সোঁদা সোঁদা গন্ধ, ভিজে
ভিজে রাস্তা, ঝিম ঝিমে নিস্তব্ধতা আর গোল গোল চোখ নিয়ে দেখি ওই উঁচুতে মেঘের মধ্যে
থেকে বেরিয়ে এসেছে আস্ত একখানা আইফেল টাওয়ার। স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে আমার
জ্ঞানগম্যির উচ্চতা পেয়ারাগাছ পেরোয় না। পাথর বা ইঁটের তৈরি স্তম্ভ মানেই কলকাতা ময়দানের মনুমেন্ট
আর লোহা বা ইস্পাতের তৈরি উঁচুপানা কিছু দেখলেই আইফেল টাওয়ার, এর বাইরে অন্য কিছুর
তুলনা টানতে পারিনা। আর এখানা দেখতেও অনেকটা আইফেল টাওয়ারেরই মত। ইয়াব্বড় হাঁ করে
তাকিয়েছিলুম। গোটা দুয়েক সাহসী পাহাড়ি মাছি হাঁয়ের ভেতর ঢুকে সরেজমিনে দেখে নিয়ে আবার
উড়ে বেরিয়ে গেল। শেষে ভাঙ্গা রাস্তার ঝাঁকুনিতে চোয়াল বন্ধ হয়ে কটা কথা বেরিয়ে এল –
ওটা ওখানে উঠলো কি করে?
“উ খরসাং কা টিভি টাওয়ার
হ্যায়”। স্টিয়ারিং হাতে সঞ্জয় রাইয়ের মুখে হাসি। আজ ওর ছেলের একবছরের জন্মদিন। বিকেলে
বাড়ি ফিরে নির্ঘাত এই গপ্পটা বলবে। তা বলুক। কিন্তু আমার বিষ্ময় কাটেনি এখনো।
টাওয়ার খানা কিসের ওপর দাঁড়িয়ে? চতুর্দিকে তো খালি মেঘ। গ্যাস বেলুনে বেঁধে ভেসে
টেসে আছে বোধহয়। সঞ্জয় ধরে ফেলেছিলো, গোটা ব্যাপারটা তখনো আমার বোধগম্য হয়নি। ঝটতি
একটা মোড় ঘুরে বুঝিয়ে দিলো, কার্শিয়াং শহর সমেত গোটা পাহাড় মেঘের তলায় চাপা পড়ে
আছে। তাই কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছেনা। স্রেফ টিভি টাওয়ার মেঘ ফুঁড়ে মুন্ডু বের করে
উঁকি মারছে। ক্যামেরা ব্যাগের মধ্যে, পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে একটা ছবি তুলে
নিলুম। কার্শিয়াংয়ের ১৫-১৬ কিলোমিটার আগে থেকেই মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি শুরু হয়েছে।
কার্শিয়াং পৌঁছে দেখি আমাদের লুকোচুরিতে যোগ দিয়েছে আর এক ছোট্ট খেলোয়াড়। পিচের
রাস্তার ধারে পাহাড়ের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসে সঙ্গে চলল ক্ষুদে রেললাইন।
দার্জিলিং হিমালয়ান
রেলওয়ে, মানে আমাদের চেনা টয়ট্রেন এই কার্শিয়াং এর পর আর নিচে নামতে পারেনা। পাগলাঝোরার
কাছে ধ্বস নেমে লাইন নষ্ট হয়ে গেছে। কি আর করা? সেই কবে একবার ট্রেনে চেপে
দার্জিলিং গিয়েছিলুম। সদ্য সদ্য কলেজ ছেড়ে বেরিয়েছি। জানুয়ারির কনকনে সকালে নিউ
জলপাইগুড়ি ইস্টিশনে নেমে দেখি দূরে ছোট্ট প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে খুশখুশ করে আওয়াজ
করছে হিমালয়ান কুইন, মানে স্টিম ইঞ্জিন। তার পেছনে তিন খানা নীল রঙা বগি। তখন
পকেটে পয়সা বাড়ন্ত, কিন্তু উৎসাহের খামতি নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ১৬ না ১৮ টাকা
ভাড়া। হুড়মুড় করে উঠে পড়লুম টিকিট কেটে, আর একটু পরেই সে গাড়ি ঘিসঘিস-টংটং করতে
করতে রওনা দিলো। তা, সেবারেও কার্শিয়াং ছিলো, টিভি টাওয়ার ছিলো, মেঘ ছিলো। কিন্তু
আমরা তিনটে চ্যাংড়া ছোঁড়া, আর সামনের দুটো কামরায় দিল্লির কোনো এক কলেজের এক দঙ্গল
মেয়ে, সঙ্গে তাদের দুই দিদিমনি। কাজেই বাইরের পাহাড়-জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে
দৃষ্টিসুখের বাজে খরচা আমরা করিনি।
দার্জিলিং
নিয়ে লেখালিখি, ছবি, সিনেমা, এই সব এত বেশী করে হয়ে গেছে, যে এখন যদি আমি দার্জিলিং
এর গপ্প করতে বসি, তাহলে আপনি দু মিনিটেই অতিষ্ট হয়ে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু মুশকিল হলো,
মেয়ের ইশকুলের গরমের ছুটিতে গুষ্টিশুদ্ধু গেলুম দার্জিলিং আর লিখতে শুরু করলুম দ্বারভাঙ্গা
নিয়ে, তা তো আর হয়না। তবে কিনা কিছু আজব বস্তু আছে, যা কিনা হাজার চর্বিতচর্বনের পরও
একই রকম আকর্ষনীয় থাকে। এই ধরুন না কেন, আমাদের রামরাজাতলা বাজারে যেকোন মিষ্টির দোকানের
জিলিপি। যতই চিবোইনা কেন, তার স্বাদ গন্ধ কখনো বদলায়নি, আকর্ষনও ঠিক তেমনিই বজায় আছে।
কিছু কিছু জায়গা থাকে, যার স্থানমাহাত্যকে সময় ছুঁতে পারেনা। পুরি-কাশি-হরিদ্বার-দার্জিলিং
এরকমই জায়গা। যতই বলুন ঘিঞ্জি, যতই বলুন নোংরা, যতই বলুন গোর্খাল্যান্ড, যতই বলুন সারা
দিন শুধু মেঘ আর বৃষ্টি। গ্লেনেরিজে বসে এক পাত্তর খাঁটি দার্জিলিং চায়ে চুমুক মারুন
দিকি। প্রথম চুমুকে ঘিঞ্জি দার্জিলিং সরে গিয়ে পুরোনো সাহেবি কেতার ঘরবাড়ি গুলো চোখের
সামনে হাজিরা দেবে। গ্লেনেরিজের পূব দিকের কাচের জানলা দিয়ে আপনি একটু দক্ষিন ঘেঁষে
নজর করবেন, দেখবেন প্ল্যান্টার্স ক্লাবের শ-দেড়েক কি তারও বেশী আগেকার কেতাদুরস্ত বাংলো
বাড়ি, তার কোনাকাটা ঢালু ছাত, বাহারি কাঠের কার্নিশ আর মনভোলানো জানলা সমেত সবুজ-সাদা
কোটপ্যান্ট পরে আপনার উলটো দিকের চেয়ারে বসে স্টেট এক্সপ্রেস পাইপে ভরে টান দিচ্ছেন
আর খাশ ব্রিটিশ উরুশ্চারনের হিন্দিতে চা হুকুম করছেন।
দ্বিতীয় চুমুকে লা-ডেন লা রোডের ওপর থেকে হাজার দুয়েক গাড়ির ভিড় হাওয়া হয়ে
যাবে, সমতলের শপিং-স্যাভি আজব বিটকেল বাঙালি পর্যটকের থিকথিকে ভিড়, মুকুলের দুষ্টু
লোকের মত ভ্যানিস ......। ডিজেলের পোড়া গন্ধের বদলে নাকে আসবে টাটকা তাজা মন
মাতানো চায়ের গন্ধ। পেয়ালা-পিরিচ-ছাঁকনি-চামচের টুংটাং তখন কানে ঢুকবে বেঠোফেনের
