ছাপোষা বাড়ির ছেলে। জীবনে কোনোদিন বিদেশ-বিভুঁই যাবার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। ছোটোবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে থ্রি-টায়ার স্লিপারে ভ্রমন ছিল সীমানা। কিন্তু ঘটনাচক্রে পেশাগত কারনে বিদেশ ভ্রমন করেছি পরবর্তি সময়ে। প্রথমবারের দুরু দুরু বক্ষে নিউ-ইয়র্কের মাটিতে পা রাখার স্মৃতি অক্ষয়। পরে আরো বেশ কয়েকবার দেশের বাইরে পা রেখেছি। কিন্তু প্রত্যেকবারেই কিছু না কিছু একটা গুবলেট আমি পাকিয়েই বসি।
এটা অবশ্য শুধু বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে নয়। যাঁরা আমাকে চেনেন, তাঁরা জানেন, সব ব্যাপারেই গন্ডগোল না পাকিয়ে আমি কিছু করতে পারি না। সেবার সান ফ্রানসিস্কোতে নেমেছি প্রায় মধ্যরাতে। গায়ে একটা হালকা টি-শার্ট। ক্যালিফোর্নিয়া চিরবসন্তের দেশ, এই ভেবে। কিন্তু আমার বসন্ত আর আমেরিকান ‘স্প্রিং’ এর মধ্যে যে প্রায় ৩০ ডিগ্রির তফাত (সেন্টিগ্রেডে মশায়, ফারেনহাইটে বলার মত আমেরিকান হতে পারিনি), সেটা আগে আন্দাজ করতে পারিনি। এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঠক্ঠক্ করে কাঁপছি ঠান্ডায়। আমার আগে একটা বড়সড় পরিবার। বোধহয় হিস্পানিক। এক গাদা কাচ্চা-বাচ্ছা আর মালপত্র সমেত সে এক মহা হুলুস্থুলু। এদিকে একটা ট্যাক্সিতে যাত্রিদের ওঠা শেষ না হলে পরের ট্যাক্সি কে লাইনের সামনে আসতে দেয়না এখানে। অবশেষে প্রায় দশ মিনিট পর ট্যাক্সিটা ছাড়লো। এবারে আমার পালা। যাবো অনেকটা দূর। ফ্রিমন্ট বলে একটা ছোট শহরে। সামনে এসে দাঁড়ালো একখানা পেল্লায় গাড়ি। আকারে – আকৃতি তে অনেকটা যেন আমাদের চেনা টয়োটা ইন্নোভার মতো। গাড়ির রং আর ছাদে লাগানো বোর্ড দেখে বুঝলুম এটা ট্যাক্সিই বটে। সামনের প্রি-পেইড বুথের ভেতর থেকে অতিকায় মধ্যবয়স্ক আফ্রিকান-আমেরিকান ভদ্রলোক হাত নেড়ে ঈশারা করলেন গাড়িতে উঠতে। দরজা খুলে ড্রাইভার নেমে এলেন। ইনিও মধ্যবয়স্ক। চেহারা দেখে কেমন জানি মনে হলো ইনি আদতে মধ্য বা পশ্চিম এশিয়া থেকে এসেছেন। অভিবাসী আমেরিকান। অবশ্য আজকের আমেরিকায় কে অভিবাসী নয়? আর ট্যাক্সি ড্রাইভারদের মধ্যে তো এটা আরো ভালো ভাবে বোঝা যায়। সাদা চামড়ার আমেরিকান, ট্যাক্সি চালাচ্ছেন এটা একটা বিরল দৃশ্য। গোটা আমেরিকায় দেখেছি ট্যাক্সি ড্রাইভারদের প্রায় সবাই এশিয়। এমনকি নিউ ইয়র্ক শহরে আপনি নিশ্চিন্তে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে পারেন। কেননা ওনারা প্রায় শতকরা আশি জন বাংলাদেশি। ইনি দেখলাম দৈর্ঘে – প্রস্থে আমার প্রায় দেড়গুন। গায়ের রং সোনালি গমের মত উজ্জ্বল। মুখে ঘন কালো গোঁফ দাড়ির জঙ্গল। দাড়ি প্রায় মর্মস্থল স্পর্শ করেছে। এক নজরে দেখেই মনে হয়, ইনি পশ্চিম এশিয়ার কোনো দেশের অধিবাসী। কিন্তু