতে তাদের চেনা যায়। ইয়া আমাদের সকলের ছবিটিও এখানে দিলাম
না। আধঘন্টা পর দাদা চিৎকার করে উঠলো – “ওই যে”।
কিঞ্চিত বামঘেঁষা বলে, ভারতবর্ষে প্রবল শক্তিধর পূঁজিবাদী টাটা কোম্পানিকে
চিরকাল খিস্তি খেউড় করে এসেছি। কিন্তু আজ সেই টাটা কোম্পানির ছাপ মারা একখানা সুমোকে
আমাদের দিকে আসতে দেখে এমন একটা চরম উল্লাস দেখা দিলো মনের ভেতরে, সেটা ভাষায় বোঝানো
অসম্ভব। প্রথমেই যেটা মনে এলো সেটা হলো, যাক বাবা, আর হাঁটতে হবে না। এ কদিন হেঁটে
হেঁটে কেমন একটা ঘোর লেগে গেছে হাঁটায়। ঝপাঝপ গাড়িতে উঠে বসা হলো। বিপিন কে শুভেচ্ছা
জানানো হলো তার সেনায় ভর্তির পরীক্ষার জন্যে। জওন ভাই আমাদের সঙ্গেই যোশীমঠ যাবে। গাড়ি
চলল ঝড়ের গতিতে। ঢাক বলে গ্রামটা পেরোবার পরে কি খেয়াল হওয়ায় আমার মোবাইল ফোনটা
বের করে চালিয়ে দেখলাম। দেখলাম নেটওয়ার্ক আছে। হু হু করে মেসেজ ঢুকতে শুরু হলো। অনেক
কিছুর সঙ্গে একটা দুঃসংবাদ পেলাম। আমার এক জামাইবাবু আর নেই। গত পরশু তিনি চলে গেছেন।
কলকাতার লোক, বাংলা শুনে ধরা মুশকিল, কিন্তু আসলে কাশ্মীরি। যাই হোক। ঘন্টা আড়াই
পর যোশীমঠে সেই হোটেলে এসে পৌঁছলাম যেখানে যাবার দিন ছিলাম। প্রথমেই দরজা খুলে বাথরুমে
ঢুকলাম। ঝকঝকে পরিস্কার বাথরুম দেখে কেমন যেন নিজের চোখেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম
না। গিজার চালিয়ে দিয়ে অনেক্ষন ধরে চান করলাম। প্রায় কিলোখানেক ধুলোমাটি বেরোল। ভাল
করে দাড়ি কামালাম। ঘন্টা খানেক পরে পরিস্কার হয়ে নিজেদের চোখে নিজেদেরই সবাইকে
আমাদের কেমন অচেনা লাগছিলো। সেই পকোড়ার দোকানে ঢুকে প্রথমে সবাই মিলে চা আর পকোড়া খেলাম।
তার পরে বেরিয়ে ইতি উতি তাকাতে তাকাতে চলেছি, হঠাৎ দেখি একটা দোকানে মোমো বিক্রি
হচ্ছে। বলল মটন মোমো। প্লেট প্রতি ৬০ টাকা। জিজ্ঞেস করতে বলল এক প্লেটে ১০ টা মোমো
থাকে। লাফালাফি করে দু প্লেট মোমো খাওয়া হলো চাষাড়ে ঝাল লঙ্কার চাটনি দিয়ে। মোমোর
দোকানের থেকে দু পা এগিয়েই জওন সিং, নরেন্দর সিং এর দফতর। সেখানে ঢুঁ মেরে একটু
গল্পগুজব হলো। জওন সিং বলে দিলো পার্টি করতে চাইলে রাস্তার উলটো দিকেই দোকান। একটু
পরে কানহাইয়ালাল সেই দোকান থেকে খবরের কাগজে মোড়া সন্দেহজনক দুখানা বোতল নিয়ে
আমাদের হোটেলের দিকে পা বাড়ালো। আমরাও অনুসরন করলাম। পথে আর একটা দোকানে রাতের
জন্যে চিকেন রুটি বলে আসা হলো। হোটেলে কিঞ্চিত খানা পিনার পর, আমরা আবার বেরোলাম
কনকনে ঠান্ডায় পাতলা টি শার্ট আর হাফ প্যান্ট পরে রাতের খানা খেতে। চিকেনে তেড়ে ঝাল
দিয়েছে পাহাড়ি দস্তুর মত। আমি ছাড়া কেউই খেতে পারলো না। বাকিরা আন্ডা ভুজিয়া দিয়ে
রুটি খেলো। আর চার প্লেট চিকেন আর গোটা আষ্টেক রুটি আমি একাই পাচার করলাম। যোশীমঠে