ন-মম্বর কি যেন একটা বিলিতি বস্তু আছে, সেই তার মত হয়ে। তৃতীয় চুমুকের আগে, আপনি অবশ্যই
সামনে ন্যাপকিন কাগজের ওপর রাখা টাটকা মুচমুচে জ্যাম টার্টে একখানা কুড়ুৎ করে কামড়
দিয়েছেন। গ্লেনেরিজের জ্যাম টার্ট বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতি সম্পূর্ন
স্বাদের খাবার। নোনতাও না, মিষ্টিও পুরোপুরি না। আপনার হাতের তেলোর চেয়েও অল্প ছোট
গোল চ্যাপ্টা চাক্তি। ওপরটায় হালকা বাদামি কুড়কুড়ে রিজের ফাঁকেফাঁকে ইষ্যৎ সাদাটে
ভুরভুরে বস্তু। মাঝখানে আধ ইঞ্চি ব্যাসের টুকটুকে লাল জ্যাম। দার্জিলিংএ সবই
ইঞ্চি-ফুট-গজ-মাইলে মাপতে ইচ্ছে করে। গোর্খাল্যান্ড যদি কখনো নতুন রাজ্য হয়, ভাবছি
এই প্রস্তাবটা ওনাদের পাঠিয়ে দেখব। জ্যাম টার্ট মুখে নিয়ে কচর মচর করে চিবিয়ে,
কোঁৎ করে গিলে ফেলার জিনিস নয়। উল্টোদিকের টেবিলে দেখছিলাম এক ব্যাটা বদমাশ জ্যাম টার্ট
খাচ্ছে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে, আনমনে। নির্ঘাত বাঙা... (ভাতৃপ্রতিম দুর্জয় রায়
হলে লিখত “নির্ঘাত ঘ...”)। থাকগে, আমার জাতিবিদ্বেষ নিয়ে এমনিতেই অনেক সুনাম
বাজারে। কিন্তু এ আপদকে ধরে পাগলাঝোরায় ফেলে দিলে গায়ের জ্বালা জুড়োতো। যাই হোক,
জ্যাম টার্ট নিয়ে কয়েক মিনিট কাটাবার পর এবারে চায়ে ফিরুন।
দার্জিলিং চায়ের স্বাদ ও গন্ধ নিয়ে অনেক মত আছে, অনেক চর্চা , অনেক বিতর্ক
আছে। সেসবে আমি ঢুকছিনা। আমি কেবল আমার পছন্দটুকু বলতে পারি। খুব গরম চায়ের লিকার
হলে, ধরুন, ৯৫ কি ৯৮ ডিগ্রি (সেন্টিগ্রেড – আমি হাওড়ার লোক), চায়ের গন্ধটা ঢাকা
পড়ে যায় গরম জলীয় বাস্পের আস্ফালনে। প্রতি মিনিটে দু ডিগ্রি করে উষ্ণতা কমছে ধরে
নিয়ে মোটামুটি ৫-৭ মিনিটের পর চায়ের আসল জৌলুস ফুটে বেরোয়। গরমকালের হিসেবে কইচি।
জানুয়ারি মাসে ৭ মিনিট পর ঠান্ডা জলের মত চা মুখে দিয়ে চাটুজ্যের বাপান্ত করা
চলবেনা কিন্তু। তৃতীয় চুমুকের সময় চায়ের সেই আসল অবস্থাটা চলে এসেছে, আর জ্যাম
টার্ট আপনার ঘ্রানেন্দ্রীয়কে এক খানা F5 মেরে দিয়েছেন। F5 কি বস্তু, সেটা না জানলে বাড়ির যে সব ছানাপোনারা দিনরাত
কম্পিউটার নিয়ে নাড়াঘাঁটা করছে, তাদের জিজ্ঞেস করুন। যাই হোক, চুমুক তো মারলেন। তার
পরে হলোটা কি? হলো উটের পাকস্থলি, হলো ডুংলুং ডো, ভূতো নবীনের গলা জড়িয়ে “ভাইরে, অ্যাদ্দিন
ছিলি কই” বলে উঠলো, আর কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই ছোট্ট ছেলেটা এই ২০১৫র অবজারভেটরি হিলের রাস্তায়
,পাহাড়ি গানটা গাইতে গাইতে আপন মনে হাঁটতে লাগল। দার্জিলিং চায়ের নাম – অরেঞ্জ পিকো।
চায়ের সুঘ্রানের সঙ্গে নাকি হালকা কমলালেবুর গন্ধ মিশে থাকে। সে চা যখন জিভ, টাকরা
পেরিয়ে কন্ঠনালীতে ঢুকে নিচে নামছে, ঠিক সেই সময় আপনি নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। দেখবেন,
নাকের মধ্যে ঘ্রানের বিস্ফোরন ঘটছে। অরেঞ্জ পিকোর সুঘ্রানের সব কটা নোট তো বটেই, টাটকা
দার্জিলিং কমলালেবুর গন্ধও পাকাপাকি ভাবে নাকের মধ্যে বাসা বেঁধে বসবে।
চা খাওয়া তো হলো, কিন্তু এ চা পাড়া-ইয়ারদোস্ত-রিস্তেদারি তে যদি কিছু
বিলি-বাঁটোয়ারা না করলেন, আর বাড়িতে এক খানা চকচকে কাচের বোতলে কিছুটা ঢেলে না
রাখলেন, তাহলে আপনার চায়ের সমঝদারিত্ব ষোলোকলায় পৌঁছল কি? গ্লেনেরিজ থেকে বেরিয়ে ডানহাতি ফিরুন, আর সোজা দক্ষিনমুখো নামতে
শুরু করুন। এ রাস্তা ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে। হাঁটতে মোটেই কষ্ট নেই। গ্লেনেরিজের উল্টোদিকে হালফ্যাশনের আমেরিকান ভাজা মুরগির দোকান হয়েছে।
আমার ভালোই লাগল। তুলনা হলে জৌলুস ও রূপ আরো ফুটে বেরোয়। মার্কিনি মুর্গী আর
গ্লেনেরিজের আমন্ড চকোলেট কেকের তুলনা করলেই শ্রেনীপার্থক্য খোলতাই হয়। কেকের কথা
আগে বলিনি বুঝি? ও, তাহলে গ্লেনেরিজের স্যান্ডউইচের কথা বলতে গিয়ে বোধহয়...। ও ,
তাও বলিনি? খেয়েচে, এ লেখা তো তাহলে মেনুকার্ড হয়ে যাবে। আপনি যখন যাবেন, খেয়ে
দেখবেন। ও নিয়ে আর লিখছিনা। দু পা হাঁটলেন ডানহাতি বাটা, আর আরো দুপা গেলেই হেস্টি-টেস্টি
বলে শাকাহারী ভোজনালয় পেরিয়ে ক্যাভেন্টার্স। ওই যে, যেখানে ফেলুদা হট চকোলেট
খেয়েছিলো। দার্জিলিং এর আর পাঁচটা খানদানী প্রতিষ্ঠানের মত, ইনিও একশ বছর
পেরিয়েছেন। তবে ইদানিং লোলচর্ম শিথিল হয়ে বয়সের ভারে কিঞ্চিত অবনত। সে যাই হোক,
ক্যাভেন্টার্সের ঠিক উল্টোদিকেই প্ল্যান্টার্স ক্লাবের বাড়ি। এখনো দেখলেই মনে হয়
চা বাগানের শ্বেতকায় ম্যানেজার এখুনি এসে বারান্দায় দাঁড়াবেন, আর পাহাড়ি বেয়ারা তাঁর
ঘোড়া নিয়ে আসবে।
প্ল্যান্টার্স ক্লাবের বাড়িটা ঠিক যেখানে শেষ হয়েছে, সেটা একটা চৌমাথা, তবে
ঠিক “চারমুখো চার রাস্তা গেছে চলে” নয়। দক্ষিনের দিকে দুটো রাস্তা গেছে, উত্তরের
দিকে দুটো। একটা করে ওপরে উঠেছে, একটা করে নিচের দিকে নেমেছে। ঠিক মাঝ বরাবর একটা
পুলিসের গুমটি। দার্জিলিং এর পুলিস, পশ্চিমবঙ্গ পুলিসই বটে, কিন্তু তাদের
সাজপোশাক, চেহারা, চাকচিক্য সবই আলাদা। কেমন ঝকঝকে হাসি মুখ আর চমৎকার ছিপছিপে
চেহারা। পুলিসের গুমটির ঠিক পেছনে ঘড়িওয়ালা টাওয়ার। বরফি ছবিতে ক্যাভেন্টার্সে বসে
নায়িকা হটচকোলেট খাচ্ছে, আর বরফি ওই ঘড়ি ওয়ালা টাওয়ারের ওপর উঠে তার দৃষ্টি
আকর্ষনের চেষ্টা করছে। দৃশ্যটা মনে করার চেষ্টা করুন। ঘড়িওয়ালা টাওয়ারের পাশদিয়ে
লা-ডেন লা রোড ধরে হেঁটে যাবেন। তবে এ রাস্তায় কিঞ্চিত সাবধান। নাকে নাকে ঠেকিয়ে
গাড়ি উঠে আসছে রাস্তা ধরে। কোনক্রমে একটা গাড়ি চলতে পারে, আর পাশে খুব বেশী হলে
একজন কষ্টেসৃষ্টে দাঁড়াতে পারে। রাস্তা ঠিক এতটাই চওড়া। আমি দিনে রাতে কখনো খালি
দেখিনি এই জায়গাটা। হাঁটার সময় খুব সাবধান। ক্লক টাওয়ার পেরিয়ে ডানহাতি আর বাঁহাতি
দুখানা ব্যাঙ্কের এটিএম ছাড়িয়েই দেখবেন রাস্তা বাঁ দিকে ঘুরে যাচ্ছে। ওই ঘুরে
যাবার মুখটায় আপনার ডানহাতি দেখুন, নাথমলের চায়ের দোকান।
দার্জিলিং এ দার্জিলিং চা পাবেননা এটা হতেই পারেনা। অতি অবশ্যই পাবেন। থরে থরে
অগুন্তি দোকানে সাজানো রয়েছে। সেখানে প্যাকেটের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা দার্জিলিং
টি, মকাইবাড়ি টি, আরো কত কি সব। কিন্তু ঘটনা হলো, ঠিক ওই রকম দেখতে প্যাকেট,
আমাদের রামরাজাতলা বাজারের মুখে বুল্টি টি কর্নারের শোকেসেও থাকে। তাই আমার মনে
হয়, নিঃসন্দেহ হতে, সোওওওজা চলে যাবেন নাথমলের চায়ের দোকান। নাথমলের দোকানেরও
প্রচুর বয়স। সেই সাহেবি আমল থেকে এনারা চা বেচে আসছেন। বিলিতি কেতায় কাচের দরজা
বন্ধ করা দোকান। ভেতরে ঢুকলেই একটা চা-চা গন্ধ পাওয়া যায়, আর আধো অন্ধকারে ভারি
চশমা চোখে এক চাচা আপনার দিকে সোজা দৃষ্টিপাত করেন। রাশভারি লোক দেখলেই আমার কেমন
যেন......। তবে দেখলুম রাশভারি হলেও বেশ সৌম্য গোছের একটা গোঁফ রয়েছে ভদ্রলোকের।
সামনের ডেস্কে সাজানো অন্তত একশ রকম চা। কোনটা কি, কিছুই বুঝলুম না। সরাসরি
আত্মসমর্পন করলুম। সবিনয়ে জানালুম, দার্জিলিং অরেঞ্জ পিকো কিনতে চাই। উত্তরে
শুনলুম, ডেস্কের ওপরে রাখা যাবতীয় চা ই অরেঞ্জ পিকো। লে হালুয়া। এবার কি করি?
ক্যাবলার মত মুখ দেখে ভদ্দরলোক বুঝলেন শ্যালদা ইস্টিশনে সদ্য নেমিচি। এবার যত্ন
করে বোঝাতে বসলেন – সব চা অরেঞ্জ পিকো হলেও দামের পার্থক্য আছে গুনমানের ওপর।
মোটামুটি ৮০০ টাকা কিলো থেকে শুরু আর ৩০০০ টাকা পর্যন্ত তার বিস্তার।দুনিয়ার বাকি
সবকিছুর মত দার্জিলিং চায়ের ক্ষেত্রেও সব সারের সেরা সার হলো সিলভার টনিক। যেমনটি
ঢালবেন, তেমন স্বাদগন্ধ বেরোবে। আমি গাঁটের অনেক হিসেব-নিকেশ করে ১৫০০র পাতা
কিনলুম ১০০ গ্রামের চার খানা প্যাকেট। দু চার জন কে দেবো। সঙ্গে পিতৃদেব ছিলেন।
বাড়ির জন্যে ২৫০ গ্রাম নেওয়া হলো। এদিক ওদিক চিন্তা করে আরো কয়েকটা ১০০ গ্রামের
মোড়ক ঝুলিতে ঢুকলো। হোটেলে ফিরে, একে দেওয়া হবে, ওকে দেওয়া হবে করে, কিছুতেই হিসেব
মেলেনা। বাবা পরের কদিন নিয়মিত নাথমলের দোকানে যাতায়াত করে গেছে হিসেব মেলাতে।
একটা নতুন ব্যাগ কিনে, দার্জিলিং ভর্তি করে বাড়ি ফিরেছি। স্বাদ? বাড়িটাই পালটে যায়
যখন ওই চায়ের পেয়ালায় চুমুক দি।
চা তো হলো। কিন্তু লা-ডেন লা রোডের পুরোটা না হেঁটে ফিরি কি করে? নাথমলের
দোকান পেরিয়ে সামনের মোড় ঘুরেই দেখবেন দার্জিলিং এর রিংক মল। মানে, আমি ঠিক অতটা
উন্নাসিক নই, যে শপিং মল মানেই মল-মূত্র বলব। কিন্তু কেমন জানি খাপছাড়া লাগে এই
জায়গাটা। বরং এখানে একটা ভূটিয়া সোয়েটারের বাজার থাকলে দিব্যি জমত। শপিং বিলাসিরা
এখানেই ভিড় জমাতেন, অবজারভেটরি হিলের রাস্তার প্রথম ৫০ মিটার খালি থাকত। মল পেরিয়ে
আরো নিচের দিকে নামতে থাকলেন লা-ডেন লা রোডের পাক ধরে। মিনিট ৬-৭ পরেই লা-ডেন লা রোড
আপনাকে নিয়ে হিল-কার্ট রোডে মিলিয়ে দেবে। এখানে আরো একটা পুলিস গুমটি, আবার সদা
হাস্যমুখ গোর্খা পুলিস কর্মী, পাশেই পেট্রোল পাম্প। হিল-কার্ট রোড বেশ বড় চওড়া
রাস্তা। একদিকে দার্জিলিং এর পাহাড় খাড়া হয়ে উঠে গেছে ওপরে, অন্য দিকে খাদ নেমে
গেছে নিচু হয়ে। এ রাস্তায় সারা দিন গাড়ির ভিড় লেগেই থাকে। বিলাসী ট্যুরিস্টের
জন্যে এখানে আকর্ষন তেমন কিছু নেই। তবে কিনা আরো দু কদম এগোলেই চোখের সামনে উদয় হয়
ছোট্ট সাজানো সুন্দর একখান রেল ইস্টিশন।
এ আমাদের সেই ক্ষুদে লুকোচুরির বন্ধু। রাস্তার ডান দিকে স্টেশন, আর বাঁ দিকে
কার্শেড। সেখানে খান তিনেক খেলনার মত ছোট্ট ছোট্ট স্টিম ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে আছে। তবে
কিনা রেল কোম্পানির তুঘলকি ব্যবস্থায় সে ট্রেনের অবস্থা হাঁসজারুর মত। এখন শুধু
দার্জিলিং থেকে জয় রাইড হয় সাত কিলোমিটার দূরে ঘুম পর্যন্ত। সে রাইডের টিকিট আবার
বেজায় আক্রা। একখানা টিকিটের দামে, পার্কস্ট্রিটের বড় রেস্তোরাঁয়
চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় হয়েও ট্যাক্সিতে বাড়ি যাতায়াত কুলিয়ে যায়। স্টেশনে জিজ্ঞেস
করে শুনলুম টিকিট পেতে লোক নাকি কাকভোরে লাইন দেয়, আর অনলাইনে কয়েক মাস আগে থেকে
হিসেব নিকেস করে টিকিট কাটে। সকালে আর বিকেলে মিলিয়ে বোধহয় চার না ছবার টয়ট্রেন
ঘুম আর দার্জিলিং এর মধ্যে মাকু মারে। দশদিনের প্রস্তুতিতে, ভরা পর্যটকের মরশুমে
দার্জিলিং এসেছি। কাজেই টয়ট্রেন বাইরে থেকেই দেখলুম। বুঝিনা এত কার্পন্য কেন রেল
কোম্পানির। চালাতেই যদি হয়, দিনভর একটু বেশী করে চালালেই তো পারে, দু পয়সা আয় ও
হয়।
দার্জিলিং এসেই পর্যটকদের হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায় কয়েকটা উদ্যোগ কে ঘিরে। তার
মধ্যে এক নম্বর বোধহয় টাইগার হিলে গিয়ে সূর্য্যোদয় দেখা। হাজার কিসিমের গাড়ি,
রেট, ব্যবস্থা। মাঝরাতে কম্বলের তলা থেকে হিঁচড়ে বের করে গাড়িটে ঠাসাঠাসি করে
বসিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে টাইগারহিল যাওয়াটুকুই মেজাজ খিঁচড়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তবু
একটু প্রলেপ পড়ে যদি কাঞ্চনজঙ্ঘা বা সূর্য্যোদয় কিছু একটা দেখা যায়। কিন্তু মে
মাসের শেষে সেই দূরাশা না করাই ভালো। আমি এর আগে টাইগার হিল থেকে সূর্য্য ওঠা
দেখেছি। তাকে আমার আগেই বহু মুনিঋষি বর্ননা করে গেছেন, কাজেই পৈতে ছাড়া এই বামুনের
মুখে সে বর্ননা আর মানায়না। তবে কিনা, সিকিমের পেমিয়াংৎসে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার যে
সূর্্য্যদয় দেখেছিলাম, বা পশ্চিম সিকিমের বার্সে থেকে, তার তুলনা খুব কমই পেয়েছি।
মে মাসে দার্জিলিং শহরের মধ্যেই মেঘের চোটে দশ হাত দুরের বস্তু ঠিকমত ঠাওর হয়না,
তায় কাঞ্চনজঙ্ঘা, টাইগার হিল। সে গুড়ে বালি। টাইগার হিলের পরেই ফাইভ পয়েন্ট, সেভেন
পয়েন্ট ইত্যাদি সব বিকট প্ল্যান নিয়ে হাজির হন ট্যুর অপারেটররা। তাতে “বতাসিয়া”
লুপ থেকে চিড়িয়াখানা, রক গার্ডেন থেকে রাজভবন, সব কিছুই থাকে। আপনার যদি দেদার
পয়সা থাকে, আপনি যদি দার্জিলিং এর কিচ্ছুটি দেখতে না চান, আপনি যদি চেল্লামেল্লি,
খাদ্য পানীয়, কাচ্চা বাচ্চা সমেত ঘন্টা চারেক ডিজেলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে জ্যাম
জমাট রাস্তায় আটকে থাকতে চান, তাহলে এই ট্রিপ গুলো আপনার পক্ষে আদর্শ। তা না
চাইলে, এক্কেবারে এসব মুখো হবেন না। এক বাতাসিয়া লুপ আর ঘুম মনাস্ট্রি ছাড়া, বাকি
সব কিছুই পায়ে হেঁটে দেখা সম্ভব। আর রক গার্ডেন? দিল্লিকা লাড্ডু। বাকি আপনার ওপর
ছাড়লুম।
এই সব পাঁচকথা ভাবতে ভাবতে আপনি লা-ডেন লা রোড ধরে আবার উঠে এসেছেন ওপরে।
গ্লেনেরিজের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছেন আর একটু অমৃতসুধা পান করে যাবেন নাকি। করতেই
পারেন। ঠকবেন না। তবে আর দুপা এগিয়ে চলুন পা রাখা যাক দার্জিলিং এর ম্যালে। আজ্ঞে
হ্যাঁ, সেই “দার্জিলিং জমজমাট” এর ম্যাল, “কাঞ্চনজঙ্ঘা” ছবির ম্যাল, আরো কত কিছুর
ম্যাল। ইংরেজি তে মল আর ম্যাল, দুটোর বানানই এক। উচ্চারন ও এক, মানেও। কিন্তু
আমাদের পরিচিত ধারনার মলের সঙ্গে এই মল কে কিছুতেই মেলাতে পারিনি। দার্জিলিং এর Mall তাই আমার কাছে চিরকালিন ম্যাল। এত বছরে ওপর
ওপর দু চারটে বদল হয়ত হয়েছে ম্যালে। এই যেমন এই বার গিয়ে দেখি ভানু ভক্তের মুর্তির
পেছনে সুন্দর বাঁধানো বসার জায়গা হয়েছে। আস্তাবলের দিকটায় একটা “কাপে কফি দে”
হয়েছে। কি বিটকেল রসিকতা মাইরি! চায়ের স্বর্গে এসে কফির দোকানে ঢুকবো কেন? দেখলুম
ম্যালে তিল ধারনের জায়গা নেই। কিন্তু কফির দোকান মাছি তাড়াচ্ছে। বেশ আত্মপ্রসাদ
লাভ করলুম। ওই আস্তাবলের আশেপাসেই দার্জিলিং এর সেরা কয়েকটা মোমো ও তিব্বতি
খাবারের দোকান আছে। ওগুলো ছেড়ে আসাটা বোকামি, এইটুকু বলে রাখলুম শুধু।
ম্যাল জায়গাটা বড্ড সুন্দর। পিৎজার টুকরোর মত আকৃতির একটা সমতল জায়গা,
এক্কেবারে পাহাড়ে ওপর। নিখুঁত ভাবে বাঁধানো। এক দিকে বাড়ি ঘর। তাও সে সব ওই একশো
বছরের ও আরো কিছু বেশী পুরোনো। তাদের স্থাপত্যও ওই সময়ের। হাঁ করে চেয়ে থাকার মত।
ছিমছাম, সুন্দর, আভিজাত্য আর ঐতিহ্যপূর্ন। এক্কেবারে দক্ষিন প্রান্তে বাঁ হাতি
বাড়িটাই সব চেয়ে প্রিয় আমার। এর নিচে দু খানা দারুন দোকান আছে। ফেলুদার গপ্পেও
উল্লেখ আছে তাদের। প্রথমটা হলো অক্সফোর্ড বুক স্টল। হিমালয়ের ওপর বইয়ের এত ভাল
সংগ্রহ দেখতে পাওয়া ভার। সব ধরনের বই ই পাওয়া যায়। আর ঢুকলেই কিনতে হবে এরকম কোন
প্রত্যাশা নেই এখানে। একটা পুরোনো বই বই ভারি সুন্দর গন্ধ দোকানটায়। অন্য দোকানটা
হলো আরো কৌতুহলদ্দিপক। যদিও বাঙালি ট্যুরিস্টদের শতকরা ৯৫ জন, এই দোকানের ছায়াও
মাড়ান না। এ হলো হাবিব মল্লিকের কিউরিওর দোকান। পুরোনো জিনিসপত্র, তিব্বতী,
ভূটানি, নেপালী বস্তুর এমনতর সমাহার খুব কম দেখবেন এক মিউজিয়াম ছাড়া। ভেতরটা ইষৎ
অন্ধকার, কিন্তু চোখ সয়ে গেলে ভারি রঙিন। রকমারি মুখোস, স্থানীয়দের পোষাক-আশাক,
ব্যবহার্য্য বস্তু, কুকরি, হাতে তৈরি শিল্পদ্রব্য, কি নেই এখানে! তবে সব চেয়ে ভালো
লাগবে থাংকা দেখতে। থাংকা হলো সিল্কের কাপড়ের ওপর আঁকা বুদ্ধের জীবন নিয়ে নানান
রকম ছবি। অসম্ভব রঙিন। আপনার বৈঠকখানায় একখানা ঝুলিয়ে রাখলে বাড়ির জেল্লা বেড়ে
যাবে। দাম? হ্যাঁ, দাম তো আছেই। ভালো জিনিসের দাম থাকবেই। তবে দার্জিলিংএ দাম
দিলে, সত্যিই ভালো জিনিসটি আপনি পাবেন।
ম্যালের অন্য দিক দুটোতে সবুজ কাঠের বেঞ্চ পাতা। পিঠে ঠেসান দেবার জায়গা সমেত।
লোহার কাঠামো। মোহনবাগান ক্লাবের ভেতরে, লনে এরকম খানকয়েক বেঞ্চ এখনো আছে। কিন্তু