রিজ বিহীন খাড়া নাক, আর কলার কাঁদির মতো হাতের আঙ্গুল দেখে মনে হয় ইনি বোধহয় সেমিতি নন্। এনার গায়ে আর্য্য রক্ত বইছে। আবার খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যায় মুখে খুব অস্পস্ট একটা মঙ্গোলিয় ছাপ রয়েছে। ঠিক বুঝলাম না ইনি কোন দেশের লোক। আর আমেরিকার মতো সাড়েবত্রিশ ভাজার দেশে এসব নিয়ে মাথা ঘামায় কজন যে আমি শুধু শুধু এসব ভেবে মরি? ভদ্রলোক আমার স্যুটকেস টা ডিকি তে তুলতে সাহায্য করলেন। কথা বলার সময় লক্ষ্য করলুম ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ, তবে একটা টান আছে। কেমন যেন চেনা টান।
এটা অবশ্য শুধু বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে নয়। যাঁরা আমাকে চেনেন, তাঁরা জানেন, সব ব্যাপারেই গন্ডগোল না পাকিয়ে আমি কিছু করতে পারি না। সেবার সান ফ্রানসিস্কোতে নেমেছি প্রায় মধ্যরাতে। গায়ে একটা হালকা টি-শার্ট। ক্যালিফোর্নিয়া চিরবসন্তের দেশ, এই ভেবে। কিন্তু আমার বসন্ত আর আমেরিকান ‘স্প্রিং’ এর মধ্যে যে প্রায় ৩০ ডিগ্রির তফাত (সেন্টিগ্রেডে মশায়, ফারেনহাইটে বলার মত আমেরিকান হতে পারিনি), সেটা আগে আন্দাজ করতে পারিনি। এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঠক্ঠক্ করে কাঁপছি ঠান্ডায়। আমার আগে একটা বড়সড় পরিবার। বোধহয় হিস্পানিক। এক গাদা কাচ্চা-বাচ্ছা আর মালপত্র সমেত সে এক মহা হুলুস্থুলু। এদিকে একটা ট্যাক্সিতে যাত্রিদের ওঠা শেষ না হলে পরের ট্যাক্সি কে লাইনের সামনে আসতে দেয়না এখানে। অবশেষে প্রায় দশ মিনিট পর ট্যাক্সিটা ছাড়লো। এবারে আমার পালা। যাবো অনেকটা দূর। ফ্রিমন্ট বলে একটা ছোট শহরে। সামনে এসে দাঁড়ালো একখানা পেল্লায় গাড়ি। আকারে – আকৃতি তে অনেকটা যেন আমাদের চেনা টয়োটা ইন্নোভার মতো। গাড়ির রং আর ছাদে লাগানো বোর্ড দেখে বুঝলুম এটা ট্যাক্সিই বটে। সামনের প্রি-পেইড বুথের ভেতর থেকে অতিকায় মধ্যবয়স্ক আফ্রিকান-আমেরিকান ভদ্রলোক হাত নেড়ে ঈশারা করলেন গাড়িতে উঠতে। দরজা খুলে ড্রাইভার নেমে এলেন। ইনিও মধ্যবয়স্ক। চেহারা দেখে কেমন জানি মনে হলো ইনি আদতে মধ্য বা পশ্চিম এশিয়া থেকে এসেছেন। অভিবাসী আমেরিকান। অবশ্য আজকের আমেরিকায় কে অভিবাসী নয়? আর ট্যাক্সি ড্রাইভারদের মধ্যে তো এটা আরো ভালো ভাবে বোঝা যায়। সাদা চামড়ার আমেরিকান, ট্যাক্সি চালাচ্ছেন এটা একটা বিরল দৃশ্য। গোটা আমেরিকায় দেখেছি ট্যাক্সি ড্রাইভারদের প্রায় সবাই এশিয়। এমনকি নিউ ইয়র্ক শহরে আপনি নিশ্চিন্তে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে পারেন। কেননা ওনারা প্রায় শতকরা আশি জন বাংলাদেশি। ইনি দেখলাম দৈর্ঘে – প্রস্থে আমার প্রায় দেড়গুন। গায়ের রং সোনালি গমের মত উজ্জ্বল। মুখে ঘন কালো গোঁফ দাড়ির জঙ্গল। দাড়ি প্রায় মর্মস্থল স্পর্শ করেছে। এক নজরে দেখেই মনে হয়, ইনি পশ্চিম এশিয়ার কোনো দেশের অধিবাসী। কিন্তু রিজ বিহীন খাড়া নাক, আর কলার কাঁদির মতো হাতের আঙ্গুল দেখে মনে হয় ইনি বোধহয় সেমিতি নন্। এনার গায়ে আর্য্য রক্ত বইছে। আবার খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যায় মুখে খুব অস্পস্ট একটা মঙ্গোলিয় ছাপ রয়েছে। ঠিক বুঝলাম না ইনি কোন দেশের লোক। আর আমেরিকার মতো সাড়েবত্রিশ ভাজার দেশে এসব নিয়ে মাথা ঘামায় কজন যে আমি শুধু শুধু এসব ভেবে মরি? ভদ্রলোক আমার স্যুটকেস টা ডিকি তে তুলতে সাহায্য করলেন। কথা বলার সময় লক্ষ্য করলুম ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ, তবে একটা টান আছে। কেমন যেন চেনা টান।
এয়ারপোর্ট ও তার চারপাশের গোলোকধাঁধা পেরিয়ে একটু পরেই গাড়ি ফ্রি-ওয়ে ধরলো। এবারে মাথা না ঘুরিয়ে সামনের সিট থেকে প্রশ্ন এলো –
- কোথায় দেশ তোমার? ভারত না পাকিস্তান?
- ভারত।
- কোন শহর? ব্যাঙ্গালোর?
আউটসোর্সিং এর কল্যানে ব্যাঙ্গালোর নামটা আমেরিকায় সুপরিচিত। ‘Bangalored’ বলে একটা শব্দই তৈরি হয়ে গেছে। আর তার মানেটাও বিশেষ সুবিধের নয়। উপস্থিত এনার মনোভাব কি, সেটাও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিছুটা ইতস্তত করে উত্তর দিলুম।
- কলকাতা। (স্পস্ট মনে আছে, ক্যালক্যাটা বলিনি।)
- ও , কলকত্তা। এখানে ভারত থেকে যারাই আসে, বেশির ভাগ ব্যাঙ্গালোর নয়ত হায়দেরাবাদ থেকে।
এবারে আমার অবাক হবার পালা। কলকাতার এই উচ্চারন উপমহাদেশের বাইরে কেউ করে না। তবে কি ইনি পাকিস্তানি? মনে মনে ঝালিয়ে নিলুম , হিন্দি – পাকি ভাই ভাই, এত দূরে আমরা সবাই সমান, ইমরান খান দারুন খেলোয়াড়, এইসব। জিজ্ঞেস করলুম ও কোথা থেকে এসেছে।
- কাবুল। তুমি আফগানিস্থানের কথা জানো?
কি বলি একে? প্রায় প্রতিবেশি দেশ।‘কাবুলিওয়ালা’, ‘দেশে বিদেশে’, ‘বাবরের আত্মজীবনি’ , বামিয়ানের বুদ্ধ, জানিনা বলি কি করে? কিন্তু সত্যি কি চিনি আফগানিস্থান কে? কতটা চিনি? তালিবান, বামিয়ানের বুদ্ধ মুর্তি ধ্বংস, তোরা-বোরা গুহা, কি বলি একে?
- নিশ্চই জানি। অনেক শুনেছি তোমাদের দেশের কথা।
- কি শুনেছ? তালিবান? যুদ্ধ?
- না না, শুধু তাই নয়, মানে, শেষ কয়েক বছর তো...।
- জানি। আমরাও ওদেশের সম্পর্কে সেই সব ই শুনি আজকাল। এদেশে বসে আরো বেশি করে শুনি।
- আমি কিন্তু আফগানিস্থান সম্পর্কে খারাপ ধারনা রাখিনা। আমাদের দেশে, বিশেষ করে বাংলায় আফগানিস্থানের ওপরে অনেক বই আছে, এমন কি সিনেমা ও হয়েছে।
- জানি, ‘খুদাগাওয়াহ’ দেখেছি আমি। কিন্তু আসল আফগানিস্থান আনেক আলাদা।
- হিন্দি সিনেমায় অনেক কিছুই সাজিয়ে গুছিয়ে দেখায়।
- তবুও আমেরিকান দের থেকে অনেক ভালো দেখায়। আমার নাম মেরজাদ (বানান টা রোমান হরফে Meherzad)। তোমার নাম কি?
কথায় কথায় আমার গন্তব্যস্থল এসে গেল। হোটেলে আমাকে নামিয়ে দিয়ে মেরজাদ চলে গেল। যাবার সময় আমাকে ওর একটা কার্ড দিয়ে গেল। বলে গেল, ট্যাক্সি লাগলে যেন আমি ওকে একটা ফোন করি, ও চলে আসবে। ও এখানেই থাকে, ফ্রিমন্ট এ। হোটেলে ঢুকে মালপত্র নামিয়ে রেখে শুয়ে পড়লাম। ভোর হতে তখন আর বেশী বাকি নেই। পরের দিন থেকেই অফিসে কাজ শুরু করতে হলো। তারপর নানান কাজের চাপে ভুলেই গেছি মেরজাদ আর তার ট্যাক্সির কথা। এদেশে আমার জন্য যেটুকু টাকা পয়সা বরাদ্দ, তাতে করে খরচ করতে হয় খুব টিপে টিপে। বাস এবং ট্রেনে যাতায়াত করতাম। ট্যাক্সি চাপার সামর্থ্য ছিলোনা।
প্রায় দুসপ্তাহ কেটে গেছে। অফিস থেকে ফিরতে বেশ দেরী হয়েছে এক দিন। ট্রেনে করে ফ্রিমন্ট স্টেশনে এসে অপেক্ষা করছি বাসের জন্য। একটা বাস একটুর জন্য ফস্কেছি। পরের বাস আসবে ১ ঘণ্টা পরে। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। এখানে প্রায় কেঊই বাসে যাতায়াত করে না। শুধু যারা গাড়ি চালাতে পারেনা কোন কারনে, কিম্বা আমার মত লোকজন, তারাই বাসে চড়ে। অনেক সময় আমি একলাই যাত্রি হতাম বাসে। আর কেঊ থাকতোনা। বেশ রাত হয়েছে। কন্কনে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, তার ওপরে টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি পড়ছে। একলা বসে আছি, হঠাৎ দেখি মেরজাদ। স্টেশন থেকে বেরোচ্ছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো।
- এখানে কি করছ?
- বাসের জন্য অপেক্ষা করছি।
- এখনো হোটেলেই আছো?
- না না, একটা বাড়িতে উঠে গেছি। কাছেই।
- চলো, পৌঁছে দিচ্ছি।
- না না, চলে যাবো ঠিক। এখুনি বাস আসবে।
- তুমি যে বাসের জন্য অপেক্ষা করছ, ২১৩ নম্বর, সেটা আসতে এখনো ৪৫ মিনিটের ওপর দেরি আছে। চলে এসো, পৌঁছে দেব।
এর পরে না গেলে অভদ্রতা হয়। মনে মনে হিসেব করলুম, মোটা মুটি ১০-১৫ ডলার গচ্চা গেল।গাড়িতে উঠলাম। মেরজাদ বলল
- তুমি এখানকার কিছু দেখেছ এর মধ্যে?
- নাঃ, কিছু দেখা হয়নি।
- এখানে দেখার মধ্যে আছে একটা লেক। আর সান ফ্রানসিস্কো। লেকে যেতে গেলে স্টেশন থেকে ২১৫ নম্বর বাস ধরবে, সোজা পৌঁছে যাবে।
- নিশ্চই যাবো।
- জানো, এই ফ্রিমন্টে বেশ বড় একটা আফগান সম্প্রদায় আছে। আচ্ছা তুমি বই পড়ো? ‘কাইট রানার’ বলে কোনো বইএর নাম শুনেছ?
