বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

হাড়হিম হিমবাহ (রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ)

আমার খুব ইচ্ছে, জীবৎকালে একটিবার, লালমোহনবাবুর মত একখানা রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস লিখব। পারব না ভাবছেন? আরে দাদা, এই যে দর্জিপাড়া লেনের সেদিনের ছোকরা গিরিশ চাকলাদারসে কিনা নিশাচর নাম নিয়ে ক্যাপটেন স্পার্ক আর র‍্যাক্সিট সমেত রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস নামিয়ে দিতে পারল। আর আপনি আমার উচ্চাশা শুনে ......? নাহয় আমার এডিশনও “তিন মাসেও কিস্যু হবেনা”। তবে খটকা অবিশ্যি একটা আছেই। ভাবছেন ফেলুদা থাকতে হঠাৎ জটায়ু কেন? একটু ভেবে দেখুন দিকি। এই অধমের দ্বারা ফেলুদা হওয়া কি কখনো সম্ভব? মগজাস্ত্র অনেক দুরের কথা, শিশুকাল থেকে আমার মগজের উপস্থিতি নিয়েই অসংখ্যবার অসংখ্য মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ফেলুদা তো কোন ছার, তোপসের তুলনায়ও আমি নেহাতই পানসে। কিন্তু লালমোহন গাঙ্গুলির সঙ্গে এই চাটুজ্যের অনেক মিল। কু-লোকে বলে আমি নাকি কিঞ্চিত লাল, আবার এদিকে আমি মোহন(বাগান) ও বটে। যদিও উটে চড়ে আরব বেদুইন হবার কথা ভাবলে রোমাঞ্চের বদলে তলপেটটা কেমন জানি ......। কিন্তু ইংরিজি বলুন, সাধারন জ্ঞান বলুন (নর্থপোলে সিন্ধুঘোটক, বা উটের পাকস্থলি), গরম কচুরি প্রেম বলুন, এই সব ব্যাপারে জটায়ুর সঙ্গে আমার যাহারপরনাই মিল রয়েছে।



তো জটায়ু হবার সাধনায় আপাতত মন দিয়েছি নামকরনে। শেক্ষপীর নেহাত লালুদার অনেক আগেকার লোক। পরের বা নিদেনপক্ষে সমসাময়িক হলে কিছুতেই লিখতেন না “নামে কি বা এসে যায়”। বাংলায় বড় বড় লেখকের কমতি নেই বটে, কিন্তু “সাম্প্রতিক্‌তম্‌ উপন্নিয়্যাস” এর নাম দেওয়াটা মিস্টার গাঙ্গুলীর কাছে শেখা উচিত। নাম তো নয়, “এক একটা চাক্কু”। “দর্শকের”, খুড়ি, পাঠকের “বুকে ঢুকে পায়রা উড়িয়ে দেবে”। কাজেই এমন নাম দিতে হবে আমার লেখার যার মধ্যে লালমোহনবাবুর মত একটা রোমাঞ্চকর “হাই ভোল্টেজ স্পার্ক” থাকবে। সেই চেষ্টায়, দিন তিনেকের লাগাতার কসরতের পর লেখার নামকরন করে ফেলেছি – “হাড়হিম হিমবাহ”। নাম তো হলো। তার পর খেয়াল হলো, লেখার একটা বিষয়বস্তু থাকা দরকার। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে, প্রানপনে ভেবেও একটা জুতসই রহস্য-রোমাঞ্চ প্লট মাথায় এলোনা। এদিকে লেখার নাম দিয়ে ফেলেছি, কিছু না লিখলেই নয়। চুপ চাপ বসে থাকতে থাকতে নিজেকেই নিজে মনে মনে গুঁতো মেরে চললুম। এই গুঁতোগুঁতির ঠ্যালায় মনে পড়ল আর এক গুঁতোর কথা। সে গুঁতোর সঙ্গে আবার হিমবাহও যুক্ত, এমন কি হাড়হিম করা একটা গল্পও পাচ্ছি। ভাবলুম যতক্ষন না যুতসই রহস্য-রোমাঞ্চ প্লট মাথায় আসে, ততক্ষন এই সব নিয়েই দু কলম লিখি।    

“Bull” এর গুঁতো

ধরুন আপনি বাগবাজার, চুঁচড়ো কিম্বা বহরমপুরের বাড়ি থেকে বেড়াতে বেরোলেন। মাস খানেক ঘুরে বেড়িয়ে যখন ফেরার সময় হলো, তখন খবর পেলেন, আপনার বাড়িটা আর আপনার নেই, আপনাকে বাড়ি ফিরতে হলে ফিরতে হবে গোরখপুর, শিলং কিম্বা হায়দরাবাদ। কেমন লাগবে বলুন তো? তার ওপরে যদি আপনার বয়স হয় মাত্র ১৩ বছর। আপনি ইয়োরোপ থেকে দেশে ফিরছেন জাহাজে করে। বাড়ির লোকজন ছাড়াই, একা একা। আপনার কাছে না আছে একটা টেলিফোন, না আছে বাড়ির কারোর সঙ্গে অন্য কোনোভাবে যোগাযোগের মাধ্যম। ভেবে দেখুন দিকি, আপনি কি করবেন! আমি হলে ওই জাহাজের ডেকেই পা ছড়িয়ে বসে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলতুম।

রাওয়ালপিন্ডির নরেন্দ্রকুমার এরকম অবস্থায় পড়েও কিন্তু কিচ্ছুটি করেনি। সেটা ১৯৪৭ সাল, আগস্ট মাস। ১৩ বছরের নরেন্দ্রকুমার প্যারিস থেকে দেশে ফিরছে স্কাউটের এক সন্মেলন শেষ করে। এদিকে দেশে ফেরার সময় জাহাজে ওঠার পর ভারতে ইউনিয়ন জ্যাক পাকাপাকি নেমে গেছে । দেশ স্বাধীন হয়েছে, এবং ভেঙে দু টূকরোও হয়েছে। নরেন্দ্রকুমারের বাড়ি চলে গেছে পাকিস্তানে। করাচি হয়ে জাহাজ পৌঁছলো মুম্বাই। তখন অবশ্য বম্বে। কোন সুত্রে খবর পেয়ে কিশোর পাঞ্জাব-দা-পুত্তর একাএকাই পৌঁছল সিমলা, এবং শেষে তার বাবা মা ও বাকি পরিবারকে সেখানে খুঁজে পেল। বেশ গায়ের লোম খাড়াকরা কিস্যা। কিন্তু আমাদের গপ্পটা এখানেই শেষ নয়। আরো অনেক দূর চলবে। নরেন্দ্রকুমার সমুদ্দুর, সমতল সব কিছু পেরিয়ে এসে সিমলার পাহাড়ে উঠলেন। আর এইখান থেকেই তাঁর উঁচুতে ওঠা শুরু হল।  


নরেন্দ্রকুমার পড়াশোনা শেষ করে পল্টনে নাম লিখিয়ে গায়ে তুললেন ফৌজি উর্দি, পায়ে পরলেন ফৌজি বুট, আর হাতে গলালেন বক্সিং এর দস্তানা। দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে বক্সিং রিং এ, নরেন্দ্র কুমার তাঁর এক উর্ধতন ক্যাডেটের সঙ্গে প্রচুর মার খেয়েও নাছোড়বান্দার মত লড়ে যান শেষ রাউন্ড পর্যন্ত। উর্ধতন ক্যাডেটটি হলেন সুনিত ফ্রান্সিস রডরিগেজ, পরে ভারতীয় সেনাবাহিনির সর্বাধিনায়ক আর অবসরের পরে পাঞ্জাবের রাজ্যপাল। এই নাছোড়বান্দার মত লড়ে যাওয়া থেকেই নরেন্দ্রর নাম হয়ে যায় “বুল”, মানে ষন্ড। যাই হোক, ষন্ডমার্কা গোঁ নিয়ে নরেন্দ্র-“বুল”-কুমার, কুমায়ুঁ রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে পোস্টেড হলেন দার্জিলিং জলাপাহাড় ফৌজি ক্যান্টনমেন্টে। আর এইখানেই তাঁর সঙ্গে তেনজিং নোরগের আলাপ হয়। তেনজিং তখন দার্জিলিঙে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে ডিরেক্টর। তেনজিংয়ের সূত্রেই নরেন্দ্র কুমারের মাথায় পাহাড়ে চড়ার পোকা নড়ে ওঠে। এবং ষন্ডসুলভ গোঁ সমেত “বুল”, পাহাড়ে চড়া শুরু করেন। একে একে ত্রিশুল, কাঞ্চনজঙ্ঘার কার্ব্রু, নন্দাদেবী, নীলকন্ঠ, এমন কি আল্পসের মঁ ব্লাঁ পর্যন্ত চড়ে বসেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল নরেন্দ্র কুমার। স্বীকৃতি হিসেবে, কর্নেল “বুল” কে গুলমার্গে ভারতীয় ফৌজের হাই-অল্টিচিউড ওয়ারফেয়ার ট্রেনিং স্কুলের অধ্যক্ষ্যের ভার দেওয়া হয়। এ বিষয়ে তাঁর চেয়ে যোগ্য লোক সেই মুহুর্তে ভারতে আর একজনও ছিলেন না।

 ১৯৭৬-৭৭ সালে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পাওয়া খবর থেকে কর্নেল বুল খেয়াল করলেন, পাকিস্তানের দিক থেকে ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তের উত্তরতম প্রান্তের গডউইন-অস্টিন শৃঙ্গ ও তার আশেপাশে এদিক ওদিক প্রচুর পর্বতারোহন অভিযান হচ্ছে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তানের শত্রুতা বিশ্ববিখ্যাত। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় জম্মু-কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভেবেছিলেন আলাদা স্বাধীন থাকবেন। কিন্তু পাকিস্তানের দিক থেকে সশস্ত্র উপজাতীয় লোকজন, এবং সদ্যগঠিত পাকিস্তানি পল্টন আক্রমন চালিয়ে কাশ্মীরে ঢুকে পড়ল। হরি সিং ঠেলায় পড়ে নেহেরু আর বল্লভভাই প্যাটেলের শরনাপন্ন হলেন। জম্মুতে রাতারাতি সইসাবুদ মিটিয়ে কাশ্মীর ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দিলো। ১৯৪৭ সালের ২৭শে অক্টোবর ভোর বেলা দিল্লির পালম হাওয়াই আডঢা থেকে সেনাবাহিনীর ডিসি-থ্রি বিমানে চেপেচুপে ১৬ জওয়ান সমেত ১ নং শিখ রেজিমেন্টের (ব্যাটেলিয়ানের নম্বর) লেফটেন্যান্ট কর্নেল দিওয়ান রঞ্জিত রাই রওনা দিলেন শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে। ভেবে দেখুন। বারামুলা চলে গেছে পাকিস্তানের দখলে। সেখান থেকে শ্রীনগর আর কিছু কিলোমিটার মাত্র। জম্মুর দিক থেকে তখন শ্রীনগর পৌঁছনোর কোন রাস্তা ছিলোনা। সমতল থেকে কাশ্মীরে ঢোকার যা কিছু রাস্তা, সবই দেশভাগের ফলে পড়েছে পাকিস্তানের দিকে। কেবলমাত্র আকাশপথে উড়েই নামা যায় শ্রীনগরে। যাই হোক, বিমানের পাইলট দু বার শ্রীনগরের ওপর চক্কর দিয়ে দেখে নিলেন, শত্রুরা এর মধ্যেই শ্রীনগর দখল করে ফেলেছে কিনা। সেরকম কিছু না দেখে, পাইলট বিজু পট্টনায়েক ওই ১৭ জন ফৌজি সমেত নেমে এলেন কাশ্মীরে। আজ্ঞে হ্যাঁ, বিজু পট্টনায়েক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নামকরা মিত্রপক্ষের পাইলট, পরবর্তীকালে উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রি, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রি নবীনবাবুর বাবা ।

এককালে বঙ্গদেশ জয় করেছিল বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে ১৮ জন অশ্বারোহী। বিংশ শতকের মাঝামাঝি কাশ্মীর জয় করতে চললো ১৭ জন ভারতীয় পদাতিক সৈন্য, কাঁধে রাইফেল, কিছু গুলি ও গ্রেনেড। উলটো দিকে রাইফেল, মর্টার, হালকা কামান, মেশিনগান সমেত ধেয়ে আসছে শিক্ষিত পাক অফিসারদের নেতৃত্বে লড়াকু উপজাতীয় পাঠান বাহিনী, সংখ্যায় যাদের নারায়নী সেনা হতেও আপত্তি নেই। কাশ্মীর যুদ্ধের বিবরন দিতে বসিনি। দেড় বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আজকের প্রকৃত নিয়ন্ত্রন রেখা বরাবর দু পক্ষ অস্ত্র সংবরন করে। সেই থেকে কাশ্মীরে ওই রেখাকেই দু দেশের বিভাজিকা মানা হয়। ভারত ও পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সীমান্ত গুজরাট ও সিন্ধের মাঝে কচ্ছের রান থেকে শুরু হয়ে রাজস্থান হয়ে, পাঞ্জাব ভাগ করে এসে ছাম্ব বলে জম্মুর পশ্চিমে একটা ছোট্ট জনপদে শেষ হয়েছে। তার পরে যে বিভাজন রেখা, সেটাকে দুদেশের কেউই আন্তর্জাতিক সীমান্ত বলে মানেনা। ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতির সময় যার সেনা যেখানে ছিল, সেটা তার দখলে থেকে যায়। ছাম্ব থেকে নওসেরা-রাজৌরি-মেন্ধার-পুঞ্চ-উরি-তিথওয়াল পর্যন্ত রেখা একটু এঁকেবেঁকে হলেও চলেছে উত্তরমুখি। কিন্তু তার পরে সে রেখা ঘুরেছে পূব-দক্ষিনে। উত্তর-পশ্চিমে দিকে পাক অধিকৃত গিলগিট বাল্টিস্তান, দক্ষিন-পূর্বে ভারতের দ্রাস-মুশকো উপত্যকা, কার্গিল। কার্গিল থেকে সামান্য উত্তরপশ্চিমে গেলেই কুকরথাং বলে এক পর্বত শৃঙ্গ। ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময় এই নামটা বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল প্রবল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর। এই কুকরথাং এর পরেই রয়েছে নামহীন এক শৃঙ্গ, তাকে চিহ্নিত করা হয় NJ9842 নম্বর দিয়ে। এই পর্যন্ত এসেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রনরেখা শেষ।

মানচিত্র ১ – হলদে রঙের দাগ দিয়ে জম্মু কাশ্মীরের সীমান্ত বোঝানো হয়েছে, যা ভারত দাবী করে। লাল দাগ দিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের নিয়ন্ত্রন রেখা (Line of Control) দেখানো হয়েছে। সবুজ দাগ দিয়ে চীন ও ভারতের প্রকৃত নিয়ন্ত্রন (Line of Actual Control) রেখা দেখানো হয়েছে।

NJ9842 এর পরে অত্যন্ত দুর্গম ও উঁচু এলাকার শুরু। সেখানে না আছে কোন প্রানের চিহ্ন, না আছে কোন জন বসতি। ২০ হাজার ফুট উচ্চতা আর শুন্যের ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট নিচের তাপমাত্রায় কে থাকতে যাবে সেখানে? কোন রাস্তাঘাট নেই, নেই সামান্যতম সমতল জায়গা। সে এক অগম্য-অকল্পনীয় স্থান। অনেকে এই এলাকাকে বলেন তৃতীয় মেরু। উত্তর ও দক্ষিন মেরুর পরেই। পৃথিবীতে এরকম জায়গা আর নেই। যেখানে মানুষ যেতে পারেনা, বাস করেনা কেউ, এরকম জায়গায় কেই বা দু দেশের বিভাজক রেখা নিয়ে মাথা ঘামাবে? কাজেই সে অঞ্চল নিয়ে স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বহুবছর কেউ কোন উচ্চবাচ্চা করেনি। কাশ্মীরের লড়াই শেষে করাচি চুক্তির সময় কাশ্মীরে দু দেশের বিভাজন রেখা হিসেবে নিয়ন্ত্রন রেখাকে মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু সেই রেখার শেষে যেখানে NJ9842, তার পর বাকি এলাকার ব্যাপারে চুক্তিতে লেখা হয় – “thence north to the glaciers.”, অর্থাৎ এর পর উত্তরের হিমবাহের দিকে। কিন্তু উত্তরে গাদা গুচ্ছের হিমবাহ। কার কথা বলা হয়েছিল, কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই। মোদ্দাকথা খুব ভাসাভাসা করে ছেড়ে দেওয়া হয়, হয়ত ওই অঞ্চল নিয়ে কারোর তেমন কোনো ধারনা না থাকায়।

৭০এর দশকের মাঝামাঝি পাকিস্তান নিজের কাছেই নিজে হতমান। দেশের আধখানা হাতছাড়া হয়ে গেছে। দেশের ভেতরে বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্তিরতা। পাশেই গর্বিত ভারতের জ্বালাময় উপস্থিতি। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানীতে। দরকার বাংলাদেশ যুদ্ধের শোধ তোলা। কিন্তু সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে সেই মুহুর্তে ভারতকে শিক্ষা দেওয়া অকল্পনীয়। এমন অবস্থায় পাকিস্তানি ফৌজ চেনা ছকের বাইরে ভাবতে চেষ্টা করল। সেই হিসেবেই গিলগিট ও স্কার্দুর দিক থেকে আরো পূব দিকে পর্বতারোহনে উৎসাহ দেওয়া হতে লাগল। কেননা এই অঞ্চলের পাহাড়পর্বত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা বা কোন মানচিত্র, কিছুই তখন ছিলোনা। এরকমই কিছু অভিযানের খবর প্রকাশিত হতে থাকে বিদেশের কিছু পত্রপত্রিকায়। ১৯৭৭ সাল থেকে আমাদের কর্নেল বুল এই রিপোর্ট গুলো পড়ে আঁচ করেন, যে এর পেছনে সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা থাকতে পারে। ইতিমধ্যে দুই জার্মান পর্বতারোহী কাশ্মীরে কর্নেলকে NJ9842 এর উত্তরের একটা ম্যাপ দেখান। সেখানে NJ9842  থেকে একটা সরলরেখা দিয়ে কারাকোরাম গিরিপথ (এই অঞ্চলের উত্তরপূর্বতম প্রান্ত, ভারত ও চিনের সীমান্ত) যোগ করা আছে। এই ম্যাপ দেখে নরেন্দ্রকুমার চমকে ওঠেন। এতে গোটা অঞ্চলটাই পাকিস্তানের বলে দাবী করা হয়ে যাচ্ছে। কর্নেল বুল তখন গুলমার্গে ভারতীয় সেনাবাহিনির হাই-অল্টিচিউড ওয়ারফেয়ার ট্রেনিং স্কুলের ডিরেক্টর। তা ছাড়া পর্বতারোহী হিসেবে তেনার তখন প্রচুর নামডাক। সেই সব প্রভাব কাজে লাগিয়েই তিনি, ফৌজের সদর দফতরে এই অভিযানগুলোর কথা পাড়লেন। বোঝালেন, যে এই অঞ্চলে যেহেতু কোনো বিভাজিকা নির্দেশ করা নেই, কাজেই, যে যতটা এগিয়ে গিয়ে দাবী করবে, সে এলাকা তার, ততটাই সে পেয়ে যাবে। দিল্লির কর্তারা নড়েচড়ে বসলেন। ও এলাকা কারোর নিয়ন্ত্রনে নেই। খোলা পড়ে আছে।  
মানচিত্র ২ – পাকিস্তানের দাবী অনুযায়ি NJ9842 থেকে ভারত-চীন সীমান্তের কারাকোরাম গিরিপথ পর্যন্ত সোজা রেখা টেনে কারাকোরাম ও সিয়াচেন অঞ্চল ভাগ হওয়া উচিত। সাদা রেখা টেনে এই মানচিত্রে সেই রেখা দেখানো হয়েছে। কর্নেল নরেন্দ্রকুমারকে জার্মান পর্বতারোহীরা এই রেখাই দেখিয়েছিলেন।

পাকিস্তানে, পিন্ডির উর্দিধারীরা ভারতের পিন্ডি চটকানোর জন্যে প্ল্যান ছকেন দিনরাত (রাওয়ালপিন্ডি, যার আদুরে ডাক নাম পিন্ডি। পাক ফৌজের সদর দফতর সেখানেই)। ঠিক যেমন দিল্লির উর্দিধারীরা পাকিস্তানকে খিল্লি করার জন্যে প্ল্যান কষে থাকেন। দুপক্ষেরই বিস্তর লোকজন এই একটি কাজের জন্যেই সরকারি তনখা টানেন। পিন্ডির লোকজন ভেবেছিলেন কারাকোরামের ওই দুর্গম এলাকায় বিদেশী পর্বতারোহীদের অভিযানের ছাড়পত্র দেওয়ায় পাকিস্তানের পক্ষে এটা প্রমান করা সম্ভব হবে, যে ওই অঞ্চল আসলে তাদেরই। কিন্তু যে এলাকা নিয়ে এত চিন্তা ভাবনা, সেই অঞ্চলটি কেমন? কি আছে সেখানে? সেখানে আছে সিয়াচেন হিমবাহ। ৭৬ কিলোমিটার লম্বা অতিকায় হিমবাহ। আকাশচুম্বি কারাকোরাম গিরীশ্রেনী চারিদিক ঘিরে রেখেছে। সিয়াচেনের পশ্চিম দিকে কারাকোরামের বিখ্যাত সালতারো রেঞ্জ পাঁচিলের মত দাঁড়িয়ে আছে সিয়াচেন হিমবাহকে পাহারা দিয়ে। পাকিস্তানের দিক থেকে সিয়াচেন অঞ্চলে পৌঁছতে গেলে, এই সালতারো রেঞ্জ পার হতে হয়। সে এক অসম্ভব ব্যাপার। এক্কেবারে খাড়া দেওয়ালের মত গিরি প্রাকার ২০ থেকে ২৫ হাজার ফুট উঁচু। শুধু কয়েক জায়গায় অল্প অল্প খাঁজ রয়েছে। সেগুলোই এক একটা গিরিপথ। উত্তরের দিক থেকে ধরলে সিয়া-লা, বিলাফন্ড-লা এবং আরো দক্ষিনে গেলং-লা, ইয়ার্মা-লা, চুলুং লা এই গিরিপথগুলো দিয়ে সালতারো রেঞ্জের খাড়া দেওয়াল টপকে সিয়াচেন হিমবাহে পৌঁছনো যায়। খুব কষ্টকর হলেও পাকিস্তানের দিক থেকে পায়ে চলা পথে কিছু জায়গা দিয়ে সিয়াচেন হিমবাহে পৌঁছনো সম্ভব, কিন্তু ভারতের দিক থেকে প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। এই অবস্থায় আমাদের কর্নেল বুল প্রস্তাব দিলেন, উনি একটা দল নিয়ে এই এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখতে যেতে চান।  আমাদের দেশে কোন কাজ চটজলদি হবার জো নেই। হাজার একটা আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতের ফাঁস। কিন্তু কেন জানি, আমাদের ফৌজি সদরদফতর, সব রকম লাল ফিতে এড়িয়ে, এক কথায় অভিযানের সম্মতি দিয়ে টাকা পয়সার ব্যবস্থা করে দিলো ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মদনলাল চিব্বার তখন ভারতীয় সেনার ডিরেকটর অফ মিলিটারি অপারেশনস। লেফটেন্যান্ট জেনারেল চিব্বার এই পর্বে কর্নেল বুলকে প্রচুর সাহায্য করেছিলেন ফৌজি সবুজ সংকেত পেতে।  

নরেন্দ্রকুমার দেরি করেন নি। গুলমার্গে নিজের স্কুলে ফিরে এসে পুরো একটা ব্যাচের ৪০ জন ফৌজি শিক্ষার্থীকে নিয়ে রওনা দিলেন উত্তর মুখে। এখানে আমার দু একটা কথা বলার আছে। ১৯৭৮ সালে, কর্নেল বুলের বয়স ৪৫ বছর।আমার এখন যা বয়স তার চেয়েও কিছুটা বেশী। পল্টনে কাটিয়ে ফেলেছেন প্রায় ২৭-২৮ বছর। স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে বেশ আরামের জীবন। এরকম অবস্থায়, আরাম ছেড়ে, এই বয়সে, কটা মানুষ দুর্জয়-দুর্গম অজানার সন্ধানে এইভাবে বেরিয়ে পড়তে পারেন? আমাদের লিভিংস্টোন, স্বেন হেদিন, ইবন বতুতা, অ্যামুন্ডসেন, ক্যাপ্টেন স্কট নেই। কিন্তু কর্নেল নরেন্দ্রকুমার তো আছেন। কেন, এনার অভিযান স্কুলের পাঠ্য বই তে ঢুকলোনা আজ পর্যন্ত? যাই হোক, কর্নেল বুলের নেতৃত্বে এই অভিযাত্রী দল, সিয়াচেন হিমবাহের বেশ কিছুটা অংশ পরিভ্রমন করে। পাহাড়ের খাঁজখোঁজ, বরফের ক্রিভাস, কোথায় এতটুকু সমতল জায়গা, যেখানে বেসক্যাম্প করা যেতে পারে, জল পাওয়া যায় কিনা, এসব তথ্য যেমন জরিপের সময় উঠে আসতে লাগল, তেমনই উঠে এলো সামরিক দিক্ থেকে গুরুত্বপূর্ন তথ্য, কোথায় হতে পারে ফরওয়ার্ড পোস্ট, কোথায় রসদ ও গোলাগুলির ডিপো রাখা যেতে পারে, কোথা থেকে শত্রুপক্ষের ওপর ভাল নজর রাখা যেতে পারে, কোথায় কি ক্যালিবারের কামান বসানো সম্ভব (জমি নরম, আলগা বা ভঙ্গুর হলে ভারি কামান বসানো মুশকিল) এই সব। সমস্যা হল, এই তিন চার মাসের অভিযানের সমস্ত রসদ, নিচে থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলোনা। এই সমস্যার সমাধান আসে আকাশপথে। ভারতীয় বায়ুসেনা থেকে দলের প্রয়োজনীয় রসদ যোগানো হতে থাকে । অভিযাত্রীরা ওই অঞ্চলের উচ্চতম শৃঙ্গ , তেরাম কাংড়ি(২) জয় করেন। এই প্রথম বার এই অঞ্চলের ভাল মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়। শুধু তাই নয়, ওপর থেকে যা দেখে বোঝা যায়না, সেই সব ক্রিভাস, বা বরফের খাঁজ, যা কিনা অভিযাত্রিদের মরনফাঁদ, সেগুলোও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। পাকিস্তানের দিক থেকে যে সব অভিযান এতদিন চলেছে, তাদের ফেলে যাওয়া অসংখ্য কৌটোবাওটা, শিশিবোতল, অন্যান্য সাজসরঞ্জাম কর্নেল নিয়ে আসেন প্রমান হিসেবে, নিয়মিত পাকিস্তানি আনাগোনার প্রমান হিসেবে। এই সব প্রমান সমেত কর্নেলের অভিযান, বিস্তারিত ভাবে প্রকাশিত হয় ইলাস্ট্রেটেড উইকলি পত্রিকায়। ব্যাস, এবার সবাই নড়ে চড়ে বসল। তবে কি পাকিস্তান এমন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে, যে অঞ্চল আসলে ভারতের?

ভারতীয় সেনাবাহিনি নড়েচড়ে বসে। নড়েচড়ে বসে প্রতিরক্ষামন্ত্রক। পাকিস্তান কি ভাবে, কি করতে চাইছে, তার ওপরে সেই সময়েও স্পস্ট ধারনা ছিলোনা ভারতে। কাজে নামে “র”। তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়। অভিযানের সমস্ত তথ্য খুঁটিয়ে বিশ্লেষন করাহয় এক বছর ধরে, এবং দেখাযায়, যদিও অসংখ্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য উঠে এসেছে অভিযানের ফলে, তবুও, সিয়াচেন হিমবাহের উত্তরতম অংশে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি। ফলে আবার অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়, এবং ১৯৮১ সালের এপ্রিল মাসে কর্নেল বুল আবার রওনা হয়ে যান ৭০ জনের দল নিয়ে। এবারের লক্ষ্য সিয়াচেন হিমবাহের উত্তরতম প্রান্তে, তার উৎসে পৌঁছনো, এবং সিয়াচেনের পশ্চিম দিক বরাবর দেওয়ালের মত দাঁড়িয়ে থাকা সালতারো গিরিশ্রেনী সম্পর্কে পুনখানুপুঙ্খ তথ্য সংগ্রহ করা। কারন পাকিস্তানি অভিযান আসতে পারে একমাত্র ওই পশ্চিম দিক থেকেই। এবারের অভিযান আগেরবারের থেকেও ফলপ্রসু হয়। গোটা সিয়াচেন হিমবাহের ওপর পরিভ্রমন করেন অভিযাত্রীদল। পৌঁছে যান হিমবাহের উত্তর প্রান্তে সিয়া কাংড়ি শৃঙ্গে। পৌছে যান ভারত ভূখন্ডের উত্তরতম বিন্দু ইন্দিরা-কল এ। সম্ভবতঃ তিনি এবং তাঁর অভিযাত্রিদলই প্রথম, যাঁরা ওই অঞ্চলে পা রাখেন। তার আগে ও অঞ্চলে মানুষের পা পড়েনি কখনো। ফেরার সময় এক আশ্চর্‍্য্য ঘটনা ঘটে। কর্নেল নরেন্দ্রকমার দুই জার্মান পর্বতারোহীকে দেখতে পান সিয়াচেন হিমবাহে, যাঁদের সঙ্গে বছরখানেক আগে তাঁর গুলমার্গে দেখা হয়েছিলো। তারা তখন সিয়াচেন আসার জন্যে অনুমতির অপেক্ষা করছিল সেনাবাহিনির থেকে। কথা বলে নরেন্দ্রকমার যা জানলেন, তা চমকে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট। ভারতীয় সেনাবাহিনি এই দুই জার্মানকে সিয়াচেন আসার অনুমতি দেয়নি। তারপর জার্মান দুজন পাকিস্তানে চলে যায়, ও সেখান থেকে তাদের অনুমতি দেওয়াহয় অভিযানের। কর্নেল বুল বোঝেন, ভারতের দিক থেকে এই অভিযান কতটা দরকার ছিলো। সালতারো গিরিশ্রেনী খুব ভালো করে জরীপ করা হয়। তার পরে সালতারো রেঞ্জের পশ্চিম দিকে বিলাফন্ড-লা, সিয়া-লা এই সমস্ত গিরিপথগুলোতে কর্নেল তাঁর দলবল নিয়ে স্কি করে ঘুরে বেড়ান। শেষে যথন তিনি ফিরে আসেন, ভারতের হাতে আসে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ন বিষদ তথ্যাবলী। এই বিশদ তথ্যাবলী থাকার জন্যেই সিয়াচেন অঞ্চলে ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে যায়।

মেঘদুত
মহাকবি কালিদাস মেঘদুত লিখে গেছেন। সে বস্তু বিশ্বসাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ। বিংশ শতকের আটের দশকে আর একবার মেঘদুত নিয়ে লেখালিখি করতে বসলেন কিছু তাগড়া গুঁফো উর্দিধারী লোকজন। ভারতীয় ফৌজি সদর দফতরে। বিস্তারে বলি। সেটা ১৯৮৪ সাল। কিন্তু প্রস্তুতি শুরু হয়েছিলো আরো আগে। কর্নেল বুলের ১৯৮১র অভিযানের পরেই। ওই রকম অগম্য বসবাস অযোগ্য অঞ্চলে টিঁকে থাকতে গেলে দরকার উপযুক্ত তালিম আর অভ্যাসের। কিন্তু সে তালিম আর অভ্যেসের উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত। পাঠক মনে করে দেখুন, সিয়াচেন অঞ্চলকে আমি এর আগেই বলেছি তৃতীয় মেরু। কাজেই ভেবে দেখুন তো, এই অঞ্চলের উপযোগী তালিমের জায়গা কোথায় হতে পারে? অসম্ভব এবং উদ্ভট মনে হলেও কথাটা সত্যি, ভারত দক্ষিন মেরু অভিযান শুরু করে এই সময় থেকেই। অন্যান্য বৈজ্ঞানিক উদ্দ্যেশ্য অবশ্যই ছিল, কিন্তু দক্ষিনমেরু পাঠানো হয় সেনাবাহিনির বেশ কিছু ইউনিটের ফৌজিদের, যারা সেখানে গিয়ে তালিম নেবে, ও চরম ঠান্ডায় ও হিমবাহের ওপরে টিকে থাকার অভ্যেস করবে। কর্নেলের অভিজ্ঞতা নিয়ে কলকাতার টেলিগ্রাফ পত্রিকায় “High Politics in the Karakoram” শিরোনামে বিশদে একটা লেখা বেরোয় ১৯৮২ সালে। লেখক জয়দীপ সরকার নিজেও একজন স্বনামধন্য পর্বতারোহী এবং লেখক। জয়দীপের লেখায় প্রথমবারের মত সাধারন মানুষ বুঝতে পারেন, হিমালয়ের ওই উচ্চতম অংশে, জনমানবহীন প্রান্তরেরও সামরিক দৃষ্টিকোন থেকে গুরুত্ব থাকতে পারে।

যাই হোক, পত্রপত্রিকায় দেখেই হোক, বা ভারতের বার বার সিয়াচেন অঞ্চলে অভিযান থেকেই হোক, পিন্ডির কর্তারা দেখলেন বেশীদিন ব্যাপারটা ফেলে রাখা যাবেনা। নিজের ফৌজ পাঠিয়ে জায়গা দখলে রাখতে না পারলে, সিয়াচেন পাকিস্তানের হাতছাড়া হবে। ১৯৮৩ সালে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে রাওয়ালপিন্ডির দফতরে ছক তৈরি শুরু হলো। সিয়াচেন ও কারাকোরাম পৃথিবীর দুর্গমতম অঞ্চল, এবং ও অঞ্চলে যাওয়ার জন্যে যে ধরনের তালিম ও জামাকাপড় লাগে, তার কোনোটাই পাকিস্তানি ফৌজের ছিলোনা সেই সময়। কাজেই তালিম দেওয়া শুরু হলো বাহিনিকে। গিলিগিট-বালটিস্তানের উঁচু এলাকায় সেনাবাহিনির প্রস্তুতি শুরু হলো। যেহেতু গ্রীষ্মকাল ছাড়া বছরের অধিকাংশ সময় সিয়াচেন অঞ্চলে পৌঁছনোর রাস্তা ঘাট অত্যধিক বরফে ঢেকে থাকে, তাই ঠিক করা হলো পরের বছর গ্রীষ্মের শুরুতেই পাক ফৌজ গিয়ে সিয়াচেনের দখল নেবে, ও ঘাঁটি গেড়ে বসে পড়বে। পাক ফৌজের প্রস্তুতির সময় দেখা গেল প্রবল ঠান্ডার উপযোগী জামা কাপড় পাকিস্তানে জোগাড় করা গেলেও সমস্যা হচ্ছে জুতো। প্রবল ঠান্ডায় বরফের ওপর দিয়ে হাঁটার জন্যে বিশেষ এক ধরনের জুতোর দরকার হয়। সেই জুতো সব দেশে তৈরি হয়না। কেবল দু একটি সংস্থা এই ধরনের জুতো তৈরি করে ইয়োরোপে, আর প্রধানত তা কেনা হয় মেরু অভিযানের জন্যে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনি থেকে লন্ডনের এক সংস্থার কাছে এই জুতো কেনার বরাত দেওয়া হলো। কিন্তু ঘটনাচক্রে, এই সংস্থা থেকে ভারতীয় সেনাও তাদের ওই বিশেষ জুতো কিনত কয়েক বছর ধরেই, মেরু অভিযানের সময় থেকে। ভারতীয় গোয়েন্দাবিভাগ “র”, এই পাকিস্তানি জুতোর বরাত সম্পর্কে জানতে পারার পরেই প্রতিরক্ষামন্ত্রক ও সেনাকর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিলো। কেন পাকিস্তান এত বিপুল সংখ্যক আর্কটিক বুট কিনছে, এটা আন্দাজ করা কঠিন ছিলোনা, কিন্তু প্রশ্ন উঠলো সময় নিয়ে।

হিসেব নিকেশ করে দেখা গেল, জুতো পাকিস্তান ফৌজের হাতে আসা, ও ওই অঞ্চলে পৌঁছনোর রাস্তা কিছুটা বরফ মুক্ত হওয়া, এই সব মিলিয়ে গ্রীষ্মের শুরুর আগে পাকিস্তান ওখানে পৌঁছতে পারবেনা। কিন্তু দিন তারিখ কিছুই পাওয়া গেলনা। আবার সেই “র”, আবার গোয়েন্দাগিরি। সিনেমায় দেখা এজেন্ট বিনোদ কিম্বা টাইগার নয়। সত্যি সত্যি “র”, পাক ফৌজি দফতর থেকে তাদের পরিকল্পনা জোগাড় করে আনল অভিযানের তারিখ সমেত। ভাবা যায়না, কি ধরনের ডানপিটেমো থাকলে এই কাজ করা সম্ভব! পাক ফৌজের অভিযানের পরিকল্পনা থেকে জানা গেল ১৭ই এপ্রিল (১৯৮৪) তাদের সিয়াচেনে পৌঁছনোর কথা। ভারতীয় ফৌজ পরিকল্পনা করল তার আগেই সিয়াচেনে পৌঁছতে হবে। সিয়াচেনে পৌঁছে ঘাঁটি গেড়ে বসে পড়ার এই পরিকল্পনাই “মেঘদুত”, অপারেশন মেঘদুত। মেঘদুতের মুখ্য কারিগর ভারতীয় সেনাবাহিনির ১৫ নম্বর কোরের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রেমনাথ হুন। কিন্তু সিয়াচেন তো শ্যামবাজার নয়, যে বাস, মেট্রো কি হলুদ ট্যাক্সি বা উবের করে চলে গেলেন ধর্মতলা থেকে। সেখানে পৌঁছবার রাস্তা বড় কঠিন। এমনকি কার্গিলের পরে সেই অর্থে আর রাস্তা নেই ও। কার্গিল অবধি যে রাস্তা, আমাদের কাছে পরিচিত হাইওয়ে ১ডি বা আলফা ওয়ান বলে, শ্রীনগর থেকে দ্রাস-কার্গিল হয়ে চলে গেছে লে পর্যন্ত। এই রাস্তার উচ্চতম অংশ জোজি-লা গিরিপথ। জোজি-লা গিরিপথের আসেপাসে অনেকটা অংশের রাস্তা বরফ পড়ে বন্ধ থাকে কয়েকমাস। সে সময় ওখানে আলফা ওয়ান হাইওয়েতে চলাচল করা যায়না। গরমকালে বরফ গললে আবার রাস্তা খোলে। তা ছাড়া ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ পাকিস্তানের ওপর গোয়েন্দাগিরি করছে, আর পাকিস্তানি গোয়েন্দারা লাহোরে বসে চাপলি কাবাব আর কাটাকাট খাচ্ছেন সে তো আর হয়না (দুটিই তুলনাহীন সুখাদ্য, এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ ভারতে এদুটো পাওয়া যায়না)। পাকিস্তানি গোয়েন্দারা ভারতের যে কোনো ধরনের সেনা চলাচলের ওপরে নজর রাখেন।

১৯৮৪র মার্চ মাসে সেনাবাহিনির লাদাখ স্কাউট ও কুমায়ুন রেজিমেন্টের জওয়ানরা পায়ে হেঁটে বরফে ঢাকা জোজি-লা পেরিয়ে দ্রাস উপত্যকায় পা রাখল। তাদের সমস্ত অফিসার পায়ে হেঁটে এই দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে এলেন। নেতৃত্ব দিলেন ব্রিগেডিয়ার ডি কে খান্না (তখন তিনি পদমর্যাদায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। পায়ে হাঁটার কারন, পাকিস্তানি রাডার ও গোয়েন্দাদের এড়িয়ে যাওয়া। প্রচুর গাড়ি ও ট্রাক সমেত চলাচল করলে পাকিস্তানি রাডারে ধরা পড়বেই। সেই জন্যে পায়ে হেঁটে যাওয়া। আর বড় রাস্তা ছেড়ে ছোটোখাটো রাস্তা গিরিকন্দর নদীর ধার দিয়ে গা ঢাকা দিয়ে এগোনো। ভেবে দেখুন, ওই পাহাড়ি রাস্তায় সমস্ত সামরিক সাজসরঞ্জাম সমেত হেঁটে যাওয়া কি কঠিন কাজ। কিন্তু কঠিন কাজ করেন বলেই না এনারা ফৌজি, নয়ত আপনি আমি ছড়ি হাতে বেড়াতে বেড়াতে সিয়াচেন ঘুরে এসে ফেসবুকে ছবি আর স্ট্যাটাস আপডেট করতে পারতাম। ভারতীয় বিমানবাহিনি সৈন্য, সাজ সরঞ্জাম ও রসদ তুলে নিয়ে যায় কাছাকাছি বিমানঘাঁটি থেকে। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইল্যুসিন IL-76 বিমান পাওয়া গিয়েছিল। আর আগেকার আন্তোনভ AN-32 বিমান ছিলোই। এই বিমানগুলো ভারি মালপত্র ও সৈন্য পরিবহনের কাজে লাগে। কিন্তু ওই কারাকোরামের ওপরে বিমান নামবে কি করে? কাজেই ওপর থেকে কিছু জায়গায় প্যারাশুটে করে মালপত্র ও সৈন্য নামানো হলো। আর বাদবাকি জায়গায়, যেখানে প্যারাশ্যুটে নামা একেবারেই সম্ভব নয়, সেখানে সৈনিক ও তাদের মালপত্র বয়ে নিয়ে গেল Mil-17 আর চেতক হেলিকপ্টার। ১৭ থেকে ২০ হাজার ফুট উচ্চতায় বাতাসের ঘনত্ব অনেক কমে যায়। যার ফলে পাতলা বাতাসে বিমান বা হেলিকপ্টার, কেউই নিজের স্বাভাবিক ভারবহন ক্ষমতার আশেপাশেও পৌঁছতে পারেনা। ফলে বহুবার করে উড়তে হয়েছে বিমানবাহিনি কে, এবং একটু একটু করে রসদ ও অস্ত্রশত্রের ঘাঁটি তৈরি করা হয়েছে। বেস ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে।

কিন্তু এতকিছু সত্বেও শেষের বেশ কিছু কিলোমিটার সেনাবাহিনিকে পায়ে হেঁটে অথবা খাড়া বরফের আর পাথরের দেওয়াল বেয়ে উঠতে হয়েছে। কর্নেল নরেন্দ্রকুমারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতীয় ফৌজ নিখুঁত ভাবে জানত, কোথায়, কোন গিরিশিরায়, বা কোন বিন্দুতে তাদের পৌঁছতে হবে, এবং কি ভাবে পৌঁছতে হবে। সেখানে পৌঁছনোর পথে কি কি জায়গায় বিপদ আছে। কোথায় খাদ, কোথায় চোরা ক্রিভাস, কোথায় আড়াল পাওয়া যাবে, সমস্ত কিছু নিখুঁত ভাবে ভাবে জানা হয়ে গিয়েছিলো ভারতীয় সেনার। পাক ফৌজ এই গুরুত্বপূর্ন তথ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারনে এত নিখুঁত পরিকল্পনা করে উঠতে পারেনি। তাদের মিশন ছিলো কিছুটা এরকম, যে তারা সিয়াচেন পৌঁছে সেখানে দেখে শুনে জায়গা খুঁজে বের করবে নিজেদের পোস্ট বসাবার জন্যে। পাকিস্তানের একটা সুবিধে এই যে, তাদের দিক থেকে , মানে পশ্চিম দিক থেকে সালতারো গিরিশ্রেনী পর্যন্ত কিছু জায়গায় গাড়ি করে পৌঁছনো সম্ভব। কাজেই তাদের যাত্রাপথ ভারতীয়দের মত এতটা সমস্যাসঙ্কুল নয়।

