[২০১০ সালের ঘটনা। লেখাও তার কিছুদিন পরেই।
হারিয়ে ফেলেছিলাম লেখাটা কোথাও। এতকাল পরে খুঁজে পেয়ে সামান্য কিছু পরিমার্জন করে তুলে
দিলাম]
আমাদের
ইশকুলে কিছু ডক্টর জেকিল মাস্টারমশায় পরীক্ষার আগুপিছু মিস্টার হাইড হয়ে যেতেন। সে
আমলে বছরে পরীক্ষা দিতে হতো মোটে দু বার, আর ওই দুই পরীক্ষার আগুপিছু দিন
কুড়ি-পঁচিশ করে “মন দিয়ে” পড়তে বসা, এবং পরীক্ষায় টেনেটুনে, মিস্টার হাইডদের নাগাল
এড়িয়ে “সিলিপ কেটে” পরের ক্লাশে উঠে যাওয়া। এই করে ইশকুল জীবন শেষ হলো।
সে
আমলে এই এত্ত বড় বড় স্বপ্ন টপ্ন ছিলোনা। এই হবো, সেই হবো, এই চাই ওই চাই ছিলোনা।
বরং বড় হলে কাজ কর্ম কিছু একটা করতে হয় করবো, আর পড়াশোনা থাকবেনা বলে যতক্ষন ইচ্ছে
ফুটবল খেলব, আর প্রতি রবিবার মাংসর ঝোল দিয়ে ভাত খাবো। সব মিলিয়ে এই ছিল লক্ষ্য।
তা সে লক্ষ্য খুব যে খুব একটা পূরন হয়নি তা বলতে পারিনা। কোমরের ওপর থেকে বুক
পর্যন্ত যে মহাকায় ফুটবলখানা রয়েছে, সেটা নিয়ে সর্বক্ষনই খেলাধুলো করতে হয়। এমনকি
শুয়ে শুয়ে পাশ ফিরলেও ডেনিলসনের মত ডজ করছি মালুম হয়। তবে প্রতি রবিবার মাংস ,
মানে পাঁঠার ঝোলটা আয়ত্তের বাইরেই রয়ে গেছে। একে তো দাম বড্ড বেশী, তার ওপরে পেটের
ফুটবলের আকার বৃদ্ধি। সেই ছোটোবেলায় পড়ার বই মোট্টে ছুঁয়ে দেখতুমনা এটা যেমন ঠিক,
আবার তেমনই অন্য বইপত্রের দিকে আকর্ষন ছিল বড্ড বেশী, এটাও ঠিক। সিনেমা রেডিও
টেলিভিশন (অনেক পরের দিকে) এসব নিয়ে একটা আলাদা জগৎ ছিল। ফেলুদা, দূর্গাপূজো, ঘুড়ি,
শক্তি-সুনীল এসব নিয়ে আর পাঁচজন বাঙালির মত রোম্যান্টিকতা আমার মধ্যে কম, আজও কম।
কিন্তু সেই আলাদা জগতে আমি কখনো ক্যাপ্টেন নিমো, কখনো গ্যারিঞ্চা, কখনো আলেক্সেই
মেরেসিয়েভ, আবদুল হামিদ, ইউরি গাগারিন, প্রোফেসর শঙ্কু, শার্লক হোমস, মিস্টার
স্পক, লিউক স্কাইওয়াকার, রোভার্সের রয়, ডেভিড লিভিংস্টোন বা তেনজিং নোরগে হয়ে
যেতাম।
তেনজিং
নোরগে বলতে মনে পড়ে গেল, এই সব প্রেরনা, যাঁদের কথা ওপরে বলেছি তাঁরা মাঝে মধ্যেই
বেশ বিপদে ফেলেন, এবং তেনজিং তাঁদের মধ্যে বোধহয় এক নম্বরে থাকবেন। আমি আদ্যন্ত
ঘরকুনো শহুরে আলসে টাইপের লোক। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুই এর জায়গায় তিন পা হাঁটতে হলে
আমার বাস-ট্রাম-রিক্সা লাগে। ইয়ারদোস্ত সমেত হল্লাগুল্লা গুষ্টিসুখ, মুড়ি
তেলেভাজা-চা, লুঙ্গি, রোববারের জিলিপি আর আপিসকুঠি, সব মিলিয়ে ছাপোষা গেরস্ত
লোক।কিন্তু অবচেতনে বসে বসে এই তেনজিং এর মত লোকজন আমাকে বার বার বিপদে ফেলেছেন।
সেবার তিন কাঠ বেকার বন্ধু কলেজ টপকে টিউশনির আড়াইশো টাকা পকেটে নিয়ে ঘোর শীতে চলে
গেছি দার্জিলিং। সেটা জানুয়ারির শেষ, আর এখনকার মত মানুষজন তখন ওই পাথরফাটা শীতে
দার্জিলিং যেতনা। ফলে গিয়ে দেখি গোটা ম্যালে কেবল আমরা তিনজন, একটি চা ওয়ালা (না
না, ইনি এখনো চা ই বিক্রি করেন), ও গোটা পাঁচেক ভুটিয়া কুকুর। ইতিউতি ঘুরে,
হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট ঘুরে তেনজিং এর ছবি টবি দেখে সন্ধ্যের ঘোরে
রাস্তা হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কে জানে কোনচুলোয় চলে গেছি। ঠান্ডায় হাত-পা তো বটেই,
এমনকি খানিক আগে বিকেলে চায়ের সঙ্গে পেটে যাওয়া দুধ অবধি জমে আইসক্রিম হয়ে গেছে
বোধহয়। কোন দিকে যাই কিছুই ঠাওর হচ্ছেনা। হঠাৎ দেখি ঘন কুয়াসা আর আঁধার ঠেলে গুটি
গুটি পায়ে এগিয়ে আসছেন এক প্রৌঢ়া গোর্থা মহিলা। বয়স ষাটের কোটায় নিশ্চিত। হাঁউ মাউ
করে তিনজনে টুটাফুটা হিন্দিটিন্দি মিশিয়ে বলতে চেষ্টা করলুম, হারিয়ে গেছি। মহিলা
মুখের রেখার সংখ্যা দ্বিগুন করে অভয়ের হাসির সঙ্গে আঙুল দিয়ে ইশারা করে পথ দেখিয়ে
দিলেন। সে পথ পিচের রাস্তা ছেড়ে উঠে গেছে শূন্যিপানে, সো-ও-জা ওপর দিকে। আঁধারের
মধ্যে ঠাওর করে দেখলুম রাস্তার যে দিকে পাহাড় উঠেছে, সেখানে যেন ঘাস-পাতার ফাঁকে
মাটিতে হালকা ধাপ কাটা। ওই ঠান্ডায়, অন্ধকারে তখন ওই সিঁড়িকেই মনে হলো স্বর্গের
সিঁড়ি। তার ওপরে তেনজিং হাসি মুখে অভয় দিলেন মনের ভেতর। প্রথমটা দিব্যি উঠছিলুম। মিনিট
সাত আট পর হাঁফ ধরা শুরু হলো। ধাপ কাটা থাকলেও এক একটা ধাপ আমার হাঁটু সমান। এদিকে
দাঁড়ানোও মুশকিল পা রেখে, কেবল উঠে যেতে হবে। দশ মিনিট পর গায়ের গরম জামা ভেদ করে
ঘাম ছুটতে লাগল। পনের মিনিট পর মনে হলো হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে দেখে
আসা অক্সিজেন সিলিন্ডার, খান কতক নিয়ে এলে হতো। হাঁটু খুলে আসছে, কোমর বিদ্রোহ
করছে, কান ভোঁভোঁ করছে, মানসপটে অশ্লীল শব্দসমুহ ঘোরাফেরা করছে। ঠিক কতক্ষন পর
ওপরের রাস্তায় পৌঁছেছিলুম মনে নেই। শুধু মনে আছে, হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করে রাস্তায় উঠে
এসেই চিত হয়ে পিচের ওপর শুয়ে পড়েছিলুম। মিনিট খানেক পর বলতে চেষ্টা করলুম একটু
শুয়ে বিশ্রাম নিই, তার পরে উঠবো, কিন্তু গলা দিয়ে কেবল “ঘোঁক” করে একটা শব্দ
বেরোলো। কয়েক সেকেন্ড পর “কোঁক” আর “ওঁক” করে দুটো শব্দ পেয়ে বুঝলুম আধঘন্টা মত
নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকা যায়। মনের ভেতরে বসে থাকা তেনজিং খুব উৎসাহ নিয়ে পাহাড় চড়তে
শুরু করেছিলেন, কিন্তু একজন তো নয়, আরো অনেকে আছেন সেখানে, ওপরে উঠে এসে সমতলের
মহা-অলস কেউ একজন পিতিজ্ঞে করেছিল, “খুরেখুরে দন্ডবত, আর নয়, পাহাড়ে আর চড়ছিনা”।
কিন্তু
তা বললেই কি হয়? লিভিংস্টোন মশায় বললেন পিঠে পোঁটলা বেঁধে বেরোও। আবার বেরিয়েছি।
আবার অলস অকর্মন্য কুঁড়ের বাদশা কসম খেয়েছে, চৌকাঠ ডিঙোবেনা। কিছুতেই না। ডিঙোইনি।
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা
এক জনায় ছবি আঁকে এক মনে,
ও রে মন
আরেক জনায় বসে বসে রংমাখে
ও আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে
কোন জনা,কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা
একজনের
সাধ, অন্যজনে দেয় বাঁধ। মাঝখান থেকে এই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে দেহকান্ডখানা ঝামেলা
পোয়ায়। আলসে ঘরকুনো বলছে যাসনি কোথাও, পাশবালিস আঁকড়ে ঘুম ঘুম ভাব করে পড়ে থাক
বিছানায়। ওর চেয়ে আরাম কিচ্চুতে নেই। ওমনি ক্যাপ্টেন জেমস টাইবেরিয়াস কার্ক বলে
বসেন – “WE BOLDLY GO, WHERE NO MAN HAS GONE BEFORE”।
কি সব্বোনাশ, কোনো মানুষ যদি না গিয়ে থাকে তাহলে সেথায় খাবো কি? ইয়ে করব কোথায়? না
বাবা, তার চে আমার পাশবালিসই ভালো। ওমনি দেখি তেনজিং কেমন একটা মিচকে গা-জ্বালানি
হাসি হাসছেন। পকেটে পয়সা, বুকে সাহস, মাথায় বুদ্ধি, এসব আমার নাই থাকতে পারে,
কিন্তু ষোলো আনার ওপর আঠেরো আনা একখান ইয়াব্বড় ইগো আমার বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। ওই
গা জ্বালানে হাসি দেখে সেই ইগো রোখের মাথায় বলে দিল – চালাও পানসি বেলঘরিয়া। অমনি
দেখি গাড়ি ছাড়ল শ্যালদা থেকে, চলল উত্তরপানে। রাত তখন দশটা হবে। গোটা পনেরো
লুচি-আলুরদমের পর পেটেও একটা স্বস্তিদায়ক অনুভুতি। চক্ষুদুটি ঘন হয়ে এল। সেটা
কালীপূজোর আগের দিন। পূজোআচ্চায় আমি বড় একটা স্বস্তি বোধ করিনা, তার ওপরে
বোমারুদের ভয়। এই সব থেকে দূরে পালাতে পেরে বড়ই নিশ্চিন্ত ঘুমে তলিয়ে গেলুম।
প্রচন্ড
ঝাঁকুনি। ক্যাপ্টেন স্কটের গলায় হাঁক শুনতে পাচ্ছি। আমাদের জাহাজ ধাক্কা খেয়েছে
দক্ষিন মেরুর প্যাক-আইসে। খাইসে, ক্যাপ্টেন স্কট মহানন্দা মহানন্দা বলে চেঁচাচ্ছেন
কেন? চোখ রগড়ে দেখি ক্যাপ্টেন স্কট নয়, আমার সফর সঙ্গী দুই মক্কেল, আমাকে ধাক্কা
দিয়ে তুলছে। গাড়ি মহানন্দা পেরোলো বলে, নামতে নাকি দেরি নেই। উঠে বসতে গিয়ে ওপরের
