বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

টুকরো স্মৃতি - ২

আমি কখনো গল্প লিখতে চাইনি। লেখা লিখি আমি পারিনা। কল্পনশক্তিও ভীষন খারাপ। শুধু যা দেখেছি, সেইটা বলতে পারি, তাও যদি শোনার ধৈর্য্য থাকে আপনাদের। কেননা কাজ-কম্ম তো সকলেরই আছে, আমার মতো তো আর নন, আমার কাছের মানুষজন আমাকে কাজ না করতে দিয়েই নিশ্চিন্ত থাকেন। পাছে কিছু অপকম্ম করে ফেলি। তবুও দেখুন, আমি নিজেকে আপনাদের চেয়ে আলাদা কিছু ভাবতে পারি না।  আসলে আমাদের জীবনে কতকিছুই তো ঘটে, এবং প্রাথমিক ভাবে কিছু স্মৃতি খারাপ ঠেকলেও পরে ভালো লাগতেই পারে। আগের “টুকরো স্মৃতি” তে সে কথা আপনাদের বলেছি। সেটা আশা করি আপনাদেরও হয়। খারাপ হোক বা ভালোই হোক, আজ যা ঘটলো, সেটা আমাদের আগামীকাল এর ওপরে একটা ছাপ রেখে যাবেই, এটুকু হলফ করে বলতে পারি। পারি না?


যাই হোক, তার নাম ছিলো মউ। আপনাদের মধ্যে যাঁরা “টুকরো স্মৃতির” আগের কিস্তিটা পড়েছেন, তারা নিশ্চিত ভাবে এবারে মুচকি মুচকি হাসছেন, আর ভাবছেন এই “লটবর”, মেয়ে ঘটিত ব্যাপার ছাড়া লেখে না। কিন্তু একটু সবুর করুন, এই তো আর কটা লাইন বাকি লেখাটা শেষ হতে, তার পরেই নাহয় আপন মতামত টা দেবেন। মউ এর বাবা কে মোটামুটি ভাবে শিল্পপতি বলা যায়, বিশাল কারবার, বালিগঞ্জে বাড়ি, একমাত্র মেয়ে এই মউ। আর আমি? তখন সদ্য চাকরি তে ঢুকেছি, দেড় বছর হয় কি না হয়। থাকি নাগপুর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে, উম্‌রেড় বলে একটা জায়গায়। চারিদিকে জঙ্গল, আর তার মাঝখানে একটা কয়লাখনি। যাঁরা তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মরত, তাঁরা জীবনের প্রথম ‘অনসাইট’ যান, কেউ বা আমেরিকা, কেউ বা ইঊরোপ, নিদেন পক্ষে সিঙ্গাপুর বা হংকং এ যান। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সে গুড়ে বালি। গিয়ে পড়লাম কয়লাখনিতে। যাই হোক, সে আরেক গপ্পো, অন্য কোথাও শোনাবো। তো সেই উম্‌রেড়ে না যেত একটা খবরের কাগজ, না ছিল একটা রেডিও। টিভি তো অনেক দুরের বস্তু তাই অফিসের কাজ ছাড়া কাজ বলতে ছিলো জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো আর বই পড়া। আমার একটা বদ অভ্যাস, যেখানেই যাই, সঙ্গে এক পাঁজা বই না নিয়ে যাই না। কিন্তু বই এর ভান্ডার তো অফুরন্ত নয়, কাজেই কিছুদিনের মধ্যেই সে সব বই শেষ। এমন কি কিছু বই বেশ কয়েকবার করে শেষ। সময় কাটাতে এবারে শুরু করলাম ডায়রি লেখা। কিন্তু সেই পান্ডব বর্জিত জায়গায় দৈনন্দিন জীবনে বৈচিত্র এতই কম, যে ডায়রির আধপাতাও ভরতোনা। অতএব শুরু করলাম চিঠি লেখা। সে কি চিঠির বহর! আনন্দবাজারে অপ্রকাশিত পত্র হিসাবে ছাপলে, পুরো পূজা সংখ্যায় আর কোনো লেখা না দিলেও চলবে। দিস্তে দিস্তে চিঠি। বাবা  মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, এবং সময় বিশেষে তাদেরও বন্ধু বান্ধব, সবাই নিয়মিত চিঠি পেতে থাকল আমার কাছ থেকে। এই করতে করতে শেষটায় বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডকেও লিখে ফেললাম, যদিও তাকে তখনো পর্যন্ত চোখেই দেখিনি। সেই চিঠি পেয়ে, হয়ত বেজায় ভড়কে গিয়ে বেচারি মেয়েটি তার এক প্রানের বান্ধবীকে চিঠিখানা দেখায়। এই বান্ধবীই হলো মঊ।

যথাসময়ে সেই চিঠির উত্তর এলো বন্ধু, তার বান্ধবী এবং বন্ধুর বান্ধবীর বান্ধবী, তিন জনের কাছ থেকেই। একটু ধাঁধা লাগছে কি? ধাঁধা আমার ও লাগতো মাঝে মাঝে। কোন চিঠিতে কাকে কি লিখছি, সেটা ভুলে যেতাম। যাইহোক, আমি তিনজনকেই উত্তর দিলাম। পত্রালাপ চলতে থাকলো। কয়েক বারের পর, বন্ধু এবং তার বান্ধবী ঝরে গেলো। রয়ে গেলো শুধু বন্ধুর বান্ধবীর বান্ধবী, মউ। প্রথমে সপ্তাহে একটা চিঠি, তার পর তিনটে, শেষে বেড়ে গিয়ে প্রায় প্রতিদিন একটা করে। এমন কি এক খামের মধ্যে দু খানা চিঠিও এসেছে, একটা রাত্রে লেখা, একটা সকালে।
কিছুদিন পর, পুজোর ঠিক আগে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ষষ্ঠির দিন ভোরবেলা বাড়ি ঢুকলাম। বিকেল বেলা সেই বন্ধুর বাড়ি আড্ডা মারতে গেলাম চেতলায়। সে বললো - “আমার গার্লফ্রেন্ডের বাড়ি চল, সে তোকে দেখতে চায়” রাজি হয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি বেশ বড়োসড়ো ব্যাপার। একদিকে আমার বন্ধুর বান্ধবী প্রায় উচ্চিংড়ের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে উড়ছে, আর অন্য দিকে দেখি একটি মেয়ে, শাড়ি  গয়না এবং ভাবভঙ্গি তে একটু গিন্নি-বান্নি গোছের, সোফায় বসে রয়েছে। আমি এর আগে কোনদিন ছবি দেখিনি বলে চিনতে পারিনি, শেষে বন্ধুর বান্ধবী আলাপের ছলে চিনিয়ে দিলো, এই হলো মউ। আমি একটু মজা করেই বন্ধু কে জিজ্ঞেস করলাম 
-   “ওরকম সেজেছে কেন রে? পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে নাকি?
-   “পক্ষ আসছে কিনা জানিনা, তবে পাত্র হাজির”
-   “মানে?
-   “ওরে গাধা, মেয়েটা তোকে ১২৬ খানা চিঠি কি এমনি এমনি লিখেছে?
মউ আমাকে মোট কটা চিঠি লিখেছে তার কোন হিসেব আমার কাছে ছিলোনা। সংখ্যাটা শুনে ঘাবড়ে গেলাম। প্রান টা কেমন যেন পালাই পালাই করে উঠলো। আমি তো রঙ চটা জিন্স, বাটিকের পাঞ্জাবি আর চপ্পল। আর এ হলো বালিগঞ্জের হাই সোসাইটি। এ নিয়ে পঞ্চাশের দশকের বাংলা ছবি হিট হতে পারে, আজকের দিনে কিছু হওয়া অসম্ভবকিন্তু ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে। মউ এগিয়ে এলো হাসি হাসি মুখে। কেন জানিনা, প্রথম থেকেই আমার মন কেমন যেন বিরূপ হয়ে পড়েছিল, এবং গোটা ব্যাপারটা দেখে সেটাকে গ্রহন করতে পারছিলো না। মউ হেসে হেসে প্রচুর গল্প করছিল, আমার চিঠির অংশ উদ্ধৃত করছিল কথায় কথায়। এদিকে আমি ঘামতে শুরু করেছি ভেতরে ভেতরে। কবে কোন চিঠিতে কি লিখেছি, এবং তার চেয়েও বড় কথা, কটা ঢপ দিয়েছি, সে গুলো মনে করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু দেখলাম, এক্ষেত্রে স্মৃতি বড়ই বেইমান।
ঝাড়া তিন ঘন্টা কেটে গেল। মুক্তি পেলাম এই বলে, যে দেশপ্রীয় পার্ক থেকে হাওড়া শিবপুরে, আমার বাড়ি পৌছতে আরো তিন ঘন্টা লাগবে তখনো বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর দিয়ে ট্রাম কোম্পানির বাস এ চড়ে রবীন্দ্রসদন থেকে ১৫ মিনিটে শিবপুর পৌঁছনোটা অনেকেই জানতো না, এটাই বাঁচোয়া। বেরোবার ঠিক আগে, কায়দা করে আমাদের বাড়ির নম্বরটা নিয়ে নিল মউ। তখনো পকেটে পকেটে মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু হতে আরো বছর তিন  চার বাকি। ওর নম্বর টা দিয়েছিল কিনা, সেটা এতদিন পরে আর খেয়াল পড়ছে না। দিলেও আমি মনে রাখার কোন চেষ্টা করিনি। ট্রেন যাত্রার ধকল ছিলো, বাড়িতে আদর যত্ন ও কিছু কম হলো না। পরিশেষে গুরুভোজন, এসব মিলিয়ে একটু তাড়াতাড়িই বিছানায় গেলাম। ঘুম নামতেও দেরি হলোনা চোখে। কিন্তু, আচমকা ঘুম ভাঙ্গলো টেলিফোনের শব্দে। ফোন ঘুম চোখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা তুললাম। সেটা থাকতো আমার ঘরেই। ওপাসে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলার শব্দ। তার পর ভেসে এলো কথা -
-   “আমি মউ”
তার পরের বাক্যালাপ কিছুটা এরকম -
মউ – “ঘুম আসছে না
আমার মন - আ মোলো, আমার ঘুমটার বারোটা বাজালি কেন?”
আমি - শরীর খারাপ নাকি?”

মউ  “শরীর নয়, মন খারাপ”
আমার মন - “অ, তো কাল সকালে বাবা কে বোলো , সাইক্রিয়াট্রিস্ট দেখাবে”
আমি - “কেন? কেউ কিছু বলেছে?

মউ  “শুধু বললেই মন খারাপ হয়? না বললে হয় না?
আমার মন - “রাত সাড়ে বারোটার সময় ঘুম থেকে তুলে এ কি বিটকেল হেঁয়ালি?
আমি - “বুঝলাম না”

মউ  “আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বললে না কেন?
আমার মন - “যাব্বাবা এতো দিন পর বন্ধুর সঙ্গে দেখা, তার সঙ্গে গল্প না করে.........”
আমি - “আরে সেরকম কিছু না, আমি একটু কম কথাই বলি।”

মউ  “আমি বোধহয় নিজেকে খুব হালকা করে ফেললাম।”
আমার মন - “শাড়ি তে অতটা বুঝিনি, তবে মনে হয় একটু হালকা হলে তোমার পক্ষে সেটা ভালোই হবে।”
আমি - “একদম বুঝতে পারছিনা কি বলছো”

মউ  “তুমি কি কিছুই বোঝো না?
আমার মন - “আ মোলো যা !”
আমি - “সত্যি বুঝতে পারছি না কি বলতে চাইছো।”

মউ  “সব ই কি বলে বোঝাতে হবে?
আমার মন - “সর্বনাশ, লক্ষন ভালো ঠেকছে না। সাবধান , সাবধান।”
আমি - “মানে ...ইয়ে ...ওই...( ঢোঁক গেলা )”

মউ  “সব জানো সব বোঝো, অথচ বলতে পারছোনা। আমি যে কান পেতে রয়েছি”
আমার মন - “হে মা কালী, হে মৌলা আলী, আর যত সব যে যেখানে আছো, বাঁচাও, বাঁচাও।”
আমি - “এখন ফোন রেখে চুপ চাপ শুয়ে পড়, কাল সকালে কথা হবে।”

মউ  “আমি করব? না তুমি করবে?
আমার মন - “তোমাকে ফোন করতে আমার বয়ে গেছে। যা খেল দেখালে, আবার?
আমি - “তুমিই কোরো।”

ফোন টা রাখলাম। এর পরে সংক্ষিপ্তসার টা যদি বলতে হয় তো বলবো, কয়েক বার দেখা হয়েছে মঊ এর সঙ্গে। কখনো রাস্তায়, কখনো বন্ধুদের আড্ডায়। কথা ও হয়েছে। কিন্তু আর কোনো দিন সহজ হতে পারিনি ওর সঙ্গে। অথচ একটা ব্যাপারে কখনো সন্দেহ হয়নি, যে মেয়েটা আমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলো। সেখানে কোনো ফাঁকি ছিলো না। কেন এমন হয় জানিনা। সে আমাকে সমস্ত মন দিয়ে ভালোবসেছে, অথচ আমি পারিনি সেটা। অনেক পরে শুনেছিলাম  তার বিয়ে হয়েছে। নিশ্চই সুখিও হয়েছে। তবে আমার মনের একটা অপরাধবোধ আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, সেটাই লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করলাম। এ লেখা কোনো দিন যদি তার চোখে পড়ে, তাহলে সে বুঝবে। জীবনে সবকিছুই হিসেব করা থাকে কিনা জানিনা। হয়ত অনেক পরে কোনো এক দিন, আমি ও মৌ এর জায়গায় থেকে বুঝেছি, সেদিন মেয়েটা কতখানি কষ্ট পেয়েছিল।
- সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়


1 টি মন্তব্য: