বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

টুকরো স্মৃতি – ৭

[অপ্রকাশিত]

খুব কম জায়গায় ঘুরেছি এমন নয়। এই জীবনে, দেখেছি খুব বেশী না হলেও নেহাত কমও নয়। তবুও স্মৃতিচারন করতে বসলে কিছু স্মৃতি ঘুরে ফিরে বার বার আসে। হয়ত সে সব স্মৃতি খুব লম্বা সময়ের নয়। হয়ত খুব বেশী গুরুত্বপুর্ণ ছাপ ফেলেনি আমার জীবনে। তবুও তারা মনে থেকে গেছে, কোন এক অজানা কারনে। ছোটবেলায় একবার বাবা মায়ের সঙ্গে দুর্গাপুর থেকে হাওড়া আসছিলাম ট্রেনে। বোধহয় ক্লাস থ্রি কি ফোর হবে তখন আমার।
খুব সম্ভবত শ্যাওড়াফুলি স্টেশনে এক বৃদ্ধা কে দেখেছিলাম ট্রেনের জানলায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে চাইছেন, আর বলছেন, অম্বুবাচী চলছে, তাই সব কিছু খেতে পারেন না, কেউ যদি ওনাকে দয়া করে একটা ফল দেয় তো উনি কিছু খেতে পান। এতদিন পরও, ওনাকে স্পস্ট মনে আছে। কেন আছে, তা জানিনা। হয়ত, ওনাকে দেখে আমার নিজের ঠাকুমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। এই ঘটনা, আমার জীবনে কোন বড় পরিবর্তন এনেছে, এ কথাও বলতে পারি না। তবু মনে থেকে গেছে।
সে যাই হোক, গতকাল কথায় কথায় আমার এক অনুজপ্রতিম কমরে... থুড়ি, বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম কিছু অচলায়তন বিশ্বাস নিয়ে। শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও একটা বড় অংশ আজও মাদুলি তাগা তাবীজ জলপড়া ঝাড়ফুঁক নজর লাগায় অন্ধভাবে বিশ্বাস করেন। দেখেছি, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মরত ডিগ্রিওয়ালা ইঞ্জিনিয়ার ও এসবের সপক্ষে জোর দিয়ে বক্তব্য রাখছেন। কিছুটা অবাক লাগে, আবার ভাবি, এই বিশ্বাস চোখে আঙুল দিয়ে এটাও দেখিয়ে দেয়, যে বর্তমান প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা এখনো যথেষ্ট নয়। আলোচনা করতে করতে, মনে এলো একটা পুরোনো স্মৃতি। টুকরো স্মৃতি। সেই নাগপুরের কাছে কয়লাখনি। আপনারা বোধহয় ভাবছেন আবার শুরু হলো। বস্তুতপক্ষে, আমার নিজেরই কেমন একটা জানি লাগছে, যে আবার ওই একই জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলছি আপনাদের। তাই লেখার শুরুতে দেখবেন, একটু কাঁদুনি গেয়ে রেখেছি। ১৯৯৯ সালের আগস্ট। বিদর্ভে ভরা বর্ষা নেমেছে। কয়লা খনির যে গেস্টহাউসে থাকতাম, সেটা হাইওয়ে থেকে জঙ্গলের মধ্যে প্রায় দেড় কিলোমিটার ভেতরে ঢুকতে হতো। রাত্রে কারেন্ট থাকতো না। তবে, বর্ষাকাল বলে খুব একটা অসুবিধে হতো, এমন নয়। কিছুটা অভ্যেস ও হয়ে গিয়েছিলো। রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর, মোমের আলোয় বই পড়তাম কিছুক্ষন। তার পর আস্তে আস্তে ঘুম এসে যেত। ওই গেস্টহাউসে, থাকতাম আমি একাই। একজন রাঁধুনি এবং চৌকিদার ছিলো, সে রান্না করে করে দিয়ে বিকেলের মধ্যে কেটে পড়তো। আবার দেখা দিতো পরের দিন ভোর বেলা। বাকি সময়টা আমি একাই থাকতাম। একদম শেষের দিকে, একজন চিনে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ আসেন ওখানে। আমার টেবিলে “দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন” দেখে “রুশকি রুশকি” বলে চেল্লামেল্লি করে আলাপ শুরু করেন। উনি চিনা ভাষা ভিন্ন আর কোন ভাষাই জানতেনও না, বুঝতেনও না। ফলে খনির ভেতরে উনি ডিনামাইট দিয়ে, কাদের এবং কি ফাটাতেন, সেইটা কোনদিন জানতে পারিনি। ওনার সঙ্গে ভাষার এবং বয়সের ব্যবধান সত্বেও একটা বন্ধুত্ত্ব গড়ে উঠেছিলো।
সে যাই হোক, রাত্রে ওখানে মশারি টাঙ্গিয়ে শুতে হতো, কারন মশার বেজায় উৎপাত। মশারির দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ায়, কয়েক দিন, মশারি না টাঙ্গিয়ে শুতে হচ্ছিলোএকটা মশা মারা ধুপ জ্বালিয়ে শুতাম। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিলো বেশ জোরে। একঘেঁয়ে ঝমঝম আওয়াজে কেমন যেন একটা ঘোর লাগা ব্যাপার আছে। খেয়ে দেয়ে শুয়েছি, আর শুয়ে, ঘুমিয়েও পড়েছি বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে এমনিতে রাত্রে আমার ঘুম ভাঙ্গে না। একদম এক ঘুমে রাত কাবার। কিন্তু সেই রাতে, ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। কেবল গাছের পাতায় পাতায় টুপ টাপ করে জলের বড় বড় ফোঁটা গুলো পড়ছে এমনিতেই নিশ্তব্ধ জায়গা, নিজের নিশ্বাসের শব্দেই চমকে উঠতে হয়। তবে আর কোন শব্দ নেই। জানলা বন্ধ করে শুয়েছিলাম, যেন জলের ছাট না আসে। আর দরজা তো বন্ধ করেই শুতাম। সাপখোপের ভয় ছিলো। জানলার কাচ গুলো রং করা, তার ওপরে গাঢ় রঙএর ভারি পর্দা লাগানো। ঘরের মধ্যে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। নিজের হাত পা ও দেখতে পাচ্ছি না। ধুপটাও কখন নিভে গেছে। কেমন একটা অস্বস্তি হলো। পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করলাম কিছুক্ষন। কিন্তু কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে যা হয়, সহজে আসতে চায়না। অস্বস্তি আর অস্থিরতা বাড়তেই থাকলো। ঠিক বুঝলাম না কি হচ্ছে। শরীরে কোথাও কোন অস্বস্তি নেই, ব্যাথা-যন্ত্রনা কিছুই নেই। তা সত্ত্বেও ছটফট করছি। ভাবতে চেষ্টা করলাম কেন এমন। কেবল মনে হচ্ছিলো, কেউ যেন এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একলা থাকতে থাকতে মানুষের অনেক রকম বিকার জন্মায়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ওখানে আমি মদ-গাঁজা-ভাঙ্গ কিছুরই নেশা করিনি। মানসিক ভাবেও সুস্থই ছিলাম। অন্ততঃ নিজে সেরকমই ভাবতাম।  
এই অস্বস্তিটা মনের ভুল ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। একা থাকতে থাকতে এসব বাজে ভাবনা মাথায় চেপে বসেছে। তার ওপরে আমার কল্পনাশক্তিটা দিব্যি সরেস। এসব থেকে মন অন্য দিকে ঘোরানো দরকার। বিছানার পাশে টেবিলের ওপর দেশলাই আর মোমবাতিটা ছিলো, সেটা জ্বালালাম। মোমবাতির আলোয় ঘরটা কেমন যেন বদলে গেলো। আগে ছিলো পুরোটাই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। কিন্তু এখন আলোর আসে পাশে অন্ধকার হালকা হয়ে গেল, আর ঘরের অন্য দিকে, কোনা গুলোতে যেন অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে এল। ঠিক যে ভয় করছে তা নয়, তবে কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। মাথার পাশে এক খন্ড শরদিন্দু অমনিবাস ছিলো। সেটাই খুলে পড়তে শুরু করলাম আবার। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি আবার জানিনা। জানিনা কতক্ষন ঘুমিয়েছি, কিন্তু ঘুম আবার ভেঙ্গে গেলো। সেই অস্বস্তি আবার ফিরে এসেছে। এবারে যেন আরো স্পস্ট অনুভুতি। কেউ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম বিছানার ওপর। পাশের টেবলের ওপর দেশলাই আর মোমবাতি হাতড়ে খুঁজতে গিয়ে দেখি, মোমবাতিটা জ্বলতে জ্বলতে পুড়ে শেষ। দেশলাইটাও হাতে লেগে নিচে পড়ে গেল। শুয়ে পড়লাম। মন থেকে কিছুতেই অস্বস্তিটা যেতে চাইছেনা। রোজই এই ঘরে শুই। আজ প্রায় ৪ মাস এখানে আছি। কিন্তু কখনো এমন কিছু মনে হয়নি। আজ কেন হচ্ছে? পরিবেশটা হালকা করার জন্যে একটু গুন গুন করে গান করার চেষ্টা করলাম, যাতে মন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়। গানের ব্যাপারে আমার দক্ষতা প্রবাদ প্রতিম। কিন্তু এখানে আর শুনছে কে? প্রথমে গুনগুন, তার পরে আর একটু জোরে। কিন্তু গান গাইতে গিয়ে স্পষ্ট মনে হলো, কেউ সত্যিই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এবং এবারে অনুভুতি এতটাই স্পষ্ট, যে বুঝতে পারলাম, আমার খাটের ডান দিকে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। খাট থেকে আন্দাজ তিন ফুট মতো দূরে। আমি চোখ বন্ধ করে গান গাইছিলাম। অন্ধকারে এবং নৈশ্বব্দে আমাদের অনুভুতিগুলো তীব্র হয়ে ওঠে। ওই চোখ বন্ধ করা অবস্থাতেই আস্তে আস্তে টের পাচ্ছিলাম অন্যকারোর উপস্থিতির কথা। একটু পরে সে উপস্থিতি এতটাই প্রবল হয়ে উঠলো, একবার ভাবলাম চোর নয়তো? কিন্তু কেমন জানি মনে হলো, এ আমার কোনো ক্ষতি করতে আসেনি। দেখতে এসেছে। আমাকে। একটা গা শিরশিরে ভাব উঠে আসছিল। ঠিক ভয় বলবো না একে। বরং প্রথম বার, কোনো অচেনা পশু পাখির গায়ে দ্বিধাগ্রস্থ ভাবে হাত দেওয়ার সময় যেরকম গা শিরশির করে, ঠিক সেরকম। আনকোরা অপরিচিত উপস্থিতি এবং অনুভুতির শিরশিরিনি।
আচমকা বিস্ময় আমরা হতবাক হয়ে যাই। কিন্তু যে বিস্ময় ধিরে ধিরে, ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে, সেটা আস্তে আস্তে কেমন যেন আলেয়ার মত মোহাবিষ্ট করে ফেলতে থাকে। প্রাথমিক অনুভুতিগুলোর ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পরে সব চেয়ে বেশী যেটা হয়, সেটা হলো কৌতুহল। কিন্তু এতটাই ঘন অন্ধকার, আর নৈশ্বব্দ, যে দর্শন ও শ্রবন, এই দুই ইন্দ্রিয় একেবারেই অকেজো। ভাবলাম উঠে বসে দেখি। কিন্তু মনে হলো, যদি কেউ সত্যিই এসে থাকে, আর আমার উঠে বসাতে চলে যায়? তাহলে তো জানতেও পারবো না। তার চেয়ে শুয়ে শুয়েই অনুভব করতে চেষ্টা করলাম। আমি জানোয়ার নই, কাজেই আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয়র বালাই নেই। তবু যেন একটা অনুভুতি আমাকে তার অস্তিত্বের প্রমান দিচ্ছিল। আমি গান আর গাইছিলাম না। কিন্তু কি মনে হওয়াতে, কথা বলা শুরু করলাম। বাংলায় না। হিন্দি তে। নাম বললাম। বললাম কোথা থেকে এসেছি, কি করতে এসেছি, বাড়িতে কে কে আছে, কি ভালোবাসি, শখ কি, এখানে কেমন লাগছে, এই সব। বলেছি আমার টুটা ফুটা হিন্দিতে। বলতে বলতে কেমন যেন সহজ হতে শুরু করলাম। মনে হচ্ছিলো, যিনি এসেছেন, তিনি মহিলা, এবং মধ্যবয়স্কা, খুব সম্ভবত দেহাতি। গায়ে শাড়ি, দেহাতি ধরনে পরা। হাতে মোটা মোটা রূপোর বালা। মাথায় কাপড় দেওয়া। এখন আর দাঁড়িয়ে নেই। আমার খাটের ও পাশটায় দেওয়ালে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে। বললাম এখন ঠিক ভয় করছেনা, কিন্তু কৌতুহল হচ্ছে খুব। হয়ত পুরোটাই কল্পনা, কিন্তু সেই মুহু্র্তে আমি যেন সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারছিলাম। মনে হচ্ছিলো, ভয় বা আতঙ্কের কিছু নেই। শুধু আছে কৌতুহল। আমি বলে চলেছি আমার শৈশব, খেলাধুলো, ইস্কুল, ফেল করা, প্রথম প্রেম। বকবক করতে করতে কিছুক্ষন পরে মনে হলো, আর কেউ নেই খাটের পাশে। খালি। চলে গেছে, যে এসেছিলো। ক্লান্ত লাগছিলো। কেমন যেন একটা অবসন্ন ভাব আসছিলো। মন শান্ত হয়ে আছে। আগেকার অস্থিরতা আর নেই। আবার ঘুমিয়ে পড়েছি কখন বুঝতে পারিনি। ঘুম যখন ভাঙ্গলো, তখন আলো ফুটে গেছে বাইরে। শরীর চাইছিলো আরো একটু ঘুমোতে। মন চাইছিলো, উঠে ভোরের আলোয় একটু বাইরে বেরোতে। বেরিয়ে এলাম। হালকা আলো ফুটেছে বাইরে। বর্ষার মরশুম বলে, চারিদিক সবুজে সবুজ। বুনো গাছপালার গন্ধে ভরপুর চারিদিক। তখনো গাছের পাতা বেয়ে গত রাতের বৃষ্টির জমে থাকা দু চার ফোঁটা মাটিতে পড়ছে। খালি পায়ে ঘাসের ওপর দাঁড়ালাম।
সত্যি কি কেউ এসেছিলো? পুরোটাই মনের ভুল? এত স্পষ্ট অনুভুতি ভুল হতে পারে? না কি একলা থাকতে থাকতে মনের ভুল আর কল্পনা মিলে মিশে এরকম ঘটলো?আমি এর উত্তর পাইনি। যদি মনের কল্পনা হয়, তাহলে তো মিটেই গেল। কিন্তু যদি সত্যিই কেউ এসে থাকে, তাহলে সে কে? কেন এসেছিল? হয়ত এখানকার পুরনো বাসিন্দা। এখানে নতুন মানুষ দেখে, দেখতে এসেছিল, কেমন মানুষ। কল্পনার তো শেষ নেই। তবে এই টুকরো স্মৃতি শেষ, ওই রাত শেষ হবার সঙ্গেই। এ স্মৃতি তে, না আছে কোন সন্তান হারানো আফগান বাপ, না আছে খেতে না পাওয়া খেলা পাগল যুবক, না আছে চমকপ্রদ ভাবে দুর্ঘটনা থেকে প্রানে বেঁচে যাওয়া, না আছে আমার প্রাক্তন ইয়ের গপ্প। কিছুই নেই। বরং এটা হতে পারত একটা গা ছমছমে সত্যি ভুতের গপ্প। তাও হলোনা। রইল কেবল টুকরো স্মৃতি হয়ে। সে টুকুই নাহয় থাক।

৩টি মন্তব্য :

  1. অসাধারণ বচন্ভন্গি .

    অনেকদিন পর একটা ব্লগ পরলাম যেটা পড়তে পড়তে মনে সেই রাতের দৃশ্যাবলির পুনরাভিনয় হলো।

    অবশ্যই অনুসরণ যোগ্য।

    উত্তরমুছুন
  2. koto somoy-i to amra emon sob obhiggYotar mukho-mukhi hoee, jaa sadharoN bodh-jukti r baeerey. onekta i jno nijer sathey dekha howa ... hotei hoy
    osadharon bachon-bhoNgitey tule enechen ek olik bodh-er tukro muhurto ... purotaee jno swopno, othoba, bastob, baa ei dui er baeerey onno kono ek jogot

    উত্তরমুছুন
  3. bhootey bishash nei, tar ullekh o nei, kintu lekhar jore mon ta seirokom bhabte chai. ashadharon.

    উত্তরমুছুন