ভারতীয় ফৌজ প্রচন্ড প্রতিকুলতার মধ্যেও পরিকল্পনা অনুযায়ি নিজেদের অগ্রগমন বজায় রাখতে পেরেছিল। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে তিরিশ থেকে পঞ্চাশ ডিগ্রি, কোমর সমান বরফ, কোথাও খাড়া পাথর বা বরফের দেওয়াল বেয়ে উঠতে হবে হাজার ফুট, সঙ্গে ঝড়ের মত হাওয়া, নেই কোন গরম খাদ্য বা পানীয়ের ব্যবস্থা। কিন্তু ফৌজি পিছু হটেনি, কদম কদম এগোতে থেকেছে। যদিও সেই এগোনোর গতি খুবই কম। কোথাও হয়ত সারা দিন চলে তিন কিলোমিটার এগনো গেছে। কোথাও হয়ত ৫০০ ফুট ওঠা গেছে। কারন বাতাস অত্যন্ত হালকা তাই অক্সিজেন খুব কম ওখানে। সেই জন্যে চার পা হাঁটলেই মনে হয় সিঁড়ি দিয়ে দশ তলা ওঠা হয়েছে। আর এখানে ঠান্ডা আর বাকি প্রতিকূলতার কথা ভাবুন। সেই সঙ্গে মনে করুন, এনাদের সঙ্গে রয়েছে ফৌজি মালপত্র, রসদ, অস্ত্র, গুলিবারুদ। এত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও মেজর রনধীর সিং সাঁধুর নেতৃত্বে একটা ছোটো দল প্রথম সালতারো রিজের ওপর ভারতীয় সেনা চৌকি স্থাপন করে ফেলল। এর পর ক্যাপ্টেন সঞ্জয় কুলকার্নির নেতৃত্বে দ্বিতীয় দল বিলাফন্ড-লা গিরিপথের দখল নিলো। ক্যাপ্টেন পি ভি যাদবের নেতৃত্বে বাকি সৈনিকরা চার দিন ধরে আস্তে আস্তে বাকি সমস্ত কটা জায়গার দখল নিলো সালতারো রিজের ওপরে আর সালতারো রিজ পার হবার জন্যে সব কটা গিরিপথ নিজেদের দখলে নিলো ১৯৮৪ সালে এপ্রিলের ১৩ তারিখ। পশ্চিম দিক থেকে কারোর পক্ষে আর সালতারো রেঞ্জ পার হওয়া সম্ভব নয়। ঠিক চার দিন পর, পরিকল্পনা অনুযায়ি ১৭ই এপ্রিল, পাকিস্তানি ফৌজ পুরো প্রস্তুতি নিয়ে যখন সালতারো গিরিশ্রেনীর পশ্চিম দিকের পাদদেশে এসে উপস্থিত হল, তারা দেখলো ওই উঁচুতে পাহাড়ের চুড়া গুলোয় এবং উঁচু জায়গাগুলোয় ভারতীয় ফৌজ ঘাঁটি গেড়ে বসে রয়েছে। 
রেখাচিত্র ১ – সালতারো রেঞ্জ, তার পশ্চিমে পাকিস্তান অধিকৃত এলাকা, পূবে সিয়াচেন হিমবাহ। 

এই অবস্থায় পাক ফৌজের কিছুই করার ছিলোনা। তারা সালতারো গিরিশিরার পশ্চিম ঢালে ও তার পাদদেশে নিজেদের ঘাঁটি তৈরি করল। কারন ভারতীয়রা বসে আছে পাহাড়ের চুড়াগুলোতে। ওপরে উঠতে গেলে একদম সোজাসুজি তাদের গুলির মুখে পড়তে হবে। উঁচুতে উঠে বসে থাকার ষোলো আনা সুবিধে ভারতীয়রা নেবে। প্রতিটি অবস্থান, প্রতিটি ঘাঁটি কর্নেল নরেন্দ্রকুমার চিহ্নিত করে এসেছিলেন।  “Bull” এর সেই নিখুঁত গুঁতোর ঠেলায় পাক ফৌজ সালতারো রিজের নিচে থেমে যেতে বাধ্য হলো। সেই থেকে সিয়াচেনে দু দেশের লড়াইয়ের শুরু। জেনারেল পারভেজ মুশাররফ পরে হিসেব কষে বলেছিলেন, ১৯৮৪ সালে, কারাকোরামে ভারতের কাছে পাকিস্তান প্রায় ২৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা হারিয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্যদের অবস্থান অনুযায়ী মানচিত্রে যে বিভাজিকা রেখা টেনে সিয়াচেন অঞ্চলকে ভাগ করা হয়, তার নাম AGPL (Actual Ground Position Line) কেউ কেউ বলেন, কারাকোরামের ওই জনহীন বসবাস-অযোগ্য অঞ্চলে সৈন্য মোতায়েন করা একেবারেই অর্থহীন। সিয়াচেনে সৈন্য মোতায়েন করা, ও তাদের ওখানে পাকাপাকি ভাবে থাকার ব্যবস্থা করা প্রচন্ড খরচসাপেক্ষ। শুনেছি একটা রূটির জন্যে নাকি ভারতীয় ফৌজের প্রায় ৬০ টাকা খরচ হয়।স্টিফেন কোহেন নামের এক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ একবার বলেছিলেন, সিয়াচেন হচ্ছে টাকমাথা দুজন মানুষের একটা চিরুনিকে নিয়ে লড়াই। আবার অন্যমতও আছে। সেখানে সিয়াচেনে অভিযানের সাফল্যকে ভারতীয় ফৌজের অসাধারন কৃতিত্ব হিসেবে ধরা হয়। এবং এটাও দেখানো হয়, ওই সালতারো রিজের নিচে পাক পল্টনকে আটকে না রাখলে, পুরো লাদাখ এলাকা পাকিস্তানের সামনে খোলা ময়দানের মত পড়ে থাকত। যে কোনো সময় তারা আক্রমন চালিয়ে নেমে আসতে পারত লাদাখের ওপরে। অপারেশন মেঘদুতকে কিন্তু পৃথিবীর একটি দেশ খুব ভালভাবে রপ্ত করেছিলো, এবং নিজেদের মত করে প্রয়োগ করে দেখিয়েছিলো। সে দেশ পাকিস্তান, আর প্রয়োগ করেছিলো কার্গিলে। কিন্তু সামরিক কৃতিত্ব শেষ পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখেনি রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক ব্যার্থতায়।

মানচিত্র ৩ – লাল রঙের রেখা দিয়ে AGPL চিহ্নিত করা আছে।

তানা বানা
তানা বানা শব্দটি হিন্দি। মানেটা ভারি সুন্দর। টানাপোড়েন, কিন্তু এই টানাপোড়েন মানে আসল টানাপোড়েন, যা তাঁতির তাঁতে থাকে। দু রকম সুতো, দুই অক্ষ বরাবর, একে অপরের সঙ্গে ৯০ ডিগ্রিতে অবস্থান করছে আর মাঝখান দিয়ে মাকু যাতায়াত করছে। সিয়াচেনের পশ্চিমে সালতারো রিজের প্রতিটি সামরিক ঘাঁটিকে নিয়ে ভারতীয় বাহিনি প্রতিরক্ষার এক নতুন তানা বানা তৈরি করতে শুরু করে ১৯৮৪ সালের পর। সে চেষ্টা তাদের পুরো সফল হয়নি। কারন ওদিকে পাক ফৌজও বসে নেই। তারাও সালতারো রিজের প্রতিটি ইঞ্চি খুঁটিয়ে মাপতে থেকেছে। এবং প্রায় প্রতিদিনই দু ফৌজের জবরদস্ত লড়াই হতে থেকেছে। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তান পুরো প্রস্তুতি নিয়ে ভারতীয় সেনা চৌকিগুলোর ওপর আক্রমন চালায়, কিন্তু ভারতীয় ফৌজিরা এই আক্রমন রুখে দেয়। যে পাকিস্তানি কম্যান্ডার সিয়াচেনে পাক আক্রমনের পরিকল্পনা করেন, তাঁর নাম পারভেজ মুশারফ। এরকম এক লড়াইয়ের সময়েই বিলাফন্ড-লা গিরিপথের বাঁদিকের এক চুড়ায় উঠে পড়ে পাক ফৌজ। এবং সামনে দেখতে পায় দুই ভারতীয় ফৌজি ঘাঁটি “অমর” এবং “সোনাম”। প্রবল উত্তেজনার সঙ্গে পাক ফৌজিরা লক্ষ্য করে সামনের দুই ভারতীয় ঘাঁটির উচ্চতা তাদের চেয়ে নিচে। এবং বিলাফন্ড-লা গিরিপথের ফাঁক দিয়ে তারা ১৫ কিলোমিটার দুরের সিয়াচেন হিমবাহ দেখতে পাচ্ছে। শুধু হিমবাহই নয়, ওই অঞ্চলে ৮০ কিলোমিটার অঞ্চলে ভারতীয় ফৌজের যাবতীয় পল্টনী ক্রিয়াকলাপ, ফৌজিরা এই চুড়ায় বসে দেখতে পাবে। দেরি না করে, ওই চুড়ায় পাক বাহিনি নিজেদের শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে ফেলল, বাঙ্কার সমেত। ঘাঁটির নাম দেওয়া হলো “কায়েদ পোস্ট”, কায়েদ-এ-আজম মহম্মদ আলি জিন্নার নামে। এই পাক ফৌজিরা সাধারন ফৌজি ছিলো না, এরা হলো পাকিস্তানের SSG (Special Services Group) কম্যান্ডো বাহিনি। SSG শাহীন কোম্পানির সুবেদার আতাউল্লা মহম্মদের নেতৃত্বে কম্যান্ডোরা এই চৌকির দায়িত্বে থাকে। কায়েদ পোস্ট পাকিস্তানের হাতে থাকা একমাত্র জায়গা, যেখান থেকে তারা ভারতীয় বাহিনির ওপর নজরদারি করতে পারে, এবং ভারতীয় পোস্টের চেয়ে বেশী উচ্চতায় থাকার কারনে, সামরিক দৃষ্টিকোন থেকে সুবিধে পায়।

কায়েদ পোস্ট ভারতের বিলক্ষন মাথাব্যাথার কারন হলো। পাক ফৌজিরা দিনরাত ভারতীয় সেনার দিকে চোখে দুরবিন লাগিয়ে পড়ে আছে। তারা কখন খায়, কখন শোয়, কখন গল্প গুজব করে, কখন বাড়ির জন্যে মনখারাপ করে কাঁদে, সব হিসেব পাক বাহিনি রেখে চলল। সিয়াচেনে রোজই দু পক্ষের খিটিমিটি লেগে থাকে। গোলাগুলি চলতে থাকে। পাক বাহিনি ওপরে থাকার কারনে প্রচুর সুবিধে পেয়ে যাচ্ছে। অমর ও সোনাম সেনা চৌকি দুটোতে রসদ ও লোক পৌঁছবার উপায় একমাত্র হেলিকপ্টার। সেই হেলিকপ্টারের উড়ানেও বিলক্ষন বাধার সৃষ্টি করে চলল কায়েদ পোস্ট। সেখান থেকে হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে অবিরাম গুলি চলতে লাগল। ১৯৮৭ সালের ১৮ই এপ্রিল কায়েদ পোস্টের SSG কম্যান্ডোরা ভারতীয় সোনাম পোস্টের ওপর গুলি চালায়, ও দুজন ভারতীয় সৈনিক মারা যায়। ভারতীয় সেনা কর্তারা প্রমাদ গোনেন। কায়েদ পোস্ট ওই অঞ্চলে ভারতীয় ফৌজের অস্তিত্ব সঙ্কট তৈরি করতে পারে, মনোবলে চিড় ধরাতে পারে। আর বিলাফন্ড-লা একবার পাকিস্তানি হাতে চলে গেলে, সিয়াচেনের পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, কায়েদ পোস্ট দখল করতে হবে। “লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে”? কায়েদ পোস্টের উচ্চতা ২১১৫৩ ফুট। কল্পনা করে দেখুন, সেখানে বাতাস কতটা পাতলা হতে পারে, অক্সিজেন কত কম হতে পারে। চতুর্দিকে খাড়া বরফের দেওয়াল, যার উচ্চতা দেড় হাজার ফুট। অর্থাৎ ওই চৌকিতে পৌঁছতে গেলে দেড় হাজার ফুট বরফের দেওয়ালের গা দিয়ে স্পাইডারম্যানের মত উঠে যেতে হবে, তাও পাক ফৌজের সদা সতর্ক নজর এড়িয়ে। সেই সঙ্গে আছে শুন্যের ৫০ ডিগ্রি নিচে তাপমাত্রা, ১৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার বেগে প্রচন্ড তুষারঝড় বা ব্লিজার্ড, চোরা বরফের খাঁজ বা ক্রিভাস, এবং আরো কত কিছু বাধা ও বিপত্তি।

জম্মু-কাশ্মীর লাইট ইনফ্যান্ট্রির ৮ম ব্যাটেলিয়ন দায়িত্ব পেলো কায়েদ পোস্ট দখল করার। ১৯৮৭র ২৯শে মে, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রাজীব পান্ডের নেতৃত্বে ১৩ জনের অনুসন্ধানী দল বেরিয়ে পড়ল কায়েদ চৌকিতে পৌঁছনোর রাস্তা খুঁজতে। দেড় হাজার ফুট একদম খাড়াই বরফের দেওয়াল বেয়ে তারা উঠেও এলো। কিন্তু কায়েদ পোস্ট থেকে তারা যখন মাত্র ৯০ ফুট দূরে, তখন পাকিস্তানি কম্যান্ডোরা তাদের দেখে ফেলে, ও মেশিনগান থেকে গুলি চালাতে শুরু করে। বরফের দেওয়ালে দড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় ভারতীয় সেনারা জবাবি গুলি ছুঁড়তে পারেননি, এবং সঙ্গে সঙ্গেই ১০ জন সৈনিক মারা যান। তরুন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রাজীব পান্ডে শহীদ হন। কিন্তু মারা যাবার আগে, লেফটেন্যান্ট পান্ডে ও তাঁর দল বরফের খাড়া দেওয়ালে বহু জায়গায় গর্ত করে ধাপ কেটে যান ওপরে ওঠার সময়, যেগুলো, পরবর্তি হানাদারির সময় অসম্ভব কাজে লাগে ভারতীয় সেনার। লেফটেন্যান্ট পান্ডের দলের লাগিয়ে যাওয়া দড়িও থেকে যায় বরফের দেওয়ালে। রাজীব পান্ডের নাম মনে রেখে কায়েদ পোস্ট দখল করার পরবর্তী পরিকল্পনার নাম দেওয়া হলো অপারেশন রাজীব। জম্মু-কাশ্মীর লাইট ইনফ্যান্ট্রির মেজর বারিন্দর সিং এর নেতৃত্বে ২ জন অফিসার, ৩ জন জুনিয়র কমিশনড্‌ অফিসার, এবং ৫৭ জন জওয়ান সমেত মোট ৬২ জন সৈনিকের দল গঠন করা হলো পরের কয়েক দিনে। মেজর বারিন্দর সিং এর ডেপুটি হিসেবে দায়িত্ব পেলেন ক্যাপ্টেন অনিল শর্মা। সিয়াচেন বেস ক্যাম্পে প্রস্তুতি ও বিদ পরিকল্পনা শুরু করা হলো।মুশকিল হলো, প্রচন্ড বরফের ঝড় ও পাতলা বাতাসের জন্যে সেনাবাহিনির চিতা হেলিকপ্টারের মালবহন ক্ষমতা খুব কমে গেছে। মাত্র ২ জন সৈনিক ও তাদের অস্ত্র ও রসদ বয়ে নিয়ে যেতে ৩ থেকে ৪ বার উড়তে হচ্ছে হেলিকপ্টারকে। পরের ২০ দিন ধরে একটু একটু করে ৬২ জন সৈনিক, অস্ত্র ও অন্যান্য মালপত্র নিয়ে যাওয়া হলো ওপরের বিলাফন্ড-লা ফরওয়ার্ড পোস্টে। সে সময় একবার হেলিকপ্টারের উড়ানে খরচ হতো ৩৫ হাজার টাকা। কাজেই ২০০র ওপর উড়ানে কত খরচ হয়েছিলো ভেবে দেখুন। সেই ১৯৮৭ তে অঙ্কটা বিশাল। ফরওয়ার্ড পোস্টে আক্রমনকারী তিনটে দল তৈরি করা হলো। প্রথম দলের নেতৃত্বে সুবেদার হরনাম সিং, দ্বিতীয় দল রইলো সুবেদার সনসার চাঁদের অধীনে, আর তৃতীয় দলের নেতৃত্বে রইলেন নায়েব সুবেদার বানা সিং। এইবার গপ্পে এলেন বানা, তা না হলে, সিয়াচেনে তানা বানার গল্প পুরো হয় না। 

২৩শে জুন রাত্রে সুবেদার হরনাম সিং ১০ জন জওয়ান নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন লেফটেন্যান্ট রাজীব পান্ডের দলের লাগানো দড়ি খুঁজে বের করতে। কিছুটা পেছনে সুবেদার সনসার চাঁদের নেতৃত্বে আরো ১০ জন সৈনিক হরনাম সিং এর দল কে অনুসরন করতে লাগল। হরনাম সিং এর দলবল বেশ কিছুটা খোঁজাখুঁজি করে, বরফের তলায় চাপা পড়া, রাজীব পান্ডের লাগানো দড়ি বের করল। তার পর শুরু হলো সেই দড়ি ধরে খাড়া বরফের দেওয়াল বেয়ে ওঠা। অত্যন্ত সন্তর্পনে, কারন একটু আওয়াজ হলেই পাক কম্যান্ডো বাহিনির নজরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। চুড়ার কাছাকাছি এসে, তখন আর প্রায় ১৫০ ফুট দূরে, নায়েক তারা চাঁদের নজরে এলো, ওপর দিকে কিছু নড়াচড়া করছে। তারা চাঁদ সঙ্গে সঙ্গে দড়িতে নিচের লোকজনকে আরো নিচে নেমে যেতে বললেন। কিন্তু ওপর থেকে ততক্ষনে পাকিস্তানি মেশিনগান গর্জন শুরু করেছে। তারা চাঁদ এবং তার নিচের আরো দুই সৈনিক সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়লেন। হরনাম সিং বাকি লোকজন কে নিয়ে প্রথমে বরফের খাঁজে, ও পরে খাড়াই বরফে গর্ত করে তার ভেতর বসে রইলেন। পরে নিহতদের নিয়ে তাঁরা নিচে নেমে আসেন। প্রথম আক্রমন ব্যর্থ হলো।

২৫শে জুন রাত্রে সনসার চাঁদের নেতৃত্বে দ্বিতীয় আক্রমন চালানো হলো। এবারে প্রস্তুতি কিছুটা আলাদা রকম। যে সময় সনসার চাঁদ ও অন্য জওয়ানরা দড়ি বেয়ে উঠছিলেন, সেই সময় সোনাম ও অমর পোস্ট থেকে কায়েদ পোস্ট লক্ষ্য করে ক্রমাগত গুলি চালানো হতে লাগল, যাতে পাক ফৌজিদের নজর অন্য দিকে না যায়। এই তালে সনসার চাঁদ কায়েদ পোস্টের খুব কাছে পৌঁছে গেলেন, আর নিচে তাঁর কম্যান্ডার বারিন্দর সিং এর কাছে আরো লোক চাইলেন, কিন্তু মাইনাস ২৫ ডিগ্রিতে, ঠান্ডায় বেতার ব্যবস্থার ব্যাটারি কাজ করলনা। বারিন্দর সিং তখন ৩০০ ফুট নিচে। উপায়ন্তর না দেখে সনসার চাঁদ, হাবিলদার রামদত্‌ কে বললেন নিচে গিয়ে খবর দিতে, ও আরো লোক নিয়ে আসতে। হাবিলদার রামদত্‌ দড়ি বেয়ে নামতে শুরু করার পর পাক ফৌজিদের নজরে পড়ে যান। মেশিনগান গর্জে ওঠে, গুলিবিদ্ধ হাবিলদার রামদত্‌ এর দেহ ৫০০ ফুট নিচে বরফের মধ্যে পড়ে যায়। সে দেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানি পোস্ট থেকে এবার নিচের দিকে টানা ফায়ারিং হতে থাকলো। কিন্তু অত ঠান্ডায় ভারতীয় সিপাহিদের রাইফেল জ্যাম হয়ে যায়,  যার ফলে নিচে নেমে আসতে হলো সনসার চাঁদের দলকে। দ্বিতীয় আক্রমন ব্যর্থ হলো।

মানচিত্র ৪ – হলদে রঙের রেখা দিয়ে AGPL (Actual Ground Position Line) চিহ্নিত করা আছে। লাল তারকা দিয়ে বানা পোস্ট ও NJ9842 দেখানো আছে।

২৩-২৪-২৫ , এই তিন রাত অসম্ভব ঠান্ডায়, কম অক্সিজেনের মধ্যে বরফের খাড়াইয়ের মধ্যে প্রায় ঝুলতে থাকা ফৌজিরা তাঁদের ক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেলেন। বোঝা যাচ্ছিলো, আর বেশীক্ষন যুঝতে পারা যাবেনা। এর মধ্যেই অনেকগুলো প্রান চলে গেছে ভারতীয় ফৌজের। পাক পক্ষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অজানা, কিন্তু ওপরে বাঙ্কারের মধ্যে বসে থাকা পাক সেনাদের ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশী নয়, সেটা বোঝা যাচ্ছিল। নিচে দড়িতে ঝুলতে থাকা ভারতীয় সিপাহিরা ক্রমাগত পাক হেলিকপ্টারের আওয়াজে বুঝতে পারছিলেন, যে রসদ ও অস্ত্রের যোগান আসছে সেখানে নিয়ম মাফিক। মরিয়া ভারতীয় সৈনিক এবং অফিসাররা ঠিক করলেন শেষ চেষ্টা করে দেখবেন। কিন্তু রাত শেষ হয়ে আসছে। আরো ১৬-১৮ ঘন্টা এই ভাবে থাকা সম্ভব নয়, কারন তাতে শক্তি অবশিষ্ট থাকবেনা আক্রমনের ও লড়াইয়ের। খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, এবং ঠিক করা হলো আক্রমন করা হবে দিনের আলোতেই। মেজর বারিন্দর সিং, নায়েক সুবেদার বানা সিং কে বলেন, পারলে পাকিস্তানি সৈনিকদের বন্দী করতে, জীবন্ত। বানা সিং স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় পাঞ্জাবীতে উত্তর দেন “স্যর, এহ্‌ (পিঁকপিঁক) মেরি মওসি দে পুত থোড়ি না হ্যায়গে” , স্যার এই (খিস্তি)রা আমার মাসির ছেলে তো নয়...। মেজর সাব নাকি এই শুনে ওই দড়িতে ঝুলন্ত অবস্থাতেই মুচকি হেসেছিলেন। সত্যি-মিথ্যে জানিনা, তবে বানা সিং এর ইন্টারভিউয়ের অনেক ভিডিও পাবেন ইন্টারনেটে। সেখানে ওনার মুখেই শুনতে পারেন।

বারিন্দর সিং এর নেতৃত্বে ৮ জন সৈনিক এগোতে লাগলেন সকাল হতেই। প্রচন্ড তুষারঝড় ও বরফ পাত শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। পেছনের ঘাঁটি থেকে ভারতীয় আর্টিলারি (কামান) লাগাতার গোলাবর্ষন করতে লাগল, যাতে করে পাক ফৌজিরা বাঙ্কারের বাইরে মাথা না বের করতে পারে। বানা সিং ৫ জন জওয়ান কে নিয়ে অন্য এক পথ ধরে ওপরে উঠতে শুরু করলেন। সে দিক আরো বেশী কঠিন, এবং কেউ কল্পনাতেও আনতে পারবেনা, যে ঐ দিক দিয়ে কেউ চুড়ার দিকে যাবার কথা ভাবতে পারে। প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে একটু একটু করে এগনো। পাকিস্তানি কম্যান্ডোরা বাঙ্কারের সামনে, নিচের দিকে মেজর বারিন্দর সিং এর ৮ জন জওয়ান কে নিয়েই ব্যস্ত। গুলির লড়াই চলছে ক্রমাগত। মেজরের বুক, একটা বুলেট ফুঁড়ে দেওয়া সত্বেও মেজর লড়াই ছাড়লেন না। নিজের অবস্থান রক্ষা করে গেলেন, এবং পাক ফৌজিদের ব্যস্ত রেখে গেলেন। প্রায় ছ ঘন্টার অমানুষিক পরিশ্রমের পর বানা সিং, লক্ষন দাস, ওম রাজ, চুনি লাল এবং কাশ্মীর চাঁদ এই পাঁচ সৈনিক প্রবল তুষার ঝড় এবং মাইনাস তিরিশ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে বেলা সোয়া বারোটা নাগাদ কায়েদ পোস্টের পেছন দিক দিয়ে উঠে এলেন ২১১৫৩ ফুট উচ্চতায়। সামনে সুরক্ষিত পাকিস্তানি বাঙ্কার। বানা সিং এগিয়ে গিয়ে বাঙ্কারের পেছনের দরজা খুলে ভেতরে একটা গ্রেনেড ছুঁড়ে দিলেন। বাঙ্কারের ভেতরে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈনিক তাতে ঘায়েল হলেন বটে, কিন্তু সবাই নয়। বানা সিং এবং বাকিরা হালকা মেশিনগান বসিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করলেন। কিন্তু অত ঠান্ডায় একটি মাত্র গুলি ছুঁড়েই মেশিনগান আটকে গেল। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ঝুলছে জীবন, বানা সিং রাইফেলের বেয়নেট বাগিয়ে সামনে ছুটে গেলেন পাকিস্তানি সেনাদের দিকে। কায়েদ পোস্টে ছিলেন সুবেদার আতাউল্লা মহম্মদের নেতৃত্বে ১৭ জন SSG কম্যান্ডো, যাঁদের ট্রেনিং দেয় আমেরিকান সেনাবাহিনি, এবং SSG কে তুলনা করা করা হয় আমেরিকান নেভি সীল দের সঙ্গে। বানা সিং কে দেখে বাকি চার ভারতীয় সৈনিকও বেয়নেট বাগিয়ে সামনে ছুটে গেলেন। শুরু হলো হাতাহাতি লড়াই। কয়েক মিনিটের মধ্যে ৬ জন পাকিস্তানি সৈনিক মারা গেলেন, বাঙ্কারের ভেতরে আরো কয়েক জন মৃত অবস্থায় পড়েছিলেন। অবশিষ্ট কয়েক জন পাকিস্তানি ফৌজি নাকি ভারতীয় সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচতে, ওই চুড়া থেকে ঝাঁপ মারেন। তাঁদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পোস্ট হাতছাড়া বুঝে পাকিস্তানি আর্টিলারি প্রচন্ড ফায়ারিং শুরু করে। মেজর বারিন্দর সিং সহ অন্য সৈনিকরা উঠে আসেন পোস্টে, এবং বাঙ্কারে আশ্রয় নেন। একটু দেরি হওয়ায় জওয়ান ওম রাজের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গোলার আঘাতে। ওম রাজকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। অত্যধিক রক্তপাতে ওম রাজ মারা যান। ভারতীয় আর্টিলারি জবাব দিতে থাকে। আরো এক রাত কেটে যায়। পরের দিন কায়েদ পোস্ট বিজয়ীদের উদ্ধার করা হয়। অন্য সৈনিকরা এসে পোস্টের ভার নেন। পরে পাকিস্তানি সৈনিকদের মৃতদেহ কার্গিলের কাছে এক ফ্ল্যাগ মিটিংএ পাকিস্তানি ফৌজের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সুবেদার বানা সিং কে অসাধারন বীরত্বের জন্যে পরমবীর চক্র, যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সন্মান দেওয়া হয়। মহাবীর চক্র দেওয়া হয় সুবেদার হরনাম সিং কে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রাজীব পান্ডে মরনোত্তর বীরচক্রে ভূষিত হন। মেজর বারিন্দর সিং কেও বীরচক্র দেওয়া হয়। ওম রাজ (মরনোত্তর), চুনি লাল সেনা মেডেলে ভূষিত হন। কায়েদ পোস্টের নাম বদলে রাখা হয় বানা পোস্ট, বানা সিং এর নামে। সিয়াচেন হিমবাহ, এবং সালতারো রেঞ্জের ওপরে শেষ পাকিস্তানি হুমকিও আর রইলোনা। ভারতীয় প্রতিরক্ষার তানা বানা এবার সম্পূর্ণ।

কায়াদত সে কায়ামত তক
আপনার আর আপনার পাশের বাড়ির মাঝে এক ফালি সরু গলির মত ফাঁকা জায়গা। যাকে বাংলায় বলে “Common Passage” । আপনার প্রতিবেশি সেখানে এক খানা বড় গামলায় সাধের ফনিমনসা কিম্বা শনিমনসা ( শনিবারে শনিবারে ফুল ফোটে। মন্দার বোস বলেছেন যে) ফলিয়ে আপনার দিকের ভাগে রেখে দিলেন এমন ভাবে, যে আপনাকে রোজ বাড়ি ঢোকা বেরোনোর সময় সেটিকে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে যেতে আসতে হয়। আপনি দু-তিন দিন আপত্তি জানালেন। শেষে রেগে মেগে গামলা সুদ্ধু শনি বা ফনিমনসা সরিয়ে দিলেন দূরে, সেই গলির এক্কেবারে পেছন দিকে, সেপটিক ট্যাংকের কোনায়। আর ওই জায়গায় নিজের সাধের ঝাউ চারাওয়ালা পোর্সেলিনের বাহারি টব রাখলেন। এর পর আপনার প্রতিবেশি হাসি হাসি মুখে এসে আপনাকে বলে গেল, বাঃ কি সুন্দর ঝাউ চারা, আমার ফনি বা শনি মনসা সরিয়ে নিলুম পাকাপাকি মশায়, আপনিই গাছ করুন। বলি এরকমধারা আষাড়ে গপ্প শুনেছেন কোথাও? লাঠালাঠি ফাটাফাটি সিপিএম-তিনোমূল এবিপি আনন্দ-চব্বিস ঘন্টা হয়ে যাবে মশায়, যদি এমন কিছু ঘটে। রোগাভোগা,পালাজ্বর-পিলে সমেত বাঙালীরাই যদি এই নিয়ে ক্ষেপে যায়, তাহলে ভাবুন দিকি তাগড়া পাঞ্জাবী-পাঠানের রক্ত কতখানি টগবগিয়ে ওঠে যখন আপনি কায়েদ পোস্ট গায়ের জোরে দখল করে তার নাম বদলে দেন! পাকিস্তানি ফৌজ আর যাই হোক কাপুরুষ নয় যে কিল খেয়ে কিল হজম করে নেবে। আটষট্টি বছর আগে একই ফৌজ ছিলো তারা আর ভারতীয়রা। কাজেই, কায়েদ পোস্ট হারানোর বদলা যে পাকিস্তানি সেনা নেবেই, এটা আন্দাজ করা কঠিন নয়। প্রশ্ন হলো কিভাবে, এবং কখন, কবে?