পৌঁছনো ইস্তক আমার খিদেটা কিঞ্চিত...।
হন্টনে দশ কিলোমিটার, আবার
জ্যামের হরিদ্বার
পরের দিন ঠিক ভোর ছটায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো হরিদ্বারের দিকে। টাটা সুমোর
সামনের আসনে বসেছি। কারন পা ভাঁজ করতে অসুবিধে হচ্ছে এখনো খুবই। সামনে কিঞ্চিত পা ছড়িয়ে
বসা যাবে। আজকে আকাশ মেঘলা। মাঝে মাঝেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। গাড়ি যদিও ভালোই
চলছে। ঘন্টা তিনেক পর কর্ণপ্রয়াগ পেরিয়ে থামা হলো। দু খানা আলুর পরোটা আর চা দিয়ে
ভালোই নাস্তা সারা গেল। আবার গাড়ি চলছে। মেঘলা বলে নিচে নেমে আসা সত্বেও অতটা গরম
লাগছে না। আস্তে আস্তে পেরিয়ে গেল শ্রীনগর, পেরিয়ে গেল রুদ্রপ্রয়াগ। রুদ্রপ্রয়াগের
কাছে ফেরার রাস্তা ভয়াবহ । বেশ কিছুটা জায়গায় রাস্তা বলে কিছুই নেই। নরম কাদা মাটি
বেয়ে প্রায় ৪৫ ডিগ্রি কোনে গাড়ি গুলো বড় রাস্তায় উঠছে । অনেক গাড়ি সে রাস্তায় আটকে
আছে। আমাদের ড্রাইভার বহু কায়দা কসরত করে কোনো মতে গাড়ি বড় রাস্তায় তুলে ফেলল। দেবপ্রয়াগ
এসে আকাশ পরিস্কার পাওয়া গেল। এদিকে বৃষ্টির চিহ্ণ মাত্র নেই। দেবপ্রয়াগ পেরিয়েই
একটা নিরামিষ ঢাবায় খেতে বসা গেল। তখন বেলা আড়াইটে বেজে গেছে। খিদের চোটে নাড়ি
ভুঁড়ি হজম হবার জোগাড়। ঢাবায় বসে আমি মোট ৯ টা রুটি খেলাম গুনে গুনে। তার পর আবার গাড়ি
চলল।
রুদ্রপ্রয়াগের পর থেকেই রাস্তায় ভিড় বেড়েছে গাড়ির। এখন ঋষিকেশের যত কাছে আসছি,
ততই যেন ভিড় আরো বেড়ে চলেছে। দেখছিলাম রাস্তার ধারে অসংখ্য রিভার র্যাফটিং এর
কোম্পানি র্যাফটিং করাচ্ছে গঙ্গায়, আর সেই বাবদে লোকজন যেমন তেমন করে গাড়ি রেখে
নদীতে নেমে পড়েছে। ফলে সরু পাহাড়ি রাস্তায় প্রানান্তকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেই
সঙ্গে যোগ করুন এই হাজার হাজার লোকের ঠান্ডা পানীয়ের বোতল, আলুভাজা বা কুড়কুড়ের
প্যাকেট, কিম্বা কোন পাথরের আড়াল পেলেই ঝাঁঝালো হিসির গন্ধ। ঋষিকেশের প্রায় দশ
কিলোমিটার আগে থেকে গাড়ি আর নড়তে চায়না। আমাদের বাস হরিদ্বার থেকে রাত দশটায়। এখন ঘড়ির
কাঁটা চারটে ছুঁয়েছে। দেখলাম অনেক সময় আছে, চিন্তার কোনো কারন নেই। টিক টিক করে ঘড়ির
কাঁটা এগোয়, কিন্তু গাড়ি এগোয় না। সাড়ে চারটে বাজল, পাঁচটা বাজলো, ছটাও বাজলো। আমরা
তখন হরিদ্বার থেকে আর মাত্র ২০-২২ কিলোমিটার দূরে। এই সময় পুলিশ দিলো রাস্তা বন্ধ
করে ঘুরিয়ে। ঋষিকেশ থেকে হরিদ্বারের রাস্তা ছেড়ে সমস্ত গাড়িতে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে
রাজাজী ন্যাশনাল পার্কের দিকে, গঙ্গার ও পাড়ে। যে রাস্তায় আমরা যাবার দিন গিয়েছিলাম।
সে রাস্তায় অনেকটা দুরত্ব বেশী হয় বটে, কিন্তু মনে হলো আর যাই হোক, ট্র্যাফিক
জ্যাম তো আর হবে না। তখনো জানিনা নিয়তি মুচকি মুচকি হাসছেন।
মিনিট চল্লিশ পর সেই হাসি টের পেলাম যখন ঘন জঙ্গলের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকারে
সীমাহীন গাড়ির সারির পেছনে আমাদের গাড়িও দাঁড়িয়ে পড়ে আটকে গেল। মিনিট পনের এদিক
ওদিক করলাম। গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছে এই জ্যাম চলেছে হরিদ্বার ছাড়িয়ে আরো অনেক দূর।
ম্যাপে দেখলাম এখান থেকে হরিদ্বার বাস আডঢা আরো বারো কিলোমিটার। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে
সাতটা ছুঁতে সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে আটকে থেকে লাভ নেই। এগোতে হবে। আমরা বাগিনী টপকে
এসেছি, এই দশ কিলোমিটার আমাদের কিই বা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে? সেই অর্থে
চ্যালেঞ্জ হয়ত ছিলো না, কিন্তু ছিলো দুর্দান্ত গরম, ঘুটঘুটে অন্ধকার আর গত কদিনের
ক্লান্ত শরীর। তবুও একে একে সবাই ব্যাগ কাঁধে তুললাম। আমি সবার আগে হাঁটা দিলাম।
জ্যাম খুলছে দেখলে সবাইকে ফোন করে বলবো। তারা আমাদের গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করবে আর
এলে উঠে পড়বে। রাস্তা একটাই আর তাতে গুচ্ছের গাড়ি। লোকে রাস্তায় সতরঞ্চি পেতে বসে
গেছে তাশ নিয়ে। কেউ কেউ বোতল নিয়ে। পা চালালাম জোরে জোরে। অন্ততঃ নটার ভেতর
হরিদ্বার পৌঁছতেই হবে। ভিষন অন্ধকার বলে চলতে খুব অসুবিধে হচ্ছিলো। হঠাৎ মনে পড়লো
আলো তো আমার সঙ্গেই আছে। ব্যাগ থেকে বের করে কপালে আটকানো আলো লাগালাম নিজের
কপালে। আক্ষরিক অর্থেই হেডলাইট হয়ে গেল। এবার হাঁটা অনেক সোজা হলো। ঘড়ি দেখতে দেখতে
হাঁটছি। সাড়ে আটটা নাগাদ একটা জায়গায় এলাম যেখানে “দুই দিকে দুই রাস্তা গেছে চলে”।
সামনে দেখি খাকি উর্দিতে দুই পুলিশ কর্মী। জিজ্ঞেস করলুম হরিদ্বার যাবো কোন
দিকে? ওনারা ডান হাতি রাস্তাটা দেখিয়ে বললেন দেড় কিলোমিটারে গঙ্গার ওপরে ব্রিজ
পাবেন। পেরোলে ওপাশেই হর কি পৌড়ি, অর্থাৎ হরিদ্বার। বাঃ বড় আহ্লাদ হলো শুনে। চলায়
নতুন দম এলো। কিছুটা গিয়েই গাছ পালার ফাঁকে ব্রিজের আলো দেখলাম। একটু পরে ব্রিজে ওঠার
মুখে দেখি একটা গাড়ি এসে আমার পাশে আস্তে হলো, আর ভেতর থেকে আমার নাম ধরে কেউ
চেঁচিয়ে ডাকছে। দেখি দাদা আর বৌদি। আমার তখন মাথায় “জোশ হাই” হয়ে আছে। বললুম তোমরা
ব্রিজ পেরিয়ে নেমে দাঁড়াও, আমি আসছি। ব্রিজ পেরিয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করে দাদা বৌদিকে
বের করলাম। এবারে হরিদ্বারের ওই তুমুল ভিড়ে না হেঁটে একটা রিক্সায় চড়া হলো। সোজা
