মাঝরাতে দেখি ফোকরটা
খ্যাঁক খ্যাঁক করে খ্যাঁকশেয়ালের মত হাসছে। একেই গরমের চোটে পিত্তি চটকে চৌঁতিরিশ
হয়ে আছে, ঘুমের দফারফা, তার ওপরে বিটকেল গা জ্বালানে হাসি। এখনো ফোকরটা যে টিঁকে আছে,
সেটাই আশ্চয্যি। সেই ছোটোবেলায় আমাদের খেলার মাঠ, আর তার ধারে ইঁটের পাঁচিল, আর পাঁচিলের
গায়ে কাঠচাঁপা গাছের পেছনের সেই ফোকরটা। আমি খেলতে নেমে কিছু ছড়িয়ে ফেললেই খ্যাঁক
খ্যাঁক করে গা-জ্বালানি হাসতো আর টিটকিরি দিতো।
ধ্যাত্তেরিকা। উঠেই পড়লুম। ঘাড়ে মাথায় জল থাবড়ে, গলাতেও দু ঢোক ঢেলে ঘুমুতে এসে
দেখি আবার হাসছে। কি যন্তন্না মাইরি।
- হলো
কি তোর?হাসছিস কেন বল তো?
- তোকে
দেখে হাসি পাচ্ছে, কি ভুঁড়ি! লুঙ্গিটা যেন ল্যাঙট ... খিক্ খিক্
- তাতে
তোর বাপের কি?
- আমার
বাপ? চিনিস নাকি?
- বয়ে
গেছে। ঘুমুতে দে। কাল অফিস আছে
- আপিসে
কি করিস তা কি আর জানিনা? আদ্দেক কাজ একে, আদ্দেক কাজ ওকে, বাকি সময় চা-কফি-ভাট-ঝাড়ি.........
- আ-গেল-যা
!! কি চাই বলবি? মাঝরাতে এমন পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে এলি কেন?
- তোর
ভুঁড়ি দেখে বড্ড হাসি পাচ্চে মাইরি, কি করি বল? পোঁদ ঘুরিয়ে ওপাস ফিরে শুলি, ভুঁড়িটা দুলে উঠলো, আবার হাসি পেলো
- আবার???
- হাসি
দেখতে ভালো লাগেনা বুঝি? হাসি দেখলে রেগে যাস? নাঃ তুই আর বড় হলি না ...খিক্ খিক্।
- কে
বললো হাসি ভালো লাগেনা?
- তাহলে
খচে যাচ্চিস কেন?
- তোরটা
হাসি নয়, দাঁত ক্যালানো।
- ছোটোবেলায়
তুই বেশ হাসকুটে ছিলি কিন্তু। এখন শালা গোমড়াথেরিয়াম।
- উফ্।
ছোটোবেলায় চাদ্দিকটা অনেক খুশি খুশি ছিলো বে, এখনকার মত এরকম বাজে চাপ-চিন্তা ছিলোনা। এমন কি বেসিক ইস্কুলের
রাম-প্যাঁদানে সাধু স্যারকেও এখন দেবতুল্য লাগে জানিস!কত্ত আনন্দ ছিলো তখন !
- খুব
আনন্দ, তাই না?
- তখন
দুগগা পুজোয় প্যান্ডেলে বসে ক্যাপ ফাটানো যেত, মোহনবাগান বছরে তিন চারটে ট্রফি পেতো, ইসকুলে বেশির ভাগ পুরোনো বই এর সঙ্গে দু
এক খানা নতুন বইও পাওয়া যেত, পাড়ার মেয়ে গুলো কেমন লাজুক লাজুক ছিলো,
বাবার মাথায় কত চুল ছিলো, মা কত আদর করত, মে দিবসে কি সুন্দর গনসঙ্গীত বাজত,
বছরে দু তিন বার ছোটোমামু আসত, পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তী হতো, আনন্দমেলায় টিনটিন
বেরুতো।
- তোর
মনে আছে ছোটোমামুকে?
কুব্ কুব্ করে একটা
পাখি ডাকছে। রাত জাগা পাখি এরকম মায়া মায়া ডাক ডাকেনা। গরমের ছুটির দুক্কুরবেলা ডাকে।
ডাকত। আর জানলার ধারে বসে বসে বই পড়তুম আর শুনতে পেতুম। অমর চিত্রকথা। ম্যানড্রেক, অরন্যদেব, আনন্দমেলা। সব মনে আছে।
মনে থাকবে না? মায়ের মুখে কতবার শুনেছি জম্মের সময়কার গল্প। অমর কুমার রায়,
ছোটোমামু। যেবার ঠাকুমা অমরনাথ ঘুরে এলো, সে বচ্ছরেই ধরাধামে পা রাখলুম আমি। বড়
নাতি। ঠাকুমা সখ করে নাম রাখতে গেলো অমরনাথ। কিন্তু রন্টুবাবু, মানে আমার ছোটোমামু
আগেই অমর হয়ে বসে রয়েছেন। তাই এ জম্মে আমার আর অমরত্ব লাভ হলোনা। মা হলো গে বাড়ির সক্কলের
ছোটো। ওপরে পাঁচ দাদা। বড়মামু যেন রয়াল বেঙ্গল টাইগার। তেমনই তর্জন-গর্জন, হাঁক-ডাক।
ব্রিটিশ আমলে মোহনবাগান-মহামেডান খেলা ড্র হওয়াতে নাকি কোন মিঞাকে ধরে পিট্টিও
দিয়েছেন (স্বগতোক্তি। বাড়ির বেড়ালটাকে পর্যন্ত কখনো চটি ছুঁড়ে মারেন নি)। ফ্রিকিক
মানেই মান্না। থ্রু-পাস মানেই কুমার বাবু। আপিস থেকে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরলে
মহিলামহল তঠস্থ। দিদিমা পয্যন্ত। রাস্তা থেকে গলা পেলেই তাবৎ লেন্ডিগেন্ডি
তাড়াতাড়ি মন দিয়ে পড়তে বসে যাবে। টিভিতে চিত্রহার দেখার জন্যে ছোড়দি, দালানে
দাঁড়িয়ে এক গেলাস জল খাবে ২৫ মিনিট ধরে আর উঁকি মেরে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকবে। কিন্তু
সামনে যাবে কে? বড়র পরে মেজো, তার পরে আরো দুই। শেষে ছোটোমামু। তবে সিনিয়রিটির
সঙ্গে বাঘত্বটাও ফিকে হতে শুরু করে মামাদের মধ্যে। করে করে ছোটোমামু হাসমুখলাল,
সদাসর্বদা। আর আমার মা একটু ছিঁচকাঁদুনি। ছোটো হলে যা হয় আর কি। মামাবাড়ির
পার্থসারথী নাম ছোটোমামুরই দেওয়া। ছোটোমামুর সব কিছুই কি ভালো, কি সুন্দর, কি
লোভনীয়! আলমারিতে কি সুন্দর গন্ধ। কি সুন্দর সুন্দর সব জামা। ছোটোবেলায় তো কাকে
কেমন দেখতে অত খেয়াল থাকেনা। বড় হয়ে দেখেছি, ছোটোমামু অসম্ভব সুদর্শন একজন মানুষ।
আর খুব সৌখিন। পরিপাটি। বড্ড আপন আপন।
- পাউরুটি
খাওয়াটা বললি না?
- আমারটা
না ছোটোমামুর?
- নরানাং
মাতুলক্রম। ছোটোমামুরটাই বল।
- হারামজাদা
সমস্কৃত ফলাচ্চিস? জানিস না আমি সেভেনে হাফইয়ার্লিতে সমস্কৃতয় পঞ্চাশে ১১
পেয়েছিলুম?
- পরের
বার তো মায়ের ঠ্যাঙানি খেয়ে পাশ করে গেলি...... খিক্ খিক্...।
- রোজ
রাত্তিরে ছোটোমামুর খাওয়া ছিলো পাউরুটি আর দুটো রসগোল্লা। খালি গায়ে লাল মেঝেতে
বসে খেতো, আর বলত এই পঁয়তাল্লিস হাজার পাউন্ড পাউরুটি খাওয়া হয়ে গেল। কি পঞ্চাস।
- তুই ও
ভাগ পেতিস, সেটা চেপে যাস না।
- মামারবাড়ি
গেলে, রাত্তির বেলা ছোটোমামু আমার জন্যে কত কি আনত জানিস? শুধু ভাগ পাওয়া না। এমন
কি বাইরে নিয়ে গিয়েও ঢাকাই পরোটা, মোগলাই, কবিরাজি আর ...
- শুধুই
খাওয়া?
- আরে
ছোটোমামুর আনকো নতুন কত্ত টি-শার্ট যে আমাকে দিয়ে দিয়েছে! তখন অবশ্য টি শার্ট কথাটা
শিখিনি, জামা ছাড়া বাকি সব কিছুই তখন গেঞ্জি।
থাকতুম এক মফস্বলে।
ইলেকট্রিক ছিলো বটে, পাকা বাড়িও। পিচের রাস্তাও ছিলো। দস্তুর মত শহুরে নামডাক সবই
ছিলো। ম্যাগি পাওয়া যেত উমাচরন কর্মকারের মুদিখানার দোকানে। ভদ্দরলোকের প্রচুর
মুদিখানা ছিলো ততদিন, যতদিন না জানতে পারলুম, উমাচরন কর্মকার দোকানের মালিক নয়,
দাঁড়িপাল্লাওয়ালা। এত কিছুর পরেও গাঁ-গেরামের গন্ধ যেত না গা থেকে। সেখানে ধু ধু
কচ্চে ধান ক্ষেত, নীল নীল শুশুনিয়া পাহাড়, খালের জলে ঝপাং ঝপাং, দামোদর নদ, খড়ের
চালা বাড়ি, গরু, শিরিষ ফুল, বিচুলি আর গোবরের গন্ধ। আর যে টুকু গাঁইয়াপনার বাকি
থাকত, সেটুকু শহুরে ভাইবোনেরা পুরো করে দিতো। হাঁদুর মতো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে
থাকতুম সেই চরিচাপুটি কথার সামনে। শুধু ছোটোমামুর দেওয়া জামাপত্তর গুলো আমাকে
কিছুটা শহুরে করে দিতো। পূজোর ঠিক আগে, হাতে চাট্টে প্যাকেট ঝুলিয়ে আমাদের বাড়ি
হাজির হয়ে যেত ছোটোমামু। আর ছোটোমামুকে জড়িয়ে ধরলেই সেই কলকাতা কলকাতা গন্ধটা
পেতুম। বাবা কোনো দিন শৌখিনতার ধারধারেনি, কিন্তু ছোটোমামু কত কি যে দেখাতো।
আফটারশেভ, পারফিউম। কি সুন্দর গন্ধ। আমি একদিন মেখে ইস্কুলেও গিয়েছিলুম। ক্লাস
সুদ্দু ছেলে আমার জামায় নাক ঠেকিয়ে শুঁকচে। আর ছোটোমামু আসা মানেই খাওয়াদাওয়া।
বাজার থেকে মাংস আসত, মাছ আসত, পাউরুটি, ডিম, কেক। আর নিজেই খুন্তি হাতে তোয়ালে
পরে রান্নাবান্না করত। মায়ের তখন ছুটি ছুটি ছুটি।
- বিরিয়ানি
করে খাইয়েছিলো মনে আছে তোর? তখনো বিরিয়ানি কি, সেটাই আদ্দেক লোকে জানতোনা
- ওরেব্বাবা,
সে আর মনে নেই? তখন আমি উঁচু ক্লাস। কি অদ্ভুত লেগেছিলো, মনে হয়েছিলো এত ভালো কিছু
খেতে হতে পারে? তার আগে পর্যন্ত আমার খাওয়া সেরা খাবার জিনিস ছিলো মোগলাই পরোটা।
- শালা
তোকে লোকে গেঁয়ো বলবে না?
- ধুস,
খেতে চাইলে পাবো কোথায়? বাইরে খাওয়ার ব্যাপার ছিলোই না আমাদের ছোটোবেলায়। থাকবে
কোত্থেকে? হোটেল রেস্টুরেন্ট কিস্যু ছিলোনা
- ওটা
রেস্তোরাঁ।
- ওই
হলো। ক্লাস সিক্সে উঠে এ বি সি ডি শিখলুম। রেস্টুরেন্ট বলেচি এই না কত, উনি এলেন
ফরাসি মারাতে। জানিস আমার কত কষ্ট হতো মনে? যখন শহুরে খাওয়াদাওয়ার গল্প শুনতুম?
- শুধু
তাইতেই কষ্ট হতো?
- না রে।
আরো কত কি যে...! মোহনবাগান হেরে গেলে কষ্ট। বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে
নিয়ে যাচ্ছে দেখে কষ্ট। বাংলায় বারো পেয়ে কষ্ট। চোখে চশমা উঠে ফুটবলার না হতে
পারার কষ্ট। আমাকে মেরে মায়ের কাঁদতে বসা দেখে কষ্ট। আমার “মহাসংকটে শঙ্কু” কেউ ঝেড়ে
দেওয়ার কষ্ট। সেই সরস্বতী পূজোর দিনে দেখা ওপাড়ার মেয়েটা আমার আর একটা বন্ধুর সঙ্গে
প্রেম করে জেনে কষ্ট। শালা এত তরিবত করে লেখা চিঠিটাও কি করে মায়ের হাতে চলে গেলো।
হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট বেরোনোর দিন নিজের মার্কশিট না আসার কষ্ট। কষ্ট হবে না?
ছোটোমামু চাকরি করত। দে’জ
মেডিক্যালে। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির ওদিকে, বন্ডেল গেটের ওদিকে অফিস। একলা মানুষ দিব্যি
চলে যেত। ছোটোমামুর বিয়ে হলো, আমাদের খুব আনন্দ। তখন বোধহয় ক্লাস এইটে পড়ি। ছোটোমাইমা
এলো। মাইডিয়ার মানুষ। আরো আনন্দ। আরো কিছু দিন পেরোচ্ছে। পড়ার চাপে কিছু দেখতে
পাইনা। কোদ্দিয়ে সব বছর গুলো কেটে গেলো কে জানে বাপু। ইস্কুল কলেজ পেরিয়ে, দোরে
দোরে ঘুরে শুকতলা ক্ষইয়ে প্রথম চাকরির মাইনে পেয়ে যখন দু দন্ড বসে ভাবতে গেলুম, দেখি
চার পাশের লোক গুলো কত্ত বদলে গেছে। আদ্দেক মাথা সাদা, কেমন বুড়োটে মেরে গেছে।
ছোটোমামুও। কয়েক বছরের তফাতে চাকরি থেকে অবসরের দিনও এসে গেল বাবার, ছোটোমামুর।
একদম একবয়সি কিনা। কাজের দাপটে এদিক ওদিক দেখতে পাইনি অনেক দিন।
- তোকে
কিন্তু তোর ছোটোমামু সেই ছোটোবেলার মতই ভালোবাসত
- তা
বাসতো। তোর মনে আছে ফোকর? সেই পরোটার গল্প?
- হে
হে, যত পেটুকপোনা তোদের। মনে নেই আর?
- পরোটা
আর মাংস। কোনো এক দিন ছোটোমামু আর আমি মাংস নিয়ে চলে আসবো বালিগঞ্জ ধাবা থেকে। লাল
লাল, তেলওলা। আর পরোটা বাড়িতে ভাজা হবে।
- আর
সেই ইলিস মাছ?
- উফ্
আর বলিসনি মাইরি। এখনো জিভে জল আসে শুনলে। কালিবাবুর বাজারে রতিকান্তর থেকে সক্কাল সক্কাল ইয়াব্বড় ইলিস আনা হবে। ভাজা, তেল মেখে কাঁচালঙ্কা দিয়ে গরম ভাত, আর
তার পরে ভাপা, কিম্বা দই ইলিস......।
কবিরাজি কাটলেট, ঢাকাই
পরোটা পেরিয়ে কলকাতায় এখন বড্ড বেশি মাল্টিকুইজিন ব্যাপার স্যাপার। খেতে যাও,
দেখবে সব ব্যাটার মেনু কার্ডে ৯০% আইটেম কমন। উত্তর আর দক্ষিন কলকাতায় কিম্বা
হাওড়ায় অলোকা সিনেমার পাশে নারায়নি রেস্তোরাঁর কাটলেটে কত পার্থক্য। সবাই নিজের
নিজের মত, অথচ কি ভালো! মাল্টিকুইজিন এসে সেই পাড়ার গেরাম্ভারি খাবার দোকান
গুলোর সব্বনাশ করে দিলে একেবারে। ঝাঁ চকচকে ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্সের রাস্তায়
জষ্টিমাসের দুপুরে ঠাঠা রোদ্দুরে দেখি একখানা ময়লা জামা আর ততধিক ময়লা প্যান্ট পরে
হাওয়াই চটি পায়ে শীর্নকায় ছোটোমামু দাঁড়িয়ে আছে। “কি গো? কি কচ্চো এখানে? এই ভরদুপুরবেলা
রোদ্দুরে?”। সেই এক গাল অমলিন হাসি। কে বললে ব্যাঙ্কে, কোম্পানির কাগজে, আলমারিতে,
মানিব্যাগে ধনদৌলত থাকে মানুষের? ওই হাসিতেই হাজার কুবেরের ভান্ডার ফেল পড়ে যায়। “অনেক
বড় হবি তুই বাবু, অনেক উন্নতি করবি, মানুষ হবি, সবাই কে বলি তোর কথা”। মাথায় হাত
বুলিয়ে বলে চলে বুড়ো মানুষটা। চাদ্দিকে চেয়ে দেখি কোলিগরা সব দেখচে। নজ্জা নজ্জা
করে। তাড়াতাড়ি কাজের বাহানা দিয়ে সরে পড়ি। অনেক পরে মনে পড়লো, এক ভাঁড় চা ও
জিজ্ঞেস করলুম না।
- ডাক্তার
তো বললে খেটে খেটে কিচ্ছুটি রাখেনি শরীরের
- জানিস
ফোকর, আমরা কেউ বুঝতেও পারিনি মানুষটা এই ভাবে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। বলত বটে আর
পারিনা, পিঠে ব্যাথা, বুকে যন্ত্রনা। গা করিনি। কোথায় কোথায় ঘুরতো সারা দিন খাওয়া
নেই দাওয়া নেই।
- কি
করবে বল? খেতে তো হবে, ছেলেটাকে মানুষ তো করতে হবে। বড্ড ভালোবাসা বাপ-ছেলেতে।
- কিছু
বলেনি জানিস? আমি কি পর? কেউ না আমি? কষ্ট হয় না?
- আপন
যদি হবি রে শালা, তাহলে বুঝতে পারলিনা কেন মানুষটা ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে?
- চুপ কর
আপদ, একটা কথা বলবিনা আর। ওই যে হাসি মুখ, ওই যে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলত “তোকে
নিয়ে আমার বড্ড গর্ব রে...” ওইতেই তো ভাবতাম বুঝি......
সে দিনটা বড্ড গরম।
ডাক্তার বললে “ভালো বুঝছিনা ভাই”। বললে হাড়ের ভেতর থেকে মজ্জা বের করে পরীক্ষা
করবে। ছোটোমামু বললে “বড্ড লাগে রে। শুনেছি”। লাগলে আর কি হবে? কত লাগল, কত
যন্তন্না পেলো, কেউ কি কোনো দিন শুনেছে সেসব, যে আমি তার এক মাত্তর ভাগ্নে হয়ে শুনতে
যাবো। হলো পরীক্ষা। কি সব বিদঘুটে দাঁতভাঙ্গা ডাক্তারি নাম ধাম লেখা একটা কাগজ
পাওয়া গেল রায়-ত্রিবেদী থেকে। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে মুখটা বাংলার পাঁচের মত করে
অনেক কিছু বললে। খুব একটা কিছু বুঝলুম না। শুধু বোঝা গেল ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে
বহুদুর। খুব সম্ভবতঃ আর কিছু করার নেই। “করার নেই মানে? বসে বসে দেখবো নাকি?”। ডাক্তারের
পরামর্শেই ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ তো। কাজের বাড়ি সবার খাওয়া
দাওয়া হলে সকলের শেষে এঁটো-কাঁটা কুড়িয়ে তার পরে নিজে একা একা খেতে বসতে দেখেছি
চিরকাল। এর ওর তার কাজ যেচে নিজে করে দেওয়ায় অদ্ভুত আনন্দ শ্রীযুক্ত অমর কুমার
রায়ের। মাত্র ৬ দিন থাকার পর, সাত দিনের দিন, শনিবারের ভোর বেলা তিনি টাটা বাই বাই
বলে চলে গেলেন। মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম হাসপাতাল থেকে।
- ইলিস
মাছ, গরম ভাত, পরোটা, লাল লাল – তেল তেল মাংস, কিস্যুটি হলোনা রে ফোকর। কিছু
বুঝতেই দিলো না।
ছোটোমামুর বোধহয় আমার
ওপর বড্ড অভিমান। একবার হাসিটা সরিয়ে রেখে সত্যি সত্যি বলতো যদি.........।ফোকর একঘেঁয়ে
খনখনে গলায় বলে চলল -
- পারলি না তো? হেরে গেলি। হেরো... হেরো... হেরো...
স্বনির্ভর, স্বাধীন একজন মানুষ, অন্যের আনন্দে যার তৃপ্তি, এটাই তার জীবনের স্বাভাবিক রাস্তা। আর, হার হল কই? এই লেখাটা তো রইল, তাই না?
উত্তরমুছুনকেমন জানি মনে হয়, অভিমান ছিলোই। সেইটাই হার।
উত্তরমুছুনলেখাটা পড়ে অনেকদিন পর আবার শ্যাম্নগরে যেতে ইচ্ছা করছে, যেখানে আমার দেশের বাড়ী আর যেখানে বছরপাচেক আগে অবধি আমি প্রতি শনি-রোববারেই যেতাম।
উত্তরমুছুনআর অন্য ব্যাপারটা নিয়ে বলতে পারি, কিছু জিনিষ আমাদের হাতে থাকে না। থাকলে নিজের বাবাকে শেষ ২ বছরে এমন অবস্থা হওয়ার ব্যাপারটা শুধুই দেখতাম না হয়ত, বদলানোর চেষ্টা করতাম!!
ওই তো হয়। যা আছে, সেটা যতক্ষন ঠিক আছে, খেয়াল করিনা। কিন্তু তার পর, বড্ড দেরি হয়ে যায়
মুছুনএইটাই, যতক্ষণ ঠিক আছে, খেয়াল করিনা। তারপর, দেরি হয়ে যায় কিনা বলতে পারব না। ঠিক জানিনা, তারপর কি হয়।
মুছুনএই ফোকর সবার জীবনেই আছে হয়তো ..... পুরনো অনেক কিছুই মনে পরে গেল .... এক অদ্ভুত আবেশে মনটা ভরে গেল
উত্তরমুছুনএ ফোকর সবার আছে। আমাদের ই আরেকটা মুখ
মুছুনপ্রতিদিন একটু একটু করে পুড়ে যাচ্ছে সব
উত্তরমুছুনফাঁকা রাস্তা খেয়া ঘাট ছোট একটা ঘর
অর্থহীন নিঃসাড় হয়ে বিবর্ণ পট।
এরকম কমেন্ট পেলে কিন্তু রাত জেগে লেখা শুরু করব। তখন আমায় থামায় কে??
মুছুনspeachless
উত্তরমুছুনএরকম বোধহয় সবার ই কিছুনা কিছু স্মৃতি আছে।
মুছুনআহা, মন ভরে গেল। :)
উত্তরমুছুনএই সব লিখতে মোটে ভালো লাগেনা। যদি আনন্দ পাই, তো সে উদ্ভুট্টে সিরিজ লিখে।
মুছুনerokom chhoto chhoto guilt bodhoy sobar modhyei lukiye ache....khub hridoy-chhNoa ei lekhata....
উত্তরমুছুনঠিক। মনে হয় সবাই আমরা এই রকম কিছু বয়ে বেড়াই।
মুছুনএকটু সময় নিয়ে পডব ভেবে এতদিন লেগে গেল।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এতদিন কেন পডিনি।এমন কিছু মানুষ বোধহয় আমাদের সবার জীবনেই আছেন যারা শুধু দিয়েই যান চান না কিছুই।আর তাদের জন্য কিছু না করতে পারার আক্ষেপ টা থেকেই যায়
উত্তরমুছুনঠিক বলেছ পারমিতা। আক্ষেপ থেকে যায় বড়
মুছুনমারাত্মক লেখা রে। ..... অনেক আগে শেয়ার করেছিলি - কিন্তু সময়ের অভাবে পড়া হয়ে ওঠে নি....
উত্তরমুছুনমনটা খুব গুমোট মেরে গেল..... তোর কলমের জোর ছাড়া আর কিছুই নয়।
-সুদীপ