- না তো।
- বইটা খুব নাম করেছে। ওতে আমাদের কথা আছে। এখানকার এক ডাক্তারের লেখা। উনিও আফগান। খালেদ হুসেইনি। পড়ে দেখতে পারো।
নামার সময় মিটার দেখে ওকে ১২ ডলার দিলুম। শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেল মেরজাদ।
পরের দিন স্টেশন থেকে বেরোবার সময় ভালো করে চারিদিক দেখে নিলুম। মেরজাদ তার ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হয়নি তো? আবার ১২ ডলার খসাবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। বাড়িতে ফিরে দেখি হাঊসকিপারের কাছে আমার নামে একটা প্যাকেট দিয়ে গেছে কেউ। প্রথমটা একটু সন্দেহ হলো। কি আছে কে জানে এতে। খুলবো? যদি বোমা টোমা হয়? শেষে সাহস করে খুলেই ফেললুম। ভেতরে একটা বই। ‘কাইট রানার’। হঠাৎ খুব ভালো লাগলো। কোন দূর দেশে, প্রায় অচেনা কেউ একটা উপহার রেখে গেছে। সেই রাত্রেই বই টা পড়তে শুরু করলুম। ট্রেনে যেতে যেতে রোজ পড়তুম। ওখানে দেখতুম লোকে ট্রেনে উঠলেই বই পড়তে শুরু করে। তা সে যে কোনো বই ই হোক। এমনকি ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও পড়তে দেখেছি। কয়েক দিন লাগলো বইটা শেষ করতে। শনিবার মেরজাদ কে ফোন করলুম। প্রথমেই প্রশ্ন করলো কেমন লেগেছে। বললুম খুব ভালো লেগেছে। আমার এই লেখা যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের অনেকেই নিশ্চই ‘কাইট রানার’ পড়েছেন। আর যাঁরা পড়েননি, তাঁরাও সময় সুযোগ করে বইটা পড়ে নেবেন। পরে ভেবেছিলুম বই এর দামটা ওকে দিয়ে দেবো, কিন্তু একটা সঙ্কোচ হলো। মনে হলো এটা দিতে গেলে লোকটার খারাপ লাগবে। তাই আর দেওয়া হয়নি। বেশ দাম ছিল বইটার। আমার যতদুর মনে পড়ে, ১৫ ডলার। খুব খারাপ লাগছে বলতে, দেশে ফেরার সময় সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে বইটা হারিয়ে ফেলি। তার বহুমাস বাদে, দেশে এই কয়েকদিন আগে টিভি তে দেখলাম ওই বইটা নিয়ে একটা সিনেমা হয়েছে, আর সেটা দেখানো হচ্ছে। সিনেমাটা দেখে মেরজাদ, ফ্রিমন্ট আর বইটার কথা খুব মনে পড়ছিল। তাই আবার এক কপি কিনে এনেছি।
আরো কয়েক মাস ছিলাম ওখানে। মেরজাদের সঙ্গে দেখা হতো প্রায় প্রতি সপ্তাহে। কথা হতো। ওর প্রিয় আফগানি গান শুনিয়েছে আমায়। তাল এবং সুর আমাদের দেশের সঙ্গে বেশ মেলে। ও হিন্দি সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসে। এবং সিনেমার কল্যানে ভাঙা ভাঙা বলতেও পারে। এদেশে আছে প্রায় ১৪ বছর। গ্রীন কার্ড পেয়ে গেছে। এই ১৪ বছরে ক্যালিফোর্নিয়া মাথায় রাখুন, ফ্রিমন্টের বাইরে গেছে বলতে সুধু আশেপাশে দু একটা শহরে, তাও ট্যাক্সি তে ভাড়া নিয়ে। একলা থাকে। আর কেঊ নেই ওর। দেশেও কেউ নেই। কি জানি কেন। বাড়ির কথা উঠলেই ও এড়িয়ে যেতে চাইত। তাই আমি দু এক বারের পর আর বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করিনি ওকে। ওর সঙ্গে একটা ক্যাফে তে বসে দেদার আড্ডা দিয়েছি। গল্প শুনেছি আফগানিস্থানের। ওর কাছে ‘দেশে বিদেশে’র গল্প করেছি। মুজতবা আলীর করা ‘গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, গোঁফ দিয়ে যায় চেনা’ র ফার্সি অনুবাদ ‘মনে বরুৎ, তনে বরুৎ, বরুৎ সনাক্তদার’ শুনে ও হেসে কুটোপাটি হয়েছে। মেরজাদের কাছেই শুনেছি, আফগানি নান বলে আমরা দেশে যে বস্তুটি খাই, সেটা তামাম আফগানিস্থানে কেউ চেনে না। ও খেতে ভালোবাসে ভাত আর রাজমার তরকারি। বেশিরভাগ আফগানই নাকি এই খেয়েই দিন কাটায়। আমরা যে হিং ব্যবহার করি, আর সেটার সিংহভাগ আফগানিস্থান থেকেই আসে, সেটা বলতে বলল, আফগানিস্থানে কেউ হিং খায়না, ওটা পুরোটাই রফতানি হয়। কথা বলতে গিয়ে দেখেছিলুম, আমেরিকায় থাকাটা ওর একেবারেই পছন্দের নয়। বলত এখানে কোন জীবন নেই। কিন্তু ওর কোন উপায় নেই, এখানেই থাকতে হবে, এখানেই মরতে হবে ওকে। আমি ওকে আমাদের দেশের কথা বলতুম। আমাদের বাড়ির কথা। আমার মেয়ের কথা। মেয়ের ছবি দেখাতুম ওকে। বলতো তুমি খুব ভাগ্যবান যে এমন মেয়ের বাবা হতে পেরেছ। যেরকম আর সবাই বলে।
এই ভাবে আমার ফেরার দিন এগিয়ে এলো। মেরজাদ এসে গেল যথা সময়ে। আমাকে এয়ারপোর্টে ওই নিয়ে যাবে। গাড়িতে ঊঠে দেখলুম গম্ভীর হয়ে আছে। আমি দু একটা কথা বলার চেষ্টা করলুম। হূঁ – হ্যাঁ করে উত্তর দিল। এয়ারপোর্টে নেমে মালপত্র নামিয়ে ওকে ভাড়া দিতে গেলুম। ভাড়া উঠেছিল ৫৫ ডলার। টাকাটা বের করতে যেতেই আমার হাত চেপে ধরল। কিছুতেই নিতে চায় না। আমি পড়লুম মহা মুশকিলে। এতগুলো টাকা। না নিলে অস্বস্তি হবেই। হঠাৎ গাড়ির ভেতর থেকে একটা প্যাকেট বের করে আমার হাতে দিলো। বলল এটা তোমার মেয়ের জন্য। একটা জামা আছে। ওকে দিও। ওর মুখচোখের অবস্থা দেখে দেখে ভালো লাগছিলো না।
- তোমাকে আমার বাড়ির কথা কিছু বলিনি কোন দিন। তুমি বলতে দেশে ফিরে যেতে। কোথায় ফিরবো? ও দেশ আমার কাছে মৃত। আমার বাড়ির সবাই, বাবা, মা, স্ত্রি আর আমার মেয়ে, আমার পাঁচ বছরের ছোট্ট আফসান শেষ হয়ে গেছে। বেঁচে নেই কেউ। যুদ্ধ সবাইকে শেষ করেছে। আমার কোথাও যাবার নেই। অথচ এইখানে, এরা আমাকে দেখে ভাবে তালিবান। সন্ত্রাসবাদী। আজ আমার চেয়ে ভালো কে জানে যে যুদ্ধ আর সন্ত্রাসবাদ কি জিনিষ? সব হারিয়েছি আমি যুদ্ধে।
কোন উত্তর দিতে পারিনি। কোন উত্তর ছিলোনা আমার কাছে। হয়ত আমাদের অনেকের কাছেই নেই। মেরজাদ চলে গেল তখনই। ওখানে বেশিক্ষন দাঁড়ানো যায় না।
কাবুলিওয়ালা রহমত, বহু বছর পর দেশে ফিরে গিয়েছিল, মেয়ের কাছে। দেশে বিদেশের আবদূর রহমান ও ফিরে গিয়েছিল পানশীরে তার বাড়িতে। কিন্তু মেরজাদ ফিরবেনা। ওর ফেরার কোনো জায়গা নেই। দেশে ফেরার পথে প্লেনে বসে এই কথাটাই শুধু ভাবছিলুম।
- সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়
- সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়
ki likhbo!!... chotto kore golay kichu atkey gelo hotath .... baeerey jholmoley rod r aloy bhasa akaashey ki baruder gondho thaktey pare??!!
উত্তরমুছুনpare
Lekha ta pore chokhe jol ese gelo..Somnath Da.Prothom dik ta nije ke hariye felechilam US ey.. kintu climax e giye ja ending dile..sotti speechless..
উত্তরমুছুনসত্যি-ই যুদ্ধ কি করতে পারে, হয়ত জানা আছে, কিন্তু বুঝেছি বললে হিপোক্রিসি হয়ে যাবে। যারা হারিয়েছে, তারাই জানে শুধু।
উত্তরমুছুনতবে, মেরজাদের মত লোকেরা, যাদের ফেরার আর কোন জায়গা নেই, তাদের ব্যাপারটা হয়ত কিছুটা বুঝি। কারুর সত্যি-ই কেউ থাকে না ফেরার মত, কারুর থেকেও থাকে না - যন্ত্রণাটা একই বোধহয়।