বাসস্ট্যান্ড। বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে থিকথিকে ভিড়ে একটা কোনায় বসলাম যখন ঘড়িতে ঠিক
নটা কুড়ি। অর্থাৎ বাস ছাড়তে মিনিট চল্লিশ দেরি আছে। দাদা বৌদি গেল কিছু খেতে। আমার
ওই গরমে আর ক্লান্তিতে কিছু খেতে ইচ্ছে করছিলো না। ঘামে চুপচুপে ভেজা টি শার্ট টা বদলে
অন্য একটা পরলাম। এ খানা রেখে দিয়েছিলাম প্লেনে পরবো বলে। না হলে বাকি জামা কাপড়ের
যা অবস্থা, প্লেন থেকে নামিয়ে দিতে পারে। কানহাইয়ালাল ফোন করে বলল সে আর জগাই মাধাই
নাকি হর কি পৌড়িতে কি সব সুখাদ্য খাচ্ছে। আমি খেলাম আধ বোতল জল।
বাস এলো মিনিট কুড়ি দেরি করে। বাসে উঠে বসতেই ঝিমুনি এলো। হরিদ্বারের চৌহদ্দি
পেরোবার আগেই ঝিমিয়ে গেলাম। রাতে কয়েকবার দেখলাম রাস্তাজোড়া প্রচন্ড ট্র্যাফিক জ্যাম
কে কলা দেখিয়ে উত্তরাখন্ড জনপরিবহনের চালক রাস্তা থেকে ওই আখাম্বা বাস নিয়ে নেমে কখনো
মাটির কানা দিয়ে, কখনো কার গোয়ালের পাশ দিয়ে নক্ষত্র বেগে চলেছে। আর কিছু ভাবতে
ইচ্ছে করছিলো না। “মরগে যা” বলে আবার মন দিলাম ঘুমে। ভোর ভোর দেখি বাস দিল্লি ঢুকছে।
যাক বাবা, তাহলে প্লেন ফস্কাবো না। এই নিশ্চিন্ত ব্যাপারটা আসতেই আর ক মিনিট ঘুম দিয়ে
নিলাম।
পরিশিষ্ট
শেষের ক পাতা না লিখলেও চলত। কিন্তু লিখলাম কেননা পাঠককে পুরোটা বলতে চাই বলে।
ভোর বেলা অটো যোগে দিল্লি এয়ারপোর্ট এসে, এয়ারপোর্টের ঝাঁ চকচকে বাথরুমে ঢুকে দাঁত
মাজা থেকে শুরু করে সব কিছুই করলাম। দু খানা বোতলে বেসিন থেকে জল ভরে চান অব্ধি।
চান করে বেরিয়েছি আর এক মস্ত চেহারার সি আই এস এফ এর হাবিলদার বেসিনে হাত ধুতে ধুতে
বিশাল গোঁফের ভেতর দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন – “নাহা ভি লিয়ে?”। আমি একটু মুচকি
দিলাম। সিকিওরিটি চেকের পর ফুডকোর্টে বসে দু খানা রোল, সেই সঙ্গে
টোস্ট আর ডিমের অমলেট সহকারে দুর্দান্ত জলখাবার খেলাম। কেননা গতকাল দুপুরের পর
পেটে দানাপানি পড়েনি। বাকি যাত্রা নির্ঝঞ্ঝাট। শুধু দমদমে নেমে দেখি সেদিন মাত্রা ছাড়া
গরম, তাপমান ৪২ ডিগ্রি। আর বেলা ১২টায় এয়ারপোর্টে একটাও ট্যাক্সি নেই। পিঠে ব্যাগ বেঁধে দিলাম হাঁটা। বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে একটা বাস ধরে এলাম সায়েন্স সিটি। সেখান থেকে
একটা হলুদ ট্যাক্সি ধরে বাড়ি। এইখানে আমার নটেগাছটি মুড়োলো। এবার আসি কিছু কাজের কথায়।
এরকম একটা একঘেঁয়ে লেখা পড়ে আপনার এই সব অভিযানের উৎসাহ না হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আর সেই জন্যে নিচের অংশটুকু আপনি নিশ্চিত ভাবেই বাদ রাখতে পারেন। কিন্তু যদি আপনার
এত কিছুর পরেও মনে হয়, এরকম একটা অভিযানে গিয়ে হিমালয়ের ওই রূপ চাক্ষুশ দর্শন