বাঙ্কে ধাঁই করে মুন্ডুটা ঠুকে গেল। ওপরের বাঙ্কের আধঘুমন্ত ভদ্রলোক –“খামোখা অমন
গরুর মত গুঁতুচ্ছেন কেন বলুন তো?” বলে লাল চক্ষু দেখালেন। আমিও সেই রক্তচক্ষু দেখে
শুড় শুড় করে বাঙ্ক থেকে নেমে এলুম। বললুম চলেই এসেছি যখন, পটি মুখ ধোয়া সব নাহয়
হোটেলে গিয়েই......... । দু জোড়া চোখ জ্বলন্ত বিষ্ময়ে আধ সেকেন্ড তাকিয়ে রইল, তার
পরে এলো মুখের তোড়ের পালা। ইস্টিশনে নেমেই নাকি আবার রওনা। হোটেল ফোটেল পরিকল্পনায়
নেই। আগেই তো বলা হয়েছিল। রেলগাড়িতেই যা করার...। ছুটলুম বাথরুমের দিকে। ভোর ৬ টা
থেকে কামরার যাবতীয় লোক সেখানে যা যা করে এসেছেন, ,আমিও তাই করতে ঢুকলুম। কিন্তু
তেনাদের কৃতকর্মের কিঞ্চিত অবশেষ তখনো ইতিউতি ছড়িয়ে। একবার ভাবলুম চেপে যাই আপাতত।
ওদিকে দুই মক্কেল শাষিয়ে রেখেছে, এর পর সাত ঘন্টা গাড়িতে চড়তে হবে। ডেভিড
লিভিংস্টোন অভয় দিলেন – মাই বয়, তুমি জানো, আমি গোটা আফ্রিকা যখন ভ্রমন করেছি,
সেখানে কটা পায়খানা ছিলো? একটিও না। তাই বলে কি আমি চেপে থেকেছি? যখন যেখানে ইয়ে
এসেছে, সেখানেই......হয়ত সেইখানে তার আগে কোনো গন্ডার, বা জিরাফ...আর এ তো তোমার
স্বজাতী মানুষের ইয়ে, যার ৯০% এই কামরার বাঙালি...... অতএব খোকা, নির্ভয়ে এগিয়ে
যাও... এই না হলে পর্যটক কিসের? আবার ইগোয় খোঁচা। নগদ ৮০০ টাকা দিয়ে কায়দাওলা
পর্যটকমার্কা পিঠের ব্যাগ কিনিচি কি এই খোঁচা খেতে? জয় বাবা লিভিংস্টোন বলে
নাক-চোখ-চেতনা সব কিছু টিপে ধরে বসেই পড়লুম।
ইস্টিশনে
ঝকঝকে সকালে নেমে মনে হলো ভাগ্যিস ঘিনপিত ঝেড়ে হালকা হয়ে গেছি, নয়ত এত সুন্দর সকাল
বেলা মনে-পেটে খিচ থেকে যেত। কিন্তু সকাল দেখবো কি? হুড়মুড় করে পেছনের লোকের ঠেলা
খেয়ে ওভারব্রজ টপকে চলে এলুম বাইরে। আর তার পর গাড়িতে চড়ে সকালের শিলিগুড়ির
কিঞ্চিত ফাঁকা রাস্তা পেরিয়ে সেবকের দিকে। মাঝে দু একবার বলতে চেষ্টা করেছিলুম
বটে, যে খালি পেটে গাড়ি চড়াটা ধর্মে পইপই করে বারন করা হয়েছে। কিন্তু চোরা না শোনে
ধর্মের কাহিনী। ঘন্টাখানেক বাদে সেবকের গৌতম হোটেলে গোটা চারেক আলুর পরোটা খেতে
পেরেছিলাম। তারপরে আবার হুহু করে চলা আর পশ্চিম বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে সিকিম। রাস্তার
অবস্থা মহাজাগতীক। চন্দ্রপৃষ্ঠের বড় করা ফোটোগ্রাফ, মঙ্গলের খাল, বৃহস্পতির ঝড়,
এমনকি ব্ল্যাক হোল পর্যন্ত আছে। হাড়গোড় অনেকটাই আলগা হয়ে এলো। ভাবছি আলগা হতে হতে
যদি কঙ্কালটা চামড়া মাংস ছেড়ে আলাদা হয়ে বেরিয়ে যায়, তাহলে সেটাকে আবার জায়গা মত
ঠেলে-গুঁজে দিতে কতক্ষন লাগতে পারে। এমন সময় হাড়-আলসে দিলো মুখ ঝামটা – আগেই
বলেছিলাম, পাশবালিশ...... এখন মরো ঝাঁকুনি খেয়ে। ঝাঁকুনি-ধুলো-গরম সব মিলিয়ে
অবস্থা এতটাই খারাপ, দেখলুম আমার ঘরের অন্য কেউ আর উচ্চবাচ্চা করলনা। এদিকে রাস্তা
শেষ হবার নাম নিচ্ছেনা। মাঝে জোড়থাং বলে একটা জায়গায় থেমেছিল, কিছু রসদ নেওয়ার
জন্যে। আমার দুই সঙ্গী মক্কেল কোথায় যেন গিয়ে ঝোলায় করে কি যেন একটা এনেছে, আর
মিচকে হাসি হাসছে। জায়গার নামটি ভারি কাব্যিক। জোড়থাং। রাস্তায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যা
যা বিজোড়ের পর্যায়ে চলে যায়, তাকে মিনিট কুড়ির বিশ্রামে জোড়াতাপ্পি দেওয়ার জায়গা
এই জোড়থাং। কিন্তু সে জোড়থাং পেরোবার পরেও বহু সময় পেরিয়ে গেছে। উঠছি তো উঠছিই
পাহাড়ে। একটাই ভাল ব্যাপার, ওপরের দিকে গরমটা কিঞ্চিত কমে আসছে। কিন্তু আগে যে
রাস্তায় কিঞ্চিত পিচের আভাস ছিল, এখানে সেই আভাসটুকুও আর নেই। এর মধ্যে দুদিকের
গাছপালা চেহারা পাল্টেছে। হাওয়া ঠান্ডা হয়েছে। জনবসতি বিরল হয়েছে। রাস্তা সরু থেকে
সরু তর হয়ে হয়ে চলেছে। ভাবলুম শেষে আমাদের গাইড দাদা তিন খানা সাইকেল বের করে না
বলে বসেন, বাকি রাস্তা সরু বলে আর গাড়ি যাবেনা, আপনারা এই সাইকেলে চলে যান। এই
খাড়াই রাস্তায় সাইকেলে চড়তে হলে সত্যি সত্যি আমি ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলব। এমন সময়
দেখি ঘ্যাঁচ করে গাড়িটা থেমে গেল। সামনে আর তেমন রাস্তাও নেই। চারিদিকে বেশ ঘন
জঙ্গল। ঘড়ি বলছে দুপুর তিনটে। পেট বলছে অভূক্ত মানুষের ভ্রমন করা শাস্ত্রে মানা। গাইড
দাদা গাড়ি লক করে বললেন, চলুন এবার হাঁটা।
ছোটোবেলায়
আমার খুব প্রিয় বইয়ের একটা বই ছিল রুশ দেশের উপকথা। সে বয়সে পড়া কিছু জিনিস মাথায়
গেঁথে যায় চিরকালের জন্যে। মনে আছে, রাশিয়ায় দুরত্ব মাপা হত ভার্স্ট দিয়ে, ওজন
মাপা হত পুদ দিয়ে। ইংল্যান্ডে যেমন মাইল আর পাউন্ড। জার্মানি ফ্রান্সে কিলোমিটার
আর কিলোগ্রাম। আমাদের দেশেও এখন সবই মেট্রিক পদ্ধতিতে – কিলোমিটারে দুরত্ব মাপা
হয়। হিলে, মানে পশ্চিম সিকিমের যেখানে আমরা গাড়ি থেকে নেমেছি, সেখানে দুরত্ব মাপার
একক একটু আলাদা। জায়গাটার চতুর্দিকেই পাহাড়, পাহাড় আর পাহাড়। এতটুকু ফাঁকফোকর নেই।
এত হিল নিয়ে হিলে দাঁড়িয়ে আছে ৯ হাজার ফুট উচ্চতায়। এই আর এক চক্কর। ভারতে দুরত্ব
মাপার বেলা কিলোমিটার, উচ্চতার বেলা ফুট। যদিও মিটারে লেখা থাকার একটা সরকারি নিয়ম
আছে, কিন্তু সে নিয়ম সচরাচর খাটেনা। এই হিলে থেকে বাকি এলাকায় দুরত্ব মাপার নিয়ম
একটু বদলে যায়। এখানে দুরত্বের একক কিলোমিটার নয়, সাড়ে-চার কিলোমিটার। শুধু তাই
নয়, জনমনিস্যিহীন এই দেশে আপনি যদিবা কারুর দেখা পান, তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, যে
কোনো জায়গা থেকে যে কোনো জায়গার দুরত্ব, উত্তর আসবে সাড়ে চার কিলোমিটার। পরের কটা
দিন এই সাড়ে চার কিলোমিটারের চক্করে আমরা বেশ কিছুটা...... থাক সে কথা, পরে আসবো।
আপাতত জায়গাটা বড্ড নির্জন। এতটাই নির্জন কান ভোঁভোঁ করে। কেমন যেন একা একা লাগে।
হাড়-আলসে একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মিস্টার স্পক বলে উঠলেন – মনুষ্যজনোচিত আবেগ
বিচারক্ষমতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, উহাকে প্রশ্রয় না দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। স্পক
ভালকান। তাঁর আবেগের পরিমান শূন্য হওয়া উচিত, কিন্তু ভালকান পিতা ও মনুষ্য মায়ের
সন্তান হবার কারনে, স্টার ট্রেকের কোনো কোনো এপিসোডে মিস্টার স্পককেও যথেষ্ট
আবেগের বশীভুত হতে দেখেছি। সে যাই হোক, আবেগ ঝেড়ে ফেলে এলাকাটা আর একটু সরেজমিনে
তদারক করে দেখতে গেলুম। রাস্তার এক ধারে অতলস্পর্শী খাদ। অন্যদিকে আকাশছোঁয়া পাহাড়
উঠে গেছে। ঘন জঙ্গল এই দুপুর তিনটের সময়েও বেশ অন্ধকার। সামনে একটা ছোট্ট গুমটি,
তার ওপরে সরকারি জঙ্গল বিভাগের লাল-সবুজ বোর্ডে লেখা “বার্সে রডোডেন্ড্রন ওয়াইল্ড
লাইফ স্যাংচুয়ারি”। গুমটির ভেতর দেখি একজন ঝিমন্ত কর্মী। আমাদের দেখে দশটাকা করে
নিয়ে টিকিট দিলেন। জিজ্ঞেস করলুম কতটা হাঁটা, উত্তর এল সাড়ে-চার কিলোমিটার।
প্রোফেসর
শঙ্কু আর শঙ্কর দুজনেই বলল, পশ্চিম আফ্রিকার রিখটার্সভেল্ড বা ক্যামেরুন পর্বতের
চিরহরিত আর বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ি জঙ্গলের ওপর দিকটা, নামে ৮-১০ হআজার ফুটের ওপরে
নাকি অনেকটা এই রকম। তেনজিং উৎসাহ দিলেন – হেঁটে যাও, হেঁটে যাও, সাড়ে চার
কিলোমিটার বই তো নয়। হাড়-আলসে বলল, সারাদিন ওই কৌটো মার্কা মারুতি ভ্যানের ভেতর
ফুটকড়াইভাজা হয়েছ, এখন আবার পিঠে ব্যাগ নিয়ে হাঁটবে? বলিহারি যাই বাবা। কে বলেছিল
এসব করতে? বেশ তো ছিল পাশবা......। “চো-ও-ও-ও-প” বলে প্রকান্ড একটা ধমক দিল
আলেক্সেই মেরেসিয়েভ – আমি বলে ১৮ দিন ভাঙ্গা পা নিয়ে বরফের মধ্যে গড়িয়ে গড়িয়ে
জার্মান লাইনের ওপার থেকে নিজের মানুষের কাছে পৌঁছেছিলুম, আর এ তো মোটে সাড়ে চার
কিলোমিটার। মেরেসিয়েভের ফৌজি ধমকের চোটেই হয়ত হাড়-আলসে আবার কোথায় জানি গিয়ে ঘাপটি