পাকিস্তানি নর্দান আর্মি কম্যান্ডের অফিসাররা জানতেন, ফৌজের মনোবল ফেরাতে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিআক্রমনে যেতে হবে। কিন্তু কারাকোরামের ওই উচ্চতায় দুম করে কিছু করা অসম্ভব। সামান্যতম প্রস্তুতির জন্যেও অনেক পরিশ্রম ও পাকা পরিকল্পনার প্রয়োজন। পাক বাহিনির বাহাদুরি এখানেই, যে মাত্র দু মাসের মধ্যেই তারা এই অসম্ভব কাজ কে সম্ভব করে দেখিয়েছিলো। জুলাই ও আগস্ট মাসের মধ্যেই সৈন্যসজ্জা হয়ে গেল, তাদের ওই আবহাওয়ার মানিয়ে নেওয়াও হলো। অস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদ, সব কিছুই যোগাড় করা হলো। এবার অপেক্ষা সঠিক সময় ও সুযোগের। পুরো পরিকল্পনাটি করেন, পরবর্তিকালে পাকিস্তানের রাস্ট্রপতি, জেনারেল পারভেজ মুশারফ। ১৯৮৭র সেপ্টেম্বরের শুরুতে পাক সেনারা আক্রমনের জন্য তৈরি হয়ে সামনের ঘাঁটিগুলোতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এলো। বিলাফন্ড-লা অঞ্চল হলো সেই এলাকা, যেখান থেকে সিয়াচেন হিমবাহ সবচেয়ে কাছে। এই অঞ্চলেই পাক সেনার হাতছাড়া হয় কায়েদ পোস্ট। জানিনা কেন, জেনারেল মুশারফ পালটা আক্রমনের জন্যে এই বিলাফন্ড-লাকেই বেছে নিলেন। যাই হোক, পুরো পরিকল্পনার নাম দেওয়া হলো অপারেশন কায়াদত। তুলনামূলক ভাবে ওপর দিকে থাকার জন্যে, ভারতীয় সেনারা নিচে পাক সেনার প্রস্তুতি দেখতে পেতেন। সৈন্য সংখ্যা, এবং ভারি অস্ত্রশস্ত্রের পরিমান বাড়তে দেখে ভারতীয় সেনা কর্তারা বুঝতে পারলেন, পাকিস্তান পালটা আঘাতের চেষ্টা করতে পারে। সেই বুঝে, ভারতীয় ফৌজ, নিজেদের ঘাঁটি মজবুত করতে শুরু করল। এই পরিকল্পনার নাম দেওয়া হলো অপারেশন বজ্রশক্তি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি দুই সেনা প্রস্তুতি সাঙ্গ করে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়ালো।

২৩শে সেপ্টেম্বর SSG র শাহীন ব্রিগেড (SSG ৩নং ব্রিগেড), ১নং ব্রিগেড ও নর্দান লাইট ইনিফ্যান্ট্রির সৈন্যরা ভারতীয় চৌকির ওপর হামলা চালালো ভোর ৬টার সময়। এক একটা ব্রিগেড মানে, প্রায় ৬০০ জন সৈনিক তাতে থাকবেন কমপক্ষে। এদিকে উলটো দিকে উনিশ হাজার ফুট উচ্চতায় ভারতীয় ঘাঁটি অশোকে তখন নায়েব সুবেদার লেখরাজের নেতৃত্বে মাত্র আটজন সৈনিক। ভারতীয় বাংকার থেকে ভারি মেশিনগানের টানা ফায়ারিং হতে থাকে, ফলে পাক ফৌজিরা সামনে এগোতে পারছিলোনা। তাদের নেতৃত্বে থাকা ক্যাপ্টেন নজরত পেছনের রেহবার পোস্ট থেকে সাহায্য চেয়ে পাঠান রেডিওতে। এক ধরনের মাঝারি মিসাইল আছে, যেগুলোর সঙ্গে একটা তার যুক্ত থাকে, এবং মিসাইল ছোঁড়ার পরে, সেই তার দিয়ে মিসাইল কে নিয়ন্ত্রন করা যায়, এদিক ওদিক ঘোরানো যায়। এই TOW মিসাইল (Tube-launched, Optically tracked, Wire-guided। BGM-71, আমেরিকায় তৈরি) সাধারনতঃ ট্যাংক ধ্বংস করার জন্যে ব্যবহার করা হয়। রেহবার পোস্ট থেকে পাকিস্তানি সেনারা এই TOW মিসাইল ছুঁড়লো ভারতীয় বাঙ্কার লক্ষ্য করে। নির্ভুল লক্ষ্যে উড়ে গেল ভারতীয় বাঙ্কার, চলে গেল তিনটি প্রান। বাকি পাঁচ ভারতীয় সৈনিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে জায়গা নিয়ে গুলি ছুঁড়ছিলেন বলে বেঁচে গেলেন। এবং এই ছড়িয়ে থাকা, এবং ঘন ঘন জায়গা বদলানোর জন্যেই পাঁচ ভারতীয় সৈনিক কে লক্ষ্য করে গুলি গোলা ছোঁড়া পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে খুব কঠিন হয়ে যায়। উপরন্তু টানা গুলিবর্ষনের মুখে পড়ে পাকিস্তানি আক্রমন ভেঙ্গে পড়ে। নেতৃত্বে থাকা ক্যাপ্টেন নজরত বুঝতে পারেন এই প্রতিরোধের মধ্যে এগিয়ে যাওয়া আত্মহত্যার সামিল, তাই তিনি ধিরে ধিরে পাক সেনাদের পেছিয়ে নিয়ে আসেন, ও নিজেদের অবস্থানে ফিরে যান।          
                         
ক্যাপটেন নজরত পেছিয়ে আসার পর, আক্রমনকারি বাহিনির ক্ষয়ক্ষতি পুরন করা নয় নতুন লোকবল দিয়ে। এবারে যোগ দিলেন ক্যাপ্টেন রশিদ, ক্যাপ্টেন চীমা, ক্যাপ্টেন মহম্মদ ইকবাল, আকবর, ইমরান, (শেষ দুজনের ফৌজি পদমর্‍্যাদা আমি জোগাড় করতে পারিনি, তবে আন্দাজ এনারাও কমিশনড অফিসার) এবং এনাদের ইউনিটের লোকজন। এ ছাড়া পেছনের ঘাঁটি থেকে এনাদের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন নায়েব সুবেদার শের বাহাদুর, ক্যাপ্টেন সরতাজ আলি এবং রেজিমেন্টাল মেডিক্যাল অফিসার। এবারে অনেক বড় বাহিনি নিয়ে ব্যাটেলিয়ন কম্যান্ডার মেজর রানা আক্রমন চালালেন। রাত তখন প্রায় ১১টা। কিন্তু এবার  ভারতীয় প্রতিরোধ ছিল অনেক সংঘবদ্ধ। অশোক পোস্টের পেছন থেকে মর্টারের গোলাবর্ষন করা হতে লাগল টানা। আর সোনাম পোস্ট থেকে রকেট হামলা চালানো হলো। একটা সময় মনে হচ্ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের পায়ের নিচের বরফ ফেটে উড়ে যাচ্ছে। পাক ফৌজিরাও পালটা গুলি ছুঁড়ছিলেন। কিন্তু অন্ধকারে, ওপরে বসে থাকা তুলনামুলক ভাবে অনেক কম সংখ্যক ভারতীয় সিপাহিদের খুঁজে বের করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। একটা রিপোর্টে পড়লুম, ভারতীয় সৈনেরা নাকি ওপর থেকে খালি ডালডার টিনে বরফ ভর্তি করে নিচে ছুঁড়ে ফেলছিলেন। সে বস্তু পাকিস্তানি সেনাদের পাহাড়ে চড়ায় বিলক্ষন বাধার সৃষ্টি করেছিল। ওদিকে পাকিস্তানি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ধরে ফেলে ভারতীয়রা তাদের মেসেজ শুনতে শুরু করে। ধুন্ধুমার গোলাগুলির মধ্যেই রাত প্রায় ৩টে নাগাদ পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন রশিদের গলায় এই মেসেজটি শোনা যায় – “দু ঘন্টা হয়ে গেল, আমরা এখনো ওপরে ওঠার দড়ি লাগাবার ব্যবস্থা করতে পারিনি, একটু পরেই দিনের আলোয় আমাদের ওরা দেখে ফেলবে। চীমা মারা গেছে, আরো বহু লোক গুরুতর আহত। তাড়াতাড়ি আরো সাহায্য পাঠান”। সন্ধ্যের আগেই ভারতীয় ফৌজের জম্মু-কাশ্মীর লাইট ইনিফ্যান্ট্রি ও গাওয়াল রাইফেলস এর আরো কিছু লোকজন নিয়ে মেজর চ্যাটার্জী এসে পৌঁছে গিয়েছিলেন বিলাফন্ড-লা এর মুখে। সারা রাত ধরে তিনি প্রতিটি পোস্ট , প্রতিটি সৈনিকের কাছে গিয়ে তাদের সাহস জুগিয়ে গেছেন, এবং সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। ফলে ভারতীয় পক্ষে সৈনিকদের মনোবল ছিল অটুট। কিন্তু মেসেজ শোনার পর বোঝা যায় পাকিস্তানি পক্ষে মনোবল ভেঙ্গে পড়ার মুখে। কিছু পরে আক্রমন বন্ধ হয়ে যায়, ও পাকিস্তানি ফৌজ নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যায়।         

পরের রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা আরো একবার ফিরে আসে। পাকিস্তানি ফৌজের নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন রশিদ এবং ক্যাপ্টেন ইকবাল। কিন্তু মেজর রানা একেবারে সামনে আসেন নি। তিনি পেছনে ঘাঁটিতে বসে রেডিওতে আক্রমন পরিচালনা করতে থাকেন। এবং এইবারের কুশলী আক্রমনে পাক সেনা বানা চৌকির খুব কাছে চলে আসে। কিন্তু প্রচন্ড ভারতীয় প্রতিরোধের মুখে পড়ে অনেক লোক হারিয়ে ক্যাপ্টেন রশিদ পেছনে পাক ঘাঁটিতে বসে থাকা অফিসারের কাছে আর্জি জানান যাতে তাঁদের সাহায্যের জন্য আরো কিছু লোক পাঠানো হয় – “Wherever I move the enemy fires at me”। উত্তরে রেডিওতে অদ্ভুত কথা ভেসে আসে পাকিস্তানি ঘাঁটি থেকে – “The kafirs have got hold of our radio frequencies and are monitoring them, all troops switch to alternate frequencies.”। অসহায় ক্যাপ্টেন রশিদ উত্তর দেন “Sir, we are not carrying our alternate frequencies and all our teams have left the base.”। এর কিছুক্ষন পর ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানি ফ্রিকোয়েন্সি তে অন্য একটা বার্তালাপ ধরতে পারে “Rashid has been killed and the reinforcements have not reached, tell these seniors to come forward and see for themselves. They are safe in their bunkers and care little for us.”। কথাগুলো আমি ইংরেজিতে রাখলাম ইচ্ছেকরেই, কারন ঠিক কি ভাষায় এগুলো বলা হয়েছে তা আমি নিজে সঠিক জানিনা। হতে পারে উর্দু, হতে পারে পাঞ্জাবী, এমন কি হতে পারে ইংরিজিতেও। কেননা পাক-ভারত দু দেশেরই সেনা অফিসাররা বেশ অভিজাত শ্রেনী, এবং তাঁরা প্রায়শঃই ইংরিজিতে কথা বলে থাকেন। জানিনা, এই ভাবে নিশ্চিত আত্মহন্তারক আক্রমনের পরিকল্পনা পাক ফৌজ কেন করেছিল। পাক ফৌজের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও তালিম ভারতীয় ফৌজের সমান সমান। পাক সেনাবাহিনি পৃথিবীর সেরা কয়েকটি সেনাবাহিনির মধ্যে একটি বলে পরিগনিত হয়। ক্যাপ্টেন রশিদের মত অত্যন্ত কুশলী অফিসারকে এই ভাবে কেন মরতে হলো, তার জবাব হয়ত কাউকে দিতে হবেনা। কেননা গোপন মিলিটারি তথ্য গনতান্ত্রিক ভারতেই হাতে গোনা লোকে জানতে পারে, আর এ তো পাকিস্তান। ক্যাপটেন ইকবাল পরে হিলাল-এ-জুরাত মেডেল লাভ করেন এই যুদ্ধের পর। হিলাল-এ-জুরাত ভারতের মহাবীর চক্রের সমতূল্য।

অপারেশন কায়াদত শেষে পরিনত হলো কায়ামতে। কায়ামত কথাটির অর্থ বিনাশ। কোথাও কোথাও দেখতে পাচ্ছি, এই আক্রমনে পাকিস্তান নাকি প্রায় এক হাজার সৈন্য হারায়। তুলনামূলক ভাবে সংখ্যাটা কেমন? কার্গিল যুদ্ধে ৫২৭ জন ভারতীয় সৈনিকের প্রানহানী হয় প্রায় দু মাসে। ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের প্রায় ৩৮০০ জওয়ান প্রান হারান। আর এখানে মাত্র দু রাতের মধ্যে পাকিস্তান হারায় ১০০০ সৈনিক, তাও একটি মাত্র লড়াইয়ে। ভারতীয় পক্ষে নিহতের সংখ্যা ৬-৮ জন। কাজেই বুঝতে পারছেন নিশ্চই, জেনারেল পারভেজ মুশারফের পরিকল্পনা মোটেই সুবিধের হয়নি। বরং ভারতীয় ফৌজের মনোবল এই লড়াইয়ের পরে অনেকাংশে বেড়ে যায়। কিন্তু সেই সঙ্গে বেড়ে যায় রক্তারক্তি। ছোটোখাটো ঝামেলা, লড়াই, প্রানহানী ঘটতেই থাকে। যেমন ১৯৮৯ সালে চুমিক হিমবাহে দু পক্ষের ধুন্ধুমার লড়াই লাগে। ওই অঞ্চলে পাকিস্তান একটা অনুসন্ধানী চৌকি তৈরি করে, সেই চৌকি ভারতের মাথাব্যাথার কারন হয়ে ওঠে। এখান থেকে ভারতীয় পোস্টগুলোর ওপর নজর রাখা যেত। এবার ভারতীয় আক্রমন, কিন্তু আক্রমন সফল হয়না। কারন পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি খুব ভাল ভাবে করা হয়েছিল। অনর্থক লোকক্ষয়ের রাস্তায় না গিয়ে, ভারতীয় ফৌজিরা এবার অন্য রাস্তা নিলেন। ২১০০০ ফুট উঁচুতে ওই সেনাচৌকিকে পেছন থেকে সমর্থন যোগাত পাকিস্তানের কওসর ঘাঁটি। ব্রিগেডিয়ার আর কে নানাবতির পরিকল্পনায় প্রবল আর্টিলারি ফায়ারিং এ উড়ে যায় কওসর পোস্ট, আর পাক বাহিনি কে পোস্ট ছেড়ে নিচে নেমে যেতে হয়। ১৯৯২ সালের আগস্ট মাসে ভারতীয় বাহাদুর পোস্ট দখল করতে এগিয়ে আসে পাক ফৌজ। কিন্তু আগে থেকে পাকিস্তানি পরিকল্পনা বুঝতে পেরে, ভারতীয় সেনারা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করে রেখেছিল (অপারেশন ত্রিশূল শক্তি)। ফলে পাক আক্রমন সফল হয়না। উপরন্তু হেলিকপ্টারে করে ঘোরার সময়, ভারতীয় ক্ষেপনাস্ত্রের আঘাতে হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়ে প্রান হারান পাক ফৌজের নর্দান কম্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ সেনানায়ক, ব্রিগেডিয়ার মাসুদ নাভেদ আনওয়ারি। ব্রিগেডিয়ার মাসুদের মৃত্যুতে পাকিস্তানি আক্রমন প্রবল ধাক্কা খায়, ও থেমে যায়। ১৯৯৫ তে, এবং ১৯৯৯ সালেও বড় লড়াই হয় সিয়াচেনে। ৯৫ সালে ভারতীয় তীয়াকশি ঘাঁটি দখল করতে অসফল হামলা চালায় পাকিস্তান। আর ১৯৯৯ তে পাকিস্তানি নাভেদ টপ(চীমা টপ বা বিলাল টপ ও বলেন কেউ কেউ) ভারতীয় সেনারা নিজেদের দখলে আনে। সিয়াচেনের ওপর ক্রমশঃই আলগা হয়ে আসে পাকিস্তানের মুঠো। অবশেষে আসে ২০০৩ সাল, যখন দু পক্ষই অস্ত্র সংবরন করে, এবং যে যার নিজের অবস্থানে থেকে যায়। দু চারটে গোলাগুলি যে তার পরে চলেনা তা নয়, কিন্তু সেটা তার আগের রোজকার নিরন্তর চলা গোলাগুলির মত নয়।

হাড়হিম হিমবাহ
গোলাগুলি নাহয় থামল ২০০৩ এর পর। কিন্তু অবিশ্বাস গেল না। নিয়ন্ত্রন রেখার দু দিকে, দুই সেনাবাহিনির সঙ্গে পারস্পরিক অবিশ্বাস পাকাপাকি ঘাঁটি গেড়ে বসে পড়ল। এক বিদেশী সাংবাদিকের লেখায় পড়ছিলাম, তিনি পাকিস্তান ও ভারত দুদিকেই একদম সামনের দু একটি সেনা চৌকি ঘুরে দেখেছেন, এবং নিজের অভিজ্ঞতা বর্ননা করেছেন। যে ভারতীয় সেনা চৌকিতে তিনি গিয়েছিলেন তার দায়িত্বে ছিলেন এক তরুন বাঙালি লেফটেন্যান্ট সোমনীল দাস। সোমনীল কলকাতার ছেলে, গ্রুপ থিয়েটার করতেন, কবিতাও লিখেছেন এক সময়, কলেজের পর ঝোঁকের মাথায় পরীক্ষা দিয়ে সেনাবাহিনিতে ঢুকে পড়েন। ১৯৪০০ ফুট ওপরে সেনাচৌকিতে বসে সোমনীল গল্প শুনিয়েছেন কি ভাবে রোজ ১০-১৫ টা পাকিস্তানি গোলা এসে তাঁদের আসেপাশে ফেটে পড়ে, এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের শুয়ে পড়ে বা পরিখায় ঢুকে আত্মরক্ষা করতে হয়। শুনিয়েছেন কি ভাবে বাতাসে শুন্যে ফেটে পড়া গোলা থেকে ছুটে আসা গোলার টুকরোর শব্দে শক্তপোক্ত পোড়খাওয়া ফৌজির ও তলপেটে চাপ লাগে। হাসতে হাসতে বলেছেন এখানে পায়খানা করার খুব অসুবিধে। বাথরুম নেই, জল নেই, কিছুই নেই এই পাহাড়ের চুড়োয়। দু তিন দিন ১০-১২ জনের পায়খানা জমে গেলেই অনেক উঁচু হয়ে যায়, আর মাইনাস তিরিশ ডিগ্রিতে সে সব জমে পাথর হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গেই। ফুটন্ত জল ঢেলেও তাকে সরানো যায়না। তখন ফৌজিরা নাকি লাইট মেশিনগান বসিয়ে ফায়ার করে, আর পুরো স্তুপ ছোটো ছোট টুকরোয় ভেঙ্গে পাহাড়ের নিচে হিমবাহের ওপর কোথাও পড়ে যায়, যেখানে হয়ত এই ফৌজিদেরও যে কোনো সময় পড়তে হতে পারে শত্রুর গুলি খেয়ে।

যে ছেলে কবিতা লিখেছে, থিয়েটারে অভিনয় করেছে, হয়ত রবিঠাকুরের গান গেয়েছে, পদ্য ও আউড়েছে এবং উপভোগ করেছে, তাকে যখন ১২০ দিন এই ১৯ হাজার ফুটের ওপর বসে বরফে জমে যাওয়া পায়খানার স্তুপে মেশিনগানের ফায়ারিং দেখতে হয়, তার কেমন লাগে? কেমন লাগে হাজার হাজার ভারতীয় ও পাকিস্তানি সৈনিকের? ঘরবাড়ি সব ছেড়ে এই অজানা অচেনা পরিবেশে দিনের পর দিন বসে থাকতে আর অপেক্ষা করতে হয় ধ্বস, নাহয় ক্রিভাস, নয়ত হাই অল্টিচিউড সিকনেস নয়ত শত্রুর গোলাগুলি, কিছু একটা তাকে খেতেই হবে। ভারত ও পাকিস্তান, দু দেশের সেনাকর্তারাই বলেছেন, আজ পর্যন্ত যত সৈনিক তাঁরা হারিয়েছেন, তার বেশীরভাগটাই আবহাওয়া আর পরিবেশের জন্যে। শত্রুর গুলিতে নয়। একটা উদাহরন দিই। ২০১২ সালের ৭ই এপ্রিল, এক প্রবল তুষারধ্বসে সিয়াচেন অঞ্চলে পাকিস্তানি ফৌজি হেডকোয়ার্টার ধ্বংস হয়ে যায়। মোট ১৪৪ জন মারা যান। সেই ঘাঁটির কেউই বাঁচেন নি। লালমোহন গাঙ্গুলী ঠিক ই বলেছেন “Truth is STRONGER than fiction”। ভুল করে “Stranger” এর জায়গায় জটায়ু “Stronger” বলেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে জটায়ুর ভুল করে বলা কথাও বোধহয় খেটে যাবে। সত্যি খুবই শক্তিশালি ও কঠোর। ভারত পাকিস্তান দু দেশের মানুষের কাছেই সিয়াচেন এক পরিচিত শব্দ কিন্তু অচেনা কাহিনি। কি হয় সেখানে, কি আছে, কি চলছে, সে নিয়ে আমাদের ধারনা খুব ভাষাভাষা। আমি একটা দীর্ঘ ক্লান্তিকর লেখার মধ্যে যা যা বললুম, তা আসলে ভগ্নাংশের ভগ্নাংশ। রাত্রে যখন ঘুমোতে যাবেন হে পাঠক, একবার মনে করে দেখবেন, ঠিক ওই সময়ে, কুড়ি হাজার ফুটের ওপরে মাইনাস ৩০ কি ৫০ ডিগ্রিতে, প্রবল তুষার ঝড়ের মধ্যে রাইফেল বাগিয়ে ধরে অতন্দ্র প্রহরায় রয়েছেন জওয়ানেরা। সাত আট পরত জামাকাপড়ের নিচেও নাকি কখনো কাঁপুনি থামেনা ওই ঠান্ডায়। শুধু কাঁপেনা জওয়ানের হাত, আর এতটুকু কাঁপেনা মন ও বিশ্বাস। সে জেগে আছে বলেই আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি।

এ লেখা পড়ে আপনার মতামত কি হবে, সে সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নেই। আপনি হয়ত বলবেন কি দরকার এসবের, পুরো অঞ্চল কে সেনামুক্ত করা হোক।নিশ্চই হোক, কিন্তু অবিশ্বাস মুক্ত করা যাবে কি? কাল আর একটা কার্গিল হবে না তো? হয়ত আপনি বলবেন এত রক্ত এত কষ্টের অর্জিত ভুমি, একে বুকের রক্ত ঢেলে টিকিয়ে রাখতে হবে, কিন্তু কত দিন পাঠক? কত দিন এই ভাবে অসম্ভবের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাবেন আমাদের সৈনিকেরা? জানিনা, এর শেষ কোথায়। সিয়াচেনের শেষ কবে, কিভাবে এবং কোথায় তার উত্তর বোধহয় সিধু জ্যাঠারও জানা নেই। ভারতীয় সেনার সিয়াচেন বেস ক্যাম্পে একটা ফলকে লেখা আছে “Quartered in snow, silent to remain, when the bugle calls, they shall rise and march again.”। প্রার্থনা করুন, বিউগলটা যেন আর কেউ খুঁজে না পায়। মনে হয় এটা আমরা সবাই চাইব।  
        

১৯টি মন্তব্য:

  1. এই লেখাটার পেছনে যে খাটনিটা - যাকে ইংরিজিতে কায়দা করে বলে "Behind the scene", সেটা যেহেতু কিছুটা দেখেছিলাম, তাই গল্পটা পড়ার আগে ঠিক করে নিয়েছিলাম যে সেই ব্যাপারটা মাথায় না রেখে পড়ব এটা। কারণ আমি চেয়েছিলাম যে লেখাটার মান শুধু লেখাটা দিয়েই বিচার হোক। কাল রাতে পড়া শেষ হয়েছিল, আর এটা বুঝেছিলাম যে আর কিছু এমনিতেও মাথায় থাকত না, চাই বা না চাই।

    বাঙলা গপ্পের একঘেয়েমি, বিষয়ের দিক থেকে, এটা তুমি তোমার অনেক লেখা দিয়েই ভাঙছো অনেকদিন থেকেই। এটা সেরকমই একটা বিষয়।

    একটা বললাম? এহ!! বয়েস হয়ে যাচ্ছে, ভীমরতি ধরছে। একটা নয়, অনেকগুলো বিষয়, অনেকগুলো প্রশ্ন আর অনেকগুলো সত্যি একসঙ্গে এর থেকে ভালোভাবে বলা যায় কিনা জানি না, কিন্তু আমি আগে শুনিনি কখনো।

    ছোটবেলায় ইতিহাস পড়তে জঘন্য লাগত। পরে বড় হয়ে বুঝেছিলাম কেন। আর এটাও বুঝেছিলাম ইতিহাস বলে আলাদা কোন বিষয় হয় না। আমাদের জোর করে পড়ানো হত - এই আর কি। আজ "ইতিহাস" পড়লাম। ভৌগলিক মানচিত্র আর গুরুত্ব, রাজনৈতিক অবস্থান, আর আমাদের সাধারণ মানুষের একদম চোখের আড়ালে থাকা (বিষেশত ভেতো বাঙালীর) ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহস, লড়াকু হাল-না-ছাড়া মনোভাব, আর আত্মত্যাগ - এগুলো নিয়ে লেখা আজকাল আর কে লেখে!! বাজারে চলবে না যে!! হায় সমাজ, হায় মিডিয়া! ও হ্যাঁ, পাকিস্তানকে ছোট না করে - এটা বলতে ভুলে গেলে আমার সঙ্গে ওই মিডিয়ার আর কি তফাত রইল!!