করার, তাহলে দুটি কথা কই। প্রথমেই দরকার প্রস্তুতি, সেটা শারীরিক ও মানসিক দুই দিক
থেকেই। শারীরিক প্রস্তুতির জন্যে মোটামুটি ধরে রাখুন আপনাকে সমতলে ১ ঘন্টায় ৮
কিলোমিটার পেরোবার মত ফিট হতে হবে। সেটা আপনি দৌড়েও যেতে পারেন, হেঁটেও যেতে
পারেন। এক দিনে এই জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। আর আপনি ট্রেনের টিকিট কেটে ভাবলেন মাস
দুয়েক সময় আছে, ফিটনেস বাড়িয়ে নেবো, ওই অবাস্তব পরিকল্পনায় কখনো যাবেন না। নিজেকে
ফিট রাখা একটা দীর্ঘ প্রস্তুতি। আপনাকে প্রথমে শরীর কে পরিশ্রমের উপযোগী করে তুলতে
হবে। প্রথমে কেন? আপনার আসল কাজই হলো শরীরকে পরিশ্রমের উপযোগী করে গরে তোলা।
বাকিটা শরীর নিজেই পরিশ্রম করে করে নেবে। চাইলে হাঁটা দিয়ে শুরু করুন। তিন
কিলোমিটার জোরে জোরে হাঁটুন, যাতে হাঁপিয়ে যান, ঘাম ঝরে দরদর করে, এরকম হাঁটা। তার
পরে কয়েক মাস পরে অল্প স্বল্প দৌড়েও দেখতে পারেন। আর মানসিক প্রস্তুতি? যে কোন
জায়গায়, যে কোন ভাবে টিকে থাকার মত মনের জোর। এটা না হলে আমার চলে না, ওটা না হলে
আমি পারবো না, এরকম কিছু থাকলে এসব অভিযান আপনার জন্যে একেবারেই নয়। মনের অদম্য
জোর এবং ইচ্ছে ছাড়া এসব অভিযানে পা না বাড়ানোই ভালো। আজকাল অনেক ট্রেকিং কোম্পানি
হয়েছে। এক সঙ্গে তিরিশ চল্লিশ জন লোককে নিয়ে তারা কোথাও একটা যায়। সেই সঙ্গে নোংরা
করে, হই হট্টগোল করে। পরিবেশ নষ্ট করে। তাই উত্তরাখন্ড আর হিমাচলের অনেক জায়গায়
এদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যাঁদের সঙ্গে নিয়ে যাবেন, খেয়াল করবেন তাঁরা যেন আপনারই
মত শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে সক্ষম হন। দলের ভেতর একজন যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন
তাহলে কিন্তু গোটা অভিযানই মাটি। আর একটা কথা, কোথাও ভুলেও কোনো আরাম খুঁজবেন না।
এ ধরনের অভিযানে কোনো আরাম বলে বস্তুই নেই। তবু কেন যাবেন? কেন কষ্ট করবেন? সে
প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে হিমালয়ের ওপরে তেরো চোদ্দ হাজার ফুট ওপরে কোথাও। আপনার
জন্যে আমার তরফ থেকে শুভেচ্ছা রইলো পাঠক। চরৈবেতী চরৈবেতী।
Khub bhalo laglo pore. porte suru korechilam sondher dike. r charte parini. ei sesh holo. Erokom bromonbkahini khubkbeshi porini. ekta jinish ektu miss korchilam, "Eadt sikim er durotto mapar ekok - 4.5 km" 😁
উত্তরমুছুনr ekta kotha obossoi bolbo onekichu janlam. notun kore prerona pelam trek e jabar!
prosongoto boli amra jachchi October e. dosomir por. Abar jete chaile amader sathe join korte paro!😉
দশমীর পর কোথায় যাচ্ছো?