মেরে লুকোলো। হাঁটতে গিয়ে দেখি রাস্তা টাস্তা তেমন কিছু নেই, গাছ পালার মধ্যে দিয়ে
হালকা পায়ে চলা দাগ, কোথাও দু একটা পাথর, ধাপের মত কাজ করছে। মন্দার বোস মুখ
খুলেছিল কিছু বলবে বলে, কিন্তু দুষ্টু লোক বলে কান দিলুম না। পায়ের নিচে ভিজে ভিজে
মাটি, গাছের ডালপালা, পাতা পড়ে আছে। সামনের দুই মক্কেল দেখি খিক খিক করে হাসছে
কিছু একটা দেখে। দু পা এগিয়ে আমিও দেখলুম, রাস্তার ওপর পড়ে রয়েছে... ও মা ... এ
কি!!! এ যে অবিকল... মক্কেল দুটো এবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লেগেছে। সেই শুনেই
বোধ হয় গাছের ওপর থেকে “টাঁও টাঁও” করে পিলে চমকানো ডাক ছেড়ে একটা পাখি উড়ে গেল।
রাস্তার ওপর পড়ে আছে অসংখ্য ফল, কোনো গাছ থেকে পড়েছে বোধহয়। আশ্চয্যি ব্যাপার,
ফলগুলো অবিকল মানুষের অন্ডকোষের মত দেখতে। অবাক হয়ে দেখছি আর ভাবছি এই ফলের নাম কি
হতে পারে, এমন সময় লিভিংস্টোন সাহেব বললেন – কিছু একটা নাম দিয়ে দাও হে ছোকরা,
আমিও যেমন বিশাল মোসি-ও-তুনিয়া (বজ্রের ধোঁয়া, আরো ভাল বাংলা নাম আছে, ভুলে গেছি)
জলপ্রপাত দেখে তার নাম বদলে আমার দেশের রানীর নামে ভিক্টোরিয়া ফলস নাম দিয়েছিলুম। পড়লুম
ফাঁপরে। জলপ্রপাতের নাম নাহয় দেশের রাজা-রানীর নামে দেওয়া যায়। রঙ্গী-বিরঙ্গী চৌরঙ্গীকে
বিটকেল জওহরলাল নেহেরু রোড করে ফেলেছি, আমরাই বা কম কিসে? নেহাত আমাদের এখন
রাজা-রানী নেই। কিন্তু এরকম বিদঘুটে ফলের নাম দেশের নেতাদের নামে দেওয়া যায় কি
করে? শেষে আকার প্রকার দেখে সেই নামটাই দিলুম, যেটা সবার আগে মনে এসেছিল। নাম শুনে
দুই মক্কেল খালি “বিচিফল...বিচিফল” বলে আর খিটকেল হাসে। শেষে গাইড দাদা তাড়া
লাগালেন, দেরি করলে নাকি সন্ধ্যে হয়ে যাবে, আর এ জঙ্গলে ভালুক আর চিতাবাঘের
আনাগোনা বেশ ভালোই।
গাছ
পালা এখানে এতটাই ঘন, যে রোদ বা আলো প্রায় ঢোকেই না। বড় বড় পাইন গাছ, বিভিন্ন
জাতের বাঁশ গাছ, লতা, ফার্নে ভর্তি। খুব স্যাঁতস্যাঁতে বলে সব কিছুর ওপর শ্যাওলা
আর মসের পুরু আস্তরন। রাস্তা থেকে পা ফস্কে নিচে পড়লে ঠিক কতটা নিচে গিয়ে পড়তে হবে
ঠাওর হয়না, কারন নিচের দিকে ঘন কুয়াশা। গাছ পালা থেকে সব সময় টুপুর টাপুর করে জলের
ফোঁটা পড়ে চলেছে। সেই আওয়াজ যেমন আছে, তেমনই আছে পাখির ডাক, দূর থেকে কোনো জন্তুর
আওয়াজ, খর খর, ঘষ ঘষ , কত কিছু শব্দ। মোটের ওপর জঙ্গল যে কত জীবন্ত, সেটা পদে পদে
মালুম দিচ্ছে। রাস্তাটা আস্তে আস্তে খাড়াই হতে শুরু করল। প্রথমটা তেমন গা করিনি। কিন্তু
মিনিট পনের পর থেকেই হাঁফ ধরতে শুরু হলো।তার ওপরে সারাদিন কৌটোর মত গাড়িতে
গুটিশুটি মেরে বসেছিলুম, হাঁটু আর কোমর জবাব দিতে শুরু করল। আরো মিনিট পনের ওই
ভাবে কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে চলার পর জিজ্ঞেস করলুম “আর কদ্দুর?” , দুই মক্কেল ও মনেহয়
পরমুহুর্তেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল। গাইড দাদা অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন
কিছুক্ষন আমাদের দিকে। তার পর ঘোষনা করলেন, এখনো নাকি আমরা এক কিলোমিটারও পেরোইনি।
সব্বোনাশ। এতেই যদি এই হয়, তাহলে এতটা পথ যাবো কি করে? এখনই তো কোমর পিঠ জবাব দিতে
শুরু করেছে। আবার ঘোষনা হলো, দুরত্ব সাড়ে-চার কিলোমিটারই বটে, কিন্তু এর মধ্যে
প্রায় ১৪০০ ফুট পাহাড়ে চড়া আছে। ব্যাস। হয়ে গেল। হাড়-আলসেটা বিচ্ছিরি চেল্লামেল্লি
শুরু করল। তেনজিং, লিভিংস্টোন সব কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেলেন বুঝতেও পারলুম না।
শেষমেষ কেশব নাগ এসে কিছুটা ভরসা দিলেন – ধরে নাও পাঁচভাগের এক ভাগ উঠেছ, আরো চার
ভাগ বাকি, তার মানে আরো আধ ঘন্টা গেলেই যা রাস্তা বাকি থাকবে তা মোটে
তিনভাগ......ইত্যাদি......প্রভৃতি। ভদ্রলোকের নামে অনেক বাঘ-সিঙ্গি ঘায়েল হয়েছে।
আমি নেহাত চুনোপুঁটি বলে পর্ষদের মার্কামারা অঙ্কবই পড়েই পিছলে এসেছি। সেধে কে
আর হাঁড়িকাঠে মাথা দেয়? তাই তাড়াতাড়ি আবার হাঁটা লাগালুম। মিনিট দশেক পর দুই
মক্কেলের একজনের জলতেষ্টা পেল, আর একজন বলল তার নাকি এখুনি হালকা হওয়া দরকার। গাইড
দাদা গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন – ছোটো না বড়। ছোটো...ছোটো বলতে বলতেই দ্বিতীয়
মক্কেল দেখি গাছের পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। মিনিট খানেক বিরতি পাওয়া গেল। এদিকে গাইড
দাদা বার বার বলছেন, পথে একবারই থামা হবে, মাঝামাঝি জায়গায়। এদিক ওদিক দেখে, একটা
ছোটো গোছের বাঁশ তুলে নিলাম হাতে। লাঠির মত কাজে লাগবে চলতে। পিঠের ব্যাগটা আস্তে
আস্তে মনে হচ্ছে বিশমন ভারি। ঠিক পনের মিনিট পর এবার দ্বিতীয় মক্কেলের পেল
জলতেষ্টা আর প্রথমজনের “ছোটোর” দরকার হলো। একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে, এতটুকু এদিক
ওদিক নেই।
ঘন্টা
খানেক চলেছি। রাস্তায় ছোটোখাটো অনেক গুলো ঝরনা পেরিয়েছি। জল অসম্ভব ঠান্ডা। এখানে
তাপমাত্রাও অনেক কমে গেছে। ঠিক বুঝতে পারছিনা, কেননা পাতলা জ্যাকেট পরে আমরা
পরিশ্রমের চোটে ঘেমে চান। মাঝে মাঝে মুখে চোখে ঝরনার জলের ছিটে দিয়েছি। ক্রমশঃ কথা
কমে আসছে আমাদের। হাঁফ ধরে যাচ্ছে কথা বললেই। কিন্তু পথের কোনো শেষ দেখছিনা। আমাদের
অবস্থা দেখে শেষে পাঁচ মিনিট যাত্রা বিরতির হুকুম দেওয়া হলো। এদিকে তখন মনে মনে
তুলনা করতে লেগেছি, নাহয় কালী পূজোয় হতোই একটু বোমের আওয়াজ, মাথায় বালিস চেপে নাহয়
সহ্যই করে নিতুম। খোদার খামোখা কেন মরতে এই টং এ উঠতে এলুম রে বাবা! আর তো পারিনা।
এখানে না আছে কোনো আরাম , না আছে কোনো বিরাম। এদিকে সেই সকাল ৯ টায় খেয়েছি, পেটে
দানাপানী নেই। হাত পা ঢিলে হয়ে আসছে। কার পাল্লায় যে পড়লুম...! সামনে পেছনে গাছের
এত ঘন জঙ্গল, যে কোথা দিয়ে এলুম, আর কথায় চলেছি, কিছুই ঠাওর হচ্ছে না তেমন। এ যেন
সেই নিলুবাবুর দিকশূন্যপুর। বড় বড় গাছে সূয্যি-চন্দ্র ঢেকে রেখেছে, ফলতঃ
উত্তর-দক্ষিন-পূর্ব-পশ্চিম ঘেঁটে ঘন্ট পাকিয়ে গেছে। আছে কেবল ওপর আর নিচে। আমাদের
পায়ে চলা রাস্তাও চলেছে সেই ভাবে, পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে। ওপরে উঠছে একটু একটু করে।
পায়ে চলা এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় ওপরে ওঠা খুবই কষ্টকর। কিন্তু নিচে নামা আরো বেশী
কসরতের। তখন পিঠের ব্যাগের ওজনের জন্যে বদলে যাওয়া ভরকেন্দ্র হিসেব করে পেছল
শ্যাওলা ঢাকা পাথরে বা পচা পাতায় ঢাকা গর্তের ওপর পা রেখে ভারসাম্য সামলে নামতে হয়।
আর হাঁটু একটু পরেই জবাব দিতে থাকে। স্যাঁতস্যাঁতে জঙ্গলে , এই উচ্চতায় টুপ টুপ
করে ঝরে পড়া জলের মধ্যে একটা অদ্ভুত বুনো গন্ধ নাকে ভাসতে থাকে, যেটা আর যাই হোক,
খারাপ লাগেনা। বরং বুক ভরে শ্বাস নিলে সামান্য হলেও মনে হয়, একটু তাজা লাগছে।
এতখানি
হেঁটে আর পরিশ্রমে, পেটের চুঁইচুঁই ভাবটা কেমন যেন নেতিয়ে গেছে। আমি দেখেছি, বসে
থাকলে আমার বেশী খিদে পায়, অন্যদের কথা জানিনা। এক এক বার কিছুটা আপাত সমতলে হেঁটে
মনে হচ্ছে যাক, এবার বোধহয় আর উঁচুতে উঠতে হবে না। কিন্তু পরক্ষনেই একটা মোড় ঘুরেই
দেখি সামনে দোতলা কি তিনতলা সমান উঁচুতে দাঁড়িয়ে গাইড দাদা হাত নেড়ে বলছেন এই দিকে
আসুন। এরকম একটা উঁচুতে উঠে দেখি গাইড দাদার সামনে দাঁড়িয়ে আরো দুই মুর্তি। উচ্চতা
পাঁচফুটের কাছাকাছি, মুখের বলিরেখায় বয়স আন্দাজ করা দুস্কর চল্লিস থেকে সত্তর , যে
কোনো কিছু হতে পারে। মাথায় একটা বহু পুরোনো রঙচটা নেপালী টুপি, পায়ে রবারের
গামবুট। আর শতচ্ছিন্ন তাপ্পিমারা প্যান্টের ওপরে একটা রংচটা এফ সি বার্সিলোনার