এখানে অগুন্তি। আর তাতে ছেলে বুড়ো, বাঙালি গোর্খা পাঞ্জাবি ইয়োরোপীয় সবাই মিলে
মিশে খিচুড়ি পাকিয়ে বসে রয়েছেন। প্রথমবার ম্যালে পা দিয়ে আপনার একটু ধাঁধা লাগবে।
বসব কোই? করব কি? নিশ্চিভো (কোই বাত নেই – রূশ ভাষায়), ধিরে সুস্থে বেঞ্চ গুলোর
দিকে তাকাতে থাকুন। ফাঁকফোকর ঠিকই পেয়ে যাবেন। বসে পড়ুন। গুষ্টিশুদ্ধু বসতে হলে,
যে কটা জায়গা পেলেন একটা বেঞ্চিতে, সেখানে বয়স্কদের বসান, আর সামনে ঘোরাঘুরি করুন।
গোর্খারা ভাগ্যিস বাঙালি নন। কয়েক মিনিটের মধ্যে হাসি মুখে উঠে গিয়ে আপনার বাকিদের
জায়গা করে দেবেন। তবে এই ঘোরাঘুরি করে ওনাকে বেঞ্চি থেকে ওঠাবার ছোটোলোকমিটা আপনি
করবেন কিনা, সেটা আপনার ওপরেই ছাড়লাম। ম্যালে করবার মত কিচ্ছুটি নেই। তবু ম্যালের
বেঞ্চে লোকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে কেন? কারন এখানে কখনোই একঘেঁয়ে লাগবেনা আপনার।
সামনে রকমারি লোকজন। বাচ্চারা খেলছে। অনেকে পায়চারি করছে, আড্ডা দিচ্ছে। আর একটু
পর পরই আপনার হাতে এক গেলাস করে গরম চা ধরিয়ে যাচ্ছে চা ওয়ালা। তবে এই চা খাঁটি
কলকাত্তাই ফুটপাতের চায়ের দোকানের চা। কনকনে হাওয়ায় দিব্যি লাগে। কিছুক্ষন বসে
থাকতে থাকতে হালকা শিরশিরে কাঁপুনি লাগে। মনে হয় জ্যাকেটের হুডটা মাথায় তুলে দি,
অথবা হোটেলে টুপিটা রেখে না এলেই হতো। বেশী জড়ভরত লাগলে উঠে পড়াই ভালো। ম্যালের
উত্তর দিকে দু খানা রাস্তা বেরিয়েছে। আমি বলি, প্রথমে ডানদিকের রাস্তাটাই ধরুন।
এটাই অবজারভেটরি হিলের রাস্তা। একদিকে রেলিং। প্রথম
চোটে মনে হবে নিউমার্কেটের সামনের ফুটপাত। অসংখ্য বিক্রেতা পোষাক সাজিয়ে বসে আছেন।
প্রায় সবই সোয়েটার, শাল, টুপি, ছাতা। কিছু কিছু স্মারক গোছের বস্তুও রয়েছে। আগেই বলেছি,
দার্জিলিং এর ওপরের খোলসটা অল্প তুলুলেই ভেতরের সাহেবিয়ানা বেরিয়ে পড়ে। একমাত্র তিব্বতী
ঠুনঠুন ঘন্টা, বা বুদ্ধমুর্তি বাদে বেশীরভাগ স্মারকই ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি,
লিভারপুল সম্পর্কিত। আর্সেনাল তুলনামুলকভাবে কম, আমি আবার তাদেরই……। আরো কম বার্সা
কিম্বা রিয়াল। মোহন-ইষ্ট? সে গুড়ে বালি। যাই হোক, এ জায়গাটা তুমুল
ঘিঞ্জি। বাঙালি ট্যুরিস্টের দরদাম কেনাকাটার চোটে পিত্তি চটে যাবার জোগাড় হয় এক
মিনিটেই। কিন্তু পঞ্চাশ মিটার হেঁটে এগোতে পারলেই ...
দার্জিলিং শহরের উচ্চতা, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কমবেশী ৭০০০ ফুট। শুধু তাই নয়,
হিমালয়ের পূবদিকটা একটু বেশী ভিজেভিজে। বড্ড সবুজ। মেঘ মেঘ। কার্শিয়াং এর আগে,
আমরা ছিলুম মেঘের নিচে। কার্শিয়াং থেকে মেঘের মধ্যে ঢুকে পড়লুম। কেমন সোঁদাসোঁদা
ঝিমঝিমে মায়ামায়া পরিবেশ। তার সঙ্গে আস্তে আস্তে মিশতে থাকে মেঘের পরতে মিশে থাকা
কেমন সব অজানা রহস্য। দার্জিলিং এই মেঘের স্তরের একদম ওপর দিক। একদম কাক ভোরে
মেঘেরা পাহাড়ের নিচের দিকে নেমে যায়, আর বেলা বাড়লে ওপর দিকে উঠে আসতে থাকে। থিয়েটারে
যেমন ড্রপসিন উঠে গিয়ে নতুন দৃশ্য বেরিয়ে আসে, ঠিক তেমনি হঠাৎ করে একটা পর্দা উঠে
গেল। ৫ – ১০ ফুটের মধ্যে চারপাশ এতটা বদলে যেতে আমি আর দেখিনি। অবজারভেটরি হিলের
রাস্তার শেষ দোকানটা পেরোতেই যাবতীয় ভিড়ভাট্টা-কোলাহল-বিকিকিনি উবে গেল। সামনে পড়ে
রইল শুধু একটা সরু কালো পাহাড়ি রাস্তা, যার এক দিকে রেলিঙের ওপাশে খাড়াই খাদ নেমে
গেছে, আর অন্যদিকটা পাহাড় উঠে গেছে, যেটার ওপরে কোথাও একটা মহাকালের মন্দির।
রাস্তার দু পাশ বিশ্ময়কর সবুজ। আর কি জানি কি ভাবে, এ রাস্তাটা দিনের বেশীরভাগ
সময়েই মেঘে ঢাকা। মাঝে মাঝে দশ হাত দুরের কিছুও ঠাওর করা যায়না। অসম্ভব নিস্তব্ধ,
কোথাও গাছের পাতা থেকে মেঘ থেকে ঘনিভুত জল টুপ টুপ করে পড়ছে, একটা দুটো পাখি
চিপ-চিপ করে ডাকছে। মানুষ জন খুব কম। কি অদ্ভুত এক জগৎ।
এ রাস্তা জোরে জোরে হেঁটে পেরিয়ে যাবার নয়। আপনার হাঁটার গতি আপনা থেকেই কমে
আসবে। মাঝে মাঝে মেঘ এতটাই ঘন হয়ে আসে, যে দু পাশে কিচ্ছুটি দেখা যায়না। আবার ক পা
গেলে, মেঘ একটু হালকা হয়ে আসে। কিন্তু এখানে এলে একটা ব্যাপার বিলক্ষন মালুম পাওয়া
যায় – এ হলো মেঘের দেশ, মেঘমুলুক। এ রাস্তা মেঘের কোলে শুয়ে আছে, কিছুটা ঝাপসা,
দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলেনা। সামনের নীলচে ধোঁয়াটে মেঘের মধ্যে থেকে মৃদু ক্লপ-ক্লপ
শব্দ ভেসে আসে। সরে গিয়ে রাস্তা দিন। বাপ ছেলেতে পাহড়ি টাট্টুর পিঠে চড়ে বেড়াতে
বেরিয়েছেন। রাস্তা সোজা নয়, পাহাড়ের গড়ন অনুযায়ী এঁকে বেঁকে চলেছে। সেই সঙ্গে আপনিও
চলেছেন। ওই উঁচুতে পাইন গাছে কেউ লাল নীল হলদে সবুজ নানা রঙের ছোট্ট ছোট্ট কাপড়ের
টুকরো ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে। কাপড়ে বৌদ্ধ মন্ত্র লেখা। বিশ্বাস বলে, এই কাপড়ের মধ্যে
দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়া নিচে জনপদের ওপর দিয়ে বয়ে যাবার সময় অশুভকে দূর করে। কিন্তু
এমন নির্জন জায়গায় অত ওপরে কে ঝোলালো ওগুলো? আরো দুপা এগোলে রাস্তার ধারে ছোট্ট
কুলুঙ্গিতে পাহাড়ি দেবতা, অল্প দুটো ফুল, ধুপ জ্বলছে। কত সামান্য, কত গম্ভীর, কত
গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে আয়োজন দেবতার বন্দনার। সামনে তাকিয়ে দেখি মেঘের ভেতর দিয়ে
হেঁটে আসছে দুই ছায়ামূর্তী। আর একটু এগোতে বুঝলুম ঠাকুমা ও নাতি খুব সম্ভবতঃ। বৃদ্ধার
পরনে ভারি সুন্দর স্থানীয় পোষাক। কুলুঙ্গির সামনে দু দন্ড দাঁড়ালেন। ধুপ জ্বালিয়ে
প্রনাম করলেন। আবার জুটি এগিয়ে চলল সামনে।
আরো দু পা হাঁটার পর যদি মনে হয়, অনেকটা হাঁটা হলো, ঠিক সেই মুহুর্তেই মেঘের
আড়াল ঠেলে সামনে হাজির হয় একটা ছবির মত ছাউনি। উনবিংশ শতকের ইয়োরোপে এরকম ছাউনি আর
বসার জায়গা হয়ত পাওয়া যেত, কিন্তু একবিংশ শতকের দক্ষিন এশিয়ায় একে দেখে নিজের গায়ে
চিমটি কাটতে ইচ্ছে করে। এখানেও গুটি কতক মানুষ বসে। কিন্তু তবুও, অনেক জায়গাই
খালি, আর আপনি নিশ্চিন্তে বসে দু দন্ড জিরোতে পারেন। অবজারভেটরি হিলের গোটা
রাস্তাতেই এরকম অনেক গুলো সুন্দর সুন্দর বসার জায়গা করা আছে। ভাবতে অবাক আগে, মোটে
৬৫০ – ৭০০ কিলোমিটার দূরে এরকম বসার জায়গা তৈরি করলে বছর খানেকের মধ্যে সেগুলোর কি
হাল হয়। পানের পিক, গুটখার প্যাকেট, কিছু চ্যাংড়ার ঠেক, আর রাস্তায় মেয়েদের
টিটকিরি মারার জায়গা। সন্ধ্যের পর সেখানে চুল্লু আর আরো কিছু অতিপ্রাকৃতের আড্ডা। আমি
বলছিনা দার্জিলিং এর লোকজন এসবের উর্ধ্বে, কিন্তু একটা স্বাভাবিক সৌন্দর্য্যবোধ
এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা না থাকলে, এরকম বস্তু বহু বছর ধরে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
পাহাড়ি মানুষের সেই সৌন্দর্য্যবোধ আছে আর সবচেয়ে বড় কথা, নিজের ঐতিহ্যের অহংবোধ
আছে। যেটা না থাকলে, আপন ভূমি ও তার সম্পদকে ভালোবাসা যায়না।
প্রতিটি বসার বেঞ্চের ছাউনির তলায়, আর কেউ থাকুক না থাকুক, একজন চা-ওয়ালা আপনি
পাবেনই। পাহাড়ের ঢালের দিকে মুখ করে বেঞ্চে বসে কাঁধের ব্যাগটা পাশে রেখে গরম গরম
এক ভাঁড় চায়ে চুমুক দিতে দিতে আপনি প্রথম বার, বিভিন্ন লোকের দার্জিলিং সম্পর্কে
নানাবিধ নৈরাশ্যব্যাঞ্জক মন্তব্য উড়িয়ে দিয়ে শেষমেস বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে চলে আসার
সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাবেন। কখনো সখনো মেঘ একটু হালকা হলে দেখবেন অনেক নিচে লেবং
রেসকোর্স দেখা যাচ্ছে। বাকি সময় মেঘ সমুদ্রের ওপরে ভেসে যাওয়া। এ রাস্তায় বসে
কাব্যি করতে ইচ্ছে করে, বা বলা ভালো ভাবতে ইচ্ছে করে। আমার দেশওয়ালি ৭০০ কিলোমিটার
দুরের কিছু লোকজন কে দেখলুম পূজো মার্কেটিং, বাচ্ছার বাঁদরামো, নেলপলিশের শেড, আই
ফোন ৬ এবং টেংরি কাবাবের সঙ্গে ভালো হুইস্কি খাওয়ার তারস্বরে এবং প্রানপন আলোচনা
চালাচ্ছেন। উজবেকিস্থানের বাইরে উজবুকের সংখ্যা অনেক বেশী। এই পরিবেশে এর একটাও
চলেনা। পূজোর কেনাকাটা, আর নেলপলিশ নিশ্চই দার্জিলিং এ হবেনা, আর বাচ্চারা বেড়াতে
এসে নিয়মের বাইরে যাবেই, সেটা নিয়ে তাদের ও আশপাশের মানুষকে উত্তক্ত করাটা রীতিমত
অসভ্যতা। আর টেংরি কাবাব? কড়া গন্ধের ও স্বাদের কিছুই খুব উচ্চস্তরের স্বাদগন্ধের
পানীয়ের সঙ্গে না খাওয়াটাই দস্তুর। তাহলে পানীয়ের আপন স্বাদগন্ধ নষ্ট হয়। খুব ভালো
দার্জিলিং চায়ের সঙ্গে ঠাসা লঙ্কা দেওয়া কড়া করে ভাজা পেঁয়াজি খেয়ে দেখবেন। সে
বস্তু এক্কেবারে বরবাদ। আর এমনতর চেল্লামেল্লিতে এই পরিবেশ ঠিক তেমনিই বরবাদ।
যদি বলেন, দার্জিলিং এর সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গা আমার কোনটা, আমি নির্দ্বিধায়
বলতে পারি, অবজারভেটরি হিলের রাস্তার ধারের এই বেঞ্চ। এখানে বসে থাক একঘেঁয়ে
লাগেনা একদম। যদিও লোকজনের আনাগনা কম, কিন্তু যাঁরাই আসেন, বড় রঙিন, বড় দেখার মত।
হলফ করে বলছি মশায়, এনাদের অনেক কে নিয়েই আস্ত উপন্যাস লিখে ফেলা যায় এলেম থাকলে। দুটি
ছেলে মেয়ে রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে কতক্ষন কে জানে, অল্প অল্প কথা বলছে। কি সুন্দর
একে অপরের সঙ্গ অনুভব করছে, দেখেই ভালো লাগে। দুটি স্থানীয় বাচ্চা ছেলে। খেলতে
খেলতে যাচ্ছে। আগের দিন রাত্রে মোহনবাগান আই লিগ জিতেছে, অনেক লাফালাফি করেছি,
মেজাজ শরিফ, ওদের দিকে দুই আঙুলে বিজয় চিহ্ন দেখালাম। সঙ্গে সঙ্গে ওরাও উত্তর
দিলো। কে বলে গোর্খারা খালি সেপাইগিরি করে আর গোর্খাল্যান্ডের দাবী জানায়? এমন
হাসিমুখ সমতলে দেখতে পাওয়া ভার। অবজারভেটরি হিলের রাস্তা হলো মেঘমুলুকের রাজপথ,
রেড রোড, ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীট, যা বলবেন তাই। আরো যে কত রকমের মানুষের
আনাগোনা। কিন্তু সবার মধ্যেই একটা অদ্ভুত সম্ভ্রমবোধ লক্ষ্য করবেন। পরিবেশের
প্রতি, মাটির প্রতি, একে অপরের প্রতি সম্ভ্রমবোধ। দার্জিলিং এর বিলিতি ঐতিহ্য
বিশ্ববিখ্যাত। কিন্তু তাই বলে সে নিজের আপন ঐতিহ্যকে ভোলেনি। এখনো তারা একসঙ্গেই
পথ হেঁটে চলেছে একে অপরের প্রতি পূর্ণ সম্ভ্রম বজায় রেখে।
এই রাস্তা গিয়ে মিশেছে পাহাড়ের অন্য ধারে বড় রাস্তার সঙ্গে। আর দুপা এগোলেই রাজভবন। সেখানে দরজায় প্রহরীকে দেখে আমার কন্যারত্ন
হাত নাড়লেন, উত্তরে ছিপছিপে ঝকঝকে গোর্খা যুবক, কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে এক গাল হাসি,