মুছুনBagini! 😁
মুছুনLekhar rasta take nijer chokhe dekhe aste! 😊
মুছুনখুব ভাল। ঘুরে এসো। আমি জুনে যাচ্ছি সতোপন্ত স্বর্গারোহিণী গ্লেসিয়ার
মুছুনaahaa! tahole r o ekta sundor lekha pabo!! 😍
মুছুনদারুন লেখা। ট্রেক টা সহজ বা কঠিন হয় নিজের শারীরিক ও মানসিক শক্তির উপর। বাগিনী কিন্তু এতটা টাফ নয়।
উত্তরমুছুনহ্যাঁ একশো বার। আমি আপনার মত সক্ষম নই। তার প্রথম কারন আমার একটি পা প্রায় অকেজো। আর দ্বিতীয়ত বয়স পঁয়তাল্লিশ। রোজ সকালে যদিও ১২ কিলোমিটার দৌড়োই আমি, কিন্তু সেটা সমতলে। পাহাড়ে নয়। পাহাড়ে উঠতে গেলে আমার সমস্যা হয়ই।
মুছুনআমি খুব পাহাড় ভালোবাসি কিন্তু শারীরিক কারণে কোনদিন যেতে পারবো কিনা জানিনা তোর লেখা পড়ে মনে একটু জোর পাচ্ছি
উত্তরমুছুনওই মনের জোরটুকু থাকলে সবই হতে পারে।।আমি খোঁড়া পা নিয়ে যেতে পারলে বাকিরাও পারবে।
মুছুনপ্রত্যেকটা শব্দ পড়ছি আর চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই অতুলনীয় ছবি,সেই সারি সারি পাহাড় আমাকে আবার হাতছানি দিচ্ছে আর বলছে কিরে সময় হয়ে এল, আবার আসবিনা? মনে হচ্ছে আমার জীবনের সার্থকতা এখানেই। তোমারলেখার প্রতিটি অক্ষরে শিহরণ আছে,আছে মহানুভবতা। ঠিক পর্বতের মত। জায়গায় জায়গায় বিশেষ হিউমার পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য যথেষ্ট।
উত্তরমুছুনএই তো ঠিক আর ৬০ দিন বাকি আমাদের যেতে। তবে তার আগে তুই ও এটা নিয়ে লিখে ফেল
মুছুনSeta korbo korbo r hoye uthlo koi.. But eta porlei enthu ese jachche.
মুছুনঅসম্ভব ভালো ঘুরেছেন তো বটেই, সোমনাথ, অসম্ভব পরিশ্রম করে লিখেওছেন সে ঘোরার বর্ণনা। পড়ে সত্যিই যেতে ইচ্ছে করে। ছবিগুলোও চমৎকার। আপনার ক্যামেরার ভারবহন সার্থক।
উত্তরমুছুনআমার বাগিনী যাতায়াত আর লেখার অন্যতম সেরা পাওনা কি জানেন? কুন্তলার থেকে এই মন্তব্যটি পাওয়া।
মুছুনদারুন লেখা। সারারাত প্রায় জেগে শেষ করলাম। এত সাহস মনে হয় করে উঠতে পারবো না এই জন্মে। পরের টার অপেক্ষায় রইলাম। সবশেষে বলি অসাধারন ফটোগ্রাফি। সব কিছু চোখের সামনে স্পষ্ট। লেখার সার্থকতা বুঝি এখানেই। আর কানহাইয়ালাল এর কমেন্ট কৈ😂😄😄
উত্তরমুছুনআরে না না। সাহসের তেমন কিছু নেইম আসলে পরিবেশ তৈরি করে দেয় সব কিছু।
মুছুনএটা শুধু লেখা নয়।।। তুমি আমাদের ক টেনে নিয়ে গেছো তোমার এই অসামান্য যাত্রায়।। অবাক সৌন্দর্য।। কোনোদিন যায়নি অথচ আমি ওখানেই।। র কি।। পরের তার অপেক্ষা ।।
উত্তরমুছুনপরেরটা একটু অন্য রকম বেড়ানো ছিলো। তবে সে লেখায় হাত দিয়েছি।
মুছুনএই অসাধারন লেখা পাহাড়ী ঝর্নার মতন কলকল করে মন ছুঁয়ে যায়। পাহাড়ের পাথর দু পায়ে দলে লেখা, হাতের ছড়ে যাওয়া চামড়া র ওপর নতুন প্রলেপ। চরৈ বতি। আরো যা আমরা লেখা পাই।
উত্তরমুছুনএমন মন্তব্য পেলে আর একবার বাগিনী ঘুরে আসাই যায়
মুছুনপায়েপায়ে অনেক চড়াই উৎরাই পেরোলাম। পথের মাঝে ঝর্ণা পার হতে একটু ভয়ই লাগছিল। হাতের আঘাতটাও বেশ অনুভব করলাম। অনুভব করলাম প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য। লেখার দীর্ঘ পথে কিন্তু অফুরন্ত অক্সিজেন, এতটুকু হাঁপ ধরে নি। পাঠক হিসাবে মানসভ্রমণ পরিপূর্ণ হল।
উত্তরমুছুনআমি লিখতে লিখতে অনেক বার ভেবেছি, লেখাটা এত বড় করাটা ঠিক হচ্ছে কিনা। এত বড় লেখা কেউ পড়বে কিনা। পরের ট্রেকের লেখাটা ছোট করব কথা দিচ্ছি।
মুছুনDurdanto ekta lekha porlaam.. porte porte mone hochhilo ami o Baghini obhijan e beriyechi tomader saathe. Asa kori bhobishotye tomader ei group ta join korte parbo. Porer lekha tar opekhaay roilaam..
উত্তরমুছুননিশ্চই। আমরা তো সব সময়েই চাই আমাদের সঙ্গে আরো সবাই যোগ দিক। আর পর পর অনেক গুলো পরিকল্পনাতেও আছে।
মুছুনএই লেখা নিয়ে বহু সুযোগ্য কথা ও চিন্তিত মতবাদ...বহু পাঠক আগেই দিয়েছেন...নতুন করে সে কথা বলতে যাওয়া ধৃষ্টতা হয়ে যাবে...কিন্তু এটুকু না বললেই নয়...এক নিঃশ্বাসে এমন রোমাঞ্চকর মানসভ্রমনের অভিজ্ঞতা বহুদিন কোনো ভ্রমন কাহিনী(আধুনিক সময়ের) পড়ে হয়নি....বাগিনীই হোক বা না হোক....সুবিশাল হিমালয়ের অন্য কোথাও ...কোনোখানে নিয়ে যাবার উৎসাহ...এক অমোঘ হাতছানির দিকে ঠেলে দেয়....লেখককে সাধুবাদ ...কৃতজ্ঞতা....ধন্যবাদ জানাব ?বুঝতে পারলাম না...একটা ঘোরের মধ্যে ঘেটে গেলাম!!!!
উত্তরমুছুনএতটা বড় করে লেখার আমার উদ্দ্যেশ্য একটাই, যাতে পাঠকের সম্যক একটা ধারনা হয়, আর যে বাঙালী অতীশ দিপঙ্কর ৬৮ বছর বয়সে হিমালয় টপকে তীব্বত গিয়েছিলেন, যে বাঙালী রামনাথ বিশ্বাস বা বিমল বাবু সাইকেলে বিশ্বভ্রমন করেছেন, সেই জাতের উত্তরসূরীরা মেকমাইট্রিপের পাট্টায়া কি বালির রিসোর্ট ছেড়ে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় আবার পা বাড়াবেন। তার বদলে আরাম হয়ত মিলবে না, কিন্তু যা মিলবে, সেটা রিসোর্টে বসে মেলেনা।
মুছুনএক্কেবারে...
উত্তরমুছুনঅসাধারণ লেখা 😀😊😊😊
উত্তরমুছুনবলছিস?
মুছুনমানসভ্ৰমন সম্পূর্ণ হলো। নিঃস্বাস প্রশ্বাস স্বভাবিক হচ্ছে।পা এর যত্ন নিও। ভালো থেকো। পরের লেখার অপেক্ষায় এ থাকবো।
উত্তরমুছুননিশ্চই দাদা। এর পরে অন্য একটা ভ্রমণকাহিনীতে হাত দিয়েছি। আর সামনের জুনে যাচ্ছি ওদিকে আবার। ফিরে এসে আবার লিখতে বসা।
মুছুনMy mom had finished this article reading up to 1.30 AM at the age of 84. may be another feather to your writer's cap!
মুছুনকি বলছেন দাদা!!! অবিশ্বাস্য লাগছে।
মুছুনআমি জিগেস করলাম কেমন লাগল? মা বললেন বেশ লিখেছে। ওকে একদিন আসতে বলিস বাড়িতে।
মুছুননিশ্চই আসবো দাদা। এখানে আমার সব কড়া ভ্রমন বিষয়ক লেখা পাবেন।।মাসিমাকে পড়াতে পারেন।
মুছুনhttp://dwitiyaadhyay.blogspot.com/search/label/চরৈবেতি%20চরৈবেতি
বড্ডো ভালো লেখাটা। পড়তে পড়তে ঘুরে ও এলাম। জানিনা কে কি বলবে, পড়তে পড়তে আমার অন্যতম প্রিয় লেখক উমাপ্রাসাদ মুখোপাধ্যায় এর কথা বড্ডো মনে হচ্ছিল। হয়তো বা এই লেখা আর ওনার লেখা গুনগত ভাবে ও বিষয়ভিত্তিক ভাবে একই রকম বলে। অসংখ্য ধন্যবাদ সোমনাথদা এই লেখাটা আমাদের উপহার দেবার জন্য।
উত্তরমুছুনঅনেক বড় মানুষের নাম করলে সপ্তর্ষী। এনার ধারে কাছে যাওয়া কেন, স্বপ্নে কল্পনাও করতে পারিনা কখনো হিমালয়কে ওনার মত করে আত্তিকরন করার কথা। শুধু অনুপ্রাণিত হই, এটুকু বলতে পারি। পুরোটা পড়া এবং এই মন্তব্যের জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এই মন্তব্যগুলোই আমার কাছে মনিমুক্ত।
মুছুনসকলে যখন ছোট লেখায় ঝুঁকেছে তখন ব্লগে এমন বড় ভ্রমণ কাহিনী কেন কোন ধরণের লেখাতে এই আকার ও সম্পূর্ণতা দেখা যায় না। এতে যা পরিশ্রম লাগে তাতে চর্চার সততা জানান দেয়। ডিটেলের কাজ দুর্দান্ত মায় খেজুর থেকে লেজুড় কিচ্ছুটি বাদ যায় নি।
উত্তরমুছুনএইটা দুর্দান্ত। হা হা হা। খেজুর থেকে লেজুড়। যা বলেছিস গুরু। চল না, দুজনে একবার ঘুরে আসি। ছোটো করে।
মুছুনFantastic writeup with minute details.. It feels the reader itself present in the place. Need to comeback again to cherish this wonderful Travelogue. Please keep them coming.
উত্তরমুছুনবিলক্ষন বিলক্ষন। সামনে আরো একটা ভ্রমন আছে। আর বাগিনীর পর আরো দু জায়গায় বেড়ানো নিয়ে লেখাও বাকি।
মুছুনসোমনাথদা, এতদিন আসতাম, টুক করে পোস্টগুলো পড়ে হাল্কা করে কেটে পড়তাম। কিন্তু বাগিনীর পিঠে পড়ে আপনি মানুষটা সম্পর্কে কৌতূহল বেড়ে গেল। একটা লোক এমন সুন্দর ভাবে সত্যি মিথ্যে লিখতে পারে ( শুরুতে ১ কিমি হেঁটে হাফ ধরার কথাটা আমি বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম প্রায়, বাকি কল্পকাহিনি গুলোও মচৎকার), পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে পারে, ইতিহাস -ভূগোল এতো সহজ করে গুলে খাইয়ে দিতে পারে, আবার এরকম ছবি আঁকতে পারে। আরও কি কি পারে কে জানে, ঈশ্বর বোধহয় এরকমই একচোখা হন, একপাত্রে দান করতেই পছন্দ করেন।
উত্তরমুছুনযাকগে, বাজে বকছি, দারুণ বিবরণ, যারা ঘুরতে যাবে বা যারা যেতে পারবে না, দুজনকেই সাহায্য করবে ঘুরে আসতে। পরের লেখার অপেক্ষায় রইলাম। নাহলে সোজা বানতলায় গিয়ে তাড়া দেবো।
আরে না না, সত্যিই হাঁফ ধরত।সেই ২০১৭ তে যারা দেখেছে আমাকে, তারাই জানে। ছবি দেখলেই বুঝবে। পরের লেখায় হাত দেবো কদিনেই। সেইটা অবিশ্যি ভিনদেশে। একদম অন্যরকম। দেখি কেমন উৎরোয়।
মুছুনঅপূর্ব, এতো নিখুঁত বর্ননা করেছিস যে ,আমার মনে হল যে আমিও তোর সাথে বিপদসঙ্কুল পথ পেরিয়ে বাগিনী ঘুরে এলাম ।
উত্তরমুছুনমেয়েদের বলিস। ওরা হয়ত যেতে চাইবে।
মুছুন