জার্সির ওপরে হাতকাটা চামড়ার জ্যাকেট, যেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডিসপোজালের মাল
হতেও বাধা নেই। দ্বিতীয়জনের আকার প্রকার অনুরুপ, খালি দৈর্ঘে একটু বেশী, আর মুখের
বলিরেখা কিছু কম। ফোঁৎ করে দম ফেললুম, মুখের প্রশ্ন লুফে নিয়ে গাইড দাদা বললেন
এঁরা দুজন জঙ্গলরক্ষী, ফরেস্ট গার্ড। আরো দু কিলোমিটার দূরে এনাদের একটা ছোটো ঘর
আছে, আজকের রাত্রিবাস আপাতত সেখানেই।এনারা আমাদের অভ্যর্থনা করতে একটু এগিয়ে
এসেছেন। বয়স্কজন (নাম পরে জেনেছি) পুসাই দাজু, মানে পুসাই দাদা এগিয়ে এলেন মুখের
বলিরেখার সংখ্যা দ্বিগুন করে হাসতে হাসতে, পরক্ষনেই আমার পিঠের ব্যাগ নিজের কাঁধে
চালান করলেন। অন্যজন, মানে প্রেম দাজু এগিয়ে গিয়ে বাকি দুই মক্কেলের ব্যাগ হাতে
তুলে নিয়েছেন। ভারমুক্ত হয়ে একটু হাঁফ ছাড়লুম বটে, কিন্তু কেমন কিন্তু-কিন্তু
লাগছিল। লিভিংস্টোন গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন – বইতে পড়োনি চাঁদ? আমিও তো কুলি দিয়ে
কাজ চালিয়েছিলুম, নিজে বয়েছি কটা ব্যাগ? কথাটা শুনে পাভেল কোরচাগিন গেল রেগে –
ব্যাটা রাজার জাত মনে করা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী। আফ্রিকায় যখন পা রাখলে তখন
তোমাদের হাতে বাইবেল, আর সেখানের দেশজ মানুষজের হাতে জমি। কয়েক বছর পর দুনিয়া
দেখলো ওদের হাতে বাইবেল, আর তাবৎ আফ্রিকার জমি তোমাদের হাতে। কালো মানুষ বলে কি
মানুষ না? কুলি আবার কি হে? ওদের কষ্ট হয়না মাল বইতে? ভেবে দেখলুম অবশ্যই হয়।
পুসাই দাজুরও হবে। কিন্তু এই সব ভাবার ফাঁকে দেখি ছোটোবেলার রুশী বইয়ের দাদুর মত
লপাং লপাং করে পা ফেলে পুসাই দাজু হুই দূরে চলে গেছে। সেই তালে তাল রাখতে গেলে
আমাকে ছুটতে হবে, আর সেটা এই ব্যাগের ভারমুক্ত হয়েও কিছুতেই সম্ভব না। অগত্যা
বিবেকের ওপরে ব্যান্ডেড লাগালুম। মধ্যবিত্ত বাঙালির ভারি সুবিধে। আর কিছু সে
পারুক, না পারুক বিবেকে ব্যান্ডেড লাগাতে তার জুড়ি মেলা ভার। অন্ততঃ আমার ক্ষেত্রে
একথা ২০০% সত্যি তো বটেই।
ইতিমধ্যে
দিনের আলো কিঞ্চিত কমের দিকে। দেখলুম এক দেড় মানুষ সমান উঁচু, বা কোথাও কোথাও
ঝোপের মত কেমন এক ধরনের গাছ হয়ে রয়েছে। পাতা গুলো লম্বাটে, কিছু কাঁটাও রয়েছে।
গাইড দাদা বললেন ওগুলো সব রডোডেন্ড্রন গাছ। নভেম্বর মাস বলে এখন ফুল নেই। মার্চ
মাসে এলে পুরো জঙ্গল লাল টুকটুকে হয়ে থাকে। পরে একবার গিয়েছিলুম মার্চ মাসে, চোখ
ভরে দেখেছিলুম ফুলের শোভা। জানা গেল ও ফুলের স্থানীয় নাম গুরাস। আর এই পাহাড়ের
চুড়োর নাম ওই ফুলের নামেই গুরাস টপ। সে চুড়ো কোন চুলোয় কে জানে, আপাতত আমাদের পথের
শেষ দেখতে পাচ্ছিনা। কিছুটা করে যাই, আর দেখি মোড় ঘুরেই আবার ওপর দিকে চড়তে হচ্ছে
চড়াই। আস্তে আস্তে হাত পা কেমন অবশ হয়ে আসছে। পা কেমন নিজে নিজেই ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে
চলছে। তবে পিঠে ব্যাগের বোঝা নেই বলে কিছুটা সুবিধে হচ্ছে এটাও ঠিক। পুসাই দাজু আর
প্রেম দাজু সামনে কোথায় কদ্দুরে চলে গেছে কে জানে। মুশকিল হলো ব্যাগের সঙ্গে জলের
বোতলখানাও চলে গেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। এই ঘন জঙ্গলে দশ বারো ফুটের পর গাছপালার
আড়ালে আর কিছু দেখাও যায় না। শুনলুম নভেম্বর মাস বলে কিছুটা পরিস্কার, নয়ত এই সময়
নাকি ঘন কুয়াশায় জঙ্গল ঢেকে যায়, আর তখন রাস্তা চলা আরো কঠিন হয়ে যায়। একটা চড়াই
উঠে, সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের রিজটা পুরো দেখা দেখা যাচ্ছে। আর আমাদের
রাস্তাটাও ওই দিকেই চলে গেছে। এতটা ওপরে উঠে এসেছি বলেই কিনা জানিনা এখানে বড় পাইন
গাছ খুবই কম। গাছ পালা যা কিছু আছে, সবই ওই রডোডেনন্ড্রন আর ওই রকমের ঝুপসি ঝোপের
মত। পাহাড়ের ওপর দিকে ক্রমশঃ বড় গাছপালা কমে আসে। ১২ হাজার ফুটের ওপরে আর গাছপালা
বিশেষ হয়ওনা তেমন। আমরা যেখানে চলেছি সে জায়গাটা দশ হাজার ফুটের ওপরে। মনে হলো
চড়াই ভাঙ্গা বোধহয় শেষ হতে চলেছে। বস্তুতপক্ষে ঘটনাও তাই ছিল। কিন্তু এখানে এবড়ো
খেবড়ো পাথরের টুকরোর ওপর দিয়ে হাঁটাটা বেশ ঝামেলা হয়ে দাঁড়ালো। অতটা চড়াই ভেঙ্গে,
খালি পেটে তখন পায়ে আর জোর বা নিয়ন্ত্রন, কোনোটাই খুব একটা বাকি নেই। এই এলাকায়
পাখপাখালির শব্দ অনেক কম। কেবল মাঝে মধ্যে চিপ-চিপ করে চুপি চুপি কোনো একটা পাখি
ডাকছে আধোস্বরে। আমার চেতনার ওপর একটা ধোঁয়াটে আস্তরন পড়ে গেছে। এই পাথরে একবার পা
হড়কালে নির্ঘাত গোড়ালি ভাঙবে। তাই অতি সাবধানে দেখে শুনে এগোলুম। প্রায় মিনিট পনেরো
পর দেখি পাথর শেষ হয়ে কিছুটা ঘাস জমি। নরম ঘাসের ওপর পা রেখে শেষ বিকেলের আলোয়
দেখি সামনে পাহাড়টা ঢালু হয়ে নেমে গেছে, আর সেই ঢালুতে, আমার থেকে প্রায় কুড়ি ফুট
দূরে রূশি রূপকথার মত পাথরে তৈরি, কাঠের জানলাওলা, ঢালু ছাতওলা এক খানা ছোট্ট
বাড়ি। বাড়িটা ভাল করে নজরে আনতে গিয়ে মুন্ডু সোজা করে তাকালুম।
চোখের
সামনে ধরে রাখা হাতের মুঠো, হিমালয় পর্বতকেও ঢেকে রাখে। আমার ইশকুলের এক বন্ধু,
ভারত আর দক্ষিন কোরিয়ার ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে বলেছিল – কোরিয়ার পেলেয়ার গুলো সব
ন্যাপালি। তার ধারনায় মঙ্গোলীয় মুখ মানে নেপালিই হয়। চেনা বস্তু ছাড়া আমরা তুলনা
দিতে পারিনা। অ্যাই দেখুন, সেই ডুংলুং ডো কেস। উল্টোপাল্টা বকতে লেগেছি। ঠিক বুইতে
পাচ্চিনা ব্যাপারটা কি করে বলি। ক্লাস সেভেনে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় যখন বাংলায়
একশোয় বারো পেয়েছিলুম, সে সময় আমার মা মুখ দেখেই ঘটনাটা বুঝে নিয়েছিল। কিন্তু
এখানে আমি এই লেখার মধ্যে হেঁড়ে মুন্ডুখানা ঢোকাই কি করে বলুন দিকি? সে যখন হবেই
না, তখন কি আর করা? সেই আমার ন্যাতন্যাতে বারো পাওয়া বাংলাতেই শুনুন ঘটনাটা। দার্জিলিং
থেকে দেখেছি, টাইগার হিল থেকে দেখেছি, পেমিয়াংৎসে-পেলিং থেকে দেখেছি, আর অনেক
জায়গা এমনকি শিলিগুড়ি থেকেও একবার দেখেছিলুম কাঞ্চনজঙ্ঘা। প্রত্যেক বারেই দেখেছি
ওই দূর দিগন্তে সাদা মুকুট পরে ঝকঝক করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ। সে দৃশ্য যতবার, যেমন
করেই দেখুন, পুরোনো হয়না, হতে পারে না। কিন্তু মুশকিলটা হয় যখন দূর দিগন্তে দেখা
বস্তুটা আপনার চোখের পুরো সামনেটা জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে হাত বাড়িয়ে বলে “হেল্লো মাই
ডিয়ার... হাউ ডু ইউ ডু...”। এতটাই কাছে, আমি আর একটু হলে আঙুল বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখতে
যাচ্ছিলুম। শেষে বুঝলুম ওই অত্ত বড় বিশাল প্রাকারের মত আকাশচুম্বি শিখর গুলো এখনো
কিছু কিলোমিটার দূরে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এত কাছ থেকে, এতটা ধরা ছোঁয়ার মধ্যে
কাঞ্চনজঙ্ঘা আমি জিন্দেগিতে দেখিনি, আর দেখবোও না। অন্য জায়গা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা
দেখেছি হাজার লোকের ভিড়ে। তাদের আনন্দ, বিষ্ময়ের সঙ্গী হয়েছি। কিন্তু এখানে এই
মুহুর্তে, শেষ বিকেলের পড়ন্ত আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে থাকলুম কেবল আমি ও আমার আর
দুই মক্কেল, কিছুটা সামনে গাইড দাদা, গোটা পাঁচেক পাহাড়ি মাছি, যে গুলো আমাদের হাঁ
হয়ে যাওয়া মুখের ভেতরেও বার কয়েক চক্কর দিয়ে এল, আর গাছের আড়ালে কোথাও একটা
চিপ-চিপ ডাক দেওয়া পাখি। প্রতিটি রিজ, খাঁজ, বরফের ঝুল-বারান্দা স্পষ্ট দেখছি।
চুড়োর ওপর ঝোড়ো হাওয়ায় উড়তে থাকা ধোঁয়ার মত বরফের কুচির মেঘ দেখতে পাচ্ছি, এমনকি
কান পাতলে যেন শুনতেও পাবো ওই ওপরের শোঁ-শোঁ করতে থাকা হাওয়ার আওয়াজ, এমনটাই মনে
হতে লাগল। তাহলে এই হল বার্সে, এই হলো তার রূপ? এই জন্যে মোটে তিনঘন্টা হাঁটলাম?
তেনজিং দেখলুম মুচকি হাসছেন। হাড়-আলসের পাত্তা নেই।
ছোট্ট
বাড়িটার দরজায় দাঁড়িয়ে দেখি পুসাই দাজু হাতছানি দিয়ে ভেতরে ডাকছে। ভেতরে যাবার
ইচ্ছে করছিলোনা তেমন, বলল চা করেছে, অগত্যা...। চায়ের কাপ নিয়ে বাইরে এসে একটা
পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে আবার কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকালুম। যখন হাঁটা থামিয়েছি, তখন
ঘাড় মাথা দিয়ে টপ টপ করে ঘামের ফোঁটা পড়ছিল। পাঁচ মিনিট হাঁ করে দাঁড়িয়ে
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সময়েই সে ঘাম শুকিয়ে গেল। পরের পাঁচ মিনিটে যাবতীয় গা গরম বিদায়
নিল। আরো পাঁচ মিনিট পর কনকনে শনশনে হাওয়া এসে হাড় পর্যন্ত কাঁপাতে শুরু করল।
চায়ের কাপ দু হাতে করে ধরে চুমুক মারলুম। বেজায় ধোঁয়ার গন্ধ ওলা মিষ্টি কালচে গরম
জল। কিন্তু সেই বস্তুই তখন সঞ্জীবনির কাজ করল। শুধু যে সঞ্জীবনির কাজ করেই সে চা থামল তা নয়, তার পর
সেই দুপুরের মরে যাওয়া খিদেটাকে চাগিয়ে দিয়ে গেল। হাওয়ার ঠেলায় তখন কাঁপুনি লাগতে
শুরু করেছে। ব্যাগ খুলে মাথায় টুপি-টাপা পরলুম। কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজ হলোনা।
কাঁপুনি তখন আয়েস করে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে জাঁকিয়ে বসেছেন, মনে হছে আগামী কাল
সুয্যিদেব মধ্যগগনে না ওঠা পর্যন্ত তিনি আর নড়বেন না। ভাবলুম বাড়ির ভেতর ঢুকি,
তাতে অন্ততঃ হাওয়াটা আটকাবে। দুই মক্কেল আগেই ভেতরে সেঁধিয়েছে। শুধু সেঁধোয়নি,
ঢুকে দেখি বাটি থেকে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা কি একটা বস্তু খাচ্ছে। পাথরের বড় বড়
টুকরোকে খুব অল্প সিমেন্ট দিয়ে গেঁথে এবড়ো খেবড়ো দেওয়াল। দরজা খুব নিচু, জানলাও
খুব ছোটো ছোটো, কাঠের পাল্লাদেওয়া। হয়ত ঠান্ডা থেকে বাঁচতেই। যথেষ্ট উঁচু বলে শীতে
এখানে ভাল পরিমান বরফ পড়ে। ছোট্ট নিচু দরজা দিয়ে ঢুকেই অন্ধকারে প্রথমটা কিছু বোঝা
যায়না। বিদ্যুত সংযোগ আশেপাসে বহু কিলোমিটারের মধ্যে নেই। লোক বসতিই নেই তো
বিদ্যুত থাকবে কোথা থেকে? একটা টিমটিমে টেমি জ্বলছে। তাতেই দেখি, দরজা দিয়ে ঢুকেই
একটা বেশ বড় জায়গা, সেখানে রয়েছে একটা কাঠের টেবিল। অবশ্যই কিঞ্চিত এবড়োখেবড়ো
তক্তার।র্যাঁদা চালিয়ে মসৃন করে তাতে পালিশ করার প্রয়োজনিয়তা কেউ কখনো অনুভব
করেননি। কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার রয়েছে। ডান পাশে আর সদর দরজার ঠিক সামনাসামনি দু
খানা নিচু দরজা, দুটো ঘরের। বাঁ দিকের শেষ প্রান্তে আর একটা দরজা যেটার ওপাশে
রান্নাঘর। আমি ঢুকতেই পুসাই দাজু আমার জন্যেও বাটি ভর্তি ধোঁয়া ওঠা বস্তুটা এনে
টেবিলের ওপর রাখল। দেখি বাটি ভর্তি ঝোল ঝোল ন্যুডল। আহা, বেঁচে থাকো পুসাই দাজু। চামচ
ছেড়ে আগে বাটি ধরে সুড়ুৎ করে চুমুক মারলুম। ও হরি, এ বস্তু তো চেনা। এ হলো ওয়াই
ওয়াই। ম্যাগির মতোই চটজলদি ন্যুডল। নেপাল কা বস্তু, তবে এদেশেও প্রচুর পাওয়া যায়। সমতলের
তুলনায় এঁদের রান্না করার পদ্ধতিটি একেবারেই আলাদা। আর ন্যূডলে বোধহয় সিকিমের
বিখ্যাত ডল্লে খুরসানি লঙ্কা মেশানো হয়েছে রান্নার সময়, কিছু পেঁয়াজ শাকের কুচিও
দেখলুম। ঝালের চোটে চোখে জল এসে গেল। ডল্লে খুরসানি যাঁরা চেখে দেখেছেন, তাঁরা
বুঝবেন, ও লংকার ঝাল আসলে কি বস্তু। আমি খুবই ভালবাসি। ওদিকপানে গেলেই নিয়ে আসি।
ঝাল আর গরমের চোটে তখনকার মত কাঁপুনি একটুখানি তফাতে গেলেন, আর আলী সাহেবের ভাষায়
ওস্তাদি গানের ফাঁকে যেমন ওস্তাদ তবলিয়া চাটিম চাটিম বোল তোলে আর ব্যাঁকা চোখে
গাইয়ের দিকে তাকায়, এও খানিকটা তাই।
দুটো
ঘরের একটা কিঞ্চিত বড়, অন্যটা একটু ছোটো। বড় ঘরের সঙ্গে একটা লাগোয়া বাথরুমও
রয়েছে, তাতে কমোডও বসানো, যদিও জল আনতে হয় বাইরে থেকে বালতিতে করে। কলের জলের
ব্যবস্থা নেই। তাতে কি? এই তো রাজকীয় আয়োজন! ওই পরিবেশে একজন মানুষের আর কি চাইবার
থাকতে পারে ভেবেই পাইনা। ঘরের ভেতর দেখলুম চৌকি পাতা, ওপরে তোষক, আর ভাঁজ করে রাখা
আছে লেপ। লেপ দেখেই মন উচাটন হল। এই ঠান্ডায় লেপের ওম উপেক্ষা করতে পারি এতটা সংযম
আমার নেই। কিঞ্চিত ছোটো ঘরটায় ঢুকে একটা চৌকিতে উঠে লেপ ধরে টানাটানি করছি, দেখি
গাইড দাদা হাঁ-হাঁ করে উঠলেন – করেন কি, করেন কি? এখন লেপের তলায় ঢুকে পড়লে আর
বেরোতে পারবেন না ঠান্ডায়। কি আর করা? অতি অনিচ্ছেয় লেপ ছেড়ে এমনিই গুঁজুপুকুলি
হয়ে বসলুম চৌকির ওপর। পুসাই দাজু আর এক প্রস্থ চা দিয়ে গেল। বলল ঘন্টা আড়াই লাগবে
রান্না করতে, তার পরেই খেয়ে দেয়ে আমাদের সেদিনের মত ইতি। চা খেলুম।ঠান্ডা মিনিট
খানেকের মত গেল, পরে আবার দ্বিগুন বিক্রমে ফিরেও এল। হাতের তেলো, পায়ের পাতা,
নাকের ডগা আর কানের লতি, এই কটা জায়গা ঠান্ডা প্রথম আক্রমন করে। যদিও গায়ে উলিকট,
জ্যাকেট সব কিছু চাপিয়ে বসেছি, তাও ঘরের মধ্যে, কিন্তু কিছুতেই গা গরম হয় না। এদিকে
কোমর পিঠ হাঁটু সব্বস্য টাটাচ্ছে অনভ্যস্ত শরীরে পাহাড়ে চড়ার জন্যে। বসে বসে গপ্প
শুনছি গাইড দাদার। শিলিগুড়ির মানুষ। বিয়ে – শাদি করেননি। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে
বেড়ান, মানুষকে দেখান, নিজেও দেখেন। পেশা ও নেশা একই। একখানি মারুতি ওমনি ভ্যান
আছে, যেটা চালিয়ে উনি আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন। সে গাড়ি হিলেতে লক করা। কেউ যদি
নিয়ে যায়? ধুস, এখানের লোকজন ওরকম না মোটে। আহা, আম্মো যদি আমাদের ওদিকের লোকজন
সম্পর্কে এরকম নিশ্চিন্ত ভরসা দিতে পারতুম অতিথিদের !
গপ্প
শুনেও গা গরম হচ্ছেনা, কেবল ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছি আরো। শেষে দুই মক্কেল জোড়থাং থেকে
আনা সেই ঝোলাখানা বের করল। ঝোলার ভেতর থেকে বেরোল এক খানা এক লিটার স্কচ হুইস্কির
বোতল। রওনা হবার দিন আপিসের একখান সুখবর আসায় দুই বদমাস আমার থেকে পয়সা নিয়ে
রেখেছিল, সেই দিয়েই কিনেছে। সিকিমে এই বস্তু বেজায় সস্তা। দেখি নিজেরা নিলো, গাইড
দাদাকে দিল, আমাকেও একখানা গেলাসে করে একটু খানি এগিয়ে দিলো। এদিকে হাত জমে পাথর,
ধরব কি করে? বললে এক ঢোঁক মেরে দাও, গা গরম হবে। গরম হবে? তাহলে তো ক্যাপ্টেন
হ্যাডকগিরি করতেই হয়। দিলুম গলায় ঢেলে। মিনিট খানেক পর কানের লতি আর নাকের ডগার
ঠান্ডা ভাবটা কমল। বাঃ বেড়ে ওষুধ তো, দাও দিকি বাছা আরএট্টু খানি... । এ বস্তু
খালি পেটে খেতে নেই। কিন্তু সঙ্গে খাবার মত আর কিছু নেইও। জোড়থাং থেকে কেউ একজন দু
প্যাকেট ম্যাগি কিনেছিল। সেই ম্যাগি বের করে ভেঙ্গে চুর চুর করে, তার ওপরে শুকনো
ম্যাগি মশলা ছড়িয়ে দেওয়া হলো। বাঃ বেড়ে বস্তু তো, দাও তো বাছা আর এক পাত্তর...। এবার
গপ্প আরো জমে গেল। ঠান্ডা আর তেমন লাগছেনা। শুকনো ম্যাগি যে এত ভাল খেতে হতে পারে,
তা কখনো ভাবিনি। একটা মোমবাতি জ্বলছিল ঘরে, টিপটিপ করে সেটাও নিভে গেল, এখন বাইরের
টেমির এক চিলতে আলো আসছে ঘরের মধ্যে। দাও তো বাপু আর এক পাত্তর, সাবধানে ঢেলো,
অন্ধকার বলে কতা। ডেভিড লিভিংস্টোন মুচকি হাসলেন - দেকেচো বাছা, আমার দেশ
স্কটল্যান্ডের জিনিস কেমন তোমার ইন্ডিয়ান ঠান্ডাকে কাবু করে ফেলেচে? যা বলেছেন
স্যার, কাবু বলে কাবু? ঠান্ডা না গরম, তার টেরটি পর্যন্ত পাচ্ছিনা। আসুন স্যার,
আপনার স্বাস্থ পান করি। কই হে, দাও তো বাপু আর এক পাত্তর। তেনজিং দাজু, আপনিও কি
বাদ যাবেন? না না, তাই কি হয়? ক্যাপ্টেন কার্ক, শার্লক হোমস, আরো যাঁরা যাঁরা
আছেন, তাঁদের সবার নাম করে এট্টু এট্টু দাও তো বাছারা।
গল্প
কি নিয়ে হলো, কতক্ষন হলো, সেই সম্পর্কে দেখলুম আমার স্মৃতি মোটেই কিচ্ছুটি বলতে
চাইছেনা। তবে একটা সময় পর, দুই মক্কেলের একজন ছোটোবাইরে করতে গিয়েছিল, এবং চেঁচিয়ে
আমাদের বাইরে আসতে বলল। বাকিরা গেল, আমি বসে রইলুম। মাথাটা বড্ড হালকা হালকা
লাগছে, বাইরে গেলে যদি দেহ ছেড়ে হুশ করে ওপর দিকে উড়ে যায় তখন কি হবে? তার চেয়ে বসে
আছি বাবা, এই ভাল। কিন্তু গাইড দাদা বসে থাকতে দিলেন কই? ঘরে এসে বললেন শিগগিরি
বাইরে আসুন, কত তারা দেখা যাচ্ছে, ভাবতেও পারবেন না। তারা? তাই বুঝি? ওপরে তাকিয়ে
দেখি সত্যিই তো, অনেক তারা। একেবারে ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। অবাক হয়ে বললুম, সত্যিই
তো, কত তারা ...... এত তারা জীবনেও দেখিনি। গাইড দাদা এবারে নড়া ধরে টেনে তুললেন
আমাকে – এখানে ঘরের ভেতর কি তারা দেখছেন? আসুন বাইরে। একটা চেয়ার পেতে বাইরে আমাকে
বসিয়ে বললেন, এবার দেখুন দিকি আকাশের দিকে। ও মা ! এ কি বিদঘুটে কান্ড। এ তো মনে
হচ্ছে গোটা আকাশে থিক থিক করছে একেবারে, এক ইঞ্চি জায়গাও খালি রাখেনি। সব্বোনাশ,
আমি নেশার ঘোরে বেশি বেশি দেখছিনা তো? গাইড দাদা এদিকে বলে চলেছেন - ওই দেখুন
কালপুরুষ, ওই যে লুব্ধক, এই খানে সপ্তর্ষী মন্ডল আর ওইটা হলো......। আকাশে আবার আলোর
মেঘ করেছে দেখছি, এই দিক থেকে ওই দিক চলে গেছে। শুনতে পেলুম ওইটে নাকি ছায়াপথ,
আকাশগঙ্গা, মিল্কিওয়ে... যে যেমন পারে নাম দিয়েছে। হাঁ করে চেয়ে রইলুম। এরকম আকাশ
আমি কোনোদিন দেখিনি। শুনতে পেলুম ক্যাপ্টেন কার্কের গম্ভীর গলা বলে চলেছে – “ SPACE, THE FINAL FRONTIER……”
এদিকে
পড়লুম মহা মুশকিলে। মিনিট কয়েক যায়, আর দুই মক্কেল বা গাইড দাদার মধ্যে কেউ এসে
জিজ্ঞেস করে, আমার মাথা ঘুরছে কিনা, বমি পাচ্ছে কিনা, শরীর খারাপ লাগছে কিনা।
কিচ্ছুটি হচ্ছিলোনা এসব। যতই বলি, আবার একটু পর ঘুরে এসে জিজ্ঞেস করে। শেষে রেগে
মেগে বললুম প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। এইবার বাকিরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মনে হলো। ঘরের ভেতর
তারা দেখার পর যে সন্দেহের বাতাবরন তৈরি হয়েছিল, পেটের আগুন তাকে পুড়িয়ে ছাই করে
দিল। রান্নাঘর থেকে “ফিইইইইইস” করে একটা কুকারের সিটি শুনতে পেলুম। কয়েক মিনিট পর
আবার পুসাই দাজুর সদাহাস্যমুখ ঘোষনা করল খানা তৈয়ার।টেবিলের ওপর অনেক গুলো ধোঁয়া
ওঠা পাত্র। লম্ফর আলোয় দেখতে পেলুম, ডাল রয়েছে, ভাত রয়েছে, একটা তরকারিও যেন দেখছি
আর একটা ঢাকা দেওয়া বাটিতে কিছু একটা আছে। খিদে ছিল জব্বর, প্রথমে থালায় এক কাঁড়ি
ভাত তুললুম, তাতে ডাল মেখে একটু তরকারির টাকনা দিয়ে খেতেই চমকে উঠলুম। প্রত্যন্ত
এলাকায়, ঘন জঙ্গলের মধ্যে সাড়ে দশ হাজার ফুট উচ্চতায় একটা পাথরে তৈরি কুঁড়ে ঘরে
দুই প্রৌঢ় জঙ্গলরক্ষীর হাতে এতখানি যাদু থাকতে পারে, এটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো
না। বললে পেত্যয় যাবেন না, সাধারন বাঁধাকপি আর আলুর তরকারি যে এমন স্বাদের হতে
পারে, তা বিশ্বাস হয় না। নেপালি কায়দার রান্নায় তেল এবং মশলার ব্যবহার বেশ কম,
এখানে বোধহয় আর কম। বরং ঝালের প্রভাব কিঞ্চিত বেশি। মোটের ওপর গড়পরতা বাঙালি
রান্নার চেয়ে খুব আলাদা কিছু নয়। আলু বাঁধাকপির তরকারিতে পড়েছে কিঞ্চিত পেঁয়াজ আর
আদা, বাঁধাকপি কাটা হয়েছে বড় বড় টুকরো করে, অল্প হলুদ আর লংকা। টমেটোও বোধহয় ছিল।
তাই দিয়েই কামাল। ছোটো একখানা ডিশে কিছু পেঁয়াজ, কাঁচালংকা আর লেবু ছিল। সেগুলো
দিয়ে ব্যাপারটা আরো জমে গেল। কোনো কথা নেই কারোর মুখে, হাপুস হুপুস চলছে। এমন সময়
কেউ একজন চাপা দেওয়া বাটির ঢাকনাটি উন্মোচন করল। এক রাতে আর কতবার অবাক হবো?
টুকটুকে লাল ঝোলের মধ্যে থেকে উঁকি মারছে মুরগির ঠ্যাং। গাইড দাদা কইলেন, এ নাকি
বুনো মুরগি। অল্প মেথি ফোড়ন, তাতে পেঁয়াজ রশুন আদা, কষে লংকা দেওয়া, কিঞ্চিত হলুদ,
ধনে-জিরেও আছে, আছে টমেটোও, আর আছে প্রচুর ধনেপাতা। মাইরি বলছি আপনাকে, এমন মুরগি
রান্না ফাইভস্টারের চিফ শেফও পারবেনা। অবর্ননীয়। চেঁচেপুঁচে খেয়ে নড়বার ক্ষমতা
ছিলোনা। কোনোক্রমে উঠে হাত ধুলুম। পুসাই দাজু গরম জলের জগ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এর
পরে একটাই কম্ম বাকি। লেপের তলায় ঢোকা। গাইড দাদা বললেন, ভোর বেলা ডেকে দেবেন,
কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর সূর্য্যদয় দেখতে।
অতিরিক্ত
ধকল, উচ্চতা, অতিভোজন নাকি অন্য কোন কারন ঠিক জানিনা, কিন্তু রাতে ভাল ঘুম হলো না।
ঘরের বাইরে থেকে সমানে খুটখুট, খশখশ, ফোঁসফোঁস, গরগর নানা রকম আওয়াজ আসছে। কারা
যেন ঘোরাঘুরি করছে বাইরে। গাইড দাদা পাশের চৌকি থেকে বললেন, ভয় পাবেন না, ঘরের
ভেতরে ঢোকেনা, ওরা শুধু বাইরেই ঘোরে। কি জানি কি জন্তু, কত বড়, কি চায়। বাইরে
ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরের ভেতরেও তাই। এত অন্ধকার কেমন যেন বুকে চেপে বসে। আধা
ঝিমুনি, আধা জাগরনে রাত কাবার হয়ে এল। ঘড়িতে দেখলুম সাড়ে চারটে। ভাবলুম উঠি, আর তো
কিছু পরেই সূর্য্য ওঠার পালা শুরু হবে। কিন্তু লেপ সরাতেই তীব্র শক। কি মারাত্মক
ঠান্ডা রে বাবা। এই ঠান্ডায় লেপ ছেড়ে বেরোবার প্রশ্নই আসেনা। কিন্তু ওদিকে অন্য
সমস্যা দেখা দিচ্ছে, ছোটোবাইরের আসু প্রয়োজন। তলপেট আর আরামের দড়িটানাটানি চলল
কিছুক্ষন। শেষে উঠতেই হলো। বাথরুম ঘুরে এসে, আবার লেপের তলায় ঢুকতে গিয়ে কি মনে
হলো, লেপটা তুলে ভাল করে গায়ে জড়ালাম। ওদিকে দেখি গাইড দাদাও উঠে পড়েছেন। উনিও
গায়ে লেপ জড়ালেন। তার পর দুই মক্কেল যে ঘরে শুয়েছিল সে ঘরের দরজায় ধাক্কা মেরে
ওদের ডাকা হলো। দু একটা উঁ আঁ শুনে হাঁক দিয়ে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। খুব হালকা
আলো ফুটেছে, আর তাতেই দেখলাম একটা অপূর্ব দৃশ্য। সামনের ঘাসজমি ঢাকা পড়ে গেছে মিহি
বরফে। গাছের পাতায়, ডালে সর্বত্র মিহি বরফ। ধপধপে সাদা হয়ে আছে সব। বাড়ির ঢালু
ছাতে, পাথরের ওপর রাস্তায় সর্বত্র বরফ। ওদিকে কালচে অন্ধকার আকাশের বুকে খুব হালকা
গোলাপী আভা লাগতে শুরু হরেছে কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োয়। ওই দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম।
দুই মক্কেল এসে যোগ দিল। চারিদিক একেবারে ঘোর নিস্তব্ধ। একটা পাখিও ডাকছে না। একটু
একটু করে গোলাপীর আভা ছড়িয়ে গেল পাহাড়ের চুড়ায়, আকাশে। তার পর সে গোলাপি লাল হতে
শুরু করল, টকটকে লাল, কয়েক সেকেন্ড পরে আগুনের মত উজ্জ্বল কমলা হয়ে শেষে পরিনত হলো
কাঁচা হলুদে। রাহুল সাংকৃত্যায়ন কানে ফিসফিস করে বললেন – এবার বুঝেছ চাঁদ? মানুষ
কেন ঘর ছাড়ে? কোন টানে বিবাগি হয়ে যায়? তোমার মত লুঙ্গি পরে বসে থাকতুম যদি, যদি
না বেরোতুম বাড়ির বাইরে তাহলে আমার লেখা “ভবঘুরে শাস্ত্র” বইখানা পড়তে পেতে?
অনেক্ষন দাঁড়িয়েছিলুম, তাই দেখে ওই কাকভোরে পুসাই দাজু হাতে একটা করে চায়ের কাপ
ধরিয়ে দিয়ে গেল। লোকটা কি ঘুমোয়না? কিন্তু চায়ের কাপ একটা বিচ্ছিরি সমস্যায় ফেলে
দিল। গরম চা পেটে পড়তেই আমাকে এমন এক জায়গায় যেতে হলো, যেখানে ঐ কনকনে বরফঠান্ডা
জলের ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয়। অবিশ্যি যা হলো ভালোই হলো। সকাল সকাল ব্যাপারটা মিটে
গেল। পুসাই দাজু এসে জিজ্ঞেস করে গেল আমরা কখন বেরোবো। সেরেচে্, আবার কোথায় যেতে
হবে? গাইড দাদা বললেন গুরাস টপ। স্থানীয় ভাষায় গুরাসতাল।
টপ
বললেই তো টপ করে টপে উঠে পড়া যায়না। সেটা কত দূর, কতক্ষন লাগে, কি আছে সেখানে, এসব
দু চারটে প্রশ্ন করেই ফেললুম। দুরত্বর ব্যাপারটা খুব সোজা। পশ্চিম সিকিমে সব
জায়গার দুরত্বই সাড়ে চার কিলোমিটার। আমরা সকাল সাতটায় বেরোলে নাকি ফিরে এসে দুপুরে
ভাত খেতে পারব। কি আছে সেখানে? ওখান থেকে নাকি সগরমাতা দেখা যায়। সেরেচে, সেটা কি
বস্তু? সগর? মানে কি সাগর? কিসের সাগর? কার মাতা? ভেঙে বললেন গাইড দাদা। নেপালিতে
মাউন্ট এভারেস্টকে বলে সগরমাতা। হয়ত বহু লক্ষ বছর আগে টেথিস সাগরের তলায় ছিল বলেই।
হিলারি আর তেনজিং দুজনেই পিঠ চাপড়ে দিলেন – চিয়ার আপ ম্যান। আজ তুমি দেখবে, আমরা
দুটিতে কোথায় উঠেছিলুম। এই সুন্দর ঝকঝকে সকালে, লাফাতে লাফাতে চলে যাও। রান্নাঘরে
উঁকি মেরে দেখি প্রেম দাজু রুটি বেলছে আমাদের জলখাবারের জন্যে। রুটিবেলার বেলনটি
অদ্ভুত। একখানা বিয়ারের খালি বোতল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। টেবিলে গরমাগরম রুটি
আর আলুর তরকারি এসে গেল। যথারিতি তরকারির স্বাদ অবাক করে দেবার মত ভাল। কি জানি কি
করে রান্না করে এরা, কি দেয় , যার জন্যে এমন অসম্ভব ভাল অথচ ঘরোয়া স্বাদ হয় খাবারের।
আজ সঙ্গে মালপত্র নেই। শুধু তিন বোতল জল নেওয়া হয়েছে, আর একটা ফ্লাস্কে কালো কফি।
কফি আমরাই এনেছিলাম সঙ্গে করে। পুসাই দাজু সামনে চলেছে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে বলে। প্রথম
আধ ঘন্টা দিব্যি চললাম। প্রায় গতকালের মতই। খুব বেশী চড়াই নেই। ডান দিকে তাকালেই
প্রাকারের মত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। রাতের বিশ্রাম আর খাওয়াদাওয়ার পর দিব্যি
তাজাও লাগছে। কিন্তু তখনো বুঝিনি বিধাতা অলক্ষ্যে মুচকি হাসি হাসছেন।
ধিরে
ধিরে চড়াই বাড়ছে। পথের চিহ্ন বিলুপ্ত হচ্ছে। আরো উঁচুতে উঠছি বলে বড় গাছ ক্রমশঃ
কমে আসছে। যদিও খুব ঠান্ডা, তাও রোদের জৌলুস সাংঘাতিক। চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। চড়াই
বাড়তে বাড়তে একটা সময়ে একেবারে খাড়া সিঁড়ির মত উঠে যাচ্ছে মনে হলো। একটানা ওঠা
অসম্ভব। মিনিট তিরিশেক পর পর বিশ্রামের জন্যে বসা হচ্ছে, আর পুসাই দাজুকে জিজ্ঞেস
করা হচ্ছে, আর ঠিক কতটা। পুসাই দাজু প্রতিবারেই অভয় দিয়ে বলেছে, আর একটুখানি,
প্রায় এসেই গেছি। সকলেই যায়। আমরা এত দূর এসে এটুকু দেখে না গেলে আফশোষ থেকে যাবে।
পুসাই দাজুর কথাতেই ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে উঠছি সমানে। সবাই যায় যখন, আমরা যাব না কেন? এই
করতে করতে প্রথম সন্দেহ প্রকাশ করল আমার মধ্যম মক্কেল। তারই অবস্থা আমাদের মধ্যে
সবচেয়ে কাহিল। বলল, সকলেই যদি যায়, তাহলে তো চলাচলের একটা রাস্তার দাগ অন্ততঃ
থাকবে। কিন্তু এখানে সেরকম কিছুই নেই। এদিকে প্রায় ১১টা বাজে। চার ঘন্টা হেঁটে
চলেছি। শেষে আর থাকতে না পেরে, পুসাই দাজুকে বললাম, সাড়ে চার কিলোমিটার আর কখন
হবে? মুখের বলিরেখার সংখ্যা দ্বিগুন করে পুসাই দাজু জানালো, সাড়ে চারের থেকে হয়ত
অল্প একটু বেশীই হবে। বেশী? এই এতক্ষন হেঁটে বেশী? আর কতটা দাজু? সত্যি সত্যি বলো।
অনেক হিসেব নিকেশ করে দাজু জানালো আরো আধঘন্টাটাক। আধঘন্টায় হয়নি, আরো প্রায়
ঘন্টাখানেক লেগেছিল। এবং শেষে ওই ঘন ঝোপঝাড় পার করে গুরাস টপে উঠে দেখলাম তাঁকে।
সগরমাতা। মাউন্ট এভারেস্ট। ভাবিনি কোনোদিন চোখে দেখতে পাবো। তেনজিং বললেন যাক তবু
চোখের দেখাটুকু হলো। হাড় আলসে বলল ছবিতে দেখলেই তো হতো। মিস্টার স্পক বললেন – আবেগ
যুক্তিহীন হলেও, অভিষ্টে পৌঁছলে মনুষ্য আবেগ ও অহংবোধ তার অভিপ্সাকে বাড়িয়ে দিতে
সাহায্য করে। দুই মক্কেল জিজ্ঞেস করল, বাকিদের কতক্ষন লাগে আসতে? পুসাই দাজু
সবিনয়ে সত্যিটা ভাঙল এবার। ৯০% লোকেই পুরোটা কেন অর্ধেক পথও আসতে পারে না। তাই
পায়ে চলা পথেরও তেমন চিহ্ন নেই। খুব কম কিছু লোকজন আছেন, যাঁরা পুরোটা উঠেছেন।
আমাদের মুখ ঝুলে এই অ্যাত্ত বড় হাঁ। বাকিটুকু ভাঙলেন গাইড দাদা, এই পথটুকু নিয়ে
আসা নিয়ে যাওয়ার জন্যে পুসাই দাজু পাবে ১০০ টাকা। ভেবে দেখুন, ১০০ টাকা, যার জন্যে
লোকটা আমাদের তিন বোতল জল, আর এক ফ্লাস্ক কফি নিয়ে পাঁচ ঘন্টা এই খাড়াই পাহাড়ে
উঠেছে। রাস্তায় মাঝে মধ্যে কি সব শাকপাতা পেয়ে সেগুলো কেটে ঝোলায় পুরেছে রাতে
রান্না করবে বলে। চুড়ায় বসে কফি খাওয়া হলো। পুসাই দাজুকে দেখছিলাম। শুনলাম নিয়মিত
মাইনে এসে পৌঁছয়না। কাছের (নির্ঘাত সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে) কোন গ্রামে নাকি বৌ
মেয়ে থাকে। এই দু একজন আমাদের মত শখের ট্যুরিস্ট এলে সামান্য রোজগার। আর সেই জন্যে
এই অমানুষিক পরিশ্রম। কিন্তু মুখের হাসি ফাইভস্টারের মত ফ্রেমে আঁটা নয় লোকটার।
মনের ভেতর আনন্দ আছে, খুশী আছে, নইলে এরকম নির্মল মুখে কেউ হাসতে পারে না। ফেরার
আগে শেষবারের মত সগরমাতার দিকে তাকালাম।
নামার
সময় কিঞ্চিত জলদি হলো। পুরোটাই উৎরাই। যদিও হাঁটুর অবস্থা বলার মত রইল না। মাঝে এক
দুবার বিশ্রামের জন্যে থামা হয়েছিল, কিন্তু ওদিকে প্রেম দাজুর গরম গরম ভাতের থালার
টান উপেক্ষা করে বেশীক্ষন বসে থাকা যায়নি। দুপুর তিনটে নাগাদ আমরা আবার ফিরে এলাম
পুসাই দাজুর কুঁড়েঘরে। বাড়িটার নাম গুরাস্ কুঞ্জ। দেখি প্রেম দাজু আমাদের জন্যে
বিশাল এক ডেকচি গরম জল করে রেখেছে। দুপুরে রোদের তাপে বরফ সব গলে গেছে। এতটা
পাহাড়ে উঠে আমাদের ঠান্ডাও একেবারেই লাগছেনা, তাই ঝপাঝপ গরম জলে চান করে ফেললুম
আমরা। আর সঙ্গে সঙ্গেই হাজির হলো গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালা। খেয়ে দেয়ে দুই
মক্কেল ঘরে ঢুকে লম্বা দিল। আমি একটা চেয়ার নিয়ে বাইরে রোদে বসে রোদ পোয়াতে
লাগলুম। চারিদিকে যতদুর দেখা যায় শুধু পাহাড় আর জঙ্গল। কোথাও লোকালয়ের সামান্যতম
চিহ্নও নেই। উত্তর-পশ্চিমে কাঞ্চনজঙ্ঘা দাঁড়িয়ে আছে। বিকেল হয়ে গেছে বলে মেঘেরা
নিচে থেকে উঠে আসতে শুরু করেছে। কেমন ঝিমঝিমে একটা পরিবেশ। কখনো ভাবিনি, এভাবে
এখানে বসে থাকবো। আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে এল, এবং পাল্লা দিয়ে তাপমাত্রা কমতে
থাকল। সিরসিরিনি দিয়ে শুরু হয়ে, সেই কাল রাতের কাঁপুনি দ্বিগুন উল্লাসে ফিরে এলো। টুপি
জ্যাকেট সব চড়িয়েও ঠক ঠক করে কাঁপুনি কমছেনা। দুই মক্কেল আবার অল্প একটু ঘুমিয়েছে,
তাই ওদের অবস্থা আরো খারাপ, শীত ওদের ওপর আরো জাঁকিয়ে বসেছে। গাইড দাদা পুসাই
দাজুকে বললেন একটু আগুনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। এর আগে আপিসের লোকজনের সঙ্গে
সমুদ্রের ধারে রিসোর্টে রাত কাটাতে গিয়ে দেখেছি, আগুন জ্বালার জন্যে তাঁরা প্রায়
হাজার খানেক টাকা দাবী করেছিলেন। গাইডদাদাকে সে কথা বলতে উনি খুব একচোট হেসে
বললেন, আপনার যদি মন চায়, কাল সকালে বেরোবার আগে, ওকে কুড়িটা টাকা বখশিস দিয়ে
যাবেন, তাতেই হবে।
সামনে
শুকনো গাছের ডালপালা দিয়ে তৈরি করা আগুন পটপট শব্দ করে জ্বলছে, আর উত্তাপ ছড়িয়ে
দিচ্ছে শিরায়-ধমনিতে। পুসাই দাজু চা আর পেঁয়াজ-লঙ্কা-বেসন দিয়ে ভাজা পকোড়া দিয়ে
গেছে। খাচ্ছি আর ভাবছি, বখশিসের কথা। বখশিস কাকে দেয়? কে দেয়? কেন দেয়? বখশিস দিলে
আমার আর পুসাইদাজুর মধ্যে একটা অদৃশ্য সিমারেখা কি তৈরি হবে না? আমি যে আসলে সেই
আগমার্কা বাঙালি-বাবু কালচারের প্রতিভু। টাকা দিয়ে কি ওরকম নির্মল হাসিমুখের মূল্য
চোকানো যায়? অথচ লোকগুলো চরম দারিদ্রের মধ্যে থাকে। কুড়িটা টাকাও ওদের কাছে অনেক।
হয়ত পরিবারের তিন জনে এক বেলা ডিম খেতে পাবে। কত কি অদেখা অজানা রয়ে যায়। বেরোবার
আগে ভাবিনি এই রকম ধকল হবে, আগে থেকে আন্দাজ করলে হয়ত স্রেফ সোজাসাপটা না বলে
দিতাম। আমি অত্যন্ত আরামপ্রিয় লোক, অন্ততঃ নিজেকে তাই ভাবি। কিন্তু এখানে এসে,
নিজের সম্পর্কেই ধারনা কিঞ্চিত বদলাচ্ছে। আমি কি উপভোগ করছি? না কি কষ্ট করছি?
আবার কি আসবো? নাকি মনে হবে এতটা পাহাড় টপকে এই দৈন্যে ভরা কুঁড়েতে আসাটা নেহাতই
বাজে খরচ? কেমন ভাবে থেকে যাবে এই স্মৃতি আমার মনে? এক দিকে মন বলছে, আর মোটে এক
দিন, কাল রাতেই শিলিগুড়ি থেকে ট্রেন, পরশু বাড়ির আরাম। হাজার বার কেউ বললেও আর
আসছিনা এই ভাবে। অন্যদিকে অন্যকেউ বলছে, এখানে আবার আসতে হবে তোমাকে। এতটা কষ্ট
করেই, কষ্ট পেরিয়ে। বাড়ির আরাম তোমাকে আটকাবে না।
তোমার ঘরে বাস করে কারা
ও মন জান না,
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,
মন জান না
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা
এক জনায় ছবি আঁকে এক মনে,
ও রে মন
আরেক জনায় বসে বসে রংমাখে
ও আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে
কোন জনা,কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা
এক জনায় সুর তোলে এক তারে,
ও মন, আরেক জন মন্দিরাতে তাল তোলে
ও আবার বেসুরো সুর ধরে দেখো
কোন জনা, কোন জনা
তোমর ঘরে বসত করে কয় জনা
রস খাইয়া হইয়া মাত, ঐ দেখো
হাত ফসকে যায় ঘোড়ার লাগাম
সেই লাগাম খানা ধরে দেখো
কোন জনা, কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা
পরের দিন সকালে পুসাই দাজুর হাতে, কিছু
টাকা দিয়ে এসেছিলাম। বখশিস। আর স্কচ হুইস্কির বোতলের কিছুটা বাকি ছিল, সেটাও। একই
স্বাদ ভাগ করে নিতে।
Fatafati Somnath.. monemone Ami o khanik beriye elam.. ar ki chai ..aro notun kichu pabo ashakori
উত্তরমুছুনএকবার ঘুরেই এসো। ভাল লাগবে।
মুছুন"Unputdownable" - ফেলুদা শব্দটা ব্যবহার করেছিল একটা বই পড়তে পড়তে, কোন বই সেটা এখন আর মনে নেই। কিন্তু, আমি আজ থেকে ৩০ বছর পরেও বলতে পারবো, কোন লেখাটা পড়ে আমার এই শব্দটা মনে হল। এটা আমি cloud এ যত্নে সঞ্চয় করে রাখছি, তোমার অনুমতির তোয়াক্কা না করেই!
উত্তরমুছুনআমি জানি আমি মাঝেমধ্যেই বেশী বকি, বিশেষত তোমার লেখা পড়ে কমেন্ট দিতে গিয়ে সেগুলোও ছোটখাটো একটা লেখা হয়ে যায়! কিন্তু কি করব, ওই, আমি তো আর মিস্টার স্পক নই, বরং উল্টোটাই, ইমোশনাল ফুল। তাই আবেগের উচ্ছ্বাস টা বার না করলে রাতে ঘুম হবে না!
তোমার লেখার ধরণ নিয়ে আমার নতুন করে কিছু বলার নেই, দিন দিন মানিকবাবুর মত তথ্যে ভরা সহজতম লেখা বেরোচ্ছে তোমার কলম থেকে। এটা আগেও বলেছি, তাই আর বেশী বললুম না এটা নিয়ে, নাহলে তোমার কান রক্তবর্ণ হোক এটা আমি চাই না।
লেখাটা নিয়ে বরং একটু বলি। যে যে ঘটনার কথা লিখেছো,সবগুলোই তোমার মুখে বিভিন্ন সময়ে শোনা আমার। প্রশ্নটা হচ্ছে, তা সত্ত্বেও আমি কি করে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম লেখাটা, একটুও বোর না হয়ে?
উত্তর দুটো...
১. চোখের সামনে দেখতে পেলাম বার্সে আর গুরসতালের সব মূহুর্তগুলো। মানে, আরেকবার ঘুরে এলাম, এটা তিন নম্বর বার। ও হ্যাঁ, আবার যাবো, তুমিও যাবে সেটাও জানি।
২. "তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা", আমার সীমিত জ্ঞানে যতদুর জানি, এটা বাউল গান। আর সুর করে গাইলে, এটা শুনতে আমার দারুণ লাগে, একটা আবেশের মত অনুভূতি হয়।
আর বেশ কিছুকাল ধরেই আমি এমন কিছু কাজকম্ম করে যাচ্ছি, বা ভাবছি, যাতে নিজেকে বাউন্ডুলের থেকে খুব আলাদা কিছু মনে হচ্ছে না আজকাল!
তো, এই লেখার মধ্যে এই গানের কথাগুলোর ব্যবহার আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কি ভাবনা, সেটা নিয়ে একটা লিখবো যখন ভাবনার যটটা ছাড়বে। তবে, এটা বলতে পারি, লেখার নামটা দেখে কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই যে লেখাটা কি নিয়ে। আর পড়ার পর এটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই যে এই লেখার নামকরণ এটা ছাড়া আর কিছু হতেই পারতো না!
আমি কোনোভাবে কাউক্কে ছোট না করেই বলছি, এই নামকরণ টা আক্ষরিক অর্থে বুঝতে গেলে, আগে সেই কাজগুলো করতে হবে যেটা এই সমস্ত বিশ্ববরেণ্য ক্ষ্যাপা লোকগুলো করে গেছেন, বা আমাদের দিয়ে করিয়ে যাচ্ছেন এখনো।
সবশেষে বলি, চাকরি বাকরি ছাড়ো, পাহাড়-সমুদ্দুর-জঙ্গল আর তাদের গল্প, এইসব দিয়েই চলে যাবে বাকিটা জীবন! আমরা তো আছিই শোনার জন্যে, সেই গল্প!
রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভবঘুরে শাস্ত্র। অবশ্যপাঠ্য।
মুছুনবলেছিলে বটে। পড়তেই হচ্ছে
মুছুনকি বলি বলতো। মনে হচ্ছে তোর ভ্রমনের বাকী দুজন যাত্রা সঙ্গীর একজন আমি নিজে। মনে অদ্ভুত একটা আমেজ এল। দুর্দান্ত এক ভ্রমন কাহিনী।
উত্তরমুছুনসে তো একবার চলে গেলেই হয়।
মুছুনদু'হাজার দশ সালের লেখা অথচ এতটাই ভালো যে পড়তে পড়তে এই সতের সালে বাসের দু দুটো স্টপেজ পরে নামতে হল। খেয়াল ছিলনা নামার কথা। রসে টইটম্বুর। বিবরণে ব্যপ্তি। ভ্রমণের সবই পেলাম। অনেকদিন পর পেলাম এমন লেখা।
উত্তরমুছুনহাঁটার গপ্প পড়ে শেষে এতটা হাঁটতে হবে এইটে বুঝিনি ভাই। কিছু মনে করিসনি , তোকে একদিন পুসাই দাজুর রেসিপির মুর্গি খাওয়াতে পারি।
মুছুনসাধ্যে কুলোলে তোর হাতটা সোনায় বাঁধিয়ে দিতাম! কি লিখেছিস!!!
উত্তরমুছুনখাইসে। তাহলে পেছনে গব্বর সিং লেগে যেত। "ইয়ে হাত মুঝে দে দে" বলে... :P
মুছুনtui aro lekh.amr r bpi lagbe na.parle roji lekh na baba.
উত্তরমুছুনযতটা পারি, লিখতে চেষ্টা করি মা।
মুছুনসোমনাথ দা, বহুদিন হয়ে গেল, নতুন লেখা নেই! আরো লেখা চাই, খুউব ই ভাল লাগে তোমার লেখা!
উত্তরমুছুনআসলে অনেকলো লেখা আধখানা করে হয়ে পড়ে রয়েছে। দেখি আগামী সপ্তাহে একখানা যদি....
মুছুন