মীন কথাটা সংস্কৃত। আমরা
বাংলায় খুব একটা ব্যবহার করি না। কেবল মনে পড়ছে “পদ্মা নদীর মাঝি” উপন্যাসে মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন পদ্মা তার মীন সন্তান দের নিজের গর্ভে লুকিয়ে রাখে।
কথাটা ইলিস নিয়ে বলা। তবে কিনা মীন মানে হলো মাছ। সব মাছই মীন। তবে এইবারে যে
রান্নার কথা বলছি, সেটা বাংলার রান্না নয়। মালয়ালি রান্না, আর খুবই সাধারন পদ। মীন মানে
মাছ, আর মইলি হলো গিয়ে ঝোল। অর্থাৎ মাছের ঝোল।
আমাদের যেমন পশ্চিম আর পূব বাংলায় মাছের ঝোল সম্পূর্ন আলাদা দুটো পদ (কেবল নামটাই এক, রান্নার ধরন ও ব্যবহার পুরোপুরি আলাদা – আমার দুটোই ভালো লাগে), কেরালাতেও তেমনই অঞ্চলভেদে মীন মইলির স্বাদের বিস্তর পার্থক্য আছে। আমাকে যিনি মীন মইলির রহস্য শিখিয়েছিলেন, তিনি আগেই বলে নিয়েছিলেন, এ হলো তাঁর মায়ের বাপের বাড়ির দিককার রান্নার ধরন। তাঁর বাবার দিকে একটু অন্য ভাবে রান্নাটা হয়।
আমাদের যেমন পশ্চিম আর পূব বাংলায় মাছের ঝোল সম্পূর্ন আলাদা দুটো পদ (কেবল নামটাই এক, রান্নার ধরন ও ব্যবহার পুরোপুরি আলাদা – আমার দুটোই ভালো লাগে), কেরালাতেও তেমনই অঞ্চলভেদে মীন মইলির স্বাদের বিস্তর পার্থক্য আছে। আমাকে যিনি মীন মইলির রহস্য শিখিয়েছিলেন, তিনি আগেই বলে নিয়েছিলেন, এ হলো তাঁর মায়ের বাপের বাড়ির দিককার রান্নার ধরন। তাঁর বাবার দিকে একটু অন্য ভাবে রান্নাটা হয়।
বাঙালি জিভের কথা ভেবে, আমি
পাকপ্রনালীতে একটা পরিবর্তন করেছি। আর সেটার জন্যে আমি মালয়ালিদের কাছে ক্ষমা
প্রার্থী। রান্নাটা হয় নারকোল তেল দিয়ে। কিন্তু আমার জ্ঞানতঃ নারকোল তেল দিয়ে
রান্না করলে, সে রান্না বাঙালিরা পছন্দ করবেন না। তাই আমি সাধারন সাদা তেল দিয়েই রান্না
করতে বলছি। দু এক বার রান্না করে, মোটামুটি স্বাদটা ধাতে এলে, একবার নারকোল তেল
দিয়ে রান্নাটা করে দেখতে পারেন। আর যাই হোক ফেলে দেবার মত হবে না, আর আপনি খাস
কেরালার ১০০% স্বাদটাও পাবেন। যাই হোক এবারে প্রনালীতে ঢুকি।
উপকরন
মাছ ৫০০ গ্রাম। কেরালায় এই
রান্না করা হয় টাইগার ফিস দিয়ে। কখনো পম্ফ্রেট দিয়েও করা হয়। টাইগার ফিস বাংলায়
পাবেন না। প্রবাসীরা দেখতে পারেন যদি টাইগার ফিস পান। নাহলে পম্ফ্রেট ব্যবহার
করতে পারেন। আমি একটু ঝুঁকি নিয়ে আড় মাছ দিয়ে রেঁধে দেখেছি। দুর্দান্ত উৎরেছে
রান্নাটা। মোদ্দা কথা এমন মাছ নেবেন, যাতে কাঁটা তেমন নেই। পোনা মাছ দিয়ে এ
রান্নাটা একেবারেই হবে না। মাছ মোটামুটি ৫০ গ্রাম ওজনের টুকরো করে নিতে হবে। পম্ফ্রেট
মাছ নিলে, একটু বড় আকারের নেবেন, যেন টুকরো করা যায় ঠিকঠাক।
একটা গোটা নারকোল (ছোটো
আকারের)। দু খানা বড় পেঁয়াজ, ১ ইঞ্চি পরিমান আদা, ৫-৬ টা কাঁচা লঙ্কা, একটা টমেটো,
কারি পাতার ৩ খানা কাঠি (মানে ৩ টে কারি পাতার কাঠি থেকে গোটা ৩০ পাতা বেরোবে) দু চামচ
গোলমরিচ গুঁড়ো, আধ ইঞ্চি দারচিনি, ৭-৮ টা লবঙ্গ, দু চামচ ভিনিগার, দেড় চামচ কালো
সর্ষে, এক চামচ হলুদ, এক চামচ লঙ্কা গুঁড়ো আর কিছুটা সাদা তেল।
প্রস্তুতি
মাছে নুন হলুদ আর ভিনিগার
ভালো করে মাখিয়ে ২৫-৩০ মিনিট রেখে দিন। একটা পরামর্শ , ভিনিগার বা লেবু দিয়ে
মাখানো কোনো বস্তু ধাতুর তৈরি পাত্রে না রাখাই ভালো। কাচের বাটি ব্যবহার করলে
সবচেয়ে ভালো।
পেঁয়াজ কেটে নিন সরু সরু
করে। আদা একেবারে মিহি করে কুচিয়ে নিন। তার পরে অল্প থেঁতো করে নিন, বা ছেঁচে নিন।
মানে, আদাটা বাটা হবে না, আবার কুচোনো ও হবেনা। মাঝামাঝি একটা ব্যাপার হবে। টমেটোটা
চার বা ছয় টুকরো করেনিন। রান্নার পরেও কিন্তু টমেটোটা মিশে যাবে না, আলাদা থাকবে। গোল মরিচ গুঁড়ো করে নিন। দারচিনিটা ভেঙ্গে নিন,
লবঙ্গ গুলোও ভেঙ্গে নিতে পারেন। তবে বাটা বা গুঁড়ো করা চলবে না।
এবারে আসি আসল কৌশলে। আর এই
কৌশল হলো নারকোলের ব্যবহার। এই জায়গাটা খুব ভালো করে খেয়াল রাখুন, কেননা মীন মইলির
স্বাদ-গন্ধ নির্ভর করে এই নারকোলের ব্যবহারের ওপরেই।
প্রথমে নারকোলটা কুরে নিন।
বাড়িতে কুরুনি না থাকলে সাঁস বের করে মিক্সিতে পিষে নিলেও চলে, তবে তাতে পরিশ্রম
বেশি। সাঁস বের করতে অনেক সময় কাল ঘাম ছুটে যায়। আধ লিটার মতো (একটু বেশি হলে ভালো
হয়) জল বেশ কষকষে করে গরম করে নিন। ঠিক ফোটার আগের অবস্থা। কোরা নারকোল একটা
পাত্রে রাখুন, আর গরম জলের ৩ ভাগের এক ভাগ নারকোল কোরার ওপরে ঢেলে দিন আর একটা
চামচ দিয়ে ভালো করে নাড়িয়ে মিশিয়ে নিন। তারপরে একটা ছাঁকনি দিয়ে জলটা ছেঁকে বের
করুন। এই নারকোলের দুধটা আলাদা করে রাখুন। এবারে বাকি জল দিয়ে আরো দু বার নারকোলের
দুধ বের করুন। আলাদা আলাদা পাত্রে রাখুন তিন ধরনের দুধ, কেননা তিন রকম দুধ দেখতেও
আলাদা আর তার ব্যবহার ও আলাদা হবে। প্রথম বারের দুধ সবচেয়ে ঘন, আর শেষের টা সব
চেয়ে পাতলা। এই ৩ টে আলাদা দুধ কে ঢাকা চাপা দিয়ে রাখুন। নারকোল কোরার আর দরকার
নেই, ওটা ফেলে দিতে পারেন। আপনার প্রস্তুতি শেষ, এবার রান্না।
রান্না
কড়ায় তেল দিন, মাছ গুলো খুব
হালকা করে ভাজুন। কেবল একটু কাঁচা ভাবটা কাটবে। পুরো রান্না হবে না। বেশি ভেজে
ফেললে কিন্তু মাছ শক্ত হয়ে যাবে।
মাছ গুলো আলাদা করে সরিয়ে
রাখুন। এবারে কড়ায় কুচোনো পেঁয়াজ দিন। কয়েক মিনিট রান্না হোক, পেঁয়াজ গুলো একটু
স্বচ্ছ হয়ে আসছে দেখলে কড়ায় সর্ষে আর কারি পাতা গুলো দিয়ে দিন। দু তিন বার খুন্তি
দিয়ে নাড়ুন। কারি পাতার গন্ধ বেরোচ্ছে দেখলেই (৩০ থেকে ৪৫ সেকেন্ড পর) আদা ছেঁচাটা
দিয়ে দিন। সঙ্গে টমেটো তা দিন। এক বার দুবার খুন্তি দিয়ে নেড়ে দিন। গোল মরিচ
গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো, দার চিনি আর লবঙ্গ দিয়ে দিন। এবারে আধ মিনিট পরে, তৃতীয় বারের
নারকোলের দুধ টা ঢেলে দিন, আর কাঁচা লঙ্কা গুলো দিন। মিশ্রনটা ফুটে উঠলে আঁচ
কিছুটা কমিয়ে দিন, কিন্তু একেবারে কমিয়ে দেবেন না। ১০-১২ মিনিট রান্না হোক। নুন
দিন কিছুটা, কারন ঝোল আকারে এখন বাড়ছে।
১০-১২ মিনিট পর, ভেজে রাখা
মাছ গুলো আস্তে আস্তে ঝোলের ওপর ছাড়ুন, আর তার পরে দ্বিতীয় বারের নারকোলের দুধ টা
ঢেলে দিন। মিশ্রন ফুটে উঠলে আঁচ কমিয়ে দিয়ে ৬-৭ মিনিট রান্না হতে দিন। এবারে প্রথম
বারের বের করা ঘন নারকোলের দুধ ঢেলে দিন। এক চামচ ভিনিগার দিন। ভালো করে মিশিয়ে
দিন, কিন্তু খেয়াল রাখবেন মাছ যেন ভেঙে না যায়। আর এবারে ঝোল ফুটে ওঠার ঠিক আগে
উনুন থেকে নামিয়ে ফেলুন। মীন মইলি তৈরি। এ রান্না খান ভাত দিয়ে। সাধারন বাড়িতে
রান্না ঝোল। মুঘলাই রান্নার তরিবত এতে নেই। কিন্তু খুব ঘরোয়া আর আপন আপন চেনা একটা
স্বাদ পাবেনই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন