তিরিশ পেরনোর পর, ফেলে আসা জীবনের অনেকটা অংশই দেখতে অন্যরকম হয়ে যায়। বার্ধক্যের বিলাপের কথা বলছিনা, কিন্তু অনেক স্মৃতি, যেগুলো হয়ত আনন্দদায়ক নয়, সেগুলোকেও রোমন্থন করতে বেশ মজা লাগে। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় ষান্মাসিক পরীক্ষায় সংস্কৃতে বারো পেয়েছিলাম। মনে আছে, সে গ্লানি ভুলতে পারিনি বহুকাল। কিন্তু এখন যখন সেই স্মৃতি ফিরে আসে, তখন দুঃখের বদলে, বেশ কিছুটা হাসিই পায়। খেলায় হেরে যাওয়ার পর না খেয়ে শুয়ে থাকা। এমন কি কলেজে খুচরো প্রেমের হঠাৎ পরিনত হতে গিয়ে বেদম ধাক্কা খাওয়া, এসব ই আসতে আসতে মধুর স্মৃতি হয়ে আসে। কিছুদিন আগে এরকমই এক বান্ধবীর সঙ্গে যোগাযোগ হলো। একটা সময় তার সঙ্গে একটু “ইয়ে” গোছের হয়েছিল, কিন্তু চলতি জীবনে দুজনে দুদিকে চলে গেলাম, যোগাযোগ রইলনা। হয়ত, তেমন একটা জোর দিয়ে যোগাযোগ রাখতেও চাইনি কেউ ই। এখন সে গৃহিণী, মা এবং বহুজাতীক সংস্থার মাঝারি ধাপে পা রেখে ওপরের দিকে তাকাতে চেষ্টা করছে। বেশ একটু ভারিক্কি চেহারাও হয়েছে। দেখা হবার পর, পুরনো ছেলেমানুষী নিয়ে খুব একচোট হাসাহাসি হলো। অত্যন্ত আশ্চর্য্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, এক্ষেত্রেও স্মৃতি, বেশ আনন্দই দিলো। যেন নেহাত ই একটা মজার ব্যপার। সেই দিন রাত্রে বসে বসে ভাবছিলাম, সব পুরনো স্মৃতিই কি এরকম আনন্দদায়ক? অনেক পুরনো কথা মনে ভিড় করে আসতে লাগল।
সেটা মাধ্যমিকের আগে স্কুলে শেষ বছর। তখন আমি বেখাপ্পা কিশোর। মানে, প্রতিমাসে মাথায় বেড়ে যাই বলে, জামা কাপড় যা পরি বেখাপ্পা লাগে। তদুপরি মাথায় ঝুলঝাড়ার মতো চুল। আর ওই বয়সেই চোখে একটা মোটা চশমা। মোটের ওপর চেহারা মোটেই আকর্ষক নয়। তার ওপরে আমি না ছিলাম পড়াশোনায় আহামরি, না ছিলাম খেলাধুলোয় নজর কাড়া। এমনকি সবার সঙ্গে কথা বলতেও স্বচ্ছন্দ ছিলাম না। নেহাত ই অন্তর্মুখি সাদামাটা কিশোর। সেইটা ছিলো সরস্বতী পুজোর দিন। তখনো “ভ্যালেন্টাইন ডে” বলে কোন কিছূর অস্তিত্ব জানা ছিলোনা। বরং বলতে পারি, সরস্বতী পুজোর দিন টাই অলিখিত ভাবে কিছুটা এই ভুমিকা পালন করত। স্কূলে সেবার পুজোর ভার আমাদের ওপর। তাই আগের রাত থেকে স্কুলেই পড়ে আছি। সকাল হয়েছে, পুজ়ো দেখতে আসছে অনেকে। অন্য স্কুলের ছেলে মেয়েরাও আসছে। এমন একটা সময়ে, আরো কিছু মেয়ের সঙ্গে পুজো দেখতে এলো সে। জানিনা কেন, এই দিনটায় সব মেয়েদের ই ভারি সুন্দর লাগে। পাড়ার চেনা মেয়েদেরও অচেনা ঠেকতে থাকে। হয়ত সেরকমই একটা দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম তার দিকে। আজ আর সেটা স্পষ্ট মনে পড়েনা। বাকি দিনটা কোথা দিয়ে কেটে গেলো বুঝলাম না। বন্ধুদের কাছে নামটা জানতে পারলাম। কিন্তু সেটা লিখবোনা। কেন লিখবোনা, সেটা একেবারে শেষদিকে গিয়ে টের পাওয়া যাবে। শুধু এইটুকু বলে রাখি, ওটায় কোন চমকের আশা না করাই ভাল।
নাম জানতে গিয়ে আরো অনেক তথ্য বেরিয়ে এল। যার কোনটাই আমাকে খুব একটা স্বস্তি দিতে পারলনা। ও সব দিকেই সেরা। পড়াশোনায়, এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিকে। সোজা কথায় ব্যাপারটা, বামন হয়ে চাঁদে হাত দেবার মত হয়ে গেল। কয়েকদিন চেষ্টা করলাম যাতে ওকে ভুলে যাওয়া যায়। কিন্তু যত বেশী করে ভুলতে চাইলাম, ততো বেশী করে যেন মনের মধ্যে ব্যাপারটা গেঁথে যেতে লাগলো। আমার একটা ডায়েরি ছিলো। সেটায় এই সমস্ত কিছু লিখে রাখলাম। সেই সঙ্গে মাঝরাতে আনমনা হয়ে যাওয়া মনখারাপের অনুভুতি গুলো একটা চিঠি তে লিখে রাখলাম। সে চিঠি কোন দিন তার হাতে পৌঁছবে এরকম দূরাশা করিনি।
এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে আমি এক সঙ্গে পড়াশোনা করতাম। ওদের বাড়িতে লোকসংখ্যা বেশী, স্থানাভাব, আর এক সঙ্গে পড়লে পড়াটাও ভালো হবার সম্ভাবনা। এই বন্ধুর হাতে পড়ে গেলাম ধরা। প্রথমে অস্বীকার, পরে স্বীকার করতে বাধ্য হলাম কারন আমার ওই ডায়েরি এবং চিঠি সব ই পরিস্কার করে দিয়েছিল। কিন্তু ধরা পড়ার পরে জানতে পারলাম আরো কিছু অজানা তথ্য। আমার এই বন্ধুটি পারিবারিক সূত্রে ওই মেয়েটির সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। যাতায়াত আছে। ও স্বীকার করলো ব্যাপারটা বামন হয়ে চাঁদে হাত দেবার মতই। ওই অঞ্চলের মেয়েদের সেরা স্কুলে ও ছিল “ফার্স্ট গার্ল”। এটাকে আরাম সে “দাদার কীর্তি” র একটা সুলভ সংস্করন বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারত, যদি না জানতাম আমাদের স্কুলের সবচেয়ে ভালো ছেলেদের মধ্যে একজন তার মনের মানুষ। আর সেই মনের মানুষ আমার ক্লাসফ্রেন্ড। আমাদের সকলেই আগামি বছর একসঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেব। অজান্তে কিভাবে কে জানে, মনে অপরাধবোধ জমা হতে থাকলো। মনে হতে লাগলো আমার এই মনোভাব ঠিক নয়। আমি অনধিকার চর্চা করছি। মাল্টিপ্লেক্স, শপিং মলের কসমোপলিটন স্মার্ট মুল্যবোধে এরকম মনোভাব কে প্রশ্রয় দেওয়া হয়না। কিন্তু আমি তো বড় হয়েছি ছোট্ট একটা শহরে। সেখানে তখনো এত কিছু বুঝতে শিখিনি। তখনো প্রেমে পড়তাম, হৃদয়ের সবটুকু উচ্ছাস জড়ো করে। আর মূল্যবোধটাও একটু অন্য ধরনের ছিলো।
আমার অপরাধ বোধের ওপর শেষ পেরেকটি মেরে দিল, আমার ই ক্লাসফ্রেন্ড সেই “মনের মানুষ”। সোজা কথায় একেবারে রগরগে বাংলা ছবির সংলাপের মত আমাকে দেখিয়ে দিলো, বাৎসরিক পরীক্ষায় আমার প্রাপ্ত নম্বর, পরিবারের সামাজিক প্রতিষ্ঠা, আন্যান্য গুনাবলী, সব দিক থেকেই আমি এতটা পিছিয়ে, যে আমার মনে এই সব চিন্তা আসাই উচিত নয়। কিন্তু ভাববেন না, কথাগুলো ও আমাকে ঠেস দিয়ে বা আঘাত করে বলেছিল। বলেছিলো বন্ধু হিসেবে। কাঁধে সহানুভূতির হাত রেখে। যদিও, ও যে কি করে কথাটা জানলো সেটাই ভেবে বের করতে পারলাম না। সেই দিন থেকে মনের ভাবনা মনেই রেখে দিলাম। ডায়েরি টা যত্ন করে তুলে রেখে দিলাম। সেটা আজও রয়ে গেছে আমার কাছে। কিন্তূ সেই চিঠিটা হারিয়ে গেলো। ওটা আর চোখে দেখিনি কখনো।
মাধ্যমিকের পর একজন মাস্টারমশায়ের কাছে অঙ্কের জন্য ভর্তি হলাম। আশ্চর্যের বিষয়, ওই এক ই কোচিনে সে ও পড়তে এলো। কিন্তু আমি কোনদিন গন্ডীর বাইরে পা রাখার সাহস করতে পারিনি। একটা সম্ভ্রমসূচক দুরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মধ্যে একটা দুটো কথা কখনো হয়েছে, তাও খুব মামুলি গোছের। বরং ওর এক বান্ধবী ছিলো, ধরা যাক তার নাম চৈতালী, তার সঙ্গে আমি কথা বলতাম অনেক সহজে। কারন, সেই বয়সে রাজনৈতিক আদর্শবোধ সদ্য গড়ে উঠছে। আর চৈতালী এবং আমি দুজনেই বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। তাকে কোন দিন এই সব ব্যাপারে মাথা ঘামাতে দেখিনি। চৈতালী এখনো সক্রিয় বামপন্থী কর্মী, এবং বর্তমানে শিক্ষকা। ওর সঙ্গে যোগাযোগ টা রয়ে গেছে।
উচ্চমাধ্যমিক পাস করলাম। কলকাতায় এসে কলেজে ভর্তি হলাম। পড়া, রাজনীতি, খেলা, বড় শহরের গোলক ধাঁধায় ঘুরপাক খাওয়া শুরু হলো আমার। আস্তে আস্তে পুরনো স্মৃতি ঝাপসা হতে শূরু করলো। স্কূলের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ধিরে ধিরে কমে গেল। কয়েক বছর পর একটা কাজে সেই পূরনো ছোট্ট শহরে গিয়ে দেখা হয়ে গেল চৈতালীর সঙ্গে। অনেক পুরনো কথা। এ কোথায়? ও কেমন আছে, এই সব। যখন চলে আসছি, চৈতালী বলল – “ওর কথা জানতে চাইলি না?”। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, আমার মনোভাবের কথা, সে জানে। এমন কি চৈতালীর অজানা নয়। আমি কথা বাড়ালাম না। বিদায় নিয়ে চলে এলাম। অনর্থক এ বিষয়ে আলোচনা করে লাভ কি? ওটা আমার জীবনের একটা শেষ হয়ে যাওয়া অধ্যায় হিসেবে মেনে নিয়েছি ততোদিনে। শুধু বুঝলাম না, এই কথাটা চৈতালী এবং ও, দুজনে জানলো কি করে!
আরো কিছু বছর চলে গেলো। আমি তখন সদ্য চাকরি পেয়েছি। এমন সময় চৈতালীর বিয়ে ঠিক হলো। যথা সময়ে নিমন্ত্রনও পেলাম। আবার সেই ছোট্ট শহর। মাঝে মাঝে আশ্চর্য্য লাগে, এই চেনা কলকাতা শহরটা কত দ্রুত বদলে যাচ্ছে। চাকরি সূত্রে কিছুকাল বাইরে থাকার পর, কলকাতায় ফিরে কয়েক বছর আগে আমার সব যেন কেমন অচেনা ঠেকছিল। কিন্তু কলকাতার বাইরের বাংলার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। সেখানেও বদল এসেছে, এবং আসছে, কিন্তু সেই বদলের গতি, এই কলকাতার বদলে যাওয়ার তুলনায় নিতান্তই অল্প। তাই, পুরনো জায়গায় গেলে মনে হয়, সময় যেন আটকে আছে এখানে। আর সেই কারনেই পুরনো স্মৃতি মনে ভিড় করে আসে। বিয়ে বাড়ীতে যা হয়। পুরনো বন্ধুদের অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল তার সঙ্গে। একেবারে মুখোমুখী পড়ে গেলাম বলা যায়। কিন্তু চমকে উঠলাম ওকে দেখে। ও যে আসবে, এটা তো ধরাই ছিলো। চৈতালীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই জন্য চমকাইনি, চমকালাম ওর চেহারা দেখে। বান্ধবীর বিয়েতে মেয়েরা সাজবেই। কিন্তু সেই সাজগোজ ভেদ করে স্পস্ট চোখে পড়ছে একটা ভাঙ্গন। মনে হলো ভেতর থেকে যেন ভেঙ্গেচুরে গেছে সে। কথা হয়েছে ওর সঙ্গে হাতে গোনা কয়েকবার মাত্র। ও আমাকে তুই বলতো, আর আমি, কোন এক অজানা কারনে তুমি তেই আটকেছিলাম। প্রথম টা খবর নেওয়া। তার পরে, এ কেমন আছে, ও কেমন আছে এই সব। একটু পরে বললো – “তোর হাতে কি একটু সময় হবে?” , আমার সেই রাত্রে ওখানেই থেকে যাবার কথা ছিলো। পরের দিন ভোরবেলায় ট্রেন ধরে ফিরব। বলল – “চল , একটু বসে কোথাও গল্প করি, এতোদিন বাদে সবাইকে দেখে খুব ভালো লাগছে”।
উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর ততোদিনে পাঁচটা বছর গড়িয়ে গেছে। কি করে কাটালাম বছরগুলো তাই নিয়ে কথা হলো। কথায় কথায় আমার ক্লাসফ্রেন্ড ওর সেই মনের মানূষের কথা উঠলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো – “তুই কি জানিস, সে এখন কোথায় আছে?”। আমি আবার চমকে গেলাম – “ সেটা তো তুমি বলতে পারবে আমার চেয়ে অনেক ভালো!”। বললো – “পুরনো কথা মনে করাচ্ছিস? সে সব তো কবেই চুকে গেছে রে। সেই উচ্চমাধ্যমিকের সময়েই। তুই জানিস না“। বললাম – “না, আমি জানতাম না”।
একটু চুপ করে বসে রইলাম দুজনে। কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। একটু পরে বললো – “ এই ক বছরে আমার কথা ভেবেছিস কোনদিন?”। মাথা নেড়ে “হ্যাঁ” বললাম। আমার চোখে চোখ রেখে বললো – তাহলে আমাকে সেটা বলিস নি কেন?”। আমি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করলাম, যে যোগাযোগ করতে চাইলেই বা করব কি করে? কেননা, আমি তো তখনো জানি যে ......। কিন্তু দেখছিলাম ওর চোখ দুটো যেন দু খন্ড হীরের টুকরোর মতো জ্বলছে। ও যেন আমার কথা গুলো শুনছেইনা। হঠাৎ মাঝপথে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল – “ যাক গে, ছাড় এসব কথা, আর কোন মানে হয় না। আমি চলে যাচ্ছি এখান থেকে, বিয়ে হয়ে যাচ্ছে দিল্লী তে”। একটু চুপ থেকে জিজ্ঞ্বেস করলাম “কার সঙ্গে?” , বললো – “জানি না, বাবা-মা পাত্র দেখেছে। আমি শুধু একবার দেখেছি, আর নাম টা জানি, মানুষটা কে চিনি না”।
চুপ করে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। উঠে যাবার আগে বলে গেল –“তোর লেখা একটা, অনেক পূরনো চিঠি আছে আমার কাছে। যদি আবার কখনো ইচ্ছে হয় তো চৈতালীর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে লিখিস”।
সেই শেষ দেখা। আমি চিঠি লিখিনি। চৈতালীর কাছে, ঠিকানাও চাইনি। পরে শুনেছিলাম ওর সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। স্মৃতি টুকু রয়ে গেছে আমার কাছে। আর পুরনো স্মৃতি হলেও এটা আমাকে এখনো আনন্দ দেয় না। তবু স্মৃতি টুকু ভাগ করে দিলাম লেখায়। শুধু তার নাম টা রেখে দিলাম নিজের কাছে। সেটা শুধু আমার। ওইটুকু থাক না। এখন সে কোথায় আছে, কেমন আছে, জানি না। যেখানেই থাক, যেন ভালো থাকে। আর কি ই বা চাইবো?
জীবন বড় অদ্ভুত।
উত্তরমুছুনচাওয়া, পাওয়া আর না-পাওয়া - এর মধ্যে কোনটা বেশী মধুর, এর উত্তর আমার এখনো অজানা।
জীবনকালে জানতে পারবো কিনা, সেটাও জানি না।
জানতে কি চাই, সেটাও বলতে পারবো না।