বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৪

ফোকর এবং ফুড়ুৎ - ১

অমন একটা ফাঁকা ফাঁকা গাঁ-গেরামে কেন যে মাঠের চাদ্দিকে অমন উঁচু পাঁচিল দেওয়া হয়েছিলো কে জানে বাপু। মাঠে ঢোকা বেরোনোয় অবিশ্যি কোনো বাধা বিপত্তি ছিলোনা। সেটা ছিলো সম্মিলনী ক্রিড়া চক্রের অঘোষিত মাঠ। আর আমরা ছিলাম সেই কেলাবের মেম্বার আর কর্মকর্তা। আমাদের ফুটবল টিমটা ছিলো বেড়ে। নরম নরম, ভিজে ভিজে দক্ষিন বঙ্গের সবুজ সবুজ মাঠ তো নয়, এ হলো রাঢ়ের পশ্চিম প্রান্তের পাথুরে লাল মাটি। কাঁকরে ভর্তি। স্লাইডিং ট্যাকেল করলে ছাল চামড়া উঠে আসতো। সবাই ভয় পেত অমন খেলতে, শুধু ভয় পায়নি পাডু।
আমাদের ডিপ ডিফেন্সের স্তম্ভ। নামটা কিঞ্চিত ইতালিয়ানো কিম্বা এসপ্যানিওল গোছের শুনতে লাগলেও, সে কিন্তু নিখাদ বাঙালি। ঠান্ডা মাথা, ফরসা টক্‌টকে রঙ, তাগড়া চেহারা নিয়ে ডিফেন্স সামলে দিতো একের পর এক খেলায়। প্র্যাকটিস খেলার সময়, আমি কখনো পেরোতে পারতাম না ওকে। ঠিক এসে পা থেকে টুকুস করে বল মেরে দিতো। মাঝে মাঝে এত অনায়াসে করত, প্রচন্ড রেগে যেতাম। মুখ বাঁচাতে ভান করতাম যেন এবড়ো খেবড়ো মাঠে পায়ে লেগেছে। তার পর মাঠের ধারে বসে পায়ের পরিচর্যা হতো কয়েক মিনিট। একটা বড় কাঠচাঁপা গাছ ছিলো, তার তলায় বসে পায়ে হাত বুলোতাম। পেছনেই ছিলো সেই ইঁটের পাঁচিল, আর তাতে একটা ফোকর। মাঠের বাকি সবাইকে ফাঁকি দিলেও, ফোকরটা সব দেখতো।
  • -   পায়ে লাগেনি তোর, ঢপ দিচ্ছিস সবাইকে
  • -   আরে না, সত্যি লাগল, বুড়ো আঙুল টা... ইয়ে...এই যে দেখ্‌
  • -   আবার ঢপ? আঙুল তো বলে লাগেনি, মাটিতেও না
  • -   না মানে...ওই যে...
  • -   অমন ননীর অঙ্গ নিয়ে খেলতে আসা কেন বাপু? পাডুকে দেখে শিখতে পারিস না?
  • -   অত শিখলে যদি শিখ্‌ হয়ে যাই?
  • -   হয়ে গেলে অন্ততঃ ভালো ফুটবল খেলতে পারবি, জার্নেল সিং এর মতো
  • -   আমি খারাপ খেলি না
  • -   সে তো দেখতেই পাচ্ছি... খিক্‌ খিক্‌

ফোকরের টিট্‌কিরিতে অতিষ্ট হয়ে আবার নেমে পড়তাম মাঠে। আবার খেলা শুরু। প্রতি বছর পাঁচিলের পলেস্তারা খসে পড়ে। চেয়ে থাকি কবে এই পাঁচিলটা ধ্বসে পড়বে, আর ওই খিটকেল বিটলে বজ্জাত ফোকরটাও আর থাকবে না। কিম্বা পাডুকে কাটিয়ে ঠিক গোল করে ফেলবো। পাঁচিলের পলেস্তারা খসছিলো, আমাদের শৈশব কৈশোরেরও পলেস্তারা খসছিলো। দেখতে দেখতে বছর গুলো চলে গেল। পাডু, বোটোন, খোকন, লাল্টু, মুটুক (আসলে মুকুট), ফুচু, সুবু, আরো কত জন আমাদের। মনে করতে গেলেই গলার কাছে কেমন যেন...। থাক্‌গে থাক্‌গে। সেন্টু মেরে লাভ নেইকো। ডিসেম্বরে বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের পাথরফাটা ঠান্ডায়, দিশি মুরগির ঝোল দিয়ে পিকনিক, সরস্বতী পূজোর নানান বদমায়েশী, দল বেঁধে দামোদরের চরে কিম্বা সাইকেলে করে দূরে বেড়াতে যাওয়া, সব পেরিয়ে একদিন এলো, যেদিন বাংলার পশ্চিম প্রান্তের ওই জায়গা ছেড়ে চলে আসতে হলো বড় শহরে। তার পরে যোগাযোগ আস্তে আস্তে কমে আসা। তখন তো ফেসবুক-হোয়াট্‌সঅ্যাপ ছিলো না, যাতে করে টুকুস টাকাস টুসকিবাজি করে, বোকাবোকা মজারু ছেড়েও বুড়ি ছুঁয়ে থাকা যায়। আবার অনেক অনেক কাল পরে, ওই ফেসবুক-হোয়াট্‌সঅ্যাপ দিয়েই আবার যোগাযোগ চালু হলো এই কিছুদিন আগে। প্রথমে চেল্লামেল্লি, পরে পেছনে লাগা, তার পরে আবার করে সব কটা বাঁদরের এক জায়গায় হবার প্ল্যান, কিস্যু বাদ গেলনা। এই কিছুদিনের মধ্যেই হবে হবে করছে রি-ইউনিয়ন। 
      
বহু দুরের সেই মাঠে পুরোনো পাঁচিলটা আছে কিনা জানিনা। বোধহয় আর নেই। ফোকরটা বিদায় হয়েছে। আর আজ, তেসরা ডিসেম্বর ২০১৪র ভোর রাতে রজত শুভ্র চাটুজ্যের নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসে গেল। কেমন ফুড়ুৎ আমাদের ছেড়ে চলে গেল পাডু। ডিফেন্স একদম ফাঁকা করে দিয়ে। বাকি টিমের সবার মেরুদন্ডে হিমশীতল স্রোত বইয়ে দিয়ে। সন্তান, স্ত্রী, বাবা, মা, দাদা, দিদি, সব্বাই কে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।

ভোর রাতেই শুনলাম ফোকর আবার গা জ্বালানী হাসছে
  • -   কাটাতে পারলি না তো আর, খেলা শেখ, খেলা শেখ

শিখ জার্নাল সিং হলে স্ট্রাইকারকে আটকাতে পারতাম। পাডু ছিলো ডিফেন্ডার। 

৪টি মন্তব্য :

  1. Tomar lekhar tulona tumi nijei... first line e sudhu keno jnina 'bapu' word ta unwanted laglo, but eta amar personal motamot.. lekhata pore phele asa purano diner onek vlo bondhur ktha mne pore glo, jader sathe facebook whatsapp thaka sotteo contact nei.. ei mone krye deoatai tomar lekha kotota vlo tar proman

    উত্তরমুছুন
  2. কি বলব!!

    পড়লাম বেশ কয়েকবার, পরে আরও কয়েকবার পড়ব, যতদিন "পরে" বলে কিছু থাকবে।

    উত্তরমুছুন
  3. সোমনাথ ,

    তোর এই লেখাটা অনেক আগেই পড়েছিলাম, কিন্তু সেসময় দেশে যাওয়া ও অন্যান্য ব্যস্ততায় - এটার উত্তর দেওয়া হয়ে ওঠে নি। .. আজ একে একে তোর সব পূরণ পোস্ট গুলো আবার নেরেচেরে দেখছিলাম.... "ফোকর এবং ফুড়ুৎ" পড়ে একটা ফাটা ফাটি শব্দ আর একটু ভয় উতলে উঠলো - কী করব বল, চল্লিশ তো পেরোলো আমাদের প্রায় সকলের ই - এখন প্রতিমাসেই ড্যাশবোর্ড এ এল জ্বলে ওঠে - সার্ভিস ডিউ
    লেখটা অসাধারণ সিরীয়-কমিকাল !!!

    - সুদীপ সান্যাল

    উত্তরমুছুন
  4. লেখাটা পড়ি আর ভাবি এই তঁ পাডু এখানেই...পা ছড়িয়ে বসে আছে...

    উত্তরমুছুন