জার্মান শব্দের সঠিক
উচ্চারন বাংলায় লেখা খুব কঠিন। আলি সাহেব হলে হয়ত পারতেন। আমার সে দুঃসাহস কোথায়? কাজেই
“Mein Widerstand” এই শব্দরূপকে
কোনক্রমে খাড়া করেছি। এটা একটা বইয়ের নাম, এবং বলাই বাহুল্য, লেখক জার্মান। এক সময়
ওপার বাংলার ছিন্নমূল মানুষকে “জার্মান” বলে মজা করে ডাকা হতো। অবশ্য সে মজার
মধ্যে নেহাত মজাই ছিলো, কোন ভাবে ছোট করার প্রয়াস ছিলোনা। বাঙাল আর জার্মান,
দুজনেরই নাকি একই রকম গোঁয়ার। কিছু করবো ভাবলে করেই ছাড়ে। যাই হোক, এই বিদঘুটে
নামওয়ালা বইয়ের লেখক ফ্রিডরিষ কেলনার ছিলেন জার্মান সরকারের মাঝারি গোছের কেরানি।
লিনৎস্ আর লাউবাখ অঞ্চলে প্রধানত সরকারি আইন দফতরে কাজ করেছেন। তাঁর কর্মজীবনের
একটা বড় অংশই কাটে হিটলারের শাষনাধীন জার্মানীতে। তাঁর লেখা বইয়ের নামের বাংলা
তর্জমা করলে দাঁড়ায় – “আমার বিরোধীতা”।
জীবনে প্রথম অধ্যায়ের মত সাদাসিধে, নিয়মনিষ্ঠ, ছকে বাঁধা নয়। যা ইচ্ছে তাই... যাচ্ছেতাই, এই আমার দ্বিতীয় অধ্যায়।
রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪
শুক্রবার, ৭ জুন, ২০১৩
টুকরো স্মৃতি – ৮, গাড়োয়ালি গাড়িওলা
[ রচনাকাল ৭ই জুন ২০১৩ - pnachforon.blogspot.com এ প্রকাশিত হয়েছে "গাড়োয়ালি গাড়িওলা" নামে ]
তীর্থ দর্শন নাকি কপালে থাকলে হয়। সে কপাল যে কেমন দেখতে তা জানিনা। তবে কিনা, পাকে চক্রে আমার বেশ কিছু ঘোরার সঙ্গে তীর্থ দর্শন জড়িয়ে গেছে। পাপীদের হয়ত ইশ্বর ধরে বেঁধেই নিয়ে যান দর্শন করাতে। লিখতে বসে প্রচুর ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলি আমি । আসলে হাড়-আলসে লোক তো, তাই প্রসঙ্গান্তরে যেতে যে টুকু মেহেনত-মজদুরি লাগে, সেটাও আমার কাছে অনেক। এবারে ঠিক করেছি বাহুল্য বর্জিত লিখবো। শুরুতেই বলে দিয়েছি, এ হলো এক গাড়োয়ালি গাড়িওলার গল্প।
তীর্থ দর্শন নাকি কপালে থাকলে হয়। সে কপাল যে কেমন দেখতে তা জানিনা। তবে কিনা, পাকে চক্রে আমার বেশ কিছু ঘোরার সঙ্গে তীর্থ দর্শন জড়িয়ে গেছে। পাপীদের হয়ত ইশ্বর ধরে বেঁধেই নিয়ে যান দর্শন করাতে। লিখতে বসে প্রচুর ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলি আমি । আসলে হাড়-আলসে লোক তো, তাই প্রসঙ্গান্তরে যেতে যে টুকু মেহেনত-মজদুরি লাগে, সেটাও আমার কাছে অনেক। এবারে ঠিক করেছি বাহুল্য বর্জিত লিখবো। শুরুতেই বলে দিয়েছি, এ হলো এক গাড়োয়ালি গাড়িওলার গল্প।
বুধবার, ২৯ মে, ২০১৩
হবেনা শেষ। হতে দেওয়া হবে না।
[ রচনাকাল ২৯শে মে ২০১৩ - pnachforon.blogspot.com এ প্রকাশিত হয়েছে ]
সকালবেলা অফিস বেরোবার আগে একবার কাগজে চোখটা বোলাই। আমার আবার বড় সড় খবরে চোখ যায়না খুব একটা। বড় সড় বলতে, ওই যে, মুখ্যমন্ত্রি কাকে যেন বলেছেন হিম্মত থাকলে করে দেখান, ছত্তিসগড়ে এক গাদা কংগ্রেসি নেতার ওপরে মাওবাদীরা টারগেট প্র্যাকটিস করেছে, সচিন আর আইপিএল খেলবেনা, ওয়েন রুনির ছেলে হয়েছে ইত্যাদি প্রভৃতি। আমার নজর থাকে, একটু আড়ালে থাকা, কিঞ্চিত ছোট হরফের হেডিংওয়ালা খবর গুলোতে। মূলতঃ খেলার খবরই।
সকালবেলা অফিস বেরোবার আগে একবার কাগজে চোখটা বোলাই। আমার আবার বড় সড় খবরে চোখ যায়না খুব একটা। বড় সড় বলতে, ওই যে, মুখ্যমন্ত্রি কাকে যেন বলেছেন হিম্মত থাকলে করে দেখান, ছত্তিসগড়ে এক গাদা কংগ্রেসি নেতার ওপরে মাওবাদীরা টারগেট প্র্যাকটিস করেছে, সচিন আর আইপিএল খেলবেনা, ওয়েন রুনির ছেলে হয়েছে ইত্যাদি প্রভৃতি। আমার নজর থাকে, একটু আড়ালে থাকা, কিঞ্চিত ছোট হরফের হেডিংওয়ালা খবর গুলোতে। মূলতঃ খেলার খবরই।
রবিবার, ১৯ মে, ২০১৩
গোধুলিয়া থেকে দশাশ্বমেধ
[ রচনাকাল ২০শে মে ২০১৩ - pnachforon.blogspot.com এ প্রকাশিত হয়েছে ]
জয় বাবা ফেলুনাথ ছবি যখন প্রথম দেখি, তখন কিশোর মনে ফেলুদা আর মগনলাল মেঘরাজের উপস্থিতি বড়ই প্রবল। আর বেশি কিছু চোখে পড়েনি। আমার সেই বয়সে পরিবেশ বেশ দুষিতই ছিলো, মানে বইমেলাটেলা সব কাছেপিঠেই হত, নাগালের মধ্যে। সেরকমই একটা বইমেলা থেকে পেয়েছিলাম সত্যজিত রায়ের লেখা “একেই বলে শ্যুটিং”। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পড়েছিলাম “ফেলুদার সঙ্গে কাশীতে”। সেই প্রথম কাশীকে চেনা।
জয় বাবা ফেলুনাথ ছবি যখন প্রথম দেখি, তখন কিশোর মনে ফেলুদা আর মগনলাল মেঘরাজের উপস্থিতি বড়ই প্রবল। আর বেশি কিছু চোখে পড়েনি। আমার সেই বয়সে পরিবেশ বেশ দুষিতই ছিলো, মানে বইমেলাটেলা সব কাছেপিঠেই হত, নাগালের মধ্যে। সেরকমই একটা বইমেলা থেকে পেয়েছিলাম সত্যজিত রায়ের লেখা “একেই বলে শ্যুটিং”। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পড়েছিলাম “ফেলুদার সঙ্গে কাশীতে”। সেই প্রথম কাশীকে চেনা।
বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১২
পর্যটনের থিম (উদ্ভুট্টে সিরিজ)
[ রচনাকাল ১১ই নভেম্বর ২০১২ - pnachforon.blogspot.com
এ প্রকাশিত হয়েছে ]
চিন্তায় মোটে ঘুম হচ্ছে না। ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে, পর্যটন মানচিত্রে বাংলা কে ওপর দিকে তুলে আনতে হবে। লোকে যেন বাড়ি থেকে
বেরোবার কথা ভাবলেই মাথার মধ্যে গুনগুন করে ওঠে “আমার সোনার
বাংলা”। মন্ত্রি সেদিন ডেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাকে বেচতে হবে। “আমরা বাংলা কে বেচবো পর্যটকদের
কাছে”। বলে দিয়েছেন অনেক চর্বি জমেছে গত ৩৪ বছরে আপনাদের,
মানে পর্যটন দফতরের আমলাদের। এবারে খেটে খাওয়ার কথা ভাবুন।
ভুলিনি
[র চনাকাল ২৯শে অক্টোবর ২০১২ - pnachforon.blogspot.com এ প্রকাশিত হয়েছে]
বেশ একটা পুজো পুজো মরশুম। মা দুগ্গা সবে বাপের বাড়ি থেকে কৈলাসের পথে পা
বাড়িয়েছেন। বিজয়ার মিস্টিমুখ চলছে। লক্ষ করেছি, বেশী মিস্টি খেলে, স্বভাবও খানিকটা মোলায়েম হয়। গতকাল এক দাদা এসেছিলেন। ছুটির
সকালে বেশ নাড়ু নাড়ু মুখ করে আড্ডা দিচ্ছি। দাদা বই টই নিয়ে চর্চা করেন। তাঁর
কাছেই খবর পেলাম, ১৯৪৬-৪৭ সালে অমৃতবাজার পত্রিকায় তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে যে সব লেখা
বেরিয়েছিলো, তার
একখানা সংকলন বেরিয়েছে। ওই দু বছর কেন? তার আগে বা পরেও তো কতকিছু ঘটেছে, বা ঘটছে। শুধু ওই দুটো বছরকে ধরে টানাটানি কেন বাবা?
২০১২ (উদ্ভুট্টে সিরিজ)
[রচনাকাল ৬ই ডিসেম্বর ২০১১ - pnachforon.blogspot.com
এ প্রকাশিত হয়েছে]
মেসো-আমেরিক সভ্যতায় একধরনের দিনপঞ্জি বা
ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হতো, যাকে বলা হয় লঙ কাউন্ট ক্যালেন্ডার। বর্তমান আমাদের
চলতি ক্যালেন্ডারে চেয়ে অনেকটা আলাদা এই ক্যালেন্ডারের একক ছিলো কিন, যা কিনা আমাদের এক দিনের সমান। ২০ কিন এ হতো ১ উইনাল, ১৮ উইনালে ১ তুন ( যা কিনা ৩৬০ দিন, অর্থাৎ প্রায়
আমাদের এক বছরের সমান) এবং ২০ তুন এ ১ কাতুন এবং ২০ কাতুন এ ১ বাকতুন। এই বাকতুন
নিয়েই সমস্যার শুরু।
মঙ্গলবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১২
উন্নয়ন ও রোবোকপ
[রচনাকাল ২০১১ - pnachforon.blogspot.com এ প্রকাশিত হয়েছে]
ঢাকের বাদ্যি বাজতে এখনো অনেক দেরি। সবে জষ্টি মাসের শেষ। বঙ্গে পরিবর্তনের বায়ু বেশ দ্রুতগতিতেই বইছেন (এবং চারমূর্তির সেই ভাল্লুকের মতন টপাটপ মানুষ ও গিলছেন)। বাংলায় ভোটপর্ব চুকতে, আমরা আইপিএল নিয়ে কয়েকদিন লাফালাফি করলাম। কিন্তু কোলকাতার দল ইয়ের মতো পরপর দু খানা খেলায় হেরে প্রতিযোগিতার বাইরে চলে গেল। কয়েক দিন হাসপাতাল সুপার এর বরখাস্ত, অস্ত্র উদ্ধার, রেজ্জাক মোল্লার গোলা বর্ষন, রামদেব নিয়ে হইচই করলাম। কিন্তু কোনটাই ঠিক জমলো না। অগত্যা উত্তেজনায় ইতি। ওদিকে দার্জিলিং সমস্যার ও সমাধান হয়ে গেল একটা সই দিয়ে। মাওবাদীরাও শুনছি নাকি দন্ডকারন্যে ফিরে গেছে। কিষেনজির টিআরপি পড়তির দিকে।
“এ মা, রাজা ন্যাংটা” – উলঙ্গ রাজা
[রচনাকাল ২০১১ - pnachforon.blogspot.com এ প্রকাশিত হয়েছে]
বল্লে নাকি হুল দিবস। সেরেচে, সে আবার কি গো? মেরে মুক পরোটা করে দেবে বল্লে, শুনিচি। কিলিয়ে কাঁটাল পাকাবে, সে ও নাহয় দেকিচি। তাই বলে ভাই হুল ফোঁটাবে? তুমি কি ভাই মৌমাচি? দেকে তো মানুষ বলেই ঠাওর হচ্চে। বেশ তেল চুকচুকে, পাকা সোনা বরন। একখানা নেয়াপাতি ইয়ে ও আচে দেকচি। গায়ে কি একটা মেকেচো বলোতো? পার্ক অ্যাভেনিউ কি? না কি ওই যে যেটা মাকলে কয়েকটা ধিঙ্গি মতো মেয়ে দৌড়ে আসে, সেইটে? না না, হুল টুল বড্ডো খারাপ কতা। সে ছিলো মেজোতরফের লাটু কত্তা। খেঁটে একগাছা লাঠি নিয়ে কত্ত পিটিয়েচে এককালে। গনা গুন্ডাকে তো সেবার হেদো পার করে দিয়ে এলো ওই লাঠি পেটা করে। তা সে লাটু কত্তাও হুল টুল নিয়ে কাজ কারবার করেনিকো।
বল্লে নাকি হুল দিবস। সেরেচে, সে আবার কি গো? মেরে মুক পরোটা করে দেবে বল্লে, শুনিচি। কিলিয়ে কাঁটাল পাকাবে, সে ও নাহয় দেকিচি। তাই বলে ভাই হুল ফোঁটাবে? তুমি কি ভাই মৌমাচি? দেকে তো মানুষ বলেই ঠাওর হচ্চে। বেশ তেল চুকচুকে, পাকা সোনা বরন। একখানা নেয়াপাতি ইয়ে ও আচে দেকচি। গায়ে কি একটা মেকেচো বলোতো? পার্ক অ্যাভেনিউ কি? না কি ওই যে যেটা মাকলে কয়েকটা ধিঙ্গি মতো মেয়ে দৌড়ে আসে, সেইটে? না না, হুল টুল বড্ডো খারাপ কতা। সে ছিলো মেজোতরফের লাটু কত্তা। খেঁটে একগাছা লাঠি নিয়ে কত্ত পিটিয়েচে এককালে। গনা গুন্ডাকে তো সেবার হেদো পার করে দিয়ে এলো ওই লাঠি পেটা করে। তা সে লাটু কত্তাও হুল টুল নিয়ে কাজ কারবার করেনিকো।
স্বপ্ন
[রচনাকাল ১৯শে মে ২০১১ - pnachforon.blogspot.com এ প্রকাশিত হয়েছে]
পয়লা এবং পঁচিশে , এই দুই সমেত বৈশাখ গত হয়েছেন। জষ্টী মাসের পচা গরমে বাজারে গুটি গুটি পায়ে হিমসাগরের আমদানি শুরু হয়েছে। ভোট পার্বন শেষ। পরিবর্তন বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ভোরের দিকে মিঠে মিঠে হাওয়ায় ঘুমের আমেজ গাঢ় হচ্ছে। যদিও রাত্রি বেলা পেটে ভিজে গামছা জড়িয়েও হাঁসফাঁস দশা কাটছেনা। তার ওপরে গতকাল বুদ্ধপুর্নিমা ছিল বলে রাত্রে পাতে পড়ল পরোটা আর আলুর দম। সঙ্গে রাবড়ী আর পান্তুয়া।
বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২
ঋষিকন্যা (উদ্ভুট্টে সিরিজ)
[রচনাকাল
২০০৯]
গঙ্গাতীরবর্তি
উত্তরাপথের সূর্য্যাস্ত নাকি মালব দেশের সন্ধ্যার সঙ্গে তুলনীয়। দিনান্তে এই
সময়টুকুতে যেন মনের সমস্ত বিষাদ আসিয়া বলপুর্বক দিবাভাগকে অস্তমিত করিয়া দিতে চায়।
জনাকীর্ণ পাটুলিপুত্রের পাষান নির্মীত ঘাটে বসিয়া করলগ্নকপোলে ভাবিতেছিলাম আমার
মনের এই যে বিকার, ইহা কি শুধুমাত্র প্রদোষকালজনিত বিষাদ? তাহা হইলে মাসাধিক কাল এরূপ অস্থির হইতেছি কেন? এই সুবিশাল মগধ সাম্রাজ্যের অধিশ্বর স্বয়ং বিক্রমাদিত্যের (দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য) খাস স্থাপত্যবিভাগের একজন মধ্যম-বাস্তুকারের কি ইহা শোভা পায়?
কর্মে মন নাই।
মুখ্যস্থপতি প্রথমে লক্ষ্য করিয়া সদুপদেশ দিয়াছিলেন। পক্ষকাল পরে ডাকিয়া তিরস্কার
করিয়াছেন। এবং গতকাল হুমকি দিয়াছেন, বৎসরান্তে যখন আমার কার্য্যকারিতার মুল্যায়ন হইবে, তখন আমার এমত অমনোযোগীতা, অতি অবশ্যই আমার বাৎসরিক
ফলাফলে প্রভাব ফেলিবে। গত কয়েক বৎসরের ফলাফল আমাকে মধ্যম হইতে গরিষ্ঠ বাস্তুকারের
পদোন্নতীর সমীপে আনিয়াছে। এমতাবস্থায় ক্ষণিকের অসতর্ক পদক্ষেপে আমাকে সরাইয়া অন্য
কেহ আগাইয়া আসিতে পারে। মুখ্যস্থপতি ইহাই বলিয়াছেন। কিন্তু ইহা আমার মানসিক
অস্থিরতা কে সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করিতে অক্ষম। ইহা শুধু ফলাফল। কারন খুঁজিতে কালের
উজান বাহিয়া আরো কিছুদুর পিছাইতে হইবে।
পূর্বরাগ
আমি কবি নহি। সাহিত্যচর্চা আমার শখ নহে। যদিচ পুর্বরাগ দেখিয়া মনে এইরূপ ধারনা
হওয়া সম্ভব, যে একখানি প্রেমাখ্যান
শুরু হইতেছে। দুই বৎসরাধিক পূর্বে আমরা শিবির ফেলিয়াছিলাম পাটুলিপুত্রের দুইশত
ক্রোশ উত্তর-পূর্বে ঘন জঙ্গলাকীর্ণ এক পাহাড়ি এলাকায়। আরো কিছু উত্তরে হিমালয়ের
শুরু এবং সে অঞ্চল দুধর্ষ পাহাড়ি উপজাতির বাসভূমি। উহাদের ক্ষুদ্র চক্ষু, উচ্চ হনু, বিরল শশ্রু মুখোমন্ডল
দেখিলেই আর্যাবর্তের অধিবাসী হইতে পৃথক করা যায়। মগধ সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্ত
ইহাদের কবল হইতে সুরক্ষিত করা একান্তই প্রয়োজন। সম্রাট সীমান্ত জুড়িয়া সেনা গুল্ম
বসাইতে চাহেন। আর সেনা গুল্ম নির্মানে বাস্তুকারের প্রয়োজন। এই কারনেই আমাদের এই
অঞ্চলে পদার্পন। এত দুরের পথ, তদুপরি পথে দস্যু-তস্করের ভয় ও রহিয়াছে। তবু অধিকাংশ বাস্তুকারই ঘরদোর ছাড়িয়া
এমন কর্মে আসিতে চাহেন তাহার পশ্চাতে দুইখানি কারন রহিয়াছে। প্রথমত এইসব দুর্গম
অঞ্চলে আসিলে নিয়মিত মাসোহারার উপরে কিঞ্চিত অতিরিক্ত ভাতা পাওয়া যায়। তদুপরি কোন
বরিষ্ঠ আধিকারিক এসব অঞ্চলে কদাচ পদার্পন করেন না বলিয়া, কার্য্যসিদ্ধির অন্তে, উপরমহলের চোখে পড়িবার
সম্ভাবনাও বাড়িয়া যায়।
কতিপয়
দিবস অতিক্রান্ত হইয়াছে। জরীপের নিমিত্ত জঙ্গলে ঘুরিতে হইতেছে। আমি নিতান্তই
নাগরিক। কখনো এরূপ উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে দিন কাটাই নাই। একদিন বেলা দ্বীপ্রহরে
একখানি ঘন গুল্মের পশ্চাতে সহসা লক্ষ্য করিলাম একখানি হরিদ্রাভ ঝলক। মেরুদন্ডে
হিমশ্রোত বহিয়া গেল, উদরের তলদেশে একটি অস্বস্তিকর চাপ অনুভব করিতে লাগিলাম। তবে কি উহা শার্দুল? এতদঞ্চলে উহাদের আধিক্য
রহিয়াছে শুনিয়াছিলাম। মস্তিস্ক শূন্য হইয়া গেল। পদদ্বয়ে ভর করিয়া বায়ূবেগে
ছূটিলাম। দিকবিদিক লক্ষ্য করি নাই। দৌড়ঝাঁপের অভ্যাস একেবারেই নাই। দ্রূত
পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িলাম। তদুপরি পথ হারাইয়াছি। পথিমধ্যে কখনো বৃক্ষশাখা, কখনো উপলখন্ডের সহিত
সংঘর্ষে নিজেকে সম্পুর্ন অক্ষত রাখিতে পারি নাই। এমনই এক সময় অনুভব করিলাম পৃষ্টে
অন্যান্য উপকরনের সহিত একখানি ক্ষুদ্র মৃৎ নির্মিত জলের সুরাহী ছিল, সেখানি ভগ্ন হইয়াছে।
অনভ্যাসের শারীরিক পরিশ্রমের ফলে যৎপরোনাস্তি তৃষ্ণার উদ্রেক হইতেছিলো। এক্ষনে
জলাভাবে সেই তৃষ্ণায় যেন ঘৃতাহুতি পড়িল। অভাবে অভাব-বোধ বৃদ্ধি পায়। একখানি বৃহৎ
বৃক্ষ সন্মুখে দেখিয়া উহার নিকট অগ্রসর হইলাম। কিঞ্চিত বিশ্রামের প্রয়োজন।
বৃক্ষতলে উপবেশন করিয়া ক্লান্তি দূর করিবার প্রচেষ্টা, সীমাহীন তৃষ্ণার তাড়নায়
বিলক্ষন বিঘ্নীত হইতেছিল। উপরন্তু অনভ্যস্ত পরিশ্রমের উপান্তে, শরীর চাহিতেছিল কিছু
খাদ্য। সহসা সন্মুখে “ছপ” শব্দে বৃক্ষশাখা হইতে
কিছু পতিত হইল। চাহিয়া দেখিয়া সহসা ঠাহর হইলনা, কিন্তু হস্তে ধরিয়া বোধ হইল ইহা বন্য তিন্তিড়ী। অত্যধিক অম্ল স্বাদের জন্য
ইহার বিলক্ষন খ্যাতি রহিয়াছে। ইহা ভক্ষন করিয়া পিত্তরক্ষা সম্ভব নহে। তদুপরি
জলাভাব।
ক্লান্তি
এবং হতাশায় কিঞ্চিত তন্দ্রা আসিয়াছিল, বলিয়া লক্ষ্য করিনাই, সন্মুখে কখন যেন একখানি মনুষ্য অবয়বের আবির্ভাব ঘটিয়াছে। মুখ তুলিয়া তাকাইলাম, সহসা প্রত্যয় হইল না।
সন্মুখে এক যুবতী, আর্য্যজাতী বলিয়াই মনে হইল। বয়স আন্দাজ বিশ বৎসর হইবে। পানপত্রের ন্যায়
মুখোমন্ডলের আকৃতি, নির্ভয় দুখানি চক্ষু, পরনে একখানি ফ্যাকাসে গেরুয়া কাপড়। কবরী এবং গ্রীবায় বন্য পুস্পের মালা ব্যতীত
অন্য কোন প্রসাধন দৃষ্টিগোচর হইলনা। বড় ভাল লাগিল।
অনুরাগকিয়ৎকাল
পরের ঘটনা। অশ্বপৃষ্ঠে পাটুলিপুত্র ফিরিতেছি। পশ্চাতে একখানি গো-শকটে রহিয়াছেন
মেধা। গত চার মাসের প্রেম বিফলে যায়নাই। ঘন জঙ্গলে পথ হারাইয়াছিলাম। ঋষিকন্যা মেধা
আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যান আপন পিতার আশ্রমে। নিশীযাপন করিয়া চলিয়া আসি, মেধা আমাকে কিয়দ্দুর
আগাইয়া দিয়া শিবিরের পথ দেখাইয়া দেন। তাঁর দ্রষ্ট পথ ধরিয়া নিরাপদে শিবিরে ফিরিয়া
আসিতে সমর্থ হই, কিন্তু অনুভব করি, ভগ্ন জলের সুরাহির
অতিরিক্ত কিছু হারাইয়া আসিয়াছি। বিশেষতঃ মধ্যাহ্নভোজনের সময় পাচকের স্থুল রোমশ
হস্ত দেখিয়া মানসপটে গতকল্যের দেখা দুখানি সুললিত বাহুর কথা, বাহুর উপরে সুললিত
স্কন্ধে আলুলায়িত ঘন কালো কুঞ্চিত কেশরাশি এবং সর্বোপরি দুইখানি চক্ষুর কথা বার
বার মনে পড়িতেছিল। এই জঙ্গলী পরিবেশে মেধার উপস্থিতি যেন আমার মরুভুমিসম বন্য
প্রবাসে একখানি ঘন সবুজ মরুদ্যান রূপে দেখা দিলো। অতঃপর নানাবিধ ছলাকলা, ন্যাকামো এবং হবু
শ্বসুরের ভজনা শুরু করিলাম। কন্যাটি কথা বলেন বড়ই কম। হয় ঘর কন্যার কার্য্য, নতুবা পুঁথী লইয়া ব্যস্ত
থাকেন। মধ্যে মধ্যে তাঁহার নিকট কতিপয় শবর জাতীয় মানুষের আনাগোনা দেখি। উহারা
বোধহয় আমাকে কিঞ্চিত সন্দেহের চক্ষুতে দেখে। মেধার সহিত উহারা কি যেন জল্পনা করিতে
আসে। মেধার মাতা নাই। গত হইয়াছেন। আর পিতা সর্বক্ষন পুঁথী ও আয়ুর্বেদ লইয়া ব্যস্ত।
ইহাদের আশ্রমিক জীবনে বৈচিত্র বড় কম। তবু তাহারই মধ্যে আমার হবু শ্বসুর মহাশয়, প্রত্যহ আমার কিছু
কাল্পনিক ব্যাধির চিকিৎসা করিতেন। এবং তাঁর তৈরি পাঁচন এবং অনুপানের দাপটে, কখনো সে ব্যাধি রাত্রি
অতিক্রান্ত হইবার পুর্বেই বিদায় লইত।
মেধাকে
যে টুকু পাইতাম, তাহাকে নাগরিক জীবনের
গল্প শুনাইতাম, পাটুলিপুত্রের গল্প।
কখনো বারানসী বা প্রয়াগের গল্পও করিতাম। কর্মসূত্রে এসব দেশ আমার পরিচিত। মেধা চুপ
করিয়া শুনিত। কয়েকবার অতিরঞ্জনের চেষ্টা করিয়াছি, সফল হই নাই। মেধার পান্ডিত্য অথবা জীবনবোধ প্রতিবারেই ধরিয়া ফেলিয়াছে। বিস্ময়
জাগিত, জঙ্গলী পরিবেশে বড় হওয়া
এক যুবতী নাগরিক জীবন সম্পর্কে এতখানি ওয়াকিবহাল হয় কি রূপে! তবে মেধা সম্পর্কে
আমার মোহ ছিলো সম্পুর্ণ একতরফা। তাহার দিক হইতে কখনো কোনোরূপ ইঙ্গিত পাইনাই।
কিন্তু আমাকে হতবাক করিয়া কিছুদিন পূর্বে মেধা নগর দর্শন এবং এবং নগরবাসী হইবার
স্বপক্ষে মত প্রকাশ করিল। অকস্মাৎ সৌভাগ্যে বুদ্ধি হারাই নাই মোটেই। ঋষির নিকট
গিয়া মেধার পাণিপ্রার্থনা করিয়াছি। ঋষি আমাকে জটাজূট ভেদ করিয়া তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে
দেখিয়াছেন। হয়ত নেহাতই মনের ভুল, তবুও মনে হইয়াছিল, তাঁর শশ্রু-গুম্ফের দুর্লঙ্ঘ বাধা উপেক্ষা করিয়া, কিঞ্চিত হাস্যের কিরন
দ্রষ্ট হইল।
বিহারে
বিবাহের
পর কিয়ৎকাল গিয়াছে। প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়াছে। কিন্তু মনে হইতেছে আরো কিছু হয়ত
চোখের সন্মুখে ভাসিয়া উঠিতেছে। পাটুলিপুত্রের নাগরিকগন নাট্যরসিক। নগরে প্রায়সই
নাট্যাভিনয় অনুষ্টিত হয়। আমার বাসগৃহ হইতে নাট্যশালা পদব্রজে বড়জোর দুই দন্ডের পথ।
সায়ংকালে মেধা ও আমি গৃহ হইতে নিস্ক্রান্ত হইয়া নাট্যশালায় যাইতেছি, অকস্মাৎ মেধা জেদ ধরিয়া
বসিলেন, শকটিকা ব্যতিত তিনি
যাইতে পারিবেন না। সায়ংকালে পাটুলিপুত্রের শকটচালকগন কিঞ্চিত মেজাজে থাকেন।
পছন্দের দিশা ব্যতিত যাইতে চাহেন না। আমি কিয়দ্দুর অগ্রসর হইয়া এক শকট চালক কে
কোনক্রমে রাজী করাইলাম। দস্যুটা এই মাত্র দূরত্বের জন্য অর্ধ কার্ষাপন দাবী করিল।
উপায়ন্তর না দেখিয়া রাজি হইলাম। কিন্তু মনের ভিতরে উহার ঊর্ধতন চতুর্দশ পুরুষ
উদ্ধার করিয়া ছাড়িলাম, যদিও কন্ঠ নিশ্চুপ রহিল। বাক্যালাপ হইতে অনুভব করিলাম, শকট চালক সমতট নিবাসী।
উহাদের গালিগালাজ ভূবন বিখ্যাত।
তদবধি
দেখিতেছি, মেধা পদব্রজে কোথাও
যাইতে চাহেন না। শকটিকা, নতুবা দোলা তাঁহার জন্য ডাকিতেই হইবে, অন্যথা তিনি গৃহেই অধিষ্ঠান শ্রেয় মনে করেন। একবার বলিয়া ফেলিয়াছিলাম, পিতৃগৃহে তাঁর পদব্রজের
অভ্যাস ছিল, আজ তিনি তা ভুলিতে
বসিয়াছেন। কি কুক্ষনেই যে বলিয়াছিলাম, মুহুর্তে অধর স্ফুরিত হইল, চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হইল, পরনের কাপড়ের আঁচল ওষ্ঠে উঠিয়া আসিল, এবং কন্ঠ হইতে সুতীক্ষ্ণ স্বরে অনুযোগ নির্গত হইল - “তবে কি মধুচন্দ্রীমা শেষ?” ইহার প্রত্যুত্তরে
নিরবতাই শ্রেয় বলিয়া মনে করিয়া ছিলাম। ইহাতেই না থামিয়া, মেধা বলিয়া চলিলেন, তিনি পিতৃগৃহে
প্রত্যাবর্তন করিবেন। সমূহ বিপদের সম্ভাবনা দেখিয়া তদ্দন্ডেই একখানি বিলাস বহুল
শকট ডাকিয়া আনিয়া গভীর রাত্রি পর্যন্ত গঙ্গাতীরবর্তি বীথি ধরিয়া ভ্রমন করিয়াছিলাম।
ইহা বাবদ, আমার মাসোহারার একখানি
বৃহৎ অংশ খরচ হইয়া গিয়াছিল। ভুলেও আর কোনদিন মুখ খুলিনাই। শুধু মাঝে মাঝে মনে হয়, এই কি সেই মেধা? যাহাকে বন্য গুল্মের নাম
না জানা পুস্পের ন্যায় আপন করিতে চাহিয়াছিলাম!
আহারে
আমার
প্রপিতামহ পূর্বদেশ হইতে আসিয়া পাটুলিপুত্র নিবাসী হইয়াছিলেন। তদবধি পরিবার
পাটুলিপুত্রেই অবস্থান করিলেও, গৌড়িয় আচার – বিচার – সংস্কার একেবারে কাটাইতে পারেনাই। বিশেষত আহারের দিক হইতে বিচার করিলে গৌড়িয়
প্রভাব সহজেই চোখে পড়িয়া যায়। মৎস এবং নানা প্রকারের আমিষ ভিন্ন খাদ্য মুখে রুচিত
না। আমাদের পরিবার বাস করিত গঙ্গার অপর পারে। কার্যের সুবিধার্থে আমি বাস করিতাম
নগরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে। আমার সেবার্থে পিতৃদেব এক ভৃত্য ও তাহার স্ত্রী কে আমার
নিকট পাঠাইয়াছিলেন। ভৃত্য আমার গৃহের সকল কার্য্য করিত, এবং উহার স্ত্রী আমার
পাচিকা রূপে বহাল হইয়াছিল। যখন কার্য্যপোলক্ষ্যে উত্তরে গিয়াছিলাম, তখন ইহাদের দুই জনকেই
পিতার নিকট প্রেরন করিয়াছিলাম। কিন্তু বিবাহের পর, পুনরায় মাতা উহাদের প্রেরন করিতে উদ্যোগি হইলে, মেধা মৃদু আপত্তি প্রকাশ করিয়াছিলেন, এবং গৃহের সকল কার্য্য আপন হস্তে করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন। নবপরিণীতা
বধুর এইরূপ মনোভাব প্রকাশের ফলে মেধা প্রথম দিবসেই অনেক খানি সম্ভ্রম আদায় করিতে
পারিয়াছিলেন ইহা বলাই বাহুল্য। ফলে পাটিলিপুত্রে ফিরিলাম ভৃত্য ও পাচিকা
ব্যাতিরেকে।
কিন্তু
অবস্থা পূর্ববৎ না থাকিলেও এতখানি বদলাইয়া যাইবে তাহা ভাবি নাই। মেধা অতিশয়
স্বাস্থ সচেতন। এবং তাঁহার খাদ্যাভ্যাস একেবারেই পৃথক। আমিষ আহারে তাঁহার একেবারেই
রূচি নাই। উপরন্তু রাত্রের আহার তিনি কেবল গোটাকতক ফল-মূল সমারোহে সমাধা করেন।
সর্বক্ষন দুশ্চিন্তা, তিনি হয়ত স্থুল হইয়া পড়িতেছেন। আমি অন্তত তার কোন লক্ষন দেখিনাই। বিবাহের পর
রাত্রে রন্ধনের পাঠ উঠিয়া গিয়াছে। দিবা ভাগেও অবস্থা তথৈবচ। ঘৃতের সহিত তন্ডুল
নতুবা দুগ্ধ ও কদলী। ইদানিং ইহাদের নাম শুনিলেই আমার ক্ষুধা অন্তর্হিত হয়। কেবল
চোখের সম্মুখে ভাসিয়া ওঠে সরিষার তৈলে ভর্জিত মৎস খন্ড, কিম্বা শূল্য পক্ক অজ
নতুবা কুক্কুট মাংসের সুবাস নাসিকায় খেলিয়া বেড়ায়। কিয়দ্দিবস পূর্বে এক সহকর্মির
গৃহে নিমন্ত্রন রক্ষা করিতে গিয়াছিলাম। তিনি বহুকাল পরে পাটুলিপুত্রে ফিরিয়াছিলেন।
সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে বিপাশা ও চন্দ্রভাগা নদীর মধ্যবর্তি অঞ্চলে
তিনি কোন এক সামরিক নির্মানকার্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন। হাসিতে হাসিতে সেই কাহিনীই
তিনি শুনাইতেছিলেন। অকস্মাৎ ভৃত্য একখানি বৃহৎ বারকোশ আনিয়া সম্মুখে রাখিল।
প্রথমটা বুঝিতে পারিনাই, পরে মনে হইল, বারকোশের উপরে অপূর্ব সুবাস নির্গত করিতেছে যাহা, তাহা বোধহয় আস্ত কুক্কুট, কোন কৌশলে ইহাকে
শূল্যপক্ক্য করা হইয়াছে। মুখে পুরিতেই মনে হইল, উহা যেন গলিয়া যাইতেছে। এরূপ সুপক্ক অথচ মুখোরোচক পদ এর পূর্বে খাইয়াছি বলিয়া
মনে পড়িলনা। বন্ধুবরকে ইহা বলিতে তিনি রহস্য ভাঙ্গিলেন। পঞ্চনদ অঞ্চলে এই খাদ্যের
প্রচলন খুব বেশি। তিনি ওই দেশে থাকাকালিন ইহার প্রেমে মশগুল হইয়া পড়েন, এবং আসিবার সময়, একখানি তদ্দেশীয় পাচক
সঙ্গে আনিয়াছেন। শুধু পাচকেই হয়নাই, ইহার জন্য এক প্রকার বিশেষ চুল্লির ও প্রয়োজন। বন্ধুবর সেটিও সঙ্গে আনিয়াছেন।
ভাবিয়াছিলাম
আস্ত কুক্কুট উদরস্ত করিব, কিন্তু মেধা বাধ সাধিলেন। অন্তপুর অকস্মাৎ মেধার বার্তা সমেত এক ভৃত্যের আগমন
হইল। বার্তায় সাবধান বানী, আমি যেন অতিরিক্ত আমিষ আহার না করি, আমার স্বাস্থ্য লইয়া তিনি বড়ই চিন্তায় পড়িয়া যান। ইহার পর সম্মুখের লোকজনের
প্রতি এক খানি দন্তবিকশিত হাসি বিতরন করিয়া হাত গুটাইয়া লইলাম। মানসপটে অশ্লীল
শব্দ ঘোরাফেরা করিতেছিল। কিন্তু গৃহে প্রত্যাবর্তন কালে বা তাহার ও পরে, ঘুনাক্ষরেও প্রকাশ
করিনাই। না জানি আরো কি বিপদ ঊপস্থিত হয়। কিন্তু গৃহে আরো বিপত্তি অপেক্ষা
করিয়াছিল। মেধা বলিলেন আমিষভোজী মানুষের গাত্র হইতে একপ্রকার দুর্গন্ধ নির্গত হয়, যাহা তিনি এক শয্যায় শুইয়া
সহ্য করিতে পারিবেন না। আমাকে স্নান করিতে হইবে। সময়টা শীত কাল, উপরন্তু ইঁদারার জল।
পরবর্তি এক পক্ষকাল জ্বরে শয্যাশায়ী রহিলাম। বৈদ্যরাজ আসিয়া ঔষধ ও পথ্য বাবদ মোটা
রকম চোট দিয়া গেলেন। মানসিক অবস্থার চিকিৎসার কথা আর ভাবিনাই।
অভিসারে
অভিসার
কথাটির সর্বাধিক ব্যবহার, কালিদাস নাকি বাৎসায়ন, কে করিয়াছেন সে নিয়ে বিতর্ক চলিতে পারে, কিন্তু ইঁহারা দুই জনেই আমাকে বিষম বিপদে ফেলিয়াছেন। কালিদাস এবং বাৎসায়নের
সম্পূর্ণ রচনা মেধা পাঠ করিয়াছেন, এবং সেই অভুতপূর্ব ঘুর্নাবর্ত হইতে নিস্ক্রান্ত হইতে পারেন নাই। প্রেম এবং
রমনের প্রতিটি পদক্ষেপে এই দুই লেখকের অনুসরন করিতে চান, আর আমি পড়িয়া যাই
সমস্যায়। প্রেম নিবেদন, যদিচ শেষ কয় মাসে কখনো করিয়া থাকি, তার প্রত্যুত্তরে মেধা সর্বদাই কালিদাসের উপমা আনিয়া হাজির করিয়াছেন। আমার
সমস্যা হইল, আমি সামান্য মজুর খাটানো
বাস্তুকার। এমত উচ্চস্তরের সাহিত্যের সহিত আমার পরিচয় নামমাত্র। আমি উহার উত্তরে
কথা খুঁজিয়া পাই না। প্রত্যুত্তর না পাওয়ায় মেধা প্রেমে মজা পান না। আমি নেহাতই
সাধারন নাগরিকের ন্যায় আপন প্রেম নিবেদন করিতে গিয়া বার বার “হাঁদা”,”ক্যাবলা”,”মুখ্যু” ইত্যাদি বিশেষনে ভুষিত
হইয়াছি। পাটুলিপুত্রে আমার মিত্রকূলের সহিত মেধার পরিচয় করাইয়া দিয়াছিলাম বিবাহের
অব্যবহিত পরই। তাঁহাদের মধ্যে এক মিত্রের সহিত মেধার ধাতে মিলিত, কারন এই মিত্র অর্থাৎ
রাঘব বর্মার ও সাহিত্য লইয়া চর্চা করিবার অভ্যাস ছিল। রাঘব কে আমি বিশেষ পছন্দ
করিতাম এমন নহে, কিন্তু যে মিত্রবর্গের
সহিত আমি মিশিতাম, রাঘবও সেখানে আসিত, অতএব উহাকে বাদ দিতে হইলে সমগ্র কূলটিকেই ত্যাগ করিতে হইত। কিন্তু যখন দেখিতাম
সকলের সম্মুখে কোন এক দুর্বোদ্ধ সাহিত্যিক রসিকতায় রাঘব এবং মেধা এক ই সঙ্গে
হাসিয়া উঠিয়াছে, তখন ই আমার মনে হইত
দাসীপুত্রটাকে সকলের সম্মুখে পাদূকা খুলিয়া প্রহার করি। মসীজীবি শয়তানটা আমার সহিত
আঁটিয়া উঠিবেনা। কিন্তু প্রতিবারেই আত্মসংবরন করিয়াছি। বাকি কথা বলিতে সংকোচ হয়।
বাৎসায়নের রচিত অসংখ্য মুদ্রা ও ভঙ্গীর অনুকরন করিতে গিয়া কখনো সপ্তাহকাল পৃষ্ঠ
নতুবা কোমরের যন্ত্রনায় কাতর রহিয়াছি, কখনো বা কোন অঙ্গ মচকাইয়া লাঠি হস্তে কার্য্যে হাজিরা দিয়াছি। তদুপরি শুনিতে
হইয়াছে, আমি কোনক্রমেই রতীকুশল
নই। অথচ আমার নিজস্ব বিশ্বাস, সুস্থ স্বাভাবিক ক্রিয়ায় আমার উৎসাহ ও নৈপুন্য, দুই রহিয়াছে। মেধা কিয়ৎকাল আমাকে বাৎসায়ন রচিত “কামসূত্র” পাঠ করাইয়াছেন, কিন্তু উহার পর, যাহা করিতে হইয়াছে, উহা প্রায়সই এত
বেদনাদায়ক, যে পরবর্তীকালে পুঁথিটি
দেখিবামাত্র আমার কাম অন্তর্হিত হইয়া যায়, এবং ভীতির উদ্রেক হয়। হায় ঋষি বাৎসায়ন, কি রচনার কি পরিণতি।
রাঘব
ব্যাতীত আরো কয়েকটি নটবর মিত্র রহিয়াছে, যাহারা মেধার ছলাকলার বিশেষ ভক্ত। উহাদের লইয়া সমস্যা দিন দিন বাড়িতেছে। অনুভব
করি, মেধার উপস্থিতি কেবল
মাত্র আমার ক্ষুদ্র জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নাই। তাহা দ্রুতগতিতে পাটুলিপুত্রের
বৃহত্তর নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করিতেছে। এমত অবস্থায় বড় অসহায় লাগে। মনে হয়, আমি যেন এক নিমিত্ত
মাত্র। এমত অবস্থা বোধকরি আমার স্থলে অন্য কেহ থাকিলেও হইত। মহাকবি এবং মহাঋষি
সম্ভবতঃ এমত অবস্থা কল্পনা করেন নাই। তাঁহাদের লেখা কেবল মাত্র প্রেমিক-প্রেমিকাকে
লইয়া। কিন্তু এস্থলে, প্রত্যাখ্যাত পতি কে লইয়া কাব্য রচনা করিতে কেহ উৎসাহ পান না। দিনে দিনে মেধার
প্রভাব যতই বাড়িতেছে, ততই আমি হতাশ হইয়া পড়িতেছি। ইদানিং আমার অবস্থা কিয়ৎপরিমানে গৃহের আসবাবপত্রের
ন্যায় হইয়া পড়িয়াছে। অবস্থান রহিয়াছে, কারন তাহা অভ্যাস, কিন্তু মননে স্থান প্রায় নাই বলিলেই চলে।
দ্বিধা ও দ্বন্দ
মেধার
সহিত পাটুলিপুত্রের নাগরিক সমাজের যোগসূত্র সুদৃঢ় হইয়াছে। তিনি নগরের অন্যতম
ব্যস্ত নাগরিকা। অবশ্য নাগরিকা বলিতে কেহ যেন প্রচলিত অর্থে না ধরিয়া লন। আমি কেবল
অধিবাসী অর্থে ব্যবহার করিতে চাহিয়াছিলাম। তিনি নাগরিকগনকে লইয়া দল পাকাইয়াছেন, ইহা বুঝিতে অসুবিধা হয়
না। পূরুষ ব্যাতিত মেধার সহিত, অনুরাধা, মমতা, অপর্না নাম্নি নাগরিক
সমাজের স্বনাম ধন্য মহিলারাও যোগ দিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার উদ্দেশ্য লইয়া বহুকাল
কিঞ্চিত ধন্ধে রহিয়াছিলাম। কেননা উহাদের সাহিত্য বাসরই হউক, অথবা আলোচনা চক্র, নিজগৃহে কখনো মেধাকে
আয়োজন করিতে দেখিনাই। দেখিয়াছি আয়োজকগন শকট প্রেরন করেন, মেধা চলিয়া যান। প্রথম
প্রথম আমাকেও আসিতে বলিতেন, এখন বোধ হয়, সে নেহাতই ভদ্রতার
খাতিরে। মেধার সহচরগনের কানাঘুষায় শুনিতে পাইলাম, পাটুলিপুত্রের আনাচে কানাচে প্রবল অসন্তোষ জমা হইয়াছে। কিসের অসন্তোষ, কেন জমা হইল, ইত্যাদি বুঝিলাম না। তবে
শুনিলাম সম্রাটের কিছু কিছু কার্য্যকলাপ নাকি উহাদের মনে ধরিতেছে না। আমার ক্ষুদ্র
বুদ্ধিতে ইহার পরিমাপ করার চেষ্টা বাতুলতা, তাই বৃথা কালক্ষেপ করিনা।
কার্য্যপলক্ষ্যে
আমাকে পক্ষকালের নিমিত্ত শোনপুর যাইতে হইয়াছিল। এই স্থল পাটুলিপুত্রের উত্তরে
অশ্বপৃষ্ঠে অর্ধদিবসের পথ। পথিমধ্যে খেয়ায় গঙ্গা পার হইতে হয়। সম্রাটের আদেশে এই
স্থলে একখানি স্থায়ী পান্থাবাস নির্মিত হইবে। প্রতি বৎসর এই স্থলে এক বৃহৎ পশু
ক্রয়-বিক্রয়ের মেলা বসে। স্থায়ী পান্থাবাস এবং শুল্ক আদায়ের রাজকর্মচারীদিগের আবাস
নির্মিত হইলে কর বাবদ আয় বহুগুন বাড়িয়া যাইবার সম্ভাবনা। শুধু তাহাই নহে, শোনপুর এর নিকটে এক
গুচ্ছ নদ – নদী একত্রে মিলিত হইয়াছে। উত্তরের পথে পাটুলিপুত্র পৌঁছিবার পথ হিসাবে এই স্থল
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। তাই ইহার যথেষ্ট পরিমান সামরিক গুরুত্বও রহিয়াছে। হয়ত এইস্থলে
এইরূপ নির্মানকার্য্যের পশ্চাতে সেই ভাবনাও হয়ত থাকিবে। পান্থাবাসকে বিনা আয়াসেই
স্কন্ধাবারে পরিনত করা যাইতে পারে। এমত নির্মানকার্য্যের নিমিত্ত প্রাথমিক ভাবে
স্থান চিহ্নিত করিয়া রাজকীয় ফরমান জারি করা হইয়াছে। আমার ভূমিকা, প্রাথমিক ভাবে জমি জরিপ
করিয়া নির্মানকার্য্য যত শীঘ্র সম্ভব আরম্ভ করা। পক্ষকাল পরে পাটূলিপুত্রে
প্রত্যাবর্তন করিলাম। আপাতত এক মাসের কিছু অধিক গৃহে থাকিতে পারিব। কিন্তু তাহার
পর ফিরিতে হইবে শোনপুরে।
গৃহে
ফিরিয়া দুগ্ধ ও কদলীর সহিত তন্ডুল লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছি। আহারে মন নাই। কেবলই মনে
পড়িতেছে অস্থায়ি শিবিরের পাচকের হস্তের স্থূল রোটিকা কিম্বা পুরোডাশ এবং শূল্যপক্ক
অজ মাংসের স্বাদ। মেধা সহসা জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি শোনপুরে কোন কার্য্যপোলক্ষ্যে গিয়াছিলাম। আমি বিস্মিত হইলাম। কেননা, ইতিপূর্বে কখনো তিনি
আমার কার্য্য লইয়া ঔৎসুক্য প্রকাশ করেন নাই। যাহা হউক, আমি বিস্তারিত ভাবে মেধা
কে পরিকল্পনা বুঝাইলাম। মেধা মন দিয়া শুনিলেন। শেষে প্রশ্ন করিলেন, যাহারা ওই স্থলের
অধিবাসী, তাহারা কোথায় যাইবে।
বলিলাম, রাজকীয় ফরমান অনুযায়ি
উহারা এক বৎসরের গ্রাসাচ্ছাদনের নিমিত্ত রাজকোষ হইতে দুইশত কার্ষাপণ পাইবে। এবং
শোন নদীর কিনারে, তাহাদের গ্রামগুলির পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও রাজকীয় স্থাপত্য বিভাগের পরিকল্পনায়
রহিয়াছে। উপরন্তু, এমত বিশাল নির্মানকার্য্যে স্থানীয় অধিবাসীগন শ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত হইয়া কিছু
উপরি রোজগার ও করিতে পারেন, কেননা নির্মানকার্য্য শেষ হইতে প্রায় পাঁচ বৎসরের অধিক সময় লাগিবে। মেধা সহসা
ক্রোধ সংবরন করিতে পারিলেন না। তাঁর যুক্তিতে, সম্রাটের কোন অধিকার নাই, চাষিদের এইরূপে বাস্তুহারা করার। ইহার পর প্রায় অর্ধদিবস ধরিয়া মেধা আমাকে
বুঝাইয়া চলিলেন যে ইহা কি প্রকার অনৈতিক কার্য্য, এবং রাজা ইহার ফলে রাজধর্ম হইতে পতিত হইয়াছেন। মেধা এবং তাঁহার নাগরিক সমাজ
ইহার বিরুদ্ধে প্রজাকূল কে সচেতন করিবেন, এবং দরকার পড়িলে রাজাধীরাজ কে উচ্ছেদ করিবেন। যেমনটা চানক্য করিয়াছিলেন। আমি
হতবাক হইয়া রহিলাম। মেধা আমাকে এই কর্মে ব্যাপৃত হইতে বারংবার নিষেধ করিলেন, এবং বলিলেন, আমি এতদ্সত্বেও
কার্য্যে যোগ দেওয়া মনস্থ করিলে তাহার ফলাফল ভাল হইবে না।
তদবধি
মন অশান্ত হইয়াছে। মাসাধীক কাল কাটিয়াছে। ইতিমধ্যে আমার শোনপুরে ফিরিয়া যাইবার সময়
প্রায় আসিয়া গেল। কিন্তু যাহা লিখিয়া আখ্যান শুরু করিয়াছিলাম, পুনরায় সেই স্থলে ফিরিয়া
আসি। কিয়দ্দিবস হইল মেধা একদল নাগরিকের সহিত উত্তরে যাত্রা করিয়াছেন। যাইবার
পুর্বে অনুমতি বা স্রেফ বলিয়া যাইবার সৌজন্যটুকু ও দেখান নি। শুনিতে পাইয়াছি, উহারা শোনপুরের পথে
গিয়াছে। কানাঘুষায় শুনিতে পাই, স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দকে লইয়া তাহারা নির্মানকার্য্যে বিস্তর বাধা দিতেছে, এবং যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি
সাধন করিতেছে। রাজপ্রহরীদিগের মোকাবিলা করিতে জঙ্গল হইতে শবররা আসিয়াছে। আর্য্য
জাতির প্রতি স্বাভাবিক ভাবেই উহাদের জাতক্রোধ রহিয়াছে। উহাদের অস্ত্র ও শিক্ষা
যোগাইতেছে উত্তরের পাহাড়ি উপজাতিরা। কেননা শোনপুরের পশু মেলা বৃদ্ধি পাইলে, উহাদের ছোট খাটো পশু
বিক্রয়ের কেন্দ্রগুলি মার খাইবে, কারন, এক্ষনে মগধ তাহার পাওনা
শুল্ক আদায় করিয়া ছাড়িবে। উপরন্তু সাম্রায্য হিসাবে মগধের উপর উহাদের বিষ নজর
বহুকালের। মেধার সহিত এই দুই জাতির নৈকট্য সম্পর্কে পুর্ব হইতেই অবহিত থাকায় মনের
উপর চাপ আরো বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ফলস্বরূপ কর্মে মন নাই, এবং মুখ্যস্থপতির হুমকি
শুনিতে হইয়াছে। ইহার শেষ কোথায় ভাবিয়া পাইলাম না। আমার সংসার, কর্ম, দেশ আজ সব কিছু ছারখার
হইতে বসিয়াছে, অথচ আমার করিবার কিছুই
নাই। সম্রাট কি দেখিতে পাইতেছেন না?
উপসংহার
উপাখ্যান
পুর্ব অধ্যায়ে সমাপ্ত হইলেই ভাল হইত। কিন্তু মন হইল, এই উপাখ্যানের একখানি ক্ষুদ্র অথচ রোমাঞ্চকর উপসঙ্ঘার রহিয়াছে, যাহা এস্থলে লিপিবদ্ধ
করিয়া রাখিলে, ভবিষতের মানুষ তাহা হইতে
শিক্ষালাভ করিতে পারিবে। স্থানীয় অমাত্য, বিদ্রোহী নাগরিক, স্থানীয় কৃষক ও শবর দিগের সহিত আলোচনা করিয়া বিরোধ মিটাইয়া ফেলিতে চাহেন।
বিদ্রোহীরা রাজি হন নাই। তাঁহাদের একমাত্র দাবী, এই প্রকল্প বাতিল করিতে হইবে। স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দের মাঝে বিদ্রোহীদের পক্ষ
হইতে এরূপ বার্তা প্রচার করা হইয়াছিল, যে, এই পশুমেলা উপলক্ষে দেশ
বিদেশের ব্যবসায়ীগনের আগমন ঘটিবে, পারস্য, তূরান হইতে ম্লেচ্ছ
অশ্বব্যবসায়ীগন আসিবে অধিক সংখ্যায়, ফলে, স্থানীয় সনাতন ধর্মাচরন
রসাতলে যাইবে। এরূপ যুক্তিহীন আরো বহু উপায়ে লোক ক্ষেপানো হইয়াছিল। ক্রমশঃ অবস্থা
স্থানীয় অমাত্যের আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া গেল। এমতাবস্থায় স্বয়ং সম্রাট আসরে
নামিলেন। প্রথমে বিদ্রোহীদের নিকট সন্ধি আলোচনার প্রস্তাব পাঠাইলেন। ইহাই তাঁহার
চাল, সেকথা মূঢ় বিদ্রোহী
নেতৃবৃন্দ, যাহার মধ্যে মেধা ও
রহিয়াছেন, তাহারা বুঝিলনা, ও প্রত্যাখ্যান করিল।
ইহা, পূর্বানুমানের ভিত্তিতে
সম্রাট স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে সন্ধির কথা প্রচার করিয়া দিয়াছিলেন। এমতাবস্থায়
পিছোবার পথ নাই। সম্রাট সসৈন্যে অবতীর্ন হইলেন। একদিকে তাঁহার হস্তিবাহিনি
শবরদিগের দফা-রফা করিল, অন্য দিকে ভোজপূর অঞ্চলের কোতোয়ালগন, তেল চুকচুকে বংশ দন্ড দ্বারা স্থানীয় অনিচ্ছুকদিগকে (শেষ পর্য্যন্ত যাহারা
অবশিষ্ট ছিল, কারন অধিকতর, রনে ভঙ্গ দিয়াছিল, অথবা দুইশত কার্ষাপণ এবং
শোন নদীর তীরে জমি লইতে রাজি ছিল) উত্তম মধ্যম দিয় ভাগাইল। বাকি রহিল কেবল মেধা ও
তাহার নাগরিক বন্ধু বান্ধব। সম্রাটের আদেশানুসারে তাহারা রাজকীয় হস্তী ও অশ্বশালার
পর্বতপ্রমান পূরীষ পরিষ্করনের কার্য্যে নিযুক্ত হইল। শোনপুরে, যখন মেলা বসিবে, আদেসানুশারে, তাহারা সেই স্থলের
পশুদের পূরীষ ও পরিষ্করনের জন্য ব্যবহৃত হইবে। মেধার সহিত আর আমার দেখা হয় নাই।
তবে শুনিয়াছি তাহার শাস্তির পঞ্চম বৎসরে তাহাকে হস্তিশালার এক চোল দেশীয় মাহুতের
পছন্দ হওয়াতে বিবাহ করিয়াছে। ইহাও শুনিতে পাইয়াছিলাম, বিবাহ নাকি রাক্ষস মতে
হইয়াছে, কারন মেধার সম্মতি ছিলনা।
পরিশেষে
জানাই, পঞ্চনদের সেই শূল্যপক্ক
কুক্কুটের প্রেমে মশগূল হইয়া আমি সেই পূর্বকথিত মিত্রের বাটিতে যাতায়াত বাড়াইয়া
দিয়াছিলাম। কিয়দ্দিবস পরে, বন্ধু পাচকটিকে ডাকিয়া আনিয়া আলাপ করইয়া দিয়াছিলেন। পাচক নহে, পাচিকা। চারি চক্ষুর
মিলন হইয়াছিল। আর দেরি করি নাই। কয়েক মাসের পর বিবাহ করিয়াছি। চুল্লিখানি বন্ধুবর
যৌতুক হিসাবে দিয়াছেন। কূলোকে কূকথা কহে। বোধ করি তাহা শূল্যপক্ক কুক্কুটের
নিমিত্ত ইর্ষা। পরিশেষে জানাই, আমি সংসার ধর্ম পালন করিয়াছি, রাজা পালন করিয়াছেন রাজধর্ম। ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়া এই ঊপাখ্যান লিপিবদ্ধ করিয়া
রাখিলাম। আশা করিব, রাজারা খেয়াল রাখিবেন।
টুকরো স্মৃতি – ৭
[অপ্রকাশিত]
খুব কম জায়গায় ঘুরেছি এমন নয়। এই জীবনে, দেখেছি খুব বেশী না হলেও নেহাত কমও নয়। তবুও স্মৃতিচারন করতে বসলে কিছু স্মৃতি ঘুরে ফিরে বার বার আসে। হয়ত সে সব স্মৃতি খুব লম্বা সময়ের নয়। হয়ত খুব বেশী গুরুত্বপুর্ণ ছাপ ফেলেনি আমার জীবনে। তবুও তারা মনে থেকে গেছে, কোন এক অজানা কারনে। ছোটবেলায় একবার বাবা মায়ের সঙ্গে দুর্গাপুর থেকে হাওড়া আসছিলাম ট্রেনে। বোধহয় ক্লাস থ্রি কি ফোর হবে তখন আমার।
টুকরো স্মৃতি – ৬
[রচনাকাল ২০০৯]
আর বলবেন না, কি যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিনা। জুলাই এর শেষ। গড়িমসি করে হলেও শেষমেষ মাথার ওপর ঘন কালো মেঘ ঘুর ঘুর করছে। মনটা উড়ু উড়ু। কিন্তু গড়ের মাঠে এখনো বল গড়াচ্ছেনা। দিন গুলো কেমন যেন পানসে লাগছে। এই সময়টায় তো কলকাতা লীগের প্রথমদিকের খেলা বেশ কয়েকটা হয়ে যাওয়ার কথা। খবরের কাগজের পেছনের পাতায় কাগুজে হিসেব নিকেস, বড় দলের সমর্থকদের পয়েন্ট হারানোর চিন্তা, ছোট দলের ডিফেন্ডারের মরিয়া লড়াই, নবীন স্ট্রাইকারের নিজেকে ছাপিয়ে গিয়ে ম্যাচ রিপোর্টে নিজের জায়গা করে নেওয়া।
টুকরো স্মৃতি – ৫
দেড় মাস আগে আইলা যখন চইলা গেলো আমাদের রাজ্যপাট তছনচ করে দিয়ে, আলিপুরি ফতোয়া জারি হলো – “বর্ষা আইলা রে”। কিন্তু কোথায় কি? ছাতা খুলতেই হলো রাস্তায় নামতে গিয়ে, কিন্তু বৃষ্টির জন্য নয়। আলী সাহেব নামখানা খাসা দিয়ে গেছেন, “ধুপছায়া”। আমি শুধু একটু অন্য অর্থে লাগাতে চাইলুম। আলিপুরি ফতোয়া মানতে দেখা গেলো মৌসুমি বায়ুর ঘন্টা, কচু, কলা। লালদীঘির পাড়ে খোদ লালবাড়ির ফতোয়াও তো আজকাল দেখি বিবাদী বাগ মিনিবাস স্ট্যান্ড পেরোয় না। আলিপুর তো কোন ছার। মুখ ঘোরালুম দক্ষিনে, কিন্তু কালিঘাটের মানতও কাজ করল না (যা মন চায়, তাই মানে করুন, ওটা আপনার ওপরে ছাড়লুম)। মৌসুমি বায়ু আপন মনে নিকোবর না কোনচুলোয় যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। খোদার খামোখা একটা পুঁচকে রাজ্যের লোকজনের ফতোয়া মানতে তার বয়ে গেছে। আর আমরা তাবৎ বঙ্গবাসী ভাজা ভাজা হতে থাকলুম। দিন গেল, সপ্তাহ গেল। তাবৎ টিভি চ্যানেল এবং খবরের কাগজের আবহাওয়ার সবরকম ভবিষ্যৎবানীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঠাঠা রোদ্দুর বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে লাগল। যেন ও লীগের প্রথম বড় ম্যাচে আমাদের দু – গোলে হারিয়েছে। এই করে করে সবাই যখন আশা ছেড়ে দিয়েছে একেবারে, সেই সময় তিনি এলেন। প্রথমে অল্প হাওয়া। পরে হাল্কা মেঘ। শেষ রাত্রে টিপির টিপির ইলশে গুঁড়ি। “পড়েছে”, “পড়েছে”। কিন্তু ওই। আবার দু দিন গেল। আবার একটু। এই করে করে শেষটায় খরা ঘোষণা হয় হয়, এমন সময় হুড়মুড়িয়ে বর্ষা এসে ঢুকলো। ভারি ভালো লাগলো। পাড়ার বাজার ওয়ালা, বাসের কন্ডাকটর, সেমি কন্ডাক্টর (ওই যে যিনি দরজা গোড়ায় ঝোলেন, আর হাঁকডাকের ঠেলায় হৃদ্কম্প তোলেন), অটো চালক, চায়ের দোকান, আমাদের অফিসের ফিন্যান্স আর অ্যাডমিনের লোকজন, বস, বসের বস (তাঁর ওপরের জন চেন্নাইতে, কাজেই বঙ্গের বর্ষা তাঁর নাগাল পায়নি) সবারই মেজাজ অনেকটা মোলায়েম হয়ে পড়লো। লোকে এই সময় একটু ভাবুক হয়ে পড়ে। বছরের এই সময়টায় বাঙালিরা কবিতাও লেখে বেশি, খোঁজ নিয়ে দেখবেন। আমিও বাঙালি। ভাবুক তো হতে হয় আমাকেও। তাই ভাবলুম। আর ভাবতে গিয়ে যা মনে এলো, সেইটে নিচে ঝট পট লিখে দিলুম। এইটা ছাড়া আর ভেবেছি ইলিশ মাছ নিয়ে, সে গপ্পো আর একদিন হবে খন।
৯৯ সালের কথা।তখন আমি চাকরি সূত্রে নাগপুরে। ঠিক নাগপুরেও না। সেখান থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে একটা কয়লা খনিতে থাকি। সে বছর ওই সব অঞ্চলে বর্ষা হচ্ছিল জব্বর। থাকতুম এক্কেবারে জঙ্গলের মধ্যে (টুকরো স্মৃতি ২ আর ৩ দেখতে পারেন)। বর্ষায় জঙ্গলের সবুজ যে কি অপরূপ হতে পারে, না দেখলে ধারনা করা যায় না। যাই হোক, এর মধ্যে একদিন কাজের সূত্রে অন্য আর একটা খনিতে যাবার হুকুম হলো। সে খনি কাছাকাছি তো নয়ই, এমন কি মহারাষ্ট্রেও নয়। যেতে হবে মধ্যপ্রদেশ। ছিন্দোয়ারা থেকে ভিমভেঠকা (আসলে ভিমের বৈঠক বা বৈঠকখানা, এখানে এলে প্রাগৈতিহাসীক গূহাচিত্র দেখতে পেতে পারেন, আলতামিরা যাবার দরকার নেই) যাবার রাস্তায় পারাসিয়ার কাছে পেঞ্চ নামে একটা খনি আছে, যেতে হবে সেখানে। নাগপুর থেকে সক্কাল সক্কাল বাস ধরতে পারলে বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাওয়া যায়। এর আগেও একবার গেছি ও রাস্তায়। তবে সেবারে সঙ্গে ছিলো গাড়ী, আর এবারে যেতে হবে নিজেকে। খনির অফিসে জিজ্ঞেস করে জানা গেল শনিবার ভোর বেলায় কিছু লোকজন একটা জিপ গাড়ী নিয়ে নাগপুর যাবে। তারা আবার ওই রাস্তাতেই যাবে। ছুটি তে বাড়ি ফিরবে। শুনে ভরষা হলো। একেবারে একলা যাওয়াটা একটু কেমন যেন লাগছিলো।
শনিবার ভোরবেলা যাত্রা শুরু হলো। একটা জিপগাড়িতে ঠাসাঠাসি করে বসেছি অনেকে। যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে একজন কে আগে থাকতেই চিনতুম। অল্প আলাপ ছিল। নকুল কাওয়ারে। সবাই কাওয়ারে বলেই ডাকতো। লোকটি বেশ রসিক, তবে কিঞ্চিত রগচটা। রাত থাকতেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। ভোরবেলাতেও তার বিরাম নেই। ছাতা সত্ত্বেও আধভেজা হয়ে জিপে উঠলুম। রাস্তাটি ভারি সুন্দর। ঝকঝকে মসৃন। কোথাও এতটুকু খানাখন্দ নেই। শুনেছিলাম বিশ্বব্যাঙ্কের খয়রাতির টাকায় তৈরি। এমন রাস্তা ধরে নাগপুর আসতে সময় লাগতো এক ঘণ্টার কিছু বেশি। যাইহোক, গাড়িতে বেশি কথাবার্তা বলছিলোনা কেউ। রাত্রের ঘুমের রেশটুকু রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করার এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হতে পারে কি? নাহয় হলোই একটা জিপে ১২ জন সওয়ার আর থাকলোই অসংখ্য বাক্স-প্যাঁটরা-তোরঙ্গ-পুঁটুলি কোল আর ঘাড়ের ওপর গোঁজ হয়ে।
নাগপুরে নেমে তাড়াতাড়ি করে গেলুম বাসের টিকিট কাটতে। কাওয়ারে বলল, আমি যেন ওর মালপত্রগুলো একটু দেখি, ও টিকিট কেটে আনছে।এদিকে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। নাগপুরের এই বাসস্ট্যান্ডটা বেশ বড়ো, আর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। সাধারনত বৃষ্টি পড়লে বাসস্ট্যান্ড বা রেলের স্টেশনগুলোর অবস্থা আমাদের দেশে খুব খারাপ হয়। কিন্তু এখানে দেখলুম সেরকম কিছু হয়নি। হয়ত কাকভোর বলেই। মধ্যপ্রদেশ রাজ্য পরিবহন নিগমের সাদা রঙের বাসে উঠে বসা গেল। জানলার ধারে সিট পেয়েছি। পাশে বসলেন কাওয়ারে। আর তার পাশে কাওয়ারের স্ত্রি। আর উল্টোদিকের আসনে কাওয়ারের ছেলে সচিন আর মেয়ে সোনালি। বছর ১০ – ১২ বয়স দুজনের। ভোরের ধাক্কাটা কেটে যাবার পরেই, গোটা রাস্তা দুজনে বিদর্ভের ঝোলে চোবানো মারাঠিতে কলকল করতে করতে গেছে। কাওয়ারে এই ভোর বেলা কোথা থেকে যেন বেশ বড় এক কাঁদি কলা নিয়ে এসেছে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। কাঁদি। এক ডজন বা এক ছড়া কলা নয়। পুরো গোটা একটা কাঁদি। নাগপুরে কলা সস্তা। মনে আছে ওই সময়ে ৩ টাকায় এক ডজন কিনেছি। আর দারুন পুরুষ্টু লম্বা লম্বা কলা। সবুজ নয়, হলদে রঙ। খুব ভালো জাতের। কিন্তু তাই বলে এক কাঁদি?
বাস ছাড়লো। কাওয়ারে একটা করে কলা ছিঁড়ে পরিবারের সবার হাতে ধরালো। আমাকেও দিলো একটা। শেষ করতেই আবার একটা দিলো। সকালবেলা একদম খালি পেট, নিয়েও নিলুম। কিন্তু আবার গেরো, এটা শেষ করতেই সামনে হাজির তৃতীয় কলা। সেরেছে, ষোলোকলা পূর্ন না করে কি ছাড়বেনা লোকটা? একটু কিন্তু কিন্তু করে এটাও নিলুম। খোসা ফেলার ব্যাপারে দেখলুম কাওয়ারে নির্বিকার। বাসের জানলা গলিয়ে টুপ টাপ ফেলে যাচ্ছে রাস্তায়। তিন খানা কলার খোসা ধরে বসে থাকা যায়না। আমিও কাওয়ারের পদাঙ্ক অনুসরন করলুম। সঙ্গে সঙ্গে সামনে হাজির চতুর্থ কলা। এবারে কিছু একটা বলতেই হয়।
- থাক্, আর না।
- আরে নাও নাও, লজ্জা পাবার কিছু নেই।
- তিনটে তো খেলাম।
- তাতে কি?
- কত খাবো আর?
- চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখো। নাগপুরে কলা সস্তা এখানে সবাই এরকম কলা খায়। দেখছোনা, সবাই কিনেছে?
বাস্তবিকই তাই। এক কাঁদি না হলেও দেখলুম সবার হাতেই কলার ছড়া। আর কেমন যেন আনমনে লোকজন টুপ্টাপ করে কলা খেয়ে চলেছে। কাওয়ারের পাশ থেকে মৃদুকন্ঠে মন্তব্য এলো –
- এর পরে বাস থামবে সেই সাওসর এ। দেরি আছে। কিছু খেয়ে নিলে তো ভালোই।
পেছনের সিটে বসেছেন এক দশাসই ফৌজি অফিসার। হাসতে হাসতে উপদেশ দিলেন
- হাতের বস্তু ঠেলবেন না। কে জানে, ভগবান কখন আবার দয়া করবেন।
ফৌজি অফিসারের পাশে বসেছিলেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। সাদা পাজামা কুর্তা (একেবারে দুধ সাদা নয়, কাচার পরে মনে হয়, একটু বেশী নীল দেওয়া হয়েছিলো), মাথায় গান্ধী টুপি। গালে বেশ একটা গালপাট্টা গোঁফ। গলার আওয়াজ শুনে মনে হল, ইনি বোধহয় ওস্তাদী গান টান করেন। বেশ গুরুগম্ভীর আর ওজনদার গলা –
- এ আর কি কলা দেখছেন? উমরেড় রোড ধরে যান, দেখবেন কলার খেত শুরু হয়েছে। বিশ কিলোমিটার দু দিকে শুধু কলার খেত। সেই কলা খেলে বুঝবেন কি স্বাদ।
কাওয়ারে বলল,
- সে কলা পাবো কোথা থেকে? শুনেছি সেগুলো সব বিদেশে চালান যায়।
- না না, এখানের বাজারেও আসে। আমার নিজেরই খেত আছে।
কথায় কথায় নাগপুরের চৌহদ্দি পেরিয়ে বাস হাইওয়ে ধরেছে। ৬৯ নম্বর জাতীয় সড়ক। এই সড়ক ধরে সাওসর পর্যন্ত গিয়ে বাস মহারাষ্ট্র থেকে মধ্যপ্রদেশের ভেতর ঢুকবে। বেলা প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ সাওসর এলো। সবাই নামলো বাস থেকে। সামনেই চা এর দোকান। বসা হলো সবাই মিলে। বৃষ্টি কিছুটা ধরেছে। কাওয়ারে বলল এই আবহাওয়ায় এক কাপ “কড়ক” চা এর তুলনা হয় না। সঙ্গে সঙ্গে ফৌজি উত্তর
- সে যদি বলেন তো চা হতে হবে পাঞ্জাবের। সে চায়ে যেমন ঘন দুধ-মালাই, তেমনি কড়া লিকার। এক কাপ খেয়েছেন তো হাত পা ছুঁড়তে ইচ্ছে করবে।
- সে চায়ে কি আদা দিয়ে তারা এরকম ঝাঁঝ আনতে পারে?
-
বললেন ভুবনরাও দিঊয়েকর। নামটা জেনেছি ততক্ষনে। ফৌজি হার মানতে নারাজ।
- পাঞ্জাবী চায়ে আদা দেয় না বলছেন? আর আদা দিলেই ভালো চা হলো? এই যে, এনাকে জিজ্ঞেস করুন না, এনাদের চায়ে দুধ,চিনি সবই কম কম, লিকার ও পাতলা। তবু সেই দার্জিলিং চাই হলো পৃথিবীর সেরা।
-
বলে আমার দিকে আঙ্গুল দেখালেন। মনে হলো সেনাবাহিনীর কাজের সূত্রে বহু জায়গা ঘুরেছেন মেজর এনায়েতুল্লা খান, আর সেই সূত্রে অভিজ্ঞতার ঝুলিটির আকার বেশ বড়। তাঁর নামটাও জেনেছি ততক্ষনে বুকে লেখা ধাতব ফলক থেকে।
- চা হলো, দিন ক্ষন আর আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করা পানীয়। ভেজা ভেজা দিনে এক রকম, শীতের সকালে আবার অন্য রকম। বিকেলে আবার আর এক রকম, কাজের ফাঁকে বা সন্ধ্যের আড্ডায় আবার আলাদা চা।
সবাই কে খুশী করতে চাই আমি। কথার সূত্র ধরে নিজের মত ব্যাখ্যা করলেন ভুবনরাও,
- দেখুন দেখুন, একদম ঠিক। যেমন দেশ, তেমনি চা। এখানে পাঞ্জাবের চা চলবে কেন? মেজর সাব কি পাঞ্জাবী? মনে তো হয় না।
- না না, আমি মধ্যপ্রদেশের লোক। আসল মেঁ হম্ ভোপাল সে হ্যাঁয়। এখন ছিন্দোয়াড়ার দিকে চলে এসেছি।
গরম গরম পকোড়া আর আলু গুণ্ডা নেওয়া হলো। আলু গুন্ডা আমাদের চেনা আলুর চপের মাসতুতো ভাই। শুধু একেবারে নিটোল গোল বলের মতো দেখতে, আর ভেতরের পুরে, রশুনের কিঞ্চিত আধিক্য। লঙ্কার কথা আর আলাদা করে বললুম না। ভারতবর্ষের যত অঞ্চলের রান্না খেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে, লঙ্কার ব্যবহারে বিদর্ভকে টেক্কা দিতে পারে, এমন অঞ্চল বোধহয় আর নেই। পকোড়া আর আলু গুন্ডার সঙ্গে চাটনি হিসেবে এলো টক দই, ওপরে লাল লঙ্কার গুঁড়ো ছড়ানো। একটা পকোড়ায় বেশ করে মাখিয়ে মুখে দিলুম, আর সটান দাঁড়িয়ে পড়লুম। না, ঝাল নয়, সেটাও ছিলো, তবে সহ্যসীমার বাইরে নয়। কিন্তু না বেরোনো আক্কেলদাঁত পর্যন্ত টকে গেলো, এমন টক দই। বাপরে বাপ। তার পরে আর কিছু মুখে তুলতে পারলুম না। এমন দাঁত সিরসির করতে লাগল। যদিও অভ্যস্ত তবুও বাকিদের দেখলুম অতি সাবধানে সামান্য একটু করে দইয়ের টাকনা দিয়ে খাচ্ছেন। তাও মাঝে মাঝে। শেষে বাস ছাড়ার পর কাওয়ারের পাশের সিট থেকে আরো খান দুয়েক কলা পাওয়া যেতে, সে যাত্রা কিছুটা সামলালুম।
বৃষ্টি এইবার ঝেঁপে এলো। সাওসর ছোট্ট শহর। বাস এবারে উত্তরের রাস্তা ধরলো। মহারাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে কিছু দূর এগোতেই দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করল। দু দিকের ধু ধু করা খেত খামার উধাও। সামনে পাহাড় দেখা দিলো সঙ্গে বেশ ঘন জঙ্গল। পাহাড়ি রাস্তায় বাস এঁকে বেঁকে চলছে। এটা আর হাইওয়ে নয়, তাই অনেক সরু রাস্তা, আর খানা-খন্দ ও রয়েছে বেশ। রাস্তায় গাড়ি একেবারেই কম। মহারাষ্ট্রের মধ্যে তবু রাস্তার ধারে ছোটো ছোটো অনেক গ্রাম দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু মধ্যপ্রদেশ পড়তেই লোকালয় উধাও। শুনলুম সামনেই কান্হান্ নদী, সেটা পেরলে কয়েক কিলোমিটারের ভেতরে পড়বে রামটেক। এবার মনে পড়ল, আগেরবার যাবার সময় এই রামটেকেই আমরা যাত্রা বিরতী নিয়েছিলুম। পাহাড়ের গায়ে আস্তে আস্তে বাসটা একটা বাঁক নিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল। একেবারে ঘন জঙ্গল চতুর্দিকে। এখানে দাঁড়ানোর কারন টা বুঝতে চেষ্টা করলুম। কাওয়ারে ঘুমোচ্ছিলো। বাস থামতে জেগে উঠে চোখ কচলাতে লাগলো। আমরা বসেছিলাম বাসের মাঝামাঝি। সামনের দিকের কয়েক জন কে তড়বড় করে বাস থেকে নামতে দেখলুম। মেজর খান ও দেখলাম ঊঠলেন। আমিও ঊঠলুম। দেখেই আসা যাক কি হলো। টায়ার ফাটেনি নিশ্চই। তাহলে তো আওয়াজ পেতুম।
বাস থেকে নামতেই ড্রাইভার সাহেব বাসের ইঞ্জিন বন্ধ করলেন। একটা অদ্ভুত জিনিষ খেয়াল করলুম, চারপাশটা কত নির্জন। কোনো শব্দ নেই। এত নির্জনতায় নিজেদের গলার আওয়াজটাই কেমন অচেনা লাগছিল। বাস থামিয়েছে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের দু জন গার্ড। প্রথমটা খাকি উর্দী দেখে মনে হয়েছিল পুলিস। কিন্তু পরে দেখা গেল এরা ফরেস্ট গার্ড। সামনে একটা সেতু, তলা দিয়ে কান্হান্ নদী বইছে। আর সেই নদী নিয়েই গন্ডগোল। নদী নাকি ফুলেছে। খেয়েছে, এ কি হাঁটু না লুচি? যে ফুলবে? গতবার যাবার সময় দেখেছিলুম ব্রীজের অনেক তলা দিয়ে বালির ওপর সরু চিক্চিকে রুপোলী রেখা। কয়েক পা সামনে গিয়ে যা দেখলুম, নিজের চক্ষেই বিশ্বাস করতে পারছিলুম না। কোথায় সেই বালির ওপরে সরু জলের রেখা? নদী বইছে ভীম বেগে। জল উঠে এসেছে ব্রীজের ওপর। ঘোলা জল আর ফেনা, তাতে ভেসে আসছে রাজ্যের গাছপালা, ডাল, কাঠকুটো ইত্যাদি। শুনলুম সারা রাত বৃষ্টি হওয়াতে নদীর এই হাল। বাস যাবেনা জল না নামলে। হয়ে গেল। শেষে এইখানে আটকে থাকতে হবে? ওদিকে যে জরুরি কাজে যাচ্ছি তার কি হবে? সঙ্গে বেশকিছু টাকাও রয়েছে, এক সহকর্মী কে দেবার জন্য। দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করলুম, কি কি করা যায়। সে সময়টা এখনকার মতো মোবাইল ফোনের যুগ নয়। কাজেই খবর দেওয়ার উপায় ও নেই কোন। কাওয়ারে বলল, বৃষ্টি থেমে গেলে কয়েক ঘণ্টায় জল নেমে যাবে। গত প্রায় ঘণ্টা খানেক বৃষ্টি হয়নি। একটু আশাতেই থাকলুম, হয়ত জল আস্তে আস্তে নামতে শুরু করবে কিছুক্ষনের মধ্যেই। একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নদীর জলোচ্ছাস দেখতে লাগলুম। এরকম জিনিষ আগে দেখিনি কখনো।
বেলা গড়িয়ে দুপুর হলো। খাবার দাবারের কোনো আশা নেই এখানে। অগত্যা চুপ চাপ বসে থাকা আর অপেক্ষা করা। মেজর সাহেব গল্প শোনাচ্ছিলেন অনেক। উপস্থিত আসছেন তিনি জম্মু থেকে। আসার পথে দিল্লি থেকে কেনাকাটা ক রেছেন। প্রায় আট মাস পরে ফিরছেন। নেহাত যৌথ পরিবার, তাই ছেলে মেয়েদের নিয়ে যান না। এখানে ওরা ভালো থাকে। বললেন
- প্রত্যেক বার বাড়িতে ফিরি আর দেখি ছেলে মেয়ে গুলোকে যেমনটা দেখে গিয়েছিলাম, তার চেয়ে কিছুটা পালটে গেছে। বড় হয়েছে, লম্বা হয়েছে। আর আমার বঊটা বুড়ি হয়েছে। আমাকেও নিশ্চই দেখে ওদের মনে হয় যে আমিও বুড়ো হচ্ছি।
- বুড়ো ভাব লেই বুড়ো। আমার তো পঞ্চান্ন হলো। এখনো খেতের কাজকর্ম নিজে করি। ব্যবসা নিজেই সামলাই। মেয়ের বিয়ে দেওয়া বাকি। নাতি নাতনীর মুখ দেখে তবে বুড়ো হব।
বললেন ভুবনরাও। বলেই হা হা করে হাসি। কাওয়ারে যোগ দিলো এবারে –
- আমি তো ভাবি আর কতদিন ওই খাদানে ডিঊটি দিতে হবে? কবে যে অবসর নিয়ে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচবো ?
আকাশ আবার ঘোর করে এলো। আমরা বাধ্য হয়ে বাসের মধ্যে আশ্রয় নিলুম। যা কিছু খাবারদাবার ছিলো, বাচ্চাদের খাওয়াতে লাগলো সকলে। কাওয়ারের কলার কাঁদি দেখলুম শেষ। এক জায়গায় বিরক্তিকর নিরুপায় অপেক্ষা। একটা সময়ে নেহাত নিরীহ আশপাশের লোকজন কে দেখেও অর্থহীন মাথা গরম হতে থাকে। মেজর খান দেখলুম ড্রাইভারের সঙ্গে আলোচনা করছেন যদি কোনো গতিকে বাসটাকে ব্রীজের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। বাসের আরো কয়েক জন দেখলুম মেজর খান কে সমর্থন ও করছেন। ড্রাইভার ও নিমরাজি। এদিকে বেচারা ফরেস্ট গার্ড দুজন কিছুতেই রাজি নয় এই অবস্থায় ব্রীজ পেরোতে দিতে। মেজাজ টা খিঁচড়ে গেলো। এই জঙ্গলের মধ্যে উপায়হীন ভাবে আটকে থাকা। খাবার দাবার মাথায় থাকুক, একটু জল পর্যন্ত নেই। ভাবলুম দেখি কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা। ফরেস্ট গার্ডদের জিজ্ঞেস করতে বলল, এখান থেকে তিন কিলোমিটার পেছনে গেলে একটা দু মাথার মোড় পড়বে। সেখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের জীপ আসে একটা বিকেল চারটে নাগাদ। সেই জিপে করে আর কিছু না হোক এই জঙ্গল থেকে বেরোনো যাবে। ভাবলুম যা থাকে কপালে, দেখি জিপ পাওয়া যায় কিনা। কাওয়ারে, মেজর আর ভুবনরাও এর কাছে বিদায় নিলুম। জোর কদমে হাঁটা লাগালুম। চল্লিশ মিনিটে আমাকে তিন কিলোমিটার রাস্তা পার হতে হবে, এদিকে বৃষ্টির বিরাম নেই। বাঁকের কাছে এসে বাসের দিকে তাকালুম। কাওয়ারের ছেলে আর মেয়ে জানলা দিয়ে হাত নাড়ছিলো। আমিও নাড়লুম। তারপর সামনে ফিরে চলা শুরু হলো।
বৃষ্টি আর ঘামে ভিজে দু মাথার মোড়ে পৌঁছলুম। দেখলুম একটা গুমটি দোকান। সেটার সামনে একজন তালা বন্ধ করছেন। জিজ্ঞেস করলুম, এখানে জীপ পাওয়া যাবে কিনা। বললুম বাস আটকে গেছে, আমি নিরুপায়। লোকটি আশ্বাস দিলো। বললো ও নাকি রোজই জীপেই ফেরে। জীপটা নাকি সাওসর অবধিই যাবে। বলতে বলতেই জীপ এলো। ড্রাইভারের পাশে একজন অফিসার গোছের কেউ বসে। তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলুম আমার অবস্থাটা। ভালো করে শুনলেন না। ইশারা করলেন পেছনে উঠে পড়তে। শুধু বলে দিলেন, সাওসর পৌঁছনোর পর আমার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে। আমি তাতেই রাজি। ঘন্টা দেড়েক পরে সাওসর বাসস্ট্যান্ডের সামনে আমাকে জীপ টা নামিয়ে দিলো। আগে এক বোতল জল কিনে খেলুম। সঙ্গে এক প্যাকেট বিস্কুট। হঠাৎ দেখি স্ট্যান্ড থেকে একটা বাস বেরোচ্ছে। সামনে লেখা নাগপুর। অভাবিত এই সৌভাগ্যে লাফিয়ে উঠলুম। চলন্ত বাসেই লাফিয়ে উঠলুম। বসার জায়গাও পেলুম একেবারে পেছনের সিটে। বাইরে তখন অন্ধকার নামছে। নাগপুর থেকে আমাকে যেতে হবে আরো ষাট কিলোমিটার।
সেই রাত্রে ঘরে পৌঁছলুম যখন, তখন ঘড়িতে বাজে পৌনে এগারোটা। খাবার দাবারের আশা ছিলোনা। কোনোক্রমে হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় গেলুম। পরের দিন ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো সাড়ে পাঁচটায়। আধঘণ্টায় তৈরি হয়ে বেরোলুম। আজ আমাকে পেঞ্চ পৌঁছতেই হবে। হাইওয়ে তে একটা দুরপাল্লার বাস কোনোগতিকে দাঁড় করিয়ে নাগপুর পৌঁছলুম। বাস টার্মিনাসে ঢোকার মুখেই একটা খবরের কাগজ কিনলুম। বাসে যেতে যেতে পড়বো বলে। ভাঁজ করে ব্যাগে রাখতে গিয়ে চোখ আটকে গেল প্রথম পাতায়। শিরোনামের খবর বলছে গতকাল সন্ধের সময় কান্হান্ নদী পেরোতে গিয়ে মধ্যপ্রদেশ রাজ্য পরিবহন নিগমের একটি বাস জলে ভেসে যায়। যাত্রিদের একজনকেও জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা যায়নি। বাসটি নাগপুর থেকে পারাসিয়া যাচ্ছিল।
- সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি
(
Atom
)