ও পালটা হাত নাড়া ফিরিয়ে দিলেন। রাজভবন পার হয়ে সে রাস্তায় আর মিনিট দশেক হাঁটলেই
দার্জিলিং চিড়িয়াখানা, আর দু পা গেলে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট। নিন,
আপনার সেভেন না হোক, ফাইভ পয়েন্ট তো হয়েই গেল। বাকি রইল বাতাসিয়া লুপ, আর ঘুম
মনাস্ট্রী। কিন্তু এর বাইরে আর কয়েকখানা জায়গার কথা আপনাকে না মনে করিয়ে দিয়ে
থাকতে পারছিনা। যদিও বাঙালি পর্যটকদের সিংহভাগ সে দিক মাড়ান না, তবুও আমি বলব
নিতান্ত অসুবিধেয় না পড়লে, একবার দার্জিলিং এর বোটানিকাল গার্ডেনটা দেখে আসুন। ম্যালের
যে দিক দিয়ে অবজারভেটরি হিলের রাস্তা শুরু হয়েছে, ঠিক তার উলটো দিকে, মানে
ভানুভক্তের মুর্তির বাঁ পাশের রাস্তা দেখবেন দু খানা। একটা বড় চওড়া রাস্তা, আর
একটা সরু গলি মত, তাতে আবার গুচ্ছের বিকিকিনির ব্যাপার। ওই ভিড় কেনাবেচার মধ্যেই
ঢুকুন। তাজমহলে যাবার রাস্তাও গা ঘিনঘিনে নোংরা আর ঘিঞ্জি। কিছুটা গিয়েই বুঝবেন হু
হু করে উচ্চতা কমছে, আর আপনি নামতে থাকছেন। চক্কর কেটে কেটে নামতে থাকুন। সদর
হাসপাতাল পেরোবেন, পেরোবেন চকবাজার। একটা শর্টকার্ট আছে, মাংসর বাজারের ভেতর দিয়ে।
নেপালিরা হিন্দু আর তারা গরু খায়না বলে এখানে গেরুয়াধারীদের আস্ফালন দেখার পর,
দার্জিলিং এর গরুর মাংসের এই এতবড় বাজার দেখলে আপনার সব ধারনা উলটে যেতে বাধ্য।
তবে চকবাজারই শেষ নয়, এর পরে আরো নামতে হবে, এবং এ রাস্তা এক্কেবারে ঘিঞ্জি বস্তির
ভেতর দিয়ে। ওই জন্যেই এদিকে পর্যটকের আনাগোনা খুব কম। রাস্তা ক্রমশঃ নিচে নামবে,
সরু ও নোংরা হবে। কিন্তু এই করতে করতেই একটা সময় আপনি বোটানিকাল গার্ডেনের দরজা
পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়বেন। ভেতরটা কিন্তু অনন্যসুন্দর। কোন নোংরা নেই, লোকজন নেই।
নিস্তব্ধ, তবে চারিদিকে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। যেহেতু পাহাড়ি জায়গা, কাজেই আমাদের
শিবপুরের বোটানিকাল গার্ডেনের মত হবেনা, সেকথা বলাই বাহুল্য, ভেতরে ঢুকেও আপনাকে
পাকদন্ডি বেয়ে আরো অনেক নিচে নামতে হবে। যদি এই পর্যন্ত পৌঁছন, আমার সনির্বন্ধ
অনুরোধ, অর্কিড হাউস না দেখে ফিরবেন না।
এর পরে আসি স্টেপ অ্যাসাইড নামে একটা বাড়ির কথায়। এ বাড়িতে দেশবন্ধু
চিত্তরঞ্জন দাশ থেকেছেন। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি এখন মিউজিয়াম। কিন্তু মুশকিল
হলো, সে মিউজিয়ামের রক্ষনাবেক্ষন ইত্যাদিতে অযত্ন আমার চোখ এড়ায়নি। মনে হলো, এই
বাড়ি নিয়ে প্রচার বড্ড কম। ম্যালের পূব দিকে ঠিক নিচের রাস্তায় মিনিট দশেক হেঁটে
গেলেই এই বাড়ির দেখা পাবেন। স্থানীয় মানুষ ও হলফ করে বলতে পারলেন না, সে মিউজিয়াম
কখন খোলে, বা আদৌ খোলে কিনা। ইতি উতি চেষ্টা চরিত্তির করে, দরজায় দু একখানা টোকাও
মেরেছিলুম। কিন্তু কপালে নেই ঘি, স্টেপ অ্যাসাইডে দোর ঠকঠকালে হবে কি?
আগেই বলেছিলুম, পায়ে হেঁটে দেখা সম্ভব নয় কেবল দু খানা জায়গা, ঘুম মনাস্ট্রি
আর বাতাসিয়া লুপ। মানে সে দুখানা দার্জিলিং এর বাইরে। প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার দূরে। বাতাসিয়া
লুপ নিয়ে আমি একটি শব্দও খরচ করতে চাইনা। আপনি যাবেন, দেখবেন, ছবিটবি তুলবেন। এই
পর্যন্ত। এ ছাড়া রইল বাকি ঘুম মনাস্ট্রী। যাঁরা সিকিম ঘুরেছেন, ধরমশালা, ম্যাকলয়েডগঞ্জ
গেছেন তাঁদের কাছে এই বৌদ্ধ মঠের নতুনত্ব কিছু নেই তেমন। কিন্তু এবার গিয়ে দেখলাম,
দর্শনার্থীদের চা খাওয়ানো হচ্ছে। আর মিঠে মিঠে এদেশী চায়ের সঙ্গে পাশেই খাশ
তিব্বতী মাখন দেওয়া নোনতা চা রয়েছে। সেই তিব্বতী চাই খেয়ে দেখলাম। দিব্যি লাগল।
নুনের পরিমান খুব সামান্য। অতি উপাদেয় চা। ব্যাস, দার্জিলিং নিয়ে আমার আর কিচ্ছুটি
বলার নেই। যা বলার তার চেয়ে অনেক বেশী বাজে কথা লিখেছি। তবে কিনা, ওই টুকু পুঁচকে
ছোট্ট নোংরা ঘিঞ্জি জায়গাটা ছেড়ে আসার সময়, কেমন একটা মন কেমন করা ভাব হয়
প্রতিবার, যেটা সচরাচর অন্য কোথাও হয়না। হয়ত এই টানটার জন্যেই দার্জিলিং থাকবে, আর আমার মত লোকের ভিড়ে, “দার্জিলিং জমজমাট” হয়েই
থাকবে। কি বলুন ফেলুবাবু? উপমাটি মোক্ষম নয়?
দুপুরের ঘুমটা সবে ভেঙ্গেছিল (বাঙালীর দুপুরের ঘুম, এই সময়েই ভাঙ্গে), হোয়াটসঅ্যাপে লেখার লিঙ্কটা পেয়ে ভাবলাম, চোখমুখটা ধুয়ে আসি, তারপর গুছিয়ে বসে পড়ব। আমার মাথা এমনিতেই খুব আস্তে চলে, ঘুম থেকে ওঠার পর তো ছেড়েই দাও, মাথা আছে কিনা তাই বুঝি না। তাই, যতক্ষণে ভাবছিলাম যে ফ্রেশ হয়ে এসে পড়ব, ততক্ষণে আঙুল লিঙ্ককে ক্লিক করে গপ্প খুলে ফেলেছে, চোখ লেখাটা পড়তেও শুরু করে দিয়েছে। কখন যে ব্রেন গিয়ার-ফিয়ার চেঞ্জ করে সপ্তমে চড়ে গেছে, খেয়াল করিনি। পড়া শেষ হতে হঠাৎ মনে হল, উঠে বসে আছি, সব ইন্দ্রিয় একদম টানটান।
উত্তরমুছুনতখনই ঠিক করলাম, কমেন্টটা একেবারে দিয়ে তারপরই মুখ ধোব।
লিখতে গেলে আমি সাধারণত ছড়িয়ে থাকি, তাও ওই প্রেম-ট্রেম জাতীয় বিষয় হলে আবেগের বশে লোকে কিছুটা গেলে, ভ্রমণ কাহিনী কদাচ নয়। এই লেখাটা পড়ে বুঝলাম, যে শালা ভ্রমণকাহিনী কাকে বলে!!
উফফ, সবকটা ইন্দ্রিয় নাড়িয়ে দিয়ে গেল। কেউ যদি দার্জিলিং নাও গিয়ে থাকে, মানসভ্রমণ নিশ্চিত। বরং, গড়পড়তা বাঙালী যেভাবে ঘুরবে (তুমিই বলে দিয়েছ কিভাবে, আমার গালি খাওয়ার চান্স কম), তার থেকে এই লেখা পড়ে বিস্তর বেশী ভালো ঘোরা হবে - এই গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি চাটুয্যে বাবুর হয়ে।
আমি দার্জিলিং আগে গেছি, কিন্তু আজ আরেকবার ঘুরে এলাম। যথাসময়ে লিখেছ, আর দিন কুড়ি বাকি আছে আবার যাওয়ার, বিচ্ছিরি রকম এপে গেলাম এটা পড়ে।
যথাস্থানে অদ্ভুত ভালো সব ছবি, আর, আবার বলছি, অদ্ভুত সব অনুভুতির বিস্ফোরণ - আরও কয়েকবার পড়ব এটা আগে থেকেই বলা রইল।
এটা পড়ে যদি কারুর লাগে যে দার্জিলিংকে কম পাওয়া গেল, পড়া আর বেড়াতে যাওয়া, দুটোই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ।
সবশেষে, একটা প্রশ্ন - জ্বর হলে কি তোমার ঘাড়ে কিছু ভর করে?
সব্বোনাশ করেছে। এই রকম মন্তব্য আমি আমার জীবনে এর আগে কখনো পাইনি। আমি অভিভুত। জ্বর হলে ঘাড়ে কিছু চাপে কিনা জানিনা, তবে মাথায় কিছু পুরোনো স্মৃতি ভিড় করে আসে। কিছু জিনিস বড্ড হারাই। যাই হোক। আশা রাখি এ লেখাটা "সবাই" পড়বে। লেখার মাঝখানে তোমার পরামর্শ বৃথা যায়নি।
মুছুনআরেকটা আশঙ্কা হচ্ছে এবার। এই যে লিখে ফেললে, এর পরের লেখাটা কি তুমি আমার ঘাড়ে চাপাবে!! এ আশঙ্কা অমুলক হলে আমি খুশি হব।
উত্তরমুছুনএর পর বাকিটুকু লেখার দায়িত্ব তোমার। সেটা আগষ্টের ১১ তারিখের পর।
মুছুনব্যাস, খেলাম কেসটা! ��
মুছুনব্যাস, খেলাম কেসটা! ��
মুছুনঅসাধারন
উত্তরমুছুনধন্যবাদ :)
মুছুনগতানুগতিক ভ্রমন বৃত্তান্ত ছেড়ে একটু অন্যরকম ভ্রমন কাহিনী ...... এই ধরণের লেখা সাধারনত চোখে পড়ে না । আমার অল্প পরীসর ঞ্জানে আমি এই ধরণের লেখা একমাত্র শঙ্কু মহারাজের ভ্রমন বৃত্তান্তে পড়েছি ...... খুব সুন্দর লেখা ..... দুর্দান্ত ।
উত্তরমুছুনএই খেয়েছে। শঙ্কু মহারাজ? রাজা প্রজায় তুলনা??
মুছুনEkuni r ekbar Darjeeling theke ghure elam mone hoche!!
উত্তরমুছুনদলবল নিয়ে একবার ২ দিনের জন্যে গেলে হয় কিন্তু
মুছুনএই লেখাটা একটু অন্যরকম। সহজ সরল তো বটেই, সে লেখকের ভাষার গুনে, কিন্তু যে ব্যাপারটা এখানে বার বার প্রকাশ পেয়েছে তা হল লেখকের চট জলদি মনোভাবের প্রকাশ দ্বিচারিতা ছাড়াই। । কিছুদিন আগে ঋতুপর্ণ ঘোষের ফার্স্ট পার্সন বইটা পড়ছিলাম, সেখানে এই ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলাম বার বার। লেখকের খোলা মেলা মন্তব্য পরিবেশ বুঝতে এবং সেই নিরিখে জায়গার গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করে। উদাহরণ স্বরূপ কিছু লোকের আলোচনা (পূজো মার্কেটিং, বাচ্ছার বাঁদরামো, নেলপলিশের শেড, ...) ও পাশাপাশি আবেশময় নরম মেঘ ডোবা স্বপ্নিল পরিবেশ।
উত্তরমুছুনআর একটা ব্যাপার এখানে অনন্য। তা হল দার্জিলিংনামা ও বাঙালীর চিরাচরিত ভ্রমণ অনুভব কে পাশাপাশি রেখেও সাবলীল চলাচল। যেন লেখার গুনেই পাঠক মেঘমুলুকে ঝাপসা পথে...পড়বেন যা অনেক সিনেমা গল্প কবিতার ভিড়ে কদিন পরেই স্থান করে নিলেও এবং এই লেখা শুরুতে লেখক ই সেটা আপনাকে মনে করিয়ে দেবে। তাই একসাথে সাহস ও বিশ্বাস। তাই অনন্য।
উপন্যাসে কিছু উপ-গল্প থাকে যা উপন্যাসের ভিত্তি এবং বিস্তার দুই ই গভীর করে। ভ্রমণ নিয়ে লেখাতে থাকে খুব ই ছোট ছোট পথ চলতি ঘটনা। এখানেও লেখক তাই করেছেন। কিন্তু আর একটা কাজ করেছেন যেটা নিয়ে একটু বলা দরকার। তা হল লেখকের নিজের তোলা ছবি গুল। প্রতিটা ছবি এখানে এক একটা উপ-গল্পের উপস্থাপনা করছে যেন। তাই উপন্যাসের কথা বলছিলাম প্রথমেই।
তাই কি জানি এই ভ্রমণ হয়ত শুধু ভূমিকা ...।।
কি আর বলি? এত সুন্দর সুন্দর মন্তব্য দেখে, আরো লেখার উৎসাহ পাই। তবে এই লেখায় দু এক খানা তথ্যগত ভুল রয়েছে। সেগুলো আজ রাতের মধ্যেই শুধরে দেবার চেষ্টা করব।
মুছুনEto asto darjeeling chokher samne uthe elo.. darun darun darun...
উত্তরমুছুনতবুও নিজে পড়তে গিয়ে দেখছি অনেক অনেক কিছু বাদ পড়ে গেছে
মুছুনsatty kotha bolte ki....bhromon kahini porte amr bises bhalo lage na! abr kichu kichu bhromon kahinite asol jaygar kothar theke besi anusangik ghotonar biboroni besi thake!
উত্তরমুছুনEi lekhata kmn hoiche seta amr alada kore bolar opekkha rakhe na! sudhu ei tukui bolbo jodi Darjeeling jai tmr ei lekhar printout niye jabo ar protita jayga ja ja tumi dekhecho, segulo obossoi dekhbo
Ar ekta kotha..prothom chobita tulonahin...
কি জানি, এখন আস্তে আস্তে মনে হছহে অনেক কিছহুই বাদ পরে গেছে। যেগুল লেখার ছিলো। :) হে হে...
মুছুনদাদা...শেষমেশ পাপ করিয়েই ছাড়লে...ভেবেছিলুম বাড়ী ফিরে শোওয়ার আগে কম্বলের ওম নিতে নিতে লেখাটা জমিয়ে পড়ব...কিন্তু এখানে সমস্ত কাজ ফেলে ...এক নিশ্বাসে পড়লাম আর স্মৃৃতি হাতরে মেঘমুলুকের আনাচে কানাচে তোমার সাথে হাটলাম
উত্তরমুছুনপাপ যদি বলো, তা হলো লোভে, আর লোভ তো সব দার্জিলিং এ :-)
মুছুনAsadhron... Amar pora onnotomo sera darjeeling niye lekha.
উত্তরমুছুনধন্যবাদ দিয়ে পোষাকি কথায় ঢুকতে চাইনা। তবে এরকম উৎসাহ পেলে লিখতে খুব ভাল লাগে।
মুছুনAsadharon
উত্তরমুছুন