    যাই হোক, এই লেখাটা প্রসঙ্গে আর একটা কথা আমি বলব, যদিও আমার শিক্ষাদীক্ষার মান অনুযায়ী আমাকে অর্ধশিক্ষিতই বলা যেতে পারে, তবু এই ধরনের লেখা স্কুলের পাঠ্যবইতে অন্তর্ভুক্ত করলে আমার উপকার হবে ছাত্র-ছাত্রীদের। অন্তত আমার সময়ে এরকম লেখা পেলে আমার তো হত।

    আর হ্যাঁ, রোজকার মত কাল রাতেও নিশ্চিন্তেই ঘুমিয়েছি, বাকি সবার মত, কিন্তু বারবার মনে হয়েছে যে বেশ কিছু ভারতীয় জওয়ান সিয়াচেনে দাঁড়িয়ে আছে, যাতে এই নিশ্চিন্তে ঘুমটা রোজ হয় আমাদের (এটাকে আঁতলামি হিসেবে ধোরো)।

    উত্তরমুছুন
  2. আমাদের দেশপ্রেম মানে পাকিস্তান কে গালাগাল দেওয়া আর আমাদের সেনাবাহিনির গুনকির্তন করা। নিজের গুনকির্তন করা হোক, কিন্তু অন্যকে খিস্তি মেরে নিজেকে বড় করার দরকার অন্ততঃ আমাদের নেই। প্রতিটি সৈনিক, সে যে দেশেরই হোক, গৌরবের ভাগিদার এবং আত্মত্যাগে অভ্যস্ত। দুনিয়ায় যেদিন একটাও উর্দী পরা লোক না থাকবে, সেদিন আমি খুব খুশি হবো। কিন্তু এটাও ঠিক, সেনাবাহিনি আমাদের অনেক কিছু শেখায় ও করতে প্রেরনা দেয়। ওই উঁচুতে অমানুষিক পরিবেশে বসে থাকা মানুষগুলোর কথা ভাবলে, সত্যিই হাড় হিম হয়ে যায় আমার।

    উত্তরমুছুন
  3. এই লেখার সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য করা বাতুলতা মাত্র। যে ছেলেটা অবসর সময়ে বসে যুদ্ধের ট্যাঙ্ক বা যুদ্ধ বিমানের মডেল তৈরীতে মেতে থাকত, তার পক্ষে এধরনের তথ্য সমৃদ্ধ লেখার মালা তৈরী করা স্বাভাবিক। শুধু এটুকু বলতে পারি আমি নিজে সমৃদ্ধ হলাম। আর এইলেখাতে থাকা কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়তো বাকী জীবনটা খুঁজে বেড়াবো।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এখনো মনে আছে সে সব? :-)
      হ্যাঁ, এই বিষয়টা আমার চিরকালীন একটা বিষ্ময়ের জায়গা।

      মুছুন
  4. আমার মত আহাম্মক আর উজবুক হলে হয়ত হাড়হিম হিমবাহ র জায়গায় সিয়াচেনে সীতাহরন লিখে পটকা ফাটিয়ে বালখিল্য করে দেশের জন্য দু লাইন ভেবে ঢাক বাজিয়ে একাকার করে ঘুমিয়ে পড়তাম। ভাগ্যিস ভাবিনি লেখার কথা। আর এখানেই লেখকের সংযম। লেখক এসব কিছুই করেন নি।
    যারা একটু রাশিয়ান বই দু একটা পড়েছেন (বেশী পড়া লোকরা ত আছেন ই) তাঁরা নিশ্চয় মনে করতে পারেন সেইসব অপূর্ব যুদ্ধ কাহিনী ও যুদ্ধ অবিজ্ঞতা যা পরে বাংলাতেও অনুদিত হয়েছে বই প্রকাশ হয়েছে রাদুগা প্রকাশন, প্রগতি প্রকাশন বা ভস্তক থেকে। লেখকের শৈশব গড়ে উঠেছে সেই সব বই পড়ে। আর তার থেকেও যেটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ তা হল যুদ্ধ, ইতিহাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে লেখকের নিবিড় পাঠ।
    এতকিছু এই জন্য বললাম কারণ এটুকু ভূমিকা না দিলে এটা প্রমান করা যায় না যে, এ লেখা ইতিহাস নির্ভর তথ্যপঞ্জি না। সেটা কিছুদিন কোন বিষয় নিয়ে একটু পড়াশোনা করলেই হাতের সামনে চলে আসে। এমনকি সিয়াচেন নিয়ে একটু পড়াশোনা করলে বাংলাতেই কত তথ্য নির্ভর লেখা পাওয়া যায়। তাই সেক্ষেত্রেও এটা নতুন না। এই লেখার সাথে আছে খানিক হালকা চালের রম্য সাহিত্য মিশেল। যার পথ প্রদর্শক আলী সাহেব।
    কিন্তু এর পরেও আছে লেখায় মৌলিকত্ব। তা হল প্রতিটা তথ্যের মর্ম উদ্ধার এবং তা একটি একটি করে গল্পের সুতোয় গেঁথে মালা বানিয়ে সিয়াচেনের ঠাণ্ডা বাঙ্কার থেকে পাঠকের রাতের আরামের বিছানা পর্যন্ত বিস্তার করে যাওয়া অনায়াসে। ঘুরে ঘুরে সৈনিকের অজর মনোভাবের গান গাওয়া। এই ঐতিহাসিক প্রাঞ্জল বর্ণনার মালা আর অজর মনোভাবের গানে পাঠক কখন জড়িয়ে পড়েন নিজেও বুঝতে পারেন না শুধু পড়ে যান লেখকের ইতিহাসের এই বিনির্মাণ। আর এখানেই লেখকের মুন্সীয়ানা। মৌলিকত্ব।
    একটু আগেই বললাম মর্মোদ্ধার। এই কাজ করতে গেলে যে ধাপে ধাপে এগোনোর প্রয়াস লাগে, তা যে করা হয়েছে নিখুঁত ভাবে, তাঁর পরিশ্রম এর কথা ভাবলে অবাক হই। তথ্যের সাথে যে চিন্তনের প্রয়োজন তা যথেষ্ট সময়ের দাবী করে। তা কি করে হল! সেলাম।
    একটু আগেই বললাম লেখায় মৌলিকত্ব আছে যার জন্য এই লেখার ভাষা হয়েছে সহজ ও আধুনিক। যার ফল পাঠক পাবেন ইতিহাস কে আর ও জানার জন্য আগ্রহী করে তুলবে। সেলাম।
    এই রকম আর ও কিছু লেখা স্বাধীনতা উত্তর ভারতে ঘটে যাওয়া যুদ্ধ গুলোকে যদি এক বইয়ের মলাটে আনা যায় তাহলে বোধ করি একটা বেশ থাপ্পড়ের কাজ হয় যুদ্ধ-লোভী যজমানদের (এখানে শুধু যুদ্ধ পূজো অর্থে পড়তে হবে)।
    আমরা যেমন প্রতিদিন রুটি সবজী খাই, কেউ খায় রুটি কাবাব। তাই এই দুজনের যুদ্ধ শেষে কেউ ই দিনের পর দিন উলটো খাবার টা খেতে পারবেন না। আমরা পারবনা রোজ কাবাব রুটি খেতে আর কাবাব খাওয়া শরীর ও রোজ সবজী খেতে পারবে না। একজন পেট রোগা হবে আর একজন হবে শুকনো কাঠের মত। তাই এ যুদ্ধে হার জিতে যেমন কারুর লাভ নেই তেমনি ক্ষতি আছে মৃত্যুর। অগত্যা...। কিন্তু এর পর ও আমরা উস্কানি গ্রহণ করি। বানরেরা আমাদের গা চুলকে দেয়। আমরা একটা কলা দেখাই না কেন তখন।
    অনেক বড় হচ্ছে লেখাটা। আসলে বলতে চাইছি লেখাটা ভালো লেগেছে। লেখক নই ত তাই প্রকাশ করতে এত কথা। সেলাম সেলাম।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এরকম উৎসাহ পেলে, আমি বোধহয় সেই কুরুক্ষেত্র থেকে শুরু করে পরশু দিনের রাজৌরি সেক্টরের গুলি ছোঁড়াছুঁড়ি পর্যন্ত সব কিছু লিখে ফেলব। এত বড় করে, এত গভীরে গিয়ে মন্তব্য পেলে, যাঁরা লেখেন, সকলেই অভিভূত হবেন। লেখক লেখিকার সঙ্গে তাঁদের পাঠক পাঠিকার যোগাযোগ, পত্রালাপ, সেগুলোও অনেক ক্ষেত্রেই সাহিত্যের মানে উন্নিত হয়। কিন্তু প্রথাগত বই ছাপা হলে, সেখানে পাঠকপাঠিকার মতামত, সে বই কে সমৃদ্ধ করতে করতে যায় না, যেমন টা হয় এই ব্লগের ক্ষেত্রে। ব্লগ তাই আমার এত প্রিয়। এখানে এই মন্তব্যগুলোও কিন্তু সাহিত্যের অঙ্গ। এবং এগুলো ছাড়া লেখা সম্পুর্ন নয়। আমি তাই যখনই কোনো লেখা পড়ি, লেখার শেষে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে তার মন্তব্যগুলোও পড়তে থাকি। এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই সেগুলো মূল লেখার চেয়ে কম আকর্ষনীয় হয় না। কিছু ক্ষেত্রে, সেগুলো মূল লেখাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

      আবার ও বলি, এই মন্তব্য আমাকে অনেক অনেক লেখার জন্যে উৎসাহ দেবে।

      মুছুন
  5. Anabadyo vai somenath......... namkaran theke stanza ba conclusion kon ta nie bobo? aar sei dhristata amar nei......... bandhu abar boli, praiseworthy......

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. সুশান্ত, এই দীর্ঘ লেখাটা পড়ার জন্যে ধন্যবাদ। প্রতিটা মন্তব্য আর উঠসাহ নতুন কিছু লিখতে বাধ্য করে আমাকে।

      মুছুন
  6. Lekhar quality niye notun kore bolar kichu nei... Sob bisheshon bohu agei bavohar kore phelechi.. Lekhata agei dekhechilam kintu protibar kono na kono badha asai pore sesh kore uthte parini.. Akhn korlam. Sesh kore duto kothai bolar soinikra rat jage bolei amra rate sute pari seta akdom thik.. Aro ekta ktha ei protikulotar ar bipodsonkul jaigai thakar jonnoi hoitoh english e ro ekta proverb royeche "everyone family wants a soldier, but in their neighbor's house".

    Somnath da sudhu ekta kothai bolar ei rokom vinno swader lekha diye amader khudro gyaner poridhi barate theko. Vobisote ro emon lekhar asai thklam.

    উত্তরমুছুন
  7. "everyone family wants a soldier, but in their neighbor's house" এটা দারুন বলেছ। আমি সৈনিকের জীবন কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি কি প্রচন্ড কঠোর কিন্তু কি সাঙ্ঘাতিক আকর্ষনীয়। নিজেও যেতে চেয়েছিলাম। চোখের জন্যে হলো না।

    উত্তরমুছুন
  8. Ato boro lekha ak barer janyao klantikor mone hoy ni. Detective galpo ba upanyas noy, tobuo tan tan uttejona.ato sundor r ato tatya sanriddho j kurnish janatei hobe. Ato tai udbuddho holam j amar ak school er bqtch mate j podomorjaday captain r ladakh e posted .ora jano pore e tuku upalobdhi kore tader parisromk marjada deoa hochhe.

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. সেনাবাহিনির মানুষজন যদি এই লেখা পড়েন, তাহলে নিজেকে চরম সৌভাগ্যবান মনে করব। ওনারা যা দেখেন, যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যান, তাকে ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা পৃথিবীর সেরা লেখকেরও নেই।

      মুছুন
  9. এযুগে অনেক negativeর মধ্যে একটা positive যে এই ধরনের লেখার সংখ্যা বাড়ছে তার সঙ্গে বাড়ছে পাঠক-ও। voices from chernobyl যদি নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতে পারে, এত তথ্য-সমৃদ্ধ, চিন্তা-উদ্রেককারী অথচ সুখপাঠ্য লেখার অন্তত জাতীয় স্তরে প্রচারের দাবি রাখলাম ।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. কি যে বলো না!!! এ তো বকের গলায় বকলস পরানো হয়ে যাবে।

      মুছুন
  10. আমি সাধারণত অসাধারণ সব কমেন্ট করার জন্য বিখ্যাত(বাড়িয়ে বললাম আরকি!!)। ভালো পোস্টের নিচে ততোধিক ভালো কমেন্ট করার জন্য ফেসবুক পাড়ায় আমার সুখ্যাতি রয়েছে। কিন্তু এই পোস্টের নিচে সেরকম কোন কমেন্ট করতে পারলাম না বলে দু:খিত। কোন এক ধর্মীয় বইতে একবার এক ঘটনা পড়েছিলাম। বাক্যের দেবী সরস্বতীও একবার শ্রীহরির দর্শন পেয়ে তার সামনে স্তব করতে না পেরে বাকহারা হয়ে পড়েছিলেন। এই লেখা পড়ে আমার হয়েছে সেই দশা।

    উত্তরমুছুন
  11. পর্দার পিছনে রেখে আসা পরিশ্রমটাই ফুল ফোটায় মূলমঞ্চে এসে। আর সেই ফুলের গন্ধ নেয় সামনের দর্শক। শো শেষের পর সই সংগ্রহে গ্রীন্রুমের বাইরে লাইন দেয়। আমি অনেকটা সেরম দর্শকের মত। অনেক ভাগ্যবান মনে করি নিজেকে যে এরম এক লেখককে সামনে থেকে চিনি আর রোজ তার সাথে কথা বলতে পারি।

    লেখার গুনগত মান বিচারের মানদন্ড থেকে অনেকখানি ঊর্ধে এই লেখা।তাই সেদিকে না যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে। এই লেখার পিছনের যে নিরলস পরিশ্রম সেটার কাছে মানা নিজে থেকেই নেমে যায়। "জাঁহাপনা তুসি গ্রেট হো।"

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ছাপা বইয়ের তুলনায়, ব্লগ এই কারনে আমার এত পছন্দের। এখানে পাঠকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা যায়। এবং লেখার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মন্তব্যগুলোও লেখার অংশ হয়ে দাঁড়ায়। মূল লেখার সঙ্গে, এই সমস্ত মন্তব্যগুলো জুড়ে যাবে, এবং ভবিষ্যৎ পাঠককে আনন্দ দেবে।

      লেখার পেছনে আলাদা করে পরিশ্রম হয়ত তেমন নেই, আর আমি আদতে মোটেই লেখক নই, পাঠক। কাজেই বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পড়তে পড়তে ধারনা গুলো তৈরি হয়েছে। যতদুর মনে পড়ছে ১৯৮৭ বা ৮৮ সালে দেশ পত্রিকায় সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ে একটা বড় লেখা বেরিয়েছিল। তখন আমি ইশকুলে পড়ি। কাজেই যা পড়েছিলাম তার বেশীরভাগই বুঝিনি। তবুও লেখাটা আমার মধ্যে সিয়াচেন নিয়ে একটা আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিল। আর পরবর্তীকালে যেখানে যখন সিয়াচেন নিয়ে কিছু লেখা বা তথ্য পেয়েছি, সেগুলো ওই আগ্রহের সুতোয় গেঁথে রেখেছি। সেই গেঁথে রাখা তথ্যপঞ্জিই এ লেখার কাঠামো। কিছু ক্ষেত্রে সন-তারিখ, নাম ও মানচিত্রের জন্যে আমাকে লেখার আগে বইপত্র বা ইন্টারনেটের শরনাপন্ন হতে হয়েছে । আর মজার কথা, লেখার পরেও গত তিন বছরে আরো অনেক অজানা তথ্যের নাগাল পেয়েছি সিয়াচেন সম্পর্কিত। মনে হয়েছে এগুলো কেন লিখলাম না। পরে ভেবেছি, আমার আগেও সিয়াচেন নিয়ে অনেকে লিখেছেন, তেমনই পরেও নিশ্চিত ভাবেই অনেকে লিখবেন। সেই না লেখা তথ্যপঞ্জি ভবিষ্যত লেখকের জন্যই সযত্নে তোলা রইল আমার আগাম শুভেচ্ছা সমেত।

      মুছুন